কবে থেকে শুরু ?
বাড়িটার নাম ‘প্রাণ বাগিচা’। এবাড়ি থেকেই বেরুত ‘চেতনা’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সেই 1401 বঙ্গাব্দ থেকে। তখন অবশ্য আমি ছিলাম না এবাড়িতে। আমার আগমন তার বেশকিছু পরে। তখনও বেরুচ্ছে ‘চেতনা’। সাহিত্যের আঙিনায় এসে আমিও যেন কেমন করে সাহিত্য চর্চার একজন হয়ে উঠলাম। ‘চেতনা’র সম্পাদনায় নিজেরই অজান্তে সহযোগী হয়ে গেলাম। ‘চেতনা’র পাশাপাশি বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেতে থাকল আমারও লেখা। এমনি করে চলতে থাকে সময়, কাটতে থাকে দিন। তারপরই ঘটে গেল সেই বিপ্লব। জল জমতে জমতে যেমন বরফ হয়, তেমনই মনের গভীরে দিনে-দিনে লালিত হওয়া একধরণের ছেলেমানুষির প্রকাশ ঘটে গেল, ছোটোবন্ধুদের জন্য একটি পত্রিকা করার ইচ্ছে।
চারাগাছ যদি ঠিক-ঠিক জল-আলো পায়, আর পায় উর্বর মাটি, তবে তো সে বেড়ে উঠবেই! আমার ছেলেমানুষি ইচ্ছেটাও রূপ পেল বাস্তবে। মাত্রই অল্প ক’দিনের ব্যবধানে তার প্রকাশ ঘটল। অনেক ভাবনা-চিন্তা, কাটা-ছেঁড়া, ঝাড়াই-বাছাইয়ের পর ঠিক হল নামকরণ। ‘ছেলেবেলা’।
চিরকালের ছেলেবেলা পত্রিকার জন্মঃ
দিনটা ছিল আমাদের ঠাকুর পুজোর দিন, মানে ২৫শে বৈশাখ, মানে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। ১৪১৫-র ওই দিনটা (এপ্রিল ২০০৮) থেকেই পথ চলা শুরু করল ‘ছেলেবেলা’। ত্রৈমাসিক প্রকাশকাল হিসেবে প্রকাশ হতে থাকল নিয়মিত। সাড়াও পেতে থাকলাম ছোটোবন্ধুদের। বড়োদের প্রশ্রয়ে আমাদের পথচলার গতি বাড়তে থাকল ক্রমশঃ। প্রথম দুটি সংখ্যা ১৬ পাতার হলেও তৃতীয় সংখ্যা থেকে তা হয়ে গেল ৩২ পাতার। প্রথম থেকেই হাতে-হাতে বিক্রির পরিবর্তে ‘ছেলেবেলা’ পাঠকের কাছে পৌঁছয় বিভিন্ন পত্রিকা স্টল এবং বইয়ের দোকান থেকে।
আমাদের লক্ষ্যঃ
প্রথম থেকেই ‘ছোটোদের জন্য যা ভালো, যাকিছু ভালো’ ‘ছেলেবেলা’ আছে তার সঙ্গেই -এই ভাবনায় প্রতিটি বিভাগের নামকরণ, লেখা নির্বাচন, অলংকরণ, প্রচ্ছদ এবং পাতা সাজানোতে আমরা গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। পারিনি শুধু পাতার কাগজের মান (ছোটোদের উপযুক্ত) বজায় রাখতে সবসময়। অবশ্যই তা আর্থিক কারণে। যত বেশি পাঠাকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় সেক্ষেত্রেও আমরা সর্বদাই সচেষ্ট থেকেছি। আড়াই বছরে দশটি সংখ্যা প্রকাশের পর আমাদের আদরের-ভালোবাসার ‘ছেলেবেলা’ ভারত সরকারের নিবন্ধীকৃত আর.এন.আই পেল ‘চিরকালের ছেলেবেলা’ নামে।
ত্রৈমাসিক থেকে মাসিকঃ
শুরু হল নতুন করে পথ চলা। এবার আর ত্রৈমাসিক নয়, প্রতি মাসেই প্রকাশ হতে থাকল ‘চিরকালের ছেলেবেলা’। দক্ষিণ কলকাতার পত্রিকা স্টল আর বইয়ের দোকান ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকল- শহর থেকে শহরতলি, মফস্বল থেকে জেলায় জেলায়, পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্রই।
বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের বরেণ্য লেখক-লেখিকাদের পাশাপাশি বহু অখ্যাত গুণি লেখক-লেখিকাদের লেখায় প্রায় প্রতিটি সংখ্যাই সমৃদ্ধ হয়েছে ‘ছেলেবেলা’ ও ‘চিরকালের ছেলেবেলা’। কলম ধরেছে, তুলির আঁচড় কেটেছে কচি কাঁচারাও।
পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি ২০১২ থেকে ২০১৪ পরপর তিনবছর ‘চিরকালের ছেলেবেলা’ একযোগে কলকাতা, হাওড়া ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় শতাধিক বিদ্যালয়ে ‘সরস্বতী পুজো পরিক্রমা ও সম্মান’ করেছে সফলতার সঙ্গে।
সংগ্রামঃ
হাঁটলেই হোঁচট লাগে। আমাদের অভাবনীয় দ্রুত পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধিই কাল হল। সামলাতে পারলাম না নিজেদের। পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না আমাদের। পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পত্রিকার কপির সংখ্যা বাড়াতে না পেরে বাধ্য হলাম থেমে যেতে। অনভিজ্ঞ আমরা সেই প্রথম বুঝতে পারলাম কথাটা। পত্রিকা শুধু ভালোবাসা আর আবেগের নয়, পত্রিকা ব্যবসারও। আমরা ব্যবসাতে হেরে গেলাম।
ভালোবাসা আর আবেগ তো কখনও হার মানে না, ধিকি-ধিকি জ্বলতেই থাকে। একটু সুযোগ পেলেই, একটু বাতাস লাগলেই সেই নিভু-নিভু আগুনই আবার জ্বলে ওঠে। অনেক কান্না বুকে নিয়ে চার-চারটে বছর কাটল আমাদের। আর যে থাকা যাচ্ছে না এমনি করে। যে করেই হোক আবার ফিরতে হবে ময়দানে। আবার আগের মতো রঙিন হয়ে উঠবে চারিদিক! এই আশায় নতুন করে আবারও শুরু হল পত্রিকা প্রকাশ।
২০১৯-এর জানুয়ারি। হৈ-হৈ করে বেরুল আবার ‘চিরকালের ছেলেবেলা’। এবার রঙিন। আরো পাতা বাড়িয়ে। ছন্দে ফিরতে না ফিরতেই ২০২০-র মার্চে এল ‘কোভিড’ ঝড়, আবারও আমাদের থামতে বাধ্য করল।
পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হলেও আমরা থেমে থাকতে পারলাম না। ডিজিটাল মাধ্যমকে সঙ্গী করে আমরা শুরু করলাম ছোটোদের জন্য, ছোটো-বড়ো সকলকে নিয়ে প্রাত্যহিক বৈকালিক অনুষ্ঠান। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতে তা সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে পরিবর্তন করা হয়।
আর ২০২১ এর এপ্রিলে অর্থাৎ ১৪২৮ সালের ১লা বৈশাখে শুরু হলো আমাদের ওয়েবসাইট https://www.chirokalerchhelebela.com
আমরা প্রত্যাশা করি, অন্ধকার ঘুচে গিয়ে আলো ফুটবেই। পৃথিবী ফিরে পাবে আগের মতো সবকিছু। ভয়-ভীতি দূরে সরে গিয়ে প্রাণ পাবে আনন্দ। আমরাও ফিবর চেনা ছন্দে- ছেলেবেলায়, চিরকালের জন্য।
- দীপালি রায়
0 মন্তব্যসমূহ