অনেকদিন বাড়ীটা বন্ধ ছিল। সুস্মি সেদিন দেখল বাড়ীটা খোলা হয়েছে আর মিস্ত্রীরা রং চং করে মেরামত করছে। তাহলে এবার ওখানে লোকজন আসবে—মনে মনে ভাবলো সে। অনেকদিন থেকে বাড়ীটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সে ভেবেছে—যদি ওখানে কেউ বন্ধু-বান্ধব থাকতো, তাহলে কী যে ভালো লাগতো! কিন্তু সে আর হয়নি। তার চেয়ে তিন বছরের বড় দাদা রঞ্জন তাকেও হষ্টেলে চলে যেতে হলো—মা বলেন বাবার বদলীর চাকরী বলে তাদের নাকি পড়াশুনোর দুর্গতি হয়। দাদা যতদিন বাড়ীতে ছিল—বেশ ভাল লাগতো। দাদার সঙ্গে ঝগড়া হতো না এমন নয়, তবু দাদার সঙ্গে ভাবও কম ছিল না। দাদার কেবল ঐ একটা দোষ, কেবল বলবে— মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা সব বিষয়ে বড়। মেয়েরা আসলে যত বড়াই করে তা কিছু নয়। আর এই নিয়েই তো সুস্মির সঙ্গে ঝগড়া বাধে—আরো যখন ছোট ছিল, তখন তো মারামারি বেধে যেতো— শেষকালে সুস্মি বাবার কাছে গিয়ে নালিশ জানাতো আর রঞ্জন বলতো, সেই তো হেরে গেলে আর নালিশ করতে বাবার কাছে ছুটতে হলো—বাবা হচ্ছেন ছেলে–সে কথা কি মনে আছে?
বাবা অবিশ্যি আদর করে ভুলিয়ে দিতেন আর বলতেন, রঞ্জন কিছু জানে না সুস্মি, মেয়েরা কম কিসে? ওসব কথা এখন আর চলবে না। রকেট করে সারা পৃথিবী পরিক্রম করে এসেছে মেয়ে, মেয়েরা এখন ছেলেদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। আর প্লেন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন মহিলা পাইলট তোমাদের দূর্বাদি। তাঁর সব কথা তোমাদের কাছে শুনি আর কত হিসেব দেবো বল? সব তাতেই এখন মেয়েদের অগ্রগতি—কাজেই মিছে দাদার সঙ্গে ঝগড়া করে লাভ কি?
বাবার কথা সত্যি। কিন্তু দাদা হেরে যাক সেটাও তো সুস্মির ভালো লাগে না, তাই মাঝামাঝি রফা হয় প্রায় সময়। কিন্তু দাদা হষ্টেলে চলে গেল—এটা একেবারে সইতে পাচ্ছে না সে। 'দাদা তুমি কবে আসবে' একথা প্রত্যেক চিঠিতে লেখে সুস্মি—আর গরমের ছুটি, পূজোর ছুটি, বড়দিনের ছুটির জন্য বসে বসে দিন গোনে।
দাদা না থাকার জন্যই তার বড্ড একা লাগে। তাদের বাংলো এমনই যে কাছাকাছি কাউকে পাবার উপায় নেই। বাড়ীটার দিকে তাকিয়ে সুস্মি মনে মনে কত প্রার্থনা করেছে, তার মত ছোট কেউ যেন আসে ও বাড়ীতে। বাড়ীটায় মিস্ত্রীর কাজ দেখে আজ সুস্মির আনন্দের সীমা নেই!
আচ্ছা মা, বলোতো ওদের বাড়ীতে ক'টা ছেলেমেয়ে আসবে?
-আমি কি করে জানব বল? - মা উত্তর দেন।
-বলো না, আন্দাজেই বল; আমার মত একজন আর দাদার মত একজন হলে বেশ হয়—না?
মা হেসে বলেন: “বেশ তো তাই আসুক না!''
—হ্যাঁ, তাই আসুক। আচ্ছা মা, দাদা কবে আসবে বলো তো? ক'দিন চিঠি আসেনি?
—দাদা আসবে এই পুজোর ছুটিতে—চিঠি তো ও লেখে ঠিক নিয়ম করে। ‘বেশী মন-কেমন করছে' একথা দাদাকে জানাতে পারে না।
কথা না বাড়িয়ে সুস্মি ঐ পাশের বাড়ীটার দিকে চেয়ে থাকে আর মনে মনে ভাবে তার মত, যেন একটা মেয়ে থাকে, এছাড়াও যদি দাদার মত একটা ছেলে থাকে বেশ হয়।
রোজ সকালে উঠে সুস্মি দেখে বাড়ীটার কাজ কতদূর এগোলো।
মাঝে মাঝে ভাবে বড্ড আস্তে আস্তে কাজ করে লোকগুলো। এক-দিন তো ডেকেই ফেল্লে: মিস্ত্রী ও মিস্ত্রী, তোমরা এত ধীরে ধীরে কাজ কর কেন গো?
–কি বলছো খুকী? বুড়ো সর্দার মিস্ত্রী জিজ্ঞাসা করে।
মা ভিতর থেকে বলেন: কি হচ্ছে সুস্মি? ওরা রাগ করবে না। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে সুস্মি ঢোক গিলে বলে: এই যে বলছিলুম, তোমাদের বুঝি এখনও অনেক কাজ বাকী?
—তা এখনও চলবে। বাড়ীটা অনেক দিন বন্ধ ছিল কিনা।
-এটা কাদের বাড়ী, কতগুলি ছোট ছেলেমেয়ে আছে গো মিস্ত্রী?
বুড়ো মিস্ত্রী হেসে বলে: বাড়ী তো চক্রবর্তী বাবুদের, কত ছেলেমেয়ে আছে তা তো জানি না খুকী।
—এই আমার মত আছে একটাও, কিংবা দাদার মত?
—আমি ঠিক বলতে পারবো না খুকী দিদি।
–আমি খুকী দিদি নই, আমি হলাম সুস্মি।
বুড়ো মিস্ত্রী আবার হেসে বলে: তা হবে।
শেষে একদিন বাড়ীর কাজ শেষ হলো, আর বাড়ীতে অনেক জিনিসপত্র আসতে লাগলো; আরো পরে এলেন বাড়ীর সকলে। সুস্মি অনেক চেষ্টা করে অনেকক্ষণ জানলায় দাঁড়িয়ে থেকে আবিষ্কার করলো বড়রা অনেকেই আছেন, কিন্তু ছোট একজনকেই সে এখন দেখতে পাচ্ছে? হাফ প্যান্ট আর সাদা হাফ সার্ট পরে তার মত একটি ছেলে সি'ড়ি দিয়ে ওঠা নামা করছে। তাহলে মেয়ে একজনও নেই তার মত? মনে মনে বল্লে সুস্মি আর ভাবলো, দাদার জিত হবে তাহলে। এই সব ভাবতে ভাবতে পাশের বাড়ীর জানালায় ছেলেটি এসে কখন দাঁড়িয়েছে দেখলো সুস্মি।
ছেলেটি বল্লে: তোমরা বুঝি এই বাড়ীতে থাকো?
সুম্মি খুশী হয়ে বল্লে: হ্যাঁ, তোমরা নতুন এলে? ক'জন ভাই-বোন?
—এই তো আমি, আমার নাম কাজল।
এসো না আমাদের বাড়ী।
ব্যস আর কি—দু'চার দিনের মধ্যে গলায় গলায় ভাব। সুস্মি কিন্তু একদিনও নতুন বাড়ীতে যায়নি, দাদা এলে তারপর যাবে। কিন্তু কাজলটা কি সুন্দর কথা বলে, কেমন মিষ্টি স্বভাব, আর কত ভালো—কিন্তু চুলগুলো মেয়েদের মত, তাহলেও বেশ দেখতে।
মাকে সেদিন সুস্মি বলল, দেখ মা—কাজলের চুলগুলো মেয়ের মত, রাত্তিরে আবার ওর মা রিবন দিয়ে বিনুনী করে দেন—অত চুল কেন মা?
মা উত্তর দিলেন: বোধহয় মানত আছে, কিন্তু ওর মুখটি কী সুন্দর—একেবারে মেয়ের মত।
ছুটি পড়লো—সুম্মির দিন গোনা শেষ করে রঞ্জন এসে পড়লো বাড়ীতে। খুব হইচই-এর মাঝখানে সুস্মি কাজলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল দাদার—এই ছুটির আগে কাজলদের স্কুলে sports হয়ে গেলো। তাতে কাজল প্রথম হয়েছে অনেক বিষয়ে, আর অনেকগুলি প্রাইজ এনেছে৷
রঞ্জন গম্ভীর হয়ে বল্লে: ছেলেরা হবেই, ও যদি মেয়ে হতো তাহলে হতো না।
—বাজে কথা বলে। না-শোনো না আর কিসে কিসে কত কি করেছে, ওর গুণের শেষ নেই!
—ছেলে বলেই হয়েছে।
কাজলের সঙ্গে ভাব হয়েছে বটে, আর তার গুণের কথা অনেক করে বলা হয় দাদার কাছে কিন্তু তবু সুম্মি, এখনও একদিনও ওদের বাড়ী যায়নি—কাজল মাঝে মাঝে আসে নাহলে জানলা দিয়ে কথা বলে।
রঞ্জন একদিন বল্লে: দেখ সুস্মি এবার এসে পর্যন্ত কাজলের গল্পই শুনছি, কত সে ভাল, কত সে বুদ্ধিমান—আর আমি যে বলি ছেলেরা সকলেই এমনি হবে, মেয়েরা হলে হতো না, তা এখন বিশ্বাস হচ্ছে কি?
-তা কেন বিশ্বাস হবে, মেয়েরা কি পারে না পারে তা কি জানো না? তাহলে বাবার কাছে চলো–বাবার লিষ্ট আছে জানো?
-বাবা তার মেয়েকে ভোলান।
-কখনও না, বাবা সত্যি কথা বলেন।
-মা থামিয়ে দিয়ে বলেন: সুস্মি, উপরে যাও, জানালায় দাঁড়িয়ে কাজল তোমায় ডাকছে, বলেছে একদিনও কেন তুমি যাচ্ছ না ওদের বাড়ী।
সুস্মি মার আঁচল ধরে বল্লে: কি বলবো মা?
-বলগে বিজয়ার দিন যাবো।
পূজোর ক'দিন খুব আনন্দে আনন্দে কেটেছে, কাজল আবার ছাতে উঠে ঘুড়ি উড়িয়েছে। চমৎকার লাট্টু ঘোরায় কাজল, ওর ঘরে বসে খেলা একটুও ভাল লাগে না। ছোট ছেলেরা যা খেলতে পারে কাজলের একটিও অজানা নেই।
দাদার কেবলই এক কথা; একসঙ্গে এতগুণ সে কেবল ছেলে বলেই সম্ভব, মেয়ে হলে শুধু পুতুল খেলতো—না হয় বোকা বোকা কথা কইতো।
সুস্মি খুব রেগে যায় –মাঝে মাঝে ঝগড়াও বাধে।
মা বলেন- ছেলে আর মেয়ে নিয়ে কী কাণ্ড তোমাদের, দিনরাত ঝগড়া কর কেন?
রঞ্জন হেসে বলে: মা তুমি কার দিকে?
সুস্মি চেঁচিয়ে বলে: আমার! আমার দিকে!
মা বলেন: আমি কারুর দিকে নই, নিরপেক্ষ! ছেলেরা অনেক কাজ করে যা মেয়েদের করা সুবিধা হয় না, তাহলেও মেয়েরা অনেক কিছু পারছে, যাতে ছেলেদের লজ্জা হয়—এই তো পরীক্ষার খবর বেরুলে কাদের নাম আজকাল আগে থাকছে? রিসার্চ করছে, ডক্টরেট হচ্ছে, দেশ-বিদেশে চলছে কৃতী হয়ে ফিরছে—এসব দেখলে মেয়েদের কৃতিত্ব কম কোথাও—বরং ছেলেদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাই ওসব নিয়ে তোমাদের ঝগড়া করা ঠিক নয়।
রঞ্জন হতাশ হয়ে বলে: মা তুমি যে কী বলো, দু'একটা মেয়ে কে কি করলো তাই নিয়ে বল্লে তো চলবে না, সাধারণভাবে বলো?
— আজকাল মেয়েরা ছেলেদের হারিয়ে দিচ্ছে সবটাতে তা তো দেখছি।
-মা, দেখছি খুব খবর রাখো! ছেলেদের কথা বলো না শুনি।
ঠোঁট উল্টিয়ে চোখ ঘুরিয়ে সুস্মি বল্লে: মা সব খবর রাখে— খবরের কাগজ মার মুখস্থ--জানো মশাই?
উপরের জানলা থেকে কাজল ডাকলো: সুম্মি, শোন এদিকে।
এক দৌড়ে উপরে গেল, আবার তখনি নীচে নেমে হাঁপাতে হাঁপাতে সুস্মি বল্লে: মাগো মা, কাজল গাছে উঠে এই এত্তো-
-গাছে উঠে? মা জিজ্ঞাসা করেন!
হ্যাঁ, ঐ যে শিউলী আর কৃষ্ণচূড়া ঐ তো দেখ না—এত ফুল পেড়েছে, আমায় নিতে বলছে।
– কাজল গাছে উঠতে পারে নাকি? হাত-পাঁ ভাঙ্গলে? মা বলেন।
সুস্মি তাড়াতাড়ি বলে উঠে: ওমা জানো না, ওর মা বলেন দস্যি মেয়ে!
রঞ্জন বলে উঠে: ভুল হলো সুস্মি–দস্যি ছেলে। মেয়ে হলে উঠতে পারতো না।
রাগ করে সুস্মি বলে: অত জানি না বাবা, ওর মা যা বলেন তাই বলছি। আমি যাই ডাকছে কাজল।
কাজল জানলায় দাঁড়িয়ে বলছে: আমার অনেক কাপড় জামা জুতো হয়েছে পূজোয় – তোমার?
—হ্যাঁ হ্যাঁ অনেক হয়েছে আমার-তেরোটা ফ্রক, সুন্দর, সুন্দর—মামার বাড়ী, মাসীর বাড়ী এখানে, বড়দিদু আর রাঙা মামা— আর দিদিভাই মানে আমার দিদিমা একটা শাড়ী দিয়েছেন—কিন্তু আমার একটাও পেটিকোট নেই, ব্লাউজ নেই, তাই ভাবনা হয়েছে।
আমারও অনেক হয়েছে প্যান্ট, সার্ট, ফ্রক, শাড়ী—কাজল মনে করবার চেষ্টা করলো।
সুস্মি হেসে বল্লে শাড়ী ফ্রকও পরবে? হি-হি —কেমন দেখাবে তোমায়? রাত্তিরে যখন চুল বাঁধো ঠিক মেয়ের মত-
কাজলের মা ডাকলেন মাষ্টার মশাই এসেছেন কাজল নেমে এসো। –একদিন এসো না আমাদের বাড়ী সুস্মি? কতদিন আমরা এসেছি, তুমি কেন আসো না? মাকে নিয়ে আজ এসো, কেমন? কাজলের মা বারে বারে বল্লেন জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে।
রঞ্জন বললে: সুস্মি বুঝি এতদিনেও যাওনি একবারও? মেয়েদের কাণ্ড কি রকম দেখো! অথচ কাজল কতবার এসেছে। তোমার যাওয়া উচিত তা একবারও ভাবনি৷
রঞ্জনের কথা শেষ হলো না—দেখা গেল কাজল তার মাকে নিয়ে এ বাড়ীতে ঢুকছে।
রঞ্জন সুস্মির দিকে তাকিয়ে বল্লে: ছেলে বলেই ওর এত বুদ্ধি।
সুস্মি মাকে ডেকে আনলো—বারান্দায় সাজানো চেয়ারে বসেই সকলে গল্প করতে লাগলেন।
কাজলের মা বল্লেন: কতদিন ভাবছি আসি, কিন্তু নতুন বাড়ীতে এসে গোছাতে গোছাতে সময় হয় না। আপনিও দিদি একবার যান না, তাই ভাবলাম এত ভাব ছোটদের মধ্যে আর আমরা কেউ কাউকে চিনি না এ ভালো না—তাই জোর করে চলে এলাম। কাজলের পড়া শেষ হলো বই নিয়ে উপরে উঠছিল, সবসুদ্ধ টেনে এনেছি।
সত্যিই তো ওর হাতে বই খাতা সবই রয়েছে।
সুস্মির মা বল্লেন: খুব খুশী হলাম ভাই, কালই আমি যাবো, সত্যি আমারই ভুল হয়ে গেছে। বাড়ীটা বেশ হয়েছে আপনার৷
কাজলের মা বললেন, আপনার বুঝি এই দুটি ছেলেমেয়ে? এদের কথা কাজল খুব বলে। আমার ভাই এই একটিই মেয়ে—এমন মেয়ে হয়েছে, ছোট থেকে একেবারে ঘোড়ায় চড়া ছেলের মত। আমার মা ওকে ছেলের মত সাজিয়ে রাখতেন। ওর হাবভাব কাজকর্ম খেলাধুলো সব ছেলের মত, দেখছেন? বিস্মিত হয়ে সুস্মির মা বল্লেন: কার কথা বলছেন, কাজলের?
এক মুখ হেসে কাজলের মা উত্তর দিলেন: হ্যাঁ আমারই মেয়ে ঐ একমাত্র সন্তান—কাজলের কথাই বলছি। দেখুন না সব ওর ছেলের মত। সবাই তো ভাবে ঐ প্যান্ট-সার্ট পরা দেখে ও বুঝি আমার ছেলে।
সুস্মি, রঞ্জন ও তাদের মা পরস্পর মুখের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকালেন। রঞ্জন স্তব্ধ হয়ে গেছে। মা কথা বলার চেষ্টা করতে লাগলেন—সুম্মি কি করবে ভেবে না পেয়ে কাজলের হাতের একটা বই নিয়ে খুলে দেখতে লাগলো—যার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা আছে: “কুমারী কাজল চক্রবর্তী”।
0 মন্তব্যসমূহ