এক বামুন আর বামনী। বামুন ভারী গরীব। ভিক্ষা করে বামুন যা পায়, দিন আর তাতে চলে না। দুজনে একদিন যদি কিছু খায় তো, তার পর তিনদিন উপোস করে কাটে। গাঁয়ে ভিক্ষাও রোজ মেলে না। বামুন-বামনী ভগবানকে ডাকে—বলে, আর কিছু চাই না ঠাকুর—শুধু একবেলা করে দুটি খেতে পাই যেন।
গরীবদের ডাক ভগবানের কানেও যায় না—বামুন আর বামনীর দুঃখও ঘোচে না।
দেশের রাজা এক মস্ত বাজার তৈরী করেছেন। রাজার ঢ্যাঁড়ায় ঘোষণা হলো দিকে দিকে এ বাজারে যারা জিনিষপত্তর বেচতে আসবে, দিনের শেষে কোনো জিনিষ বিক্রী না হয়ে যদি মজুত বাকি থাকে, তাহলে রাজার সরকার সে সব জিনিষ কিনে নেবে— কিনে রাজার ভাণ্ডারে তা জমা দেবে। তা যে-জিনিষই হোক—নোটে-পালং শাক থেকে হাতী-পর্য্যন্ত।
ঢ্যাঁড়া শুনে বামনী বামুনকে বললে—ডাঁটিশুদ্ধ কতকগুলো কলাপাতা জোগাড় করে আনো, আর সেই সঙ্গে মাটীর একটা বড় হাঁড়ি।
বামুন ঘুরে ঘুরে ডাঁটিশুদ্ধ ক’খানা কলাপাতা আর একটা মাটীর তিজেল হাঁড়ি নিয়ে এলো। বামনী তখন কলাপাতার ডাঁটিগুলো নিয়ে কুচি কুচি করে কাটলো—কেটে সেই তিজেল হাঁড়িতে ভরে হাঁড়ির মুখ কলাপাতা দিয়ে মুড়ে কলার ছেটো দিয়ে মজবুত করে বাঁধলো—বেঁধে বামুনকে বললে—এই হাঁড়ি নিয়ে গিয়ে বসো! কেউ যদি বলে—কি বেচতে এসেছো? তাহলে বলবে আমাদের যত দুঃখ-দুর্দশা বেচতে এনেছি। যদি বলে, কত দাম? তা বলো এক হাজার টাকা—তার এক পয়সা কম দিলে চলবে না।
হাঁড়ি নিয়ে বামুন এসে বাজারে বসলো। বাজারে কত খদ্দের এসেছে, কত জিনিষ কিনছে। বামুনকে দেখে তারা বললে– তোমার হাঁড়িতে কি আছে গো? কি এনেছো বেচতে? বামুন বলে– আমার হাঁড়িতে আছে আমাদের যত দুঃখ-দুর্দশা— নেবে? এক হাজার টাকা দাম!
শুনে খদ্দেররা শিউরে সরে যায়, বলে—দুঃখ-দুর্দশা আবার নতুন করে কে কিনবে? একেই নিজের নিজের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে জ্বলে-পুড়ে মরছি—তার উপর আবার নতুন করে পরের দুঃখ-দুর্দশা কেনা!
হাঁড়ি নিয়ে বামুন সারাদিন বসে রইলো—কেউ তার দুঃখ-দুর্দশা কিনলো না।
দিনের শেষে বাজার ভাঙছে— দোকান পশারীর দল টাকা গুণে গেঁজেয় ভরে যে যার বাড়ী ফিরছে—রাজার সরকার এলো তার পাইক পেয়াদা নিয়ে—কার কি জিনিষ বিক্রী হলো না, রাজার তরফ থেকে কিনে রাজার ভাণ্ডারে জমা পাঠাবে—
বামুনকে দেখে সরকার বললে—কি ঠাকুর—তোমার হাঁড়িতে কি আছে—বিক্রী হলো না?
বামুন বললে—আমার হাঁড়িতে আছে আমাদের যত দুঃখ-দুর্দশা— রাজার বাজারে বেচতে এসেছি—তা কেউ কিনলো না৷
শুনে সরকার বললে—দুঃখ-দুর্দশা কি কেউ সখ করে কেনে ঠাকুর যে তুমি এসেছো তাই বিক্রী করতে।
বামুন বললে—আজ্ঞে, এ ছাড়া আমাদের এমন কিছু তো নেই যা বিক্রয় করে দু-পয়সা পাবো! তা বিক্রা হলো না যখন—কথাটা বামুন শেষ করলো না...সরকার বুঝলো।
রাজার ঢ্যাঁড়া দেওয়া আছে, যার যে জিনিষ বিক্রী হবে না রাজা তা দাম দিয়ে কিনবেন। আর এ বাজারে তাই হয়ে আসছে রোজ। তা বলে দুঃখ-দুর্দশা কেনা? তাই তো।
সরকার বললে—তুমি বসো ঠাকুর—তোমার দুঃখ-দুর্দশা বিক্রী হলো না—মহারাজের হয়ে দাম দিয়ে এ জিনিষ কেনা—এমন জিনিষ বিক্রীর কথা কখনো শোনা যায়নি তো—তা মহারাজকে একবার কথাটা বলি গিয়ে...
সরকার এলো ঘোড়ায় চড়ে, রাজার কাছে, এসে রাজাকে বললে, বামুনের কথা।
শুনে রাজা বললেন—তা হোক—আমি যখন কথা দিয়েছি— বাজারে বেচতে এসে যার যে জিনিষ বিক্রী হবে না—পড়ে থাকবে, আমি সে জিনিষ দাম দিয়ে কিনবো —তখন আমার সে কথার নড়চড় হতে পারে না। বামুন যখন তার দুঃখ-দুর্দশা বেচতে এনে বেচতে পারেনি, তখন ওর ও দুঃখ-দুর্দশা কিনতেই হবে। না হলে সত্যভঙ্গের পাপ হবে। তুমি যাও, দাম দিয়ে ওর দুঃখ-দুর্দশা কিনে নিয়ে এসো। সরকার ফিরলো বাজারে—ফিরে বামুনকে বললে—বেশ, মহারাজা কিনবেন তোমার এ দুঃখ-দুর্দশা। তা এর জন্য দাম দিতে হবে কত? বামুন বললে—এক হাজার টাকা। তার এক পয়সা কম হলে চলবে না।
এক হাজার! শুনে সরকারের চোখ যেন ঠিকরে পড়লো। সরকার বললে—একে তো দুঃখ-দুর্দশা কেনা—তার জন্য দাম দিতে হবে এক-হাজার টাকা। তুমি পাগল হয়েছো, ঠাকুর...
বামুন বললে—হুঁ—না মশাই, পাগল আমি নই। এর দাম দিতে হবে এক হাজার-টাকা।
মুস্কিল তো। সরকার আবার এলো রাজার কাছে—এসে হাত-যোড় করে বললে—দুঃখ-দুর্দশার জন্য বামুন দাম চায় মহারাজ—এক-হাজার টাকা।
শুনে রাজা বললেন—যে দাম চায়, তাই দেবে। না হলে সত্য-ভঙ্গের পাপ হবে।
সরকার আবার এলো বাজারে। এসে বামুনকে এক হাজার টাকা দাম দিলে—দিয়ে বামুনের হাঁড়ি নিয়ে রাজপুরীতে ফিরলো—রাজা বললেন—ভাণ্ডারীকে হাঁড়ি দাও—ভাণ্ডারে যেমন সব জিনিষ জমা থাকে, তেমনি এ হাঁড়ি জমা থাকবে।
এরপর একদিন যায়— দুদিন যায় — তিনদিনের দিন, তখন অনেক রাত—পুরী নিঝুম নিস্তব্ধ—সকলে ঘুমোচ্ছে—রাজার কিছুতে আর ঘুম হয় না। মাথা দপদপ করছে—
বিছানা ছেড়ে রাজা এলেন ঘরের বাহিরে যে বড় বারান্দা, সেই বারান্দায়। আকাশে এক-ফালি চাঁদ... চাঁদের জ্যোৎস্না পড়েছে চারিদিকে—সে জ্যোৎস্নায় রাজা দেখেন—পুরী থেকে একটি মেয়ে— পরণে ঝক্ঝক্ জড়ির শাড়ী—গায়ে গহনা, মুখে মস্ত ঘোমটা—মেয়েটি পা টিপে টিপে চলেছে পুরীর দেউড়ীর দিকে! কে? কে ঐ মেয়ে? রাজা বেশ চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—কে? কে তুমি? মেয়েটি সাড়া দিলে না—ফিরেও তাকালো না—যেমন যাচ্ছিল তেমনি চলেছে।
রাজা তখন প্রায় ছুটে নীচে নেমে এলেন...মেয়েটি তখন দেউড়ির সামনে—রাজা এসে বললেন—কে তুমি?
মেয়েটি দাঁড়ালো... বললে — আমি এ পুরীর লক্ষ্মী! বললেন—এত রাত্রে পুরী ত্যাগ করে কোথায় চলেছেন মা লক্ষ্মী?
মা-লক্ষ্মী বললেন—পুরীতে আর কি করে থাকি বলো? তুমি কার দুঃখ-দুর্দশা কিনে পুরীতে এনেছো — যেখানে দুঃখ-দুর্দশা সেখানে আমি থাকি না—থাকতে পারি না তো।
রাজা বললেন—কিন্তু আমি সত্য রক্ষা করেছি, মা লক্ষ্মী। কথা দিয়েছি, বাজারে যারা জিনিষ বিক্রী করতে আসবে, তাদের সে জিনিস যা বিক্রী হবে না আমি সে জিনিস দাম দিয়ে কিনবো —তা যে জিনিসই হোক৷ কাজেই আমি বামুনের দুঃখ দুর্দ্দশা কিনে সে কথা রক্ষা করেছি,
–ও জিনিষ না কিনলে আমার সত্যভঙ্গের পাপ হতো। এ জিনিষ কিনে আমি কোনো পাপ করিনি যখন —তখন আপনি কি বলে আমার পুরী ত্যাগ করে যাবেন?
মা-লক্ষ্মী বললেন—তবু যেতে হবে, মহারাজ। কেন না দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে লক্ষ্মী এক পুরীতে কখনো থাকে না। কাজেই আমায় যেতে হবে মহারাজ।
রাজা বললেন—বিনা-পাপেও আমাকে যদি ত্যাগ করে যান—কি করবো, উপায় নেই। তা বলে সত্যভঙ্গ করবো না আমি।
মা-লক্ষ্মী চলে গেলেন। রাজা শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেললেন, মা-লক্ষ্মীকে আর কোন কথা তিনি বললেন না।
পরের দিন রাত্রেও রাজার ঘুম হচ্ছে না... রাজা এসে বারান্দায় দাঁড়ালেন। দাঁড়াতেই দেখেন, সুন্দর সুপুরুষ এক ব্রাহ্মণ পুরী থেকে চলছেন দেউড়ির দিকে! রাজা নেমে এসে তাঁকে বললেন— আপনি কে?
ব্রাহ্মণ বললেন – আমি হলুম ধৰ্ম্ম।
রাজা বললেন—এত রাত্রে পুরী ত্যাগ করে কোথায় চলেছেন?
ধৰ্ম্ম বললেন—এ পুৱী আমি ত্যাগ করে যাচ্ছি। লক্ষ্মী যে জায়গা ছেড়ে যান—আমিও সেই জায়গায় থাকি না। লক্ষ্মী যেখানে গেছেন, আমিও সেই জায়গায় যাচ্ছি।
রাজা বললেন— কিন্তু আমার অপরাধ? আমি পাপ করিনি, অধর্ম্ম করিনি, আপনি কি বলে ত্যাগ করে যাবেন?
ধর্ম্ম চট করে একথার জবাব দিতে পারলেন না— ভাবতে লাগলেন।
রাজা বললেন-বুঝেছি, আমি ঐ বামুনের দুঃখ-দুর্দশা কিনে পুরীতে এনেছি, তাই আপনি চলে যাচ্ছেন। কিন্তু ও দুঃখ-দুর্দশা কিনে আমি সত্যরক্ষা করেছি—আপনারই মান রেখেছি। আমি যদি না কিনতুম, তাহলে আপনার অপমান করতুম—আমার অধর্ম্ম হতো। এর জন্য আপনি আমাকে কিছুতেই ত্যাগ করে যেতে পারেন না—যদি যান, আপনি তাহলে ধর্ম্ম হয়ে অধর্ম্ম করবেন!
ধর্ম্ম বললেন—রাজা ঠিক বলেছেন! তিনি খুশী হলেন, বললেন—তুমি ঠিক কথা বলেছো, মহারাজ—আমি এ পুরী ত্যাগ করে গেলে আমার মহা-অধর্ম্ম হতো। ত্রিভুবনে কেউ তাহলে আর ধর্ম্মকে মানতো না। তুমি আমাকে খুব রক্ষা করেছো। আমি এ পুরী ত্যাগ করে যাবো না।
এ-কথা বলে ধৰ্ম্ম দেউড়ি থেকে ফিরে পুরীতে ঢুকলেন, রাজা চুপ করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে পুরীতে ফিরবেন হঠাৎ পিছনে পায়ের শব্দ শুনলেন। ফিরে তিনি দেখেন, মা-লক্ষ্মী পুরীর দেউড়িতে। রাজা বললেন—মা-লক্ষ্মী! আপনি ফিরে এলেন।
মা-লক্ষ্মী বললেন—হ্যাঁ মহারাজ। আমাকে ফিরতে হলো, কেন না, ধৰ্ম্ম যেখানে থাকেন, সেখানে আমাকে থাকতে হবে। ধৰ্ম্মকে যে মানে, সে কখনো লক্ষ্মীছাড়া হতে পারে না। যেখানে ধৰ্ম্ম, সেইখানেই লক্ষ্মী! আমার ভুল হয়েছিল মহারাজ, তাই চলে গিয়েছিলুম। পরের দুঃখ-দুর্দশার ভার যে নিতে পারে তার মতো ধার্ম্মিক আর কেউ নেই। তুমি যতদিন ধৰ্ম্মকে এমনি মেনে চলবে—তোমার পুরী থেকে আমার যাওয়ার সাধ্য থাকবে না—কখনো আমি এ পুরী ত্যাগ করে যেতে পারবো না।
এর পর থেকে রাজার সুখ আর ঐশ্বর্য্য দিনে দিনে বাড়তে লাগলো—রাজার পুণ্যধর্মে রাজ্যে প্রজাদেরও আর কোন দুঃখ-দুর্দশা রইলো না।
0 মন্তব্যসমূহ