Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

কাঠপুতলি ।। লীলা মজুমদার

 

ছোটবেলায় মাঝে মাঝে পুরী যেতাম। সমুদ্রের ধারে থাকতাম, দেখতাম ভোরে যে-সব নৌকো সমুদ্রে মাছ ধরতে বেরত, বেলা বারোটার পর তারা ফিরত! ফিরেই নৌকো টেনে বালির উপর তুলে, জাল নামিয়ে উপড় করে ফেলত। অমনি ঢিপি হয়ে পড়ত চেনা-অচেনা কত রকম মাছ। কতকগুলো ঠিক মাছ ও নয়, সমদ্রের গুগলী আর মাছ শামুক এই সব। মাটিতে পড়ে সেগুলো চিকচিক কিলবিল করত আর আমরা অমনি দেখতে ছুটতাম। বড়রা চ্যাঁচামেচি করতেন, “এই সমুদ্রে চান করে এস। রান্না হয়ে গেছে, এক্ষুনি খাবার দেবে, আবার ঐ দেখ সব রোদ্দূরে মাছ দেখতে ছুটল।তা কে কার কথা শোনে।

অদ্ভুত সব মাছ : শুঁড়-ওয়ালা গোল মাছ, দাঁড়-ওয়ালা করাত-মাছ, তেলচুককে সার্ডিন মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া এই সব মাছ বাজারে বিক্রি হত। এ ছাড়াও ধরা পড়ত ছোট ছোট হাঙরের বাচ্চা, তাদের নিচের মাড়িতে দুসারি করে দাঁত। ছোট ছোট অক্টোপাস,, আটটা ঠ্যাং মেলে কিলবিল করত। এ-সব ওরা আলাদা করে রাখত।

সমুদ্রের পাড়ি যেখানে খুব উঁচু, সেখানে জেলেদের ঘর। তালের পাতা দিয়ে বোনা গোল গোল ঘর। ঘরের বাইরে ছোট একটা পাথরের কিংবা ইটের ঢিবি তার ওপর রাতে ওরা আলো দিত। এক থুরথুরে বড়ো জেলে এসে রোজ দাঁড়াত। তাকে সবাই উনো বলে ডাকত।

তাকে আমরা অনেক কথা জিজ্ঞাসা করতাম। রাতে তেল পুড়িয়ে আলো জ্বাল কেন তোমরা?"

উনো অবাক হয়ে বলত, “না জ্বাললে দেওরা পথ চিনে আমাদের বাড়িতে কি করে আসবে? ভূতেরা পালাবে কেন? আর দূর থেকে আমাদের ফেরি-করা ছেলেরা নিশানা পাবে কোথায়?"

হাঙর অক্টোপাস দেখিয়ে বলতাম, “ওগুলো কে খায়? কেনে?”

আমরা খাই। ও কি খারাপ জিনিস নাকি? নাক সিঁটকাচ্ছ কেন? খারাপ হলে আর থোমা গরুর চ্যালারা খেত না।

আমরা তো অবাক! থোমাদের চ্যালারা আবার কে? বুড়ো তার কোঁচড় থেকে ছোট্ট একটা পাতুল বের করে দেখাল। একটা দশ বারো বছরের ছেলের মতো, কাঁধ অবধি চুল গায়ে জামাপরা, মুখটা হাসি-হাসি। চোখ দুটো বন্ধ, হাত দুটো মাথার ওপর তোলা। প্রথমে মনে হল পাথরের তৈরি। বুড়ো বলল, “ভালো করে দেখ।" তখন দেখলাম কাঠের তৈরি, কাঠের আঁশ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু পাথরের মত শক্ত। উনো বলল, "ওনার নাম খ্রিষ্ট।"

আমরা বললাম, “খ্রিষ্ট আবার কি? কেষ্ট বল।

উনো রেগে বলল, “আমাদের দেবতারা আলাদা। ও কেষ্ট নয়।" আমরা বললাম, “তাহলে নিশ্চয় যীশুখৃষ্ট।"

উনো পুতলিটাকে আবার ট্যাঁকে গুঁজে বলল, "আমি আমার হাঙর মাছ নিয়ে চললাম। তোমাদের কিছু বলব না।

আমরা ওকে ধরে পড়লাম। না, না, উনো, বলতেই হবে। ওকে কোথায় পেলে? বললে তোমাকে শার্ট দেব।"

এখন তোমাদের ভাত খাবার সময় হয়েছে না? ঐ দেখ মা-জি তোমাদের ধরে নিয়ে যেতে লোক পাঠিয়েছে। ঠিক হয়েছে। বাঙ্গালীদের এ-সব কথা বলতে হয় না। -শার্ট কবে দেবে?”

আজকেই দেব।"

সন্ধ্যেবেলায় তোমাদের বাড়িতে যাব।"

সন্ধ্যেবেলায় শার্ট হাতে নিয়ে উনো বলল, “আমার বাবা এখানকার লোক ছিল না। মাদ্রাজের কাছে জেলেদের গাঁ আছে সেখানে থাকত। তবে সেখানকার লোকও ছিল না ওরা। ওর বাবার বাবা সাগরের ওপার থেকে এসেছিল। বাবার মা ছিল না. সৎমা, পেট ভরে খেতে দিত না। বলত, জেলেরা জাল উপুড় করলে দুটো একটা ছোট মাছ ছিটকে পড়ে, তাই নিয়ে অসবি। তাহলে খেতে পাবি।' রোজ তাই আনত বাবা। জেলেরা রাগ করত। দূর থেকে বাবাকে দেখলেই তেড়ে আসত। বাবা দূরে দূরে মাছ খুঁজতে যেত।"

একদিন দেখে এক অচেনা ছেলে, ছোট জাল নিয়ে নৌকা থেকে একলা নামল। বালির ওপর জাল উল্টাতেই মাছগুলো পড়ল। সে কি মাছ! এমন আশ্চর্য মাছ বাবা জন্মে দেখেনি। কি তাদের রঙ কি তাদের চেহারা দেখে মনে হল সমুদ্রের তলাকার বাগান খালি করে ফল তুলে এনেছে। তার মধ্যে একটিও চেনা মাছ ছিল না। একটা কালোপানা আস্ত ঝিনুক বাবার পায়ের কাছে পড়তেই বাবা সেটি পা দিয়ে চাপা দিয়ে রাখল। জেলে দেখতে পেল না। ঐ ঝিনুকে মুক্তো থাকে। জেলে বোধ হয় ডুবুরি।

সে ওরই মধ্যে থেকে ছোট একটা নীল রঙের অক্টোপাস্, আলাদা করে রাখতেই বাবা বলল, “ওটি আমাকে দাও। ও-তো কেউ খায় না।"

বুড়ো বলল, “না, না, আমার মাছে চোখ দিও না। ও-সব থোমা-গুরুর চ্যালারা নেবে। তারা অত মানেটানে না। গাঁসুদ্ধ সব ছেলেপুলেকে খাওয়ায়, ওদের অত মানলে চলে?"

বাবা বলল, “কে তোমার থোমা-গুরু, তার নাম তো কখনো শুনিনি?" পাকা ভুরুর তলা থেকে চকচকে চোখে তাকিয়ে বুড়ো বলল, 'তাহলে চল আমার সঙ্গে। কোঁচড়ে করে ঝিনুকটা নিয়ে বাবা তার সঙ্গে গেল।

বাবা দেখল, সমুদ্রের বালির ওপর ছোট জেলেদের গ্রাম। গোলপাতার ঘর, মাটির দেয়াল দিয়ে বালি ঠেকিয়ে কুমড়ো করেছে, তরমুজ করেছে। ঝেঁটিয়ে-পেটিয়ে সাফ করে রেখেছে। বেলগাছের তলায় কুয়োর পাশে দাঁড়িয়ে পঞ্চাশটা কালো কালো ছেলে-মেয়ে, হাত জোড় করে, আকাশে চোখ তুলে, সরু গলায় গান গাইছে। বাবা বলল, “ওরা কি করছে?"

বুড়ো বলল, “দেবতার নামগান করছে। খ্রিষ্টর পূজো করছে।বাবা তো অবাক! 'ঠাকুর নেই, পাথর নেই, পূজো করছে কার?

এমন সময় ঘর থেকে থোমা-গুরু, বেরিয়ে এল। ছেঁড়া কাপড়-পরা, খালি পা, লাল মুখে। বাবা হাঁ করে দেখল, গান শেষ হলে ঝুড়ি থেকে রুটি নিয়ে সবাই ভাগ করে খেল। বাবাকে দিতে গেল, বাবা নেয় না। ছুঁড়ে ফেলে, বাবা ভয় পেয়ে ছুটে পালাল।

অনেক দূর গিয়ে একটা টিলার নিচে পড়ল আবার থোমার সামনে। থোমা জেলেদের ভাষায় বলল, “নিলে না কেন? খ্রিষ্টর দেওয়া রুটির মতো কি আছে?"

বাবা বলল, “আমরা গরীব লোক, শুঁটকি খাই, ওসব আমাদের নিতে নেই।" থোমা হাসল। তাই শুনে বাবার মনটাও খুসি হয়ে গেল। খোমা বলল, “খ্রিষ্ট-ও তো গরীব ছিল। তার বাবা জুতোর মিস্ত্রী। সে গরীবদের কাছে ডাকত। তুই আয় আমার কাছে।পায়ে পায়ে বাবা এগিয়ে গিয়ে ঝিনুকটা থোমার পায়ের কাছে রেখে বলল, “এটা তোমাদেরই। জেলের কাছ থেকে না বলে নিয়েছিলাম।"

কেন নিয়েছিলি?"

ওতে মুক্তো থাকে। একটা মুক্তা বেচলে আমাদের ছয় মাসের খাবার হয়। এখানে সবাই ঐ রকম ঝিনুকে খোঁজে।"

তবে ফিরিয়ে দিচ্ছিস কেন?'

'গাঁয়ের ছেলে-মেয়েদের খাবার কিনে দেবে বলে।'

থোমার হাতে ভিক্ষার ঝুলি।

ঝিনুকটা ঝুলিতে ভরে, ঝুলির মধ্যে থেকে ছোট্ট একটা কাঠপুতলি বের করে থোমা বলল, “এই নাও খ্রিষ্টর পুতলি। মুক্তোর চেয়েও ঢের বেশি এর দাম। এ ঘরে থাকলে আর কোনো ভয় থাকে না।"

বাবা নিল না সেটাকে, ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভয়ে ছুটে পালাল।

মিশন স্কুলে মাস্টারের বাড়িতে বাবা কুয়োর জল তুলত। পরদিন তাঁকে বলল, 'থোমা কে?'

মাষ্টার তো অবাক। থোমা, তার নাম কোথায় শুনলি? তার মতো মহাপুরুষ আর কোথায় পাব রে? ইংরেজরা আসবার আগে সে এসেছিল, গরীবরা ছিল তাঁর প্রাণ। তার নামে মন্দির আছে। ঐ টিলার ওপর শত্রুরা তাকে মেরে ফেলেছিল। লোকদের তো আর কেউ বাঁচতে দেয় না। সে বড় ভালো লোক ছিল রে!"

বাবা সেই টিলার নিচে খুঁজে দেখল, যদি কিছু পায়। বালি সরিয়ে কাঠপুতলিটাকে আবার পেল। বদলে গেছে। কাঠ ছিল, পাথর হয়েছে। সেই চেহারা। ছোট একটা ছেলে কাঁধ অবধি চুল, জোব্বা গায়, হাত দুটি মাথার ওপর তোলা। খিষ্ট। কিন্তু থোমার সেই গাঁটাকে আর খুঁজে পেল না। সমদ্রের ধারে সেই ছেলেকেও দেখল না।

আর বাড়ি গেল না বাবা। থোমা বলেছিল, "খ্রিষ্ট থাকলে কোন ভয় থাকে না।' খ্রিষ্টকে কোমরে গুঁজে সমুদ্রের ধারে হেঁটে হেঁটে দশ বছর পরে বাবা এইখানে এসে পোঁছেছিল। ততদিনে ডুবুরির কাজ তার শেখা হয়ে গেছিল, আর তার কোনো কষ্ট রইল না। ১০০ বছর বেঁচেছিল আমার বাবা। আমাদের ঠাকুর দেবতারা ঘরে থাকে, খিষ্ট থাকে দোরের মাথায় বাড়ি থেকে বেরুলে ওকে সঙ্গে আনি। আর আমার কোনো ভয় থাকে না। গল্প শেষ করে উনোকে উঠে পড়তে দেখে, আমরা ওকে পয়সা দিতে গেলাম। ও রেগে পয়সা ঝেড়ে ফেলে দিল।

আমরা বললাম, “দেখি আরেকবার তোমার খিষ্টকে।দাদা কাঠপুতলিটাকে ভালো করে দেখে বলল, “এ নিশ্চয় যীশু খৃষ্ট, খৃশ্চানদের দেবতা। দিদি বলল, "কিংবা শ্রীকৃষ্ণ, হিন্দুদের দেবতা। বৃন্দাবনে মাঘ মাসে বেজায় শীত পড়ে, তাই জোব্বা পরেছে।

উনো আমাদের হাত থেকে কাঠ-পতুলিটাকে ছিনিয়ে নিয়ে বলল, “ওকে আমি চিনি না? ও খৃশ্চানদের যীশুও নয়, হিন্দুদের কেষ্টও নয়। ও হল গিয়ে পৃথিবীর সব গরীব দুঃখীদের খ্রিষ্ট। তোমরা ওকে কি করে জানবে!"

এই বলে উনো হন হন করে চলে গেল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ