Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

স্বপ্নের বিভীষিকা ।। অঙ্কুর ঘোষ

পরিমল যখন ছোটো ছিল, তখন রোজ রাত্রে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখত। সে দেখত, একটা অচেনা জায়গায় একা দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে কেবল নিকষ কালো অন্ধকার, তাই খানিক সময় লাগত জায়গাটা ঠাহর করতে। তারপর, একটু একটু করে অন্ধকার হালকা হয়ে আসত। আকাশে চাঁদের ক্ষীণ আলোয় দেখা যেত, একটি ঝুলন্ত সেতুর ওপর সে একা দাঁড়িয়ে। দুইধারে দু’টি বিশালাকার পর্বতকে জুড়ে দিয়েছে সেতুটি। সেই পর্বতগুলিও কেমন বিকটদর্শন। তাদের গায়ে একটাও সবুজ গাছ-লতাপাতা কিংবা শ্যাওলা পর্যন্ত জন্মায়নি। কেবল রুক্ষ খটখটে মাটি। এমন সময় কোথা থেকে শোঁ-শোঁ করে একটা হিমেল বাতাস এসে পরিমলের মুখে-চোখে স্পর্শ করত। উঃ! সে কী ঠাণ্ডা! পরিমল শিউরে উঠত। তবে, এরপর যা ঘটত, তা আরো অদ্ভুত। কীসের একটা শব্দে পিছন ফিরে তাকিয়ে চমকে উঠত পরিমল। সে দেখত, একটি ছায়া মূর্তি তার দিকে তিরবেগে ধেয়ে আসছে। তাকে ধরার চেষ্টা করছে।

পরিমল আর কোনো কথা না ভেবেই, নিদারুণ আতঙ্কে সেতুর অপর প্রান্তটি লক্ষ্য করে ছোটা শুরু করত। কিন্তু কী আশ্চর্য ব্যাপার! সেতুটা যেন আর শেষ হতেই চায় না! সে ছুটছে তো ছুটেই চলেছে! সমগ্র সেতুটা পরিমলের পায়ের তলায় ঝঙ্কার দিয়ে উঠত। তার মনে হত, এই বুঝি সবসুদ্ধ নিচে ভেঙে পড়বে! তারপর, একটা জায়গায় গিয়ে সে আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ত- তার সামনে স্বয়ং সেই ছায়ামূর্তিটি দাঁড়িয়ে! তার মুখ সে কখনো দেখতে পেত না অবশ্য।

পরমুহূর্তেই পরিমলের ঘুম ভেঙে যেত। ধড়মড় করে সে বিছানায় উঠে বসত।

সেই একই বিভীষিকা প্রতিরাত্রে স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে পরিমলকে তাড়া করে বেড়াত। তাকে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে দিত না।  

দেখতে দেখতে বছরগুলি কাটতে লাগল। তারপর, একদিন হঠাৎ করে পরিমলের স্বপ্নটা দেখা বন্ধ হল। ইতিমধ্যে সে বেশ বড়ো হয়েছে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজেও ভরতি হল। মাঝে আরো অনেকগুলি বছর পেরিয়ে গেল। অবশেষে ভাগ্যক্রমে তার একটা ভালো চাকরিও জুটে গেল। শৈশবের সেই স্বপ্নটার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল পরিমল।

তার বছর দুয়েক মতো হয়েছে এই নতুন চাকরিতে। অফিসের কয়েকজন সহকর্মী ঠিক করল, একসঙ্গে লাদাখে বেড়াতে যাবে। পরিমলও তাদের সঙ্গী হল। অনেকদিন ধরেই তার পাহাড়ে ট্রেকিং-এর শখ। সকলের সঙ্গে দিনদুয়েক ভালোই বেড়ানো হল। তৃতীয় রাত্রে, একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে ওদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। তাঁবুর ভিতর নিশ্চিন্তমনে শুয়েছিল পরিমল। চারিদিক একেবারে নির্জন, শান্ত। এমন সময় তার ডান হাতটা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে কে যেন বলে উঠল, ‘পরিমল! এই পরিমল! একবার উঠে দেখ, কী সুন্দর লাগছে বাইরেটা!’

পরিমলের ঘুম ভেঙে গেল। সুব্রত ডাকছে। তার পাশেই সে শুয়েছিল। ‘কী হয়েছে?’ বলে উঠে বসে পরিমল।

‘একবার আমার সঙ্গে আয়। কী আশ্চর্য সুন্দর একটা দৃশ্য দেখলাম, তুই না দেখলে একেবারে মিস করে যাবি!’

তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসতে, সুব্রত আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ওইদিকটায় চল। আমি একটু আগেই দেখে এলাম।’

পরিমল তার দিকে তাকাল।

সুব্রত অপ্রস্তুত হয়ে বোঝাল, ‘ঘুম আসছিল না, কিনা। তাই ভাবলাম একবার ওদিকটা ঘুরে আসি।’

ওরা দুজনে অন্ধকারের মধ্যে হাঁটতে লাগল। সুব্রত আগে আগে চলেছে, তাকে অনুসরণ করছে পরিমল।

হাঁটতে হাঁটতে যখন ওদের ক্যাম্প থেকে অনেকদূর এসে পড়েছে, আচমকা পরিমল দাঁড়িয়ে গেল। তার ডানদিকে সে যে দৃশ্য দেখছে, কেন-জানি ভারি চেনা-চেনা লাগছে! ওই যে দূরে পাহাড় দুটো- ওদের মাঝখানে যে কাঠের সেতুটা ঝুলছে! না, কোনো ভুল নেই! বিদ্যুতের ঝলকের মতো শৈশবের হারানো স্মৃতি মনে পড়ে গেল পরিমলের। কিন্তু সুব্রত কোথায়? পাশ ফিরে তাকিয়ে পরিমল হতবাক হয়ে গেল, সুব্রতর কোনো চিহ্নমাত্র নেই!

ওদিকে পরিমলকে সেতুটা চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে। না, আর সে থাকতে পারল না। পরিমল দুরু-দুরু বুকে তার দিকেই অগ্রসর হল। কয়েক পা সবে এগিয়েছে, এমন সময় হাড়হিম-করা একটা হাওয়ার ঝাপটা তার ঘাড়ে এসে লাগল। পিছন ফিরে তাকাতেই তার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল- সেতুর মুখটায় ওটা কে দাঁড়িয়ে? অন্ধকারে লোকটির মুখ দেখা যাচ্ছে না বটে। পরিমল আর দেরি করল না। সেতুর উপর রুদ্ধশ্বাসে ছোটা শুরু করল। কোনোদিকে না চেয়ে। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে তাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। ছায়ামূর্তিটি পথরোধ করে পরিমলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর একটু কাছে এগোতেই এবার তার মুখ দেখতে পেল পরিমল। এই মুখ যে তার ভারি চেনা- হায়! এ যে অবিকল তার নিজেরই মুখ!

আশ্চর্য! পরিমল ভয় পেল না। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে, তার শরীরে যত শক্তি আছে সমস্ত একত্রিত করে, সে সামনের মূর্তিটির গলা চেপে ধরল। একই সঙ্গে পরিমল অনুভব করল, কেউ যেন তার নিজের গলাতেও দুটি শক্ত হাত প্রবল আক্রোশে চেপে ধরেছে!

চোখে অন্ধকার দেখার ঠিক আগের মুহূর্তে সে শুনতে পেল, যেন অনেকদূর থেকে তার সহকর্মীদের সমবেত চিৎকার ভেসে আসছে, ‘পরিমল, কোথায় আছ? আমাদের সাড়া দাও!’  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ