Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

সে কোন বনের হরিণ ।। পূণ্যলতা চক্রবর্তী

 

ছোট্ট ছানাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে মা-হরিণ গিয়েছিল ঝরণার জল খেতে। বেচারার আর ঘরে ফেরা হল নাবনের বাঘ ঝরণার ধারে ওৎ পেতে বসেছিল, খ-প্ করে তাকে ধরে নিল। ভোরবেলা দুজন লোক বনে কাঠ কাটতে গিয়েছিল, মা-মরা ছানাটাকে দেখতে পেয়ে তারা কোলে করে নিয়ে এল মনুদের বাড়িতে। মনুর বাবা সেটাকে কিনে নিলেন।

কিছুদিন আগে ওদের পোষা ছাগল ধবলীর একটা ছানা হয়েছে, এই ছানাটাকে তার পাশে রাখা হলধবলী তাকেও নিজের ছানার মতই চেটে আদর করল। হরিণছানা আর ছাগলছানা দুই ভাইয়ের মত একই ছাগলমায়ের কাছে রইল ; মায়ের দুধ খেয়ে একটু বড় হয়েই, তারা কচি ঘাস পাতা খেতে আর ছুটোছুটি লাফালাফি করে খেলতে শিখল। হরিণছানার সারা গায়ে ঠিক যেন চন্দনের ফোঁটার মত সাদা সাদা ফুটকি, তাই তার নাম রাখা হ''চন্দন', ছাগলছানাটা সারাদিন নেচে কুঁদে বেড়ায় তাই তার নাম হ''কুন্দন'

মনুর মা যখন পান সাজতে বসেন চন্দন প্রায়ই এসে তাঁর হাত থেকে পানের বোঁটা খায়। মজা দেখবার জন্য মা একদিন ছোট একটি পান সেজে তার মুখে দিলেন। মসলা দেওয়া মিঠাপান চন্দনের খুব ভাল লাগলসে রোজ এসে ছোট পান খেয়ে যেতো। এখন চন্দন কুন্দন বড় হয়েছে, বাড়ির ভিতরে আসে না, বাগানেই থাকেরাতে বাগানে একটা জাল-ঘেরা ছোট ঘরে ঘুমোয়। বিকালে স্কুল থেকে ফিরে মনু তার বন্ধুদের নিয়ে ওদের সঙ্গে খেলা করে। চন্দন দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে আর খুব ছুটতে পারে। কুন্দন মোটা হয়ে গিয়েছে তাই বেশী ছুটতে পারে না, শিং আর দাড়ি গজিয়ে তার চেহারাটা বেশ ভারিক্কি হয়েছে, মেজাজটাও একটু চটাসহজেই রেগে যায়।

শহরের একধারে মনুদের বাড়ি। বাড়িটা ছোট, তবে বাগানটা মস্ত বড়, অনেক ফুলগাছ ফলগাছ পুকুর, সবুজ ঘাসের '' এর পরে এদিকে আর বাড়ি নেই, উঁচু-নীচু মাঠ আর ধানজমি পেরিয়ে ছোট একটা নদীনদীর ওপারে দূরে পাহাড়। বাগানের বেড়ার ধারে গিয়ে চন্দন সেই দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কি ভাবে কে জানে? ঐ বনেই যে ওর জন্ম হয়েছিল, সেকথা কি ওর মনে পড়ে? ওতো তখন খুবই ছোট ছিল। তবে কেন অমন করে তাকিয়ে থাকে? মালী বলল, ওকে আর বেশীদিন ধরে রাখা যাবে না; আরেকটু বড় হলেই বনের হরিণ বনে পালিয়ে যাবে।' মনু চন্দনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, 'না-না, চন্দন আমাদের খুব ভালবাসে, আমরাও ওকে এত ভালবাসি, আমাদের ছেড়ে ও কোথাও পালাবে না।'

ফাল্গুন মাস, শীত চলে গেছে, আমের গাছে 'বৌল ভরে গেছে, নানারকম রঙিন ফুলে আর নতুন কচি পাতায় বাগানটা যেন ঝলমল করছে, মনুর সাধ হল একদিন বন্ধুদের নিয়ে বাগানে পিক্‌নিক্ করবে! মা বললেন, 'বেশ তো, রবিবার তোমার বাবার আর আমার দুপুরে একটা নেমন্তন্ন আছেসেদিন তোমরাও পিকনিক্ করো, কেমন?” রবিবার ভোরে উঠে মা পায়স আর টমেটোর চাটনি রেঁধে, পান সেজে, চাল-ডাল ঘী তেল মসলাপাতি বাসনপত্র সব গুছিয়ে ঠিক করে দিলেন; ছেলেরা সকাল সকাল চা খেয়ে সেইসব মাথায় নিয়ে হৈ হৈ করে বাগানে চলল। সঙ্গে গেল মালীর ছেলে মহাবীর আর বুড়ীঝির নাতি পুঁটে।

বড় আমগাছটার তলায় ইঁট পেতে বাগানে ডালপালা কুড়িয়ে খিচুড়ি আর মুরগীর `মাংস রান্না হল, বাগানের আলু বেগুন কফি ভাজা হল, উনুন নিভিয়ে সেসব বেশ করে ঢাকা দিয়ে ছেলেরা পুঁটে আর মহাবীরকে বলল, 'দেখিস, যেন কাগ-টাগ না আসে, আমরা চট্ করে পুকুরে চান করে আসছি।' চট্ করে চান হল না। জল ছোঁড়াছুঁড়ি ঝাঁপাঝাঁপি খেলায় বেশ খানিক দেরীর পরে হঠাৎ খেয়াল হল, 'চল্ চল্ খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে' বলে উঠতে যাচ্ছে এমন সময়ে পুঁটে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এল, 'হই দাদাবাবুরা শিগগিরি এসো! তোমাদের ছাগোলটা খ্যাঁচা খুলে বেইরে পড়েচে, ধোত্তে গেলে শিং নেইড়ে তেইড়ে আসচে!'

ছুট্‌-ছুট-ছুটে এসে ছেলেরা দেখল সব ভাজাভুজি আর কালাপতা দুজনে খেয়ে এখন চন্দন আরামে আমগাছে হেলান দিয়ে বসে পান চিবোচ্ছে। একথালা মিঠাপান প্রায় শেষ! ওদিকে কুন্দন পেয়ারা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে শিং বাগিয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে,তার নাকে মুখে মাখামাখি হয়ে ছাগলদাড়ি বেয়ে টপ্ টপ্ করে পায়স ঝরছে। মাথার উপরে মহাবীর মুখটি কাঁচুমাচু করে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে ঝুলছে। গরম হাতা নিয়ে কুন্দনের নাকে ছেঁকা দিতে গিয়ে তার এই শাস্তি দেখে ওরা সবাই হাসবে কি কাঁদবে বুঝতে পারল না। পুঁটে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল, 'সব পায়স শেষ করে দিয়েছে গো। 'যাক হাঁড়িভরা খিচুড়ি আর মাংস তো আছে, চমৎকার চাটনিটাও কি ভাগ্যি চন্দন কুন্দন দেখতে পায়নি, তাই দিয়ে বেশ পেট ভরেই খাওয়া হ'ল। তাছাড়া গাছে পাকাকুল, পেয়ারা এসব তো আছেই। গাছে চড়ে ফল খেয়ে গান গেয়ে ছুটোছুটি হুটোপুটি খেলা করে কোথা দিয়ে যে দিনটা কেটে গেল, বিকাল হতে না হতেই আবার খিদে পেয়ে গেল।

ডালপালা জ্বেলে চায়ের জল চড়িয়ে ওরা গান করছে 'যাবো না যাবো না যাবো না ঘরে—' এমন সময় বাবা মা ফিরে এলেন। আরো খানিকটা পায়স মা ঘরে তুলে রেখেছিলেন, চন্দন-কুন্দনের কাহিনী শুনে তাড়াতাড়ি সেটা এনে দিলেন। চিঁড়ে ভাজা, ঘুগুনী আর পায়সের সঙ্গে ধোঁয়া-গন্ধি চাআঃ কি চমৎকার যে লাগল খেতে! এত হাসি খেলার মধ্যেও পুঁটের মনটা থেকে থেকে পায়সের জন্য কেঁদে উঠছিল, এবার চেটেপুটে পেটভরে পায়স খেয়ে তার দুঃখ ঘুচল। বাবা-মায়ের সঙ্গে খানিক গল্পসল্প করে, একে একে সবাই যে যার ঘরে ফিরল; আজকের পিক্‌নিক্‌টা তাদের অনেক দিন মনে থাকবে। চন্দন আর কুন্দনও আজকের দিনটা সহজে ভুলবে না। রোজ তারা ঘাস ছোলা শাক পাতা এইসব খায়, আজকের মত মজার ভোজ তো আর কোনো দিন খায়নি।

চন্দন তো পানের স্বাদ ভুলেই গিয়েছিল, অনেকদিন পরে আবার পান খেয়ে তার ভারি লোভ হয়েছেরোজ সে মায়ের কাছে এসে মস্ত বড় একটা পান খেয়ে যাচ্ছে। মনু বলে, 'ওরে চন্দন, অমন করে যে বনের দিকে তাকাস, সেখানে তোকে মিঠা পান সেজে দেবে কে? ' 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ