Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

লক্ষ্মীনারাণ ।। শিবনাথ শাস্ত্রী

 

লক্ষ্মীনারাণ এক বামনের ছেলে। দেহটি কুস্তির পালোয়ানের মত, কিন্তু মাথাটি যেন একটি ছোট হুঁকার খোল। কাজেই লক্ষ্মীনারাণের বুদ্ধিশুদ্ধি বড় কম। কিন্তু তার মা সে-কথা স্বীকার করেন না। তিনি বলেন, “আমার লক্ষ্মীর পেটে-পেটে বুদ্ধি আছে, বয়স হলে ফুটবে। কবে যে লক্ষ্মীর বয়স হবে তাহা তো বুঝিতে পারা যায় না; দেখিতে দেখিতে বিশ-বাইশ বৎসর হইয়া গেল, তবুও লক্ষ্মীর বয়স হইল না; সে সংসারের কোনো কাজেই আসিল না। কাজের মধ্যে গরুর খড় কাটে ও প্রাতে গরুগুলিকে গোয়াল হইতে বাহির করিয়া নাড়িয়া বাঁধে। বলিতে কি লক্ষ্মীনারাণ ঐ গরুগুলিকেই অনেকটা আপনার মত দেখিতে পায় এবং ঐ গরুগুলির সঙ্গেই তার যা বনে। নতুবা পাড়ার ছেলেদের জ্বালায় সে পাড়ায় বাহির হইতে পারে না। বাহির হইলেই যেমন কাকের পিছে ফিঙ্গে লাগে, তেমনি ছোঁড়ারা তার পিছে লাগে; এবং বিধিমতে তাহাকে জ্বালাতন করে। পিছন দিক দিয়া আসিয়া তাহার কাছা খুলিয়া দেয়, তার হুঁকার খোলের মত মাথাটিতে ঠোকর মারে, তার দুই কাধে হাত দিয়া লাফাইয়া ঘোড়া-চড়ার মত তার পিঠে চড়িয়া বসে। কারণ লক্ষ্মীনারাণকে ক্ষেপাইতে সকলে ভালবাসে সে ক্ষেপিলে খোনা নাকে, যে-সব গালাগালি দেয় ও তার আকৃতি-প্রকৃতি যেরূপ দাঁড়ায় তা দেখিলে হাসিয়া পেটের নাড়িতে ব্যথা হয়।

লক্ষ্মীনারাণ বোকা বলিয়া তার পিতা তাকে একেবারেই আমলে আনেন না। তাকে বাদ দিয়া সংসারের কাজ এজন্য করেন; কোনো কাজের ভার তার উপর দেন না। পতি-পত্নীতে বড় বিবাদ হয়। লক্ষ্মীর মা বলেন, 'এক- আধটু সংসারের ভার না দিলে ছেলেটা মানুষ হবে কি ক'রে? তোমরা ওকে চেন না, ও আমার মনে করলে দশ টাকা আনতে পারে।'

লক্ষ্মীর পিতা বলেন, হ্যাঁ যা নয় তাই, ওকে আবার কাজের ভার দেব ? ওটা কি মানুষ ?”

লক্ষ্মী যখন এই সকল কথা শোনে, তখন মায়ের বাক্যে সায় দিয়া মনে-মনে ভাবে, আমি কি না করতে পারি। লক্ষ্মী কিন্তু সংসারের একটা কাজ করে, গরু দুহিয়া থাকে।

একবার বাড়ীতে একটা কাজ উপস্থিত। দশ লোক খাবে। সকাল-সকাল প্রথম বাজারে যাইতে পারিলে ভাল জিনিস পাওয়া যায়। লক্ষ্মীর পিতা ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন কাহাকে বাজারে পাঠান। তিনি নিজে নানা কাজে পড়িয়া যাইতে পারিতেছেন না। লক্ষ্মীর মা বার বার বলিতেছে, ‘একটু বেলা হলে না হয় তুমি যেও, এখন না হয় লক্ষ্মীকে পাঠাও না কেন?”

কর্তা মহাশয় দুই-চারিবার বলিলেন, 'হ্যাঁ লক্ষ্মী যাবে, ও গিয়ে করবে কি?' কিন্তু শেষে উপায়ান্তর না দেখিয়া লক্ষ্মীকে ডাকিলেন, 'লকে, লকে এদিকে আয়; এই একটা টাকা নিয়ে বাজারে যা; আট আনার মাছ কিনে কারু হাতে পাঠিয়ে দিস ; তারপর প্রথম হাটে ভাল তরি-তরকারি যা পাবি কিনে আনিস।'

আজ লক্ষ্মীনারাণকে দেখে কে? টাকাটি ট্যাকে গুজিয়া, দুই হাত দুলাইয়া গরবে গরবে পা ফেলিয়া বাজারের দিকে চলিল। পথে যদি বালকেরা ডাকে, 'কিরে লকে কোথায় যাচ্ছিস ?' উত্তরই দেয় না, ফিরেও তাকায় না, যদি কেহ ভদ্রভাবে বলে, 'কি ভাই লক্ষ্মীনারায়ণ কোথায় যাচ্ছ?' তবে উত্তর দেয় 'বাজারে যাচ্ছি, মাছ কিনতে।' ঘটনাক্রমে লক্ষ্মীনারাণ যেই বাজারে উপস্থিত অমনি এক মেছুনি এক চুপড়ি কৈ মাছ আনিয়া নামাইল। খুব বড়-বড় কৈ দেখিয়া লক্ষ্মীর জিভে জল আসিল। কথা না বলিলেও সকলের বোঝা উচিত যে লক্ষীনারায়ণ আর কিছু না পারুক, খাইতে বেশ পারিত এবং দেখিয়াছে মা তাহাকে বড়-বড় কৈ মাছের ঝোল করিয়া খাওয়াইতে ভালবাসেন। সুতরাং কৈ দেখিয়াই লক্ষ্মীর মনে হইল কৈ মাছ কিনিতে হবে। লক্ষ্মী জেলের মেয়েকে বলিল, 'আঁট আঁনার কৈ দাও', এই বলিয়া টাকাটি তাহাকে দিল। মেছুনি যাহা দিল তাহা লইয়াই লক্ষ্মী চলিয়া যায় আট আনা যে ফিরিয়া লইতে হইবে সেদিকে খেয়াল নাই! জেলের মেয়ে নিজের গরজে ডাকিয়া ভাঙানি পয়সা ফিরাইয়া দিল। তখন লক্ষ্মী বলিল, 'তাই তো তরি-তরকারি কিনিতে হবে।' এখন মাছগুলি বাড়ীতে পাঠাইতে হইবে। কাকে দিয়ে পাঠাবে ? লক্ষ্মী চেষ্টা করিলে রাজারের চেনা চাষা লোক ঢের পাইত যাহাদের কাহাকেও দুইটা পয়সা দিলে বাড়িতে পৌঁছাইয়া আসিতে পারিত। লক্ষ্মী যখন কোনো কর্তব্য নির্ধারণ করিতে বসিত, তখন যদি কোনো একটি বিষয় স্মরণ হইত, তাহা হইলেই অনেক সময় বিপদ ঘটিত। তখনি একটা নুতন আজগুবি বুদ্ধি যোগাইত, এবং সে তৎক্ষণাৎ কাজে তাহা না করিয়া থাকিতে পারিত না। তার এই উদ্ভাবনী শক্তিতে সময়ে সময়ে মুশকিল বাঁধাইত। তাহার প্রমাণ এখনি পাইবে। সে দেখিল মাছগুলি জীয়ন্ত আছে। অমনি স্মরণ হইল যে উজুইয়ের কৈ কানে হাঁটিয়া জল হইতে ডাঙায় উঠে। সেই কথা স্মরণ হইয়া হঠাৎ এক নূতন বুদ্ধি তাহার মনে যোগাইল। তাদের বাড়ি হইতে বাজার পর্যন্ত একটি খালের মত ছিল। সে ভাবিল মাছগুলি খালে দিলে তো আমাদের ঘাটে উঠিতে পারে। অমনি সে খালের জলে মাছগুলি ছাড়িয়া দিয়া বলিল, ‘সোঁজা আমাদের ঘাঁটে গিয়ে উঠবি।

মাছ তো পাঠানো হইল। তারপর লক্ষ্মী বাজারে প্রবেশ করিল। যেই প্রবেশ করা অমনি দেখিল, এক কুম্ভকার এক বাজরা কলিকা নামাইতেছে। স্মরণ হইল যে গৃহে ক্রিয়াকর্ম হইলে হুঁকা প্রভৃতি কেনা হয়। পিতা তরি-তরকারী কিনিতে বলিয়াছিলেন। লক্ষ্মীনারাণের শাস্ত্রে কলিকাগুলিও তরি-তরকারির মধ্যে, সুতরাং তৎক্ষণাৎ আট আনা দিয়া এক বোঝা কলিকা কিনিয়া লোকের মাথায় দিয়া গৃহাভিমুখে চলিল। আজ সে পিতাকে পরাস্ত করিবে। দেখাইবে সে কেমন কাজের ছেলে, তাই আবেগে চলিয়াছে। পথে যদি কেহ ডাকে বা দাঁড়াইতে বলে, দাঁড়ায় না, বলে, আমি বাজার করে যাচ্ছি, ধরে কাজ আছে।'

বাড়িতে পৌঁছিয়া তার কি দশা হইল, সকলেই বুঝিতে পার। ঘরের কাজ-কর্ম কোথায় রহিল। পতি-পত্নীতে ঘোর বিবাদ বাঁধিয়া গেল।

ইহার পরে লক্ষ্মীনারাণের পিতা আর তাকে কোনো কাজ কর্মের ভার দিতেন না। আবার বহুদিন কাটিয়া গেল, আবার একবার গৃহে কাজ-কর্ম উপস্থিত। অনেকগুলি লোক খাওয়ানো হইবে। তৎপূর্বদিন গোয়ালাকে আট আনা বায়না পাঠাইয়া আধ মণ দই পাঠাইবার জন্য বলিতে হইবে। পিতা ভাবিলেন এত বাজার করা নয়, কেবল গোয়ালার বাড়িতে গিয়া আট আনা পয়সা দিয়া আসা বৈ তো নয়, তা কি আর লক্ষ্মীনারায়ণ পারিবে না? ভাবিয়া চিন্তিয়া তিনি লক্ষ্মীনারাণকে ডাকিয়া বলিলেন, 'লকে। এদিকে আয় তো এই আট আনার পয়সা অমুক গোয়ালাকে দিয়ে ব'লে আয় কাল প্রাতে আধ মণ দই দিতে হবে।'

আবার লক্ষ্মীনারাণের মাথা ঘুরিয়া গেল। সে আট আনা পয়সা পকেটে গুঁজিয়া বাহির হইল। পথে যাইতে যাইতে দেখিতে পাইল যে রাজাদের একটা হাতি আসিতেছে। হাতি দেখিয়া লক্ষ্মীনারাণের হাতি চড়িতে বড় সাধ হইল। মাহুতকে বলিল, 'মাহুত হাতি চঁড়াবি।'

মাছত দেখিল বোকা বামনের ছেলে, জিজ্ঞাসা করিল,

'কি দিবে ?'

লক্ষ্মীনারাণ বলিল, 'আঁট আঁনা দিব।

রাজপুত্রই বা পথে বালকদের মাছত ভাবিল বেশ তো উপরি লাভ জুটিল। সে তৎক্ষণাৎ হাতি বসাইয়া লক্ষ্মীনারাণকে উপরে তুলিয়া লইল ৷ হাতি যখন চলিতে আরম্ভ করিল তখন যদি লক্ষ্মীনারাণের ভাব কেহ দেখিত তখন নিশ্চয় হাসিয়া পাগল হইত। কোথায় ? এমনই গৌরবে বসিয়াছে। কোলাহল, 'ওরে ভাই লকে হাতির উপর চলেছে। ওরে লকে হাতির উপর কি ক'রে চড়লি ?" লক্ষ্মীনারাণ কাহারও কথা শুনিতেছে না কোনো দিকে দেখিতেছে না। কেবল আপনাকে রাজপুত্র ভাবিতেছে। তার ছোট মাথাটি একেবারে ঘুরিয়া গিয়াছে।

মাহুত কিয়দ্দূর গিয়া লক্ষ্মীনারাণকে নামাইয়া দিল। তখন দৈ-এর বায়নার কথা লক্ষ্মীনারায়ণের মনে হইল। অগ্রেই বলিয়াছি তার উদ্ভাবনী শক্তি আশ্চর্য, একটু ভাবিয়াই এমন একটা কৌশল বাহির করিল, যাহা শুনিলে, তোমরা তাহার বুদ্ধির প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারিবে না। সে অনেকবার দেখিয়াছিল যে মা দুধে তেঁতুল দিয়া ঘরে দৈ পাতেন। সেই কথাটা স্মরণ করিয়া মনে-মনে একটি উপায় স্থির করিয়া বাড়িতে ফিরিয়া আসিল। সন্ধ্যা পর ভাঁড়ার হইতে তেঁতুল লইয়া গোয়ালে প্রবেশ করিয়। সমুদয় গরুকে তেঁতুল খাওয়াইয়া দিল।

রাত্রে পিতা জিজ্ঞাসা করিলেন, 'ওরে লকে গোয়ালার বায়না দিয়েচিস তো ?' লক্ষ্মী উত্তর দিল, 'ইবে হবে, ভয় পাও কেন ? ঠিক সময়ে পেলেই তো হল।' পরদিন প্রাতে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ জমিতে লাগিলেন। বাজার হইতে সন্দেশ প্রভৃতি আসিল, দৈ আর আসে না। পিতা ব্যস্ত হইয়া উঠিতে লাগিলেন। 'ওরে লকে দই কৈ? বায়না

দিয়েছিস তো?' শেষে লক্ষ্মীনারায়ণ বিরক্ত হইয়া জননীকে বলিল, “আঁ তোঁমরা জ্বালাতন করে তুললে। ভাঁড়টা দাও তোঁ দৈ দুয়ে আনি।' শুনিয়াই তো জননী অবাক। বলিল দৈ ছয়ে আনবি কিরে?' লক্ষ্মী উত্তরে বলিল, 'ওঁগো কাল রাত্রে সব গরুকে তেঁতুল খাইয়ে রেখেছি।'

বুঝিতেই পার ব্যাপারটা কি দাঁড়াইল! গৃহকর্তা পাগলের মত হইয়া উঠিলেন। দাতে দাঁত ঘষিতে লাগিলেন। লক্ষ্মীনারাণকে ও তাহার মাতাকে ভৎসনা করিতে লাগিলেন। বলিতে লাগিলেন, 'ওরে হতভাগা, ওরে লক্ষ্মীছাড়া আট আনা পয়সা যে দিলাম তার কি করলি?

এত গালাগালিতে লক্ষ্মীনারাণের বড়ই ক্রোধের উদয় হইয়াছে। সে এক-একবার হাতি চড়িবার বিষয় স্মরণ করিতেছে অমনি রাজপুত্রের ভাবটা মনে আসিয়া পড়িতেছে। শেষে সে আর গালাগালি সহ্য করিতে না পারিয়া গম্ভীরভাবে গৃহের বাহির হইয়া পিতাকে বলিল, 'যা করেছি তা তোমার জন্মেও করো নি।'

পিতা জিজ্ঞাসা করিলেন, 'কি, করেছিস কি ?'

উত্তরে লক্ষ্মী বলিল, 'তোমার চোদ্দ গঁণ্ডা পুরুষেও তাঁ করে নি। '

পিতা তবু বলিলেন, 'ওরে হতভাগা কি করেছিস বল না? লক্ষ্মী বলিল যাও যাও মুখ খারাপ করো না বলছি রাজপুত্রে যা করে তাঁ করেছি।

পিতা জিজ্ঞাসা করলেন, 'কি রাজপুত্রের কাজটা করলি ?”

উত্তরে লক্ষ্মীনারাণ বলিল 'আমি হাতি চঁড়েছি।' এই বলিয়া রাজপুত্রের মত গরবে গরবে পা ফেলিয়া ঘরের ভিতর গেল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ