সেই দিন থেকে রাত্রে রাহুলের চোখে ঘুম নেই।
ও ওর মায়ের মৃত্যুটা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। বারবার সেই দৃশ্যটাই যেন মনের পর্দায় ফুটে উঠছে। অথচ এই কদিন আগেও তো সব ঠিকঠাক ছিল। তেমন কিছু তো হয়নি, যে মাকে একেবারে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসতে হলো।
এইসব সাত পাঁচ প্রশ্ন মাথায় নিয়ে রাহুল একটু ঘুমোতে চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ তন্দ্রা আসার পরে হঠাৎ একটা কারণে ঘুমটা ভেঙে গেল ওর। সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রবল শ্বাস নেওয়ার শব্দ শুনে রাহুল শিউরে উঠলো। হাতের সামনে বেড সুইচটা অন করল। আলোটা জ্বলে উঠতেই সমস্ত স্পষ্ট হয়ে উঠলো। কই কিছু তো নেই, হয়তো মনের ভুলভ্রান্তি। কখন থেকে এইসব সাত পাঁচ চিন্তাটা পিছু ছাড়ছে না। হয়তো এর জন্যই নানারকম বিকার।
পরদিন সকালে বাবাকে এইসব কথা জানাতেই বাবাও একটু চিন্তিত হয়েই রাহুলকে বলল, শোন তোকে একটা কথা জানাতে ভুলে গেছি। এই গুপ্তভিলা ভাড়া নেওয়ার পর থেকেই আমারও একটা সন্দেহ হয়েছিল। প্রতিদিন রাতে আমার মাথার সামনে দাঁড়িয়ে কাকে যেন খুব জোরে শ্বাস নিতে শুনেছি। কিন্তু কোনদিন কাউকে চোখে পড়েনি। অথচ সকালে উঠে দেখেছি আমার মাথার বালিশটা আর মাথাতে নেই। স্থান পরিবর্তন করেছে । আর একটা ঘটনা তুই লক্ষ্য কর ঝগড়া নেই, ঝাটি নেই তোর মা শুধু শুধু কার ওপর রাগ করে আত্মহত্যা করল।
রাহুলের ভয় হতে লাগলো। এরপর থেকে সত্যি সত্যি ওই বাড়িতে থাকতে রাহুলের ভয় হয়। বহুবার বাবাকে বলে সে বাড়িটা ছেড়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু এরকম মফস্বলে বাড়ি ভাড়া পাওয়া অত সহজ না এই বলে বাবা এড়িয়ে গেছে। কিন্তু তা বলে এই অভিশপ্ত বাড়িতে?
মাঝরাতে বহুবার রাহুল ছাদের উপরে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেয়েছে। কিন্তু কোন বারই উপরে ওঠে দেখবার দুঃসাহস হয়নি। সেদিন বন্ধু সুদীপ্তর সঙ্গে এই নিয়েই কথা হচ্ছিল রাহুলের। সুদীপ্ত কিন্তু বিজ্ঞানচেঁতা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গত বছর ফিজিক্সে মাস্টার ডিগ্রী কমপ্লিট করেছ। অতি সহজে এইসব কথা যে বিশ্বাস করবে না তা রাহুল জানতো। তাই ওকেই এই কথাটা বলার প্রয়োজন মনে করলো। নানা কথার পর সুদীপ্ত সেদিন রাতে গুপ্ত ভিলায় রাত্রি যাপনে মনস্থির করে বসলো। বলল, আমি আজ নিজের চোখে দেখতে চাই ঘটনাটা সত্যি না মিথ্যা
সুদীপ্তর প্রথমে বাড়ির চেহারাটা দেখে সন্দেহ হয়েছিল। জোড়া জীর্ণ বাড়ি বহুদিন রং করা নেই। সামনে নারকেল, সুপারি, ঝাউ গাছের সারি যেন যমলোক। বাড়ির ভেতরটা অন্ধকার। জানলা দরজা খুবই কম। দিনের বেলাতেও লাইট না, জ্বালালে স্পষ্ট করে কিছুই দেখা যায় না। দোতলায় একটা ঘুলঘুলিও নেই। তাই আরো বিকট অন্ধকার। যাইহোক এটা ভুলে গেলে চলবে না সে সাইন্সের ছাত্র। শেষে কিনা তোরা এই বাড়িটা ভাড়া নিলি? বিস্ময় চোখে বলে ওঠে সুদীপ্ত।
না একপ্রকার চাপে পড়েই আর কি!
মানে?
এই মফস্বলে ভালো বাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না তাই, তারওপর বাবার টেনেস্পার অর্ডারটাও তাড়াতাড়ি চলে আসায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই...
নানা কথর পর সুদীপ্ত রাহুলকে জিজ্ঞাসা করে বসলো, বলতো তোর মা ঠিক কোন জায়গাটায় আত্মহত্যা করেছিল? আমাকে একবার দেখাবি?
রাহুল নিয়ে গেল দোতলার চিলেকোঠায়, অন্ধকারময় এক একটা সিঁড়ি ভেঙ্গে যেতে যেতেই সুদীপ্ত মাঝে মাঝে শিউরে উঠছিল কিন্তু ঘুনাক্ষরেও রাহুলকে সে কথা বুঝতে দেয়নি। সুদীপ্ত ভালো করে দেখল জায়গাটা। মনে মনে স্থির করে বসলো আজ রাত্রে ওরা এখানে এসেই বসবে।
সেইদিন রাত্রের আহার সেরে ওরা ওই চিলেকোঠায় গিয়ে বসলো। কৃষ্ণা পঞ্চমীর চাঁদ তখন ডুবতে বসেছে। রাহুলের একটু তন্দ্রা এলো। সুদীপ্ত তখনো জেগে হঠাৎ যেন একটা বাঁশির সুমধুর আওয়াজ শুনতে পেয়ে ওরা ছাদের ওপর গেল মনে হল। শব্দটা ছাদের ওপাশ থেকে আসছে। ওরা অনুসন্ধান করতে লাগলো কে এই বাঁশি বাজাচ্ছে। আলো-আঁধারির মধ্যে ওরা দেখতে পেল একটা পাঁচ সাত বছরের বাচ্চা ছেলে বাঁশি বাজাতে বাজাতে ছাদের কার্নিশ এর উপর ঘুরছে। রাহুল ভয়ে কেঁপে উঠলো। কাঁটা দিয়ে উঠলো সুদীপ্তর শরীরেও। সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড ঝড়ের তান্ডব শুরু হতেই ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকানি। এই বিদ্যুতের আলোতেই ওরা বাচ্চাটাকে আরো স্পষ্ট দেখতে পেল।
রাহুল চিৎকার করে উঠলো, কে, কে ওখানে?
কোন উত্তর নেই।
ঘুরেই চলেছে ওরা ইতস্ততভাবে। একটু কাছে এগিয়ে যেতেই ছেলেটা যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল আর খুঁজেও পাওয়া গেল না।
ঝড় কিন্তু তখনও থামেনি। একটা বিকট কান্নার শব্দে ওদের রক্ত হিম হয়ে এলো। ওরা পিছু ফিরে দেখল, ছেলেটি দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। দাঁড়াও! দাঁড়াও! সুদীপ্ত চিৎকার করে বলল। ওরা ওকে অনুসরণ করে নিচে এল।
ঝড়ের ধাক্কায় দরজা-জানালার খোলা পোড়ার বিকট আওয়াজে রাহুলের বাবার ঘুম অনেকক্ষণ আগেই ভেঙ্গে গেছে। বিনিদ্র চোখে একটা ছায়া মূর্তি দেখে জয়ন্তবাবু চিৎকার করে উঠলো। মনে হল মূর্তিটা দরজার ওপাশ থেকে এপাশে চলে যাচ্ছে। হাতের সামনে টর্চটা জ্বালিয়ে বাইরে এসে দেখল ওরাও হন্তদন্ত হয়ে উপর থেকে নামছে।
কোনও কথা না বলে ওরা তিনজনই বাইরে এসে বড়ো ঝাউ গাছটার সামনে থমকে দাঁড়ালো। বাচ্চা ছেলেটা ঝাউ তলার মাটিটা ক্রমশ খুড়েই চলেছে। খুঁড়ে খুঁড়ে প্রায় গর্ত অনেক হয়ে গেছে।
ওরা সকলে বিস্ময়ে হতবাক, ছেলেটার হাতে কি এমন শক্তি যে এই শক্ত মাটিটা এত সহজেই খুঁড়ে ফেলল। ওরা কিন্তু একটাও টু-শব্দ করেনি। অবশেষে বাচ্চাটা যেন কোথায় মিলিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের তাণ্ডবও।
ওরা আলো জ্বালিয়ে গর্তটা ভালো করে দেখলো। সকলে শিউরে উঠল। দেখলো এই বাচ্চাটার কঙ্কাল আর তার প্রত্যেকটি হাড়ে নিখুঁত অক্ষরে লেখা মুক্তি দাও! মুক্তি দাও!
আর বিলম্ব না করে রাহুল গর্তের মধ্যে কঙ্কালটা দাহ করল, তারপর ওটাকে মাটি চাপা দিল।
আজ এতদিন পর রাহুল প্রাণের খুশিতে নিঃশ্বাস নিল। মুক্তি দেওয়ার স্বাদ গ্রহণ করল বাতাস থেকে।
তারপর শোনা গেল বহু বছর আগে ওখানে এক পরিবার বাস করত। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ হওয়ায় ওরা ওদের একমাত্র বাচ্চাকে খুন করে ওখানে পুঁতে দিয়েছিল। শেষে দুজনেই আত্মহত্যা করেছিল। সেই থেকে ওই বাড়িতে কেউ ভাড়া নেয় না। নিলেও কিছু না কিছু অঘটন ঘটে থাকে। কিছুদিন পর ওরা নতুন বাড়ি পেয়ে গেল।
0 মন্তব্যসমূহ