Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ভূত বাংলোয় এক রাতে ।। গুরুস্বরূপ মুখোপাধ্যায়

কলেজের লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ক'মাস হল একটা নামী কোম্পানির সেল্স ম্যানের কাজে যোগ দিয়েছি। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। সকাল থেকে একটা ঢাঁইপাড়া ব্যাগে ঠেসেঠুসে মাল ঢুকিয়ে অর্ডার অনুযায়ী কাস্টমারের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিই। সকালে বেরিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়।

সেদিন বিকাল থেকে প্রবল বর্ষণে রাস্তাঘাট জলে থৈ থৈ। মাল ডেলিভারি দিতে বেরিয়ে ছিলাম বাঁকুড়ার জয়পুরের জঙ্গলের কাছাকাছি এক গ্রামে। বনের মাঝে বাইকটা চলতে চলতে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। সেল্ফ স্টার্ট আর পায়ে কিকের পর একনাগারে কিক করলেও কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছে না।

এই রাতে বনের মাঝে ফাঁকা পিচরাস্তায় দু-একটা রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যাওয়া লরি বা মোটরবাইক ভিন্ন আর কোনো যানবাহন চোখে পড়ল না। তখনও টিপটপ বৃষ্টি রাস্তা আর গাছের পাতা ধুইয়ে দিচ্ছে। এইরকম পরিবেশে যে এভাবে আমার বাইক ফ্যাসাদে ফেলে দেবে তা ভাবতেও পারিনি। নিজের উপর আর আমার মোটরবাইকের উপর প্রচণ্ড রাগ হল। মনে হল এই বনের মাঝেই এই ঘুমিয়ে পড়া বাহনটাকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।

এমন সময় ছপাৎ ছপাৎ জল কেটে কেটে ছাতা মাথায় এক ব্যক্তিকে আসতে দেখলাম। এই জংলী পরিবেশে মানুষের দেখা পেয়ে মনে কিছুটা শক্তির সঞ্চার হল। কিন্তু ক্ষণিক বিদ্যুতের ঝলকানিতে লোকটার চেহারা দেখে গা সিঁটিয়ে উঠল। পেল্লাই লম্বা। গায়ের রং পোড়াকাঠের মত কালো। গায়ে হাড় ঢাকতে যতটুকু চামড়া বা মাংস প্রয়োজন ততটুকুই আছে, ওর বেশি একটুকুও নেই। চোখ কোটরে বসে গেছে। ঘোলাটে অক্ষিবলয়, কিন্তু দৃষ্টির তীব্রতা যেন যাকে তাকে পুড়িয়ে দিতে পারে।

কাছে এসে লোকটি ঘ্যাসঘ্যাসে গলায় বলল, এ বাইক আর স্টার্ট নেবে না মশায়। বেকার পরিশ্রম করছেন। চাইলে আজকের রাতটা আমার বাড়িতে থেকে যেতে পারেন।

আমি এরকম অযাচিত অতিথি আমণ্ত্রণে ভাবলাম তাহলে কি চোর ছেঁচোচের পাল্লায় পড়লাম। নিশ্চিত আমার কাছে টাকা আছে এখবর পেয়েছে। এই দুর্যোগের রাতে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে গলায় ছুরি বসিয়ে সব হাতিয়ে নেবে। তারপর নিজেই নিজেকে উত্তর দিলাম কীসব বোকার মতো ভাবছি। আমার কাছে নগদটাকা হয়তো শপাঁচেক পকেটে আছে, বাকি সব পেমেন্টই তো অনলাইনে হয়েছে। এই বনবাদাড়ের ডাকাত অতটা আপডেট হতে পারেনি এটা নিশ্চিত।

প্রথমে সেই ব্যক্তির আমণ্ত্রণ নাকচ করলেও, পরে নিরুপায় হয়ে তার বাড়িতে আশ্রয়ের উদ্যেশ্যে রওনা দিলাম। সামনেই তার বাড়ি হাত বাড়িয়ে দেখালো। পৌঁছে দেখলাম বেশ পুরানো প্লাস্টার খসা স্যাঁতস্যাতে এক বাংলো। তবে বাড়ির ভেতরে কোনো আলো জ্বলতে এবং কোনো মহিলা বা পুরুষের অস্তিত্ব পেলাম না। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি ঝাঁঝালো উত্তর দিলেন, সে নিয়ে আপনার কোনো অসুবিধা আছে কী? তিনি আমার কথায় আঘাত পেয়েছেন বুঝে আর কোনো কথা বাড়ালাম না। যাহোক করে ভিজে জবজবে বাংলোর উঠোনে মোটোরবাইকটা টানতে টানতে উপরে তুললাম।

আমাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে শোবার বিছানাটা দেখিয়ে হঠাৎ করে কোথাও যেন উধাও হয়ে গেলেন। আবার হঠাৎ দেখলাম কখন যে আমার সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছেন মালুম পেলুম না। সারাদিনের ক্লান্তি শরীর আর নিতে পাচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে আর অপেক্ষা না করে বিছানায় শরীরটাকে ফেলে দিই। কিন্তু সেই ভদ্রলোকের নানান অবান্তর প্রশ্ন আমার সম্পর্কে, খেই হারানো অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনতে শুনতে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম। খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু আমি তার মেহেমান, বলতেও পারছি না, এবার আপনি যান, আমি শোবো। কিংবা আপনি পাগল, আমায় একটু স্বস্তি দেন। এখন এই ক্লান্ত শরীর, মনে আপনার কোনো কথায় ভালো লাগছে না, মাথা যণ্ত্রণায় টিপটিপ করছে---। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে সহ্য করতে করতে কখন যে সেই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি।

যখন ঘুম ভাঙলো তখন আমি আর আমার মধ্যে নেই। একটা হাড়হিম করা অবস্থা দেখে আমার শরীর বিছানাতে শুয়েই কেমন যেন বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগল। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি প্রচণ্ড শব্দে দমকলের মতো দ্বিগুণ চলছে আমার হৃৎপিণ্ড। এই বুঝি বুক ফেটে বেরিয়ে পড়বে আমার রক্তমাখা হৃৎপিণ্ডটা। ঠিকরে গিয়ে আছড়ে পড়বে দেওয়ালে। হঠাৎ বরফশীতল কয়েকটা নিঃশ্বাস মুখে পড়তেই তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আমি তাকিয়ে দেখলাম শেয়ালের জ্বলন্ত চোখের মতো চার-জোড়া চোখ আমার মুখের অত্যন্ত কাছে এসে কী যেন খুঁজে চলছে। এই বুঝি তার তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে আমার মুখে কামড় বসিয়ে দেবে। এক-আধবার আবার আমার আপাদমস্তক শরীরে চোখ বুলাচ্ছে। হালকা আলোতেই বুঝতে পারলাম সকলের মুখে লেগে আছে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। একজনের আবার মুখের গালের কষ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ছে। আমার চোখ মেলার সাথে সাথেই সেই অশরীরীদের একসাথে খিলখিল করে হেসে উঠার শব। সেকী বীভৎস হাসি। সেই হাসির চোটে যেন কানের পর্দা ফেটে যাবার উপক্রম। বুঝলাম আমি সুস্থ ব্যক্তির বাড়িতে নয়, এসে উঠেছি ভূতুড়ে বাংলোয়। আর কোনো সমঝোতা না করে মাথার কাছে রাখা পার্সেলের প্রকাণ্ড ব্যাগটাকে তাদের মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে প্রাণপণে সেই বাড়ি থেকে বেরুবার চেষ্টা করলাম।

অন্ধকারে আর হঠাৎ ভৌতিক পরিবেশে প্রথমে আমার বাইরে যাবার দরজা খুঁজতে অসুবিধা হলেও একসময় কোনোক্রমে দরজা খুলে ছুট দিলাম। আমার এরকম অবস্থায় তাদের হাসির উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। আমি জল-কাদা পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটছি, আর পেছনে ছুটে আসছে জ্বলন্ত চারজোড়া চোখ আর খলখল করে তাদের কানফাটা হাসির শব্দ। সেই ভাবে ছুটতে ছুটতে কতটা পথ অতিক্রম করেছিলাম জানি না। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলাম আমি সারাদেহে জলকাদা মাখা অবস্থায় ভিজে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছি কোনো এক ক্লাবঘরের দাওয়ায়। জনা-দশেক লোক আমাকে শুশ্রূষা করছে। কেউ ভিজে গামছা দিয়ে আমার মুখে হাওয়া করছে। কেউ পায়ের তলায় দু-হাত দিয়ে ক্রমাগত ঘষে চলছে। জ্ঞান ফিরে জানতে পারলাম আমি নাকি খুব প্রাণে বেঁচে ফিরেছি। গতদিনের ঝড়বৃষ্টির রাতে আমাকে মৃত এই বনের বিট অফিসারের আত্মা তার পরিত্যক্ত বাংলোয় নিয়ে গিয়েছিল প্রাণে মেরে ফেলার জন্য। তারা বলল, এমনই এক ঝড়-জলের দিনে ওই বিট অফিসারের বাংলোয় বাজ পড়ে দুই পুত্র সহ স্বামী স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন। সেদিন থেকে প্রায়ই যেদিন এরকম ঝড়-জলের রাত হয় তাদের অতৃপ্ত আত্মা নিরিহ, অজানা, বিপদে পড়ে থাকা পথচারীদের তাদের সঙ্গী করার জন্য আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে তার বাংলোয় নিয়ে আসে। এভাবে অনেকেরই প্রাণ গেছে।

সেদিনের পর থেকে যখনই দিনেরবেলা এই রাস্তা ধরে যাই ,দেখতে থাকি রং-চটা, প্লাস্টার খসা দেওয়ালে  গাছগাছালি গজিয়ে থাকা ভূত বাংলোটা আমাকে দেখে কেমন আড়চোখে তাকায়, আর নিঃশব্দে হাসতে থাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ