আকাশের মেঘ বেশি ঘন করে এসেছে। এদিকে ভূষণবাবু দ্রুত পা চালালেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। সামনে একটা ঘন জঙ্গল পেরিয়ে তবে নিজের বাড়ি মোঙ্গলদা গ্রাম। প্রতিদিনই তার ফিরতে দেরি হয়ে যায়। আজ একটু বেশি দেরি হয়ে গেল। হঠাৎ করে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে লাগতেই তার চলার গতি দ্বিগুণ হয়ে গেল।
কিন্তু লক্ষ্য করলেন আশেপাশে কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। তাই কাকভেজা হয়ে তিনি জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলেন। পাতার ফাঁকে যেটুকু বৃষ্টি ফোটা গায়ে লাগে তাতে অবশ্যই খুব একটা সমস্যা হবে না। কিন্তু যেভাবে আঁধার করে এসেছে, রাস্তার পথটুকু ভালো করে দেখা যায় না। কিছুদূর এগিয়ে তিনি দেখতে পেলেন পথের পাশে সেই মাথাভাঙ্গা মন্দিরটা। আদিকাল থেকে সেটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অনেকেই বলে সেখানে নাকি অশুভ শক্তির বাস। একটা সময় ওখানে নিয়ম করে পুজো-অর্চনা হতো। একদিন সেখানে পুরোহিতকে মেরে ফেলে মন্দিরের গয়না নিয়ে পালায় একদল দুষ্কৃতী। তখন থেকে গ্রামের মানুষ এই জায়গাটাকে এড়িয়ে চলে। সন্ধ্যার পর কেউ এই পথে পা মাড়ায় না।
আজ হঠাৎ করেই এত সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার পরও ভূষণবাবু বাধ্য হয়ে এই পথটাতে আসতে বাধ্য হলেন। মাথাভাঙ্গা মন্দিরটা দেখে তাঁর বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো। ভাবলেন, জানি না কী কপালে আছে।
একটু দূর যাওয়ার পরে হঠাৎ করে একটা খুব জোরে একটা শব্দ করে বাজ পড়ল। তিনি চমকে উঠলেন, মন্দিরের দিকে ফিরে দেখলেন সেটার ভেতরে একটা প্রদীপ জ্বলছে। তিনি বেশ অবাক হলেন, এই পরিত্যক্ত মন্দিরে এরকম রাতের বেলা বৃষ্টির মাঝে এখানে কে প্রদীপ জ্বালাতে এসেছে। তিনি আর সাহস করে এগোলেন না, সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লেন ।
হঠাৎ দেখলেন মন্দিরের ভেতর থেকে ২৪-২৫ বছরের একটি বউ বেরিয়ে আসছে, মাথায় রাঙ্গা সিন্দুর, মুখে উদ্ভাসিত আলো। ঠিক যেন কোনও লক্ষী প্রতিমা। তার মনে একটু ভক্তির সঞ্চার হল। তিনি মনে করলেন এটি নিশ্চয়ই কোনও দেবী। তিনি কাছে গিয়ে প্রণাম করে শ্রদ্ধাভরে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে মা ? আর এই আঁধার বেলা বৃষ্টির মাথায় নিয়ে এখানে কি করছো?
বউটি কিছু বলল না। তাঁর দিকে একটু মিষ্টি হাসি হেসে আবার বনের উল্টো পথে চলে গেল ।
ভূষণবাবু সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না? মনের কৌতূহল মনের ভেতর চাপা পড়ে রইল। তিনি দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়িতে ফিরে তাঁর বউকে সব ঘটনা বিস্তারিত জানালেন। তাঁর বউ বললেন, যে তুমি মায়ের দর্শন পেয়েছ কাউকে এ কথা জানিও না ।
সেদিন রাতে ভূষণবাবুর ভীষণ জ্বর এলো। জ্বর আর মাথা ব্যথা। গ্রামের মধ্যে কোনও ভালো ডাক্তার নেই। সেই শহরে যেতে হয় চিকিৎসার জন্য। তাই গ্রামের ছেলেরা তাঁকে শহর নিয়ে যাবার উপক্রম করল। কিন্তু সব বিফলে গেল। সে-রাতেই ভূষণবাবু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
ভূষণবাবুর স্ত্রী রাতের ঘটনাটা গ্রামের মানুষদের জানালেন। গ্রামের মানুষ বললেন, ওটা কোনও দেবীর স্বরূপ ছিল না, নিশ্চয়ই কোনও ডাকিনী। তাই ওই পোড়ো বাড়ির বা ভাঙ্গা মন্দিরের কাছে কেউ যায় না। ধীরে ধীরে এই কথাটা পুরো গ্রামে চাউর হয়ে গেল। এই ঘটনার পর আরো কয়েকদিন পার হয়ে গেল ।
হঠাৎ করে একটি আট দশ বছরের মেয়ে বল খেলছিল। বলটা একটা ঝোঁপের আড়ালে চলে গেলে সে বলটা আনতে যায়। কিছুক্ষণ পর মেয়েটির চিৎকার শুনে গ্রামের মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়। তারপরে মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত দেহ তারা উদ্ধার করে। ওইটুকু ফুটফুটে মেয়ের এরকম মর্মান্তিক মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারল না।
কিন্তু ঘটনা হচ্ছে যে সামনের জঙ্গলে কোনও হিংস্র পশু থাকতো না। হ্যাঁ, কদাচিৎ কোনও শেয়ালের ডাক শোনা যায়। কিন্তু গ্রাম সংলগ্ন মাঠে এসে কোনও শেয়াল একটা বাচ্চা মেয়েকে এভাবে জখম করতে পারে না। তাই গ্রামের মানুষ কিছু সদুত্তর না পেয়ে এটাকেও ডাকিনী এসে করেছে, এটাই রটে যায়। গ্রামে একটার পর একটা দূর্ঘটনা ঘটতে থাকে।
একবার স্কুলের মাস্টার মশাই কিছুদিন কিছু ছেলে নিয়ে মাঠের মধ্যে খেলার আয়োজন করেছে। ছেলেদের খেলা যখন জমে উঠেছে হঠাৎ করে জঙ্গলের ভেতর থেকে শাঁখের শব্দ শোনা গেল। তারপরে কাঁসর-ঘন্টা বেজে উঠল। যেন ভাঙ্গা মন্দিরে পুজো হচ্ছে। ছেলেরা বেশ আশ্চর্য হল। তারা বাড়ি ফিরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করল যে মন্দিরে নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটনা ঘটছে, যার জন্য ভূষণবাবু বা ফুটফুটে মেয়েটির এরকম মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এর থেকে রক্ষা পাবার উপায় কেউ তো জানে না।
0 মন্তব্যসমূহ