চাকরির চিঠি পেলে কার না আনন্দ হয়! তাও আবার ব্যাঙ্কের চাকরি, কিন্তু পোস্টিং বালিচরা ব্রাঞ্চ। নামটা পড়ে কেমন দমে গেলাম। এই নামে কোনো জায়গা থাকতে পারে এটা আমার জানা ছিল না।
আমায় চিন্তা করতে দেখে বোন টিপ্পনী কাটল, “এতদিন শুনিসনি। এবার শুনলি, জি কে (জেনারেল নলেজ) বাড়ল তোর। পরের পরীক্ষাতে কেউ তোকে আটকাতে পারবে না”।
পাগলি একটা! ব্যাঙ্কের চাকরি পেয়ে গিয়েছি, আবার অন্য চাকরি কেউ খোঁজে? কিন্তু তার আগে জানতে হবে ওখানে কিভাবে যাবো! ঠিকানা আছে নদিয়া জেলা। ইউরেকা! কৃষ্ণনগরে বড়ো পিসি থাকে, নিশ্চয় ওখান থেকে বেশি দূর হবে না।
পিসির বাড়ি থেকে করিমপুরের বাসে চেপে বসেছি। বাসযাত্রা আর শেষই হচ্ছে না, এরপরে আবার ভ্যানোতে উঠতে হবে। ভ্যানোর যাত্রাও একসময় শেষ হল, কিন্তু ব্যাঙ্কের টিকি দেখা গেল না | সহযাত্রীদের দেখলাম বালি খাদানে নেমে হনহন করে হাঁটতে লাগল। আমিও নামলাম, এবং পা স্লিপ করে গড়িয়ে পড়লাম।
ঠিক তখনই আওয়াজ শুনলাম, “পঁড়েছে, পঁড়েছে, জালে পঁড়েছে”।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কেউ নেই । কানের কাছে কে যেন বলল, “এঁ হেঁ-হেঁ-হেঁ সাঁরা গাঁয়ে বাঁলি নেঁগেছে। ওঁরে হেঁবো ঝাঁড়নখান নিঁয়ে আঁয়, বাঁবুর জাঁমা-প্যাঁন ভাঁলো কঁরে ঝেঁড়ে দেঁ।
কে যেন আমার আগাপাশতলা ঝাড়তে লাগল। যত বলি থামো, থামো, ততই ঝাড়পিট বাড়তে থাকে। বালিতে চোখ কিচকিচ, দাঁত খিচখিচ করতে লাগল। বিভীষিকা, মরীচিকা দেখছি। এমন সময় একজনকে আসতে দেখলাম। এতক্ষণ যারা কথা বলছিল, তাদের দেখতে পাইনি। সামনে যে তাকে দেখতেও পেলাম, কথাও শুনতে পেলাম।
“নমস্কার স্যার, আমি শিবুকান্ত দাস। আপনি নিশ্চয় আমাদের বালিচরা ব্রাঞ্চের নতুন স্টাফ! গ্রামের লোকের কাছে শুনে আপনাকে নিতে এলাম। একি! আপনি ছাতা আনেনি? আসুন আমার ছাতার তলায় আসুন”।
“না, মানে আমি ছাতা এনেছি। কিন্তু—
“ও! বুঝেছি। হেবো, লবাদা বাবুর ছাতা দিয়ে যাও”।
এসব কি কান্ড রে বাবা! হেলতে দুলতে ছাতা এসে ধরা দিল আমার হাতে, “বাঁবু কঁমলি ছাঁতা নুঁকিয়ে রেঁখিছিল। দিঁইছি তুঁলে আঁছাড়”।
পরপর ঘটনার ঘনঘটা, চড়া রোদ-গরম! ব্রাঞ্চে ঢুকেই মাথাটা ঘুরে গেল। বেঞ্চিতে শুইয়ে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে জ্ঞান ফিরল। শিবুদা ম্যানেজারকে বলল, “আজ আর অচিদাকে কিছু করতে হবে না। হেবো, লবাদা খুব নাচিয়েছে”।
“ঠিক আছে অচি, তুমি আজ সবার কাজ দেখো”।
“স্যার আমার নাম অর্চিষ্মান”।
“আরে ও তো অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারে। আমাদের কাছে তুমি অচি, তোমার আপত্তি না থাকলে কচি বলেও ডাকতে পারি, বলে হা-হা- করে হাসলেন”।
“ছাঁর, আঁসবো?”
এ কে? ভূ—ত? আমার বিষ্ফারিত চোখ দেখে বলল, “আঁপনি যাঁ ভাঁবচেন আঁমি তাঁ লঁয়, নঁতুন এঁয়েচেন তাঁই দেঁখতে অ্যাঁলাম"।
সবাই কেমন অদ্ভুত।
ইনকাম ট্যাক্সের জয়েনিং লেটার পেয়ে দু’বছর পর ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসি। আসার আগে রঙিন ছাতা, পুতুল দিয়েছিলাম কমলিকে।
কমলি খুব খুশি হয়ে বলেছিল, “ব্যাঁঙবাবু তুঁমি খুঁব ভাঁলো। আঁমার সাঁথে খেঁলা কঁরবে?”
আসার দিন শিবুদা বলে দিয়েছিল হাজার ডাকলেও যেন পিছন ফিরে না তাকাই, তাহলে ওই বালিচরার ঘূর্ণিতে ঘুরে মরতে হবে। অনেকদিন আগে নাকি একজন স্টাফ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল।
এখন আমার মনে হয় বালিচরা ব্রাঞ্চটা ভূতের ব্রাঞ্চ নয়তো! হয়তো কর্তৃপক্ষ জানেই না ব্রাঞ্চ ছিনতাই করেছে বালিচরার ভূতবাহিনী। নাহলে লাঞ্চে রোজ শুঁটকি মাছ হয়? সকলে বলে, “খুঁব ভাঁলো রেঁধেছ মাঁসি, খাঁসা হঁয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ