রাজ্যের নাম নন্দনপুর। ছোট্ট রাজ্য। নন্দনপুর রাজ্যে সেনাপতির নাম গম্ভীরা সিং। সেনাপতি ভীষণ জাঁদরেল লোক। গম্ভীরা সিং সেনাপতি হওয়ার পর থেকেই রাজ্যে চুরি ডাকাতি লোপ পেয়েছে।
গম্ভীরা সিং তাই রাজদরবারে গোঁফে তা দিতে দিতে বলেন: "আমার ভয়ে রাজ্যে চুরি ডাকাতি বন্ধ। সব চোর ভয়ে রাজা ছেড়ে পালিয়ে গেছে । সেনাপতি মশাইয়ের চেহারাও সাংঘাতিক। যেমনি লম্বা তেমনি চওড়া আর তেমনি গোঁফ। সেই গোফে তিনি অনবরত তা দেন। চোরদের কাছে তিনি যেন সাক্ষাৎ যম।
গম্ভীরা সিং তাই রোজ রোজ দরবারে বড়াই করেন: “বড় চোর তো নেই-ই, এমন কি রাজ্য থেকে ছিঁচকে চোরগুলো পর্যন্ত ভয়ে পালিয়ে গেছে। রক্ষীরা এখন রাতে পাহরা দেবার বদলে নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়। এসব কার জন্যে জানেন ? আমার জন্যে। আমার জন্যে বাঘে গরুতে একখাটে জল খায় মশায় !”
সেনাপতিমশাইয়ের বড়াই শুনে রাজামশাই মাথা নেড়ে বলেন : হ্যাঁ তা তো বটেই।
মন্ত্রীমশাই মুচকি হেসে বলেন, "আপনার যা চেহারা ঠিক বাঘের মতো, চোরেরা তো ভয় পাবেই- আমরাই মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে যাই।
মন্ত্রীমশাইয়ের কথা শুনে রাজদরবারের সকলেই হেসে উঠলেন। সেনাপতি গম্ভীরা সিং গম্ভীরভাবে গোঁফে তা দিতে লাগলেন ।
আসল কথা হলো—রাজ্য থেকে চোরেরা বিদায় নেয়নি, তারা অবস্থা বুঝে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে মাত্র। তাদের দু'একজন রাজদরবারেও ছিল অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ।
চোরের দলের সর্দার পুঁটিরাম যেমনি চালাক তেমনি দেখতে সুন্দর। সে শুধু সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছিল কি করে জাঁদরেল সেনাপতিটাকে জব্দ করা যায় । পুঁটিরাম ছদ্মবেশে রাজদরবারে বসেছিল। অবস্থা বুঝে কি কি ব্যবস্থা নেওয়া যায়—সে বসে বসে তার ফন্দি আঁটছিল ৷ ছদ্মবেশী পুঁটিরাম সব শেষে মুচকি হেসে বললো, “চোর নেই বলেই যে ভবিষতে চুরি হবে না এমন কোনো কথা নেই । তা ছাড়া বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা হওয়াও খুব আশ্চর্য কিছু নয় ।”
সেনাপতিমশাই ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “তার মানে ? ”
পুঁটিরাম মুচকি হেসে বললো, “মানে কিছু নেই, এমনিই বলছিলাম ।”
আগেই বলেছি পুঁটিরাম তার দলবদল নিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। পুঁটিরাম চোর—চুরির সম্পত্তি নিয়ে নদনপুরের কাছাকাছি গণেশপুরে বণিক সেজে বাস করত। কিন্তু তার আসল ব্যবসা ছিল চুরি-ব্যবসা ।
পুঁটিরাম সত্যি সত্যিই একদিন সুযোগ পেয়ে গেল ।
নন্দনপুরে আবার অসম্ভব রকমের চুরি শুরু হয়ে গেল। চুরির কুলকিনারা না করতে পেরে সেনাপতিমশাই তেলেবেগুনে জ্বলতে লাগলেন ।
রোজই তিন চারটে করে চুরির খবর পাওয়া যেতে লাগলো। চুরিগুলি অভিনব ।
মন্ত্রীমশাই সেদিন রাজদরবারে বসে সেনাপতিমশাইকে বললেন, “চোরগুলো আর আপনাকে মোটেই ভয় করছে না ।"
সেনাপতিমশাই কোনো কথা বললেন না, রাগে জ্বলতে জ্বলতে মুখ দিয়ে শব্দ করলেন, “হুম । "
ছদ্মবেশী পুঁটিরাম রাজামশাইকে বললেন, 'চুরি বন্ধ করতে না পারলে রাজ্যে ধনপ্রাণ নিয়ে বাস করা মুশকিল। রক্ষীবাহিনীরা রাতে পাহারা দিচ্ছে না মনে হয় । অথবা পাহারা দিতে গিয়ে ঘুমুচ্ছে।”
রাজামশাই গোবেচারা লোক। পুঁটিরামের অভিযোগ শুনে তিনি সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভাল নয়, ভাল নয়—এ চুরি বন্ধ করুন। নইলে প্রজাদের কাছে লজ্জায় মুখ দেখানো যাবে না ।
সেনাপতিমশাই রাজাকে বললেন, “আপনি কিচ্ছু ভাববেন না, আমি অবি- লম্বেই চোরদের ধরে সাংঘাতিক শান্তি দেওয়ার বাবস্থা করছি। আর সৈন্যদের হুকুম দিয়েছি. রক্ষীদের ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলেই যেন নাক কেটে নেওয়া হয়।” রাজামশাই গালে হাত দিয়ে ভাবতে ভাবতে বললেন, “কিন্তু চুরি অনেক হল, আজ পর্যন্ত একটা চোরও ধরা পড়লো না ।"
মন্ত্রীমশাই মুচকি হেসে বললেন, “সেনাপতিমশাইয়ের রক্ষীবাহিনী অবশ্য একজন নিরীহ ভিখিরীকে ধরে নিয়ে এসেছিল-কিন্তু চুরির কোনো অপরাধই প্রমাণ করতে পারেনি।”
সেনাপতিমশাই চুপ করে রইলেন। আবহাওয়া খারাপ। সময় খারাপ হলে ব্যাঙেও লাথি মারে। সেনাপতিমশাইয়ের সেই দোর্দণ্ড প্রতাপ আর নেই। রক্ষীবাহিনীর লোকেরা আগে সেনাপতিমশাইকে দেখলে সমীহ করতো, এখন মুচকি হাসে। বলা বাহুল্য, সেনাপতিমশাইয়ের গিন্নী ও সেনাপতিমশাইকে ঠাট্টা করেন কারণ ইতিমধ্যে খোদ সেনাপতিমশাইয়ের বাড়ীতেই দু'বার চুরি হয়ে গেছে।
সেনাপতি-গিন্নী বললেন, “তোমাকে নিয়ে চোরেরা ঠাট্টা করতে আরম্ভ করেছে। অথচ খুবই বড়াই করে বলতে : তোমার ভয়ে চোরেরা সব রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গেছে। সেজন্যই বলা হয়, অতি বাড় ভাল নয় ।
“অতি বাড় ভাল নয়
ঝড়ে পড়ে যায়,
অতি ছোট হ'লেও যে
ছাগলে মুড়ে খায় ।”
গিন্নীর ঠাট্টা-তামাশা সেনাপতিমশাইয়ের ভাল লাগে না । তিনি নিজেও আজকাল ঘোড়ায় চড়ে টহল দেন— রক্ষীবাহিনীও পাহারায় ব্যস্ত, অথচ তার মধ্যেই চুরি হচ্ছে। দিনে চিন্তা, রাতে ঘুম নেই। সেনাপতি মশাইয়ের বিরাট বপুর আগের মতো আর জৌলুস নেই। সেনাপতিমশাই গোঁফে তা দিতে ভুলে যান। আগের মতো আর তেমন হম্বি-তম্বি নেই । মাঝে মাঝে শুধু বলেন, “একবার চোরদের ধরতে পারলে এমন শিক্ষা দেব !”
মন্ত্রীমশাই পরদিন দরবারে এসেই বললেন, রাজামশাই, সর্বনাশ হয়েছে।”
রাজামশাই বললেন, “কি হয়েছে ?”
মন্ত্রীমশাই বললেন,“কাল রাত্রে আমার বাড়ীতে চুরি হয়ে গেছে। আমার এতদিনকার সঞ্চয়—সব গেছে।”
রাজামশাই মাথা চুলকে বললেন, “ভীষণ ভাবনার কথা। তাই তো ! ” পরের দিন আরও দুঃসংবাদ । খোদ রাজবাড়ীতেই চুরি । এত পাহারাদার এত রক্ষী,—কিন্তু তবু শেষ রক্ষা করা গেল না ।
সেনাপতিমশাই দরবারে এসে সব শুনে বললেন, “সব ষড়যন্ত্র, সব ষড়যন্ত্র !”
মন্ত্রীমশাই বললেন, “এমন জাঁদরেল সেনাপতি থাকতে যদি এই অবস্থা হয় -তবে উপায় কি ?”
সেনাপতি মশাই বললেন, “আমি থাকতে চোরেরা এটাকে চোরের মুলুক বানাবে, এ আমি সহ্য করব না।”
সেনাপতিমশাই ক্রোধে অস্থির হয়ে কোষ থেকে তরোয়াল খুলে নিয়ে চোরের উদ্দেশে এগোতে লাগলেন।
সেনাপতিমশাই বেরিয়ে যাবার পর মন্ত্রীমশাই রাজাকে বললেন, “শুধু সেনাপতি মশাইয়ের উপর নির্ভর করে থাকা আর চলে না। অবশ্য ওঁকে দোষ দেওয়াও চলে না, উনি চেষ্টার কোন ত্রুটি করছেন না, তবু আমার মনে হয় বিদেশ থেকে একজন গোয়েন্দা আনা দরকার । ”
রাজামশাই বললেন, “আমিও সেই কথাই ভাবছি।”
কয়েক দিনের মধ্যেই বিদেশ থেকে একজন গোয়েন্দা আনা হলো । গোয়েন্দার নাম প্রবীরকুমার। তিনি রাজ্যের চারিদিকে বিভিন্ন ছদ্মবেশে ঘুরতে লাগলেন। বলা বাহুল্য, সেনাপতি মশায়ের অগোচরেই তাঁকে রাখা হলো । জানাজানি হলে সেনাপতিমশাই মনে দুঃখ পাবেন। তিনি ভাববেন, রাজা তাঁর উপর আস্থা রাখতে পারছেন না ।
প্রবীরকুমার বলেন, "আমি অনেক সূত্র পেয়েছি, আশা করি দু'দিনের মধেই বামালশুদ্ধু চোর ধরতে পারব।”
কিন্তু পরদিন এক অটন ঘটলো। মন্ত্রীমশাই রাজামশাই দরবারে উপস্থিত। সেনাপতিমশাই গোঁফে তা দিতে দিতে দরবারে ঢুকে বললেন, “একটা চোরকে পাকড়াও করে এনেছি। লোকটা কয়েকদিন থেকেই আমার বাড়ীর আশেপাশে সন্দেহজনক অবস্থায় ঘুরছিল।
একটু পরেই সেনাপতিমশাইয়ের রক্ষীবাহিনী বদ্ধ অবস্থায় চোরকে রাজ- সভায় হাজির করল।
বলা বাহুল্য, সে চোর আর কেউ নয়, সেনাপতিমশাই ভুল করে গোয়েন্দা প্রবীরকুমারকেই চোর বলে ধরে এনেছেন।
রাজার ইঙ্গিতে প্রবীরকুমারকে ছেড়ে দেওয়া হলো। সেনাপতিমশাই রাজার আচরণে খুবই ক্ষুব্ধ হলেন। এতদিন পরে যাও বা একজনকে ধরা হলো, তাকেও ছেড়ে দেওয়া হলো ?
অবশ্য কিছু পরেই প্রবীরকুমারের প্রকৃত পরিচয় পেয়ে তিনি খুবই লজ্জিত হলেন।
প্রবীরকুমার বললেন, “চোর ধরতে হ'লে এখনই আমার সঙ্গে সৈন্য নিয়ে চলুন ।”
রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতিমশাই সকলেই সৈন্য নিয়ে প্রবীরকুমারকে অনুসরণ করে চললেন।
“একি! এ যে সেনাপতির বাড়ী ।”
প্রবীরকুমার বললেন, “এই বাড়ীর চারপাশ ঘিরে রাখতে হবে। তবেই চোর বা চোরাই মালের পাত্তা পাওয়া যাবে।”
সেনাপতিমশাই বললেন, “তার মানে ? আমার বাড়ী ঘেরাও ?"
প্রবীরকুমার হেসে বললেন, “বাঘের ঘরেই ঘোগের বাসা হয়।”
প্রবীরকুমারের কথাই সত্যি প্রমাণিত হলো। অবশ্য সেনাপতিমশাইয়ের কোনো দোষ নেই। তিনি নিজেও জানতেন না যে তাঁর বাড়ীতেই চোরের আড্ডাখানা। তাঁর শ্যালক শ্ৰীমান সোহন সিংই চোর-সর্দার পুঁটিরামের সঙ্গে যোগ-সাজস করে রাজ্য জুড়ে আনায়াসে চুরি ব্যবসা চালিয়েছে ।
সেনাপতিমশাই সকলের বাড়ী তল্লাসী নিয়েছেন, কিন্তু নিজের বাড়ী তল্লাসী নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নি। অথচ তাঁর বাড়ীরই একাংশে চোরের আড্ডাখানা। পুঁটিরাম সোহন সিংয়ের অন্যতম বন্ধু। আর সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার সোহন সিংয়ের চেহারাটা অনেকটা গম্ভীরা সিংয়ের মতোই। সেনাপতি গম্ভীরা সিং যখন রাতের বেলা নিজের বাড়ীতে বিশ্রাম গ্রহণ করতেন, তখন সোহন সিং গম্ভীরা সিংয়ের পোশাক ব্যবহার করতেন, এবং জায়গা বিশেষ থেকে রক্ষীদের অন্যত্র সরিয়ে রাখতেন। আর সেই সুযোগে পুঁটিরাম তার দলবল নিয়ে চুরি করতো। চোরাই মাল এনে জমা হতো সেনাপতি মশাইয়ের বাড়ীতেই !
সেনাপতিমশাইয়ের বাড়ীতেও দু' দুবার চুরি হয়েছে। বাড়ীর একাংশ থেকে অপর অংশে সে চোরাই মাল জমা হয়েছে ।
সেনাপতিমশাই নিজের শ্যালকের এ ধরনের আচরণে খুবই লজ্জিত হলেন ।
তিনি গোঁফে তা দিয়ে বললেন, “আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল যে, বাইরের চোরের কোনোমতেই এত সাহস হতো না।”
মন্ত্রীমশাই মুচকি হেসে বললেন, " শেষে বাঘের ঘরেই যোগের বাসা !”
গোবেচারা রাজামশাই ব্যাপার দেখে হতবাক্ । খোদ সেনাপতির শ্যালক যে চোরদের একজন চালক এ যে ভাবাই যায় না ।
সেনাপতিমশাই নিজেই শ্যালকের গায়ে থুথু দিয়ে বললেন, “ছিঃ ছিঃ ছিঃ।”
0 মন্তব্যসমূহ