গোবর্দ্ধন সত্যই যেন পাগল হয়ে উঠেছেন।
চীৎকার করেন, ছুটাছুটি করেন, হাতে থাকে এক গাছা ঝাঁটা। প্রলয় কাণ্ড বাধিয়ে তোলেন তিনি। উন্মাদের মত ছুটাছুটিতে পা বেধে উল্টে যায় বাক্স-বিছানা, জলভরা কলসীটা ছিটকিয়ে বহু দূরে গিয়ে পড়ে—ভেঙ্গেও যায়৷
কাছে এগিয়ে যেতে সাহস কারও নাই—স্ত্রী মাতঙ্গিণী গালে হাত দিয়ে রান্নাঘরের বারান্দায় বসে, ছেলে মেয়েরা সবাই একটা ঘরের দরজা আধ ভেজানো ক'রে সভয়ে তাকাচ্ছে গোবর্দ্ধনের দিকে।
গর্জন করছেন গোবর্দ্ধন, “সব মেরে ফেলব—একধার হতে ডিম বাচ্চা ধাড়ি—একটা কাউকে আস্তো রাখব না। বেরিয়ে আয়, এবার একবার বেরিয়ে আয় বলছি, দেখি কে হারে কে জেতে!”
কাউকেই দেখা যাচ্ছে না, শত্রু একেবারে অদৃশ্য।
এ রকম অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়া সম্ভবপর নয়। নারকেল কাঠির ঝাঁটা সবেগে আন্দোলিত হয়, কিন্তু শত্রু পলাতক।
.রান্নাঘরে যুদ্ধের চিহ্ন পরিস্ফুট—ভাত তরকারী ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত। গোবর্দ্ধনের ভাতের খালা ছিটকে পড়েছে ভাতের হাঁড়ির উপরে, মাটির হাঁড়ি সঙ্গে সঙ্গে শতধা এবং হাঁড়ির ভাত অর্দ্ধেকের বেশী গেছে উনানের মধ্যে—ছাইয়ের সঙ্গে মিতালি করেছে—সে ভাত তরকারী আর কাউকে খেতে হবে না। রান্নাঘর দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এই মাত্র এখানে একটা দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেছে। বাসন পত্র চারিদিকে ছড়ানো, জলের বালতি উল্টানো, চারিদিক জলে থই থই করছে।
মাতঙ্গিণী স্বামীর হাত ধরে তাঁকে থামবার অনুরোধ করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু এক ধাক্কায় তাঁকে সম্মুখ হতে দূরে সরিয়ে দিয়ে দরজার পাশ হতে ঝাঁটাটি নিয়ে সবেগে বার হয়ে পড়েছেন গোবর্দ্ধন ঘটক। এ অত্যাচার আর সহ্য হয় না। মানুষ তো তিনি, গায়ে রক্ত মাংস আছে, হাত পা চুল সবই আছে। এই হাত পায়ের আঙ্গুল, মাথার চুলগুলো পর্যন্ত যারা কুরে কুরে খায়, তাদের বাধা দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন তিনি, কিন্তু সে সবই হয়েছে ব্যর্থ। অবশেষে খাদ্য দ্রব্যের উপর আক্রমণ-আর কত সহ্য করা যায়?
ছোট প্রাণী—স্ত্রী বলেন, আহা অবোলা প্রাণী, থাক্ না দু' চারটে, ওরা এমন কি ক্ষতি করবে? কিন্তু ক্ষতি কে কতখানি করে, স্ত্রী-বুদ্ধিতে তিনি তা বুঝতে পারেন না বলেই জানতে চান না। তেলা পোকা—এর নাম যে কে দিয়েছে আরসুলা তার ইতিহাস আজ পাওয়া যায় না। ঘরে দোরে নিঃসঙ্কোচে ঘুরে বেড়ায়”—অবশ্য পায়ের উপরই কেবল মাত্র নির্ভর করে না, মাঝে মাঝে পক্ষ মেলে পাখীর মত উড়ে বেড়ায়। আচমকা গায়ে এসে বসলে কেবল ঘৃণায় নয়,- ভয়ে বিরক্তিতে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। করকরে পা যুক্ত প্রাণীটা গা হতে সরে না যাওয়া পর্যন্ত গায়ের শির্ শিরানী থামে না।
রাত্রে মশারি না ফেলে শোয়ার উপায় নাই। অতিরিক্ত গরমে যে দিন মশারী ফেলা না হয়, তারপর দিন সকালে উঠে দেখা যায়—আঙ্গুলের আগাগুলি কুরে কুরে খেয়েছে — হাতের ব্যথায় কোন কাজ করা যায় না। মাথার চুলের গোড়ার দিক পালিশ করে কেটেছে। মাথায় হাত দিলে কাটা চুল হাতে উঠে আসে।
এর পর খাদ্য সামগ্রীর উপর আক্রমণ।
কোন কিছু রাখার উপায় নাই। আলু, বেগুণ, মাছ, ভাত কিছুই বাদ দেয় না। বর্তমানে আক্রমণ চলেছে কাগজ-খাতা-বইয়ের উপরে। এতকাল জানা ছিল কাগজ, খাতা বই, ইঁদুরেই কাটে—সেদিন একেবারে হাতে হাতে ধরা পড়ে গেছে—এ ওই ক্ষুদ্র জীবেরই কীর্তি।
অফিসের হিসাবপত্র সব কেটে দিয়েছে—এখন সাহেবের কাছে কৈফিয়ৎ দেবেন কি। তেলাপোকায় কেটেছে এ কথা বলা চলে না,—বলতে গেলে সাহেব সেই মুহূর্তে সামনের দরজা দেখিয়া দেবেন।
জামা কাপড় কিছু আস্ত নাই। নূতন আদ্দির পাঞ্জাবীটার পঞ্চাশ জায়গায় ছোট ছোট গর্ত। সেদিন বৃষ্টির জন্য ছাতা মাথায় দিয়ে আফিসে যাওয়ার সময় চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেছে। সমস্ত ছাতায় অসংখ্য ছিদ্র।
সন্ত্রস্ত চোখ চারিদিকে ফিরান গোবর্দ্ধন ঘটক। স্ত্রীকে ধমকান, ছেলেমেয়েদের চড় চাপড় দেন—কেন তারা তেলাপোকা মারে না!
বড় মেয়ে দশ বছরের ননী ফুঁপিয়ে কাঁদে, “বাঃ, ওদের ধরা যায় নাকি! মারতে গেলেই সর্ সর্ করে কোথায় লুকায়, নয় তো মাথার ওপর দিয়ে উড়ে কোথায় পালায়, মারব কি করে?” মাতঙ্গিণী সরোষে বলেন, “সংসারের কাজ কর্ম এবার শিকেয় তুলে রেখে তেলাপোকা খুঁজে বেড়াই। তোমার অসহ্য হয়—অফিস কামাই করে তেলাপোকা মারো—আমার অত সময় নেই।”
গোবর্দ্ধন দাঁতের উপর দাঁত রেখে বলেন, “সময় করতে হবে। নিজে না পারো—ছেলে মেয়েদের দিয়ে কাজ চালাবে। ওই নোংরা জীব, আদাড় আস্তাকুঁড়ে যাদের বাস,—তারা এসে খাবারে মুখ দেবে আর সেই খাবারই আমাদের খেতে হবে—ওতে যত রোগ আছে সব ধরবে যে। এর পর মরবে টি-বি হয়ে। আর ক্রনিক ডিজিজের উপযুক্ত নাম খুঁজে না পেয়ে একটু থেমে বলে যান—“ধরবে বাত, কলিকপেন—ধরবে সায়টিকা,—বুঝবে তখন। যাকে আজ অবহেলা করছো, সে কি ভীষণ, কি মারাত্মক!”
তবুও মাতঙ্গিণী নিজের জিদ ছাড়েন না, “আমি এই সংসার ঠেলে তোমার ওই তেলাপোকার পেছনে ঘুরতে পারবো না, পষ্ট কথা বলে দিচ্ছি। আর এই তুচ্ছ কারণে তুমি ছেলেমেয়েদের যে মারধর করছো—ওদের ইস্কুল নেই—পড়া নেই? সব ফেলে এখন তেলাপোকাই খুঁজে বেড়াক—কেমন?”
রাগে গোঁ গোঁ করেন গোবর্দ্ধন ঘটক।
যাক! কাউকে দরকার নেই, তিনি নিজেই মারবেন তেলাপোকা।
অফিস হতে ডি, ডি, টি এনে ঘরে ছড়ান। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে দেখেন সেই ডি, ডি, টি, গুঁড়ার উপর দিয়ে তেলাপোকা চলে যাচ্ছে, তারা মরছে না।
হতাশ ভাবে তিনি বলেন, “নাঃ, বেবাক জাল—কোয়াইট জাল। ডি, ডি, টি, নকল হয়েছে দেখছি—আচ্ছা রহেনে দেও—আমি অন্য উপায় দেখছি।”
শয়নে, স্বপনে, আহারে, বিহারে, অফিসে, ভ্রমণে, চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায় কদাকার তেলাপোকার দল। ফলে রাত্রে ঘুমের ঘোরে দেখতে পান সহস্র তেলাপোকা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তাঁর চোখ কান নাক কিছুই নাই।
মাতঙ্গিণী মুখ মুচকে হাসেন। বলেন, “একটা মাদুলি নাও, তোমার এই তেলাপোকাতঙ্ক রোগটা দূর হোক। শুনেছি পাগলা কুকুরে কামড়ালে লোকের জলাতঙ্ক ব্যারাম হয়— তেলাপোকার কামড়ে দেখছি তোমার এই তেলাপোকাতঙ্ক রোগ হয়েছে। শুনেছি কোন এক বুড়ো শিবতলায় সব আতঙ্ক দূর করবার মাদুলি পাওয়া যায়। কাল তুমি অফিসে গেলে আমি ছুটেছি সেই বেলেঘাটায়। কিছু না খেয়ে ভিজে কাপড়ে ওষুদ এনে রেখেছি। আজ তুমি চানটা করে নাও, গলায় বেঁধে দিই।”
কালো ডোরে বাঁধা মাদুলিটার পানে তাকিয়ে তেলে বেগুণে জ্বলে উঠলেন গোবৰ্দ্ধন। মাতঙ্গিণীর হাত হতে মাদুলিটা কেড়ে নিয়ে তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন বাড়ীর বাইরে— একেবারে কর্পোরেশানের রাস্তায়। একটি মাত্র কথা না বলে অস্নাত অভুক্ত অবস্থায় চলে গেলেন অফিসে এবং রাগ করে সারা দিনটা কিছু না খেয়ে কাটিয়ে দিলেন।
কিন্তু এমন করেই বা কয়দিন কাটানো যায়?
কাল রাত্রে মশারীর মধ্যে ঢুকে তাঁকে একেবারে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। রাত একটায় উঠে - দাপাদাপি করে ঘর শুদ্ধ সকলের ঘুম ভাঙিয়েছেন। ছোট এক বছরের মিনি পর্যন্ত জেগে গেছে এবং পিতার সেই ভয়াবহ মূর্তি দেখে কাঁদবার কথা পর্যন্ত তার মনে হয় নি।
সেই মুহূর্তে আবিষ্কার করেছেন নারকেলের কাঠির ঝাঁটা। আশ্চর্য, আর কিছু হাতের কাছে না পেয়ে সেই ঝাঁটাটাকেই অস্ত্র স্বরূপ ব্যবহার করেছেন তিনি এবং তার এক ঘা খেয়েই বেচারা তেলাপোকার ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে।
এই প্রথম একটি শিকার।
আট দশ দিন হতে স্ত্রীর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ, উপলক্ষ্য এই তেলাপোকা। ঝাঁটা আবিষ্কার করে ছেলেমেয়েদের সগর্বে বলে দিলেন, “এই দেখ, বেশী কষ্ট করতে হবে না তোদের। এই ঝাঁটা দিয়ে একটি ঘা বসাবি-তেলাপোকার দফা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। ঝাঁটাটা সর্বদা কাছে রাখ-বি, তেলাপোকা দেখতে পেলেই ছুটে গিয়ে বসাবি—আর দেখতে হবে না।”
ছেলেমেয়েদের জিম্মায় ঝাঁটা রেখে তিনি তাড়াতাড়ি স্নান করে রান্নাঘরে খেতে গেছেন। স্ত্রী আসনের সামনে ভাত তরকারী দিয়ে উনানের তরকারী দেখছেন। থালার উপর একটা এবং আশেপাশে আর তিনটি তেলাপোকা—দল বেঁধেই এসেছে তারা ইতিমধ্যে।
“ননী, টেনা, ভ্যানা–ঝাঁটা নিয়ে আয়, চট করে ঝাঁটাটা—”
বলতে বলতে সদর্পে তিনিই ঝাঁটা আনতে ছুটলেন। মানুষের সাড়া পেয়ে তেলাপোকারা শুড় শুড় করে সরে যায়।
ঝাঁটা হাতে ফিরে আসেন গোবর্দ্ধন, কিন্তু তেলাপোকা তখন লুকিয়েছে।
কিন্তু যাবে কোথায়? একটা নয়, দুইটা নয়, চারটা তেলাপোকা। পাকা একটা গণ্ডা।
সদম্ভে আতিপাতি করে খোঁজেন গোবর্দ্ধন। হাঁড়ি কলসী উল্টান, পা লেগে ভাতের থালা সোজা চলে যায় ভাতের হাঁড়িতে। রীতিমত দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়,—কিন্তু পাওয়া যায় না একটাকেও। মাতঙ্গিণী একেবারে স্তব্ধ, ছেলেমেয়েরা পিতার মূর্ত্তি দেখে একটা ঘরে লুকিয়েছে৷ ঝাঁটাটা তাদের উপর পড়াও বিচিত্র নয়।
পাওয়া গেল বারান্দার পাশে দুইটিকে। একটিকে আঘাত করবার সঙ্গে সঙ্গে অপরটি পাখীর মত ডানা মেলে উড়ে যায়।
কিন্তু যাবে কোথায়! গোবর্দ্ধন ঝাঁটা হাতে তার পিছনে দৌড়েছেন একেবারে বাইরের রাস্তায়।
রামচাঁদ তেওয়ারী পথ দিয়ে চলতে চলতে এই দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ায়। পরিচিত লোক সে, তাই বাধা দেয়, “এ গোবরধন বাবু, আপলোক বাউরা হো গিয়া—বিলকুল বাউরা। ঘুম যাও বাবু, ঘরমে ঘুম যাও, তামাসা মাত দেখাও।”
তাকান গোবর্দ্ধন। এর বার তেওয়ারীর পানে তাকিয়ে কোন কথা না বলে ভিতরে প্রবেশ করেন। তারপর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ধপ করে রান্নাঘরের বারান্দায় ঠিক মাতঙ্গিণীর পাশেই বসে পড়েন৷
তেলাপোকাটা দ্রুত উড়ে তেওয়ারীর পিঠে আশ্রয় নিয়েছিল তিনি লক্ষ্য করেছিলেন—কিন্তু মারা গেল না —
একেবারে হাতের কাছে পেয়েও তাকে ছেড়ে দিতে হল।
নিঃশব্দে থাকেন মাতঙ্গিণী, কোন দিকে তিনি তাকিয়ে থাকেন কে জানে।
আশপাশের ঘরের লোকেরাও তো এই কথাই বলে—গোবর্দ্ধন বাবুর মাথা খারাপ হচ্ছে, এই বেলা চিকিৎসা করানো দরকার।
জনে জনে একথা শুনায় এবং সেইজন্যই তিনি বেলেঘাটা হতে মাদুলি সংগ্রহ করে এনেছিলেন। সেটা গলায় বাঁধলে নিশ্চয় তেলাপোকাতঙ্ক সেরে যেতো।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে গোবর্দ্ধন হাতের ঘড়ির পানে তাকিয়েই লাফিয়ে উঠলেন। অফিসের সময় হয়েছে—আর দেরী করা চলবে না।
এতক্ষণে রান্নাঘরের পানে তাকিয়ে তাঁর অনুতাপ হয়। ছি ছি, তেলাপোকা মারার জন্য তিনি এ করেছেন কি! নিজে খেতে পেলেন না, ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত খেতে পাবে না, রাঁধা ভাত তরকারী নষ্ট করেছেন। তেল, লবণ, মসলা, জল সব একাকার করেছেন।
কাতর ভাবে তিনি হাত দু'খানা কচলান। কাতর কণ্ঠে বলেন, “আমার তো আর দাঁড়াবার সময় নেই মাতংগ, আমি অফিসে চলছি। তুমি একটু কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের না হয় খিচুড়ীই করে দাও। এত বেলায় আবার ভাত ডাল রাঁধতে পারবে না। আর দেখ—”
দুই পা এগিয়ে আসেন তিনি, চাপা সুরে বলেন, “তোমার এত কষ্ট করে আনা মাদুলিটা অগ্রাহ্য করে ছুঁড়ে ফেলা আমার বড় অন্যায় হয়েছে। আজ তো আর হবে না, কাল তুমি আর একবার কষ্ট করে বেলেঘাটায় গিয়ে আর একটা মাদুলি এনো। তবে একটু হাতে পায়ে ধরো তাঁদের—যাঁরা মাদুলি দেন—তাঁদেরকে বলো—গলায় না বেঁধে আমি বরং হাতে বাঁধব। গলায় কালো কারে বাঁধা মাদুলি যদি হঠাৎ কারও বিশেষ করে সাহেবের চোখে পড়ে-বড় লজ্জার কথা হবে। বলো কিন্তু—ভুলো না যেন।”
মাতঙ্গিণী নির্বাকে তাঁর পানে তাকান, কোন কথাই বলেন না।
0 মন্তব্যসমূহ