আমাদের গ্রামের নাম সুবর্ণ ডাঙা। এই গ্রামে একটা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। বিদ্যালয়ের নাম আমাদের গ্রামের নামেই সুবর্ণডাঙা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। আমাদের সময়ে একাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রমই চালু ছিল।
তা আমাদের স্কুলটা ছিল বাড়ির থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূর।
অবশ্য একটা 'সর্টকাট' রাস্তা আছে কবরখানার ভিতর দিয়ে। সেইখানে আছে অতি পুরাতন এক জীর্ণ বিশাল বটবৃক্ষ। আছে কিছু নিমগাছ, বনফুলের ঝোপঝাড় এবং কিছু দুই -তিন হাত উঁচু বিছুটির গাছ।
ওখানে দিনের বেলায়ই গা বাঁচিয়ে চলতে হয়। রাতের বেলায় তো কথাই নেই। ওঁনারা মানে ঐ অশরীরীরা বটের ডালে বসে পা ঝুলিয়ে দিব্বি নাকী সুরে গান গান। তা আশপাশের লোকজন এইসব দেখেছেন ও শুনেছেন। সন্ধ্যা হতে -না-হতেই ও অঞ্চলের জানালা-দরজা ঝুপঝাপ বন্ধ হয়ে যায়।
এই বছর আমাদের স্কুলের 'সিলভার জুবিলী'! বার্ষিক অনুষ্ঠানটা খুব ঘটা করে হবে ।শহর থেকে নামী-দামী কণ্ঠ শিল্পী যণ্ত্র শিল্পীরা আসবেন।
আমি কোনোবারই ফাংশনে যাই না।
এবার ঠিক ক'রেছি যাবো। কারণটা এ-বছর একটা নতুন সাথী পেয়েছি। অমল। চাকরির খাতিরে ওর বাবা এই গ্রামে বদলী হ'য়ে এসেছেন। অমল শহুরে ছেলে এবং খুব চটপটে। ও ভূত-ফুত মোটেও মানে না।
অমলের পকেটে সবসময় একটা সিগারেট জ্বালানোর 'লাইটার' থাকতো। আমার কেমন জানি সন্দেহ হতো! পরে অবশ্য জেনেছিলাম, ও'লাইটার দিয়ে ধূপকাঠি জ্বালায়। দেশলাই-এ অতটা সড়গড় নয়।
* * * * * *
১৫-ই ডিসেম্বর ফাংশানের দিন।
আমি আর অমল একটু আগেভাগেই গিয়ে স্কুলে পৌঁছোলাম।
রাত বারোটা। ফাংশান শেষ। বাইরে বেরোলাম। একটু শীত-শীত করছে। আবার টিপির-টিপির বৃষ্টিও শুরু হয়েছে।
অমলকে বললাম- অমল,কী করবি?
-কী আর করবো! কবরখানার ভিতর দিয়ে 'সর্টকাট'-এ চটজলদি পৌঁছে যাবো। অমলের চটপট জবাব।
-আমার তো ভয় করছে রে!
-ভয় আবার কী।
-দু'জনে ধীরে- ধীরে কবরখানার রাস্তা ধরলাম।
কবরখানার কাছে আসতেই বৃষ্টিটা বেশ জোরে শুরু হ'ল।
-চল্, এই বটগাছের নিচে দাঁড়াই।-অমল ব'লল।
-তবে,তাই দাঁড়াই!
দু'জনে বটগাছের নিচে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির থেকে মাথা বাঁচানোর জন্য।
আমাদের মাথার ঠিক উপরের ডালটা থেকে, হঠাৎ একটা ক্ষীণ কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলাম- আমার মনে হচ্ছে, তোমাদের এক জনের কাছে সিগারেট জ্বালানোর'লাইটার'আছে।
অনেকক্ষণ এই ডালে বসে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছি। আর বিড়িটা ও নিভে গেছে। তা একটু যদি আমার বিড়িটা জ্বালিয়ে দাও, আমার খুবই উপকার হয়।
আমি আশ্চর্য হয়ে অমলকে জিজ্ঞেস করলাম- ও কীভাবে জানলো যে তোর কাছে 'লাইটার' আছে?
-ও ব্যাটা আন্দাজে ঢিল মেরেছে!
অমল এগিয়ে গিয়ে'লাইটারটা জ্বালাতেই, আমি স্পষ্ট দেখলাম গাছের ডালে কোনো লোকই নেই। সব হাওয়া! শুধু সুতোয় বাঁধা একটা আধপোড়া বিড়ি গাছের ডালে ঝুলছে।
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পড়ি-কি-মরি দৌড়! আর চেঁচাতে লাগলাম-অমল! পালা! পালা!
সোজা ঘরে এসে মূর্চ্ছা গেলাম।
পরের দিন সকালে জেগে উঠলাম।
দেখি,অমল পাশে বসে আছে। ওকে সবিস্তারে সব ব'ললাম।
সেদিন স্কুল ছুটি ছিল। পাড়ার বন্ধুদেরও পুরো ঘটনাটা বললাম। ওরা বললো- তোরা খুব ঝুঁকি নিয়েছিলি। জানিস না, গত পরশু এই পাড়ার খগেন ঘরামী ঐ গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা ক'রেছে। ওর একটাই সখ ছিল বিড়ি খাওয়া।
যাই হোক, তোরা খুব বেঁচে গেছিস!
0 মন্তব্যসমূহ