সন্ধ্যায় বড় মামাকে নিয়ে গল্পের আসর বসিয়েছে ওরা দুই ভাই বােন। দীপ আর দীপা। দীপ বয়েসে খুব ছােট। আর দীপা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ঘরে হাত গুটিয়ে বসে ফলাফলের অপেক্ষা করছে। তাই তার হাতে এখন অখন্ড অবসর। আর এই অবসরটুকুর সদ্ব্যবহার করার জন্য সে তার এই গাল্পিক, আড্ডাবাজ আর রসিক বড়মামাটিকে ওদের বাড়িতে আসবার জন্য অনুরােধ করেছিল। তার মামা প্রিয় ভাগ্নির কথা উপেক্ষা করতে পারেন নি।
বয়সের দিক বিচার করলে দীপার থেকে দ্বিগুণ বয়সের হলেও মামার সঙ্গে তার একটা স্নেহপূর্ণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে । দীপার যত কথা পেটে জমে থাকে তার
এই প্রিয় মামাটি এলেই সে পেট খালি করার জন্য মুখে যেন খই ফোটায় ।
দীপার মামা পেশায় সাংবাদিক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেন। দুই একটা বইও ছাপা হয়েছে তার। অত্যন্ত আড্ডাপ্রিয় আর গল্পপাগল এই মামাটিকে কাছে পেল তাই ওরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায় ।
গল্পের আসর বেশ জমে উঠেছে। গায়ে কাঁটা দেওয়া একটা ভূতের গল্প বলছেন মামা। এটা নাকি তার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ভৌতিক অভিজ্ঞতা।
দীপা গল্পের ভেতরে এমনভাবে ডুবে আছে যে, কখন তার মা বাবা পাশে এসে বসেছেন গল্প শুনতে, তা খেয়ালই করেনি। এই
গল্প শেষ হতেই দীপা তার পাশে বাবাকে এবং ভাইয়ের পাশে মাকে দেখে বলল-
মা, বাবা, তোমরা কখন এলে এ'ঘরে?
দীপার মা বললেন- তোর এই পাগলা মামাটা যা শুরু করেছে এখানে, তাতে আর রান্নাঘরে থাকতে পারলাম না।
দীপা হেসে বলল- আমি জানতাম, তুমি মামার গল্প শুনতে না এসে পারবেই না। কারণ মামার গল্প শোনার জন্য তোমারও লোভ কম নেই। অযথা মামাকে আর পাগলা বোলো না।
মামা বললেন- দীপা, তোর মায়ের কথা বাদ দে। চালুনি বলে সুঁচ তোর পেছনে কেন ছ্যাঁদা? আমি যদি তোদের সাথে গল্প করে পাগলা হই, তাহলে তোর মা কী, তাই একবার জিগ্যেস করে নে আগে। তোর মায়ের কাছে গল্প শোনার জন্য ছোটবেলায় আমিই পাগল ছিলাম। এত ভাল ভাল গল্প জানে তোর মা। কিন্তু আমি ভাবছি, তোর বাবার মত একজন নিরস মানুষও শেষপর্যন্ত....
দীপার বাবা ঈষৎ হেসে বললেন, তোর মামা যেখানে যায় সেখানেই ভূত ওর পিছু লেগে থাকে, তাই আমার সন্দেহ প্রকৃত পক্ষে তোর মামাটাই একটা ভূত কিনা। শেষে না এই মামা ভূতটাই তোদের ঘাড় মটকে দেয়, তাই...
আসলে যতই রঙ তামাশা হােক না কেন, গল্পের প্রতি আবালবৃদ্ধবণিতা সকলেই একটা মােহ থাকেই। তা যদি কোনো সুদক্ষ গাল্পিকের মুখে বর্ণিত হয় আর সেটা যদি ভৌতিক গল্প হয় তাহলে তো কথাই
নেই। আশপাশের সমস্ত কানই উতকর্ণ হয়ে উঠবে শোনার জন্য। বাবার কথার মর্মার্থটা উপলব্ধি করেই বোধ হয় দীপা মামাকে বলল- মামা, তুমি এতক্ষণ তোমার জীবনের ঘটনা বলে যে গল্পটা বললে সেটা
কি আসলে সত্যি? নাকি তুমি বানিয়ে বানিয়ে...
মামা সে কথার কোনাে জবাব দিলেন না, শুধু কৌতুকমাখা একটা মুচকি হাসি হাসলেন।
বাবা বললেন, সত্যি মানে তোর মামাই তো সত্যিকারের একটা ভূত। যাকে বলে, মামাভূত।
মা হেসে বললেন- গল্পে অনেক রকম ভুতের নাম আছে- গেছোভূত, মেছোভূত, নেঁকোভূত, পেত্নিভূত বেহ্মদত্যিভূত- কিন্তু...
বাবা সােৎসাহে বললেন-হ্যাঁ, আর তার সাথে আজ নতুন এই ভুতের নামটাও জুড়ে দাও- মামাভূত।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
দীপা প্রসঙ্গ পাল্টালাে।
-আচ্ছা মামা, তুমি যে এত ভুতের গল্প বলো, লেখো- তোমার ভয় করে না ? যখন
রাতে একাকী চলাফেরা কর কিংবা শুয়ে থাকো। তখন ঐসব মনে পড়লে ভয় করে না ? অামার তো ভূতের গল্প শুনতে খুব ভাল লাগে কিন্তু পরে খুব ভয়ও করে ঐ সব মনে পড়লে।
মামা মুচকি হেসে বললেন- ভয় কিরে? গল্প তো গল্পই।
দীপা বলল, ধর, আজকে যে গল্পটা বললে, এই ভূতটাই যদি রাতে জানালা পথে হাত বাড়িয়ে তোমার চুলের মুঠি ধরতে আসে? আমার তো ভাবতেই ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে গায়ে ! তোমার ভয় করবে না?
বাবা বললেন- ভয় করবে না মানে, তোর মামার বিছানাগুলাে তাহ'লে পরদিন সকালে তােরই ধুয়ে...
কথা শেষ না করেই হো হো করে উঠলেন।
মামা তার জামাইবাবুর চোখের দিকে চেয়ে দেখলেন একবার। তারপর বললেন- অনেক তো ভূতের গল্প বলেছি কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি আজ পর্যন্ত। সত্যিই যদি গল্পের মিথ্যে ভূত সত্যিভূত হয়ে আসে তখন কি হবে জানি না।
প্রসঙ্গ পাল্টে দীপার মাকে উদ্দেশ্য
করে বললেন- দিদি, রাত তো বেশ হয়েছে। এবার খাবারের ব্যবস্থা কর। খুব খিদে পেয়েছে।
দীপার বাবা বললেন - হ্যাঁ, যাও।
-তােমরাও চল না।
-কেন? তুমি খাবার রেডি কর গে। আমরা আসছি।
-আমি বাপু একা একা রান্না ঘরে যেতে পারবাে না।
মামা বললেন - আমি যাচ্ছি, চল—দীপা
দীপ- তোরাও চল।
দীপা আর দীপ দুই ভাইবােন একই খাটে ঘুমোয়। কিন্তু আজ রাতটা মাকেও তাদের সাথে ঘুমোতে হচ্ছে। কারণ ঐ ভুতের ভয়।
সবাই ঘুমিয়ে গেছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে হঠাৎ দীপার মামা চিৎকার করে উঠলেন। ঘুম ভেঙ্গে গেল সবার। তাহলে কি সত্যি সত্যি ভয় পেলেন তিনি?
-কি হয়েছে মামা? মা, মামার রুমে চলো তাে। মামা কোন কথা বলছো না কেন?
দীপার উচ্চস্বরে দীপেরও ঘুম ভেঙে গেল। ওরা মামার শোয়ার ঘরে যাবার জন্য দরজা খুলছে।
এমন সময় মামা বলে উঠলেন- দীপা, এদিকে আয় শিগগীর।
ওরা সভয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল মামার ঘরে।
- কী হয়েছে রে? দীপা ও তার মায়ের মুখে ভীতিভরা কৌতুহল।
মামার চোখে তখন কৌতুকের ঝিলিক ৷
- দীপা, দিদি, দেখ, রাতের সেই গল্পের ভূতটা সত্যি হয়ে আমার চুলের
গােছা ধরে টেনে ভয় দেখাতে এসেছিল। কিন্তু ভূতকে ভয় দেখাবে ভূতে? আস্তো ভূতটাকেই ধরে ফেলেছি।
মা মেয়ে সত্যিকারের ভূতটাকে জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিনে নিল সহজেই। মামা শক্ত করে তার কব্জি ধরে আছেন।
দীপা সবিস্ময়ে বলল, বাবা, তুমি এসেছো ভূত সেজে মামাকে ভয় দেখাতে?
মামা বললেন--দিদি, তােমার সেই ভূতের তালিকার মামা ভূতের নামের শেষে এই বাবাভূতের নামটাও জুড়ে দাও!
মা হেসে বললেন- আজ একা শুতে গিয়ে তাহলে এই ফন্দি এঁটেছে শালাবাবুকে ভয় দেখাবার?
মামা দীপাকে বললেন- দীপা, তাহলে এবার বুঝতে পেরেছিস আমি কেন ভূতের ভয় পাই না!
দীপা ঘাড় কাত করল হাঁ সুচক।
মামা আবার বললেন—এতদিন তােদের অনেক মিথ্যে ভূতের গল্প শুনিয়েছি। এবার একটা সত্যি ভূত ধরে দেখাতে পেরেছি বলে খুব ভাল লাগছে। অবশ্য এই চতুর ভূতটাকে ধরতে আমার অনেক কৌশল
অবলম্বন করতে হয়েছে। একটু হলেই পালিয়ে যেত আর কি?
বলে মামা হাসলেন।
দীপ এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল। এবার কি বুঝে সে চেঁচিয়ে বলে উঠল -ছড়া বলার ভঙ্গিতে—বাবাভূত সত্যিভূত, মামাভূত মিথ্যে ভূত! বাবাভূত সত্যিভূত, মামাভূত মিথ্যে ভূত!
মামা হেসে বললেন—কি জামাইবাবু? আপনার ছেলেই বলে দিচ্ছে, কে সত্যি ভূত, মামা না বাবা!
সবাই হাে হাে করে হেসে উঠল।
0 মন্তব্যসমূহ