সবে তখন চাকরিতে যোগ দিয়েছি। একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টের শিক্ষানবিস। কর্মস্থল মুম্বাই। আর চষে বেড়াতে হত সারা পশ্চিম ভারতের আনাচে কানাচে। কোম্পানির নাম-ডাক দুনিয়ার অন্যতম সেরা পাম্প সাপ্লাইকারক হিসাবে।
সময়টা বিগত শতকের শেষ। টুরগুলি ট্রেনে করেই হত। যেখানে সেখানে গোলমাল হলেই তলব পড়ার সাথে সাথেই দৌড়ে যেতে হত। মূলতঃ যেতে হত কলকারখানায়। আর বলাই বাহুল্য সে জায়গাগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাম্প বর্জিত স্থান।
পাম্প বলে-কয়ে খারাপ হয় না। তাই যখন তখন ডাক আসত। খুবই পরিশ্রমের চাকরি। কিন্ত চ্যালেঞ্জের। ভালই লাগছিল। অনেক নতুন জায়গা দেখা, আর থেকে থেকে স্থানীয় ভাষা, বিশেষ করে মারাঠী বেশ ভালোই রপ্ত করে ফেলেছিলাম।
চাকরির তখন দুই তিন বছর হয়ে গেছে। পুজোর ঠিক পরে পরেই সকালে অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম, রাতে শোলাপুর যেতে হবে । এক চিনিকলের পাম্প বিগড়েছে। আর সেই পাম্প চার মাস আগে আমরাই বসিয়ে এসেছি ।
বেলা এগারোটা নাগাদ অ্যাডমিনের নিকিতা জোশী, ফোন করে জানালেন, এসি তে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না । ততদিন আমি একা একাই যেতে শুরু করেছি , আর জায়গাটি আমার চেনা। নিকিতা জানাল দুইটি অপশন । এক, এসি বাসে সারারাত জার্নি। অথবা, সিদ্ধেশরী এক্সপ্রেস করে স্লিপার ক্লাসে যাওয়া। তখন এমন কিছু গরম ছিল না, আর বাস জার্নি ক্লান্তির। তাই রাতের ট্রেনেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সে সময় ট্রেন বুকিং কম্পিউটারের মাধ্যমে হলেও, বাড়ি বসে হত না। টিকিট কাউন্টার থেকেই কাটতে হত।
যাইহোক ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে, টুকটাক জিনিসপত্র নিয়ে, সারারাত ঘুমানোর বাসনা নিয়ে দাদর স্টেশন থেকে নটা নাগাদ গাড়িতে চাপলাম। সাইড লোয়ার এর আসন। যেটা আমার পছন্দের নয়। উপরের বাঙকের ছোট ছেলেটি বেশ তাড়াতাড়ি উঠে গেলেই, আমি লম্বা ঘুম দিলাম নিচের বাঙকে। চাদর মুড়ি দিয়ে। শহর ছাড়তেই খোলা জানলা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঘুমের দেশে নিয়ে গেল।
রাত কটা হবে আন্দাজ নেই। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক মুখের ওপর এসে যা বলছিল, তার মর্মার্থ হল, এই সিটটি তার। উঠে বসতে হল। ট্রেনের বাকি লোকজন আলো নিভিয়ে ঘুমের দেশে। আমার উপরের আলোটি আগে থেকেই জ্বলছিল না । অবশ্য হাল্কা চাঁদের আলো কামরাটিকে ভাসিয়ে দিয়েছিল।
দাবিদার ভদ্রলোকের বয়স ষাটের উপরে। স্থানীয়দের মতন বেশভূষা, সাদা ফতুয়ার নিচে খাটো ধুতি। মাথায় গান্ধী টুপি। এক গ্রাম্য মারাঠী মানুষ। বারকয়েক টিকিট মিলিয়ে দেখলাম। একই সিট নাম্বার। PNR নাম্বার আলাদা। আমার টিকিট দাদর থেকে, আর রাজারাম কুনতের দৌনড থেকে। দুজনেরই গন্তব্য শোলাপুর।
ট্রেন ইতিমধ্যেই ছেড়ে দিয়েছিল। এদিক ওদিক খুঁজে চেকারবাবুর পাত্তাই পাওয়া গেল না। আরোও চার ঘন্টার রাস্তা। কি আর করা যাবে, বাপের বয়সী লোকটিকে তো বলা যায় না যে নিজের রাস্তা দেখুন। তাই বাকি সময়টা সিট শেয়ার করেই কাটিয়ে দেওয়ার ঠিক হল। রেল কোম্পানির নিন্দা করেই ঝিমোতে ঝিমোতে শোলাপুর পৌছে গিয়েছিলাম। রাজারাম ছেলের কাছেই থাকেন। ছেলে দৌনড স্টেশনের ইলেকট্রিকাল সুপারভাইজার। রাজারাম যাচ্ছেন তার মেয়ের বাড়িতে, আদরের নাতনীর জন্মদিন পালনে।
ট্রেনে বসেই ঠিক হয়েছিল যে শোলাপুর নেমেই এইরকম ঘটনা কি করে ঘটল তা জানা । তাও আবার কম্পিউটার থেকে। ট্রেন থেকে নেমে খানিক আনমনা হয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম, পিছনে ফিরে দেখি, রাজারাম ভ্যানিশ। হঠাৎই মনে হল, প্রতারক নয় তো ? রোখ চেপে গেছিল, সোজা স্টেশন মাস্টার-এর আফিসে। খুলে বলতে, প্রথমেই অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টার। আমিও নাছোড়। শেষমেষ রফা হল, আটটার পর রিজার্ভ টিকিট কাউন্টার খোলার পর দেখা যাবে ।
সেদিন কেন জানি না, খুবই তাড়াতাড়ি কাজ মিটে গিয়েছিল। সামান্য একটু প্রবলেম, যা চিনিকলের লোকজন ধরতে পারছিল না। অফুরন্ত সময়, খাওয়াদাওয়ার পর লোকাল এক পরিচিত কে নিয়ে স্টেশনে হাজির হয়েছিলেম। স্টেশন মাস্টার অবশ্য আশা করেনি যে আমি আবার ফিরে আসব।
বুকিং কাউন্টারের ইনচর্জকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। এসে খানিক টাকা টালবাহানা করে তিনি ব্যাপারটা দেখে যা জানিয়েছিলেন তাতে চোখ কপালে উঠার জোগাড়। রাজারামের টিকিট ছিল বটে, কিন্তু দিন পাঁচেক আগে তা বাতিল করা হয়েছিল। তার মানে জালিয়াতি !
হঠাৎই মনে পড়েগেছিল রাজারামের ছেলের কথা। সে ও তো রেলের কর্মচারী। জানানো মাত্র হটলাইনে ফোন। দৌনড স্টেশনে।
বিস্ময়ের আরো বাকি ছিল। এ কথা সত্য যে রাজারামের টিকিট কাটা ছিল। নাতনীর জন্মদিনের জন্য শোলাপুর আসার। কিন্ত দিন কুড়ি আগে কুয়ো থেকে জল তোলার সময় হার্ট অ্যাটাকে রাজারামের মৃত্যু হয়েছিল। আর দিন পাঁচেক আগেই তার ছেলে নিজে গিয়েছিল টিকিট বাতিল করতে।
সেই রাতে এসি কামরার আপার বার্থে শুয়ে ফেরার পথে দু চোখের পাতা এক করতে পারিনি।
0 মন্তব্যসমূহ