অমিত আর ঈশান দুই বন্ধু। তারা দুজনেই মাঝে মাঝে সাইকেলে চেপে ঘুরতে বেরোয়। ওদের পাশের গ্রামের নাম লোচনপুর। সেখানে রয়েছে অনেক পোড়ো বাড়ি। সন্ধ্যার সময় অবসরে তারা দুই বন্ধু প্রায় সেখানে ঘুরতে যায়। গ্রামটি একদম নির্জন, জনমানবহীন। নামে মাত্র দু-একটা ছোটো-বড়ো বাড়ি আছে। আর আছে অনেক দিনের পুরোনো বেশ কয়েকটি ইয়া বড়ো সাইজের মান্ধান্তা আমলের পুকুর। সেইসব পুকুরে আছে বিশাল আকারের মাছ, বিষাক্ত সাপ। অনেক পুরোনো হওয়ায় কেউ সেখানে কখনও স্নান করে না। সবাই পুকুরগুলো এড়িয়ে চলে। আসলে একটা গা ছমছমে ব্যাপার আছে কি না! তাই নিত্য পথযাত্রীরাও এই জায়গাটিকে যত দ্রুত সম্ভব পরিত্যাগ করে চলে।
অমিত আর ঈশান, ওদের তেমন ভয় নেই। তাই কখনও কখনও এই কয়েকটি পুকুরের যে কোনও একটির পাড়ে বসে দুই বন্ধু মিলে আড্ডা দেয়। এমন একটা সুন্দর নিরিবিলি গা ছমছমে জায়গায় তাদের বসে থাকতে বড্ড ভালো লাগে।
দিনকয়েক আগে তারা একটা অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিল। সেটাই তো আসল গল্প।
সময়টা ছিল শীতকাল। শীতের সন্ধ্যার মিষ্টি আমেজ। তারা দুই বন্ধু অন্যদিনের মতো একসাথে ঘুরতে বেরিয়েছিল। সুন্দর মাটির রাস্তা, বড়ো বড়ো গাছেদের সারি, হনুমানের হুপ হুপ শব্দ শুনতে শুনতে তারা যখন বিরাট পোড়ো বাড়িটার সামনে এসে পৌঁছাল তখন আকাশে মেঘেদের সারি সারি নৌকো ভেসে চলেছে। বাঁশবনে কাকেদের একটানা চিৎকার এখানকার পরিবেশকে বেশ মুখরিত করেছিল। হঠাৎই ঈশানের চোখ পড়ল বাড়িটির পিছনে কী যেন একটা দৌড়ে পালালো। তারা ভাবলো শেয়াল-টেয়াল হবে হয়তো! এই জায়গাটিতে শেয়াল, বেঁজি, গন্ধগোকুল-এর অভাব নেই।
চারপাশের অনেক ঘাসজমি আছে। রয়েছে বেশ কিছু বড়ো বড়ো আমের বাগান, সুতরাং এখানে অনেক বন্য পশু থাকাটা অন্তত অবাস্তব কিছু নয়। তবে যাইহোক বিষয়টিকে তারা প্রথমে তেমন কোনও গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু একটু পরেই হাড়হিম শব্দে তারা চমকে উঠল।বাড়ির পিছন থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ আসছে। এ কোনো পরিচিত শব্দ নয়!
ব্যাপারটা কী ? এই ভেবে তারা দুজনেই আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে পিছনে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তারপর যা দেখল তা আর ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
ওদের দুজনের চোখে তখন স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কথা বলার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই।
একটু দূরেই একটা অদ্ভুতরকমের প্রাণী,ভয়ংকর তার চেহারা। কিছুটা মানুষের মতো। কিন্ত পুরো মানুষ নয়! হাতে-পায়ে বড়ো বড়ো নখ! মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল। টুকটুকে লাল চোখ । একটা মৃত শিয়ালের মাংস খুবলে খুবলে খাচ্ছে, আর ভয়ংকর আক্রোশের সাথে মুখে অদ্ভুতরকমের সব শব্দ করছে ! মনে হচ্ছে সে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে লাল রঙের আবিরের মতো রক্ত। আর একটা বিচ্ছিরিরকমের আঁশটে গন্ধে ভরে উঠেছে সেই নিস্তব্ধ পরিবেশ।
এমন দৃশ্য দেখে তাদের দুজনের মুখে কথা নেই। মনে হচ্ছে তারা এবার অবশ হয়ে যাবে।
এমন একটা ভয়ংকর প্রাণী এখানে কীভাবে এল? ভাবতেই তাদের পোড়োবাড়ির ভাবনা মাথায় এল। এখানে আসতে সবাই এই কারণেই বারণ করে তাহলে!
ভয়ংকর প্রাণীটা তাদের দুজনকে এখনও দেখতে পায়নি। নইলে হয়ত তাদের দুজনকেও তার পাকস্থলীর ভোজ্যবস্তুতে পরিণত হতে হত এতক্ষণ।
ঈশান আর অমিত চুপিচুপি সেখান থেকে এসেই প্রাণপণ সাইকেলে চেপে দিল ছুট। পিছনে ফিরে তাকানোর এখন সময় নেই। ভয়ংকর প্রাণীটা তাদের দেখতে পেলে যে একদম রক্ষে থাকবে না।
দৌড়, দৌড়, দৌড়...
তারা জোরে সাইকেল চালিয়ে কয়েক মিনিট মধ্যে বাড়ি পৌঁছে ভয়ে মূর্ছা গেল।
তারা এমন একটা খারাপ কিছু দেখবে কখনোই প্রত্যাশা করেনি।
তারপর জ্ঞান ফিরতেই একটু ধাতস্থ হয়ে ঈশান মাকে এ গল্প শোনাতেই মা তাকে খুব বকলেন। আর সেখানে যেতে বারণ করে দিলেন। বললেন ওই বাড়িগুলো খুব ভয়ংকর। খারাপ আত্মাদের সেখানে বসবাস। তাদের উপদ্রবের জন্যই তো সন্ধ্যার পর সেই রাস্তা দিয়ে চলবার কোনও জো নেই!
ঈশান মায়ের কথা শুনে ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। আসলে সেদিনের অভিজ্ঞতা তাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। তাই দুই বন্ধু কখনও আর সেই পোড়ো বাড়ি যায় না।
আসলে এমন বাড়িতে যেতে নেই। কারণ সেখানে গিয়ে সবাই ফিরে আসতে পারে না! তাদের ভাগ্য বড্ড ভালো ছিল, তাই তারা এই যাত্রায় বেঁচেবর্তে ফিরতে পেরেছে...
0 মন্তব্যসমূহ