Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

নিশি ।। ঐন্দ্রিল ভৌমিক

গ্রামের হাসপাতালে ডাক্তারি করতে এসে একটা গোটা বাড়ির মালিক হয়ে গেলাম। আমার কোয়ার্টারটা বেশ বড়সড়। কিন্তু বসবাসের পক্ষে সুবিধাজনক না।

হাসপাতাল থেকে প্রায় দুশো মিটার দূরে। চারদিকে ধানক্ষেত। হাসপাতাল আর কোয়ার্টারের মধ্যে একটা পায়ে চলা পথ। পথের দুধারে ঝোপঝাড়।

সিস্টারদের কোয়ার্টারগুলো হাসপাতাল লাগোয়া। ডাক্তার বলে মনে হয় অতিরিক্ত সম্মান দেখিয়ে কোয়ার্টারটা দূরে করা হয়েছে। অতিরিক্ত সম্মান যে কখনো কখনো বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।

ভেতরে ঢুকে আরও মন খারাপ হয়ে গেল। ছাদ থেকে প্লাস্টার খসে পড়ছে। বাথরুমের দরজা নেই। আমার সামনেই দুটো ধেড়ে ইঁদুর খাটের তলায় ঢুকে গেল।

গ্রুপ ডি স্টাফ মফিজুলদা মনটা আরও খারাপ করে দিলেন। বিকালে গল্প করতে করতে বললেন- রাতে কেউ ডাকলে চট করে ঘরের বাইরে বেরবেন না। আর বেরোলেও হাতে একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ রাখবেন।

জিজ্ঞাসা করলাম- কেন? সাপের ভয় আছে নাকি?

-সেতো আছেই। হেন বিষাক্ত সাপ নেই এই অঞ্চলে পাবেন না। কেউটে, গোখরো, কালাচ সব আছে। কিন্তু সেজন্য নয়। তার চেয়েও খারাপ জিনিস আছে।

-কী জিনিস?

মফিজুলদা বললেন- সন্ধ্যায় সেসব জিনিসের নাম উচ্চারণ না করাই ভালো। শুধু মনে রাখবেন, রাতে কেউ যদি ডাকে সে আমিই হোক, বা পেশেন্টের বাড়ির লোক- প্রথম তিনবার ডাকে সাড়া দেবেন না। মটকা মেরে পরে থাকবেন। চারবার ডাকলে তবে সাড়া দেবেন।

-মানে? এখানে ভূত প্রেতও আছে নাকি? এই একবিংশ শতাব্দীতেও এসব আমায় বিশ্বাস করতে হবে?

-বিশ্বাস করতে না চাইলে করবেন না। তবে কথাটা মাথায় রাখবেন। প্রথম তিনবার কোনো সাড়া দেবেন না।

হাসপাতালে প্রথম প্রথম কান্না পেতো। গোটা হাসপাতালে আমি একা ডাক্তার। সারাদিন রোগী দেখেও ছুটি নেই। রাতেও দু চারজন খারাপ রোগী হাজির হয়। বাড়ি যাওয়ার উপায় নেই। খুব দরকার হলে সাবডিভিশন থেকে কোনও ডাক্তারকে দুচারদিন ডিউটি করার জন্য অনুরোধ করতে হয়।

এক গরমের রাতে লো ভোল্টেজ। ঘামে বিছানা জব জব করছে। আধো ঘুমের মধ্যেই মহিলা কণ্ঠের আর্তনাদ শুনলাম- ডাক্তারবাবু, শিগগিরি আসুন। আমার ছেলেকে বাঁচান।

ঘুম ভেঙে বোঝার চেষ্টা করছি, সত্যি শুনেছি, নাকি মনের ভুল। তার মধ্যেই আবার সেই মহিলার আর্তনাদ- ডাক্তারবাবু, তাড়াতাড়ি। আমার ছেলে যে মরে যাবে।

আর শুয়ে থাকা যায় না। ‘আসছি’ বলে সাড়া দিয়ে গায়ে গেঞ্জি গলিয়ে বারান্দায় এলাম। কিন্তু কোয়ার্টারের সামনে ফাঁকা। কেউ নেই। আমি নিশ্চিত এক মহিলার কণ্ঠস্বর শুনেছি। মনের ভুল হতেই পারে না। মহিলা তাহলে কোথায় গেলেন? আমার সাড়া পেয়ে নিশ্চয়ই হাসপাতালে ছেলের কাছে ফিরে গেছেন।

রাস্তায় নামলাম। ঘুরঘুট্টে অন্ধকার। এক ফোটা হাওয়াও নেই। কী গুমোট আবহাওয়া।

হাসপাতালের সামনে এসে দেখি গেট বন্ধ। ভেতরেও আলোর চিহ্ন নেই। খারাপ পেশেন্ট থাকলে সিস্টার দিদি নিশ্চয়ই দরজা খোলা রাখতেন। আমারই তাহলে মনের ভুল।

চলে আসছি। হঠাৎই টর্চের আলোয় দেখলাম হাসপাতালের গেটের সামনে কি একটা পড়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখি কাঁথায় মোড়ানো সদ্যজাত শিশু। একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেছে।

আমিই চেঁচামেচি করে দরজা খোলালাম। সারারাত্রি বাচ্চাটাকে নিয়ে কেটে গেল। অক্সিজেন, গ্লুকোজ, এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন দেওয়ার পর ভোর রাত্রে বুঝলাম বাচ্চাটা আপাতত বিপদের বাইরে।

সিস্টার চা বানিয়েছেন। চা খেতে খেতে জিজ্ঞাস করলেন- আচ্ছা ডাক্তার ভৌমিক, আপনি জানলেন কী করে বাচ্চাটাকে কেউ হাসপাতালের সামনে ফেলে পালিয়েছে?

কী উত্তর দেব? নিশির গল্প সিস্টার বিশ্বাস করবেন? বললাম, আমি বাঁচাইনি, একজন মা ওকে বাঁচিয়েছে। কে ওর মা জানি না। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত জানি প্রতিটি শিশুর একজন মা থাকে। আর মা তার সন্তানকে যেভাবে হোক রক্ষা করবেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ