Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ভজুদার আবির্ভাব ।। কান্তি পি. দত্ত



। এক । 

ভজুদ৷ আমাদের কার্তিকপুরের ইয়ংম্যানস্ ক্লাবে আকস্মিক ভাবেই হঠাৎ একদিন এলেন, বসলেন—তারপর আমাদের মন জয় করে নিলেন । 

কিন্তু এই ভজুদাই বা কে ? কি করেই বা তিনি এলেন ? এবং কেনই বা এলেন আর কি কেরামতী দেখিয়েই বা আমাদের হৃদয় জয় করে নিলেন ! 

যারা ভজুদার সঙ্গে পরিচিত নন—তাঁরা এ ধরণের নানা প্রশ্ন অবশ্যই আমার উদ্দেশ্যে করতে পারেন। এবং তাদের পক্ষে এধরণের প্রশ্ন করাটাও অত্যন্ত স্বাভাবিক ৷ 

কৌতুহলী ব্যক্তিদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই—আমিও চেষ্টার কসুর করব না মোটেই । 

বলতে পারেন ভজুদাকে চিনিয়ে দেবার জন্য—আমারই এমন প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা কেন ? 

দেশ ও দশের কথা ভেবেই আশাকে এই প্রশান্তকর প্রচেষ্টা চালাতে হচ্ছে—কারণ ভজুদাকে না চিনতে পারলে - না জানতে পারলে আমাদের সকল জানা এবং সকল চেনাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার তেমন কোন মানেই হবে না ! 

বেশ কয়েকবছর আগে ভজুদাকে আমরাই কি জানতুম না চিনতুম ? তিনি অত্যন্ত দয়া পরবশ হয়ে আমাদের কাছাকাছি এসে উদয় না হ'লে—আমরাই কি অদ্বিতীয় ভজুদাকে জানবার বা দেখবার সুযোগ পেতুম ! ভজুদা নিজে থেকে এসে আমাদের কাছে ধরা না দিলে- আমরাই বা কি তাঁকে ধরতে পারতুম, না তাঁর ধারে কাছে ঘেষতে পারতুম । 

তাই বলে কেউ যে ভাববেন না, ভজুদা একজন ভূঁইফোড় ব্যক্তি আকাশ থেকেই তিনি হঠাৎ কার্তিকপুরে ইয়ংম্যানস্ ক্লাবের চৌহদ্দির মধ্যে ধপাস করে এসে পড়েছেন, আর আমরা ধপাস করে তাঁকে জাপ্টে ধরে ফেলেছি! ব্যাপারটা মোটেও তা নয়, মশাই ৷ 

ভজুদার বয়স যখন ত্রিশ বছর তখনই তাঁর সঙ্গে আমাদের প্রথম দেখা । অতএব ত্রিশ বছর বয়েসে কার্তিকপুরে তার প্রথম আবির্ভাব হলেও, এ পৃথিবীতে সেটাই প্রথম আবির্ভাব নয়। তিনি ত্রিশ বছর আগে এই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও জন্মেছেন, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছেন। 

এবং কার্তিকপুরের মতো গণ্ডগ্রামে ভজুদার মতো কোন মহান ব্যক্তি যে কখনও পদার্পন করবেন—আমরা তো কল্পনাই করতে পারিনি । স্বপ্নেও ভাবতেই পারিনি। তাঁর জীবনের ত্রিশ বছর পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর একদিন হঠাৎ কার্তিকপুরের মতো এক গণ্ড গ্রামে ভজুদার আবির্ভাব ঘটেছে! আমাদের ভজুদা সত্যিই পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্য বিশেষ, এ যাবৎকাল আমরা এই পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যর কথাই জানতুম, কিন্তু ভজুদা আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়ে প্রমাণ করলেন, এই পৃথিবীতে আরও আশ্চর্য্য আছে এবং তিনি স্বয়ং এই পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্য বিশেষ । অর্থাৎ ভজুদার সঙ্গে পরিচিত না হলে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্যের সঙ্গে আমাদের কোন পরিচিতিই ঘটত না! সেদিক দিয়ে আমাদের সকলকেই ভজুদাকে ধন্যবান জানাতে হয় । 

সেদিন বিকেলে আমরা কয়েকজন মিলে কেরাম খেলছিলাম । হঠাৎই ক্লাব ঘরে ভজুদার আবির্ভাব ঘটল। তিনি চুরুট টানতে টানতেই ক্লাব ঘরে ঢুকে পড়লেন। কারে৷ তোয়াক্কা না করেই ভেতরে ঢুকে পড়লেন ৷ আমাদের কারও কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না । 

ঢুকেই প্রশ্ন করলেন : এটা তোমাদের ক্লাব ঘর বুঝি ? ভীমরুলদ৷ পকেট থেকে গুটি তুলতে তুলতে বললেন : হুঁ । 

পটলা আমার কানে কানে বলল : এই মক্কেল কেরে ? 

আমি পটলার কানে কানে বললুম : 

চিনিনা । 

এ অঞ্চলে নূতন আমদানী ৷ আগে কখনও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না ৷ 

ভজুদা চুরুট টানতে টানতে জিজ্ঞেস করলেন : এই ক্লাবের সেক্রেটারী কে ? 

আমি আর পটল৷ ভীমরুলদাকে দেখিয়ে দিলাম । কারণ ভীমরুলদার পৃষ্ঠোপোষতার ফলেই আমাদের এই ক্লাব গড়ে উঠেছে ৷ তাছাড়া ভীমরুলদা আমাদের সকলের বড় । আমরা কেউ চব্বিশ পেরোতে পারিনি, ভীমরুলদ৷ অলরেডী পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেছেন। আমরা সকলেই বেকার । অর্থাৎ চাকুরীর প্রত্যাশায়—অনেকবার অনেক জায়গায় ধন্নী দিয়ে কনফার্মড বেকারে পরিণত হয়েছি, ভীমরুলদা বেকার হলেও মাঝে মাঝে ব্যবসাদার ! যে ব্যবসা সে সময়ে করলে মোটামুটি লাভ হয়, ভীমরুলদা তাই করেন। 

গতবছর ভীমরুলদা ব্যাঙের ব্যবসা করেছিলেন। কোলকাতায় ব্যাঙ চালান দিয়ে বেশ দু' পয়সা কামিয়ে নিয়েছিলেন । 

ভজুদা ভীমরুলদাকে বেশ ভালভাবেই নিরীক্ষণ করে বললেন : আপনিই বুঝি এই ক্লাবের সেক্রেটারী ! 

: সন্দেহ আছে কি ? 

সন্দেহ থাকবে কেন—এ অঞ্চলে গতকালই এসেছি কিনা- তাই সবার সঙ্গে এখনও তেমন পরিচিত হতে পারিনি। 

ক্যারাম খেলা মুলতুবী রেখে বাধ্য হয়েই ভজুদার প্রতি ভীম- রুলদার নজর দিতে হোল । ভদ্রলোককে তো আর দাঁড় করিয়ে রাখা যায় না, আর চাটাইতে বসতে বলা যায় না ৷ তাই মানকের মিষ্টির দোকান থেকে একটা চেয়ার আনতে হোল ৷ 

ভীমরুলদা ভজুদার উদ্দেশ্যে বললেন : বসুন। 

ভজুদ। চেয়ারখানায় দিব্যি জাকিয়ে বসে বললেন : তা এ ক্লাবে কি কি হয় ? মানে কি কি কর্ম করা হয় ? 

ভীমরুলদাই জবাব দিলেন : খেলাধুলা হয়, ব্যায়াম হয়, সাহিত্য চর্চাও হয়, আবার রাজনীতিরও চর্চাও হয়৷ 

–তা বেশ হয়েছে। তবে তো ঠিক জায়গাতেই ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছি। আমি আপনাদের ক্লাবে ভর্তি হতে চাই। এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে চাই। 

ভজুদার প্রস্তাব শুনে এবং তাঁর চেহারার দিকে তাকিয়ে আমরা রীতিমত ভড়কে যাই। ঐ তো রোগা পটকা চেহারা । বলতে গেলে তালপাতার সেপাই! উনি করবেন 'ব্যায়াম । তবেই ব্যায়াম করেও কি ঐ চেহারার আর উন্নতি করা সম্ভব । উনি অবশ্য ফ্রী হ্যাণ্ড একসাইজ করতে পারেন, সেটা বাড়ীতে বসে করলেই বরং ভাল হো'ত । ভীষণ রোগা চেহারা ভজুদার । চোখে পাওয়ার ফুল চশমা। কায়দা করে ছাঁটা সরু গোঁফ। ঐ তো চেহারা। তবে বেঁটে নন । দস্তুর মতো লম্বা ৷ ছ ফুট তো বটেই । 

মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি । 

ভজুদার প্রস্তাব শুনে ভীমরুলদার মনেই খটকা লাগল, তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন : আপনি ব্যায়াম করবেন ? 

: নিশ্চয়ই। চেহারা দেখে ঘাবড়ে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু এককালে আমি দস্তুরমতো একজন ব্যায়ামবীর ছিলাম । বলতে গেলে বিশ্বশ্রীই। বিশ্বের সেরা সেরা ব্যায়ামবীরগণ আমার চেহারা দেখে দস্তুরমতো হিংসে করত। বলতে গেলে হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরতো । বলতে গেলে আমি বিশ্বের সেরা হেভী-ওয়েট চ্যাম্পিয়ন ছিলাম । একবার নিউ-ইয়র্কে আমি সে পরিচয়ও দিয়েছিলাম । হাসতে হাসতেই নেহৎ খেলাচ্ছলেই পাঁচশ পাউণ্ড উপরে তুলছিলাম, হাজার পাউণ্ড তোলার জন্য হাতও লাগিয়েছিলাম। সাহেবরা সকলেই অবাক হয়ে গিয়েছিল । আমাকে হেডী ওয়েট চ্যাম্পিয়ন আখ্যা দিতেও চেয়েছিল-কিন্তু আমি ওদের সেই আখ্যা গ্রহণ করিনি । কারণ আমি সম্মান চাইনি। পাদপ্রদীপে আসতে চাইনি । প্রস্তাব আমি হেলায় প্রত্যাখান করেছিলুম । 

কিন্তু আপনার চেহারার এমন হাল হোল কি করে ? ভজুদা মুচকি হেসে বললেন : সবই মশায় কপাল! কপালে থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব হয় । পরোপকার করতে গিয়েই আমি বারবার নিজের ভীষণ ক্ষতি করেছি। যখনই সেখানে--বিশ্বের মানুষের দুর্গতির খবর পেয়েছি “তখনই সেখানে ছুটে গেছি--আমার পরাণ হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠেছে ! 

পটলা ফোড়ন কেঁটে বলল : তাহালে বিশ্বময় ছোটা ছুটি করার ফলেই – আপনার চেহারার এ হালৎ ঘটেছে । 

পটলার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ভজুদা বললেন, ভাই, তোমার প্রশ্নের মধ্যে কেমন যেন সন্দেহের ভাব উঁকিঝুকি দিচ্ছে ! তুমি হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছ না । অবশ্য এটা তোমার দোষ নয়—এই অবক্ষয় ও অবিশ্বাসের যুগে—আমরা অত্যন্ত  বিশ্বাস ভাজন ব্যক্তিদেরও বিশ্বাস করি না ৷ সব কিছুই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাই ! 

অথচ প্রতি মুহূর্তে এ পৃথিবীতে কতো অবিশ্বাস্য কিছুই না ঘটছে । আমার পরিচয় যথাযথ পেলে- এমন অবিশ্বাস তোমার মনে কখনই স্থান পেত না । 

ভীমরুলদা পটলার মাথায় এক চাট্টা মেরে বললেন : পটলা তুই চুপ কর, ভদ্রলোককে তাঁর কথা বলতে দে। সব কথায় ফোড়ন কাটা উচিত নয় ৷ 

ভীমরুলদার গাট্টা খেয়ে পটলা প্রায় চুপসেই গেল । মুখ কাচু মাচু করে বসে রইল । 

ভজুদ৷ নিভে যাওয়া চুরুটে অগ্নি সংযোগ করে, তিন টান দিয়ে -বললেন : ওর কোন দোষ নেই । এ যুগে কেউ কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু অবিশ্বাস্য হ'লেও আমার জীবনে এমন অনেক সত্য ঘটনা ঘটেছে যা শুনে বিশ্ববাসীর তাক লেগে যাবে! দেশ ও দশের জন্যে আমি কী না করেছি। ইচ্ছা করলে আমি কোটি কোটি টাকা উপায় করতে পারতুম, এটম বোমার চেয়েও—মারাত্মক কোন অস্ত্র তৈরী করতে পারতুম –কিন্তু মানব কল্যানের কথা ভেবেই আমি নিজেকে বারবার সংযত রেখেছি। আত্ম স্বার্থ রক্ষার জন্য জন স্বার্থ বিসর্জন দিতে চাই নি ! এই যে আমার এত আত্ম ত্যাগ—তাঁর বিনিময়ে কি পেলুম ! সত্যি কথা বলতে গেলেও—লোকে আমাকে এখন অবিশ্বাস করে । 

বলতে বলতে ভজুদার চোখের কোনে জল চক্‌ চক্ করে উঠল। অত্যন্ত ভাবাবেগের সঙ্গেই তিনি কথা বলছিলেন। ভীমরুলদা তো রীতিমত মুগ্ধ হয়েই শুনছিলেন। ভজুদা পকেট থেকে রুমাল বের চোখে মুছে বললেন : আমার চেহারার এহাল হলো কেন জানেন ? গোয়ায় যখন স্বাধীনতা আন্দোলন চলছে, আমি তখন নিউ-ইয়কৈ বিশ্বকে এটম বোমার হাত থেকে কি ভাবে রক্ষা করা যায় এনিয়ে আমেরিকান বুদ্ধিজীবিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে গবেষনা চালাছিলুম । এমন সময় আমার এক গোয়ানীজ বন্ধু লিখলেন-- ভজুদা আপনি আসুন । আমাদের মুক্তি সংগ্রামে সহায়তা করুন। আমি তার সেই আহ্বান উপেক্ষা করতে পারলুম না, আমেরিকান প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে একখানা বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ জানালুম । আমেরিকার তৎকালীন প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ – আমার সেই অনুরোধ উপেক্ষা করেন নি। ঐ বিশেষ বিমানেই আমি পাঞ্চুমে অবতরণ করেছিলুম। কিন্তু সালজারের লোকেরা কি করে যেন আমার আবির্ভারের কথা আগেই টের পেয়ে গিয়েছিল। আমি প্লেন থেকে নামার পরই গ্রেপ্তার হলুম । তারপর চলল অত্যাচার আর নিপড়ীন । আমার গোয়ানীজ বন্ধুটি জানতে পারল না যে আমি গোয়ায় এসেছি--এবং গ্রেপ্তার হয়েছি। আমি বলেই সেই অত্যাচার সহ্য করেছি। ওরা আমার শরীরের রক্ত টেনে বের করে, বিষাক্ত দ্রব্য ঢুকিয়ে ছিল। ব্যস্ একবছরের মধ্যেই আমার সেই বিশাল চেহারার এমন পরিণত ঘটল। আমি বলে বেঁচেছিলুম—অন্য লোক হলে মারা পড়ত । আমার জীবনী শক্তি ছিল প্রচুর । ঐ অবস্থায় পর্তুগালের জেল ভেঙ্গে পলায়ন করি। তারপর আর কি–1 জেলে আয়না ছিলনা, বাইরে এসে আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখি—আমার শরীরে হ্যাণ্ডেড পাসেন্টের মধ্যে নাইন্টি পারসেণ্টই নেই । তবু আমি বেঁচে আসতে পেরেছিলুম —বলে ঈশ্বরকে বার বার ধন্যবাদ জানিয়েছিলুম—কারণ মানব কল্যানের জন্য আমাকে যে এখনও অনেক কিছু করতে হবে! আরও কিছুদিন বাঁচারও প্রয়োজন ছিল । 

আমরা এতক্ষণ ভজুদার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতোই, শুনছিলুম, ভীমরুলদা তো দস্তুরমতো অভিভূতই হয়ে পড়েছিলেন । 

ভীমরুলদা ভজুদাকে বললেন : আপনার মতো লোককে এ গ্রামে পেয়ে আমরা ধন্য । এখানে থাকবেন নাকি ? এখানে আপনি কাদের বাড়ীতেই বা এসেছেন । 

পটলা বলল : আপনার নামটাও কিন্তু আমাদের এখনও জানা হোল না অথচ আপনার কথা শুনেই মনে হচ্ছে আপনি একজন স্বনাম ধন্য ব্যক্তি ! 

পটলার কথায় সায় দিয়ে ভেটোও বলল : উনি স্বনামধন্য ব্যক্তি তো বটেই । 

নেহাৎ দয়াপরবশ হয়েই আমাদের এখানে এসেছেন ? ভজুদ। অমায়িক হাসি হেসে বললেন : না ভাই, আমি স্বনাম ধন্য কোন ব্যক্তি নই । দেশ ও দশের জন্য কাজ করেছি বটে, নানা বিষয় নিয়েও গবেষনাও করেছি—কিন্তু নাম করতে চাই নি মোটেই ৷ আমার মতে নাম-প্রচার হ'লে সাধনার বিঘ্ন ঘটে। নিজেকে খুব মাতব্বর বলে মনে হয় । আমি মাতব্বরী করতে চাই নি মোটেই ৷ যদি আমি মাতব্বরী করতুম — অনায়াকে বিশ্বের সেরা সেরা মাতব্বরের মধ্যে একজন মাতব্বর বনে যেতে পারতুম ! 

কথাই বটে। আপনার বিনয় 

ভীমরুলদা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন : আপনার উপযুক্ত আপনার বিনয় থেকেই মনে হয়—আপনি কত মহান, কত বিদ্বান । তা স্যার আপনার নামটা জানতে পারি 

কি ? 

ভজুদ৷ মুচকি হেসে বললেন : তেমন কোন ভারিক্কী নাম নয়। নেহাৎ সাদা মাটা নাম । ভজহরি সরখেল ! 

পটলা বলল : আপনি কত বড় বড় কাজ করেছেন—অথচ খবরের কাগজওলারা আপনাকে টাচ করেনি মোটেই । 

: তা ভাই, যা বলেছো। আমিই বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা খবরের কাগজের কর্ত্ত পক্ষকে বারণ করে দিয়েছি--আমার নাম না প্রচার করতে । ওদের বলেছি—আমি যখন নাম প্রচারের প্রয়োজন বোধ করব—তখন ওদের জানাব । তা এ পর্যন্ত তাঁরা আমার অনুরোধ রক্ষা করেছে – তবে আর কতদিন রক্ষা করবে বলতে পারি না। লণ্ডন থেকে এবার যখন প্লেনে দমদমে নামি—সাংবাদিকরা আর আর একটু হলেই আমাকে ঘেরাও করে ফেলেছিল আর কি । একজন বলেই ফেলল : স্যর, এবার আর আমাদের চুপচাপ থাকতে বলবেন না । সারা বিশ্বের জন্য আপনি কত কি করেছেন! অথচ বিশ্ব আপনাকে চিনতেই পারল না মোটেই! এবার আর আপনার কোন কথা শুনব না—পাবলিসিটি দিয়ে দিয়ে তুল কালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দেব । আমি তখন হাতজোড় করে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বললুম : ‘ভাই, আমাকে আর মাত্র ছয়মাসের টাইম দাও —ছমাসের মধ্যেই আমার একটা বিরাট মিশন পূর্ণ হয়ে যাবে । তখন তোমার যত খুশী পাবলিসিটি দিও আমি আর বারণ করব না। ভেটো জিজ্ঞেস করল: সাংবাদিকরা আপনার অনুরোধ রক্ষা করেছিল ? 

: ভজুদ৷ অমায়িক—হাসি মুখে ফুটিয়ে বললেন : নিশ্চয়ই। নইলে কী আর কার্তিকপুরের মতো এই গ্রামে চুপচাপ গা ঢাকা  

দিয়ে বসে থাকতে পারতুম ! হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসত । আমার সাধনায় বিঘ্ন ঘটাত ! 

ভজুদার কথা শুনে ভীমরুলদা অভিভূত হয়ে ভেটোকে বললেন : ওরে ভেটো শোন, কতবড় মহান্ ব্যক্তি উনি ৷ নামের কোন মোহ নেই ! 

ভেটো ভজুদাকে জিজ্ঞেস করল : সভার এ গ্রামে আপনি কোথায় অর্থাৎ কাদের বাড়ীতে উঠেছেন ? 

এ গ্রামে আমি ঠিক উঠিনি—আমি এসেছি বিশ্বনাথপুরের 

ন' পাড়ায় ! 

: ন' পাড়ায়, কাদের বাড়ী উঠেছেন স্যার ? 

নন্দদের বাড়ী । 

: নন্দ আপনার কে হয় ? 

: আমি নন্দের পিসতুতো বোনের মাসতুতো দাদ৷ হই । “পিসতুতো বোনের মাসতুতো দাদা'—কথা শুনে আমরা অনেকেই বেশ ভড়কে গেলুম । অনেকের কাছেই কথাটা ধাঁধার মতো শোনাল । 

ভেটো বলল : স্যার, ব্যাপারটা ঠিক ক্লীয়ার হোল না । 

: মাথাটা একটু খেলিয়ে নিলেই সব কিছু ক্লীয়ার হয়ে যাবে— আমি নন্দের পিসতুতো দাদা ! 

ভীমরুলদা ভজুদাকে জিজ্ঞেস

খাবেন ? 

: আপত্তি কি ? 

করলেন : স্যার, একটু চা 

অতএব ভীমরুলদা মাণিকের মিষ্টির দোকানের একটা বয়কে হাঁক দিয়ে ডেকে বললেনঃ দশ কাপ চা আর দশটা সিঙ্গারা নিয়ে আয় জলদি। 

ভীমরুলদা নিজে বেকার হলেও—অপরকে খাওয়াবার ব্যাপারে চিরদিনই দিল-দরিয়া। খাইয়ে এবং খেয়ে খেয়েই তিনি ফতুর! 

চায়ের পেয়ালা ও দুটো সিঙ্গারা ভজুদার দিকে এগিয়ে দেওয়া হোল। ভীমরুলদা সিঙ্গারা খান না, সারাদিনে দু'কাপ চা খান মাত্ৰ ৷ অর্থাৎ চাও তেমন পছন্দ করেন না । তিনি আমাদের মতো মোটেই চা-খোর নন্ । 

ভজুদা সিঙ্গাড়া দুটো নির্বিচারে নিঃশেষ করে হুহু করে কেঁদে ফেললেন । 

ভীমরুলদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন : স্থার, আপনি কাঁদছেন ! 

ভজুদ। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন : আমাকে আর স্যর বলে লজ্জা দিও না ভাই, আমাকে তোমরা ভজুদ। বলেই ডেকো। আমার আর স্যারত্ব কি আছে বলে৷ ৷ কাঁদছি কেন এই কথা জিজ্ঞেস করছ ? আজ আমাকে এই বাজে চা খেতে হচ্ছে—অথচ গত বছর ঠিক এই সময়ে বৃটেনের প্রধান মন্ত্রী হ্যারল্ড উইল সনের সঙ্গে দশ নং ডাউনিং ষ্ট্রীটে বসে চা খেয়েছিলুম। সেই চায়ের কী ফ্লেভার । 

গজ দূরে বসে থাকলেও 

ভেবেই কাঁদছিলুম তাই ৷ 

আমি কোথায় এসেছি। 

ভজুদার কথা শুনে 

গেছি । 

লীফটি : গন্ধ পাওয়া যেত ! 

চার পাঁচ 

সেই কথা 

দেশ ও দশের কল্যাণের কথা ভেবে- আজ অবশ্য এর জন্য আমার মোটেই দুঃখ নেই ! 

ভীমরুলদা ভীষণ অভিভূত হয়ে পড়লেন, স্থান ত্যাগ করে ভজুদার পায়ের ধূলো নিয়ে বললেন : ভজুদ৷ জানি না আপনি কেন—আমাদের এ অঞ্চলে এসেছেন! কিন্তু আপনার মতো একজন গ্রেট-মডানকে আমাদের মধ্যে পেয়ে আমরা সত্য ধন্যই হয়ে 

আপনার আদেশ আমরা সকলেই মাথা পেতে নেব । ভজুদার সঙ্গে হ্যারল্ড উইলসনের চা-পানের কথা শুনে টেবলুর ট্যারা চোখ আরও বেশী ট্যারা হয়ে গিয়েছিল সে ভজুদাকে বলল : আপনার মতো বিখ্যাত লোক কেন যে এই গণ্ডগ্রামে এয়েছেন—সেই কথাটাই এখনও বুঝে উঠতে পারলুম না ভজুদা ! 

ভজুদা স্মিতহাস্যে বললেন : বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া আমি এখানে আসিনি। আমি এখানে দু'টি কারণে এসেছি। 

এক হচ্ছে বিশল্য 

১৪ 

করণী গাছ আর দ্বিতীয় হচ্ছে রুদন্তী গাছ—এই দু'টি গাছের খোঁজেই আমি এখানে এসেছি । 

থাকতে হবে। 

এবং বেশ কিছুদিন এখানে তাই আমাকে ভ্যাবলা বলল : বিশল্যকরণী গাছ, নামটা যেন শোনা শোনা মনে হচ্ছে, মহাভারতেই যেন নামটা শুনেছি মনে হচ্ছে । 

ভীমরুলদা ভ্যাবলাকে এক ধমক দিয়ে বললেন : ভ্যাবলা তো মহাভারতের জ্ঞান দেখছি ভীষণ টনটনে — বিশল্য করণীর কথা মহা- ভারতে নেই—বিশল্যকরণীর কথা আছে রামায়ণে । 

ভজুদা সপ্রংশস দৃষ্টিতে ভীমরুলদার দিকে তাকিয়ে বললেন : তোমার কথাই ঠিক ভাই। রামায়ণেই বিশল্য করণীর সেই ব্যাপারটা রয়েছে । হনুমান বিশলৎ করণীর খোঁজেই গন্ধমাদন পর্বতে গিয়েছিলেন, কিন্তু হনুমান তো আসলে মানুষের জাত নয়, ঘটে বুদ্ধিও কম ছিল তাই গোটা গন্ধমাদন পর্ব্বতটাই তুলে এনেছিলেন। আসল কথা হোল ঐ গন্ধমাদন পর্ব্বতে একটাই মাত্র বিশাল্যকরণী গাছ ছিল না—অনেকগুলো বিশল্যকরণী গাছ ছিল – হনুমান যখন গন্ধমাদন পৰ্ব্বত নিয়ে আকাশ পথে ছুটছিলেন—তখন দু চারটে গাছ এদিক- ওদিক পড়ে গেছে । আমি বিশল্যকরণী গাছের খোঁজে বেশ কয়েক বছর এদিকে ওদিক ঘোরাঘুরি করেছি—শেষ পর্যন্ত এক নাগা সন্ন্যাসী আমায় বললেন : ওহে ভজহরি তুমি যে গাছের খোঁজে ঘোরাঘুরি করছ—তা উত্তর চব্বিশ পরগনায় পাবে । সেই বিশল্যকরণীর খোঁজেই আমার এখানে আসা ৷ ঐ গাছের যদি একবার খোঁজ পাই —তবে আমি চিকিৎসা জগতে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারি। বিশ্ববাসীকে চমকে দিতে পারি। ঐ বিশল্যকরণীর দ্বারাই দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগ আমি নিরাময় করতে পারব। শুধু ক্যানসারই নয়, আমি অন্যান্য রোগও নিরাময় করতে পারবো । 

ভজুদা বিশল্যকরণী প্রসঙ্গ শেষ করে আর একটা চুরুট ধরালেন । 

১৫ 

পটলা বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল : হ্যাঁ, বিশল্যকরণী গাছের কথা আমরা রামায়ণে শুনেছি বটেও কিন্তু ক্বদন্তী গাছের কথা কোথায়ও শুনি নি ৷ সে গাছ আদৌ আছে কি না – আর সে গাছ দেখতেই বা কেমন ! 

নেই ৷ 

আমার মনে হয়–এ ধরণের কোন গাছই ভজুদা বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন : ওহে অর্বাচীন - তোমার যাহা মনে হয়, তাহাই যে ঠিক তুমি বুঝলে কিরূপে ? তোমার বয়সই কতটুকু, আর জ্ঞানই বা কতটুকু । নিউটন পর্যন্ত বলেছেন— আমি জ্ঞানের সমুদ্রে অবগাহন করতে পারিনি—সাগরবেলায় মুড়ি কুড়িয়েছি মাত্র । আর বলছ—তোমার জানাই ঠিক ! 

ভীমরুলদাও পটলার উদ্দেশ্যে একবার জ্বলন্ত দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললেন : পটলা তুই কার সঙ্গে তর্ক করছিস ! তুই এচড়ে পাক্কা হয়েছিস। 

পটলা ভীমরুলদার ধমক খেয়ে মাথা নীচু করল । অর্থাৎ মুখ গুজে রইল । 

পটলার দিকে তাকিয়ে আমার সহানুভূতি হোল, আমি ভজুদাকে প্যাচে ফেলবার জন্যই বললুম : পটলা ঠিক ও ভাবে কথাটা উত্থাপন করতে চায়নি। ও জানতে চেয়েছিল রুদন্তী গাছ দেখতে কেমন— কি কি উপকারেই বা লাগে। আর তাছাড়া বিশল্যকরণী গাছের মতো রুদন্তী গাছ নিশ্চয়ই দুষ্প্রাপ্য নয়—। আপনি যদি গাছটা কি রকম বলে দেন—তবে ঐ গাছ খোঁজার ব্যাপারে আপনাকে আমরা প্রভূত সহায়তা করতে পারি । 

ভজুদা চুরুটে দু'বার টান দিয়ে বললেন--এই তো বিজ্ঞের মতো কথা ভাই ৷ ঠিকই বলেছো—রুদন্তী গাছ বিশল্যকরণী গাছের মতো অতো দুষ্প্রাপ্য নয়। হয়তো সবাই মিলে খোঁজাখুঁজি করলে দু একটা গাছ আশে পাশেই পাওয়া যেতে পারে। রুদন্তী গাছের নাম বলে আমি তোমাদের কোন আজগুবি গাছের কথা বলিনি । 

১৬ 

গুল্ দেওয়ার চেষ্টা করিনি। রুদন্তী গাছের কথা আমাদের আয়ুৰ্ব্বেদ শাস্ত্রেও আছে । আমি আমার নোট বুকে এসম্বন্ধে শাস্ত্রেও শ্লোক ও ঠুকে রেখেছিলাম দাঁড়াও মনে করতে চেষ্টা করছি । 

চুরুট নিভিয়ে রেখে ভজুদা শ্লোক আওড়াতে লাগলেন : রুদন্তী নাম বিখ্যাত৷ জরাব্যাধি বিনাশিনী। 

চন পত্রোপমৈঃ পত্রৈষু ক্তা পীযূষবর্ষিনী । চতুর্ব্বিধাতু সা জ্ঞে রক্তা পীতা সিতসিতা। তমৌষধীং সদাদায় শুক্লপক্ষে শুভদিনে ছায়া শুঙ্কাং চ তাং কৃত্বা ভক্ষয়েন্নিতেন্দ্রিয়ঃ। বিরেচমনং কৃত্বা বিড়াল পদমাত্রয়া । ভক্ষয়েন্নধূ সর্পিবভ্যাং মাসমেকং মহৌষধীং । জীর্ণায়াং ভোজনং কার্য্যং দুগ্ধ ভক্তং নরো জয়ী । দৃঢ়কায়োহতি তেজস্বী সর্বরোগ বিবর্জ্জিতঃ । বলীপলিতনির্মুক্তো পরমায়ুস্ততো ভবেৎ ॥ 

ভজুদার মুখে শ্লোক শুনে আমরা একেবারেই থ' হয়ে গেলুম ৷ আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে মনে ভজুদাকে গুলবাজ ভেবেছিলুম, কিন্তু ঐ রুদন্তী গাছ সম্বন্ধে এক শ্লোক ঝাড়ার পর থেকেই আমরা চমকে উঠলুম ৷ ভজুদা যেন আমাদের কাছে আরও রহস্যময় হয়ে পড়লেন । 

ভীমরুলদা ভজুদাকে বললেন : সংস্কৃত আমার মোটেই আসে না । একমাত্র সংস্কৃতের জন্য স্কুল-ফাইনালের চৌকাঠ আজও পেরোতে পারিনি। স্মৃতিশক্তি আমার অত্যন্ত দুর্বল, যা পড়তুম তাও মনে রাখতে পারতুম না । 

ভজুদা রহস্যময় হাসি হেসে বললেন : স্মৃতিশক্তি অনায়াসেই বাড়ানো যায়—স্মৃতিশক্তি বাড়াবার দাওয়াই আমার জানাই আছে ৷ দাঁড়াও তাঁর আগে শ্লোকটার মানে বলে দিচ্ছি। 'রুদন্তী নাম বিখ্যাত জরা ব্যাধি বিনাশিনী'—অর্থাৎ রুদণ্ডী নামে একপ্রকার গাছ আছে— 

ভজুদা—২ 

১৭ 

মানে ঐ গাছে জরা ব্যাধি 'চণ পত্রো পমৈঃ পত্রৈযুক্ত৷ পীযুষ- 

তাহা জরা ও ব্যাধি বিনাশকারিণী। বিনাশ করার মতো শক্তি রয়েছে। বর্ষিনী'। অর্থাৎ ঐ গাছের পাতা ছোলার পাতার মতো এবং উহা থেকে দুগ্ধের মত একপ্রকার রস বা দুগ্ধ ক্ষরিত হয় । 

টেবলু রুদণ্ডী গাছের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বাধার সৃষ্টি করে বলল : গাছ থেকে আবার দুধ বেরোয় নাকি । 

ভীমরুলদা টেবলুকে ধমক লাগাতে যাচ্ছিলেন, ভজুদা ইশারা করে তাঁকে শান্ত হতে বলে, টেবলুর দিকে তাকিয়ে বললেন : ভাই, আমি তো আর গো-দুগ্ধ, বা ছাগদুগ্ধের কথা বলিনি। এ হচ্ছে বৃক্ষ দুগ্ধ ৷ 

ভজুদা চুরুটে তিন টান দিয়ে “চতুর্বিধাতু সা জ্ঞেয়া রক্তা পীতা 

উত্তর শুনেই টেবলু, চুপসে গেল । শ্লোকের অর্থ বলতে সুরু করলেন : সিতাসিত৷৷ তামৌষধীং সদাদায় শুক্লপক্ষে শুভে দিনে ।'—-অৰ্থাৎ রুদণ্ডীর দুগ্ধ চার প্রকার—রক্তবর্ণ, পীতবর্ণ, শ্বেতবর্ণ ও কৃষ্ণবর্ণ । এই ঔষধি ( দুগ্ধ ) শুক্লপক্ষে শুভদিনে সংগ্রহ করতে হবে। ‘ছায়া শুষ্কাং চ তাং কৃত্বা ভক্ষয়েন্নিতেন্দ্রিয়ঃ। বিরেচযমনং কৃত্বা বিড়াল পদমাত্ৰয়া ॥ ভক্ষয়েন্মধূ--কপিভ্যাং মাসমেকং মহৌষধীং । জীৰ্ণায়াং ভোজনং কাৰ্য্য দুগ্ধ ভক্তং নরো জয়ী । 

দৃঢ় কারো হতি তেজস্বী সৰ্ব্বরোগ বিবর্জিতঃ। বলীপালিতনি- মুক্তো পরমায়ুস্ততো ভবেৎ ॥’—অর্থাৎ ঐ দুগ্ধ সংগ্রহ করে ছায়ায় শুকিয়ে নিতে হবে । এবং ইন্দ্রিয় সংযম করে যথাবিধি বাহৎ ও বমন দ্বারা শরীর বিশোধিত করে প্রত্যেহ দুই তোলা পরিমান একমাস কাল 

খেতে হবে । ঐ ঔষধ খাওয়ার পর 

হজম হয়ে গেলে—কেবল মাত্র 

তবেই ঔষধ সেবী ব্যক্তি জয়ী, 

একমাস কাল দুধ-ভাত খেতে হবে। 

দৃঢ়কায়, অত্যন্ত বলশালী, সর্বরোগহীন, বলীপলিত শূন্য ও দীর্ঘায়ু 

হৰে ৷ 

ভজুদার মুখে শ্লোক ও শ্লোকের সঠিক ব্যাখ্যা শুনে আমরা 

১৮ 

টেবলু হুমড়ি খেয়ে...... দাওয়াইটা বদলে দিন (পৃ:১৯ ) 

সকলেই অবাক হয়ে গেলুম, ভজুদার জ্ঞানের বহর লম্বাই-এ সম্বন্ধে আমাদের আর কোন সংশয়ই রইল না । আমাদের কারো কারো মনে ভজুদার রহস্য জনক চরিত্র সম্বন্ধে, কিছু কিছু সংশয় থাকলেও মুখ ফুটে তা প্রকাশ করতে সাহস পেলুম না । 

টেবলুতো ভজুদার পায়ে হুমরি খেয়ে বলল, ভজুদা আমার স্মৃতি শক্তি একদম নেই । ফলে তিন তিনবার পি-ইউ ফেল করলুম। আমাকে একটা স্মৃতি-শক্তি বর্দ্ধক দাওয়াই বাতলে দিল ৷ 

ভজুদা টেবলুকে দু'হাত দিয়ে ধরে তুলে বললেন : আমি যখন এখানে রয়েছি—তোমার কোন ভাবনা নেই। আমি অবশ্যই তোমাকে স্মৃতি শক্তি বর্দ্ধক একটা দাওয়াই বাতলে দেব । 

—দেখবেন ভজুদা, কথা দিচ্ছেন কিন্তু! এবার ফেল করলে, বাবা বলেছে—বাড়ী থেকে একদম আউট করে দেবে । 

ভজুদা গম্ভীর স্বরে বললেন : আমি যখন কথা দিলুম, তোমার আর ভাবনা নেই ৷ তুমি পরে আমার সঙ্গে দেখা কর । 

। 

ভীমরুলদা ভজুদাকে বললেন : আজ থেকে এ ক্লাবের সভাপতি —আপনিই। আপনার নির্দেশ আমরা সব সময় অক্ষরে অক্ষরে 

পালন করব। 

আমরা উপস্থিত সকলই সদশ্যই হাতে তালি দিয়ে ভীমরুলদার প্রস্তাব সমর্থন করলুম । 

ভজুদা বিনয় প্রকাশ করে বললেন : এখানে যতদিন থাকব, আমি তো সব সময় তোমাদের সঙ্গেই থাকব। নানা বিষয় নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়, তার ওপর এ দায়িত্ব না চাপালেই ভালো হ’তো ! 

ভীমরুলদা হাত জোড় করে বললেন : আপনার কাজে আমরা ডিসটার্ব করব না। আপনি যদি সময় না পান্, আপনার হয়ে আমিই না হয় কাজ চালার—কিন্তু আপনিই আমাদের মাথার ওপরে? থাকবেন। আপনার নির্দ্দেশ আমরা সকলেই অক্ষরে অক্ষরে পালন । 

ভীমরুলদার কথা শুনে ভজুদা ভীষণ অভিভূত হলেন, প্রায় কেঁদেই 

বললেন : তোমাদের কাছ থেকে সাদর অভ্যর্থনা পেয়ে আমি মুগ্ধ 'আমি পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে নানা সময়ে নানা অভিনন্দন পেয়েছি—কিন্তু তোমাদের আন্তরিক অভিনন্দন মনে রাখার মতো । তবে তোমাদের সকলের কাছে আমার একটা অনুরোধ ! আমার মিশনের কথা কাউকে প্রকাশ করবে না। আর আমি যে সারা বিশ্বের একজন অন্যতম গণমান্য ব্যক্তি সেকথাও কাউকে প্রকাশ 

করবে না। 

তবলা তোতলা বলে সে এতক্ষণ চুপ করে ছিল, কিন্তু এবার আর মুখ না খুলে পারল না : কি – কি—কিন্তু, আ—আ...আগুন, কি ক—ক...কখনও, ছাছাছাই, চাপা দিয়ে দিদিয়ে রাখা যায় ! ভজুদা মাথা নেড়ে বললেন : তা ঠিক ! আগুন বেশীদিন ছাই চাপা দিয়ে রাখা যায় না ৷ নামের স্নেহ এড়াবার জন্যই আমাকে এ তাবৎ কাটাতে হয়েছে, একস্থান পরিত্যাগ করে আর হয়েছে—আর হয়তো নিজেকে চাপা দিয়ে রাখা যাবে না। তবু চেষ্টা করতে হবে তো। উদ্দেশ্য পরিপূর্ণভাবে সফল না হওয়া পর্যন্ত আমি নিজেকে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশও করতে চাই না। 

কাল ভবঘুরের মতো 

একস্থানে চলে যেতে 

ভীমরুলদা বললেন—এ ব্যাপারে আমরা চেষ্টা করব বৈকি ! তবে খবরের কাগজের লোকদের কাছে কোনমতেই কোন কথা বলা 

চলবে না। 

ভজুদা বললেন—সে ভয় নেই, ওরা আমার হাতের লোক ৷ নইলে এতক্ষণে হাজার হাজার সাংবাদিক আমাকে ঘিরে থাকতো। উঃ, ভাবতে গেলেও আমি শিউরে উঠি। সেবার ফ্রান্সে দ্য গলের সঙ্গে যখন বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে গোপনে আলোচনা করছিলুম—আর একটু হলেই বিপদে পড়তুম কোন সুযোগে যে ওরা আমার ফটো তুলেছে টেরও পাইনি—কিন্তু পরে ক্যাপসনে ছাপবার জন্য যখন আমার পুরো নাম জানতে চেয়েছে ব্যস্ তক্ষুণি আমি বলেছি দোহাই আমার কোন পাবলিসিটি দেবেন না—সর্বনাশ ঘটে যাবে ৷ 

নীরবে 

২১ 

কাজ করাই আমার স্বভাব । এভাবে পাবলিসিটি দিলে আমার পক্ষে লোমে ভীড় সামলে কোন কাজ করা সম্ভব হবে না ৷ ফলে সারা বিশ্বের সাংঘাতিক ক্ষতি হবে। কথাটাতে৷ মিথ্যে নয়—সেবার আমি হস্তক্ষেপ করেছিলুম বলেই বিশ্বযুদ্ধ বাঁধেনি। আমিই ক্রুশ্চেভ সাহেবকে বললুম—কিউবার দিক থেকে ষোলখানা জাহাজ ঘুরিয়ে নিন। কেনেডী সাহেব ভীষণ চটে গেছে, ঠাণ্ডা মানুষ চটে গেলে যা হয়। ক্রুশ্চেভ আমার অনুরোধ রেখেছিলেন তাই বিশ্বযুদ্ধ ঘটতে গিয়ে ঘটতে পারেনি, ফ্রাণ্ডের সাংবাদিকরা সে খবর রাখত বলেই— সেদিন আমার অনুরোধ রেখেছিল । আমার সম্বন্ধে কোন পাবলি- সিটি দেয়নি। সাহেবদের সামলানো সোজা, কিন্তু দেশের লোকদের সামলানো মুস্কিল । তাই এ ব্যাপারে আমাদের সকলকেই সতর্ক যেতে থাকতে হবে। অর্থাৎ নো পাবলিসিটি । নীরবে কাজ করে যেতে হবে। ভীমরুলদা বললেন—তা ঠিক এ ব্যাপারে আমরা সকলই সতর্ক থাকব । 

। 

ভীমরুলদা একে একে আমাদের সকলের সঙ্গেই ভজুদার পরিচয় ঘটিয়ে দিলেন ৷ পটলা, টেবলু, ভ্যাবলা, ন্যাপলা, গোপাল, ভেটো এবং আমি--আমরা সকলেই ভজুদার পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার জানালুম ৷ সেই থেকেই ভজুদ। আমাদের সর্ব্বাধিনায়ক হয়ে গেলেন । অর্থাৎ উড়ে এসেই জুড়ে বসলেন । অথবা বলা যায়, তিনি এলেন 

বসলেন এবং আমাদের জয় করলেন ! 

ভীমরুলদা আমাদের সকলকে সাবধান করে দিয়ে বললেন— আজ থেকে ভজুদাই আমাদের সব । তাঁর কথা কেউ অমান্য করলে অথবা তাঁর কাজের কোন সদস্য কোনরূপ বিরূপ সমালোচনা করে তাকে গাট্টা মেরে ক্লাব থেকে বের করে দেওয়া হবে । 

গাট্টা এবং বহিস্কার—এ দু'টোর কোনটাই আমাদের কাম্য ছিল না ৷ অতএব আমরা সকলেই ভজুদার অধীনতা বিনা দ্বিধায় স্বীকার করে নিলুম । 

22 

ভীমরুলদা তো এমনিই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়লেন যে ভজুদাই তাঁর সব সময়ের জপ তপ ও ধ্যানে পরিণত হ'লো ৷ 

পটলা ক্লাবের বাইরে এসে আমার কানে কানে বলল—ভজুদা আশ্চর্য্য মানুষই বটে! তুক-তাক জানে নিশ্চয়ই—মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভীমরুলদার মতো লোককেও বশ করে ফেলল ৷ 

টেবলু আমাদের অনুসরণ করে আসছিল, টেবলু ভজুদার হয়ে গুপ্তচর বৃত্তিও করতে পারে, তাই আমি পটলার উদ্দেশ্যে মুখে আঙুল দিয়ে বললুম—নো টক্ নো সমালোচনা । 

২৩ 

॥ দুই ॥ 

পরদিন বিকাল বেলা ক্লাবে এসে দেখি, ভজুদা অলরেডী এসে এসে গেছেন । ব্যায়াম করবেন বলে হাফ-প্যান্ট পরেই এসেছেন। সাট খুলে ফেলতেই স্যাণ্ডো-গেঞ্জী বেরিয়ে পড়ল । এবং স্যাণ্ডো গেঞ্জীর থাকলেও ভজুদার দেহের হাড় পাজরা দস্তুরমতো দৃশ্যমান 

হো'ল । 

ভজুদার চেহারার দিকে তাকিয়ে আমার আর পটলার দস্তুরমতো হাসি পেয়ে গেল । কিন্তু ভীমরুলদার উপস্থিতি এবং তাঁর হাতের গাট্টা খাওয়ার ভয়েই—আমরা অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখলুম । 

ভজুদা ভীমরুলদাকে বললেন : আবার প্রথম থেকেই শুরু করা যাক । ওয়েটলিফটিং দিয়েই সরু করা যাক্ ৷ অর্থাৎ এক পাউণ্ড থেকে শুরু করেই—এক থেকে হাজার, দু'হাজার পাউণ্ড অবধি অবলীলা ক্রমে চলে যাব ৷ 

ভীমরুলদা মাথা নেড়ে ভজুদার কথায় সায় দিয়ে বললেন, সেই 

ভালো! 

ভজুদা ওয়েট লিট করলেন । দুপাশে মাত্র এক পাউণ্ড হেডী ওয়েট চ্যাম্পিয়ন ভজুদাকে দস্তুরমতো হিমশিম খেতে হোল ! 

পটলা অন্য দিকে তাকিয়ে ফিক্ করে হেসে ফেলল, আমি হাসতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু যেই বুঝলুম যে—ভীমরুলদা আমাকে নজরে নজরে রাখছেন, অমনি হাসিকে কান্নায় পরিণত করলুম। গাট্টার ভয়ে কেঁদেই ফেললুম । 

ভীমরুলদা ধমক দিলেন : এই সন্তু কাঁদছিস কেনরে ? 

আমি ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নিলুম, বললুম : কাঁদব না ? এই দৃশ্য কি কখনও চোখে দেখা যায়—যিনি এক কালে দু' হাজার 

পাউণ্ড ওজন অনায়াসে তুলেছেন, সেই গ্রেট ভজুদা কিনা দু'পাউণ্ড ওজন তুলতে এমন হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। 

সব 

ভজুদা আমার খেদোক্তির সূত্র ধরে বললেন : তা ঠিকই । কথা ভাবলে আমারই কান্না পায় । তোমারতো কান্না পাবেই । এই আমি ইরানের অলিম্পিক ওয়েট-লিফটারদের দশবছর আগে ট্রেনিং দিয়েছি দু’হাঙ্গর পাউণ্ড ওজন অবলীলা ক্রমে তুলে সবাইকে তাক লাগিয়েছি । আজ সেই আমারই কি হাল ? তোমরা কেঁদো না— এই অবস্থা বেশীদিন থাকবে না। বিশল্যকরণী ও রুদন্তী গাছের সন্ধান পেলেই—আমি একমাসের মধ্যেই হালত ফিরিয়ে নিতে পারব, যতদিন সে দুটো গাছের সন্ধান না পাচ্ছি—ততদিন আমাকে এভাবে অভ্যাস বজায় রাখতেই হবে ! 

ভীমরুলদা মাথা নেড়ে বললেন : “তা তো বটেই ৷’ 

ফ্রী-হ্যাণ্ড-একসেরসাইজও 

ভজুদা তাঁরপর কিছুক্ষণ 

পদ্মাসনে বসে বেশ কিছুক্ষণ ধ্যানস্থও হয়ে রইলেন। 

করলেন । 

তারপর চোখ মেলে বললেন : এই ক্লাবে বক্সিং এর ব্যাবস্থাও করতে হবে। আমি তোমাদের সবাইকে এক এক জন ক্লেসিয়াস ক্লে বানিয়ে দেব । বিশ্বের সেরা ক্লেসিয়াম ক্লে বক্সিং কিন্তু আমার কাছেই শিখেছিল, ক্লেসিয়াস ক্লে সবার কাছে জয়ী হ'লেও—আমাকে কোনদিন হারাতে পারে নি। পাঁচবার ট্রাই নিয়েছি—কিন্তু কিছুতেই সে গুরু মারা বিদ্যাতে সাকসেসফুল হ'তে পারে নি । 

ভজুদার বক্তব্য আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতোই শুনছিলুম, কিন্তু পটলা পেছন থেকে পটলা চিমটি কেটেই আমার সম্বিত ফিরিয়ে আনল । 

ভজুদা টেবলুকে হুকুম করলেন : যাও, মানিকের দোকান থেকে এক কেজি কাঁচাগোল্লা সন্দেশ নিয়ে এস। ব্যায়ামের পরে প্রোটীন 

খাওয়া আবশ্যক । 

টেবলু আদেশ পেয়ে কিছুক্ষণ ভাবল, এক কেজি সন্দেশ দশটাকা, 'ভজুদাতো টাকাও দিলেন না, অথচ টাকার কথা বলাও যায় না। আর 

২৫ 

হুকুম যখন, তামিল না করেই বা উপায় কি!—টেবলুর বাবার ভুষিমালের কারবার করেন । অবস্থা মোটামুটি ভালই । টেবলুও মাঝে মাঝে গদীতে বসে। অতএব সময়—সুযোগ বুঝে দশ-বিশ টাকা ম্যানেজ করা তাঁর পক্ষে মোটেই কঠিন নয় । 

ভীমরুলদাও ধমক লাগালেন : দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? যা এককেজি সন্দেশ নিয়ে আয় । 

ধমকের চোটে টেবলু ভ্যাবাচেকা খেয়েই সন্দেশ আনতে ছুটে গেল ৷ সম্ভবত : ধার করেই এককেজি সন্দেশ নিয়ে এল । 

বহুবাহুল্য, ভজুদাই লায়ন শেয়ার নিলেন। 

নিজের জন্যে রেখে বাকী পাঁচশ সন্দেশ । 

পাঁচশ সন্দেশ 

আমাদের সকলের মধ্যে ভাগ করে দিলেন ৷ ভজুদ৷ একা পাঁচশ সন্দেশ খেয়ে, এক গেলাস জল নিঃশেষ করে বললেন : দেশ ও দশের প্রয়োজনের কথা ভেবেই আমাকে সবার আগে স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে হবে । শরীর মাদ্যং খলু ধর্ম্ম সাধনম্ । শরীরটার প্রতি সকলেরই— সবার আগে নজর দেওয়া কর্তব্য । 

পটলা আমার কাণে কাণে বলল : এই কি ভজুদার উচিত বিচার 

হোল । 

আমি বললুম : কি ? 

পটল৷ আমার কাণে কাণে ফিস ফিসিয়ে বলল : এই একা পাঁচশ 

সন্দেশ খাওয়া । 

আমি পটলাকে বললুম : চুপ্ । শরীর মাদ্যং খলু ধৰ্ম্ম সাধনম্ । নিজের শরীর বাঁচিয়ে—অপরের শরীর রক্ষার ধর্ম্মে সাহায্য করতে 

হবে । 

ভজুদ। এরপর কাকে কি আদেশ করেন কে জানে ? আমি আর পটলা সরে পড়ার উপক্রম করছিলুম! কিন্তু কপাল মন্দ হ’লে যা হয়, তাই ঘটল । পটলা একদম ফেঁসে গেল ৷ 

ভজুদ। ছেঁড়া চাটাইতে শুয়ে পটলাকে আদেশ করলেন : এই যে 

২৬ 

পটলা ভাই—আমাকে একটু ম্যাসেজ করে দাওতো! ব্যায়ামের পর ম্যাসেজ করানো বিশেষ প্রয়োজন । 

পটলা সেয়ানা ছেলে, সে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, বলল : আমি ম্যাসেজ করতে জানি না মোটেই । 

কিন্তু শেষ রক্ষা পেল কই ? ভজুদার সূচালো গোঁফ এবং ফ্রেঞ্চকার্ট দাঁড়ির ওপর হাত বুলিয়ে বললেন : আমার ধারণা ভুল হতেই পারে না । তোমার চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে তুমি একজন ভাল ম্যাসেজার । ম্যাসেজ করা মানে হাত-পা টেপা ৷ এতে জানা—না - জানার প্রশ্ন 

ওঠে না। 

পটলাকে বাধ্য হয়ে ভজুদার হাত পা কুইনিন সেলার মতো মুখ করেই ভজুদার 

অর্থাৎ ম্যাসেজ করতে লাগল । 

টিপতেই হোল । পটলা 

হাত-পা টিপতে লাগল 

ভীমরুলদা পটলার মুখের বিরক্তি ভাব লক্ষ্য করে বললেন : এই পটলা ও রকম মুখ করে বসেছিস কেন ? ওর মতো লোকের হাত-পা টেপার সুযোগ যে পেয়েছিস এতেই তোর বর্তে যাওয়া উচিত ছিল ! ভেবে দেখতো উনি কত বড় মহান ব্যক্তি ! এই যে তুই হাত—টিপছিস —ওর আত্মজীবনীতে একদিন নিশ্চয়ই সেই কথা প্রকাশিত হবে। তখন দুনিয়ার লোক তোকে কত সমীহ করবে একবার ভেবে দেখত ৷ 

পটলা কোন কথা বলল না, একমনে হাত-পা টিপতেই লাগল ৷ 

ভজুদা পরদিনের প্রোগ্রাম বাৎলে দিলেন : আগামী কাল থেকেই আমরা জঙ্গলে জঙ্গলে বিশল্যকরণী গাছ এবং রুদণ্ডী গাছের সন্ধানে 

বেরুব। 

ভীমরুলদা সকলকে নির্দেশ দিলেন : আগামী কাল ঠিক সকাল সাতটায় সকলের ক্লাব ঘরে উপস্থিত হওয়া চাই ! এখন তোমরা যেতে 

পার ৷ 

পটলা ভজুদার পা-টিপতে লাগল, আমরা কয়েকজন বেরিয়ে 

পরলুম । 

২৭ 

টেবলু বাইরে এসে বলল : ভজুদার জন্যে আমার দশটাকা ধার করতে হোল। আগামীকাল আমি বিশ্যলীকরণী আর রুদন্তী গাছের সন্ধানে কিছুতেই বেরুতে পারব না । 

থাকতেই হবে ৷ 

আমাকে গদীতে 

আমি বললুম : সে উপায় নেই। ভজুদা যখন একবার হুকুম দিয়েছেন : তখন তা রদ করার কোন উপায় নেই । 

। 

পরদিন ঠিক সকাল সাতটায় আমরা সকলেই ক্লাব ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলুম। মাণিকের দোকান থেকে চা আর সিঙ্গারা খেলেন না, প্রোটীন খেলেন অর্থাৎ সন্দেশ খেলেন । সব কিছুই ভীমরুলদার অ্যাকাউন্টে এল । 

সন্দেশ ও চা শেষ করে ভজুদা বললেন : তোমরা সকলেই বেকার তাই বলে তোমরা ভেবনা, তোমাদের আমি এমনি এমনি খাটাচ্ছি, যদি বিশল্যকরণী গাছ এবং রুদন্তী গাছের সন্ধান পাই : ভেষজ বিজ্ঞান জগতে সাংঘাতিক আলোড়ন সৃষ্টি হবে । আমর সব কিছুই পেটেণ্ট করে বিক্রী করব, বেকার থেকে তোমরা সকলেই অনায়াসে ক্রোড়পতি বনে যাবে। কিন্তু আন্তরিক ভাবে আমাদের সকলকেই 

একমন একপ্রাণ হয়ে খাটতে হবে । 

টেবলু বলল : নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই । কিন্তু ভজুদা, তাঁর আগে আপনার সেই স্মৃতিশক্তি বর্দ্ধক দাওয়াই পেটেন্ট করে বিদ্যার্থীদের কাছে বিক্রি করলে : প্রচুর পয়সা পাওয়া যেত ! 

ভজ্বদা মাথা নেড়ে বললেন : তোমার প্রস্তাব অতি শীঘ্রই বিবেচনা করা হবে—টেবলুভাই । এখন আর সময় নষ্ট না করে- আমাদের বিশল্যকরণী ও রুদন্তী গাছের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া উচিত । 

আমরা সকলেই বেরিয়ে পড়লুম, বগলিয়াণীর মাঠ পেরিয়ে- 

26 

ঝোপে ঝাড়ে বিশল্যকরণী এবং রুদন্তী গাছের খোজ করতে লাগলুম বিশল্যকরণী সম্বন্ধে ভজুদা আমাদের কোন আইডিয়া দেননি, কিন্তু রুদন্তী গাছ সম্বন্ধে আইডিয়া দিয়েছেন । ছোলা গাছের পাতার মতো পাতা । ছোলা গাছের পাতার মতো কোন পাতা দেখতে পেলেই আমরা ভজুদার কাছে জমা দিতে লাগপুম—ভজুদার কাধের ব্যাগটা পাছে-আগাছায় ভর্তি হয়ে গেল । কিন্তু ঐ ধরণের কোন গাছ থেকেই 

যে দুধ ক্ষরিত হ'তে দেখলুম না । 

তিন চার মাইল দূরে আমরা তেলে গ্রামে গিয়ে পৌঁছলুম, ঐ গ্রামের বাসিন্দা কছিমুদ্দি বলল : ঐ ঢিবিটার ওপাশে গেলে—ছোলা গাছের পাতার মত পাতাওয়ালা অনেক গাছ দেখতে পাবেন । 

ভজুদা সাহেবী কায়দায় কছিমুদ্দিনের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, থ্যাংক ইউ । 

আমরা ঢিবিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলুম, কছিমুদি বলল—বাবুরা ঐ দিকটায় ভীষণ সাপের উপদ্রব । একটু সাবধানে যাবেন । 

সাপের কথা শুনেই আমরা অনেকেই নিরুৎসাহ পড়েছিলুম । 

হয়ে 

ভজুদা একটা চুরুট ধরিয়ে বললেন : কোন ভয় নেই। আমি বেদেদের কাছ থেকে সর্প বিতাড়নের মন্ত্র জেনেছি। ঐ মন্ত্ৰ আওড়ালে ধারে কাছে কোন সাপ থাকবে না, সব দূরে পালিয়ে যাবে। 

ভজুদার আশ্বাসে আমরা উৎসাহ ফিরে পেলুম। ঢিবি পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লুম । জঙ্গলে ভীষণ জোকের উৎপাত। পটলা আমার কানে কানে বলল : সাবধানে চল, চারিদিকে জোকের ভীষণ উৎপাত । 

· 

ভজুদা মুখের চুরুট ফেলে দিয়ে সর্পতাড়ন মন্ত্র আওড়াতে লাগলেন—ওঁ ঠ ঠ ঠ চাহাঁহি চাহীহি স্বাহা ! ওঁ উদরং পাহিহি গাহিহি স্বাহা !’ 

তবু আমরা চারিদিক দেখে শুনেই এগুতে লাগলুম । বলা যায় না, এ জঙ্গলে গোথুরো সাপের ভীষণ উৎপাত ৷ 

আমি ভীমরুলদা ডেটো, টেবলু ও ভ্যাবলা আগে আগে চলেছি । ভ্যাবলার পেছনে ভজুদা, ভজুদার পেছনে পটলা 

কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আমরা রুদন্তী গাছের খোজ করছি, হঠাৎ পেছন থেকে ভজুদার আর্ত চীৎকার শুনে আমরা সবাই ছুটে এলুম । 

ভজুদা আর্তস্বরেই বললেন—মুঝে সাপনে কাট লিয়া। আর বাঁচব না । 

ভীমরুলদা তাড়াতাড়ি নিজের ধূতী ছিঁড়ে—ভজুদার হাঁটুর ওপরে কষে বেঁধে দিলেন । আমাদের যার যার পকেটে রুমাল ছিল সেই রুমালও হাটুর ওপরে আরও বাঁধন দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা 

হ'ল ৷ 

ভীমরুলদা ভজুদাকে জিজ্ঞেস করলেন : আপনিতো সৰ্পতাড়ন মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতেই আসছিলেন : আপনাকে সাপে কামড়াল কি করে ? 

ভজুদ। কাঁদতে কাঁদতে বললেন : প্রথমে দুবার সর্প বিতাড়ন মন্ত্র আউরেছিলাম বটে, তবে এদিকটায় এসে মোটেই আউরাইনি । তাছাড়া পায়ের দিকে মোটেই গজর রাখিনি। তবে সাপে যে 

কামড়েছেই—এ বিষয়ে আমি সিওর নেই । 

পটলা বলল : সাবধানের মার নেই। ভীমরুলদা ভজুদাকে এক্ষুনি চ্যাংদোলা করে বিশ্বনাথপুরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। এতবড় একটা মহৎপ্রাণ সম্বন্ধে কোন রিস্কই নেওয়া চলে না। সাপেই কামড়াক বা জোঁকেই কামড়াক অবিলম্বে একটা ব্যবস্থা করা উচিত। 

পটলার প্রস্তাব আমরা সবাই মেনে নিয়েছিলুম। ভজুদাকে চ্যাংদোলা করেই বিশ্বনাথপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে এসেছিলুম । ভজুদা বিশ্বনাথপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডাঃ দাসকে আর্তস্বরেই 

বললেন—ডাক্তারবাবু আমি বোঁধ হয় আর বাঁচবনা। গোঁখরো সাপেই আমাকে কেটেছে ! 

ডাঃ দাশ দষ্ট স্থান পরীক্ষা করে বললেন : গোখরো সাপে আপনাকে মোটেই কাটেনি। সম্ভবতঃ জোঁকে ধরেছিল! 

পটলা আমার কানে কানে বলল : ভজুদাকে জোকেই ধরেছিল। আমি তার পা থেকে জোঁকটা ছাড়িয়ে নিয়ে দূরের জঙ্গলে ফেলে দিয়েছি । 

পাশের ঝোপে সম্ভবতঃ একটা ব্যাঙ লাফিয়েছিল, সেই থেকেই ভজুদা সাপে কেটেছে বলে ধরে নিয়েছেন। 

ধারে কাছেও ছিল না ! 

আসলে সাপ 

পটলার কথা কেবল আমিই শুনেছিলুম এবং ভজুদা শুনতে পাননি। ভজুদ। তখনও গোঙাচ্ছিলেন। ভীমরুলদা ডাঃ দাশকে বললেন : ভজুদা একজন পৃথিবী বিখ্যাত ব্যক্তি । 

ফলে তাঁর যেন প্রাণ না যায় । 

আমার ভুলের 

ডাঃ দাশ বললেন : বেশ আমি সম্ভাব্য প্রি-কশান নেওয়ার ব্যবস্থা করছি। আপনারা কেউ সাপ দেখেছিলেন ? ভজুদা বললেন : সাপ দেখিনি বটে, তবে পাশের ঝোপে শব্দ শুনেছিলাম । পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি রক্ত ! 

ডাঃ দাশ একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক, তিনি সব বাঁধন খুলে দিয়ে বললেন : সাপে আপনাকে মোটেই কামড়ায়নি ! 

হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে ভজুদা বললেন : তাইতো সাপে আমাকে কাটবে কি করে। একবার সর্প বিতাড়ন মন্ত্র আউরে- ছিলাম—তার ফলে দু'ক্রোশের মধ্যে কোন সাপ থাকারই কথা 

নয়তো ! 

ক্লাব ঘরে ফিরে এসে ভজুদা বললেন : এবার থেকে আর 

আমাদের সাপের ভয় করে চলতে হবে না । 

৩১ 

পুনর্ণবায়া মূলঞ্চ শ্বেতং পুষে‍ মনাহতং 

বারিপীতং তস্যপার্শ্বে ভবনেষু নপন্নগাঃ । 

অর্থাৎ শ্বেত পুনর্ণবার মূল পুষ্যা নক্ষত্রে তুলে এনে জল সহ পোষণ পূর্ব্বক পান করলে—সে ব্যক্তির নিকটে যা নহে সর্প থাকতে পারে 

না। 

ভজুদার শাস্ত্রজ্ঞানের পরিচয় পেয়ে আমরা সকলেই ভীষণ ভড়কে পেলুম। ভীমরুলদা বললেন : সেই ভালো। পুষ্যানক্ষত্রে পুনর্ণবার মূল তুলে—জল সহ বেটে খেয়ে নেওয়াই ভালো । 

ভজুদ। পঞ্জিকা কনসাল্ট করে বললেন : পরশুদিনই পুষ্যানক্ষত্র। অতএব তরশু থেকেই আমরা আবার নূতন উদ্যমে বেরিয়ে পড়ব । 

কিন্তু পুষ্যানক্ষত্র পর্য্যন্ত অপেক্ষা করলুম বটে, কিন্তু যেদিন বেরুব বলৈ স্থির করেছিলুম—সেদিনই তুমুল বর্ষা নামল । কিন্তু ভজুদার হুকুম—এদিক-ওদিক হওয়ার উপায় নেই, যথা সময়েই সকাল সাতটায় ভিজতে ভিজতে আমরা ক্লাব ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলুম ৷ 

ভীমরুলদা ভিজে ঢোল হয়েই এসেছেন। ভজুদা রেন কোট চাপিয়ে সাড়ে-সাতটার সময় এলেন । ভজুদা ঢুকতেই পটল৷ দু'বার হ্যাচ্ছো দিল । 

ভজুদা বললেন : ঢুকতেই ‘হ্যাচ্ছো' যখন—আজ আর বেরিয়ে কাজ নেই । তাছাড়া ও বৃষ্টি—বৃষ্টি না থামলে গ্রামের পথে চলাই 

দায় হবে । 

পটলা আর একটা হচ্ছে। দিয়ে বলল : সদির হ্যাচ্ছে। মোটেই অশুভ নয় । তবে এ বৃষ্টির জন্য বেরুন সম্ভব নয়। বর্ষাকালে গ্রামে 

পথ-চলা সত্যিই মুস্কিল খানা-ডোবায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা । ভরুদা 

আপনি সাঁতার জানেন তো ? 

ভজুদা সরু গোঁফে তা দিয়ে বললেন : 

জানি মানে ? সাঁতারে 

আমি একজন একসপার্ট । 

১৯৫৬, ১ন ৫৭ 

এবং ১৯৫৮ সালে আমি 

তিন তিনবার ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়েছি । 

৩২ 

অবশ্য সে খবর তোমরা 

পাবে কি করে ? বিলিতি পত্রিকাতো তোমাদের এখানে আসে না। ঐ রকম রেকর্ড টাইমের মধ্যে আর কেউ ইংলিশ চ্যানেল পেরোতে পারেনি । আর একবার আন্দামানে সাঁতরে যাওয়ার এটেমট নিয়েছিলুম--কিন্তু আমার বন্ধু-বান্ধবগণ বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়াল। নইলে আমি ঠিকই আন্দামানে পৌঁছে যেতুম । অতএব আমি যদি সাঁতার না জানি—আর কে জানবে বলো ? লণ্ডন লাইফ-সেভিং সোসাইটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে, আমি ডুব সাঁতার দিয়ে ক্বতিত্ব দেখিয়েছিলুম—আজ লণ্ডনের লোকেরা তা নিয়ে আলোচনা করে ৷ আর একবার জাপানে—এক ডুব দিয়ে ঝিনুক তুলে এনেছিলুম । অবশ্য আমার জাপানী বন্ধু ওকি হাতোর সঙ্গে বাজী ধরেই ডুব দিয়েছিলুম । জাপানের সমুদ্রোপকূলে মুক্তোর চাষ হয়, ডুবুরীরা ডুব দিয়ে মুক্তো ভরা ঝিনুক তুলে আনে । ওকি হাতো আমায় বলেছিল : ভজুদা, আপনি কিছুতেই ডুব দিয়ে মুক্তো তুলে আনতে পারবেন না। 

আমি বললুম : পারব ৷ 

ব্যস হয়ে গেল ! আমি এক ডুবে প্রায় দু'হাজার হাজার ফিট নীচ থেকে চারটে মুক্তোভরা ঝিনুক তুলে আনলুম ৷ 

ওকি হাতে৷ তাই দেখে ভীষণ ভড়কে গেল। মুষড়েও গেল ৷ জাপানীরা কথায় কথায় হারিকিরি করে। সেদিন ডুবন দিলেই ভালই হোত, ওকিহাতোর মতো অমন এক পরম বন্ধুকে হারাতে হোত না। ওকি হাতো মনের দুঃখে পরদিনই হারিকিরি করল। ওকি হাতোর মৃত্যুর পর আমার আর জাপান ভাল লাগল না। পরদিনই জাহাজে হংকং যাব বলে স্থির করলুম। কিন্তু জাহাজে উঠেই আর এক বিপদ ঘটল । জাহাজ বন্দর ছেড়ে কিছু দূর এগোতেই—একদল জলদস্যু জাহাজ আক্রমণ করল। ভীষণ নৃশংস ওরা। আমার কোমরের বেল্টে একশো মুক্তো ছিল। জাহাজ থেকে তাই জলে লাফ দিলুম—এবং সাঁতরে সাঁতরেই হংকংয়ে পৌঁছলুম । অতএব 

ভজুদা—৩ 

সাঁতারের কথা আমার কাছে উল্লেখ না করাই ভাল । সাঁতার বেশ ভাল জানি বলেই—বহুবার আমি বহুবিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে গেছি ৷ একবার একদল হাঙর আমায় তাড়া করেছিল, আমি এমন স্পীড বাড়ালুম—অর্থাৎ হাঙররা জলের জীব হয়েও আমার সঙ্গে এঁটে উঠতে 

পারলনা । 

পটলা সাঁতারের প্রসঙ্গ তুলে এত কথা শুনতে মোটেই প্রস্তুত ছিল না ভজুদার মুখে সাঁতার প্রসঙ্গ শুনে, সে একেবারেই চুপ, হয়ে গেল ! ভাল সাতারু বলে পটলার খুব গর্ব ছিল, চিৎসাঁতার, ডুবসাঁতার এবং দ্রুত সাঁতারে পটলা এ অঞ্চলের সেরা সাঁতারু বলেই খ্যাতি লাভ করেছিল। কিন্তু ভজুদার সাঁতারের রেকর্ড শুনে—পটলার মুখ দিয়ে আর কোন ভাষাই বেরুল না । 

তবে আমাদেরও বিশল্যকরণী ও রুদন্তী গাছের সন্ধানে বেরুন সম্ভব হো’ল না । কারণ তিন দিন ধরেই তুমুল বৃষ্টি প্রায় এক নাগাড়েই চলেছিল! চারদিন পরে ভজুদার হুকুম হো'ল : এবার আবার বেরুতে হবে। বৃষ্টির ভয় করলে চলবে না । 

খানা-ডোবা-জলে জলে একাকার । ওর মধ্যে দিয়েই পথ করে করে বিশলৎ করণী আর রুদন্তী গাছের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লুম। সর্প দংশনের ভয় আর নেই । কারণ আমরা সকলেই পুষ্যানক্ষত্রে তোলা পুনর্ণবার শেকড় জল সহ বেটে খেয়ে নিয়েছি। 

কিন্তু গ্রামের কর্দমাক্ত পথে পথ-চলাই দায় হো'ল ৷ পটলা তিনবার আছার খেল । ভীমরুলদা আছাড় খেতে খেতে কোন রকমে সামলে নিলেন। ভজুদা যদিও চলছিলেন ঠিকই, এবং লম্বা পা ফেলে বেশ একটু তাড়াতাড়িই চলছিলেন । এবং তাড়াতাড়ি চলতে গিয়ে পা পিছলে একেবারে খানায় পড়ে গেলেন । খানাটা জলে ভরা ৷ 

খেতেই আর্দ্র চীৎকার 

ভজুদা খানায় পড়ে গিয়ে হাবু-ডুবু খেতে 

করে উঠলেন : হেল্প ! হেল্প ! 

ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ভজুদা খানায় পড়ে গিয়ে যে ওরকম হেল্প ! 

08 

আমি বোধ হয় আর বাঁচব না । 

( পূঃ ৩১ ) 

হেল্প! করে চীৎকার করবেন, আমরা তা ভাবতেই পারি নি । হাবুডুবু খেতে খেতে দু'চার ঢোক খানার জলও খেয়ে ফেললেন ! 

ভীমরুলদা এবং পটলাই শেষ পৰ্য্যন্ত তাকে খানা থেকে ওপরে টেনে তুলল ! 

ভজুদা কিছুক্ষণ মরার মতো পড়ে রইলেন। ভীমরুলদা ফ্ল্যাঙ্ক থেকে খানিকটা গরম চা খাইয়ে দিতেই, তিনি এদিক ওদিক পিট পিট করে তাকাতে তাকাতেই আচমকা উঠে বসলেন । 

পটলা বলল—ভজুদা ব্যাপারটা কি হোল ? ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী হয়েও—আপনি খানায় পড়ে হাবু ডুবু খেলেন । 

ভজুদা পকেট হাতড়ে দেখলেন চুরুট জলে ভিজে গেছে, অতএব চুরুট না ধরিয়েই তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন : পটলা ভাই! বহু বছর আগে আমি ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছিলুম । কিন্তু তারপর আর সাঁতার কাটার সুযোগ পাইনি—যখন সেই লুপ্ত অভ্যাসটা ফিরে আসছিল—এমন সময় তোমরা দুজন টেনে তুললে ৷ আর একটা কথা কি জানো, ইংলিশ চ্যানেল আর খানা এক নয়, পা ফসকে পড়ে যখন খানায় পড়লুম—কি একটা যেন আমার পা জড়িয়ে ধরেছিল, অথবা আগাছাতেই পা আটকে গিয়েছিল—তাই আমি হেল্প! হেল্প ! করে চীৎকার করছিলুম! আর গোটা ইংলিশ চ্যানেল ঘুরে এস— কোথায়ও আগাছার টিকিও দেখতে পাবে ন। । তবে তুমি যদি আমার সঙ্গে সাঁতার প্রতিযোগিতায় নামতে চাও—নদীতেই একদিন তা হবে ! সাঁতারের 

পটল৷ বলল : না, না, ভজুদা আপনার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামব এমন যোগ্যতা আমার কই ? 

ভীমরুলদা পটলার মাথায় এক গাট্টা মেরে বললেন : যোগ্যতা 

যখন তোর নেই—তখন ফ্যাচ ফ্যাচ করছিস কেন ? 

পটলা হয়তো আরও কিছু বলতো, বা বলবার চেষ্টা করত, কিন্তু ভীমরুলদার হাতের ঐ গাট্টা খাওয়ার পর—তার মুখ দিয়ে আর কোন 

কথা বেরুল না । 

৩৫ 

ভজুদার খানায় পড়ে খাবি খাওয়ার জন্য, সেদিন আমাদের আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হোল না - আবার ক্লাব ঘরেই ফিরে আসতে 

হোল । 

ভজুদাই বললেন : কয়েকদিন আমাদের অভিযান বন্ধ থাক ৷ পথ- ঘাট যা পিচ্ছিল এ-ভাবে চলা যায়, একটা নূতন উপায় ভাবতে হবে । তোমরা সকলে পাঁচদিন পরে এস—যা হোক একটা ব্যবস্থা করতে হবে। অভিযান কোন ক্রমেই বন্ধ রাখা যাবে না—এক একটা মিনিটেরও দাম আছে ৷ সময়ের অপচয় করা কোন ক্রমেই বুদ্ধি- মানের কাজ হবে না । আমি ব্যক্তিগত ভাবে অযথা কালহরণ মোটেই পছন্দ করি না— 

কিন্তু এক্ষেত্রে উপায়হীন হওয়ার ফল আমাকে পাঁচদিন সময় নষ্ট 

করতে হচ্ছে। 

কারণ পা পিছলে যাওয়ার পর আমার পা মচকে 

গেছে! এবং পাটা টন টন করছে! 

ভজুদ। একদম ভিজে গিয়েছিলেন, তৎসঙ্গে ভীমরুলদা এবং পটলা ও —অতএব তিনজনেই বাড়ী চলে গেল । ক্লাবে আমি, ভেটো, টেবল আর ভ্যাবলা বসে ক্যারাম খেলতে লাগলুম। 

ভ্যাবলা বলল : ভজুদাকে আমার যেন কেমন কেমন মনে হচ্ছে ! টেবলু বলল : ভজুদার মতো খাঁটি লোক হয় না ৷ 

তবে ইংলিশ চ্যানেল আর খানা এক নয় । তাছাড়া অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস পায় । বহুদিন সাঁতার কাটেন নি—তাই আচমকা খানায় পড়ে গিয়ে ভ্যাবা- চোকা খেয়ে হেল্প ! হেল্প! চীৎকার করেছিলেন ! 

৩৭ 

॥ তিন ৷৷ 

পাঁচদিন পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে হোল না, দু'দিন পরে টেবলু কাক-ডাকা ভোরে এসে খবর দিয়ে গেল : তোমাদের সকলকেই ভজুদা সকাল সাতটার সময় ক্লাব ঘরে উপস্থিত থাকতে বলেছেন। 

অতএব সকল সাতটার সময় আমরা সকলেই আবার ক্লাব ঘরে সমবেত হলুম । সকলেই এসেছেন, এমন কি তবলাও এসেছে। আগের দু'টো অভিযানে পেটের ব্যামোর জন্য তবলা যোগদান করতে পারে নি । 

ভীমরুলদা টেবলুকে জিজ্ঞেস করলেন : ভজুদা ঠিক আসবেন তো! মানে আসতে পারবেন তো ! 

টেবলু মাথা নেড়ে বলল : নিশ্চয়ই আসবেন—ভজুদার কথা 

কখনও নড়চড় হতে পারে না । 

ভীমরুলদা বললেন : কাল নন্দদের বাড়ীর বুড়ো চাকরটার সঙ্গে হাটে দেখা হয়েছিল— সে যে বলল – ভজুদার পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। এমন কি বাড়ীতেই চলাফেরা করতে পারছে না । তবে এতদূরে আসবেন কি করে ? 

টেবলু বলল : আমি অতোশতো জানি না, তিনি ঠিক সকাল সাড়ে সাতটায় সময় ক্লাব ঘরে এসে উপস্থিত হবেন ! 

ভজুদা এসেই সন্দেশ খেতে চাইল । তাই টেবলু আগে ভাগেই মানিকের দোকান থেকে পাঁচশ সন্দেশএনে রাখল। বোঝা গেল গত দু'দিন ভুষিমালের গদীতে বসে—সে বেশ কিছু টাকা ম্যানেজ 

করেছে ৷ 

কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সাড়ে-সাতটার সময়ই 

সময়ই ভজুদা ক্লাব ঘরে এলেন। না, পায়ে হেঁটে নয়। ক্লাব ঘরে আসার জন্য— তাঁর পা মাটিতে ঠেকাতেই হয়নি মোটে। হেঁটে আসার তাঁর 

৩৮ 

উপায়ও ছিল না ৷ 

তবে এলেন কি করে ? উড়ে এলেন নাকি ! অথবা নন্দদের বাড়ী থেকে হেলিকপটরে করেই বুঝি ক্লাব গ্রাউণ্ডে 

এলেন । না, তাও না। 

কাঁটায় কাঁটায় বজায় রেখেছেন । কথা দিয়ে আমি রাখি বলেই- 

ঝাঁকায় চেপেই তিনি ক্লাব ঘরে এলেন, নন্দদের বাড়ীর ষণ্ডা মার্কা চাকর ভূতোই তাঁকে ঝাঁকায় চাপিয়ে ক্লাব ঘরে নিয়ে এল । বলতে গেলে ঝাঁকায় চেপেই তিনি বিশ্বনাথপুর থেকে কার্তিকপুরে চলে এলেন । এবং পাংচুয়ালিটিও তিনি ঝাঁকা থেকে নেমে তিনি বললেন : সারা বিশ্বের নেতারা আমায় খাতির করেন। একবার মস্কো থেকে লণ্ডন যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন হয়েছিল, অথচ প্লেনে সীট পেলুম না ৷ কি করা যায় তাই ভাবছিলুম। ইংলণ্ডের প্রধানমন্ত্রীকে আমি কথা দিয়েছিলাম শনিবার দিন বিকেল পাঁচটা পয়তাল্লিশ মিনিটের সময় আমি অতি অবশ্যই তাঁর সরকারী বাসভবন অর্থাৎ দশ নম্বর ডাউনিং ষ্ট্রীটে গিয়ে দেখা করব। কিন্তু প্লেনে সীট না প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে যাওয়ায় উপক্রম হোল । 

পাওয়ায় আমার সমগ্র 

চার্চিল সাহেব আমাকে 

দুটো জিনিষ শিখিয়েছিলেন, এক হচ্ছে চুরুট, আর দ্বিতীয় হচ্ছে সময়া- নুবৰ্ত্তিতা ৷ 

পটলা জিজ্ঞেস করল : প্লেনে তো সীট পেলেন না—তবে লণ্ডনে গেলেন কি করে ? 

ভজুদা চুরুটে অগ্নি-সংযোগ করে তিনটান দিয়ে বললেন : সেই কথাই বলছি। লণ্ডনে আমি ঠিক সময়েই গিয়ে পৌঁছেছিলাম । ক্রুশ্চেভদা আমাকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন। তিনি আমাকে আনবিক শক্তি চালিত একটি রকেট দিয়ে সহায়তা করেছিলেন । এবং বলতে গেলে সেই রকেটের সহায়তায় আমি ইংলণ্ডের সমুদ্র উপকূলে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। এবং পাঁচটা চল্লিশ মিনিটে দশ নং ডাউনিই ষ্ট্রীটে গিয়ে পৌঁছেছিলুম । অথচ মস্কো থেকে ট্রাঙ্ককলে জানিয়েছিলুম–প্লেনের সীট পাইনি। কিন্তু আমাকে ঠিক . 

৩৯ 

সময় মতো লণ্ডনে পৌঁছতে দেখে অনেকেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ৷ পটলা বলল : সত্যি ভজুদা আপনার তুলনা হয় না, আপনি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্য । 

ভজুদা বললেন : তা যা বলেছো ৷ আমার জীবনটা অবাক বিস্ময়ের এক বিরাট সমন্বয়ই বটে । একথা আমাকে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট দাগলও বলেছিলেন একবার। তবে পটল ভাই তোমার হিসাবে একটু ভুল হয়ে গেল—আমাকে তুমি পৃথিবীর দশম আশ্চর্য্য বলতে পার । কারণ আমার আগেও নবম আশ্চর্য্য বিদ্যমান ছিল। 

ভীমরুলদা বললেন : পটলা ভীষণ ফাজিল । ভজুদা আপনি ওকে নবম আশ্চর্য্যের বিবরণটা একটু শুনিয়ে দিন তো। পটলা ক্রমশ : ডেঞ্জারাস হয়ে উঠেছে। লিটল লার্নিং ইজ ডেঞ্জারাস। কথায় কথায় তর্ক করা, সব কিছুতে সন্দেহ প্রকাশ করা ওর স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

ভজুদার হাতের চুরুট নিতে গিয়েছিল। ভজুদা বললেন : সব বলছি। তাঁর আগে সন্দেশ আর চা খেয়েনি । পটলা ভাই মানিকের 

দোকান থেকে দশ কাপ চা আনার বন্দোবস্ত করো তো । 

পটলা মুখ কাচুমাচু করে বলল : ভজুদা, মারা যাব ৷ আমার পকেট গড়ের মাঠ। মানকে আমাকে মোটেই ধার দেবে না ! 

ভীমরুলদা জ্বলন্ত চোখে পটলার দিকে তাকিয়ে বললেন : তুই অর্ডার দিয়ে আয়, পয়সা আমিই দেব। খাওয়াবার মুরোদ নেই, খাওয়ার গোঁসাই ! 

ভজুদা নির্বিচারে পাঁচশ গ্রাম সন্দেশ ও চা শেষ করে, চূরুট ধরালেন । তারপর বললেন : প্রথমে মিশরের পিরামিডের কথাতেই আসা যাক । নীল নদীর পশ্চিম তীরে গেলেই পিরামিড গুলো দেখা যাবে, পিরামিড গুলো আসলে মিশরের সম্রাট ফারাওদের সমাধিক্ষেত্র মিশরীরা বিশ্বাস করতেন—মৃত্যুর পরেও ভোগ স্পৃহা বিদ্যমান থাকে তাই মৃতদেহের সঙ্গে খাবার দাবার, সোনা, রত্ন সব কিছু সমাধির মধ্যে দিয়ে দিতেন । 

80 

তৈরী করা কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে তো আর পিরামিড 

সম্ভব নয়। 

অতএব পিরামিড তৈরীর ব্যাপারটা ছিল সম্রাটদেরই একচেটিয়া সোনাদানা, মনিমুক্তা, সব কিছু সহ —মৃতদেহকে মোমি বানিয়ে পিরামিডে রাখা হোত ! জীবদশাতে সম্রাটেরা সুখ ভোগ করতেন- মৃত্যুর পরও যাতে সে সুখ ভোগে বাধা না ঘটে সে রকমই ঢালাও ব্যবস্থা ছিল সেখানে ৷ সোনা দানা, মণি মাণিক্য ও সম্রাটদের সম্পদের লোভেই দশ্যুরা পিরামিডে হানা দিত । আমি আর অ্যালবাট এমন একটা পিরামিডের সন্ধান পেয়েছিলাম - যে পিরামিডে দস্যুরা আগে ঢুকতে পারে নি। পিরামিডের ভেতরে গিয়ে দেখি প্রকোষ্ঠের পর প্রকোষ্ঠ। চারিদিকে সোনা, আর মণি মুক্তার ছড়াছড়ি। অ্যালবাট আর আমি বেশ কিছু সোনাদানা আর মণিমুক্তা হাতিয়েও এনেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত সব কিছু বিশ্ব রেডক্রশকে বিলিয়ে দিলুম । অথচ ঐ সম্পদ বিলিয়ে দেবার আগে পর্য্যন্ত আমি আর আলবাট রোজ রাত্রেই মোমির স্বপ্ন দেখতুম—দু'টো মোমি যেন জ্বল জ্বল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকত। আমি আর অ্যালবার্ট ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে চীৎকার করে উঠ তুম । অ্যালবার্ট আমায় বলল : 

ভজুদা এ সম্পদ অভিশপ্ত ! 

শেষ পর্য্যন্ত 

ব্যক্তিগত ভোগে এ সম্পদ লাগানো যাবে না, আন্তর্জাতিক রেডক্রশ তহবিলে 

দান করে দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত । 

তাই 

অ্যালবার্টের প্রস্তাব আমারও মনঃ পূত হয়েছিল। পিরামিড থেকে আহরিত সমস্ত সম্পদই আমরা আন্তর্জাতিক রেডক্রশ তহবিলে দান করে দিয়েছিলুম । আর আশ্চর্য্যের ব্যাপার এই যে— দান করার পর থেকে আর মোমির স্বপ্ন দেখতুম না । 

ভ্যাবলা জিজ্ঞেস করল: ভজুদা আপনি কটা পিরামিড দেখে- ছিলেন আর ঐ সব পিরামিডগুলো কোন সালেই বা তৈরী করা হয়েছিল ? 

ভ্যাবলার প্রশ্নবানে ভজুদা মোটেই জর্জরিত হলেন না, ঘাবড়ালেন 

ও ধরণের প্রায় সত্তরটা পিরামিড 

না মোটেই, মাথা চুলকে বললেন : রয়েছে—আমি মাত্র পঞ্চাশটা দেখেছি। গুলো খৃষ্টপূর্ব ৩৫০০ সাল থেকে ১৮০০ চেয়ে উঁচু পিরামিডটা ৪৫০ ফিট হবে । 

যতদূর মনে হয় ঐ পিরামিড সালের মধ্যে তৈরী ! সব 

ভজুদ। একটু থামলেন, এক গ্লাস জল খেয়ে আবার পৃথিবীর আশ্চর্য্য সম্বন্ধে বলতে লাগলেন : তোমরা চীনেম্যান দেখেছ বটে, কিন্তু চীনের প্রাচীরতো দেখনি! আমি দেখেছি। বিরাট লম্বা প্রাচীর তা প্ৰায় চৌদ্দশ' মাইল পর্য্যন্ত বিস্তৃত । প্রাচীর থেকেই চীনেদের সম্বন্ধে আইডিয়া করে নেওয়া যায়—ওদের এলেম আছে বটে । মহা প্রাচীর উত্তর চীন থেকে মঙ্গোলিয়া পর্য্যন্ত বিস্তৃত। তাজ্জব ব্যাপারই বটে। তা হবেই বা না কেন ঐ প্রাচীর গড়তে তো আর কম সময় লাগেনি—কম করেও দেড় হাজার বছর লেগেছিল। চীনের প্রাচীরের ওপরে উঠে আমি মনের আনন্দে গানও ধরেছিলাম, গান গাইতে গাইতে আর খেয়াল করিনি, পা ফসকে একেবারে নীচে পড়ে গিয়েছিলুম—ভাগ্যিস নীচে খড়ের গাদা ছিল—তাই সে যাত্রায় রক্ষা পেয়ে গিয়েছিলুম নইলে আমাকে আর তোমরা এখন এভাবে 

দেখতে পেতে না ৷ 

তাক 

অবশ্য ব্যবিলনের শূন্যোদানও কম আশ্চর্য্যের বিষয় নয়। লাগানোর মতই ব্যাপার । ৭৫ থেকে ৩০০ ফিট পর্যন্ত মাটির ওপরে শূন্যে অবস্থিত। 

রাজা নেবু কাডনেজার ৬০০ খৃষ্টাব্দে ঐ শূন্যোদানটি 

তৈরী করেছিলেন। শূন্যে উদ্যান তৈরী 

চেয়েছিলেন জানি না । 

করতে কেন যে তিনি 

জাভার বুদ্ধ মন্দির দেখেও আমি কম অবাক হইনি ভাই, আগ্নেয়- 

গিরির লাভা দিয়েই নাকি ঐ মন্দির তৈরী করা হয় । 

আমাদের তাজমহলও পৃথিবীর আর এক আশ্চর্য্য । 

করতেই লেগেছিল প্রায় বাইশ বছর । 

82 

তৈরী 

বৃহত্তম গীর্জা বলতে রোমের সেন্ট পিটার্স গীর্জা । 

এতবড় গীর্জা আমি পৃথিবীর আর কোথায়ও দেখিনি। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হাজার লোক একসঙ্গে সমেবত হয়ে উপাসনা করতে পারে। 

রেঙ্গুনের শোয়ে ড্রাগন পেগোডাই বা কম কি ! বুদ্ধদেব নাকি নিজের মাথার আটগাছি চুল দিয়েছিলেন ব্রহ্মদেশের কয়েকজন ব্যবসায়ীকে ।, ঐ পবিত্র চুলকে সংরক্ষণের জন্যেই নাকি ঐ প্যাসেজটি তৈরী করা হয় ৷ 

আমেরিকার ষ্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখে আমি কম অবাক হইনি ৷ স্বাধীনতার প্রতি আমেরিকাবাসীর আগ্রহ ও শ্রদ্ধা যেন ঐ মূর্তির মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। মূৰ্ত্তিটি ন্যু ইয়র্ক বন্দরের পোতাশ্রয়ের মুখে বেডলোর দ্বীপে অবস্থিত। মূর্তিটির উচ্চতা ১৫১ ফিট, ওজন ২২৫ টন । 

আলোক বর্তিকাধারিনী এক নারী মূর্তি। 

ফ্রেডারিক বার্থ ফিল্ড ঐ মূর্ত্তিটা নির্মাণ করেন । 

ভাস্কর 

আমেরিকার আর একজন 

আর একজন ভাস্কর আমার মূর্ত্তিও গড়তে চেয়েছিলেন, বলেছিলেন বিশ্বশান্তির মূর্ত প্রতীক হিসাবেই রাষ্ট্রসঙ্ঘের ভবনের সামনে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করা উচিত । 

বললুম : 

আমি বললুম : 

না ভাই, বেঁচে থাকতে আমার মূর্ত্তি গড়ো না । আমি মরে যাওয়ার পর—আমায় নিয়ে তোমরা যা খুশী কর আমি আপত্তি করতে আসব না। ১৯৫৫ সালে নোবেল প্রাইজ কমিটি আমাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেবার জন্য প্রায় উঠে পড়ে লেগেছিল, কিন্তু আমি কোন পুরস্কারের ধার ধারিনি। আমি সে বৎসর পুরস্কার নিতে চাইনি বলে—সে বৎসর আর কাউকেই নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি । ১৯৫৬ সালেও ওরা আমায় আবার নোবেল শান্তি পুরস্কার দিতে চায়, আমি আপত্তি করি। অতএব সে বৎসরও 

কাউকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়না । 

১৯৫৭ সালে আমার সুপারিশ অনুযায়ীই কানাডার লিস্টার বি, পিয়ারসনকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। এ সব একটুও 

80 

বানিয়ে বলছি না, সবাই তোমরা রেকর্ডে পাবে । রেকর্ডই আমার 

কথার সত্যাসত্য প্রমাণ করবে । 

ভজুদার মুখে নোবেল প্রাইজ প্রসঙ্গ শুনে আমাদের সকলেরই মাথা শ্রদ্ধায় নত হয়ে এল । কারও মুখে কোন কথা নেই । বলতে গেলে আমরা সবাই প্রায় নির্বাক হয়ে গেলুম। বলবার মতো ভাষাই হারিয়ে ফেললুম । 

টেবলু আমৃত৷ আমৃতা করে বলল : ভজুদা, আপনার কিন্তু আরও অনেক বিষয়ে নোবেল প্রাইজ পাওয়া উচিত ছিল । 

ভজুদা গর্বের হাসি হেসে বললেন : বহুবার সে চেষ্টাও হয়েছে । ১৯৪৩ সালে—-সুইডিশ আকাদমি অব লিটারেচার আমাকে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার দিতে চেয়েছিল আকাদমিরই একজন সদস্য। আমি টের পেয়ে ঘোর আপত্তি জানালুম ৷ ব্যস হয়ে গেল ওরা আমার আমাকে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ দিতে পারল না । 

এবং তাঁর ফলে ১৯৪৩ সালে আর কাউকে সাহিত্যে আর কাউকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়নি ৷ অবশ্য আমাকে সাহিত্য নোবেল প্রাইজ দিতে চেয়ে ওরা কিছুমাত্র ভুল করেন নি। আমার লিখিত উইল ফাইট ওয়র' বইটির প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৪৩ সালের ১লা জানুয়ারী, এবং ছয় মাসের মধ্যে তিনটি এডিশন শেষ হয়ে গিয়েছিল। ঐ বইখানির প্রিন্টেড প্রাইস ছিল ৫০ সেন্ট, কিন্তু কালোবাজারে বিক্রী হ'তে লাগল তিন ডলারে । পাবলিশারের ঘরে লম্বা কিউ, সাপ্লাই দিয়ে পাবলিশার কুলোতে পারছিল না, হইচই, চেঁচা- মেচি, মারামারি। শেষ পর্য্যন্ত পাবলিশার বাধ্য হয়েই নিশ্চিত প্রচুর লাভ সত্ত্বেও বইটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিল। বাজার থেকেই উপে গিয়েছিল তিনলক্ষ বই । আমার কাছে মাত্র একখানা বই ছিল, তাও আর শেষ পর্য্যন্ত হাতে রইল কই ? ঐ বইখানা অবশ্য আমেরিকান এক ব্যবসাদার একলক্ষ ডলার দিয়ে কিনে নিতে চেয়েছিলেন, ভ্যালাইস্তিনা তেরেসকোভা অর্থাৎ বিশ্বের প্রথম মহিলা 

88 

মহাকাশচারী—বইখানা চেয়ে পাঠানোয়—আমি তাকে বইখানা দিয়ে দিই। সাহিত্য সৃষ্টি করা আমি ছেড়ে দিয়েছি—ঐ বইখানা হাতের কাছে থাকলে অনায়াসে তোমাদের দিতে পারতুম । এবং অনায়াসে তোমরা বুঝতে পারতে অমন সাহিত্য সৃষ্টি আর কখনও সম্ভব 

হবে না। 

ভজুদ৷ একটানা বলতে বলতেই একটু থামলেন, এবং সেই সুযোগেই পটলা বলল : আমাদের দুভার্গ্য যে, অমন একখানা বইয়ের আমরা নাম পৰ্য্যন্ত শুনিনি । 

ভজুদা বিরাট এক হাই তুলে বললেন : এই কার্তিকপুরে বাস করে অনেক কিছুই জানা সম্ভব নয়, পটলা ৷ এবং সে জন্য দুঃখ 

জায়গায় যখন জায়গায় যখন টেলিভিশনের ছড়াছড়ি 

করো না, বিশ্বের সব 

কার্তিকপুরে এখনও বিজলী 

বাতিই জ্বলল না । অবশ্য এই ক্লাব ঘরে অনায়াসে আমি গ্যাসের আলো জ্বালতে পারি—পচা গোবরের গ্যাস থেকেও বাতি জ্বালানো যায় ! যাক্ সে কথা, আমি তো শুধু সাহিত্য স্রষ্টাই নই । পদার্থ বিজ্ঞানেও আমার নোবেল প্রাইজ পাওয়ার কথা ছিল ১৯৬৬ সালে, সবকিছু প্রায় ঠিকঠাকই হয়ে গিয়েছিল—কিন্তু আমিই শেষ পর্য্যন্ত সুইডিশ আকাদমি অফ সায়েন্সের কাছে ব্যক্তিগত ভাবে সুপারিশ করেছিলুম : বিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ দিতেই কাস্টলারেরই তা প্রাপ্য আমার 

অনেক যুক্তি উল্লেখ করেছিলুম । 

১৯৬৬ সালে যদি কাউকে পদার্থ 

হয়— তবে ফ্রান্সের আলফ্রেড় হয়—তবে নয়। সুপারিশের সঙ্গে অখণ্ডনীয় 

শেষ পর্যন্ত সুইডিশ আকাদমি 

অব সায়েন্স আমার সুপারিশ মেনে নিতে বাধ্য হন । 

ভজুদার বক্তব্য শেষ হতেই ভীমরুলদা শ্লোগান তুললেন : 

মহান্ ভজুদা ৷ 

আমরা সমস্বরে জের টানলুম : 

ভজুদা মিষ্টি হেসে বললেন : 

জিন্দাবাদ ! 

এতেই তোমর। শ্লোগান তুলছ ৷ 

সব কথাতো এখনও শোনই নি—আর এ ব্যাপারে আমার মহত্ত্বের 

৪৫ 

কীই বা ছিল । ঐ মানের যোগ্যতম ব্যক্তিকেই আমি পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ দেবার জন্য সুইডিশ আকাদমি অব সায়েন্সকে অনুরোধ জানিয়েছিলুম । এবং তাঁরা আমার সেই অনুরোধ রক্ষা করে আমাকেই বরং কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। তবে ভেষজ 

বিদ্যার গবেষণার ব্যাপারে আমার ১৯৪৫ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমি যা নিয়ে গবেষণা করেছিলুম, ঠিক সেই বিষয় নিয়ে সুইডেনের ডঃ হুগো থিয়োরেল গবেষণা করছিলেন । আমি অনেক আগেই আমার গবেষণার কথা প্রকাশ করতে পারতুম, কিন্তু ডঃ হুগো থিয়োরেল ঐ ব্যাপার নিয়ে গবেষণা করছেন জেনে আমি সম্পূর্ণ ব্যাপারটা চেপে গেলুম । ফলে ১৯৫৫ সালে সুইডেনের ডঃ হুগো থিয়োরেলই নোবেল প্রাইজ পান । 

১৯৫৯ সালে সুইডিশ অব সায়েন্স আকাদমি আবার রসায়নে নোবেল প্রাইজ পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি সে বছর আমার বিশেষ বন্ধু চেকোশ্লোভাকিয়ার জারোস্লোহেরোভস্কির পক্ষেই সুপারিশ করি । 

ভীমরুলদা শ্লোগান তুললেন : ভজুদা কী··· আমরা সবাই সোল্লাসে চীৎকার করে উঠলুম : 

জয় ! 

ভজুদার ভীষণ তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সব জায়গায় জল তিনি গ্রহণ করেন না বলে, পরপর তিন কাপ চা শেষ করার পর তিনি বললেন : এবার কাজের কথায় আসা যাক । আমাদের আর বেশী সময় নষ্ট করা উচিত নয়, এখন ন'টা বাজে—আমাদের এক্ষুণি বিশল্যকরণী গাছ আর রুদন্তী গাছের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া উচিত । 

ভীমরুলদা ভজুদার পায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন : আপনার পায়ের যা অবস্থা—এ অবস্থায় আপনি যাবেন কি করে ? 

ভজুদা মুচকি হেসে বললেন :-আমি ঝাঁকায় চেপেই যাব। ভুতো আমাকে ঠিকই নিয়ে যাবে। তাছাড়া আমি সঙ্গে দূরবীণও 

৪৬ 

এনেছি। ঝাঁকার ওপরে বসেই দূরবীনের মাধ্যমে আমি অনায়াসে বিশল্যকরণী বা রুদন্তী গাছ স্পষ্ট আউট করতে পারব । 

অতএব ভজুদা টুক্ করে নিয়ে ছাঁকাতে উঠে নিজেকে গুটিয়ে বসলেন। আমরা সবাই মিলে ধরাধরি করে ভজুদা সমেত ঝাকাকে ভূতোর মাথায় চাপিয়ে দিলুম ৷ 

অতএব ভজুদ। ঝাঁকায় চেপেই চললেন। ঝাঁকার ওপর বসেই দূরবীনের মারফত আশেপাশের গাছ এবং আগাছার দিকে লক্ষ্য রাখতে লাগলেন! আমরা চললুম পিছু পিছু ! 

ভজুদা ঝাঁকায় চেপে যাচ্ছেন বলে—আমরা কেউ হিংসে করিনি । মানব কল্যাণের কথা কেথা ভেবেই—তাকে ঝাঁকায় চেপে বিশল্যকরণী ও রুদন্তী গাছের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল । "করার কোন অবকাশ ছিল না ৷ 

এক্ষেত্রে হিংসে 

89 

■ চার 

কিন্তু বহুদিন চেষ্টা করেও আমরা বিশল্যকরণী গাছ বা রুদন্তী 

গাছের সন্ধান পেলুম না । 

উৎসাহ দিয়ে বললেন : 

ভজুদা অবশ্য হতাশ হন নি, তিনি সকলকে 

হতাশ হ'লে চলবে না ! 

হতাশ হ'লে চলবে না! বহু কষ্ট সত্বেও 

আমাদের এই অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে ৷ 

কিন্তু ভীমরুলদা এবং টেবলুই গণ্ডোগোল বাধাল । 

টেবলু বলল : আমার সামনে পরীক্ষা। আমাকে স্মৃতিশক্তি বৰ্দ্ধক দাওয়াই দিন—নইলে পরীক্ষায় ফেল করলে আমায় বাবা বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দেবেন—এবং ভুষিমালের গদীতে বসারও চান্সও দেবেন না । এবং ফলে অভিযানের খরচ চালানো সম্ভব 

হবে না ! 

ভীমরুলদাও বললেন :-মানিকের দোকানে ইতিমধ্যেই অনেক ধার হয়েছে! বহুদিন ধরে কোন ব্যবসা করছি না বলে —– আমার মূলধনও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। নূতন কোন ব্যবসা না ধরলেই নয় ৷ বুঝতে পারলুম ভীমরুলদা ব্যাঙচালান দেওয়ার ব্যবসা ধরতে চাইছেন । আমাদের কথা স্বতন্ত্র, ব্যবসা করার মতো মূলধন বা উৎসাহ—আমাদের কিছুই নেই। চাকরির জন্য অযাথা ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছিলুম, ভজুদার পেছন পেছন ঘুরতেও 

আপত্তি ছিল না ৷ ভজুদ৷ কিছুক্ষণ ভেবে একবার ভীমরুলদার দিকে তাকিয়ে বললেন : আইডিয়া এসেছে। আমি দুজনেরই সমস্যার 

আমাদের তাই তেমন 

একবার টেবলু আর 

আমার মাথায় একটা সমাধান করে দিচ্ছি । 

কাল থেকেই আমি স্মৃতি শক্তি বর্দ্ধক দাওয়াই জানাচ্ছি। এতে পাশ করবে আর ভীমরুলও স্মৃতিশক্তি বর্দ্ধক দাওয়াই বেচে বেশ দু' পয়সা কামিয়ে নিতে পারবে। তবে এ ব্যাপারে একটা সৰ্ত্ত আছে ! 

ভীমরুলদা বললেন : আমি আপনার যে-কোন সর্ত মেনে নিতে রাজী ৷ 

: দাওয়াই বেঁচে যা লাভ হবে—তাঁর অর্দ্ধেক ক্লাবকে দান করতে হবে। বিশল্যকরণী এবং রুদন্তী গাছের সন্ধান করা কিছুদিন বন্ধ থাকবে—আমাদের তহবিলে বেশ কিছু অর্থ সঞ্চিত হ'লেই— আমরা আবার নূতন উদ্যমে অভিযানে বেরুব । 

ভীমরুলদা মাথা নেড়ে বললেন : আমি এই সর্তে রাজী। 

আমি, তবলা, ভ্যাবলা পটল। বললুম : দাওয়াই বেচার ব্যাপারে আমরা অনায়াসেই ভীমরুলদাকে সহায়তা করতে পারি—তবে আমাদের বেশ কিছু কমিশন দিতে হবে। 

ভীমরুলদা বললেন : আমি রাজী। দাওয়াই বিক্রী করলে তোমরা পনের পারসেন্ট কমিশন পাবে । 

অতএব পরদিন সকাল থেকেই নন্দদের বাড়ীতে ভজুদা স্মৃতি শক্তি বর্দ্ধক দাওয়াই প্রস্তুত করতে শুরু করলেন। নন্দদের বাড়ীর চাকর মাঠ থেকে ঘাস তুলে পিষতে লাগল, সেই ঘাস রৌদ্রে শুকানো, সেই ঘাসের সঙ্গে ভজুদা কি একটা জিনিস মিশিয়ে দিলেন। তারপরই ঐ গুলো প্যাকেট করে বাজারে ছাড়া হোল । 

আমরা সকলে মিলে স্কুলে, কলেজে হাটে এবং বাজারে স্মৃতি শক্তি বৰ্দ্ধক অদ্ভূত দাওয়াই বেচতে লাগলুম ৷ 

হু হু করে দাওয়াই বিক্ৰী হ'তে লাগল, ভজুদা সাপ্লাই দিয়ে এঁটে উঠতে পারল না । 

ভীমরুলদা রবিবার দিন ক্লাব-ঘরে এসে বললেন : বেশ লাভ হচ্ছে, এভাবে বেশ কিছুদিন চালাতে পারলে আর ভাবনা নেই ! 

ভজুদা বললেন : এ দাওয়াই চলবে । চলার মতো দাওয়াই । কিন্তু পরীক্ষার পরই দাওয়াইয়ের সেল একদম কমে গেল, কেউ আর দাওয়াই কিনতেই চায় না ৷ 

স্কুল-কলেজের ছেলেপিলেরা বলল : দাওয়াই কিনে কি লাভ ? 

৪৯ 

ওজুদ! — ও 

গণ টোকাটুকির মাধ্যমে অনায়াসেই পাশ করা যাবে এবার থেকে । 

টেবলুও তাই বলল : পরীক্ষা হলে গিয়ে দেখলুম দিব্যি গণ- টোকাটুকি চলছে, পাঁচটাকা করে চাঁদা নিয়ে গার্ডরা নিজেরাই বই সাপ্লাই দিচ্ছে ৷ কলেজের অধ্যাপকেরা গার্ড দিচ্ছেনা। গার্ড দিচ্ছে, দপ্তরী ও চানাচুরওয়ালারা অথচ গভর্ণমেন্ট কলেজ ৷ অন্য কলেজের পরীক্ষা বাতিল হ'লেও, সরকারী কলেজ বলে ঐ সেন্টারের পরীক্ষা বাতিল হবে না মোটেই । আমিও টুকেই মেরে দিলুম । নোট দেখে টুকিনি । য়্যুনিভার্সিটিতে গতবার যারা ষ্ট্যাণ্ড করেছিল, তাদেরই একজনের সব সাবজেক্টের খাতা বাগিয়ে ছিলুম—সেই খাতা দৃষ্টেই হুবহু টুকে গেলুম ৷ আমার ফাষ্ট ডিভিশন আটকায় 

কে ? 

তবে 

ভ্যাবলা বলল : ইস্ খুব ভুল হয়ে গেল । আমি এবার চেষ্টা করলে অনায়াসে বি, এ, পার্ট ওয়ান পাশ করতে পারতুম । 

টেবলু ও ভ্যাবলার কথা শুনে ভজুদা হু হু করে কেঁদে ফেললেন । আমরা সকলেই অবাক । ভজুদা কোন রকমে কান্না সংবরণ করে বললেন : দেশের যুব সমাজের কি হাল হ'লো তাই ভাবছি। টুকে পাশের কথা আমরা কোনদিন কল্পনাই করতে পারনি। টুকে পাশ করে কি লাভ ? গণ টোকাটুকির ফলে—ভালো ছেলেরা পড়ায় মোটেই উৎসাহ পাচ্ছেনা! বাজে ছেলেপুলেরাই বাজী মাৎ করছে ! 

যথা সময়েই পরীক্ষার রেজাল্ট বের হোল, টেবলু টুকেই টেন্থ, ষ্ট্যাণ্ড করল । 

খবরের কাগজের লোকেরাও টেবলুর ছবি ছাপিয়ে দিল । অথচ এই টেবলু যে পাশ করবে—তা আমরা কোনদিনই কল্পনা ক রতেই পারিনি । 

ভীমরুলদা বললেন : শিক্ষার ওপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে । ভজুদা টেবলুকে জিজ্ঞেস করলেন : টেবলু, তুমিতো বাংলায় লেটার পেয়েছে। আচ্ছা বলোতো বৃশ্চিক মানে কি ? 

ভিমরুলদা শ্লোগান তুললেন ভজুদা কি জয় । 

(খৃঃ ৫৩ ) 

টেবলু নির্বিকার চিত্তেই জবাব দিল : কুমীর। 

তবলা ক্লাশ ফোর পর্য্যন্ত পড়েছে, সে আর চুপ থাকতে পারল না : হো...হো...হো’ল না। বি... বি... বিশ্চিক, মা...মা মানে বি...বি... বিছা ! 

টেবলুর বিদ্যার দৌড় দেখে আমরা সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলুম, অথচ টেবলু টেন্থ, ষ্ট্যাণ্ড করেছে! তর্ক করে কোন লাভ নেই । 

ভীমরুলদা টেবলু প্রসঙ্গে ইতি ঘটিয়ে বললেন : একটা নূতন ব্যবসা না ধরলে আর চলছে না, ভজুদা ! স্মৃতিশক্তি বর্দ্ধক দাওয়াই বেচে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছি—একটা নূতন ব্যবসা না ধরলে –এ টাকা আর কদ্দিন ? 

ভজুদা চুরুট টানতে টানতেই বললেন : একটা নূতন ব্যবসার ফন্দি আমার মাথায় এসেছে। যদি পঞ্চাশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে পার—এ ব্যবসায়ে পনের দিনের মধ্যেই দু'লাখ টাকা অনায়াসে কামিয়ে নিতে পার । এ ব্যবসার সময় মাত্র পনের দিন অর্থাৎ ১৭ই চৈত্র থেকে ১লা বৈশাখ 

ভীমরুলদা মাথা চুলকে বললেন : পঞ্চাশ হাজার টাকা যোগাড় করতে না পারলে ও জমি বন্ধক রেখে অনায়াসেই আমি পঁচিশ হাজার টাকা পেতে পারি । 

টেবলু বলল : তেমন লাভজনক ব্যবসা হলে—আমিও বাবার কাছ থেকে নিয়ে পঁচিশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে পারি—কি ধরণের ব্যাবসা তাই বলুন না ! 

ভজুদা বললেন : আগে সন্দেশ খেয়েনি, তারপরেই প্ল্যান দিচ্ছি । এ ব্যবসায় কোন রিস্ক নেই, কিন্তু পনের দিনের মধ্যেই তিন গুণ 

লাভ ৷ 

লাভের কথা শুনেই টেবলু মানিকের দোকান থেকে এক কেজি নলেন গুড়ের সন্দেশ নিয়ে এল । 

এক কেজি থেকে পাঁচশ' গ্রাম সন্দেশ যথারীতি উদরস্থ করে 

৫২ 

ভজুদা বললেন : এ ব্যবসার প্রাথমিক ধাপে বাংলাদেশের কুমোর মানে মূর্ত্তি শিল্পীদের সঙ্গে কন্ট্রাকই করতে হবে । তাদের অ্যান্ড্রু ভান্স দিয়ে বলতে হবে—চাহিদা অনুযায়ী তাঁরা ১৭ই চৈত্রের মধ্যে প্রমান সাইজের গণেশের মূর্ত্তি গড়ে দেবে——কিন্তু তারা আর অন্য গণেশ মূর্ত্তি গড়তে পারবে না । এ ভাবে সংগ্রহীত লক্ষ গণেশ মূর্তি নিয়ে—পশ্চিম বাংলার সকল ব্যবসা কেন্দ্রেই অস্থায়ী গণেশ সাপ্লাই সেন্টার খুলে বসতে হবে। অর্থাৎ ব্যাপারটাকে মনোপলি 

করতে হবে । আমাদের গণেশ সাপ্লাই সেন্টার ছাড়া আর কোথায়ও ব্যবসায়ীরা গণেশের মূর্তি কিনতে পারবে না ৷ ৷ ফলে, 

ফলে, আটআনার গণেশ মূর্তি তাদের দু'টাকা আড়াই টাকা দিয়ে কিনতে হবে। সমগ্র পশ্চিম বাংলায় কম করেও ছোট বড় ছ'লক্ষ ব্যবসায়ী রয়েছেন অতএব দু' লক্ষ গণেশ মূর্তি বেচতে পারলে অনায়াসে দেড়লাখ থেকে দু' লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। আর এ ব্যবসায়ে ফেল মারার সম্ভা- বনাও নেই । কারণ যতই দাম হোক, পয়লা বৈাশেখের দিন সকল হিন্দু ব্যবসায়ীকে গণেশ কিনতে হবেই । 

ভজুদার পরিকল্পনা শুনে টেবলু আর ভীমরুলদা চেঁচিয়ে উঠল : ভজুদা জিন্দাবাদ, ভজুদার তুলনা নেই । 

কিন্তু চৈত্র মাসের অনেক দেরী। পাক্কা ছ' মাস বাকী। ছ' মাস টিকে থাকতে পারলেই-দেড়লাখ টাকা। আমরা সকলেই আশায় আশায় বুক বেঁধে রইলুম, সেই সঙ্গে রুদন্তী গাছ আর বিশল্যকরণী গাছের খোজ করতে লাগলুম । 

প্রত্যেক রবিবার ক্লাবঘরে উপস্থিত হওয়া আমাদের প্রত্যেকের পক্ষে ছিল বাধ্যতা মূলক, কারণ রবিবার দিনই ভজুদা সকলকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। রবিবারের আসরে ভজুদাই ছিলেন একমাত্র বক্তা, আমরা সকলেই শ্রোতা ৷ ভজুদা তাঁর দীর্ঘ মহান জীবনের নানান দিক তুলে ধরতেন । আমরা অবাক বিস্ময়ে 

শুনতুম মাত্ৰ ৷ 

৫৩ 

এক রবিবার ভজুদা চা ও সন্দেশ পর্ব শেষ করে বলছিলেন : তোমরা হয়তো জানোনা ১৯৬৯ সালের একুশে জুলাই আর্মষ্ট্রং এবং অলড্রিনের সঙ্গে আমিও চাঁদে অবতরণ করেছিলুম --কিন্তু আমার অনুরোধ ক্রমেই—আমি যে সঙ্গে ছিলুম একথা প্রকাশ করা হয়নি । 

ঠিক তক্ষুনি পটলা তাঁর বোম্বের নকুড় মামাকে নিয়ে ক্লাব ঘরে ঢুকল । পটলা তাঁর বোম্বেটে নকুড়মামার সঙ্গে ভজুদার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গে বলল : ইনি আমাদের সভাপতি বিশ্ব- বিখ্যাত ভজুদা । 

ভজুদার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে পটলার নকুড়মামা বলল : আপনাকে যেন এর আগে কোথায় দেখছি বলে মনে হচ্ছে । 

ভজুদা মুখে আশ্বাভিক গাম্ভীর্য্য এনে বললেন : দেখতে পারেন বৈকি ! আমি হেলিসিঙ্কিতে এবং হনেলুতে বহুদিন ছিলুম—ওখানে যদি কখনও গিয়ে থাকেন –তবে নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন বৈকী। 

নজুড়মামা দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতেই বললেন :—হ্যাঁ । মনে পড়েছে । বোম্বের ভিটি ষ্টেশনে আপনাকে বহুবার চানাচুর বিক্রী করতে দেখেছি। আমি যে ওয়েষ্টার্ণ রেলওয়েরই একজন টি টি । একবার বিনাটিকিটে পুনা যাচ্ছিলেন বলে—আমি আপনার চুল টেনে ধরেছিলুম বলেও যেন মনে হচ্ছে । 

ভজুদা মুখে অস্বাভাবিক হাসি এনে বললেন : আপনি আমাকে দেখেন নি—তবে আমার মতো অন্য কাউকে দেখে থাকতে পারেন 

বৈকী! 

নকুড়মামা নাকে এক টিপ নস্যি গুজে বললেন : আমার চোখ বড় সাংঘাতিক,! আমার দেখা কখনই ভুল হোতে পারে না, মশায় । 

: বেশ কোন সালে আমার দেখেছেন বলে মনে হচ্ছে ? নকুড়মামা বললেন : আমার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রবল । আমার যতদূর মনে হচ্ছে—আপনাকে আমি ১৯৫৬ সালের মাঝামাঝি 

(8 

বহুবার ভিটিতে দেখেছি । 

হয়েছিলুম ! 

কারণ তখন আমি তো ভিটিতে টিটি 

ভজুদা অট্টহাস্য করে উঠলেন : আপনার কথা যদি সত্য হয়— তবে স্যার বারট্রাণ্ড রাসেল মিথ্যা প্রমাণিত হন্ । 

; তার মানে ? 

: আমি গোটা ১৯৫৬ সাল ইংলণ্ডে বারট্রাণ্ড রাসেলের সঙ্গে ছিলুম। ওরই সঙ্গে দর্শনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করে এক বছর কাটিয়েছি। লর্ড রাসেলের অতিথি হিসাবেই আমি সেখানে ছিলুম। আপনার অবিশ্বাস হ'লে আপনি অনায়াসেই লর্ড রাসেলের সঙ্গে পত্রালাপ করে আমার বক্তব্যের সততা যাচাই করে নিতে পারেন। আপনি কোথাকার নকুড়চন্দ্র কোথায় কাকে দেখলেন এ নিয়ে মাথা ঘামাবার অবকাশ আমার নেই ৷ 

ভজুদা জবাব দিয়েই চুরুট টানতে লাগলেন, পটলার বোম্বেটে নকুড়মামা পরাজিত সেনা-নায়কের মতেই প্রস্থান করলেন । 

নকুড়মামার প্রস্থানের পরেই, ভ্যাবলার বেঙামামা আমাদের ক্লাব ঘরে প্রবেশ করলেন । বেঙামামা দেগঙ্গর স্পোর্টস ক্লাবের চেয়ারম্যান। 

বেঙামামা ভীমরুলদাকে বললেন : আগামী রোববার তোমাদের ক্লাবের সঙ্গে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ দিতে চাই। এবার আমরা প্রস্তুত, গত তিন বছরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেব— তোমাদের হারিয়ে ভূত বানিয়ে দেব। কোলকাতা থেকে দুজন প্লেয়ারও হায়ার করে এনেছি । 

বেঙামামার প্রস্তাব শুনে ভীমরুলদা ভজুদার নির্দেশের জন্য তার দিকে তাকালেন । 

ভীমরুলদার হয়ে ভজুদাই জবাব দিলেন : আপনাদের চ্যালেঞ্জ আমরা একসেপ্ট করলুম। রবিবার দিন খেলার মধ্যেই পরিচয় পাবেন—আপনারা কোলকাতা থেকে গোটা মোহনবাগান দলকে 

হায়ার করে আনলেও হেরে যাবেন ! 

৫৫ 

বেঙাদা ভজুদার দিকে তাকিয়ে ভীমরুলদাকে প্রশ্ন করলেন : ইনি আবার কে ? 

ভীমরুলদা গম্ভীর ভাবেই জবাব দিলেন : আমাদের ক্লাবের প্রেসিডেন্ট –মহামান্য মাননীয় বিশ্বজন শ্রদ্ধেয় এবং বিশ্ববিখ্যাত 

ভজুদা 

: বেশ, মাঠেই দেখা যাবে—কেমন বিশ্ববিখ্যাত! বেঙামামা এক রকম লাফাতে লাফাতেই প্রস্থান করলেন ৷ 

কিন্তু ভ্যাবলাকে নিয়ে শেষ পর্য্যন্ত গণ্ডগোল বাঁধল । ভ্যাবলা নাম করা সেন্টার ফরওয়ার্ড –কিন্তু বেঙ! মামার ভয়েই— সে আমাদের হয়ে খেলতে চাইল না ৷ 

ভ্যাবলা বলল : মামার বাড়ীতে যাই । মামার বিরুদ্ধে টীমে খেলব—আমায় ঠেঙিয়ে বিদেয় করে দেবে। আমি কোনদলেই 

খেলব না । 

ভজুদাই শেষ পর্য্যন্ত বিপদ তাড়ন বলে, আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন, চুরুট টানতে টানতেই বললেন : অতো ভাবনার কি আছে ? আমিই সেন্টার ফরওয়াডে খেলল ৷ 

ভজুদার উক্তি শুনে পাটলা ভজুদার দিকে তির্য্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললঃ আপনি ফুটবল খেলবেন ? তাও আবার সেন্টার ফরওয়াডে । 

ভজুদা নির্বিকার চিত্তে বললেন : এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। আমি অতীতে ফুটবল খেলারও একজন যাদুকর ছিলাম । ফুটবল জগতের যারা দিক্‌পাল তাদের কাছে আমার কথা একবার চুপে চুপে জিজ্ঞেস করেই দেখ না। থঙ্গরাজ, মুস্তাফা, সি, প্রসাদ, কিটটু, আপ্পালারাজু, জার্ণাল সিং, চুণি গোস্বামী—এরা সকলেই, 

আমাকে চেনে ৷ 

১৯৬৬ সালে পাঞ্জাব পুলিশ ডি, সি, এম ফুটবলে বিজয়ী হয়েছিল আমারই দৌলতে। আমি তখন দিল্লীতে—পাঞ্জাব পুলিশের একজন কর্ণধর অশোকা হোটেলে এসে আমায় অনুরোধ জানালেন । ঠিক 

৫৬ 

অনুরোধ বলতে গেলে কাতর মিনতিই : ভজুদা আমাদের মান রাখুন ৷’ 

আমি বললুম : আমি বাঙালী, পাঞ্জাব পুলিশের হয়ে খেলব কি করে ? তাছাড়া আমি মাত্র দু'দিন আপনাদের হয়ে খেলতে পারব তাতে এমন কি উপকার হবে ? 

উক্ত পাঞ্জাবী পুলিশ অফিসার বললেন : ভজুদা আপনি রাজী হ’লে সে সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি পুলিশ বলে যাবেন । কেউ যাতে সন্দেহ না করে—সে জন্ম দাড়ি ও পাগড়ী লাগাবারও ব্যবস্থা করা হবে। বাইরের কেউ আপনাকে চিনতে পারবেই না। আপনি একেবারে ভজিন্দর সিং বলে যাবেন। 

আমি কারও কাতর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারিনা, পাঞ্জাব পুলিশের হয়ে দু' দিন খেলতে রাজী হয়ে গেলুম । সেমি ফাইনালে– এবং ফাইনালে । আমি অবশ্য পাঞ্জাবী পুলিশ অফিসারকে প্রাথমিক পর্যায়ে হঠিয়েই দিতে চেয়েছিলুম, বলেছিলুম আমাকে ফুটবল গ্রাউণ্ডে নামিয়ে কোন লাভ হবে না 

আমি দশবছর ধরে ফুটবলই টাচ্ করিনি বলতে গেলে । প্রাকটিশ ছাড়া পা খুলবে কেন ? আর পা না খুললে ফুটবলে কেরামতীই বা দেখাব কী করে ? 

কিন্তু সেই পাঞ্জাবী পুলিশ অফিসারটি ভীষণ নাছোরবান্দা, সে হাত জোর করে বলল : ভজুদা — অর কোই আপকা নেই পয়চানা 

- লেকিন ম্যয় জরুর আপকো পহচান লিয়া ৷ 

আমি বললুম : সো ক্যাইসে ? 

—ভজুদা, আর কেউ আপনাকে চিনতে পারেনি, কিন্তু হামি জরুর আপনাকে চিনে নিয়েছি। ১৯৫২ সালে হেলিসিস্কিতে অলিম্পিক হয়েছিল, সেবার আমার বড়দাদা ভুপিন্দর সিং সেখানে খেলতে গিয়েছিল! সেবার অলিম্পিকে ফুটবলে যে দল বিজয়ী হয়েছিল—আপনি সে দলের কোচ, ছিলেন । আমার বড় ভাইয়ার সঙ্গে আপনার আলাপও হয়েছিল । 

৫৭ 

পাঞ্জাবী পুলিশ অফিসারটির কথা শুনে আমিতো দস্তুর মতো তাজ্জব বনে গেলুম ৷ অবশ্য কথাটা সে মোটেই মিথ্যে বলেনি ! অতএব বাধ্য হয়েই আমাকে পাঞ্জাব পুলিশের হয়ে দু' দিন খেলতে হয়েছিল। এবং ঐ দু' দিন খেলেই আমি সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলুম ৷ প্রথম দিনে মাঠে নেমেই ৩০ মিনিটের মধ্যে একাই দশটা গোল দিয়েছিলুম, আর ফাইনালের দিন—৪০ মিনিটের মধ্যেই একাই পনেরটা গোল দিয়েছিলুম। সেদিন মাঠে যারা উপস্থিত ছিল, তাঁরা সকলেই অবাক হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের সেই খেলার পরে —অনেক বিখ্যাত দলের দালালরা ভজিন্দর সিংয়ের খোঁজ করেছিল। কিন্তু বলা বাহুল্য তারা কেউ ভজিন্দরের সিংয়ের খোঁজ পায়নি । 

ভজুদ। তাঁর 

ফুটবল প্রসঙ্গে ইতি টানলেন। ভীমরুলদাতো আনন্দের অতিশয্যের চীৎকার করে উঠলেন : ভজুদা, হিপ হিপ 

হুররে। 

আমরাও অবাক বিস্ময় সহ ভীমরুলদার চীৎকারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে দিলুম । 

পরের রোববার আমাদের বিশ্ববিখ্যাত ভজুদা যথারীতি দেগঙ্গার ফুটবল গ্রাউণ্ডে খেলতে নামলেন। যথারীতি সেন্টার ফরওয়ার্ডেরই খেলতে নামলেন। ভজুদার সেই লিকলিকে পা দেখে আমি আর পটলাতো ভীষণ ভড়কেই গেলুম। ভাবলুম ঐ লিক্‌লিকে পা নিয়ে কি ফুটবল খেলা সম্ভব। 

বেঙামামাতো ভজুদাকে দেখেই ঠাট্টা করে বললেন : এই বুঝি 

আপনাদের সেরা খেলোয়ার । 

ভীমরুলদা গম্ভীর স্বরে বললেন : হুঁ । একটু পরেই টের পাবেন । ভজুদা সেন্টার ফরয়াডেই খেলতে নামলেন । বল নিয়ে তীব্র গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন ও, কিন্তু একটু পরেই ভজুদা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন । আর রেফারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য চীৎকার করে উঠলেন : রেফারী প্লীজ । 

আমরা খেলা বন্ধ করে ভজুদার কাছে এগিয়ে গেলুম। পটলা বলল দেগঙ্গার ঘেণ্ট, ভজুদার পাকে ভালভাবেই জখম করে দিয়েছে । 

ভজুদা গোঙাতে গোঙাতেই বললেন : একী রকম খেলা, বল না তাক্ করে পা তাক করে চোট মারা । এই কি খেলার নিয়ম ? 

রেফারী পর্য্যন্ত ফাউল ডিক্লেয়ার করল না । 

বেঙামামা বললেন : গ্রামের ফুটবল খেলাতে ওরকম মারধর হয়েই থাকে ৷ এসব ধর্তব্যের মধ্যেই নয় । ঐ লিকলিকে পা নিয়ে ফুটবল খেলতে নেমে ছিলেন কেন ? 

ভজুদা গোঙাতে গোঙাতেই বললেন : 

অবজেকশান । এমন 

অসভ্য টীমের সঙ্গে আমরা ফুটবল খেলতেই চাই না ৷ 

অতএব ফুটবলের ক্ষেত্রে তাঁর সেই ঐতিহাসিক কেরামতী দেখাবার সুযোগই পেলেন না ৷ 

ভজুদাকে চ্যাংদোলা করেই ক্লাব ঘরে ফিরিয়ে আসতে হো'ল ৷ পা টা বেশ জখম হয়েছে ! 

ভজুদা বললেন : ইস্ মাঠে নেমে দুর্ভাগ্য বশতঃ কেরামতী দেখাতে পারলুম না । নইলে আমি একাই ত্রিশটা গোল করে দেগঙ্গার বেঙ মামার মুখ চূণ করে দিতুম ! আমার মনে হয় কি জানো—ঐ দেগঙ্গার ঘন্টি নিশ্চয়ই দিল্লীর ডি, সি, এম মাঠে আমার খেলা দেখেছ । তাই মাঠে নেমেই আমার পা তাক করে ঝেড়েছে। 

উঃ উঃ উঃ ! 

যন্ত্রণার চোটে ভজুদা কঁকাতে লাগলেন । 

ভজুদাকে বিশ্বনাথপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলুম ৷ 

গুণ্ডা কোথাকার 

চ্যাংদোলা করেই 

ডাঃ দাশ ভজুদার 

পা পরীক্ষা করে বললেন–এ পা সারতে কম করেও চৌদ্দদিন লাগবে । 

সম্ভবত : ফ্রাকচার হয়েছে ! 

অতএব ভজুদাকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালেই কাটাতে হো'ল । 

৫ ৯ 

চৌদ্দদিন পরে ভজুদা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ল্যাংচাতে 

ল্যাংচাতে ক্লাব ঘরে এলেন, সন্দেশ ও চা খেয়ে বললেন : 

ফুটবল খেলা নয় গুণ্ডাবাজী ৷ 

এর নাম 

এখানকার খেলার রকম-সকম আগে 

থেকে জানতে পারলে আমি কিছুতেই খেলতে নামতুম না । 

ভ্যাবলা মুখ কাচুমাচু করে ভজুদাকে বলল : আমার বেঙামামার হয়ে আমিই ক্ষমা চাইছি ভজুদা ! 

: তুমি আর কি করবে, তোমারতো কোন দোষ নেই ৷ 

দোষে, ভাগনে তো অপরাধী হ'তে পারে না । 

মামার 

: আমি জানি ভজুদা আপনি ক্ষমাশীল। আপনি নিজগুণে আমার 

এতদিন আপনার কথা মামাকে বলিনি- 

মামাকে ক্ষমা করে দিন। 

সবকথা বেঙা মামাকে বলেছি। 

গতকাল রাতে আপনার 

বেঙামামা তো আপনার সব কথা শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন । আপনি যে এতবড় একজন বিশ্ববিখ্যাত লোক, বেঙামামা তা ভাবতেই পারেনি। তিনি এখন দস্তুরমতো অনুতাপ করছেন । 

ভজুদা মিষ্টি হেসে বললেন : বেশ, ক্ষমা করে দিলুম । তোমার মামা বলেই আমি তাকে ক্ষমা করে দিলুম । 

ভজুদার সেই মুহূতের ক্ষমাসুন্দর চাহনি লক্ষ্য করে—আমি আর পটলা দস্তুরমতো অভিভূত হয়ে পড়েছিলুম । 

দেগঙ্গার বেঙামামা যে অনুতপ্ত হয়েছেন একটু পরেই বোঝা গেল । কারণ পনের মিনিট পরেই দেগঙ্গার বেঙামামা ঘোন্টুর সঙ্গে আমাদের ক্লাব ঘরে উপস্থিত হোলেন । বেঙামামা ভজুদার উদ্দেশ্যে হাত জোর করে বললেন : গতকাল আপনার সব কথা ভ্যাবলার মুখে শুনেছি । আমাদের খুব অন্যায় হয়ে গেছে ভজুদা, আমরা না জেনে চরম অপরাধ . করে ফেলেছি—আপনি আমায় ক্ষমা করে দিন। নইলে আমি 

কিছুতেই শান্তি পাব না । 

ঘেন্টুও বলল : 

ভজুদা আমায় ক্ষমা করুন । আমি না চিনেই 

আপনার মতো মহান লোককে লেঙি মেরেছিলুম, আজ আমি 

অনুতপ্ত। 

ওদের কাতরোক্তিতে ভজুদার মন গলে একেবারে জল হয়ে গেল, নিজের পকেটের পয়সা দিয়েই তিনি দেগঙ্গার ঘোন্ট ও বেঙামামাকে চা ও গরম সিঙ্গাড়া খাইয়ে বিদায় দিলেন । 

ভজুদা ছ'মাস কার্ত্তিকপুরে এসেছেন—সম্ভবঃঐ প্রথম নিজের পকেট থেকে পয়সা বের করলেন। 

বেঙামামা ও ঘোণ্ট চলে যাওয়ার পরই ক্লাব ঘরে উদয় হ'লেন হামাদামা যুব সঙেঘর প্রেসিডেন্ট লম্বু মুখার্জ্জী ! লম্বু মুখার্জ্জী ভীমরুলদাকে বললেন : আপনাদের সঙ্গে সামনের রোববার ক্রিকেট ম্যাচ দিতে চাই । 

ভীমরুলদা অনুমতির জন্য ভজুদার মুখের দিকে তাকালেন । 

ভজুদা লম্বু মুখার্জ্জীকে জিজ্ঞেস করলেন : ক্রিকেট তো খেলতে চাইছেন, প্রথম টেষ্ট খেলা কোন সনে এবং কাদের মধ্যে শুরু হয়েছিল 

বলতে পারেন ? 

ভজুদার প্রশ্ন বাণে লম্বু মুখার্জ্জী বেশ জর্জরিত হয়ে পড়লেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ আমাদের কাছে ইতিপূর্বে একজন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ বলে জাহির করে এসেছেন। ভজুদার এক প্রশ্নেই প্রায় ঘায়েল হয়ে পড়লেন, আমতা আমতা করে বললেন, এবং সেই সঙ্গে গাম্ভীর্য বজায় রাখারও চেষ্টা করলেন : আমি এখানে ম্যাচ, খেলার কথা বলতে এসেছি, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিতে আসিনি । আপনারা আমাদের সঙ্গে খেলবেন কি না তাই বলুন ? 

ভজুদা বললেন : খেলবতো বটেই! তার আগে আপনাদের একটু বাজিয়ে নিতে চাইছিলুম ৷ আমার প্রশ্ন সহজ প্রশ্ন—প্যাচালে৷ প্রশ্ন নয়। আপনারা ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক আইন—কানুন 

মানেনতো । 

৬১ 

টাইয়ের নট ঠিক করতে করতে লম্বু মুখার্জ্জী বললেন : নিশ্চয়ই মানি। ম্যাচও নিয়ম অনুসারেই হবে । তবে একদিনের ম্যাচ, 

ভজুদ। লম্বু মুখার্জ্জীকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন : বলুনতো ক্রিকেটের আইন-কানুন করা তৈরী করেছেন ? 

: কেন ভারতীয় ক্রিকেট ক্লাব ! 

ভজুদা গর্বের সঙ্গেই বললেন : কিছুই জানেন না দেখছি, ক্রিকেটে আইন-কানুন তৈরী করেছেন এম, সি, সি, । আর প্রথম টেস্ট খেলা ইংলণ্ড ও অষ্ট্রেলিয়ার মধ্যে ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে । 

লম্বু মুখার্জ্জী গম্ভীর ভাবে বললেন : আমি তা জানতুম, কিন্তু ক্রিকেট সম্বন্ধে এই সব ছোট-খাট প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমি নিজেকে ছোট করতে চাইনি ! 

: তাস খেলা সম্বন্ধে কিছু জানেন ? 

লম্বু মুখার্জ্জী গম্ভীর ভাবে জবাব দিলেন : আমি মোটেই তাসারু নই—তাস সম্বন্ধে আমার তেমন ইন্টারেস্ট নেই ! 

: জানেন না তাই বলুন ৷ খেলার শুরু হয় । চৌদ্দ শতকে বেশ ভাল ভাবেই চালু হয় ৷ আমদানী করেন ! 

সম্ভাবতঃ ভেনিস শহরেই প্রথম তাস তাস খেলা ইউরোপের নানা দেশে ভারতে পর্ত গীজরা তাস খেলা 

ভজুদার বক্তব্য শুনে লম্বু মুখার্জ্জী ছোট্ট করে ঢু, বলেই পালিয়ে 

গেলেন। 

লম্বু মুখার্জ্জী চলে যেতেই ভীমরুলদা বললেন : আমাদের ক্লাবে ভাল ভাল বোলার আছে বটে, কিন্তু ভালো ব্যাটসম্যান নেই । আর ওদের লম্বু মুখার্জ্জী একাই একশ । 

ভজুদা বললেন : আমি যখন তোমাদের সঙ্গে আছি— ভাবনার কোন কারণ নেই । 

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলুম : আপনি ক্রিকেট খেলাও জানেন নাকি ? 

৬২ 

প্রশ্ন করেই বুঝতে পারলুম যে এক বিরাট ভুল করলুম—এখন বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমায় ভজুদার ক্রিকেট খেলার ব্যক্তিগত ইতিহাস এবং ভূগোল শুনতে হবে । হ'লোও তাই । 

। 

ভজুদ। ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন : ক্রিকেট জানি বলতে গেলে ভুল হবে ! নিজের সম্বন্ধে বলাও যুক্তি যুক্তি নয় । 

৷ অবশ্য ফ্রাঙ্ক ওরেল বারবার বহু জায়গায় বলেছে : ‘আজ পর্যন্ত বিশ্বে যে কয়েকজন কৃতী ক্রিকেটার জন্মেছেন—আওয়ার ডীয়ার ভজুদা তাঁদের মধ্যে অন্যতম ৷ 

আমি অবশ্য ওরেলকে বলেছি—ওকথা বলে আমায় লজ্জা দিও না ওরেল, আমি ক্রিকেটের কীইবা জানি!' 

তবু তো যদি কখনও লালা অমর নাথ, বিজয় হাজারে, ভিন্ন মানকড়, দিলীপ সিংজী, সি, কে, নাইডু, বিজয় মার্চেন্ট, চাঁদু বোরদে, চন্দ্রশেখর, জয়সীমা বা পতৌদির নবাবের বাড়ীতে যাও—তবে ওদের ঘরে বা এলবামে আমার দু'চার খানা ফটে! নিশ্চয়ই দেখতে পাবে । ওদের মধ্যে কেউ কেউ আবার গোপনে গোপনে আমার ফটোর পূজোও করে । 

কেন জানো—ইংলণ্ডের মাঠে আমি একবার ভেল্কী দেখিয়ে দিয়েছিলুম—এক ইনিংসে আমার একক রাণের সংখ্যা ছিল তিনশো ছাপ্পান্নো ! তবে ওটা ফ্ৰেণ্ডলি গেম বলেই—রেকর্ড করা হয়নি ৷ তবে সারা বিশ্বের ক্রিকেটাররা জানতে পেরেছিল— ব্যাপারটা! তাজ্বব বনেছিল অনেকেই। অষ্ট্রেলিয়ার মত টীমের বিরুদ্ধে একক তিনশোছাপ্পান্ন রাণ তোলা যায় –দুনিয়ার কেউ ভাবতে পারেনি। আমি সকলকে ভাবিয়ে তুলেছিলুম বটে! হিংসেতে অনেকের বলে উঠেছিল! কিন্তু আমি জানি ক্রিকেটের মতো এমন ভদ্র এবং সম্প্রীতি-সূচক গেম আর নেই—ক্রিকেটের সেই ঐতিহাসিক ঐতিহ্য রক্ষা করবার জন্যই আমি ক্রিকেট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলুম। তাছাড়া অতো রান করার জন্য কোন দলই আমাকে ভাল চোখে দেখত না—আমি যদি একাই তিন- 

চারশো রাণ করি—দলের অন্যান্যদেরতো তাহ'লে ব্যাট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ৷ অতএব আমি ক্রিকেট না খেলায় অনেকেই সন্তুষ্ট হয়েছে ! তবে এই ক্লাবের জন্য প্রয়োজন হলে 

আজ আমি নিজেই ব্যাট হাতে নোব । 

অতএব পরের রোববার আমরা ক্রিকেট খেলার জন্য হামাদামার মাঠে গেলুম। যুবসঙ্ঘের ছেলেরা আমাদের মোকাবেলা করার জন্য উপস্থিত ছিল বটে, কিন্তু লম্বু মুখার্জ্জীর পাত্তাই পাওয়া গেল না। হামাদামায় আমার এক বন্ধু ছিল, তাকে জিজ্ঞেস করলুম : কি করে তোদের লম্বু মুখাৰ্জ্জী খেলছে না ! 

হামদমার বন্ধুটি বলল : লম্বুদা খেলত ঠিকই—কিন্তু তোদের সঙ্গের ঐ রোগা-পটক৷ ভদ্রলোককে দেখে ব্যাট হাতে নিয়ে আসতে দেখে কেটে পড়েছে। ব্যাপারটা যে কী আমরা কেউ বুঝতে পারছিনা। লম্বুদা যে এ সময়ে কেটে পড়বে তা আমরা ভাবতেই পারিনি । 

লম্বু মুখার্জি কেন ভজুদাকে দেখেই কেটে পড়েছে—আমি ঠিকই বুঝতে পারলুম । লম্বু মুখার্জি ক্রিকেট সম্বন্ধে স্বীয় অভিজ্ঞতার কথা বড়াই করে প্রচার করত, কিন্তু ভজুদার প্রশ্নবাণে সেদিন আমাদের ক্লাবেই সে নাজেহাল হয়েছিল । ভজুদা যদি আবার কোন প্রশ্ন করে বসেন, এবং হামদামার ছেলেদের সামনে উত্তর দিতে না পারল— লজ্জায় তাঁর মাথা হেঁট হয়ে যাবে। তাই দূর থেকে ভজুদাকে আমাদের সঙ্গে দেখতে পেয়েই লম্বু মুখার্জী ব্যাট হাতে নিয়ে সরে পড়েছে। 

লম্বু মুখার্জী সরে পড়লেও, যুবসঙ্ঘের অন্যান্য ছেলেরা আমাদের সঙ্গে ম্যাচ খেলতে চাইল । 

ভজুদাই টসে জিতলেন । এবং আমাদের টিমের হয়েই, ভজুদা এবং ভীমরুলদা ও সবার প্রথমে ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন। ভজুদাই ওপেনিং ব্যাটসম্যান। ভজুদা অনেক রাণ তুলবেন বলে আমরা খুব ভরসা করেছিলুম, ভীমরুলদা তেমন রান তুলতে না পারলেও দীর্ঘক্ষণ 

৬৪ 

উইকেটে থাকার যতো ক্ষমতা তাঁর রয়েছে ৷ আমরা সকলেই ভাবলুম ভজুদা ও ভীমরুলদার জুটি কম করেও একশ দেড়শো রান তুলবে- আমরা হয়তো ব্যাট হাতে নিয়ে দাঁড়াবার সুযোগই পাব না ৷ 

কিন্তু আমাদের সব ধারনাই ভুল প্রমাণিত হলো। ভজুদা প্রথম বলেই আউট হয়ে গেলেন, একেবারে বোল্ড আউট । ভজুদা যে এভাবে আমাদের ডাউন করে দেবেন, আমরা ভাবতেই পারিনি । পটলা ভজুদার স্থলে উইকেটে গিয়ে দাঁড়াল। ভজুদা উইকেট থেকে এসে আমায় বললেন : ইচ্ছে করেই আউট হয়ে এলুম। এমাঠে আমিই যদি একশো দুশো রাণ তুলি—অপর ব্যাটসম্যানরা খেলারই সুযাগই পাবে না । তাই চলে এলুম। তারপর দেখলুম লম্বু মুখার্জি ভয়ে ভয়ে মাঠেই নামেনি—তাই আমারও খেলারও কোন মানে হয় না । 

অবশ্য সেদিন ক্রিকেট ম্যাচে আমরাই জিতেছিলুম, কারণ বোলার হিসাবে ভ্যাবলা ও বিমল অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছিল । পঁচিশ রাণের বিনিময়ে—দশটা উইকেটই ওরা নিয়েছিল। 

কার্তিকপুরের ক্লাব ঘরে ফিরে এসে ভজুদা বললেন : আমি ভেবে চিন্তে প্রথম বলেই আউট হলুম—কারণ ভেবে দেখলুম ঐ মাঠে আমার মতো লোকের খেলার কোন মানেই হয় না । 

ভীমরুলদা বললেন : তা তো বটেই । তাছাড়া আপনার ভয়ে লম্বু মুখার্জ্জী খেলতে না নামায়—আমাদের খুব সুবিধে হয়েছে— কারণ লম্বু মুখার্জীর একবার হাত জমে গেলে সহসা আউট করা সম্ভব হো'ত না ! 

ভজুদা বললেন : যদি বেঁচে থাকি রঞ্জিত ষ্টেডিয়ামে আমি একবার খেলার মতো খেলা দেখাব । সি এ বি কে আজই চিঠি লিখে দিচ্ছি ! 

ভজ্‌দা— 

৬৫ 

215! 

দেখতে দেখতে মাঘ মাস পার হয়ে গেল। রুদন্তী গাছ বা বিশল্য করনী গাছের কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। চৈত্র মাসের আর বেশী দেরী নেই । গণেশ সাপ্লাই বিজিনেস খুলতে হ'লে—কম করেও পঞ্চাশ হাজার টাকা দরকার। 

মাত্র আট হাজার টাকা পেলেন । 

ভীমরুলদা জমি বন্ধক রেখে 

টেবলুও এসে বলল: পঁচিশ হাজার টাকা গণেশ সাপ্লাই বিজিনেসে লাগানো আমার পক্ষে সম্ভব হবেনা। বাবা পাঁচ হাজার টাকা মাত্র দিতে রাজী হয়েছেন । 

ভজুদা বললেন : তেরো হাজার টাকায় গণেশ সাপ্লাই বিজিনেস সম্ভব নয়—-যে ভাবেই হোক পঞ্চাশ হাজার টাকা চাই-ই 

ভজুদ। চিন্তিত। 

টাকার দরকার হ'লেই টাকা পাওয়া যায় না। ভীমরুলদা একেবারেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। একমাত্র ভজুদাই আমাদের সকলের ভরসা । 

ভজুদা মাথার চুল টানতে টানতেই বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা চিন্তা করছিলেন। পনের মিনিট পরেই ‘ইউরেকা' বলে চেঁচিয়ে উঠলেন । ভজুদার চোখে মুখে বেশ প্রফুল্ল ভাব । প্রফুল্ল চিত্তেই বললেন : 

পেয়ে গেছি। এক লাখ টাকা পেয়ে গেছি । আর কোন ভাবনা নেই । 

ভীমরুলদা বললেন : কি পেয়ে গেছেন ভজুদা ? 

: এক লাখ টাকা । 

কে জানে ভজুদ৷ ইতি মধ্যেই কোন গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছেন কিনা । 

এক লাখ টাকা কোথায়ই বা পেলেন, কখনই বা পেলেন কে 

জানে ? না, লটারী পাবেন—তাই বা কে জানে ? 

আমরা সকলেই ভজুদার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি । 

ভজুদা বললেন : আমি গান গাইব । 

৬৬ 

পটলা বলল : গান থেকেই একলাখ টাকা কি করে এক মাসের মধ্যে উপায় করবেন ? 

ভজুদা অৰ্দ্ধ নিমীলিত চোখে ভাব-গম্ভীর কণ্ঠে বললেন : এতো আর যে সে গান নয় – ঐ গান গেয়ে একদিনেই লাখ টাকার বেশী ইনকাম্ করা সম্ভব । 

ভীমরুলদা হাত জোড় করে বললেন : দোহাই ভজুদা, হেঁয়ালি না করে আসল কথা বলুন ৷ 

ভজুদা বললেন : তোমরা টিকিট কেটে জলসার ব্যবস্থা কর । এমন গান শুনতে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকেও লোক আসবে ৷ টিকিট দিয়ে তোমরা কুলিয়ে উঠতে পারবে না, জায়গা দিয়েও তোমরা কুলিয়ে উঠতে 'পারবে না, কোলকাতা কর্পোরেশনের এবং পশ্চিম বঙ্গ সরকারের কাছে অনুমতি নিয়ে—একমাত্র গড়ের মাঠেই এই 

ধরণের গানের আসর করা সম্ভব ! 

পটল৷ বলল : সে গানের আসরে ক'জন শিল্পী থাকবে—বোম্বে থেকেও নিশ্চয়ই শিল্পা আনতে হবে । 

ভজুদা মুচকি ’েসে বললেনঃ আমি একাই গাইব ? 

: সে কি গান দাদা ? 

ভজুদা অৰ্দ্ধনিমীলিত চোখে বল ে: আমি এমন গান গাইব সে গান—আজ পর্যন্ত কেউ গায় নি। 

দীপক-রাগিনী । আসরে 

একশ একটা ঘিয়ের প্রদীপ থাকবে, সেই প্রদীপ গুলো আমার গানের সুরমূর্ছনায় একে একে জ্বলে উঠবে । 

ভজুদার কথা শুনে আমরা সকলেই অবাক হয়ে গেলাম । ভীমরুলদা ভীষণ অভিভূত হয়ে বললেন : এরকম গানের কথা প্রচার করলে, জায়গাই দেওয়া যাবেনা। একলাখ কেন—পাঁচ লাখ হবে । কিন্তু গড়ের মাঠ ঘিরে নিতে পারি এমন টাকাই বা কোথায় ? 

টেবলু বলল : আমাদের হাতে যে টাকা আছে বারাসাতের সুভাষ-ময়দান অনায়াসে আমরা ঘিরে নিতে পারব। ঐ মাঠে 

৬৭ 

পঞ্চাশ হাজার লোকের সিটিং একোমোডেশান দেওয়া যাবে। পাঁচ টাকা করে পঞ্চাশ হাজার টিকিট বিক্রী করলেও—কম করেও আড়াই লাখ টাকা উঠবে । ডেকোরেশান, লাইটিং এবং পাবলিসিটি বাবদ পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করলেও দু'লাখ টাকা নেট প্রফিট থাকবে । প্রথমে ছোট থেকেই শুরু করা যাক্ ৷ তারপর ঐ দু'লাখ টাকা নিয়ে গড়েরমাঠ ঘিরে ফেলে বিরাট কিছু করাও যাবে। তখন আর পায় কে ? 

টেবলুর প্রস্তাব আমরা সকলেই মেনে নিলুম ৷ ভীমরুলদাও বললেনঃ গণেশ সাপ্লাই বিজনেসের আর আমাদের প্রয়োজন হবে না—জলসার বিজনেস করেই অর্থাৎ একমাত্র ভজুদাকে নিয়ে আমরা 

লালে লাল হয়ে যাব ৷ 

ভজুদা ভাবগম্ভীর কণ্ঠে বললেনঃ একমাত্র তোমাদের জন্যেই আমাকে প্রচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তোমাদের আর্থিক কষ্টের কথা স্মরণ করেই --- আমাকে বারোবছর পরে গান গাইতে হচ্ছে । আমার ওস্তাদ ছিলেন হিমালয়ের এক সাধু। তিনি বরফাবৃত পর্ব্বতের ওপর বসে—দীপক রাগের মাধ্যমে হাজার প্রদীপ জ্বালিয়ে ছিলেন। সেদিনই আমি বুঝতে পেরেছিলুম – ভারতীয় রাগ-সঙ্গীতের মতো সঙ্গীত নেই । আধুনিক গান কি আবার গান আরে ছো ! টেম্পোয়ালা হিন্দীগান শুনে আমার মনে হয়—গানের নামে একি বেলেল্লাপনা ! তোমাদের আর্থিক 

তোমাদের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবেই আমাকে দীপক রাগ ধরতে হচ্ছে ! পাদ-প্রদীপে আসতে হচ্ছে ! 

ব্যাস্! ভজুদার প্রতিশ্রুতি পেয়েই—আমরা সেই মহাসঙ্গীতের আসরের দিন ক্ষণ স্থির করে ফেললুম। প্রচারে প্রচারে চারিদিকে তোলপাড় করে ফেললুম। শুধু এক কথা—বিশ্ববিখ্যাত ভজুদা দীপক রাগ গাইবেন—আসরে সবার সামনেই একশ একটি ঘিয়ের প্রদীপ রাগ-মুর্ছনায় জ্বলে উঠবে। এ সঙ্গীতের তুলনা নেই ! খবরের কাগজওয়ালারা নিজেরাই—তাদেরই প্রয়োজনে এমন একটি সংবাদ লুফে নিল । আমাদের আর খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে 

৬৮ 

ae 

ভজুন। হুযড়ি খেয়ে পড়লেন (পূঃ ৫৮ ) 

C3 

হো’ল না—তারাই দীপক রাগের কথা প্রচার করতে লাগল ৷ এক বিরাট কোম্পানীতে। টিকিটের পেছনে তাদের নাম ছাপাবার জন্য পঁচিশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে গেল । বিভিন্ন হুজুগে প্রতিষ্ঠান আমাদের ব্যাপক সহায়তা করবার জন্য নিজেরাই স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে এগিয়ে এল । 

সে এক এলাহি কাণ্ড! বারাসাতের সুভাষ ময়দান সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলা হোল । বিভিন্ন বড় বড় সংস্থা প্যাণ্ডেলের ভেতরে তাদের প্রস্তুত দ্রব্যসামগ্রীর প্রচার ব্যবস্থার জন্য স্পেস ভাড়া করলেন—স্পেস ভাড়া দিয়ে আমরা একলাখ টাকা পেয়ে গেলুম । 

আর পঞ্চাশ হাজার টিকিট হু হু করে দু'দিনের মধ্যেই বিক্ৰী হয়ে গেল ! একসট্রা দু'হাজার আসনের ব্যবস্থা করা হোল, দিল্লী, লণ্ডন, নুইয়র্ক প্রভৃতি স্থান থেকেও বহু গণ্য মান্য লোক এলেন- এমন গান ও রাগ সঙ্গীতের মাধুর্য্য উপলব্ধি করার জন্য। পাঁচ টাকার টিকিট কালে৷ বাজারে হাজার টাকাতেও বিক্রী হ'তে লাগল ৷ বলা বাহুল্য, সারা ভারতে—এবং সারা বিশ্বে এক বিরাট আলোড়ন পড়ে গেল ৷ সারা বিশ্বের বেতার ও টেলিভিশন সংস্থার লোকেরাও বারাসাতে এসে ভীড় জমাল ৷ 

সে এক বিরাট ব্যাপার । এক এলাহি কাণ্ড! আমার পক্ষে 

ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় ! 

ভজুদা সব শুনেতো কেঁদেই ফেললেন, অর্থাৎ আনন্দেই কেঁদে বললেনঃ এমনটি যে হবে আমি ভাবতেই পারিনি। এর থেকে 

আমি বড় বড় অনেক কাজ করেছি—কিন্তু নামের মোহ আমাকে কোনদিনই বিভ্রান্ত করতে পারেনি। বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ সংস্থাকে এতদিন আমি আমার সম্বন্ধে নীরব থাকতে বলেছিলুম–আরতো তাঁদের নীরব রাখা যাবেনা। জাপানের তোশেই সংবাদ সংস্থা, রাশিয়ার তাস নিউজ এজেন্সী, আমেরিকার এসোসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকা এবং ইউনাইটেড প্রেস অব আমেরিকা, ইংলণ্ডের রয়টার ও গ্লোব এজেন্সী, ফ্রান্সের হাডানা এজেন্সী, ইতালীর স্টাফানি, 

१० 

জার্মানীর ডি-এন-টি, ভারতের পি,টি, আই এবং ইউ পি আই-- সব সংস্থা আমার অনুরোধেই আমার সম্বন্ধে এতদিন নীরব ছিল, কিন্তু এবার তো আর চুপ করে থাকবে না । ফলে নামের মোহ যে আমাকে অধঃপতনে নিয়ে যাবে। সেই দুঃখেই আমি কাঁদছি । এ আমি কী করলাম ! 

তবলা ভজুদাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল: কি... আ...আ...আর, কি... ক...করবেন ? আ-আ-আরতো, উ-উ-উপায় নেই ! 

পটলা বললঃ এখন আপনি না গাইলে—সবাই আমাদের পিটিয়েই লাশ বানিয়ে দেবে । 

ভজুদা গম্ভীর কণ্ঠে বললেনঃ তোমাদের ভালবাসায় আমি বাঁধা পড়ে গেছি ভাই, আমি আসরে বসব এবং গান গাইব । 

যথা সময়েই ভজুদা আসরে এলেন । গেরুয়া ধূতী, গেরুয়া পাঞ্জাবী, কাঁধে গেরুয়া সিল্কের চাঁদর । আসরে লোকে লোকারণ্য। রা জ্যর মন্ত্রীরাতো এসেছেনই, কয়েক জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও এসেছেন, তাছাড়া এসেছেন বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত জগতের বিভিন্ন দিকপালগণ । 

তারপর প্রেস-ক্যামেরা ম্যান, বিভিন্ন টেলিভিশন সংস্থার কর্ম- কর্তারা। বাইরেও অজস্র লোক ৷ 

ভজুদা আসরে বীণা নিয়ে বসতেই, চারিদিক থেকেই হাতে তালি। আধঘণ্টা ধরে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবেই হাততালির বহর চলল ! 

পটল৷ তবলা সঙ্গত করবাব জন্য পাশে গিয়ে বসল ! ভজুদা 

গান ধরলেন তানা-তানা-তানানা ধা । তানা-তানা—তানানা ধা! তানা-তানা-তানানা ধা ! 

আধ ঘণ্টা ধরেই সে গান চলল ! তারপর ? 

হঠাৎ আসরের সকল বাতি অফ হয়ে গেল। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এল ! দশ মিনিট পরে আবার বাতি জ্বলল, কিন্তু ভজুদাকে কোথায়ও পাওয়া গেল না। ভজুদার পাত্তাই পাওয়া গেল না । ভজুদা 

গায়েব হয়ে গেলেন । আমরা উদ্যোক্তরা সকলেই চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলুম! চারদিক থেকে হইচই, চেঁচামেচি উঠল । 

ভীমরুলদা মাইকে বললেনঃ আপনারা সব শান্ত হোন্ ! দর্শক ও শ্রোতারা শান্ত হ’লেন। তাঁরা ভেবেছিলেন ভজুদ। আবার গাইবেন! 

ভীমরুলদা মাইকের মারফত ঘোষণা করলেন: আমাদের ভজুদা একজন বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তি। নিশ্চয়ই কোন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র কারীর দল তাকে গায়েব করেছে—এ সম্বন্ধে আমরা নিঃসন্দেহ। যারা টিকিটের টাকা ফেরত নিতে চান---তারা অবশ্যই কাউন্টার থেকে টাকা ফেরত নিতে পারেন । 

সত্তর হাজার টিকিটের মধ্যে টাকা ফেরত নিয়েছিলেন চল্লিশ হাজার লোক ৷ ত্রিশ হাজার লোকের পক্ষে টিকিটের টাকা ফেরত নেওয়াই সম্ভব হয়নি। তাছাড়া বিভিন্ন কোম্পানী বিজ্ঞাপনের স্পেস ভাড়া করায়— খরচা বাদেও আমাদের দেড়লাখ টাকা লাভ হয়েছিল ! পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্লাবের উন্নয়ন খাতে ব্যয় করেছিলুম, একলাখ টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করেনিয়েছিলুম। ভজুদা উধাও হয়েও আমাদের আর্থিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছিলেন। 

কিন্তু আমাদের পরম প্রিয় ভজুদা যে কেন এবং কি ভাবে—উধাও হয়ে গেলেন—আমরা কেউ বুঝতেই পারলুম না । 

আমরা ভজুদার খোঁজে সারা ভারত ঘুরে বেড়িয়েছি—কিন্তু কোথায় ও ভজুদার খোঁজ পাইনি । 

তাই আমাদের একান্ত অনুরোধ যদি কেউ কোথায়ও বিশ্ববিখ্যাত ভজুদার খোঁজ পান—অবশ্যই কার্তিক পুরের ইয়ংম্যানস ক্লাবের গোচরে আনবেন । আমরা ক্লাবের তরফ থেকে ঐ ধরণের সংবাদ দাতাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেব বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রইলাম । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ