পুজোর ছুটিতে, প্রতি বছরের মতো এবছরও তিতাস তার মামার কাছে যাবে বেড়াতে। সব ঠিকঠাক। কাল সকালেই তারা রওনা দেবে। তারা তিনজন। তার বাবা,মা আর তিতাস। অনেক দূরের রাস্তা জব্বলপুর। মধ্যপ্রদেশের একটা ডিসট্রিক্ট শহর।
খুব সুন্দর গোছানো শহরটি। কি নেই সেখানে ?
তার মা বলল, খুব সকাল সকাল বেরতে হবে কিন্তু তিতাস, জব্বলপুর রাস্তা তো একটুখানি নয়, তোর মামাকে সব বলে রেখেছি। তোর মামা আসবে লখনৌ স্টেশানে। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে যাবে।
তোর মামা নাকি তোর জন্য ব্যাট আর বল কিনে রেখেছে। গিয়ে খেলতে হবে তো ?
তিতাসের মামা, বলরাম বোস হলেন রেলে, জব্বলপুরের ডিভিশানাল ম্যানেজার। অফিসের কাজে তাকে মাঝে মধ্যেই এখান ওখান ছুটতে হয়। একটা গোটা ডিভিশানের দায়িত্ব তার মাথায়। তাই কাজের চাপে তিনি বিয়ে করার ফুরসতটুকুও পাননি।
এই ভাগ্নেটিকে নিয়েই তার যত স্বপ্ন। তিতাসকে তিনি বড়ো ভালোবাসেন। আর তিতাসও তার মামাকে খুব ভালোবাসে। প্রতি বছর, ওরা এই পুজোর ছুটিতে মামার কাছে বেড়াতে আসবেই। সেখানে এক সপ্তাহের সফরে তাদেরও আনন্দের অন্ত থাকে না।
পরের দিন সকাল-সকাল হাওড়া স্টেশান থেকে তারা ট্রেন ধরল। আজ তিতাসের ভারী আনন্দ। ট্রেনে কতরকম বায়না, কতরকম খাবার-দাবার। আর বাকি সময়টা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা। সে যে কি মজা, বলে বোঝানো যাবে না !
ট্রেন অবিরাম ছুটে চলেছে - কু-ঝিক-ঝিক..!
তিতাস জানালা দিয়ে বাইরের গাছ পালা নদী পাহাড়, সব কিছু দেখতে দেখতে চলেছে।
ওর শিশুমন সবকিছুকে চেটেপুটে খেতে চায়। প্রকৃতির সব দৃশ্যপট গলাধঃকরণ করেও ওর মনের ক্ষুধা পরিতৃপ্ত হয় না। প্রকৃতির কি অনুপম দৃশ্যপট ! সেই দৃশ্যপটকে মনের রসে জারিত করে রং তুলি দিয়ে নতুনভাবে নিজের মতো করে, আঁকতে আঁকতে চলেছে তিতাস।
ট্রেন অবিরাম গতিতে ছুটে চলেছে কু...ঝিক...ঝিক..!
সেই দিনটা সারাদিন সারারাত যাওয়ার পর, পরের দিনেও সারাদিন যাবার পর সন্ধ্যার মুখে তারা এসে পৌছালো লখনৌ স্টেশানে। লখনৌ স্টেশানে ট্রেন ঢুকতেই তারা খুঁজতে লাগলো তিতাসের মামাকে। ভিড়ের মধ্যে কখন যে বলরামবাবু ট্রেনে উঠে পড়েছেন, তা, তারা খেয়ালই করতে পারেনি।
কি গো বিনয়, কেমন আছো ?
এই মল্লিকা, ভালো আছিস তো ?
হ্যাঁ দাদা, আমরা সব ভালো আছি। তুমি ভালো আছো তো ?
আমার আবার ভালো থাকা।
ওই আছি রে কোনরকম !
কেন দাদা, এরকম বলছো কেন ?
না, মানে, আমার ভালো থাকা আর মন্দ থাকা তো একই ব্যাপার ? তাই বললাম আর কি !
যাইহোক, তিনি তাদের কাছে এসে বসলেন। তার সঙ্গে একটি এ্যাসিসট্যান্ট অফিসারও এসেছেন। অনেক কথা অনেক গল্পে ট্রেনের কামরায় সকলেই আনন্দে মুখরিত। ট্রেন আবার অবিরাম গতিতে ছুটে চলেছে, কু...ঝিক...ঝিক..!
মধ্যপ্রদেশের একটা ছোট্ট অনামী স্টেশন বারডিংলা। যেটাকে স্টেশন না বলে হল্ট বলাই ভালো। এখানে অবশ্য সব ট্রেন দাঁড়ায় না, আর এক্সপ্রেস দাঁড়ানোর তো কোনো গল্পই নেই। কিন্তু,তাদের এক্সপ্রেসটা কোনরকম সিগন্যাল না পেয়ে, এই হল্টে হঠাৎ করে এসে দাঁড়িয়ে গেল ! বারডিংলায় কোন প্যাসেঞ্জার নামল না কিন্তু একঝাঁক প্যাসেঞ্জার উঠল, হঠাৎ করে ট্রেনটি দাঁড়ানোর জন্য। তারা সকলে তিতাসদের কামরাটাতেই উঠল ! তাদের গায়ে সব কি সুন্দর একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ !
কিছুক্ষণ বাদে তাদের কথাবার্তায় বোঝা গেল, যে ওরাসব, কোন একটা বিয়েবাড়িতে বরযাত্রী যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে ওদের গান বাজনা শুরু হল। ট্রেন সফরের এই বাড়তি পাওনাটুকু বেশ ভালোলাগে তিতাসদের।
তাদের আরও বেশি ভালো লাগে, বলরামবাবু সাথে আছেন বলে। খানিকটা পথ এখনো যেতে হবে ওদের। অতএব মুখ বুজে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। এই রাতের, সুন্দর সফরে তিতাসরাও ওদের সাথে সামিল হয়ে গেল। কথায় বার্তায় মিশে গেল সকলেই। তখন শুধু আনন্দ আর উচ্ছাস।
রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে ভেঙে, অবিরাম গতিতে ছুটে চলেছে তাদের জব্বলপুরগামী সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস।
এত সুন্দর পরিবেশের মধ্যে, হঠাৎ করে, কোথা থেকে একটা পোড়া পোড়া গন্ধ তিতাসদের সকলেরই নাকে লাগতে শুরু করল !
কিছুক্ষণ বাদে, বলরামবাবুর মোমাইলে অফিস থেকে একটা কল এল ! আর, তারপরই তিনি ট্রেনের এই কামরা থেকে অন্য কামরায় পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে লাগলেন ! তিতাসের মা জিজ্ঞাসা করল, দাদা, কিছু কি হয়েছে ?
তিনি বললেন, না, না ! তোরা চুপ করে এখানেই বোস। আমি একবার আসছি ! আর একটা কথা কিন্তু, কেউ উঠতে বললেও যেন উঠিস না !
বিস্ময়ে এদিক ওদিক তাকাতেই, তারা দেখল, একঝাঁক অগ্নিদগ্ধ মানুষ তাদের দিকেই ছুটে আসছে !
বাবুজী, কামরে মে আগ হো গিয়া... জলদি উতরো..!
ট্রেনের কামরায়, সেই মিষ্টি গন্ধ এক নিমেষেই কোথায় উধাও হয়ে গেছে ! এখন শুধুই মানুষ পোড়ার বিভৎস একটা গন্ধ নাকে আসছে !
সকলের মুখই পুড়ে কালো হয়ে গেছে ! কিন্তু একটা সৌভাগ্য, তাদের এখনো কিছু হয়নি !
তিতাসের বাবা বলল, আমাদের এখনই কিছু একটা করতে হবে, নইলে প্রাণে বাঁচব না !
তার মা এবং তিতাস, এই তাৎক্ষণিক পরিস্হিতিতে একেবারেই দিশেহারা !
তিনি বললেন, তুমি এখনই কিছু একটা করো, তা না হলে যে ছেলেটাকে বাঁচাতে পারব না !
তারা সকলেই একসাথে বলতে লাগলো-
বাবুজী, জলদি উতরো...কামরে মে আগ হো গিয়া...!
বিরামহীন গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। আর, তার হাওয়ায় আগুনের লেলিহান শিখা যেন দ্বিগুন বেগে বাড়তে আরম্ভ করল !
এমন অবস্হায়, সেই সমস্ত আধপোড়া মানুষগুলো একে একে সবাই ট্রেন থেকে ঝঁপ দিয়ে নামতে শুরু করল !
ক্রমশই আগুন তাদের দিকে ধাবিত হতে লাগল। শেষে এমন হল যে, তাদের বসে থাকা দায় !
অগত্যা তারা উঠতে বাধ্য হলেন !
গেটের মুখটায় আগুন কিছুটা কম আছে। তাই, বিনয়বাবু বললেন,চলো আমরা ওখানটাই গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু আগুন সেখানেও ধাবিত হতে লাগল! এই পরিস্হিতিতে, সকলেই হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করল !
তাদের পাশ দিয়েই অনেক প্যাসেঞ্জার সেই রাতের অন্ধকারেও, ট্রেনের বাইরে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করতে লাগল !
তাদের পিছনে, চার-পাঁচজন আধ পোড়া লোক তাদের বলছে, বাবুজী জলদি উতরো ! সবকি জান খতরে মে হ্যায় ! জলদি উতরো... নেহি তো জান সে বাচ নেহি পায়োগে..!
এই সমস্ত দৃশ্য চোখের সামনে দেখে, ভয়ে এবং উৎকণ্ঠায়, তারাও মনস্হির করল, তারাও সকলের মতো ট্রেন থেক নীচে ঝাঁপ দেবে !
কিন্তু, ট্রেনের এই প্রচণ্ড গতি, কি জানি কি হয় ! যদি...শেষে...
এমন দোটানার মধ্যেই তারা গেটের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, এখানে দাঁড়িয়েও তারা বিস্মিত! তারা যেন, কোনো এক অমোঘ টান অনুভব করছে ! তাদের, কারা যেন টেনে নীচে নামাতে চাইছে। কোনো একটা অদৃশ্য শক্তির কাছে তারা যেন আজ অসহায় বোধ করছে !
কি করবে তারা এখন ? ভেবে পায়না বিনয়বাবু !
তবুও,প্রাণপণে চিৎকার করতে করতে তিতাসকে বুকে আগলে নিয়ে তারা দু'জনেই গেটের রড ধরে ঝুলছে !
হঠাৎ, হাত ফসকে ছিটকে নীচে পড়ে গেল মল্লিকা আর তিতাস ! পড়তে পড়তে মল্লিকা শুধু একটা কথাই বলেছিল, আমাদের ওরা ধাক্কা দিয়ে নীচে ঠেলে দিল বিনয়...!
বিনয় এখন কী করবে ? ভেবে পায় না ! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সে !
এমন তাৎক্ষণিক মুহূতে কারও মাথাই কাজ করে না। বিনয়বাবুরও করেনি ! তিনি এক মুহূর্তও কোনো সময় নষ্ট না করে তাদের বাঁচাতে, সাথে সাথেই ট্রেন থেক ঝাঁপ দিলেন নীচে !
একটা ভারি কোন বস্তুতে প্রচণ্ড আঘাত লাগে তার মাথায়! হাত-পায়েও প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে ! শরীরের অন্যান্য অংশও হয়তো ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে ! কিন্তু মাথাটা যে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে, তা তিনি সাথে সাথেই বুঝতে পারেন ! যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে মাথাটা ! তবুও দুহাতে মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে, যন্ত্রণাটা লঘব করার চেষ্টা করছেন বিনয়বাবু !
দু'হাত বাড়িয়ে খুঁজতে থাকেন মল্লিকা ও তিতাসকে ! একবার অব্যক্ত স্বরে ডাকলেন মল্লিকা বলে ! আরো একবার খুব কষ্ট করে ডাকলেন তিতাস..!
কিন্তু, তাদের কোনো সাড়া নেই !
এইভাবে, কতক্ষণ পড়ে আছেন, তা তিনি জানেন না। কিন্তু যখন তার ঘোর কাটল, অনুভব করলেন চোখে তিনি ভালো দেখতে পাচ্ছেন না ! এখন তার মাথাটাও যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে ! ওঠার কোনো শক্তি নেই ! তবু, মল্লিকা এবং তিতাসের জন্য তখনও তিনি চিন্তায় ব্যকুল ! কোনোরকমে উঠে বসলেন। দাঁড়াবার কোনো শক্তি তার নেই ! তার মাথা থেকে রক্ত গা বেয়ে ঝরে পড়ছে !
ভোরের মৃদু আলোয়,আস্তে আস্তে তার চোখের দৃষ্টি একটু একটু করে সজাগ হচ্ছে। তিনি দেখলেন, ইতস্তত চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে পোড়া মানুষের লাশ ! কিছু জিনিষপত্র, আর তিতাসের হাতে ধরে থাকা সেই খেলনাটা !
তাকে ধরে ঘিরে আছে এক দল মানুষ ! যাদের সকলেরই গা, হাত, মুখ, সব পোড়া ! দেখলে চেনা যায় না! ঠিক যেমন গত রাতে ট্রেনের সেই আধপোড়া মানুষগুলোর মতো ! কি অসহায় ভাবে হাউ হাউ করে তিনি কাঁদতে লাগলেন ! গায়ের সমস্ত জোরটুকু প্রয়োগ করে, স্ত্রী পুত্রের ব্যকুলতায়, মনের জোরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন ! তাদের খুঁজতে লাগলেন পাগলের মতো ! কিন্তু, সেখানে কোথাও তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন না..!
কিন্তু, তিনি শুনতে পেলেন কারা যেন দেহাতি হিন্দি ভাষায় বলাবলি করছে, ইস ট্রেন মে তো আগ হো গিয়াথা ! চারো কামরে কো পাল্টি হো গ্যায়ি !
ইস কামরে মে, হামারা বড়া সাহাব বলরামবাবু থা ! উনকো ভি মত হো গিয়া ! ইয়ে দ্যাখো ভাইয়া, ট্রেন সে গীড়নে কা বাদ, সামনা বালা পাত্থর মে উনকো ক্যায়সে মত হুয়া ! আভিতক্ কোই দিখা ভি নেহি !
এই কথাগুলো বিনয়ের কানে আসা মাত্রই তিনি বুঝতে পারলেন যে, দাদা আর বেঁচে নেই !
তবুও নিজের শরীরটাকে টানতে টানতে বহু কষ্টে সেখানে গিয়ে তিনি হাজির হলেন এবং নিজের চোখে দেখলেন যে বলরামবাবুর চোখ-মুখ আগুনে পুড়ে একেবারে ঝলসে গেছে !
তিনি একটা বড়ো পাথরের ওপর মুখ থুবরে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন ! তার কানে মাথায় পিঁপড়ে ধরে গেছে !
এই সমস্ত বীভৎস দৃশ্য দেখে বিনয়বাবু আর সহ্য করতে পারলেন না ! তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না ! বহুকষ্টে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে জঙ্গলের মধ্যে আছড়ে পড়ে গেলেন ! এইভাবে তিনি কতক্ষণ পড়ে ছিলেন তা কারও জানা নেই !
সকালবেলার প্রথম সূর্যের আলোটা চোখে-মুখে পড়তেই বিনয়বাবু চোখ মেললেন। এখন তার যন্ত্রণাটা অনেক কমে এসেছে। গা হাতেও আর তেমন ব্যথা নেই। শরীরটা এখন বেশ সুস্হ লাগছে। এবার আস্তে আস্তে উঠে বসলেন তিনি ! পুব দিকের লাল সূর্যটা সবেমাত্র হলুদ হতে শুরু করেছে ! চারিদিকে লোকে লোকারণ্য !
সকলেই অচেনা। কাউকেই চেনা যায় না।
তিনি একবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু, তিনি আর উঠতে পারলেন না !
ঠিক সেই মুহুর্তে, পিছন থেকে কার যেন এক জোড়া ঠান্ডা হাত, তার হাতটাকে শক্ত করে ধরে, তাকে মাটি থেকে টেনে তুলতে চাইছে !
এ কী, দাদা..? আপনি এখানে..! আপনি তো মারা গেছেন..? তাহলে...এখানে এলেন কী ভাবে..!
ভাই বিনয়...তুমিও আর বেঁচে নেই..! আমি বলেছিলাম না, কেউ ডাকলেও যেন সিট থেকে উঠো না। তা, শুনলে আমার কথা..? শোনো বিনয়, ট্রেনের এই বিভৎস ঘটনাটা আজ নয়, আজ থেকে তিন দিন আগের ঘটনা ! আমিও তিন দিন আগেই মারা গেছি, এই বারডিংলার জঙ্গলের সেই ভয়ঙ্কর রাতে..! কিন্তু, অনেক চেষ্টা করেও আমি তোমাদের বাঁচাতে পারলাম না..! ওই দ্যাখো, মল্লিকা আর তিতাস আসছে ! এসো বিনয়... বাকি পথটা আমরা সকলেই একসাথে যাই..!
0 মন্তব্যসমূহ