ট্রেনের কামরা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে একপাশে কাত হয়ে পড়ে কিছু দূর এগিয়ে থামল। ভেতরের বিদ্যুতহীনতায় ঘুটঘুট্টে অন্ধকার আর যাত্রীদের তীব্র আর্তনাদের মধ্যে সৌরভ জ্ঞান হারায়।
যখন জ্ঞান ফেরে দুই হাতের কনুইয়ের কাছে তীব্র যন্ত্রনা। ধীরে ধীরে মাথা কাজ করছে। দুর্ঘটনা ঘটেছে। যাত্রীদের কাতরানোর আওয়াজ পাচ্ছে ও। ঘষটে ঘষটে দরজার কাছে গিয়ে অতি কষ্টে নামল। নেমে সামনে তাকিয়েই দেখল বেশ কয়েকটা কামরা একেবারে উল্টে গেছে। বাইরে মেঘলা হলেও পূর্ণিমার জন্য চারিদিক স্পষ্ট। ব্যাথাটা দাঁত চেপে সহ্য করছে। কামরাটা থেকে যে-ক'জন নড়াচড়া করতে পারছে সৌরভের দেখাদেখি দরজা দিয়ে নামল। একজনের চোখে বীভৎস ক্ষত। চোখ ঢেকেই নেমেছেন উনি। কতক্ষণে রেসকিউ টিম আসবে কে জানে! আর একজনের কাঁধে চোট আছে বলছে। এই ক’জন লাইনের উপরেই বসে পড়ল। দূরে যেসব কামরা অক্ষত আছে সেখান থেকে লোকজন উঁকি মারছে। অথচ কেউ দুর্ঘটনার কবলে পড়া চারটে কামরার দিকে এগিয়ে আসছে না। আকাশে হঠাৎই বিদ্যুতের ঝলকানি। সৌরভ ভেবে পেল না এর মধ্যে বৃষ্টি নামলে কী করবে। সবার যা চোট, ওরা নিজে থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছে ঠিকই কিন্তু আর এগোনোর ক্ষমতা নেই। যে মানুষটার চোখে ক্ষত উনি রেলের পাথর-বিছানো ফাঁকা জায়গাটায় এইবার শুয়েই পড়েছেন আর কাতরাচ্ছেন। ট্রেনের ভিতরে যারা আছেন ওরা সবাই কী মৃত! সৌরভ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে। ব্যথা সহ্য করতে করতে উঠে দাঁড়াল। সামনে ছোটো একটা পুরোনো ঘর মতো দেখা যাচ্ছে। এগোতে লাগল ওইদিকে। বাড়ি থেকে রওনা দেবার সময় গায়ে প্রচণ্ড জ্বর ছিল। এখন বৃষ্টিতে ভিজলে নিউমোনিয়া নির্ঘাত। আগে একবার হয়েছিল।ওর এগোনো দেখে দু’জন সহযাত্রী পিছু নিল। ওনারা কোনো কথা বলছে না দেখে সৌরভের অস্বস্তি হতে লাগল।
পরিত্যক্ত ঘরটাতে আশ্রয় নিতেই জোরে বৃষ্টি নামল। অন্য দু’জন দাঁড়িয়ে আছে অনতিদূরেই। এই পোড়ো, জঙ্গলী-গাছে ঘেরা ঘরটাতে সৌরভের কেমন গা ছমছম করতে লাগল। সাপ-খোপের উপদ্রব তো থাকতেই পারে। এদিকে বৃষ্টি কখন কমবে কে জানে! হাত মচকেছে নাকি ফ্র্যাকচার হয়েছে ও বুঝতে পারছে না। জ্বরের ওষুধ জ্বর কমায় সাথে গা-হাত-পা ব্যাথা কমায়, ওষুধ খেয়ে ও ট্রেনে ঝিমোচ্ছিল। তাতেই কি যন্ত্রণা মাঝে মাঝে কমে আসছে আবার দমকা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে! ব্যাথা বাড়া-কমার মধ্যেই লোক দু’টোকে আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। সুলেখা জ্বর নিয়ে কলকাতাতে আসতে বারণ করেছিল। কিন্তু মায়ের ফোন। যা কিছু হয়ে যাক সৌরভকে আসতেই হবে, দু’দিনের জন্য হলেও। সুলেখা এক বছরের ছেলেটাকে নিয়ে এলাহাবাদেই রয়েছে।
ছোট ঘরটাকে রেলের পুরোনো সম্পত্তি বলেই মনে হচ্ছে। পাশের দু’জনের অভিসন্ধি কী! পার্স, ফোন হাতড়াতে দেখল কিছুই নেই। ট্রেনেই আছে তবে। নিজের মনেই বিড়বিড় করে চলেছে ‘কেউ কি আমাদের উদ্ধার করতে আসবে না’! বৃষ্টি আধ ঘন্টা পর কমল। সৌরভ বড়ো বড়ো টর্চ জাতীয় কিছুর আলো দেখতে পেল যেন। সহযাত্রী ভদ্রলোক দু’জনকে যেচে বলল, চলুন আমরা আস্তে আস্তে এগোই আবার ওখানেই। এখানে থাকলে আমাদের সন্ধান কেউ পাবে না’।ওঁরা কোনো উত্তর না দিয়ে সৌরভের পিছে পিছে চলল। এরা চোর নাকি? কিছুই পাবে না ওর কাছে। ট্রেনের সামনে এসে দেখল উদ্ধারকারী দল একে একে লাশগুলো নামিয়ে রাখছে। আহতদের জন্য অনেক অ্যাম্বুল্যান্স। সৌরভ কাছে গিয়ে বলল, ভাইয়া, হামে হসপিটাল লেকর চলিয়ে। হাম ইসি ট্রেন কি প্যাসেঞ্জার হ্যায়। বারিশ মে শেল্টার ঢুনঢতে হুয়ে নজদিক এক পুরানে ঘর মে ঘুস গয়ে থে। কেউ যেন ওকে পাত্তাই দিল না। নিজেরা বলাবলি করছে- কে মৃত, কে জীবিত বোঝা দায়! সৌরভ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্ষতিগ্রস্ত কামরার দিকে চোখ যেতে দেখল ওর লাশটাও নামানো হচ্ছে সাদা চাদরে মুড়ে। আর ওই ভদ্রলোক দু’জনের লাশও তো...
0 মন্তব্যসমূহ