Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

কলকাতার ভূত ।। প্রদ্যোত গুহ

ভূত আছে কি নেই সে তর্ক হয়ত ভবিষ্যতেও চলবে কিন্তু ইতিমধ্যে ভূত যে কলকাতা ছেড়ে পালিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।

আমাদের ছোটোবেলায় কলকাতায় ভৌতিককাও অনেক ঘটত বলে শুনতাম। অপদেবতার সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়েছে এমন লোকের দেখাও হামেশাই পাওয়া যেত। তাদের সেই রোমহর্ষক কাহিনি শুনতে শুনতে আমাদের গায়ে কাঁটা দিত।

অন্ধকারে এক ঘর থেকে আর এক ঘরে খেতে পারতাম না৷ এখন অবশ্য দেব-দ্বিজে ভক্তির মতো ভূত প্রেতের ভয়ও কমেছে। কিন্তু সে অন্য কথা আমাদের ছেলেবেলায় ভূত কলকাতার শহরে লোকচক্ষুর অগোচরেই শুধু বিরাজ করত তা হয় --- কলকাতার বেশ কিছু- সংখ্যক বাড়িও ছিল তাদের দখলে। লোকে সে-সব বাড়ির ধারে-কাছে ঘেঁষত না। দু-চারজন 'ড্যাম কেয়ার লোক যারা সেই সব বাড়িতে ভূতের উপর মামদোবাজী করতে গেছে- তাদের নাজেহাল হবার কাহিনি তখন লোকের মুখে মুখে ফিরত। এমন কি তাদের কেউ কেউ জানে-মালে ফৌত হয়েছে বলেও শুনেছি।

বেচারা এখন কলকাতার লোকসংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। মাথা গোঁজার তাগিদে লোকে যে-যেখানে পেরেছে ঢুকে পড়েছে - বড়লোকের খালি বাড়ির মতো ভূতের বাড়িও রেহাই পায়নি । ভূতের বাড়িগুলি এতদিনে সত্যিই বে-দখল হল। উদ্বাস্তু ভূতেরা কোথায় গেছে জানি না। হয়ত শহরেরই কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে আছে। কিন্তু তাদের সে প্রতাপ আর নেই। ভুতের গল্পও এখন বড় শোনা যায় না৷

শহর কলকাতায় নানা দেশের নানা মানুষের ভিড়। কলকাতাকে তাই বলা হয়ে থাকে আন্তর্জাতিক শহর। কলকাতার মনুষ্যলোকের মতো প্রেতলোকও আন্তর্জাতিক। ভূতেরও দেশ-কাল আছে। সাদা-কালো আছে। ভূতেরও ইতিহাস আছে৷ এখানে কয়েকটি ঐতিহাসিক ভূতের গল্প বলব।

-লাটের ভূত -

আলিপুরের জজ কোর্টের অনতিদূরে হেস্টিংসের প্রাসাদ। বাড়িটিতে এখন নারী শিক্ষা পর্যদের আপিস হয়েছে। বাড়িটা এককালে ছিল গবর্নর জেনারেলের পল্লীভবন। বাড়িটা নাকি এক সময় ভৌতিক কার্য-কলাপের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। আর সে ভূত স্বয়ং হেস্টিংসের। লাটসাহেবের ভূত। লাটের মতই ছিল তার চলাফেরা।

শোনা যায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি নাকি অদৃশ্য জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে রাজকীয় দাপটে রাস্তা কাঁপিয়ে বাড়ির দরজায় এসে নামতেন । তারপর সেই বিশাল প্রাসাদের প্রতিটি ঘরে তন্ন তন্ন করে কি জানি খুঁজে বেড়াতেন। কোনো মহামূল্যবান বস্তু কি তিনি ঐ বাড়িটাতে ফেলে গিয়েছিলেন যার খোঁজে প্রেতলোক থেকে নিত্য তিনি আনাগোনা করতেন ?

ইতিহাসের পৃষ্ঠা এই রহস্যের উপর কিছুটা আলোকপাত করে। ১৭৮৫ সালের ২১শে জুলাই হেস্টিংস তাঁর বন্ধু এবং প্রাক্তন একান্ত সচিব নেসবিট টমসনকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটার বয়ান নিম্নরূপ :

“বারে বারে আমার দপ্তরের কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু আপনার বা লারকিনসের কাছ থেকে এ বিষয়ে এখনও কোনো সংবাদ পেলাম না। নিয়ে আমি যে কী উদ্বেগের মধ্যে আছি তা আপনারা কল্পনা করতে পারবেন না।"

দপ্তরটি হেস্টিংসের কাছে কিরূপ মূল্যবান ছিল ১৭৮৭ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর কলকাতা গেজেটে' প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন থেকে তা আঁচ করা যাবে। বিজ্ঞাপনটি ছিল এইরকম :

“বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবার সময় ওয়ারেন হেস্ট্রিংস মহোদয়ের একটি কালো রঙের বাক্স তাঁর এপ্লানেডের বাসভবন থেকে খোয়া গেছে কিংবা হয়ত ভ্রমক্রমে তাঁর অন্যান্য অনেক জিনিসের সঙ্গে নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

বাক্সটির মধ্যে দুটি মিনিয়েচার ছবি এবং কিছু ব্যক্তিগত কাগজপত্র ছিল। এতদ্বারা জানান যাচ্ছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি এমন সংবাদ দিতে পারেন যার ফলে বাক্সটি উদ্ধার করা সম্ভব হবে, মিঃ লারকিনস এবং মিঃ টমসন তাঁকে দুহাজার সিক্কা টাকা পুরস্কার দেবেন।”

যতদূর জানা যায় দপ্তরটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এই দপ্তরটির খোঁজেই কী হেস্টিংস তাঁর প্রাক্তন বাসভবনে হানা দিতেন ?

১৮৭৬ সালের প্রথম দিকে বিলেতের ইণ্ডিয়া হাউসের মহাফেজখানায় হেস্টিংসের কিছু কাগজপত্র আবিষ্কৃত হয় । এই কাগজগুলিই কি ছিল সেই রহস্যময় কালো বাক্সে? আর এই আবিষ্কারের পরই কি আলিপুরে হেস্টিংসের ভৌতিক আনাগোনা বন্ধ হয়?

- তুমি কি শুধুই ছায়া? -

সেকালে কলকাতার সুপ্রীম কোর্টে সার অ্যান্টনি ও সার আর্থার বুলার নামে দুজন জঙ্গ ছিলেন। সার আর্থার ও তাঁর ভাই চার্লস আবার ছিলেন টমাস কারলাইলের ছাত্র। আমাদের দ্বিতীয় গল্পটি সার অ্যান্টনি সম্পর্কে।

সার অ্যান্টনির স্ত্রী এবং পরিজনবর্গ ইংলণ্ডে ছিলেন। সার অ্যান্টনি একদিন রাত জেগে স্ত্রীর কাছে দীর্ঘ একটি চিঠি লিখছিলেন। হঠাৎ চোখ তুলতেই দেখেন তাঁর স্ত্রী দরজার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। জজ সাহেব চমকে ওঠেন।

চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে যান স্ত্রীর দিকে। স্ত্রীর ছায়াশরীর এক-পা দু'পা করে পেছু হটতে হটতে অবশেষে এক সময়ে মিলিয়ে যায়। স্তম্ভিতের মতো জজ সাহেব আবার এসে বসেন চেয়ারে। চিঠির খেই হারিয়ে গেছে। মাথার মধ্যে দপদপ করছে। তবু কলম তুলে নিয়ে আবার চিঠি লেখায় মনঃসংযোগের চেষ্টা করেন। আবার চোখ পড়ে দরজার দিকে। দেখেন, ছায়ামূর্তি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বিষণ্ন চোখে চেয়ে আছে তাঁর দিকে। সার অ্যান্টনি আর থাকতে পারেন না। স্ত্রীর নাম ধরে ডেকে দৌড়ে যান ছায়ামূর্তির দিকে। ছায়ামূর্তি আবার পেছু হটতে হটতে শু্যে মিলিয়ে যায়।

কিছুক্ষণ বাদে চাকর-বাকররা এসে দেখে সার অ্যান্টনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। পরদিন সমস্ত ঘটনাটা বর্ণনা করে এবং স্ত্রীর স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশে এক চিঠি লেখেন। চিঠিটি পারিবারিক দলিল হিসাবে বুলারদের গৃহে রক্ষিত আছে।

পরের ডাকে জানা যায় সার অ্যান্টনি যে সময় ছায়ামূর্তি দেখেছিলেন সেই সময়ই ইংলণ্ডে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে।

- কাউন্সিলে আগন্তুক -

সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে অশরীরীর এদেশে আগমনের আর একটি কাহিনীর বিবরণ পাওয়া যায় ১৮৮০ সালে প্রকাশিত পাদ্রী সেভিলের একটি বইয়ে। পাদ্রী সাহেব লিখেছেন, “মি: স্পার্কস আমাকে জানিয়েছেন তার দাদু যোসেফ কার্টার মহোদয় ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের সচিব। একদিন সন্ধ্যায় তিনি সুপ্রীম কাউন্সিলের সভায় বসেছেন কাউন্সিল কক্ষে। মিঃ শেকসপীয়র নামে কাউন্সিলের জনৈক সদস্য হঠাৎ বলে উঠলেন, “হা ভগবান, এ যে দেখছি আমার বাবা !" "কাউন্সিলের সদস্যরাও দেখলেন এক অপরিচিত মূর্তি কাউন্সিল কক্ষের মধ্যে দিয়ে ভাসতে ভাসতে আর একটি কক্ষে অদৃশ্য হয়ে গেলেন, যদিও সে কক্ষের কোনো প্রবেশপথ ছিল না। কাউন্সিল সদস্যদের বিশেষ করে যা চোখে পড়ল তা হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের টুপি। এই টুপির নাম ছিল 'চিমনি পট’–এদেশে সে টুপি পাওয়া যেত না।

ঘটনাটি গবর্নর-জেনারেলের মনকে এতটা প্রভাবিত করেছিল যে তিনি তৎক্ষণাৎ আদেশ দিলেন— ঘটনাটির একটি বিবরণ লিপিবদ্ধ করে যেন মহাফেজখানায় রাখা হয়। বিবরণটি সম্ভবত এখনও সেখানেই আছে ।

কয়েকদিন বাদে মিঃ শেকসপীয়রের বাবার মৃত্যুসংবাদ নিয়ে একটি জাহাজ এসে কলকাতা বন্দরে ভিড়ল। এই জাহাজেই ‘চিমনি পট’ টুপির প্রথম চালানও ভারতবর্ষে এসে পৌঁছল।

- বিলেতে ছায়ামূর্তি -

অশরীরী ছায়ামূর্তিরা বিলেত থেকে শুধু যে এদেশেই, এসেছে তা নয়—এদেশ থেকে ওদেশেও গেছে। ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে জেমস ভগলাম এমনি একটি ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।

অ্যাণ্ড ল্যাঙের জনৈক আত্মীয়া এডিনবরায় থাকতেন। এক সকালে জেগে উঠে তিনি দেখেন তাঁর বাবা তাঁর শিয়রে দাঁড়িয়ে। তাঁর পরনে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সামরিক উর্দি। ভদ্রলোক বুক চেপে ধরলেন। তাঁর মুখে ফুটে উঠল বেদনার অভিব্যক্তি। তারপর ছায়ামূর্তি শূন্যে মিলিয়ে গেল।

ভদ্রমহিলা সব কথা জনৈক পাদ্রীকে খুলে বললেন। পাদ্রী সাহেব ঘটনার দিনের তারিখ-টারিখ সব টুকে নিলেন। ভারতবর্ষে পূর্ণ শান্তি বিরাজ করছে। কাজেই ভদ্রমহিলার দুঃস্বপ্নের কোনো ব্যাখ্যা কেউ খুঁজে পেল না ।

পরবর্তী জাহাজে খবর এল ভারতবর্ষে 'মিউটিনির' হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। ভদ্রমহিলার বাবা পুরো সামরিক পোশাকে গিয়েছিলেন অধীনস্থ সিপাহিদের শাস্ত করতে। সিপাহিদের গুলিতে সেখানে তাঁর প্রাণাত্ত হয়।

- ধর্মতলার হানাবাড়ি -

হান্টার অ্যাণ্ড কোম্পানী ছিল সেকালের একটি বিখ্যাত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। মিঃ লুইস কুপার ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষক। বৌবাজারে এখন যেখানে সেণ্ট জেভিয়ার গীর্জাটি অবস্থিত, ঐখানে একটি বাড়িতে তিনি স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বাস করতেন। বৌবাজার তখন অভিজাত পাড়া ছিল। দৈব- দুর্বিপাকে ভদ্রলোকের দুটি পুত্রই হঠাৎ মারা যায়৷ পুত্র বিয়োগের পর ভদ্রলোকের স্ত্রীর মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ দেখা দেয়। বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে 'তিনি কিছুদিন ভবানীপুরের উম্মাদ আশ্রমে রাখেন।

এই বাড়ির বেদনাদায়ক স্মৃতি ভদ্রমহিলার মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তরায় হবে মনে করে কুপার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের অনতিদূরে ধর্মতলার উপর ছোট একটি বাড়ি ভাড়া করে স্ত্রীকে সেখানে এনে রাখেন। নিজে তিনি বৌবাজারের বাড়িতেই রইলেন।

প্রতিদিন সকালে ধর্মতলার সেক্রেড হার্ট গীর্জায় প্রার্থনা সেরে কুপার নিজের বগি গাড়িতে চেপে বাজার নিয়ে যেতেন স্ত্রীর বাসায়।

১৮৪৫ সালের ৬ই মার্চ সকালে যথারীতি স্ত্রীর বাসায় গিয়ে কুপার দেখেন স্ত্রী মৃত অবস্থায় বারান্দায় পড়ে আছেন। গলায় গামছা জড়িয়ে শ্বাসরোধ করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। ভদ্রমহিলা যে প্রাণপণ শক্তিতে আততায়ীর সঙ্গে যুঝেছিলেন তার যথেষ্ট চিহ্ন পাওয়া গেল। দেখা গেল বাড়ির মূল্যবান দ্রব্যাদি সবই অপহৃত হয়েছে।

জোর পুলিশ তদন্ত চলল। কুপার আততায়ীকে ধরিয়ে দেবার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করলেন। কিন্তু আততায়ীকে গ্রেপ্তার করা গেল না, খুনেরও কোনো কিনারা হল না।

এই ঘটনার পর থেকে রটে গেল বাড়িটা ‘হানাবাড়ি’। হানাবাড়িতে কে বাস করতে যাবে। বাড়িটা অনেককাল খালি পড়ে থাকল ।

কয়েক বছর বাদে কি একটা কাজে দু'জন নীলকর সাহেব কলকাতা এলেন। কার্যব্যপদেশে কলকাতায় কিছুদিন থাকতে হবে। মফঃস্বলের লোক। কলকাতার খবরাখবর তাঁরা জানেন না। দুই বন্ধুতে মিলে বাড়িটা তাঁরা ছ'মাসের জন্য লীজ নিয়ে নিলেন।

একদিন দুই বন্ধুতে নাচ-গানের দু'খানা টিকিট কিনলেন। কিন্তু একজনের হঠাৎ জ্বর হয়ে যাওয়ায় তিনি যেতে পারলেন না। অপর বন্ধু তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে রেখে যেতে চাইলেন না ; তিনি তাঁকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নাচ-গানের আসরে পাঠিয়ে দিলেন। সে রাত্রে তিনি হল ঘরে শুয়ে রইলেন। পরদিন সকালে উঠে নাচ-গানের আসর থেকে কোনো বান্ধবী পাকড়ে বাড়ি নিয়ে আসার জন্য বন্ধুকে এক হাত নিলেন।

বন্ধু তো আকাশ থেকে পড়লেন। না, কখখনো না। আমি কউকে নিয়ে আসিনি। আসলে জ্বরের ঘোরে তুমি খোয়াব দেখেছ। আচ্ছা, কি দেখেছ বল তো!

বন্ধু জবাব দিলেন, মধ্যরাত্রির কিছু পরে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম তোমার ঘর থেকে এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। লম্বা- চওড়া চেহারা মহিলার বেশ সুন্দরী—ইউরোপীয়ও হতে পারেন, আবার ইউরেশীয় হওয়াও অসম্ভব নয়। মহিলা হল পেরিয়ে বারান্দার দিকে গেলেন। আমি জেগেই ছিলাম। ভদ্রমহিলার গলায় এক টুকরো কাপড় কস্ফার্টারের মতো জড়ান ছিল। কৌতূহল হল। আমি মহিলাকে আর একবার ভালো করে দেখবার জন্য উঠে বারান্দার দিকে গেলাম। কিন্তু ততক্ষণে মহিলা চলে গেছেন।

এই বর্ণনা শুনে অপর বন্ধু তো মেরে গেলেন। চাকর- বাকরদের কাছে খোঁজ করা হল সেই রাত্রে তারা কাউকে নিচে নামতে দেখেছে কি না।

জানা গেল বাড়িটা হানাবাড়ি। কেঁচো খুড়তে সাপ বেরোল। নীলকর সাহেব দু'জন বাকী ক’মাসের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তৎক্ষণাৎ সে বাড়ি থেকে সরে পড়লেন।

সে-বাড়িটা এখন আর নেই। এখন সেখানে ৰাঙালী খ্রীস্টানদের মেথডিস্ট গীর্জা হয়েছে।

-- রহস্যময় আলো -

বিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতার কোনো একটি ইংরেজী সংবাদপত্রে চন্দননগরের এক সংবাদদাতার নিম্নলিখিত পত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল :

“প্রতিদিন রাত্রে চন্দননগরের ডিস্ট্যান্ট সিগন্যাল (হুগলির দিককার ) পোস্টের কাছে একটি রহস্যজনক আলোর সিগন্যাল দেখা যায়। এ সম্পর্কে অনেকগুলি গল্প প্রচলিত আছে। সবচেয়ে চালু গল্পটি হলো : চন্দননগরে যখন প্রথম রেললাইন বসে তখন ডিস্ট্যান্ট সিগন্যালের কাছে জনৈক গার্ডের অপঘাতে মৃত্যু হয়েছিল। সেই থেকে নাকি সে রোজ নানা চেহারায় আবির্ভূত হয়ে আলোর সিগন্যাল দেখিয়ে থাকে। আলোটাই শুধু দেখা যায় কিন্তু প্রেজমূর্তি অদৃশ্যই থাকে। আলোটা কখনও দপ,রূপ, করে কখনও স্থির হয়ে জ্বলে । বিশ গজ দূর থেকে আলোটা দেখা যায়। আলোটা অদৃশ্য হয়ে যায়।

তার বেশি এগোবার চেষ্টা করলে শান্টিং জমাদারের সঙ্গে ভূতটার জমাদার বলে সে যখন লাল আলো খুব দোস্তি হয়ে গেছে। দেখায় ভূতটা তখন দেখায় লাল আর সবুজ আলো। সবুজ আলো দেখালে কিন্তু ভূতটা কোনো বাধা দেয় না। গতকাল যদিও মেঘলা ছিল তবু রাত্রিবেলা প্লাটফর্ম থেকে আলোটা আবার দেখা গেছে। আমি ৩৩নং আপ গাড়ির গার্ডকে অনুরোধ করেছিলাম তিনি আলোটার দিকে যেন নজর রাখেন এবং লক্ষ্য করবার চেষ্টা করেন আলোর পিছনে কাউকে দেখা যায় কি না । কিন্তু ট্রেনটা আলোর সমীপবর্তী হবার আগেই আলোটা অদৃশ্য হয়ে যায়।

“আপনার পাঠকদের মধ্যে যারা কখনও ভূত দেখেন নি বা ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করেন না তাঁরা অনুগ্রহ করে চন্দননগর পর্যন্ত এলেই নিজেদের সন্দেহভঞ্জন করতে পারবেন । ব্যাপারটা সত্যিই অনুসন্ধান করে দেখবার মতো।”

- পিয়ানোর ভুত -

কলকাতা হিস্টোরিকাল সোসাইটির জনাব আবহল আলি শ্ৰীমতী ডি-র কাছ থেকে নিচের গল্পটি শুনেছিলেন :

“১৯২৬ সালে আলিপুরের ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে আমি কিছুকাল বাস করেছিলাম। ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ থ্যাকারে এই বাড়িতে কিছুদিন বাস করেছেন। তাঁর পুত্র বিখ্যাত ঔপন্যাসিক উইলিয়ম মেকপীস থ্যাকার তখন বালক ছিলেন। সেকেলে ধরনের প্রকাণ্ড বাড়ি—প্রশস্ত লন, একদিকে আম-লিচুর বাগান। বাড়িটার একদিকে টালির নাল| আর একদিকে জেল- খানার প্রকাও দেয়াল।

“একদিন রাত্রে ঘুম ভেঙে যেতে শুনি কে যেন পিয়ানো বাজাচ্ছে। ভারী মিষ্টি হাত। আশ্চর্য হলাম। আমাদের বাড়িতে পিয়ানোও ছিল না, রেডিও-ও না।

“কিছুদিন বাদে এক মহিলা আমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে এলেন। প্রথম দিন সান্ধ্য-চায়ের আসরে তিনি আমাকে বললেন, 'আপনার পিয়ানোর হাত খুব মিষ্টি। বিকেলবেলায় আপনার বাজনা খুবই উপভোগ করেছি।'

"আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, 'আমাদের বাড়িতে পিয়ানো নেই।'

“১৯৬৯ সালে ইংলণ্ডে ফিরে সার জেমস ও লেডি ডোনাল্ডের সঙ্গে দেখা করতে গেছি। ভারতবর্ষ সম্পর্কে কথা হচ্ছিল। সার জেমস প্রথম মহাযুদ্ধের সময় আলিপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন এবং ম্যাজিস্ট্রেট ভবনে বাস করেছেন। লেডি ডোনাল্ডের ছিলেন সঙ্গীত পটিয়সী। তিনি যেবার ও-বাড়িতে এসেছিলেন সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন একটা দামী পিয়ানো। যুদ্ধশেষে সার জেমস যখন সপরিবারে দেশে ফিরে যান তখন জাহাজে স্থানাভাববশত পিয়ানোটা নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাঁর অতি প্রিয় বাছা- যন্ত্রটি হাতছাড়া হওয়ায় লেডি ডোনাল্ডের মা খুবই দুঃখিত হয়েছিলেন। কয়েক বছর পরে তিনি মারা যান। আমার কাছ থেকে রহস্যময় পিয়ানো বাজনার কাহিনী শুনে লেডি ডোনাল্ড বললেন, এ নিশ্চয়ই তাঁর মায়ের প্রেতাত্মা। ঐ বাড়িতে পিয়ানোটা ফেলে রেখে গিয়েছিলেন বলেই ওখানে তিনি আনাগোনা করছেন।

“আমার স্বামী কিন্তু বলেন, মানুষের ভূত তবু বিশ্বাস করতে পারি কিন্তু পিয়ানোর ভূত ? না বাপু, অতটা বিশ্বাস করতে পারব না!”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ