Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

হাতুড়ে ডাক্তারের ভুতুড়ে রুগি ।। কণা বসুমিশ্র

মফস্বল শহর। তারপর আবার শীতের সময়। খুব তাড়াতাড়ি রাত গাঢ় হয়েছে। ঝটিকাচরণ চাকী অনেকদিনের ডাক্তার এই শহরে। যদিও ওঁর নামের পাশে এম বি, এম বি বি এস, এম ডি ইত্যাদি কিছুই নেই। তবু ডিসপেনসরি ওঁর জমজমাট। বাড়িতেই ছোটখাটো একটা ডিসপেনসরি। সেখানে একটা কাঁচভাঙা আলমারিতে গোটা কয়েক ওষুধ। একটা নড়বড়ে টেবিল আর একটা চেয়ার। রুগিদের বসবার জন্যে গোটা দুয়েক বেঞ্চও পাতা। ঝটিকাবাবুর রুগিরা এই শহর থেকে বেশ খানকটা দূরের মানুষ। পাঁচমাইল বলে একটি গ্রাম আছে। সেই গ্রামে তাদের বসতি। বেশির ভাগ মানুষই পূর্ববঙ্গের তাড়া-খাওয়া উদ্বাস্তু। কিছু এদেশী মুসলমান ঘরও আছে। তারা সবাই গরিব মানুষ। ঝটিকাবাবুকে কল দিলে ওরা অনেক সময় ফীজ দিতে পারে না। এই গাছের তরিতরকারি, কলাটা মুলোটা দিয়ে থাকে। ঝটিকাবাবুর দাবি অবশ্য খুব বেশি নয়। উনি এতেই খুশি। রুগিরা অনেকেই বাঁচে না। তাই বলে কেউ ডাক্তারকে দোষারোপও করে না। ভাগ্যের দোহাই মেনে রুগির আত্মীয়-স্বজন কপাল চাপড় চলে যায়। মৃত রুগির আপনজনদের শোকের অংশীদার হন ডাক্তারবাবু। ঝটিকাবাবুর চোখের জল গরিব মানুষের মন ভেজায়।

ইনজেকশনের সিরিঞ্জে প্রায়ই ওষুধ থাকে না। তা আর কী করা যায়? ফীজটা যেমন ওষুধও তেমন! ডাক্তারবাবু ইনজেকশনের সিরিঞ্জে ডিসটিলড ওয়াটার ভরে কলেরা, টাইফয়েড, টি বি রুগিকে নির্বিশেষে ছুঁচ ফুটিয়ে যান। বোকা মানুষগুলো পরম নির্ভরতায় তাকিয়ে থাকে হাতুড়ে ডাক্তারের চোখের দিকে। সেদিন রাত গোটা নয়েক হবে। ঝটিকাচরণ চাকী রুগি-টুগি দেখে ডিসপেনসরি বন্ধ করে সবে ঘরে গেছেন। ঝটিকাবাবুর কাজের ছেলেটি ভানুভক্ত ছেত্রী ভাত বেড়ে ওঁকে খেতে ডেকেছে। “আসছি” বলে ঝটিকাবাবু প্যান্ট-ট্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গিটা সবে হাতে নিয়েছেন, এমন সময় 'ডাক্তারবাবু। ডাক্তারবাবু!” বলে কে যেন ডেকে ওঠে।

ঋটিকাবাবুর স্ত্রী মারা গেছেন অনেকদিন। নিঃসন্তান ঝটিকাবাবু এই কাজের ছেলেটিকে পুত্রস্নেহে মানুষ করেছেন। সেই ওঁর তদ্বির তদারকি করে। উনি ভানুকে ডেকে বলেন, “বাইরে যে এসেছে, তাকে বলে দে কাল সকালে আসতে।” বিরক্তিতে কুঁচকে ওঠে ঝটিকাবাবুর ভ্রু। বয়সের বলিরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে কপালে। 'আচ্ছা, জ্বালাতন। আমার কি বিশ্রাম-টিশ্রাম নেই ?" গজর গজর করতে থাকেন ঝটিকাবাবু ওঁর পায়ের কাছে অনেকগুলো পাকা কলা । এক রুগি দিয়ে গেল এইমাত্র। ঝটিকাবাবুর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে কলার ওপরে। সোনার রঙের মতো এমন পাকা মৰ্তমান কলা ! আহা। ঋটিকাবাবুর জিভে জল এসে যায়। ঠিক তখুনি ভানু এসে বলে, “লোকটা কাঁদো কাঁদো ভাবে বলছে, তার বউয়ের খুব অসুখ। এক্ষুনি ডাক্তারবাবু না গেলে তাকে বাঁচানো যাবে না।” “কী মুশকিল! কী মুশকিল!” বলতে বলতে ঝটিকাবাবু ডিসপেনসারির জানলার কাছে এগিয়ে যান। ভানু চেঁচিয়ে বলে, “বাবু, ভাত খেলে হত না?” ঝটিকাবাবু সে কথা গ্রাহ্য করেন না।

“কে?”বলে ঝটিকাচরণ চাকী মুখ বাড়ান ডিসপেনসারির জানলায়। রোগা ছিপছিপে একটি লোক এগিয়ে আসে। তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। রুক্ষ একমাথা চুল। এর বেশি অন্ধকারে বোঝার উপায় ছিল না। করুণ গলায় লোকটি বলে, “একবার চলেন ডাক্তারবাবু। ইয়ে আমার ইস্ত্রীর বড্ড অসুস্থ।”

“আজ নয়। কাল যাব।” গলা খেঁকিয়ে বলেন ডাক্তার। কিন্তু লোকটি অবুঝ। সে কেবলই বলে, “চলেন, চলেন। আপনে গরিবের ডাক্তার। গরিবের ওপরে দয়া হবে না বাবু?”

তিরিশ বছর ধরে এই কথাই শুনে আসছেন ঝটিকাবাবু। স্তোকবাক্যে পেট ভরে না। লোকটা হয়ত ফীজ দেবে না। তবু স্বভাব দোষ। এরা ডাকলে উনি না গিয়েও তো পারেন না। কিছুদিন ধরেই ঝটিকাবাবু সর্দি কাসিতে ভুগছেন। গলা ব্যথা। মাথাটাও ঝিম ঝিম করে। শরীরটা ভাল না থাকায় মেজাজটাও খিঁচড়ে থাকে। উনি তিক্তগলায় বলেন, “অন্য ডাক্তার নিয়ে যাও!”

ফ্যাচ করে লোকটি এবারে কেঁদেই ফেলে, “আমি তো আপনার জন্যেই...। ”ওর কাতর গলার স্বর ডাক্তারের মন ছুঁয়ে যায়। ডাক্তারবাবুর মনে হয়, লোকটা যেন অনেকদিন খায়নি।”

“তোমার বাড়ি কোথায় ?”

“পাঁচমাইল।”

উনি জানতেন এই উত্তরটাই শুনতে হবে। তবু ডাক্তার বলেন, “সেই শ্মশানের মধ্যে দিয়ে আমায় এখন যেতে হবে?” লোকটা দেঁতো হাসি হেসে বলে “তাতে কী? আপনে তো হামেশাই যান সেখানে।”

ঝটিকাবাবুর আর খাওয়া হয় না। উনি ভাবেন, রুগি দেখে এসেই না হয় খাবেন।

অনেক কালের পুরনো একটা ভাঙা ফোর্ড গাড়ি ছিল ঝটিকাচরণ চাকীর। উনি নিজেই গাড়ি চালান। ডাক্তারি করে যা উপায় হয়, তাতে খেয়ে-পরে আর ড্রাইভার রাখা সম্ভব হয় না। ওঁর গাড়ির এঞ্জিনটাও প্রায় ঝুরঝুরে। যাই হোক, ঠেলেঠুলে ওই গাড়ি নিয়েই ঘোরাফেরা করেন ডাক্তার।

ঝটিকাবাবু গিয়ে বসেন চালকের আসনে। পেছনের সীটে গিয়ে বসে ওই লোকটি।

গাড়ি ছুটছে। ভট্ ভট্ আওয়াজ হচ্ছে কেবলই। মনে হচ্ছে পৈতৃক প্রাণটা বুঝি যায়। মরাভরলির রাস্তা ধরে যখন গাড়ি ছোটে, তখন চারদিকের গাছপালা আর পেঁচার ডাক রীতিমত যেন অন্যমনস্ক করে ডাক্তারবাবুকে। অনেক দূরে টিমটিম করে জ্বলছে কয়েকটা আলো। ঝোড়ো হাওয়া বইছে থেকে থেকে। শীতে কামড়ে ধরছে শরীর। গ্লাস পরা হাতটাও মাঝে মাঝে স্টীয়ারিং থেকে ফসকে যাচ্ছে যেন ওঁর। ঝটিকাবাবু বুঝতে পারছেন না অ্যাক্সিলারেটরের ওপরে কেন ওঁর দখল নেই আর। গলাবন্ধ কোট। কান মাথায় বেশ করে মাফলার জড়ানো, তবু কেন হু-হু করে ঠাণ্ডা ঢোকে! অ্যাক্সিলারেটরে পা ছোঁয়ানোর আগেই গাড়ি তীরবেগে ছুটতে থাকে। আশ্চর্য! মরাভরলি নদীর পারে কয়েকটা আলো। চিতা জ্বলছে শ্মশানে। এত দূর থেকে লোকজন বোঝার উপায় নেই।

“কী ভাই, আর কদ্দুর ?” সামনের অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন ঝটিকাবাবু। কিন্তু কোনো সাড়া-শব্দ নেই। লোকটি কি ঝিমুচ্ছে নাকি? স্ত্রীর অসুখ, চিন্তায় ভাবনায় হয়তো সে খুবই ক্লান্ত। তবু এই শীতের রাতে এভাবে মুখ বুজে যেতেও ভাল লাগে না ডাক্তারের।

উনি আবারও হাঁকেন, “কী গো, তোমার দেশ কোথায় ছিল গো?” তবু কোনো উত্তর নেই। পেছন ফিরে তাকান ঝটিকাবাবু। উনি দেখেন, লোকটা ঘাড় গোঁজ করে বসে রয়েছে।

অমাবস্যার রাত। ছিটে-ফোঁটা আলো নেই আকাশে। শেয়াল ডাকছে। আর কয়েক গজ দুরেই চিতার আগুন। সেই আগুনের চার পাশে গোল হয়ে বসে রয়েছে কয়েকজন লোক। ঝটিকাবাবুর মাথা ধরে ওঠে। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় ওঁর প্রাণটা ছটফট করছিল এক কাপ চায়ের জন্যে। উনি ভেবেছিলেন, এই গরিব লোকটি ফীজ দিতে না পারলেও চা দেবে নিশ্চয়। শ্মশানের চিতার আগুন লাল হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে অমাবস্যার আকাশে। ঝটিকাবাবু ভূত বিশ্বাস করেন না। তবু কেমন যেন একটা অস্বস্তি হতে থাকে। কেসে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে উনি বলেন, “এসে তো পড়লাম পাঁচমাইল। এবার বলো তোমার বাড়ি কোথায় ?”

লোকটির যেন হুঁশ হয়। “এবারে ডাইনের রাস্তা ধরুন বাবু।” “অ্যাঁ, কী বললে? ওদিকে তো মাঠ মনে হচ্ছে।”

"মাঠ নয়, মাঠ নয়, খানিকটা পোড়ো জমি বাবু।” লোকটা হায়নার মতো থ্যাক খ্যাক করে হাসে। যেমন গেঁয়ো, তেমনি অসভ্য তো, ভাবেন ডাক্তার। আগে জানলে এর সঙ্গে? আরে দূর। দূর। কিন্তু গাড়ি তখন ওঁর আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। এবড়ো-খেবড়ো জমির ওপর দিয়ে গোঁয়ারের মতো গোঁ-গাঁ করে ছুটছে গাড়ি। “এবারে বাঁয়ে।” লোকটি বলে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা বাঁ দিকে ঘুরে যায়। ডাক্তার ভাবেন, আরে এ তো বড় মজা । গাড়িটা মন্ত্রশক্তি পেয়েছে নাকি? স্টীয়ারিং ঘোরানোর আগেই গাড়ি ঘুরে যায়। কিন্তু সামনেই যে একটা জলের রেখা দেখা যায়। সর্বনাশ। ওটা খাল না ? ঝটিকাবাবু আঁতকে ওঠেন। গাড়ির এঞ্জিনের মধ্যে যেন হাজারটা পাখি ডাকতে থাকে। অনেক কালের পুরনো পাজর বের করা ফোর্ড গাড়িটা যেন বিদ্রোহের সুর তোলে। ক্ষুব্ধ, বিরক্ত ঝটিকাচরণ চাকী গলায় ঝাজ ঢেলে বলেন, “কী হে, এই রাত দুপুরে তুমি কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছ! আর যাব কোথায় ? ওদিকে যে খাদ।” .

লোকটি ফের হাসে, সেই বিশ্রী হাসি। ব্রেক করেন ডাক্তার। প্রচণ্ড জোরে একটা ধাক্কা খেয়ে গাড়িটা থেমে যায়। আর সেই মুহূর্তে লোকটা বলে ওঠে, “আসুন ডাক্তারবাবু। ওই সামনেই আমার চালাঘর।"

“খালের ওপারে।”

"হ্যাঁ। বাঁশের একটা সাঁকো রয়েছে দেখছেন না? ওই সাঁকোটা পার হয়ে আপনি আসুন।” লোকটির গলায় এবার অনুনয় ঝরে পড়ে।

"আবার বাঁশের সাঁকো? এসব কথা আগে বলা উচিত ছিল।”বক বক করতে করতে গাড়ির দরজা খুলে নামেন ডাক্তার। তাঁর বেতো, কেসো দেহটার বুকের ওপর যেন হাপর পড়তে থাকে। স্টেথিসকোপ আর ওষুধের বাক্সটা হাতে নিয়ে ডাক্তার হাটেন লোকটির পেছন পেছন। সাঁকোর ওপর দিয়ে যাবার সময় ক্যাচর ক্যাচর আওয়াজ হয়। কিন্তু লোকটির হাঁটা এতই দ্রুত যে, সে চোখের পলকে বাতাসের মতো মিলিয়ে যায়। আজকাল চোখে কম দেখেন ঝটিকাচরণ। বাঁ দিকের চোখটায় সামান্য ছানি পড়েছে। তাই ডাক্তার ভাবেন, ওটা হয়তো ওঁর চোখের গোলমাল। বাঁশের সাঁকো পেরিয়েই একটা চালাঘর। লোকটি যেন আদর করে ডাকে, “আসুন ডাক্তারবাবু, আসুন।”

“তুমি কোথায়? আলো-টালো ধরো।” চাপা রাগে বলেন ডাক্তার। যেন হাওয়ার ভেতর থেকে কথা ভেসে আসে। “এই যে আমি ডাক্তারবাবু। কেরোসিনের যা দাম' আলো জ্বালাব কী করে!”

মাটির দাওয়ায় পা রাখেন ডাক্তার। কতগুলো চামচিকে উড়ে যায়। বহুদিনের পুরনো ধুলোর ভ্যাপসা গন্ধ ডাক্তারের নাকে আসে। তাড়াতাড়ি রুমালটা নাকে চেপে ধরেন উনি অন্ধকার ঘুটঘুটে ঘরের মধ্যে থেকে লোকটি বলে, “ওই তো দরজা। সোজা চলে আসেন।”

ঝটিকাচরণ চাকীর বুকের ওপর যেন পাথরের মতো ভয় চেপে বসে। জীবনে অনেকবারই তো এই এলাকায় এসেছেন ডাক্তারবাবু, কিন্তু এমন গা ছমছম তো করেনি কখনো। এই মুহূর্তে মনে হয় ডাক্তারের, খুব খারাপ জায়গায় উনি এসে পড়েছেন যেন। এখানে কোনো গুণ্ডাদের ঘাঁটি- টাটি আছে। হয়তো কোনো দুরভিসন্ধি আছে ওই লোকটির । যদি ও টুটি চেপে ধরে ডাক্তারের? কী নিতে পারে ও ? হাতের এই ঘড়িটা? না পকেটের এই সামান্য কটি টাকা। কিন্তু এইটুকুর জন্যে ? না, না। এ হতে পারে না। ঘরের মধ্যে পা দেন ডাক্তার। পচা দুর্গন্ধ। ইঁদুর ঘরে রয়েছে নাকি ? না অন্য কিছু? খস খস আওয়াজ হতে থাকে। সামনেই লোকটি দাঁড়িয়ে। এই অন্ধাকারে তার মুখ ভাল করে দেখতে পান না ডাক্তার। শুধু ধবধবে জামাটা আর ধুতিটা চোখে পড়ে। আর ওই লোকটির চোখের মণিদুটো সাপের মণির মতো জ্বল জ্বল করে। হঠাৎই ডাক্তারের মনে পড়ে যায়, ওষুধের বাক্সে টর্চটা রয়েছে। এতক্ষণ যে কেন মনে পড়েনি, আশ্চর্য। “কী হল, বসেন ডাক্তারবাবু।” এবারে খাঁটি পূর্ববঙ্গের ভাষায় লোকটা বলে, “আপনে ভয় পাইতেছেন নাকি?” বুক দুর দূর করে ওঠে ডাক্তারের।

“না, না, ভয় পাব কেন?” কোথায় আপনার পেশেন্ট। বলতে বলতে ডাক্তার ওষুধের বাক্সটা খোলেন। হাতড়ে হাতড়ে টর্চটা বার করেন ডাক্তার। টর্চ জ্বালেন। মাটির মেঝেতে চাদরে ঢাকা একটি মানুষ দেখতে পান ডাক্তার। তার আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা। পাশেই একটা জলচৌকি রাখা আছে। যদিও তার ওপরে ধুলোর পুরু সর। ডাক্তারের বসার ইচ্ছে হয় না। উনি উবু হয়ে বসে বলেন “এই কি তোমার পেশেন্ট?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু।” এই প্রথম ভাল করে খুঁটিয়ে দেখেন ডাক্তারবাবু লোকটিকে। ওর তোবড়ানো গাল ৷ গর্তে 'বসা চোখ। চোখের নীচে বিশ্রীভাবে হাড় উঁচু হয়ে আছে। লোকটি কেমন আদেশের মতো সুরে বলে, “আপনে জলচৌকির উপরে বসেন।” অগত্যা তাই বসতে হয় ডাক্তারকে। “এবারে আমার ইস্ত্রীরে দেখেন।” কথাটা বলেই লোকটা অন্ধকারে কোথায় যেন সরে যায়। শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস ঢোকে বাঁশের খোলা দরজাটা দিয়ে। অনেক দূর থেকে ভেসে আসে, “বল হরি, হরি বোল!” দূরে কারা যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শ্মশানের দিকে চলে যায়।

কাঁপা কাঁপা গলায় রুগিকে উদ্দেশ করে ঝটিকারচপ চাকী বলেন, “আপনি হাতটা বার করুন তো।” তখন সাদা চাদরের মধ্যে থেকে নিঃশব্দে একখানা হাত বেরিয়ে আসে। মুখটা ঢাকাই থাকে। নাড়ি দেখার জন্যে হাতের কব্জিটা ধরেন ডাক্তার। ঝটিকাবাবুর বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। নাড়ির কোনো স্পন্দন নেই। বরফের মতো ঠাণ্ডা শক্ত হাতটা ধুপ করে পড়ে যায় ডাক্তারের হাত থেকে। এ যে বেশ কয়েক দিন আগের মৃতদেহ। হা-হা-হা-হা-হা। বাতাস যেন হেসে হেসে চলে যায়। ডাক্তারের কানের কাছে কাদের যেন নিঃশ্বাস পড়তে থাকে।

“রাম! রাম!” নাস্তিক ডাক্তার জীবনে এই প্রথম মনে মনে রাম নাম করেন। পাড়ি মরি করে ছুটে পালাতে যান ডাক্তার। কিন্তু দরজার কাছে অদৃশ্য মানুষের গলার স্বর, “কেমন দেখলেন ডাক্তার ?”

“ভাল। ভাল।” পথ আগলে দাঁড়ায় তবু লোকটা। “একটা প্রেসকিপশন কিংবা নিদেনপক্ষে একটা ইনজেকশন।”

ডাক্তার কি মূর্ছা যাবেন এখন? রাম নাম মনে মনে জপতে জপতে অসম্ভব সাহসী ডাক্তার পকেট থেকে কাগজ-কলম বার করে ফস ফস করে প্রেসক্রিপশন লেখেন। দরজা থেকে সরে না লোকটা। “ডাক্তারবাবু, একটা ইনজেকশন দিন।” কঠিন কণ্ঠস্বর।

নাহ! লোকটা যে নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত ওই মরা মানুষটার গায়ে ছুচ! “কী হল ডাক্তারবাবু দেরি করেন ক্যান?” লোকটা যেন প্রায় ধমকে ওঠে। ডাক্তারের মাথার ওপর চামচিকে উড়তে থাকে। উনি শকুনের কান্না শুনতে পান। সামনের শ্যাওড়া গাছের মাথায় বোধহয় শকুনের বাসা। অনেকগুলো শকুন একসঙ্গে সুর মিলিয়ে কাঁদতে থাকে। বাতাসের শব্দ। শকুনের কান্না, চামচিকের লুটোপুটি মিশে-মিশে অদ্ভুত একটা বাজনা তৈরি হয়। ডাক্তারের বুকের মধ্যেও বাজনা বাজে। সেই ডিসটিল্ড ওয়াটার ভরা ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা মেঝেতে শোওয়া মরা মানুষটার হাতে ফুটিয়ে দেন ডাক্তার। হঠাৎ ওর মুখের চাদরটা সরে যায়। নাকি নাকি সুরে সে বলে, এঁকি কলের জঁল বাঁবু ? দশ দিন আগে “এই ছুচ ফুটাইয়াই তো আমারে মারছিলেন ডাক্তারবাবু।”

অ্যাঁ। সর্বনাশ। দশদিন আগে ? কিন্তু সে এ বাড়ি তো নয়। অন্য আর একজনের বাড়িতে। হ্যাঁ, এক কলেরা রুগি! ডাক্তার ওষুধের বাক্স ফেলেই এবারে ছুট লাগান । দরজায় ভারী হাওয়া বাধা দিতে চায়, হা-হা-হা-হা, ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। চামচিকে পাখা ঝাপটায়। কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ডাক্তারেরা। পেছন পেছন ছুটে আসে. কে যেন। নাকি সুরে বলে, "ডাক্তারবাবু, আপনের ফীজ? ফীজটা।” ডাক্তার ছোটেন। ছুটতেই থাকেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ