Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বেঁচে থাকো সর্দি কাশি ।। সৈয়দ মুজতবা আলী

ভয়ঙ্কর সর্দি হয়েছে। নাক দিয়ে যা জল বেরচ্ছে তা সামলানো রুমালের কর্ম নয়। ডবল সাইজের বিছানার চাদর নিয়ে আগুনের কাছে বসেছি। হাঁচছি আর নাক ঝাড়ছি, নাক ঝাড়ছি, আর হাঁচছি। বিছানার চাদরের অর্ধেকখানা হয়ে এসেছে, এখন বেছে বেছে শুকনো জায়গা বের করতে হচ্ছে। শীতের দেশ, দোর জানালা বন্ধ, কিচ্ছু খোলার উপায় নেই। জানালা খুললে মনে হয় গৌরীশঙ্করের চুড়োটি যেন হিমালয় ত্যাগ করে আমার ঘরে নাক গলাবার তালে আছেন।

জানি, একই রুমালে বারবার নাক ঝাড়লে সর্দি বেড়েই চলে, কিন্তু উপায় কি? দেশে হলে রকে বসে বাইরে গলা বাড়িয়ে দিয়ে সশব্দে নাক ঝাড়তুম, এ নোংরামির হাত থেকে রক্ষা তো পেতুমই, নাকটাও কাপড়ের ঘষায় ছড়ে যেত না।

হঠাৎ মনে পড়ল পরশুদিন এক ডাক্তারের সঙ্গে অপেরাতে আলাপ হয়েছে। ডাকসাইটে ডাক্তার-ম্যুনিক শহরে নাম করতে পারাটা চাট্টিখানি কথা নয়। যদিও জানি ডাক্তার করবে কচু, কারণ জর্মন ভাষাতেই প্রবাদ আছে, ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাত দিনে, না খেলে এক সপ্তায়।'

তবু গেলুম তাঁর বাড়ি। আমার চেহারা দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা কি। আমি শুধালুম, সর্দির ওষুধ আছে? আপনার প্রথম এবং খুব সম্ভব শেষ ভারতীয় রোগীর একটা ব্যবস্থা করে দিন। আমার এক নাক দিয়ে বেরুচ্ছে রাইন, অন্য নাক দিয়ে ওডার।

ডাক্তার যদিও জর্মন তবু হাত দুখালি আকাশের দিকে তুলে ধরলেন ফরাসিস্ কায়দায়। বললেন, অবাক করলেন, স্যার। সর্দির ওষুধ নেই? কত চান? সর্দির ওষুধ হ্য হাজারাে রকমের।

বলে আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে খুললেন লাল কেল্লার সদর দরজা পরিমাণ এক আলমারি। চৌকো, গােল, কোমর-মােটা, পেট-ভারী বাহান্ন রকমের বােতল-শিশিতে ভর্তি। নানা রঙের লেবেল, আর সেগুলাের উপর লেখা রয়েছে বিকট বিকট সব লাতিন নাম।

এবারে খানদানী ভিযেনীল কায়দায় কোমরে দু'ভাঁজ হয়ে, বাও করে বাঁ হাত পেটের উপর রেখে ডান হাত দিয়ে তলােয়ার চালানাের কায়দায় দেরাজের এক প্রান্ত অবধি দেখিযে বললেন, ‘বেছে নিন, মহারাজ (কথাটা জর্মন ভাষায় চালু আছে); সব সর্দির দাওয়াই।

আমি সন্দিগ্ধ নয়নে তাঁর দিকে তাকালুম। ডাক্তার মুখব্যাদন করে পরিভােষের ঈষৎ হাস্য দিয়ে গালের দুটি টোল খােলতাই করে দিযেছেন| হা-টা লেগে গিয়েছে দুকানের ডগায়।

একটা ওষুধের কটমটে লাতিন নাম অতি কষ্টে উচ্চারণ করে বললুম, 'এর মানে তাে জানিনে।'

সদ্য হাসি হেসে বললেন, 'আমিও জানিনে, তবে এটুকু জানি, ঠাকুরমা মার্কা কচু-ঘেঁচু মেশানাে দিশী দাওযই মাত্রেই লম্বা লম্বা লাতিন নাম হয়।'

শুধালুম, 'খেলে সর্দি সারে?”

বললেন, ‘গলায় একটু আরাম বােধ হ্য, নাকের সুড়সুড়িটা হতাে একটু আধটু কমে। আমি কখনাে পরখ করে দেখিনি। সব পেটেন্ট ওষুধ-নমুনা হিসেবে বিনা পয়সায় পাওয়া। তবে সর্দি সারে না, এ কথা জানি।

আমি শুধালুম, 'তবে যে বললেন, সর্দির ওষুধ আছে?”

বললেন, 'এখনাে বলছি আছে কিন্তু সর্দি সারে সে কথা তাে বলিনি। বুঝলুম, অমনি কান্ট হেগেলের দেশ। বললুম, 'অ।'

ফিসফিস করে ডাক্তার বললেন, 'আরেকটা কথা এই বেলা শিখে নিন। যে ব্যামাের দেখবেন সাতান্ন ব্লকমের ওষুধ, বুঝে নেবেন, সে ব্যামাে ওষুধে সারে না।'

ততক্ষণে আবার আমি হাঁজাে হাঁজাে আরম্ভ করে দিয়েছি। নাক চোখ দিয়ে এবার আর রাইন-ওডার না, এবারে পদ্মা-মেঘনা। ডাক্তার ডজন দুই কাগজের রুমাল আর একটা ওযে-পেপার বাস্কেট আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।

ধাক্কাটা সামলে প্রাণভরে জর্মন সর্দিকে অভিসম্পাত দিলুম।

দেখি ডাক্তার আমার দিকে তাকিযে মিটমিটিয়ে হাসছেন।

আমার মুখে হয়তাে একটু বিরক্তি ফুটে উঠেছিল। বললেন, 'সর্দি-কাশির গুণও আছে।”

আমি বললুম, 'কচু-হাভী-ঘণ্টা।

বললেন, 'তর্জমা করে বলুন। আমি বললুম, 'কচুর লাতিন নাম জানিনে: হাতী হল এলেফান্ট' আর 'ঘণ্টা' মানে 'কে'।

মানে?

আর বুঝে দরকার নেই: এগুলাে কটুবাক্য।

Google দ্বারা বিজ্ঞাপন অ্যাড় দেখা বন্ধ করুন এই বিজ্ঞাপনটি কেন? 

আকাশপানে হানি ভুরুযুগল বললেন, 'অদ্ভুত ভাষা। হাতী আর ঘণ্টা গালাগাল হয় কি করে! একটা গল্প শুনবেন? সঙ্গে গরম ব্রাণ্ডি?'

আমি বললুম, ‘প্রথমটাই চলুক। মিক্স করা ভালাে নয়।'

ডাক্তার বললেন, 'আমি ডাক্তারি শিখেছি বার্লিনে। বছর তিনেক প্ল্যাকর্টিস করার পর একদিন গিযেছি স্টেশনে, বন্ধুকে বিয়ে দিতে। ফেরার সময় স্টেশন-রেস্তোরাঁয় ঢুকেছি একটা ব্লণ্ডি খাব বলে।'

ঢুকেই থমকে দাঁড়লুম। দেখি, এক কোণে এক অপরূপ সুন্দরী। অত্যন্ত সাদাসিধে বেশভুষা,-গরীব বললেও চলে-আর তাই বােধ হয় সৌন্দর্যটা পেয়েছে ভার চরম খােলতাই। নর্থ সী দেখেছেন? তবে বুঝভেন হব-হব সন্ধ্যায় তার জল কি রকম নীল হ্য-তারই মত সুন্দরীর চোখ। দক্ষিণ ইটালিতে কখনাে গিয়েছেন? না? তবে বুঝতেন সেখানে সােনালি রােদে রূপালি প্রজাপতির কি রাগিনী। ভারই মত ব্লণ্ড চুল। ডানযুৱ নদী দেখেছেন? না? তা হলে আমার সব বর্ণনাই বৃথা।'

আমি বললুম, 'বলে যান, রসগ্রহণে আমার কণামাত্র অসুবিধা হচ্ছে না।'

'না থাক। ওরকম ব্যোরিং পােস্টের বর্ণনা দিতে আমার মন মানে না। আমরা ডাক্তার-বদ্যি মানুষ, ভাষা বাবদে মুখ-সুখ্য। অনেক মেহন্নত করে যে একটি মাত্র বর্ণনা কায এনেছি সেইটেও যদি না বােঝেন তবে আমার শােকটা কোথায় রাখি বলুন তাে।

কাতর হয়ে বললুম, 'নিরাশ করবেন না।'

তবে চলুক ত্রিলেগেড় রেস্। ডানযুত্র নদীর শান্ত-প্রশান্ত ভাবখানা ভাঁর মুখের উপর। অথচ জানেন, ডানযুব অগভীর নদী ন্য। আর ডানযুবের উৎপত্তিস্থল দেখেছেন? না। তা হলে বুঝতেন সেখানে ও স্বল্পী ডানযুব যে রকম লাজুক মেয়ের মত এঁকে বেঁকে আপন শরীর ঢাকতে ব্যস্ত, এ-মেয়ের মুখে ভেমনি ছড়ানাে রয়েছে লজ্জায় কেমন যেন আঁকুপাঁকু ভাব।

এই লজ্জার ভাবটার উপরই আমি বিশেষ জোর দিতে চাই। কারণ আপনি নিশ্চই লক্ষ্য করেছেন, লজ্জা-শরম বলতে আমরা যা-কিছু বুঝি সে সব মধ্যযুগের পুরনাে গল্প থেকে। ব্যোত্রিচে দান্তেকে দেখে লাজুক হাসি হেসেছিলেন-আমরা তাই নিয়ে কনার জাল বুনি, আজকের দিনে এসব তাে আর বার্লিন শহরে পাওয়া যায় না। মধ্যযুগের নাইটদের শিভালরি গেছে আর যাবার সময়ে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে মেয়েদের মুখ থেকে সব লজ্জা সব ব্রীড়া।'

কিন্তু আপনার দেশে নিশ্চয়ই এখনাে মধুর সেই জিনিসটি দেখতে পাওয়া যায়, আর তার চেযেও নিশ্চম, আপনার দেশে লােক এখনাে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে।

ভাই আপনি বিশ্বাস করবেন, কিন্তু আমি নিজে এখনাে করতে পারিনি, কি করে আমার তখন মনে হল, এ মেযেকে না পেলে আমার চলবে ।'

হাসলেন না যে? ভার থেকেই বুঝলুম, আপনি একবহাল, আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পেরেছেন; কিন্তু জার্মানরা আমার এ-অবস্থার কথা শুনে হাসে। আর হাসবে নাই বা কেন? চেনা নেই, শােনা নেই, বিদ্যাবুদ্ধিতে মেযেটা হ্যত অফিসবযের চেয়েও আকাট, হ্যত মাতালদের আচ্ছায বিত্যার বিক্রি করে পয়সা কামায, কিম্বা এও তাে হতে পারে যে তার বিয়ে হত্যে গিয়েছে। এসব কোনাে কিছুর অস্ব-তালাশ না করে এক ঝটকায মনস্থির করে ফেলা, এ-মেযে না হলে আমার চলবে না! আমি কি খামখেয়ালির চেঙ্গিসখান না হাজারাে প্রেমের ৬ জু?

ভাবছি আর মাথার চুল ছিড়ছি-কোন্ অজুহাতে কোন্ অছিলায় এঁর সঙ্গে আলাপ করা যায়।'

কিছুতেই কোনাে হদীস পাচ্ছিলে, আমাদের মাঝে তিনখানা মাত্র ছােট্ট টেবিলের যে উত্তাল সমুদ্র সেটা পেরিযে ওঁর কাছে পৌঁছই বা কি প্রকারে। প্রবাদ আছে, প্রেমে পড়লে বােকা নাকি বুদ্ধিমান হয়ে যায-প্রিয়াকে পাওয়ার জন্য তখন ভার ফন্দি-ফিকির আর আবিষ্কার কৌশল দেখে পাঁচওনের ভাক লেগে যায় আর বুদ্ধিমান নাকি প্রেমে পড়লে হয়ে যায় একদম গবেট-এমন সব কাণ্ড করে বসে যে দশজন তাজ্জব না মেনে যায় না, এ লােকটা এসব পাগলামি করছে কি করে।'

এ জীবনে সেই সেদিন আমি প্রথম আবিষ্কার করলুম যে আমি বুদ্ধিমান, কারণ পুর্ণ একঘণ্টা ধরে ভেবে ভেবেও আমি সামান্যতম কৌশল আবিষ্কার করতে পারলুম না, আলাপ করি কোন্ কায়দায়। কিন্তু এহেন হৃদ্যাভিরাম আবিষ্কার করেও মন কিছুমাত্র উল্লসিত হল না। ভুখন বরঞ্চ বােকা বান (ত পারলেই হয়ত কোনাে একটা কৌশল বেরিয়ে যেত।'

ফলাইন উঠে দাঁড়ালেন। কি আর করি। পিছু নিলুম। তিনি গিয়ে উঠলেন মুনিকের গাড়িতে। আমিও ছুটে গিয়ে টিকিট কাটলুম মুনিকের। কিন্তু এসে দেখি সে কামরার আটটা সীটই ভর্তি হয়ে গিয়েছে। আরাে প্রমাণ হয়ে গেল, আমি বুদ্ধিমান, কারণ এ কথা সবাই জানে, বুদ্ধিমানকে ভগবান সাহায্য করলে এ-পৃথিবীতে বােকাদের আর বাঁচতে হত না। আমি ভগবানের কাছ থেকে কোনাে সাহায্য পেলুম ।'

আমি বললুম, 'ভগবানকে দোষ দিচ্ছেন কেন? এ ভাে কন্দর্প ঠাকুরের ডিপার্টমেন্ট।

বললেন, তাতেই বা কি লাভ? তিনি তাে অন্ধ। মেযেটাকে বানিয়ে দিয়েছেন তাঁরই মত অন্ধ। এই যে আমি একটা এত বড় অ্যাপলাে, আমার দিকে একবারের ভরে ফিরেও তাকালাে না। ওঁকে ডেকে হবে

আমি বললুম, কচু, হাতী, ঘণ্টা।

এবার ডাক্তার বাঙলা কটুকাটব্যের কদর বুঝলেন। বললেন, আহা-হা-হা। তারপর জর্মন উচ্চারণে বললেন, 'কও হার্টী গল্টা। খাসা গালাগাল।'

আমি বললুম, 'কামরাতে আটজনের সীট ছিল ভাে বয়েই গেল। প্রবাসে নিম নাস্তি। আপনি কোন গতিকে ধাক্কাধাক্কি করে

বললেন, ‘ভাজব করালেন। একি আপনার ইণ্ডিয়ান ট্রেন, না সাইবেরিয়াগামী প্রিজনার ভ্যান! চেকার পত্রপাঠ কামরা থেকে বের করে দেবে?

দাঁড়িয়ে রইলুম বাইরের করিডরে ঠায। দেখি, মেযেটি যদি খানা-কামরায় যায়। স্টেশনে ভাে থেযেছে শুধু কফি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটলাে, কত লােক কত কামরা থেকে উঠলাে নামলাে কিন্তু আমার স্বর্গপুরী থেকে কোনাে-(কটুবাক্য) নামলাে না। সব ব্যাটা নিশ্চই যাচ্ছে মুনিক আর কোথাও যেতে পারে না? মুনিক কি পরীস্থান না মুনিকের ফুটপাথ সােনা দিয়ে গড়া? অবাক করলে এই ইডিটগুলাে।

‘প্রেমে পড়লে নাকি ক্ষুধাতৃষ্ণা লােপ পায়। একবেলার জন্য হ্যত পায়। আমি লাঞ্চ থাইনি, ওদিকে ডিলারের সময় হয়ে গিযেছে-আমার পেটের ভিতর হুলুধ্বনি জেগে উঠেছে। এমন সম্য মা-মেরির করুণা হল। মেযেটি চলল খানা-কামরার দিকে। আমিও চললুম ঠিক পিছনে পিছলে। আহা, যদি একটু হোঁচট খেযে আমার উপর পড়ে যায়। দুত্তোর, তারও উপায় নেই-উচু হিলের জুভাে হলে গাড়ির কাঁপুনিতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে—এ পন্নেছে ক্রেপ-সাে।

ঠিক পিছনে পিছনে গিয়ে থানা-কামরায় ঢুকলুম। ওযেটারটা ভাবলে স্বামী-স্ত্রী। না হলে তরুণ-তরুণী মুখ শুমসাে করে থানা-কামরায় ঢুকবে কেন? বসালাে নিয়ে একই টেবিলে-মুখােমুখি। হে মা-মেরি, নত্র দম্ গির্ত্যে তােমার জন্য আমি একশ'টা মােমবাতি মানত করলুম। দয়া করাে, মা, একটা কিছু ফিকির বাৎলাও আলাপ করবার।

বুদ্ধিমান, বুদ্ধিমান, কোনাে সন্দেহ নেই আমি বুদ্ধিমান। কোনাে ফিকিরই জুটলও না, অথচ মেযেটা বসে আছে আমার থেকে দুহাত দুরে এবং মুখােমুখি। দুহাত না হয়ে দুলক্ষ যােতনও হতে পারত-কোনাে ফাল্লাক হ'ত না।

জানালা দিযে এক ঝটকা কলার গুঁড়া এসে টেবিলের উপর পড়ল। মেয়েটি ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকাতেই আমি টিভি জানালা বন্ধ করতে গিয়ে করে ফেললুম আরেক কাণ্ড। ঠাস করে জানালাটা বুড়াে আঙুলের উপর এসে পড়ে সেটাকে দিল খেলে। ফিনকি দিয়ে রক্ত।

মা-মেরির অসীম দ্যা যে কাণ্ডটা ঘটলাে। মেয়েটি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “দাঁড়ান আমি ব্যাণ্ডেজ নিয়ে আসছি।

আমি নিজে ডাক্তার, বিবেচনা করুন অবস্থাটা। রুমাল দিয়ে চেপে ধরলুম আঙুলটাকে। মেয়েটি ছুটে নিয়ে এল কামরা থেকে ফার্স্ট এডের ব্যাণ্ডেজ। ভারপর আঙুলটার তদারকি করল শাস্ত্র-সম্মত ডাক্তারি পদ্ধতিতে। বুঝলুম মেডিকেল কলেজে পড়ে। ঝানু ডাক্তার ফার্স্ট এডের ব্যাণ্ডেজ বয়ে নিয়ে বেড়ায় না আর আনাড়ি লােক এরকম ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে পারে না।'

'আমি তাে 'না, না', 'আপনি কেন মিছে মিছে', 'ধন্যবাদ, ধন্যবাদ', উঃ, বড় লাগছে', 'এতেই হবে', 'ব্যস্ ব্যস' করেই যাচ্ছি আর সেই লিলির মত সাদা হাতের পরশ পাচ্ছি। সে কি রকম মুখমলের হাত জানেন? বলছি: আপনি কখনাে রাইনল্যাণ্ড গিযেছেন? না? থাক, ভুলেই গিয়েছিলুম প্রতিজ্ঞা করেছি, আপনাকে কোনাে বর্ণনা দেব না।'

“প্রথম পরশে সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে যায়, বলে না? বড় খাঁটি কথা। আমি ডাক্তার মানুষ, আমার হাতে কোনাে প্রকারের স্পর্শকাতরভা থাকার কথা ন্য তবু আমার যে কী অবস্থাটা হযেছিল আপনাকে সেটা বােঝাই কি করে? মেয়েটি বােধ হয় টের পেয়েছিল, কারণ একবার চকিতের ভরে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা বন্ধ করে আমার দিকে মাথা তুলে তাকিযেছিল।'

ভাতে ছিল বিস্ময়, প্রশ্ন এবং হ্যত বা একটুখানি, অতি সামান্য খুশীর ঝিলিমিলি। ভবে কি আমার হাতের স্পর্শ-? কোন্ সাহসে এ বিশ্বাস মনের কোণে ঠাঁই দিই বলুন।

আমি শুন্ গুন্ করে বললুম, 'গ্য করে তবু ভয় কেন ভাের যায় না, হায় ভীরু প্রেম হায় রে

ডাক্তার বললেন, ‘খাসা মেলডি তাে। মানেটাও বলুন।

বললুম, 'আফটার ইউ। আপনি গল্পটা শেষ করুন।

বললেন, ‘গল্প নয়, স্যার; জীবনমরণের কথা হচ্ছে!

আমি শুধালুম, 'কেন, সেপ্টিকের ভ্য ছিল নাকি?”

রাগের ভাব করে বললেন, 'ইয়ােরােপে এসে আপনার কি সব রসকষ শুকিয়ে গিয়েছে? আমাকে হেনেছে প্রেমের বাণ আর আপনি বলছেন অ্যান্টিসেপ্টিক্ আন্।

আমি বললুম, অপরাধ নেবেন না।

বললেন, তারপর আমি সুযােগ পে্যে আরম্ভ করলুম নানা রকমের কথা কইতে। গােল গােল। আমি সে পরিচয় করার জন্য জানকবুল সেটা ঢেকে চেপে। সঙ্গে সঙ্গে কখনাে শুনটা এগিয়ে দি, কখনাে যেটটা সরিয়ে নি, কখনাে বা বলি, 'মাছটা খাসা ভেঙ্গেছে, আপনি একটা থাল ; ওহে থানসামা, এদিকে, ইত্যাদি।

করে করে সুন্দরীর মনটা একটু মােলায়েম করতে পেরেছি বলে মনে একটু ক্ষীণ আশার সঞ্চার হল।

‘মেযেটি লাজুক, কিন্তু ভারী ভদ্র। আমার ভ্যাজর ভ্যাজর কান পেতে শুনলাে, দু একবার ব্লাস্ করলাে, সে যা গােলাপি-আপনি কখনাে, না, থাক।”

কিন্তু খেল মাত্র একটি অমলেট আর দুস্লাইস রুটি। নিশ্চই গরীব। ক্ষীণ আশাটার গায়ে একটু গত্তি লাগল।

এমন সময় ডাক্তারের অ্যাসিস্টেন্ট এসে জানালাে রুগী এসেছে। ডাক্তার বললেন, 'এথখুনি আসছি।”

ফিরে এসে কোনাে ভূমিকা না দিয়েই বললেন, ‘মুনিকে নাবলুম এক বস্ত্রে। এমন ভান করে কেটে পড়লুম যাভে মেযেটি মনে করে আমি ভ্যান থেকে মাল নামাতে গেলুম। যথন গুড বাই' বলে হাত বাড়ালুম তখন সে একবার আমার দিকে তাকিয়েছিল। প্রেমে পড়লে নাকি মানুষের পাখা গজায-হলেও বা, কিন্তু একথা নিশ্চয় জানি মানুষ ভথন চোখে মুখে এমন সব নুতল ভাষা পড়তে পারে যার জন্য কোন শব্দরূপ ধাতুরূপ মুখস্থ করতে হয না। তবে সে পড়াতে ভল থাকে বিস্তর, কাকতালীয় এন্তার।'

আমি দেখলুম, লেখা রয়েছে 'বিষাদ' কিন্তু পড়লুম, 'এই কি শেষ? আমিও অবাক হযে শুধালুম, 'বার্লিন থেকে মুনিক অবধি হামলা করে স্টেশনে খেই ছেড়ে দিলেন?”

ডাক্তারদের বাঁকা হাসি হেসে বললেন, 'আদপেই না। কিন্তু কি আর দরকার পিছু নিযে? মেডিকেল কলেজে পড়ে, ওভেই ব্যস্।

সেদিনই গেলুম মেডিকেল কলেজের রেস্তোরাঁয়। লাঞ্চ থেতে নিশ্চয়ই আসবে। এবারে মেয়েটি আর লজ্জা দিয়ে মনের ভাব ঢাকতে পারল না। আমাকে দেখা মাত্র আপন অজানাতে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে হাত বাড়ালাে। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মুখে যে খুশী ছড়িয়ে পড়ল তা দেখে আমার মনে আর কোনাে সন্দেহ রইল না, ভগবান মাঝে মাঝে বুদ্ধিমানকেও সাহায্য করেন।

ততক্ষণে মেয়েটি তার আপন-হাল্লা আচরণটাকে সামলে নিযেছে-লজা এসে আবার সমস্ত মুখ ঢেকে ফেলেছে।

ডাক্তার খানিক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, 'এখানেই যদি শেষ করা যেত তবে মন্দ হত না কিন্তু সর্দি-কাশির তাে তা হলে কোনাে হিল্লে হ্য না। ভাই কমিযে-সমিযে তাড়াতাড়ি শেষ করে দি।

আমি বললুম, 'কমাবেন না। ভালটা একটু দ্রুভ করে দিন। আমাদের দেশের ওস্তাদরা খানিকটে গান করেন বিলম্বিত একতালে, শেষ করেন। দ্রুত ওভালে।'

ডাক্তার বললেন, 'দুঃখিনী মেয়ে। বাপ-মা নেই। এক খাণ্ডার পিসির বাড়িতে মানুষ হয়েছে। দু'মুঠো খেতে দেয়, পরতে দেয়, ব্যস্। কলেজের ফীজটি পর্যন্ত বেচারী যােগাড় করে মাস্টারী করে।

ভাতে আমার কিছু বলার নেই কিন্তু আমার ঘােরতর আপত্তি এভাবে বুড়ী এমনি নর্তারবন্দ করে রেখেছে যে চকিভা হরিণীর মত, সমসৃণ সে শুধু ডাইনে বাঁয়ে তাকায়, ঐ বুঝি পিসি দেখে ফেললে, সে পরপুরুষের সঙ্গে কথা কইছে। আমি তাে বিদ্রোহ করে বললুম, 'এ কি বুখারার হারেম, না ভুকী পাশার জেলা না? এ অত্যাচার আমি কিছুতেই সইব না। এভা শুধু আমার হাত ধরে বলে, “প্লীজ, প্লীজ, ভুমি আর একটু বরদাস্ত করে নাই; আমি তােমাকে হারাতে চাইনে। এর বেশী সে কথনাে কিছু বলেনি।

“এই মােকামে পৌঁছতে আমার লেগেছিল ঝাড়া একটি মাস। বিবেচনা করুন। সাত দিন লেগেছিল প্রেম নিবেদন করভে। পনরাে দিল লেগেছিল হাতখানি ছুঁতে। আরাে এক সপ্তাহ পর সে আমায় বললে কেন সে এমন ভয়ে ভয়ে ডাইনে বাঁয়ে তাকায়।'

খিযেটার সিনেমা মাথায় থাকুন, আমার সাথে রাস্তায় বেরতে রাজী হ্য না-পাছে পিসি দেখে ফেলে। আমি একদিন থাকতে না পেরে বললুম, 'তােমার পিসির কি কুইনটুপ্লেট আছে নাকি যে ভারা মুনিকের সব স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে দাঁড়িয়ে তােমার উপর নজর রাখছে?” উত্তরে শুধু কার স্বরে বলে, “প্লীজ, প্লীজ।

যা-কিছু আলাপ-পরিচয, ঘনিষ্ঠভা-আফ্ল্যিতা সব ঐ কলেজ-রেস্তোরাঁয় বসে সেখানে ভিড় সাডি-টিনের ভিতর মাছের মত। চোরে চেয়ারে ঠাসাঠাসি কিন্তু তার হাতে যে হাতখানা রাখব তারও উপায় নেই। কেউ যদি দেখে ফেলে।'

আমি বললুম, সমুথে রয়েছে সুধা পারাবার নাগাল না পায় তবু আঁখি ভার কেমনে সরাব কুহেলিকার এই বাধারে।

ডাক্তার বললেন, মানে বলুন।

আমি বললুম, 'আপ যাইযে, পরে বলবাে।'

ডাক্তার বললেন, 'সেই ভিড়ের মাঝখানে, কিম্বা করিডরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপচারিতা। করিডরে কথা কওযা যায় প্রাণ খুলে, কিন্তু তবু আমি রেস্তোরাঁর ভিড়ই পছন্দ করতুম বেশী কারণ সেখানে দৈবাৎ, রুচিৎ কথনাে এভা তার ছােট্ট জুতােটি দিয়ে আমার পায়ের উপর দিত চাপ।

‘ভার মাধুর্য আপনাকে কি করে বােঝাই? এভাকে পরে নিবিড় ভর করে চিনেছি কিন্তু সেই পায়ের চাপ যে আমাকে কত কথা বলেছে, কত। আশ্বাস দিযেছে সেটা কি করে বােঝাই?

হ্যত ভার চেনা কোনাে এক ছােকরা স্টুডেন্ট এসে হাসিমুখে তাকে দুটি কথা বললে। অত্যন্ত হার্মলেস; কিন্তু আমি হিংসায় জরজর। টেবিলের উপর রাখা আমার হাত দুটো কাঁপতে আরম্ভ করেছে, আমি আর নিজেকে সামলাতে পারছিনে

এমন সময সেই পায়ের মৃদু চাপ |

সব সংশযের অবসান, সব দুঃখ অন্তর্ধান।'

ডাক্তার বললেন, ভাই আমার দুঃখ আর বেদনার অবধি রইল না। এই বিরাট মানিক শহরে লক্ষ লক্ষ নরনারী নিতে মলের ভার নামাচ্ছে, নিষ্ঠুর সংসারে লড়বার শক্তি একে অন্যের সঙ্গসুখ স্পর্শসুখ থেকে আহরণ করে নিচ্ছে, আর আমি তারই মাঝে এমন কিছুই করে উঠতে পারছিনে যাতে করে এভাকে অন্তত একবারের মত কাছে টানতে পারি।'

‘শেষটা আর সইতে না পেরে একদিন এভাকে কিছু না বলে ফিরে গেলুম বার্লিন। সেখান থেকে লিখে জালালুম, ও রকম কাছে থেকে না পাওয়ার দুঃখ আমার পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব হযে উঠেছে-আমার নার্ভস একদম গেছে। তােমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসা আমার | কিছুতেই হয়ে উঠত না-তােমার মুখের কাভর ছবি আমার চলে আসার সব শক্তি নষ্ট করে ফেলত।'

আমি বললুম, 'আপনি তাে দারুণ লােক মশাই। তবে, হ্যাঁ, আপনাদের নীটশেই বলেছেন, 'কড়া না হলে প্রেম মেলে না।

ডাক্তার বললেন, ঠিক উল্টো। কড়া হতে পারলে নিক থেকে পালাভুম না। পলাযন জিনিসটা কি বীরের লক্ষণ? তা সে কথা থাক।”

উত্তর পেলুম সঙ্গে সঙ্গেই। সে চিঠিটা আমি এতবার পড়েছি, যে তার ফুলস্টপ, কমা পর্যন্ত আমার মুখস্থ হত্যে গিযেছে। এবং তার চেযেও বড় কথা , সে চিঠিটির বক্তব্য আমার কাছে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ঠেকলাে।'

আপনাদের দেশে অবিশ্বাস্য বলে কোনাে জিনিস নেই-ভিখিরিকে মাথায় তুলে নিয়ে আপনাদের দেশে হাতী হামেশাই রাজা বানায়। কিন্তু মনিতে তাে সেরকম ঐতিহ্য নেই। চিঠিতে লেখা ছিলঃ -

বেশি লিখব না-আমারও অসহ্য হয়ে উঠেছে। তাই স্থির করেছি তােমার ইচ্ছামত তােমায় আমায় একবার নিভৃতে দেখা হবে। তারপর বিদায। যতদিন পিসি আছেন ততদিন আমি আর কোনাে পন্থা খুঁজে পাচ্ছিনে। তুমি আসছে বুধবার দিন আমাদের বাড়ির সামনের ফুটপাতে অপেক্ষা করাে। আমি তােমাকে আমার ঘরে নিয়ে আসব।

ডাক্তার বললেন, বিশ্বাস হ্য আপনার যে মেযে পিসির ভযে আমার সঙ্গে কলেজ রেস্তোরাঁর বাইরে যেতে রাজী হত না, সে আমাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে আপন ঘরে?”

আমি বললুম, পীরিতি-সায়রে ডােবারপুর্বে যে রাধা সাপের ছবিমাত্র দেখেই অভৱান হতেন সেই রাধাই অভিসারে যাওয়ার সময় আপন হাত দিযে পথের পাশের সাপের ফনা চেপে ধরেছেন পাচ্ছে সাপের মাথার মণির আলােকে কেউ তাঁকে দেখে ফেলে।

ডাক্তার বললেন, ভাই বটে। তবে কি না আমি রাধার প্রেমকাহিনী কথনাে পড়িনি। সে কথা যাক।'

আমি মানিক পৌঁছলুম বুধবার দিন সন্ধ্যের দিকে। কলার গুঁড়ােয় সর্বাঙ্গ ঢেকে গিয়েছিল বলে ঢুকলুম একটা পাবলিক বাথে স্নান করতে। টাবে বসে সর্বশরীর ডলাই-মলাই করে আর গরম জলে সেদ্ধ চিংড়িটার মত লাল হযে যখন বেরলুম ভথন আর হাতে বেশি সময় নেই। অথচ গরম টাব থেকে ও রকম হুট করে ঠাণ্ডায় বেরলে যে সঙ্গে সঙ্গে ঝপ করে সর্দি হয় সে কথাও জানি। চালটা না করলেও যে হত সে

অস্বটা বুঝতে পারলুম রাস্তায় বেরিয়ে কিন্তু তখন আর আফসােস করে কোনাে ফায়দা নেই। সেই ডিসেম্বরে শীতে চললুম এভার বাড়ির | দিকে মা-মেরির উপর ভরসা করে, যে এ যাত্রায় সর্দিটা নাও হতে পারে।'

আমি বললুম, 'আমরা বাঙালায় বলি, 'দুগগা বলে ঝুলে পড়লুম।”

ডাক্তার বললেন, 'সাড়ে এগারটার সময় গিয়ে দাঁড়ালুম এভার বাড়ির সামনের রাস্তা। টেম্পারেচার ভথন শুল্যেরও নীচে-আপনাদের পাগলা ফারেন্হাইটের হিসেবে বত্রিশের ঢের নীচে। রাস্তায় এক ফুট বরফ। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, আর আমার চতুর্দিকে যে হীম হতে লাগলাে তার সঙ্গে তুলনা দিয়ে বলতে পারি আমাকে যে কেউ একটা বিরাট ফিলিডেরের ভিতর ভালাবন্ধ করে রেখে দিল।' তিন মিনিট যেতে না যেতে নামল মুষলধারে-বৃষ্টি নন্য-সর্দি। সঙ্গে সঙ্গে ডাইনামাইট ফাটার হাঁচি-হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো, হ্যাঁচ্চো। আপনার আজকের সর্দি তার তুলনায় নস্যি, অর্থাৎ নস্যির খোঁচায নামানাে আড়াই ফোঁটা জল। হাঁচি আর জল, জল আর হাঁচি।

| কি করি, কি করি ভাবছি, এমন সময় এভা এসে নিঃশব্দে আমার হাত ধরলাে-বরফের গুঁড়াের উপর পায়ের শব্দ শােনা যায় না। ভার। উপর সে পরেছে সেই ক্রেপ-সােলের জুভাে-বেচারীর মাত্র ঐ এক জোড়াই সম্বল।

কোনাে কথা না বলে আমাকে নিযে চলল তার সঙ্গে। ক্লাটের দরজা খুলে, করিডরের খানিকটে পেরিযেই তার কামরা। নিঃশব্দে আমাকে (সেখানে ঢুকিয়ে দরজায় খিল দিযে মাথা নীচু করে আমার সামনে দাঁড়িযে রইল।'

এভার গােলাপি মুখ ডাচ্ পনিরের মত হলদে, টুকটুকে লাল ঠোঁট দুটি ক্ল-ডানযুবের মত ঘন বেগুনি-নীল-ভযে, উত্তেজনায়।

আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল আবার আমার সেই ডাইনামাইট ফাটানাে হাঁচ্চো, হাঁচ্চো।

এভা আমাকে ধরে নিযে আমার মাথা গুঁজে দিল বিছানায়। মাথার উপরে চাপালাে বালিশ আর সব ক'খানা লেপ-কম্বল। বুঝতে পারলুম কেন; পাশে ঘরে পিসি যদি শুনতে পান ভবেই হয়েছে। আমি প্রাণপণ হাঁচি চাপবার চেষ্টা করছি আর লেপ-কম্বলের ভিতর বমশে ফাটাচ্ছি।'

কতক্ষণ এ রকম কেটেছিল বলতে পারব না। হাঁচির শব্দ কিছুতেই থামছে না। এভা শুধু কম্বল চাপাচ্ছে, আমার দম বন্ধ হবার উপক্রম। কিন্তু নিবিড় পুলকে বার বার আমার সর্বশরীর শিহরিত হচ্ছে-এভার হাতের চাপ পেযে।

এমন সময় দরজায় ধাক্কা আর নারীকণ্ঠের তীর চিৎকার, দরজা খােলা'।

পিসি!

আর লুকিয়ে লাভ নেই। আমি লেপের ভিতর থেকে বেরলুম। এভা ভয়ে ভিরমি গিয়েছে, খাটের উপর নেতিয়ে পড়েছে।

আমি দরজা খুলে দিলুম। সাক্ষাৎ শকুনির মত বীভৎস এক বুড়ী ঘরে ঢুকে আমার দিকে না তাকিয়েই এভাকে বললাে, 'কাল সকালেই তুই এ বাড়ী ছাড়বি।”

সঙ্গে সঙ্গে আর কি সব বকুনি দিযেছিল, ঘেন্না, কেলেঙ্কারী, শােবার ঘরে পরপুরুষ', 'রাস্তার মেয়ের ব্যাভার', এই সব, সে আমার আর মনে নেই। বুড়ী আমার দিকে তাকায় না। গালের উপর গাল চড়ছে যেন 'গজী প্যিানাের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি কেউ আঙ্গুল চালাচ্ছে।

আমি আর থাকতে পারলুম না। বুড়ীর দুই বাহু দুহাত দিযে চেপে ধরে বললুম, আমার নাম পিটার সোহ্। বার্লিনে ডাক্তারি করি। ভদ্রঘরের ছেলে। আপনার ভাইঝিকে বিয়ে করতে চাই।”

ডাক্তার বললেন, মা-মেরি সাক্ষী, আমি এভাকে বিয়ে করার প্রস্তাব এত দিন করিনি পাছে সে না বলে বসে। আমি অপেক্ষা করছিলুম পরিচযটা ঘনাবার জন্য বিয়ের প্রস্তাবটা আমার মুখ দিয়ে যে ভুখন কি করে বেরিয়ে গেল আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি।

‘পিসি আমার দিকে হাবার মত তাকালাে-এক বিঘৎ চওড়া হা করে। পাকা দুমিনিট ভার লেগেছিল ব্যাপারটা বুঝতে। ভারপর ফুটে উঠল মুখের উপর খুশীর প্যলা ঝলক। সেটা দেখতে আরাে বীভৎস। মুথের কুঁচকানাে, এবড়াে-থেবড়াে গাল, ভাঙা-চোরা নাক-মুখ-চোঁট যেন আরাে বিকৃত হয়ে গেল।'

আমাকে জড়িয়ে ধরে কি যেন বলল ঠিক বুঝতে পারলুম না। তারপর হঠাৎ আমাকে ছেড়ে দিয়ে ছুটল করিডরের দিকে। চিৎকার করে কাকে যেন ডাকছে।

এভা ভথনাে অচৈতন্য।

বুড়ী ফিরে এল বুড়ােকে নিয়ে। বুড়াে ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছে চট করে। তার চেহারার খুশীর পিছনে দেখলুম সেই ভীত ভাব-এভার মুখে (যেটা অষ্টপ্রহর লেপা থাকে। বুঝলুম, পিসির দাপটে এ বাড়ির সকলেরই কণ্ঠশ্বাস।'

মনে হল বুড়াে খুশী হয়েছে এভা যে এ বাড়ির অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে তার জন্য। হায, ভার ভাে নিষ্কৃতি নেই।

ডাক্তার বললেন, 'সেই দুপুর রাতে ওয়াইন এল, শ্যাম্পেন এল। হােটেল থেকে সসেজ, কটলেট এল। হৈহৈ রৈরৈ। এভা সম্বিতে ফিরেছে। বুড়াে শ্যাম্পেন টানছে জলের মত। বুড়ী এক গেলাসেই টং | আমাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদে আর এভার বাপের কথা স্মরণ করে বলে, ভাই বেঁচে থাকলে আজ সে কী খুশীটাই না হত।

আর এভা? আমাকে শুধু একবার কানে কানে বলল, “জীবনে এই প্রথম শ্যাম্পেন খাচ্ছি। তুমি আমার উপর একটু নজর রেখাে।

ডাক্তার উৎসাহিত হয়ে আরাে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময়ে আস্তে আস্তে দরজা খুলে ঢুকলেন এক সুন্দরী-হ্যাঁ, সুন্দরী বটে।

এক লহমায আমি নর্থ সীর ঘন নীল জল, দক্ষিণ ইটালির সােনালি রােদে রূপালি প্রজাপতি, ডানযুবের শান্ত-প্রশান্ত ছবি, সেই ডানযুবের লজ্জাশীল দেহছন্দ, রাইনল্যাণ্ডের শ্যামলিয়া মােহনীয়া ইন্দ্রজাল সব কিছুই দেখতে পেলুম।

আর সে কী লাজুক হাসি হেসে আমার দিকে তিনি হাত বাড়ালেন।

আমি মাথা নীচু করে ফরাসিস্ কায়দায় তার চম্পক করাঙ্গুলিগ্রান্তে ওষ্ঠ স্পর্শ করে মনে মনে বললুম, বেঁচে থাকো সর্দি-কাশি চিরজীবী হয়ে তুমি।'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ