Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

অদৃশ্য সঙ্কেত ।। শ্রীস্বপন কুমার

 

-এক- 

আঃ—আ—অ... 

নৈশ প্রহরের মনোরম মায়াময় পরিবেশকে একমুহূর্তের মধ্যেই যেন গভীর অশান্তির মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে ফুটে উঠল একটা কাতর আর্ত চীৎকার । 

মুমূর্ষু নারীকণ্ঠের অন্তিম করুণতায় যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল বিয়েবাড়ির আনন্দকোলাহলময় আলোকোজ্জ্বল সুন্দর পরিবেশ। 

অনন্ত নীল আকাশের অগণন তারারাও বুঝি বারেকের জন্য কেঁপে উঠল এই আকুল শব্দের তীক্ষ্ণতায় । 

প্রেতলোকের বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস যেন নেমে এলো অকলঙ্ক স্বৰ্গীয় নির্মলতার মাঝে ৷ 

কিন্তু কার এ কণ্ঠ ? 

কোথায় এর উৎস ? 

বিবাহ উপলক্ষে রায়সাহেব ঈশান মিত্রের বাড়িতে উপস্থিত সমবেত অতিথিবর্গ ব্যস্ততার সঙ্গে অপরিসীম চাঞ্চল্য নিয়ে ছুটে গেল দোতলায় কোণের একখানা ঘরের দিকে । 

কিন্তু একি ? 

তাদের পদক্ষেপের অনেক আগেই একটি নিরপরাধা নারীর শেষ নিশ্বাস বাতাসের বুকে বিলীন হয়ে গেছে । 

কিন্তু কে এর জন্যে অপরাধী ? 

কার চক্রান্তের বিষবাষ্পে আজ একটি কোমল কুসুমের পাপড়ি ভূলুন্ঠিত হয়ে ধূলিমলিন ধরণীর ধূসরতায় নিজেকে নিঃশেষে সঁপে দিয়েছে ? 

কে দেবে এর উত্তর ? 

সকলের মুখে মুখে শুধুমাত্র একটি কথাই ভেসে ভেসে বেড়াতে লাগল— মনোরমা দেবী মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু এ কি মৃত্যু, না হত্যা ? 

এই একটিমাত্র প্রশ্নই বার বার আলোড়ন তুলতে থাকে ডিটেকটিভ দীপক চ্যাটার্জীর মনে। নিশ্চয়ই এর মধ্যে জড়িত আছে গভীর রহস্য। আর রহস্যের যবনিকা সরিয়ে, হত্যাকারীর কূটচক্র ভেদ করে তাকেই খুঁজে বের করতে হবে—প্রকৃত অপরাধী কে ? 

এইজন্যেই বোধ হয় ভগবান ঠিক এই সময়েই তাকে এখানে উপস্থিত করেছিলেন । 

চিন্তার অতলে তলিয়ে যায় দীপকের মন। 

*****

রায়সাহেব ঈশান মিত্রের বাড়িতে রহস্যানুসন্ধী দীপক চ্যাটার্জীর যাতায়াত আজ নতুন নয় । ঈশান মিত্রের প্রথমা স্ত্রী বিনতা দেবী দীপককে বেশ একটু স্নেহ করতেন । সে আজ পাঁচ বছর আগেকার কথা।

দীপক তখন আজকের রহস্যভেদী দীপক চ্যাটার্জী নয় । সে তখন ঈশান মিত্রের প্রথম পক্ষের ছেলেকে প্রাইভেট পড়াত । বি. এ. পরীক্ষা দিয়ে হাতে ছিল তার অখণ্ড অবকাশ। আর বাড়িতে বসে আড্ডা মেরে সময় নষ্ট করতে আর যেই ভালবাসুক, দীপক চ্যাটার্জীর মত ছেলেরা সে দলের নয় ৷ 

তারপর এই দীর্ঘ পাঁচ বছরে পৃথিবীর বুকের ওপর দিয়ে ঘটে গেছে অনেক পরিবর্তন ৷ 

দীপক চ্যাটার্জীর পিতা ইহলোকের মায়া কাটিয়েছেন। দীপক এখন পিতার অগাধ সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী 1 তা ছাড়া সে বিদ্বান ও বুদ্ধিমান্ । তাই তার মত ছেলেদের একটা-না-একটা খেয়াল এসে জুটবেই । দীপকের কিন্তু রহস্যভেদটা খেয়াল না হয়ে একেবারে নেশায় এসে দাঁড়িয়েছিল । ইতিমধ্যে সে ক্রিমিনোলজিতে এম. এ.টাও দিয়ে ফেলেছিল। তাই এ বিষয়টা তার একটা বিশেষ 'ফ্যান্সী' হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 

ওদিকে ঈশান মিত্রের প্রথমা স্ত্রী বিনতা দেবীও একটিমাত্র ছেলে শঙ্করকে রেখে হঠাৎ হার্টফেল করে মারা যান। এ খবরটা অবশ্য দীপক তখন জানতে পারেনি। জানতে পারল বিনতা দেবী মারা যাবার দেড় বছর পরে ঈশান মিত্র যখন দ্বিতীয়বার বিবাহের ব্যবস্থা করে দীপককেও তাতে নিমন্ত্রণ করলেন। 

দীর্ঘদিন পরে দীপক আবার ওই বাড়িখানার দিকে পা বাড়াল ৷ 

কিন্তু বাড়িখানায় পা দিয়েই দীপক কেমন যেন অবাক হল ৷ 

সেদিন বৌভাত। উচ্ছ্বাস আর কলরবে সারা বাড়ি গম্ গম্ করছিল। কিন্তু কোথাও এতটুকু মাত্র আনন্দের রেশ চোখে পড়ল না দীপকের। এ যেন একটা উৎসবের গতানুগতিক নিয়মরক্ষা। 

প্রথম পক্ষের ছেলে শঙ্করের বয়স বছর দশেকের বেশি নয়। কিন্তু সে যেন অতিমাত্রায় গম্ভীর । কেমন যেন বীতস্পৃহ ভাব তার, উদাসীন নির্লিপ্ততা । ঈশান মিত্রের বাড়ির অধিকাংশ আত্মীয়স্বজনের মনের মধ্যেও কেমন যেন একটা অস্বস্তির ভাব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। তাদের প্রত্যেককে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে দীপকের এ কথাটাই মনে হলো যে, তারা কেউ ঈশানবাবুর এই দ্বিতীয়- বার দারপরিগ্রহকে সন্তুষ্টচিত্তে নিতে পারেনি । 

বাইরে রাত নেমেছে। রাতের কালো ডানায় তারাদের ঝিলিমিলি। ঝিরিঝিরি বইছে ফাল্গুনী হাওয়া । 

দীপক একা দোতলার ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল। ভেতরের হলঘরে অতিথিদের কলগুঞ্জন। 

কয়েকজন অতিথি ঈশান মিত্রের নববিবাহিতা স্ত্রীকে গান গাইবার জন্যে অনুরোধ করছেন শোনা গেল।

মায়া দেবী কয়েকবার আপত্তি করল। অবশেষে অতিথিদের অনুরোধ এড়াতে না পেরে বাধ্য হয়েই গান ধরল : - 

                আমি চঞ্চল হে 

                আমি সুদূরের পিয়াসী । 

                দিন চলে যায়, আমি আনমনে, 

                তারি পথ চেয়ে থাকি বাতায়নে,

                ওগো প্রাণে মনে আমি যে তাহার 

                         পরশ পাবার প্রয়াসী । 

                         আমি সুদূরের পিয়াসী । 

চমৎকার কণ্ঠ মায়া দেবীর । 

দীপক সংগীতজ্ঞ নয় । তবে গানের সুরের অপূর্ব মূর্ছ না তাকে বিহ্বল করে তুলল। দীপক সিগারেটে আর একটা সুদীর্ঘ টান দিয়ে ভাবতে লাগল— সত্যি, ঈশান মিত্রের স্ত্রীভাগ্য ভাল, সন্দেহ নেই । মায়া দেবী অনুপম রূপলাবণ্যের অধিকারিণী । তা ছাড়া এমন সুন্দর কণ্ঠস্বর যে-কোনও সাধারণ মানুষের ঈর্ষার বস্তু। তা ছাড়া মায়া দেবী যে একজন বিদুষী মহিলা এ কথাও শুনেছে দীপক । 

কিন্তু মায়া দেবী রায়সাহেব ঈশান মিত্রকে বিবাহ করল কেন ? ঈশান মিত্র মায়া দেবীর চেয়ে বয়সে অন্ততঃ পনর-কুড়ি বছরের বড় ৷  

মায়া দেবীর বয়স কুড়ির কাছাকাছি বলে মনে হয় । কিন্তু ঈশান মিত্রের বয়স প্রায় চল্লিশ । 

তা ছাড়া ঈশান মিত্রের প্রথম পক্ষের যে একটি ছেলে আছে এ কথাও মায়া দেবীর অবশ্যই অজানা ছিল না। এ কি তবে শুধু অর্থের প্রলোভন ? হয়ত তাই । 

-একি, দীপকদা যে ? এখানে ? 

পরিচিত কণ্ঠস্বর। 

দীপক পেছন ফিরে চাইল। ঈশান মিত্রের ভাইপো অশোক মিত্র তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অশোকের বয়স পঁচিশের কাছাকাছি। দোহারা চেহারা । অল্পবয়সে পিতৃহীন হবার পর সে আর তার বড় ভাই অমল দুজনেই কাকার কাছে মানুষ । সবসময় হাসিখুসি ভাব অশোকের। বেশভূষায় বেশ একটু বাবুগিরির ছাপ। তবে অন্য কোনও বখেয়াল তার নেই । 

—তুমি ত জান অশোক, কলরবকে আমি পছন্দ করি না। দীপক হেসে বলল—তবে তুমিও এভাবে উৎসব-আনন্দকে এড়িয়ে চলছ কেন ? 

—ভাল লাগছে না । নির্লিপ্ত স্বর অশোকের। 

—বুঝেছি। 'বোরিং' লাগছে, তাই না ? 

—সত্যি দীপকদা । কাকাবাবুর এ বয়সে আর বিয়ে না করলেই ভাল হতো ৷ 

-কেন ? 

—এখন হচ্ছে দাদার অথবা বিনয়দার ঠিক বিয়ে করবার বয়স । কাকা যদি এ বয়সে বিয়ে করে এভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন, তবে শঙ্করটা ধীরে ধীরে উচ্ছন্নে যাবে । 

বিনয়দার পরিচয় এখানে সংক্ষেপে দেওয়া উচিত। বিনয় হচ্ছে রায়সাহেব ঈশান মিত্রের নিজের ভাগনে। অশোকের চেয়ে সে বছর তিনেকের বড়। বিনয় একটু খামখেয়ালী ধরনের। বি. এ. পর্যন্ত পড়ে সে পরীক্ষা দেয়নি । কেউ প্রশ্ন করলে বলে, শুধু শুধু ডিগ্রীগুলো কুড়িয়ে কি লাভ? বোঝার মতো চেপে বসে মানুষের উন্নতির পথে ব্যাঘাত ওগুলো শুধু কাঁধে সৃষ্টি করে। তবে পড়াশুনার দিকে তার ঝোঁক প্রচুর। আর আছে তার পিয়ানো বাজানোর শখ, কিছুদিন ওস্তাদের কাছে পিয়ানো শিখেছিল, এখন নিজেই বাজায়। পিয়ানোতে তার হাতও খুব মিঠে । 

বিনয়ের কথা বলল--সত্যি, ওঠাতে দীপক বলল-- সত্যি, বিনয়ের বিয়ের কথাই আমি ভাবছিলাম । হঠাৎ যে ঈশানবাবু আবার বিয়ে করবেন এটা আমি ভাবতেই পারিনি। তবে শঙ্করকে মানুষ করে তুলতে গেলেও তো একজন নারীর প্রয়োজন।

অশোক বাধা দিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলল – তোমার কথা বাদ দাও দীপকদা ওরকম সুন্দরী, বিদুষী গায়িকার দ্বারা ছেলে মানুষ হয় না। বিনতা কাকীমার কথা কি তুমি এর মধ্যে ভুলে গেলে ? যেন পবিত্র মাতৃমূর্তি ! আর এ যেন কেমন ! এঁকে কাকীমা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে না ৷ 

—সেটা ঠিক সেজন্যে নয়, অশোক । দীপক বলল—এর কারণ অন্য ৷ মায়া দেবী প্রায় তোমার সমবয়সী। বরং তুমিই বোধ হয় তার চেয়ে দু-এক বছরের বড় হবে। সেজন্যই ওঁকে তুমি ঠিক গুরুজন বলে ভাবতে পারছ না, তবে ধীরে ধীরে ওটা সয়ে যাবে । 

দীপকের কথায় অশোক যেন সন্তুষ্ট হলো না। বলল – আচ্ছা, চলি দীপকদা । দেখি, ওদিকে খাবার যোগাড় কতটা হলো । শঙ্করটাও নিচের ঘরে মন খারাপ করে বসে আছে, তার দিকেও একটু দেখতে হবে। 

আর কথা না বাড়িয়ে ধীরে ধীরে অশোক হলঘরের দিকে চলে যায় । 

অশোক চলে যেতে দীপক কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। সত্যি কথা বলতে গেলে ঈশান মিত্রের এই দ্বিতীয়বার বিয়ে সারা পরিবারের বুকেই একটা অশান্তির ছায়া বয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কেন ? হয়ত এরা প্রত্যেকেই আশা করেছিল ঈশান মিত্র মৃত্যুর পূর্বে উইল করে শঙ্করের সাথে এদের প্রত্যেককেও তাঁর অগাধ সম্পত্তির কিছু কিছু অংশ দান করতে পারেন। কিন্তু ঈশান মিত্রের এই দ্বিতীয়বার বিবাহ তাদের সে আশাকে সম্পূর্ণ নির্মূল করেছে । 

তা ছাড়া ঈশান মিত্রের দ্বিতীয়া স্ত্রী মায়া দেবী অপূর্ব সুন্দরী। যে কোন পুরুষকে সম্পূর্ণ বশীভূত করবার ক্ষমতা তাঁর আছে। তাই দ্বিতীয়া স্ত্রীর প্রতি তাঁর আকর্ষণ প্রথমা স্ত্রীর চেয়েও অনেক বেশি হবে বলেই তাদের ধারণা। এক্ষেত্রে মায়া দেবীর কোনও সন্তান হলে সেই যে সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে তাও কারও অজানা নয় । শঙ্কর হয়ত পাবে সামান্য একটা অংশ, আর তারা ত এক কপর্দকও নয় । 

দীপক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সত্যি, বিষয়সম্পত্তি আর টাকাই মানুষের সত্যিকারের প্রবৃত্তির অনেক উপরে আজ স্থান পেয়েছে। কিন্তু কেন ? মানুষের জন্যেই টাকা ৷ টাকার জন্যে ত আর মানুষ নয় ! 

পার্কের দিক থেকে এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে গেল। আকাশে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের লুকোচুরি খেলা চলেছে । ডেকে উঠল কোন্ একটা রাত- জাগা পাখী । 

হঠাৎ দীপকের চমক ভাঙল । 

হলঘরে অতিথিদের কলগুঞ্জন থেমে গেছে। সবাই বোধ হয় ডাইনিং রুমে। সে যে কি করে এতক্ষণ এভাবে তন্ময় হয়ে ছিল তা নিজেই ভেবে পেল না ৷ 

হলঘরে প্রবেশ করতেই তার হঠাৎ দেখা হয় মনোরমার সঙ্গে। মনোরমার সঙ্গে আগে দীপকের সামান্য পরিচয় ছিল। মনোরমা ঈশান মিত্রের প্রথম পক্ষের স্ত্রী বিনতা দেবীর বোন । বিনতা দেবীর কঠিন অসুখের সংবাদ পেয়ে দু বছর আগে সে পিতৃগৃহ থেকে এখানে এসেছিল। তারপর দিদির আকস্মিক মৃত্যু ঘটে যাওয়ায় সে এই পরিবারেই থাকতে বাধ্য হয় । সে অল্প- বয়সেই বিধবা হয়েছিল। তাই পিতৃগৃহেও খুব ভাল ব্যবহার পেত না ৷ ঈশান মিত্রের জীর্ণ সংসার-তরীর হালটা বেশ দৃঢ়মুষ্টিতে ধরেছিল বলে, এ সংসারে তার যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। মনোরমা নিঃসন্তান। তাই শঙ্করকে সে খুবই স্নেহ করত। মনোরমার স্নেহযত্নে শঙ্কর কোন দিনই মায়ের অভাব বুঝতে পারেনি এতটুকুও। 

মনোরমার এ সংসারে দীর্ঘদিন থাকার আরও একটা কারণ ছিল। এটা অবশ্য দীপক কানাঘুষায় শুনেছে—খুব বেশি বিশ্বাস করেনি। ঈশান মিত্রের বড় ভাইপো, অশোকের দাদা অমল নাকি বালবিধবা মনোরমার প্রতি কিছুটা আসক্ত হয়েছিল। এমন কি, বিধবাবিবাহটা সামাজিক অনুশাসনের দিক থেকে উচিত কিনা এ নিয়ে সে এককালে যথেষ্ট গবেষণা করেছে। কিন্তু তারপর যে কি কারণে দুজনের বিবাহটা ঘটে ওঠেনি তা দীপকের অজ্ঞাত । 

মনোরমা দীপককে দেখে কেমন যেন থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল । দীপকের এই ধরনের আকস্মিক আবির্ভাব যেন সে ঠিক আশা করেনি ৷ 

দীপক বলল – মনোরমা দেবী যে ! 

মনোরমা আলতো হাসিতেমুখখানা ভরিয়ে তুলে বলল— হ্যাঁ, নিচের ডাইনিং রুমে অতিথিরা সব ভিড় করেছেন, তাই দোতলায় উঠে এলাম ।  তারপর আপনি যে এখানে ? খেতে যাননি কেন ? 

দীপক হেসে বলল—আমি তো আপনাদের ঘরের লোক । 

একসময় খেতে গেলেই হলো । 

মনোরমা হেসে বলল—কিন্তু তিন বছরের মধ্যে তো এ বাড়িতে পা দেবার সময় পাননি। আমরা বেঁচে আছি কিনা, সেদিকেও নজর দেবার অবকাশ হয়নি আপনার ৷ আপনি অদ্ভুত লোক কিন্তু।

দীপক বলল—সত্যি, বাবা মারা যাবার পর আমি কেমন যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছি! কলরব আর হৈ-চৈ তো ভাল লাগেই না, বরং কেমন যেন একটা নিরালার দিকেই ঝুঁকে পড়ছে আমার মন । আর ঠিক সেই জন্যেই অতিথিদের সঙ্গে ডাইনিং রুমে না গিয়ে পাশের ব্যাল্কনিতে একা দাঁড়িয়েছিলাম । 

মনোরমা বলল—বুঝেছি দীপকবাবু, আপনি আজকাল ‘পোয়েট্' হয়ে উঠছেন। 

দীপক বলল—ঠিক উলটো মনোরমা দেবী। আমি হয়ে উঠেছি কেমন যেন পেসিমিস্ট। আনন্দ-কোলাহল—বিশেষ করে এ ধরনের সামাজিক ফাংশানকে উপলক্ষ করে যে উচ্ছ্বাস, এ সবের দিকে আর ঝুঁকতে চায় না আমার মন । 

মনোরমা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল—এটাকে কি আপনি একটা ফাংশান বলে মনে করেন দীপকবাবু? 

দীপক মনোরমাকে বাজিয়ে দেখবার ইচ্ছা নিয়ে বলল – নয় কেন শুনি ? 

মনোরমা বলল—এটা হচ্ছে কোনও একজন খামখেয়ালী প্রৌঢ়ের বিলাস চরিতার্থ করবার ইচ্ছা । 

এতটা বাড়াবাড়ি দীপকের ভাল লাগছিল না । সে বলল—এটা কিন্তু আপনি ঠিক ‘ব্যালেন্সড' মন থেকে বলছেন না মনোরমা দেবী। 

—তা ছাড়া আর কি বলব দীপকবাবু ? 

—দেখুন, বিবাহ করবার পক্ষে ঈশানবাবুর বয়সটা একটু বেশি হয়েছে স্বীকার করি, কিন্তু সেটা এমন কিছু নয় । তিনি ত আর ঠিক ষাট বছরের বুড়ো হননি এখনও । তা ছাড়া বুড়ো বয়সের একটা অবলম্বন হিসেবেও বিয়ে করা তাঁর অনুচিত নয় । 

–যাক্, এ সম্বন্ধে বেশি কথা আমি বলতে চাই না দীপকবাবু। আশা করি এখন এ আলোচনা বন্ধ রাখাই বাঞ্ছনীয় । 

—বেশ। এ আলোচনা আপনার অপ্রিয় হলে, ও সম্বন্ধে আর কিছু বলব না আমি ৷ 

—আপনি আমার সঙ্গে আসুন দীপকবাবু । আমি আপনার খাবার ব্যবস্থা করে দিয়ে শঙ্করের ঘরে যাব । ও আবার আমার পাশে না শুলে ঘুমোতে চায় না। উঃ, এ রকম একটা ছেলের মুখের দিকে চেয়েও যে মানুষ নতুন বিয়ে করা থেকে বিরত থাকল না, তাকে কি আপনি সত্যিকারের উদারমনা পুরুষের দলে ফেলবেন ? 

দীপক আর কথা না বাড়িয়ে নিচে নেমে গেল ৷ 


—দুই—

নিচে নেমে এসে দীপক সবে খেতে বসেছিল। অন্য অতিথিরা খাওয়া- দাওয়া শেষ করে বসেছিল গিয়ে বাইরের ঘরে। যাদের শীগগির ৰাড়ি ফেরা প্রয়োজন তারা চলে যায় বাড়ি ৷ অন্য সকলে তাস ইত্যাদি খেলা নিয়ে মেতে উঠেছিল । 

ঠিক এমনি সময় দোতলার ঘরে শোনা গেল এই আর্ত চীৎকার। 

সকলেই ছুটে গেল দোতলার ঘরের দিকে। 

ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সকলে দেখতে পেল মনোরমা দেবী মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়েছে। দেহ নিস্পন্দ। কোথাও প্রাণের চিহ্নমাত্রও অবশিষ্ট আছে বলে বোঝা গেল না । হাতে ছিল একখানা বই ৷ বোধ হয় সে কিছুক্ষণ আগেও বইখানা পড়ছিল। সেটা একপাশে খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। 

দীপক ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেই বলে উঠল—দেখুন, আপনারা কোনও জিনিসপত্রে হাত দেবেন না। কারণ, পুলিস এসে এগুলো দিয়ে তদন্ত করবে এবং প্রত্যেকটি জিনিস বেশ ভাল করেই দেখা হবে । 

—পুলিস ? উপস্থিত অতিথিদের মুখে একসঙ্গে প্রশ্ন ফুটে উঠল ৷ 

—হ্যাঁ, দীপক বলল, প্রথমে একজন ডাক্তারকে ডাকা প্রয়োজন । আর পুলিসে ফোন করা উচিত। আচ্ছা, সে সব ব্যবস্থা আমিই করছি। এটা একটা খুনের কেস বলেই মনে হচ্ছে । 

—খুন ? মানে মার্ডার! আশ্চর্য! সকলের মুখ দিয়ে যেন একটি কথাই ধ্বনিত হলো । 

—হ্যাঁ, আমার তাই মনে হচ্ছে ।  

—কিন্তু... 

—সেই কিন্তুর নিরসনের জন্যেই পুলিসে ফোন করতে বাধ্য হলাম । 

সকলেই ঘর থেকে একে একে বেরিয়ে গেল । 

—আপনারা প্রত্যেকেই নিচের ঘরে বসুন। কেউ চলে যাবার চেষ্টা 

করবেন না। 

দীপকের স্বরটা কঠোর বলে মনে হলো । 

সোজা নিচে নেমে এলো দীপক, টেলিফোনের সামনে গিয়ে রিসিভার তুলে নিল—হ্যালো পুট্ মি টু বি বি... 

—হ্যালো, কে ? 

—আমি চ্যাটার্জী কথা বলছি । 

—ও, দীপক... 

—ঠিকই অনুমান করেছেন, ডাঃ লাহিড়ী । 

—তারপর হঠাৎ কি ব্যাপার বলো ত ! 

—আপনি জানেন ডাঃ লাহিড়ী, যে কিছুদিন হলো আমি ডিটেকশনকে আমার জীবনের অন্যতম একটি প্রফেশন হিসেবে গ্রহণ করেছি। 

—হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়ছে বটে। 

—সম্প্রতি রায়সাহেব ঈশান মিত্রের বাড়িতে তাঁর বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে এসেছি। কিন্তু 'ঢেঁকি স্বর্গে গিয়ে ধান ভানে', জানেন ত ? এখানে এসেও দেখছি সেই ব্যাপার ! এখন কেসটা পরীক্ষা করবার জন্যে আপনি যদি দয়া করে... ! 

—নিশ্চয়ই ! আমি সবসময়েই তোমাকে সাহায্য করবার জন্যে প্রস্তুত ... 

—ধন্যবাদ। 

- এখুনি আসছি। 

ফোন ছেড়ে দিয়েই দীপক স্থানীয় থানার সঙ্গে সংযোগ চাইল । 

ফোন তুললেন স্থানীয় থানার দারোগা ভজহরিবাবু । 

—হ্যালো, কে ? 

—আমি দীপক চ্যাটার্জী কথা বলছি রায়সাহেব ঈশান মিত্রের বাড়ি থেকে। আপনি ? 

–আমি ভজহরি সামন্ত... 

—ওহো, ভজহরিবাবু, আপনি ! 

—হ্যাঁ। তারপর ব্যাপার কি মিঃ চ্যাটার্জী ? 

—রায়সাহেব ঈশান মিত্রের বিয়েতে আমি এখানে নিমন্ত্রিত হয়েছিলাম । কিন্তু এদিকে একটা মারাত্মক ব্যাপার সংঘটিত হয়েছে। 

—কি ধরনের ? 

—বোধ হয় এটা একটা কেস অব মার্ডার ।

—ও, আচ্ছা আমি যতো শীঘ্র পারি আসতে চেষ্টা করছি। আপনি ওখানেই থাকবেন ত ? 

—হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। 

—ধন্যবাদ । আশা করি আপনার কাছ থেকে উপযুক্ত সাহায্য আমি পাব ৷ 

ফোন ছেড়ে দিয়ে দীপক ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে একটু পরেই শুনতে পেল ডাঃ লাহিড়ীর মোটরকার বাইরে পার্ক করছে। 

দীপক ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে এলো । 

—সর্বপ্রথমে মৃতদেহ কে দেখতে পায় দীপক ? 

—সেটা ঠিক জানি না। আচ্ছা দেখছি... 

একতলার যে ঘরে সকলে বসেছিল সেখানে প্রবেশ করে দীপক প্রশ্ন করল—আচ্ছা, আপনাদের মধ্যে কে সর্বপ্রথম মৃতের ঘরে প্রবেশ করেছিলেন ? 

উত্তর দিল রায়সাহেব ঈশান মিত্রের ভাইপো অমল ৷ 

বলল—আমিই সর্বপ্রথম ওঁর চীৎকার শুনে ওঁর ঘরে প্রবেশ করেছিলাম ।

—আপনাকে ডাক্তারবাবু কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে চান। 

– বেশ, বলুন । 

ডাঃ লাহিড়ী অমলের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন— আপনি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে প্রথমে কি দেখতে পেলেন ? 

অমল বলল—মনে হলো মৃত্যুর আগে উনি কিছু বলতে চেয়েছিলেন। ঠোঁটদুটো বারকয়েক কেঁপে কেঁপে উঠেছিল শুধু । 

—তারপর ? 

—তারপরেই উনি ঢলে পড়েন ৷ আর কোন স্পন্দনই পাওয়া যায়নি । —বেশ, ওতেই চলবে । 

ডাক্তার লাহিড়ী যে ঘরে মৃতদেহ ছিল সেই ঘরখানার দিকে পা বাড়ালেন ৷ 

দীপকও তাঁর অনুগমন করবার আগে অমলের দিকে ফিরে প্রশ্ন করল— কোনও লোক বাড়ি থেকে বের হয়নি তো ? 

—না। আমি, অশোক, বিনয়, শঙ্কর, কাকা, নতুন কাকীমা, নতুন কাকীমার ভাই অবনীবাবু, ঝি, চাকর ইত্যাদি আর অতিথিরা সকলে নিচের ঘরে আছেন ।

—খুনের সময় যাঁরা যাঁরা বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন পুলিস তাঁদের সকলের সঙ্গেই হয়ত দেখা করতে চাইবে। কাজেই .. 

-বুঝেছি। 

—আর একটা কথা, অমলবাবু 

-কি কথা বলুন । 

—যদি এই ব্যাপারের তদন্ত করতে করতে কোনও বিশ্রী অথবা স্ক্যাণ্ডেলাস ব্যাপার বের হয়ে পড়ে, অথবা পরিবারেরই কোনও লোক এই খুনের সঙ্গে যুক্ত বলে প্রমাণিত হয়, তবে তাকে আইনের হাত থেকে বাঁচাতে পারব না । 

পাশে দাঁড়িয়েছিল অমলের ভাই অশোক সে বাধা দিয়ে বলল—তাতে আপত্তি নেই দীপকদা। দীর্ঘ দু'বছর যিনি এই সংসারের হাল দৃঢ়মুষ্টিতে ধরেছিলেন, যাঁর নিপুণ যত্নে আমরা কোনও কষ্ট, কোনও অভাব বুঝতে পারিনি, তাঁকে যে এভাবে হত্যা করতে পারে তার উপযুক্ত শাস্তি পাওয়াই উচিত । 

দীপক কোনও কথা না বলে চলল উপরের ঘরের উদ্দেশ্যে। 


– তিন–

ডাঃ লাহিড়ী বেশ কিছুটা চিন্তা না করে কখনও নিজের মতামত প্ৰকাশ করতে চান না । 

দীপক চুপ করে দাঁড়িয়েছিল তাঁর পাশে । সমস্ত দেহটা বেশ ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে তিনি বললেন—তোমার কল্পনাটা মিথ্যা নয় দীপক ৷ 

—অর্থাৎ? 

—সাধারণ লোকে এটাকে হার্টফেল বলে ভুল করতে পারে, কিন্তু ব্যাপারটা তা নয় । 

— আসল রহস্যটা তবে কি ? 

—এই যে পিঠের দিকে তিনটে সরু সরু ছুঁচ ফোটার চিহ্ন দেখতে পাচ্ছো ? 

-হ্যাঁ। 

—এই দেখ এই ক্ষতের মুখে তিনটি রক্তের বিন্দু জমাট বেঁধে আছে । —এটাই কি হত্যাকাণ্ডের আসল রহস্য ? 

আপাততঃ মনে হচ্ছে তাই । বোধ হয় সরু ছুঁচের মতো যন্ত্রের আগায় তীব্র অর্গ্যানিক বিষ মাখিয়ে ওর শরীরে তা ফুটিয়ে দেওয়া হয় আর তাতেই ওঁর মৃত্যু ঘটেছে। 

ঘটেছে। অবশ্য আমি এখনও নিঃসন্দেহ নই। তাই লাস মর্গে পাঠান উচিত । আশা করি পুলিস এসেই সে ব্যবস্থা করবে। 

—হ্যাঁ, পুলিসেও সংবাদ দিয়েছি আমি । স্থানীয় থানার দারোগা ভজহরিবাবু আমার বন্ধু । তিনি এক্ষুনি এসে পড়বেন ।  

ঘরের কোনও জিনিসপত্রে হাত না দিয়ে ওরা দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন । 

ঈশান মিত্রের বাড়িতে পা দিয়েই যে জিনিসটা ভজহরিবাবুকে অবাক্ করল তা হচ্ছে বাড়িখানার থমথমে গাম্ভীর্য । সামান্য কিছু আগে যে এখানে একটা আনন্দকোলাহলময় ঘটনা ঘটেছিল তার সামান্য রেশও এখন আর কোথাও পাওয়া যায় না । 

ড্রইংরুমে পা দেবার আগেই তাঁর দেখা হলো দীপকের সাথে । 

--এই যে মিঃ চ্যাটার্জী, তারপর খবর কি বলুন ! 

—ওপরের ঘরে ঘটনাটা ঘটেছে। চলুন ওদিকে যাওয়া যাক । হ্যাঁ, ইনি হচ্ছেন ডাঃ লাহিড়ী। এঁর অভিমত হচ্ছে যে মনোরমা দেবীর দেহে অর্গ্যানিক বিষ ফুটিয়ে দিয়ে ওঁকে হত্যা করা হয়েছে । আর মৃত্যুটাও একটা নিকষকালো রহস্ত যবনিকার আড়ালে এমনভাবে ঘটে গেছে যে আমরা বিন্দুবিসর্গও টের পাইনি ৷ 

ভজহরিবাবু বললেন--আচ্ছা, এ ব্যাপারের কিনারা করবার জন্যে আপনার সাহায্য কি আমি পেতে পারি দীপকবাবু ? 

দীপক বলল—না, আমি আমার নিজের ধারায় তদন্ত করে যাব, ভজহরিবাবু। তবে শেষ মুহূর্তে আপনার সাহায্য আমার অবশ্যই প্রয়োজন হবে । যাক, চলুন আমরা আগে যে স্থানে হত্যাকাণ্ডটা অনুষ্ঠিত হয়েছে সেই অকুস্থলটা দেখে আসি। তারপর এই ঘরে বসে প্রত্যেককে পৃথক্ পৃথক্ ভাবে প্রশ্ন করতে হবে। সকলকে এক জায়গায় নিয়ে এলোমেলো প্রশ্ন করলে চলবে না, ভজহরিবাবু। 

ভজহরিবাবু বললেন—হ্যাঁ, তা ত বটেই। বেশ চলুন, যে ঘরে হত্যাকাণ্ডটা সংঘটিত হয়েছে সেখানে যাই । 

যে ঘরে মনোরমার মৃতদেহটা রাখা ছিল সেটা আকারে খুব বড় নয়। একটা চাদর দিয়ে মনোরমার সারাদেহ আবৃত ছিল। দীপক এক মিনিট ভেবে প্ৰশ্ন করল—আচ্ছা, উনি চীৎকার করে ওঠবার পর আশা করি ঘরের কোনও জিনিসই সরানো হয়নি ? 

দীপকের সঙ্গে বিনয় এবং অমলও এসেছিল ঘরের মধ্যে। অমল বলল- না দীপকবাবু। চীৎকার শুনে আমিই সর্বপ্রথম ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছিলাম । কিন্তু আমি কোনও জিনিসই নাড়াচাড়া করিনি। আমার পর যারা এসেছিলেন তাঁরা কেউ কোনও জিনিস নাড়াচাড়া করেননি । 

দীপক ভাল করে ঘরের চারদিকে চেয়ে দেখল । জিনিসপত্র কোনও কিছুই অগোছাল অবস্থায় নেই । মনোরমা দেবী মৃত্যুর পূর্বে অথবা আহত হবার পূর্বে খুনীর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেছিলেন এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া গেল না । মনোরমা দেবী যে বইখানা পড়ছিলেন সেটা ছিল টেবিলের ওপর উল্‌টানো অবস্থায়। 

ঘরের সমস্ত স্থান তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোন সূত্র মিলল না। দীপক ভজহরিবাবুর দিকে চেয়ে বলল—নিশ্চয়ই ওঁর কোন অতিপরিচিত ব্যক্তি ওঁকে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করেছিল। 

-সেকি ? 

—হ্যাঁ, উনি আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হয়ে এমন হতভম্ব হয়ে যান যে, আত্মরক্ষা করবার কোনও চেষ্টাই করেননি। তার কারণ এই যে, যে লোক ওঁ কে খুন করেছে সে যে খুন করতে পারে এ ধারণাই মনোরমা দেবীর কল্পনায় স্থান পায়নি । 

ভজহরিবাবু কোনও উত্তর দিলেন না। 

দীপক এবার ঘরের মেঝের দিকে দৃষ্টি দিল । সমস্ত মেঝেটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখল সে। কোথাও কোনও জিনিসের অস্তিত্ব চোখে পড়ল না তার। হঠাৎ ঘরের এককোণে ঠিক ইনজেকসনের ভাঙ্গা এম্পুলের মত কি একটা জিনিস দেখতে পেয়ে সেটা তুলে নিয়ে পকেটে রাখল দীপক । 

ভজহরিবাবু বললেন— ওটা কি দীপকবাবু ? 

দীপক বলল—এখনও ঠিক জানতে পারিনি। জানতে পারলে পরে আপনাকে অবশ্যই জানাব ৷ 

দীপক হঠাৎ অমলের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল- আচ্ছা, এ বাড়িতে সায়েন্স স্ট ডেণ্ট অর্থাৎ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করে এমন কে আছে ? 

অমল বলল—একমাত্র বিনয়দা বিজ্ঞান নিয়ে কিছু কিছু পড়াশুনো করেন। নিচের তলায় লাইব্রেরী ঘরে আগে বৈজ্ঞানিক বিষয়ের কোনও বই ছিল না । বিনয়দাই প্রথম পদার্থ ও রসায়নবিদ্যার অনেকগুলি বই কিনে এনে লাইব্রেরীতে রেখেছেন । 

দীপক কোনও উত্তর দিল না। শুধু বলল—লাসটা এক্ষুনি মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন ভজহরিবাবু । 

ভজহরিবাবু বললেন— আচ্ছা। চলুন যাওয়া যাক্ এখান থেকে । পরে সব ব্যবস্থা করছি। 

দীপক বলল—না, আঘাতের স্থানটা একবার দেখতে হবে । নিশ্চয়ই অত্যন্ত শক্তিশালী কোনও বিষের সাহায্যে ওঁর মৃত্যু ঘটানো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। 

ভজহরিবাবু বলেন—সে কথা স্বীকার করতে আমি বাধ্য। আহত হবার পর মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ওঁর মৃত্যু ঘটেছে। 

দীপক হেসে বলল –তাহলে বুঝতে পারছেন ভজহরিবাবু, যে আততায়ীর টক্সিকোলজি অর্থাৎ বিষসংক্রান্ত রসায়ন সম্বন্ধে কতো নিখুঁত জ্ঞান রয়েছে ! 

—সে ত বটেই। কিন্তু ওর থেকে আপনি কি ডিডাক্‌শন করছেন ? 

দীপক হেসে বলল—কিছুই না। চলুন আমরা পাশের ঘরে যাই । সকলের আগে অমলবাবুই আমাদের সঙ্গে আসুন । গোটাকয়েক কথা আপনাকে প্রথমে জিজ্ঞাসা করব, কারণ আপনিই প্রথম মৃতদেহ দেখতে পান । 


- চার - 

দীপক আর ভজহরিবাবু পাশাপাশি বসে অমলকে প্রথমে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। ভজহরিবাবু গোটাকতক সাধারণ প্রশ্ন করবার পর দীপক অমলের দিকে চেয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করল—আচ্ছা, আপনি কি বলতে পারেন কাল যখন শব্দ শুনে আপনি ছুটে যান তখন বিনয়বাবু কোথায় ছিলেন ? 

অমল একটু ভেবে বলল—বিনয়দা তখন বোধ হয় নিচের হলঘরে ছিলেন । তবে সেটা আমি আন্দাজে বলছি । আমি কুড়ি মিনিট আগে ওঁকে অবশ্য হলঘরে দেখেছিলাম । তবে সেই সময় উনি কোথায় ছিলেন তা আমি ঠিক করে বলতে পারি না । 

দীপক বলল—আচ্ছা, আর একটা প্রশ্ন করছি, যদিও সেটা একটু অন্য ধরনের হবে। আপনার কাকার এই দ্বিতীয়বার বিয়েতে কি মনোরমা দেবী খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন ? 

-তা কিছুটা হয়েছিলেন বৈকি 

—কারণ ? 

—শঙ্করকে তিনি নিজের ছেলের মতোই ভালবাসতেন । তার কথা চিন্তা করে আর বিনতা কাকীমার কথা ভেবেই তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি । 

-বুঝেছি। আচ্ছা, কিছুদিন আগে আপনি মনোরমা দেবীর প্রতি কিছুটা আসক্ত হন বলে শুনেছি। সে কথাটা কতদূর সত্যি ? অবশ্য এই ‘পার্সোন্যাল' কথাটা আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে আমি বাধ্য হচ্ছি বিশেষ একটা কারণেই। 

সামলে নিয়ে বলল—দেখুন দীপকবাবু, মানুষমাত্রেরই মনে তার সাধারণ প্রবৃত্তি- গুলো থাকবেই । উপযুক্ত বয়সেও যখন আমার বিয়ে দেবেন না বলে মামা স্থির করলেন, তখন মাঝে মাঝে সামান্য একটু স্ফূর্তির জন্যে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলা- মেশাটাকে আপনি খারাপ নজরে দেখতে পারেন না ! 

দীপক বলল—না, মাপানাসক্ত ও চরিত্রহীন লোকদের আমি ঘৃণা করি বিনয়বাবু । আমার মনে হয় মানুষ ইচ্ছা করলেই নিজের মনোমত নিজেকে পরিচালিত করতে পারে। এই যে অত্যন্ত অল্পদিন হলো কুসংসর্গে পড়ে আপনি বিপথগামী হতে চলেছেন, এতে আপনার সমস্ত সদগুণের মূলে কালিমা লেপিত হচ্ছে না কি ? 

বিনয় কোনও উত্তর না দিয়ে মুখ নিচু করল । 

দীপক প্রশ্ন করল—আচ্ছা, ঈশানবাবু যে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন, তাতে কি আপনি তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছিলেন ? 

বিনয় বলল—শুধু আমি নয়, অশোক, অমল, মৃতা মনোরমা,—সকলেই এই ব্যাপারটাতে কমবেশি অসন্তুষ্ট হয়েছিল । 

-আচ্ছা, আপনি বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করছেন কতদিন? 

—গবেষণা বললে ভুল হবে—শুধু স্টাডি । তা প্রায় বছর তিন চারের কম নয় । 

-আপনি ইউনিভার্সিটি জীবনে ছিলেন আর্টস স্টুডেন্ট, কিন্তু এভাবে প্রাইভেটলি সায়েন্স মানে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করছিলেন কেন ? 

—এটাকে আমার 'হবি' মানে খেয়াল বলতে পারেন । 

—মনোরমা দেবীকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে তা আপনি জানেন ? 

—ডাক্তার ত তাই বললেন । 

—যদি বলি সেই বিষটার প্রয়োগব্যাপারে আপনার হাত ছিল ? মানে এ বাড়িতে ত আর কেউ বৈজ্ঞানিক ব্যাপারে ততটা ওয়াকিবহাল নয় । 

-কিন্তু আমার কি স্বার্থ ছিল যে মনোরমাকে আমি বিষপ্রয়োগ করতে যাব ? বিনা কারণে এতবড়ো একটা ক্রাইম কোনও সুস্থমস্তিষ্ক মানুষই করতে পারে না, দীপকবাবু। আর আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধে আশা করি আপনার সন্দেহের অবকাশ নেই । 

—ও কথা বাদ দিন বিনয়বাবু। বাড়ির কারো সঙ্গে কি সম্প্রতি মনোরমা দেবীর কোনও মনোমালিন্য হয়েছিল বলে স্মরণ হয় আপনার ? 

একটু চিন্তা করে বিনয় বলল – না, সে রকম কারও কথাই ত স্মরণ হয় না । তবে একটা কথা শুধু যেন একটু মনে পড়ছে। নতুন মামীমা ত কাল মাত্র এ বাড়িতে এসেছেন। আর আজ হচ্ছিল বৌভাতের উৎসব । কিন্তু আজ সকালে যেন কি একটা ব্যাপার নিয়ে নতুন মামীমার সঙ্গে ওঁর সামান্য একটু. তর্কবিতর্ক হয়েছিল। অবশ্য ব্যাপারটা তত সাংঘাতিক কিছু নয়। কি ব্যাপার উপলক্ষ করে এই গোলযোগ ঘটে তাও আমি জানতে পারিনি। 

– আর কেউ কি এ সম্বন্ধে বলতে পারে ? 

—এ কথাও মামীমা ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। 

—আচ্ছা, যখন হত্যাকাণ্ডটা সংঘটিত হয়, তখন মায়া দেবী কোথায় ছিলেন তা কি জানেন আপনি ? 

—উনি যে ঘরে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার পাশের ঘরে সেলাই, মানে এমব্রয়ডারী নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। 

—চীৎকার শুনে তিনি ছুটে যাননি ? 

—হ্যাঁ, অমলের পরেই তিনি ছুটে এসেছিলেন। 

—আচ্ছা, অমলবাবুকে আপনার কি রকম মনে হয় ? 

—কেন ? মোটামুটি ভালই লাগে ওকে । 

—সে কথা নয় । তাঁর সঙ্গে কিছুদিন আগে মনোরমা দেবীর যে বিয়ের কথা হচ্ছিল সেই ব্যাপারের কথা বলছি । 

—সেটা এমন কিছু নয় ! মামার অমত ছিল বলে বিয়েটা ঘটে ওঠেনি, এই আমি জানি । 

—মায়া দেবীর ভাই অবনীবাবু তখন কোথায় ছিলেন ? 

—তিনি বললেন যে তিনি নিচের লাইব্রেরী ঘরে ছিলেন। তাঁর আসতে তাই একটু দেরী হয়েছিল । 

—আচ্ছা, আপনাকে আর কোনও প্রশ্ন করতে চাই না বিনয়বাবু। যদি কোনও প্রয়োজন থাকে পরে জিজ্ঞাসা করব । এখন শুধু মায়া দেবী আর অবনীবাবুকে গোটা কয়েক প্রশ্ন করেই আমার কাজ শেষ আজকের মত । প্রথমে আপনি মায়া দেবীকে পাঠিয়ে দিন, গোটা কয়েক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব তাঁকে। 

বিনয় ঘাড় নেড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল । 

দীপক ওর গমনপথের দিকে চেয়ে আপন মনেই বলে—এদের মধ্যে কে যে সত্যিকারের হত্যাকারী তা খুঁজে বের করা সত্যিই দুরূহ। 

ভজহরিবাবু দীপকের কথা শুনে মৃদু হেসে ওঠেন । 


–পাঁচ – 

মায়া দেবী যে সুন্দরী এ কথাটা দীপক তাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিল। তবে ঠিক সাম্নাসামনি তার সঙ্গে কথা বলবার সৌভাগ্য দীপকের হয়নি । এখন তাকে দেখে দীপকের এই কথাই মনে হলো যে সাধারণ কথায় সুন্দরী বললে মায়া দেবীর প্রতি অবিচার করা হয়। মায়া দেবী অপরূপ রূপলাবণ্যবতী।

মায়া দেবী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে নমস্কার করে আসন গ্রহণ করল । তার চেহারা দেখে মনে হয় যে কিছুক্ষণ আগেও সে কেঁদেছে । চোখ- দুটো ঈষৎ ফোলা । 

দীপক মায়া দেবীর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল—মনোরমা দেবীর সঙ্গে আপনার কি পরিচয় হয়েছিল ? 

মায়া দেবী গম্ভীরভাবে বলল—যে রকম সাধারণভাবে হয়ে থাকে ঠিক সেই রকমই । 

—মনোরমা দেবীকে আপনার কি রকম মনে হয় ? 

—বাইরে থেকে তাঁকে যত সহজ ও সাধারণ বলে মনে হয়, আসলে তিনি তত সহজ ও সাধারণ ছিলেন না। 

—এ কথার অর্থ? 

—এর বেশী আমি বলতে পারব না দীপকবাবু।

—আচ্ছা থাক । আপনার মনে অযথা কষ্ট দিতে চাই না আমি । শুধু -একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই। 

–কি কথা বলুন । 

—আজ সকালে মনোরমা দেবীর সঙ্গে আপনার একটু মতান্তর ঘটেছিল বলে শুনলাম । সেটা ঠিক কি ব্যাপার নিয়ে তা জানতে পারি কি ? 

মায়া দেবী কোনও উত্তর দিল না । 

দীপক বলল—এ কথাটার উপরে আমি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছি মায়া দেবী ৷ 

মায়৷ দেবী হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাড়াল। একটু থেমে হঠাৎ সজোরে বলে উঠল—আমিই মনোরমা দেবীকে হত্যা করেছি, দীপকবাবু। আপনি আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলুন। 

—আপনি ? 

দীপক আর ভজহরিবাবু একসঙ্গে বলে ওঠে। 

—হ্যা। আমি—আমিই তাকে হত্যা করেছি। আমি নিজমুখে এ কথা স্বীকার করছি। 

ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হলেও বোধ হয় তারা অতটা চমকে উঠত কি না সন্দেহ । —কিন্তু আপনার এতে ত কোনও স্বার্থ নেই মায়া দেবী। দীপক একটু ভেবে কথাটা বলে উঠল। — তা ছাড়া সবে এখানে পা দিয়ে আপনি এমন একটা কাজ কখনও করতে পারেন না ৷ 

-এর বেশি আর কিছু বলতে চাই না আমি। কিছু না... 

কথাটা বলে এক ঝলক হলকা হাওয়ার মত ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মায়া দেবী। বিপুল উত্তেজনায় তার সারা দেহটা তখন যেন ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছিল । 

দীপক আর ভজহরিবাবু অবাক হয়ে পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকে। দীপক শুধু বলে—আশ্চর্য! 

জীবনে নানা ধরনের অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে দীপককে, কিন্তু এ ধরনের ঘটনা বোধ হয় এই প্রথম। এই আকস্মিক ঘটনাবলীর সম্মুখীন হয়ে সে প্রথমটা থতমত খেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু একটু থেমে আপন মনে কি সৰ-কথা চিন্তা করে দীপক ভজহরিবাবুর দিকে চেয়ে বলল—উনি যে মিথ্যা কথা বললেন, এ সম্বন্ধে আমি স্থিরনিশ্চয় ভজহরিবাবু । 

–কেন? 

—অন্য কাউকে খুনের দায় থেকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যে। 

—কিন্তু আসল খুনী কে ? 

—তা এখনও বুঝতে পারিনি। তবে অল্পদিনের মধ্যেই যে পারব সে আশা রাখি । 

—কিন্তু আপনি কি করে বুঝলেন যে মায়া দেবী নির্দোষ ? 

—বিনয়বাবুর কথা থেকে।

– সেকি ? 

—হ্যাঁ, বিনয়বাবু বলেছেন যে যখন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তখন মায়া দেবী পাশের ঘরে সেলাই নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তা ছাড়া সবে এখানে পা দিয়েই এমন কিছু ঘটতে পারে না, যা থেকে... 

—তা বটে । 

—তা ছাড়া আরও একটা কথা আছে । 

—কি ব্যাপার ? 

—এত দ্রুত পরিকল্পনা করে, বিষ জোগাড় করে, সেই বিষ মনোরমা দেবীর দেহে সঞ্চালিত করবার মত যন্ত্রের ব্যবস্থা করে, ঠিক সময়ে ওঁকে হত্যা করে, তারপর সেলাই নিয়ে বসতে গেলে যে পরিমাণ শক্তিশালী নার্ভএর প্রয়োজন তা ছিল না মায়া দেবীর। আর, কোনও নারীর দ্বারা এটা সংঘটিত হয়েছে বলে আমার ধারণা হয় না । 

—তবে উনি এভাবে স্বীকারোক্তি করলেন কেন ? 

—বললাম ত কোনও একজনকে খুনের দায় থেকে বাঁচাবার জন্যে । 

—কিন্তু বিনয় বা অমল বা ওঁর ভাই অবনীবাবু যেই খুনী হোক না কেন, তাকে বাঁচাবার জন্যে উনি এভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবেন, এটাই বা আপনি এত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছেন কেন ? 

—ঘটনাপরম্পরা আমাকে এ কথা বিশ্বাস করতেই বাধ্য করছে ভজহরিবাবু। কিন্তু অমল বা বিনয়ের জন্যে মায়া দেবী এভাবে স্বার্থত্যাগ করবেন বলে মনে হয় না । ওঁরা দুজনেই ঈশানবাবুর এই দ্বিতীয়বার বিবাহকে সুনজরে দেখেন- নি। সুতরাং এবার অবনীবাবুর উপরে সন্দেহটা গিয়ে পড়া স্বাভাবিক । 

—কিন্তু অবনীবাবু হঠাৎ মনোরমা দেবীকে হত্যা করতে যাবেন কেন ? সে রকম কোনও স্বার্থ ত ওঁর ছিল না । আর সুস্পষ্ট কোনও 'মোটিভ' ছাড়া কেউ খুন করে না। 

—এ কথা আমি জানি । 

—তবে ? 

—সেটাই আমাদের বের করতে হবে। অবনীবাবুকে এখুনি এখানে ডেকে আনার ব্যবস্থা করুন। কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই তাঁকে । 

—বেশ। আমি কিন্তু স্যার এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, অবনীবাবু এই খুন করতে পারেন । 

অবনীবাবু সম্বন্ধে সংক্ষেপে একটা কথাই বলা যায় যে, তিনি অত্যন্ত চাপা ধরনের লোক। সাধারণভাবে কোনও প্রশ্ন করেই তাঁর কাছ থেকে মামুলী উত্তর ছাড়া অন্য কোনও কথা বের করা গেল না। 

অবশেষে কিছুক্ষণ চিন্তা করে দীপক বলল—আপনার বোন মায়া দেবী নিজেকে খুনী বলে স্বীকার করেছেন । 

-সে কি ?—আকস্মিক এই কথাটা শুনে অবনীবাবু অদ্ভুতভাবে চমকে উঠলেন। দীপক এই সুযোগেরই প্রতীক্ষা করছিল। সে এবার বলল—কিন্তু তিনি খুনী বলে আমাদের মনে হয় না আদৌ। আমরা মনে করি যে খুন করেছে তাকে রক্ষা করবার জন্যেই উনি এই মিথ্যা কথাটা বলেছেন । অর্থাৎ উনি চান না যে খুনী ধরা পড় ক এবং তার ফাঁসি হোক । 

—কিন্তু খুনী কে ? 

-যাকে বাঁচাবার জন্যে মায়া দেবী নিজেকে বিপন্ন করতে পারেন, এমন একজন নিশ্চয়ই। 

—আমি ত কিছুই বুঝতে পারছি না, দীপকবাবু । 

—খুনের সময় আপনি কোথায় ছিলেন? 

—সে সময় আমি কোথায় ছিলাম ঠিক মনে নেই । 

—মিথ্যা কথা ৷ 

—বিশ্বাস করুন দীপকবাবু । বোধ হয় মায়াকে কি একটা কথা বলবার জন্যে আমি দোতলায় তাকে খুঁজতে যাই । 

—এটাও অবিশ্বাসযোগ্য কথা হলো। দেখুন অবনীবাবু, আপনি সত্যি কথা না বললেও, আমরা তা বের করতে সক্ষম হবই। অনর্থক খানিকটা দেরি করিয়ে আমাদের তদন্তের পথে বাধার সৃষ্টি করে কোনও লাভ নেই আপনার । 

—বিশ্বাস করুন, আমি খুনের ব্যাপারে যা বলেছি তার চেয়ে একবর্ণও বেশী জানি না । 

—বেশ, আপনি যখন বলবেন না আর কিছু তখন কি করব! এর ফলে আপনি নিজের বিপদকেই বাড়িয়ে তুলছেন। চলি আজকের মত ৷ আশা করি আপনি নিজে চিন্তা করে পরে সব কথা আমাদের খুলে বলবেন। 

দীপক আর কোনও কথা না বলে উঠে দাড়ায় বাড়ির দিকে রওনা হবার উদ্দেশ্য নিয়ে । 


-ছয়-

সেদিন বাড়ি ফিরেই দীপক সর্বপ্রথমে তার ল্যাবরেটরীতে গিয়ে উপস্থিত হলো। জরুরী প্রয়োজন হতে পারে ভেবে দীপক বাড়ির কোণে ছোট একটা ঘরে তার নিজের ব্যবহারের জন্যে একটা ল্যাবরেটরী করেছিল। তাতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সব থাকত । দীপক তখুনি সেই সব যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে গেল কাজ করতে । আধঘণ্টা পরে সে যখন ল্যাবরেটরী থেকে বের হলো, তখন তার মুখে ফুটে উঠেছে সফলতার হাসি। যেঅ্যাম্পুলের মত জিনিসটা সে কুড়িয়ে পেয়েছিল তাতে শুধু খানিকটা ‘ডিস্‌টিল্ড ওয়াটার' ছিল। কোনও বিষের নামগন্ধও নেই ওতে । ওটা ওখানে রাখা ছিল শুধু পুলিসকে ভ্রান্তপথে চালনা করবার উদ্দেশ্যেই । আসল বিষ পূর্ব থেকেই ব্যবস্থা করে অন্যত্র রাখা ছিল। 

এবার দীপকের তদন্তের পথ অনেকটা সহজ হয়ে এলো। এটা অবশ্যই সাময়িক উত্তেজনার বশে খুন নয়। অনেক আগেই এই হত্যার জন্যে প্ল্যান করা হয়েছিল। তারপর সুযোগমত কাজটি সংঘটিত হয়েছে। 

কিন্তু কে এই হত্যাকারী ? 

বিভিন্ন চিন্তা এসে পর পর দীপককে বিভ্রান্ত করে তুলতে লাগল । সামনে বিরাট অন্ধকার । তার মধ্যে সামান্য একটি মাত্র আলোকের রেখা শুধু দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাও অস্পষ্ট, ক্ষীণ । 

ক্রিং ক্রিং ক্রিং... 

টেলিফোনের সরব আর্তনাদ দীপকের চিন্তায় বাধার সৃষ্টি করল। 

—হ্যালো, কে ? 

—আমি, ভজহরি কথা বলছি। আপনিই ত মিঃ চ্যাটার্জী ? 

—হ্যাঁ। কিন্তু হঠাৎ আবার এ ধরনের আহ্বান কেন ? নতুন কোনও খবর-টবর নাকি ? 

—ঠিক ধরেছেন ত ! 

—বোধ হয় পুলিস মর্গের রিপোর্ট ? 

—আরে আশ্চর্য ত ! আপনিই যদি সব বলে ফেলবেন তবে আমি আর বলব কি ? 

—এটা এমন কিছু কঠিন নয়, ভজহরিবাবু । এখন আপনার কাছে নতুন খবর আসবার একমাত্র পথ খোলা আছে পুলিস মর্গ । এ ছাড়া আর কোনও পথই ত খোলা নেই আপনার সামনে । 

—ঠিক তাই। মর্গের রিপোর্টে অদ্ভুত একটা জিনিস জানতে পারলাম আমরা । মনোরমা দেবীর মৃত্যুর কারণ ওই ক্ষতস্থানের মুখে কোনও বিষ- প্রয়োগের ফলে নয় ৷ 

—সেকি ? এতটা আমি অবশ্যই আশা করতে পারিনি। তা হলে ওঁর মৃত্যুর কারণটা কি ? 

—ওঁর খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই বিষেই ওঁর মৃত্যু হয়েছে। ওঁর পেটে সেই বিষ পাওয়া গেছে । 

—মৃত্যুর পূর্বে উনি যে চীৎকার করে উঠেছিলেন ! 

—সেটা অবশ্যই সম্ভব । মৃত্যুর পূর্বে বোধ হয় আততায়ী তাঁর পিঠে ছুঁচ বিধিয়ে দিয়ে এবং একটা কাঁচের অ্যাম্পুল ঘরের কোণে ফেলে পুলিসকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। আর তাতে বিনয়বাবুর উপরেই সন্দেহটা গিয়ে পড়ে বেশী—কারণ উনি ছিলেন বাড়ির মধ্যে একমাত্র বিজ্ঞান-জানা লোক ৷ 

—কিন্তু এতটা প্ল্যান করে যে খুন করতে পারে তার বুদ্ধির তীক্ষ্ণতার কথা ভেবে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। 

—হ্যাঁ, আরও একটা খবর মর্গে পোস্ট-মর্টে মের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে। সেটা হচ্ছে এই যে, মৃত্যুর সময় উনি গর্ভবতী ছিলেন । 

– সেকি ? 

—হ্যাঁ, ‘ক্যারিয়িং ফর্ ফাইভ মাস' । ওঁর তখন পাঁচ মাস চলছিল । —কিন্তু এটা ত অবৈধ । 

-তা ত বটেই । আর সেই জন্যেই অমলবাবুর উপরে সন্দেহটা গিয়ে পড়ছে এবার । ওঁর কাকা বলেছিলেন যে মনোরমা দেবীকে উনি যদি বিয়ে করেন, তা হলে কাকার সম্পত্তি থেকে উনি সম্পূর্ণ বঞ্চিত হবেন । 

—সে কথা ত জানি ৷ 

—আমার মনে হয় তার পূর্বেই বোধ হয় মনোরমা দেবী গর্ভবতী হয়ে পড়েন। উনি ইতিপূর্বে বোধ হয় তা জানতে পারেননি । পরে জানতে পেরে উনি মনোরমা দেবীকে হত্যা করে নিষ্কণ্টক হতে চাইলেন । 

—নট্‌ আলাইকুলি ! অসম্ভব কিছু নয়। 

—এদিকে ব্যাপারটা বের হয়ে যেতে পারে ভেবে উনি ছুঁচের আগায় বিষ ইত্যাদির অবতারণা করে এবং ঘরের কোণে অ্যাম্পুল ফেলে পুলিসকে বিভ্রান্ত করবার চেষ্টা করলেন । এর ফলে সন্দেহটা গিয়ে পড়বে বিনয়বাবুর ওপর । 

—কিন্তু আমি ভাবছি আর একটা কথা, ভজহরিবাবু। 

– কি কথা, বলুন । 

—মায়া দেবী হঠাৎ নিজেকে খুনী বলে স্বীকার করলেন কেন ? 

—সেটাই ত প্ৰশ্ন । অমলবাবুর প্রতি হঠাৎ ওঁর এতটা আকর্ষণের কারণ কি হতে পারে ? 

—সেটা এখনও বুঝতে পারিনি । 

—আমার মনে হচ্ছে কোথাও বোধ হয় বিরাট একটা গলদ রয়ে গেছে। কিন্তু কোথায় যে গলদটা তা আমরা ঠিক ধরতে পারছি না! 

—হয়ত সেটা সম্ভব । কিন্তু এমনও ত হতে পারে যে অমলবাবুকে মায়া দেবী খুব স্নেহ করেন এবং... 

—খুব বেশী সম্ভব নয়। আমি ত যতটা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে অমল- বাবু মায়া দেবীকে খুব সুনজরে দেখেন না। ঈশানবাবুর এই দ্বিতীয়বার বিয়ে তিনি সুনজরে দেখেননি। আর তাঁর মনোভাবটা এখনও পূর্ণমাত্রায় রয়েছে । 

-আর একটা জিনিসও অবশ্য সম্ভব। 

–কি ব্যাপার ? 

—মায়া দেবী হয়ত কোনও কারণে ধারণা করেছিলেন যে তাঁর ভাই অবনীবাবুই খুনী । তাই ভাইকে বাঁচাবার জন্যে : 

-কিন্তু মায়া দেবী কি মনোরমা দেবীর ওই গর্ভের কথা জানতেন বলে 

মনে হয় আপনার ? 

—হতে পারে । 

—তবে তিনি অবনীবাবুকে খুনী বলে ভাববেন কেন ? অবনীবাবু ত এ বাড়িতে পা দিয়েছেন বড় জোর দু'মাস । বিয়ের আগে তিনি কখনও এ বাড়িতে যাননি । কিন্তু মনোরমা দেবী পাচ মাস পূর্বে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। 

—আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে, দীপকবাবু । আই অ্যাম্‌ অ্যাট্ এ লস্ । কিছুই ঠিকমত বুঝতে পারছি না । 

—তবে এক কাজ করুন না কেন। চলুন দুজনেই ঈশান মিত্রের বাড়িতে গিয়ে ওঁদের জিজ্ঞাসা করি ওঁরা কেউ এ বিষয়ে কিছু জানতেন কিনা । আমার মনে হয়, স্থত্র যখন একটা পাওয়া গেছে, তখন শেষ ধাপে আমরা অবশ্যই পৌঁছতে পারব । 

—বেশ। আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি। আপনি এখানে এলে দুজনে একসঙ্গে বের হবে| রায়সাহেব ঈশান মিত্রের বাড়ির দিকে । 

দীপক রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দেয়। 

রিসিভারটা রেখে বাইরের ড্রইংরুমে নেমে আসে দীপক । 

সেদিনের ডাকে আগত চিঠিগুলো সেখানে টেবিলের ওপর পড়ে ছিল । 

চাকর ভজুয়াকে এক কাপ চা আনতে বলে দীপক চিঠিগুলোর ওপর মনঃসংযোগ করল। 

দু'তিনটে চিঠি পড়া হলে, একটা নীল খামের ভারী চিঠির ওপর দীপকের মনোযোগ আকৃষ্ট হলো ৷ 

টেবিলের ওপর থেকে চিঠিটা তুলে নিয়ে মুখটা ছিড়ে ফেলে দীপক দেখল চিঠিটা ইংরেজীতে লেখা। টাইপ করা। তার মর্মার্থ এইরূপ :— 

প্রিয় দীপকবাবু, 

আশা করি আপনার নিজের স্বার্থে ই আপনি রায়সাহেব ঈশান মিত্রের বাড়ির ঘটনা থেকে দূরে সরে দাড়াবেন । আপনার বুদ্ধি আছে স্বীকার করি, কিন্তু অতিবুদ্ধি ভাল নয় ৷ তা ছাড়া পারিবারিক ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে লাভ কি ? 

আপনি যদি এই কেস থেকে সরে দাঁড়ান তবে যথাসময়েই পাঁচশোটি টাকা ডাক মারফত আপনার হাতে গিয়ে পৌছবে। 

অন্যথায় আপনার জীবন বিপন্ন হতে পারে বলে আমার ধারণা । প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানবেন ৷ 

ইতি— 

আপনার কোনও শুভার্থী । 

চিঠিখানা পড়ে দীপক বিড়বিড় করে বলে—তা হলে অবশ্যই আমাকে এ ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করতে হবে। 

তখুনি সে মোটরে চড়ে বেরিয়ে পড়ে রায়সাহেব ঈশান মিত্রের বাড়ির উদ্দেশ্যে । 


– সাত -

অমল আর বিনয় বাইরের হলঘরে বসে নিজেদের মধ্যে কি যেন আলোচনা করছিল, এমন সময় দীপক গিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো। ভজহরিবাবুও এসেছিলেন তার সঙ্গে । 

দীপক অমলের দিকে চেয়ে বলল— অমলবাবু, আপনার সঙ্গে গোটা কয়েক প্রাইভেট কথা আছে । কোথায় গেলে কথাগুলো বলবার সুবিধে হবে ? 

অমল বলল—ওপাশের ঘরে চলুন। 

—বেশ। ভজহরিবাবু, আপনি এদিকে বিনয়বাবুর সঙ্গে কথাবার্তা বলুন । ভজহরিবাবুর কিন্তু একা থাকতে ভাল লাগছিল না। তিনি বললেন— আমিও আপনার সঙ্গে গেলে অসুবিধে হবে কি ? 

দীপক বলল—নিশ্চয়ই। বিনয়বাবুর সঙ্গে আপনার কি যেন গোটাকয়েক কথা আছে বলছিলেন। সেটা এখনই সেরে ফেলুন না । 

দীপকের ইঙ্গিত জেনে ভজহরিবাবু বললেন— হ্যাঁ, বিনয়বাবুর সঙ্গে কথাগুলো সেরে ফেলি। আপনি ততক্ষণে ওঁকে যে সব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন বললেন সেগুলো শেষ করুন। 

দীপক উঠে পাশের ঘরে চলে গেল অমলকে সঙ্গে নিয়ে। 

অমল বলল—আপনি যে আবার হঠাৎ ফিরে এলেন, মিঃ চ্যাটার্জী? দীপক বলল—একটা নতুন জিনিষ হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেললাম কিনা, তাই... অমল বলল—কি আবার আবিষ্কার করলেন আপনি ? 

—মনোরমা দেবীর মৃত্যুর কারণ তাঁর পিঠে যে আঘাত দেখা গেছে সেটা নয় । খাবারের সঙ্গে ইতিপূর্বে বিষ মিশিয়ে তাঁর মৃত্যুকে আসন্ন করে তোলা হয়েছিল । 

—আপনি কি করে জানলেন তা ? —পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট থেকে । 

—আশ্চর্য ত! 

—আশ্চর্য ত বটেই। আরও গোটাকয়েক আশ্চর্য খবর দিতে চাই আপনাকে অমলবাবু।

--বলুন । 

—প্রথম কথা, আপনার কাকীমা মায়া দেবী নিজমুখে স্বীকার করেছেন যে তিনিই নাকি মনোরমা দেবীকে খুন করেছেন। 

-সেকি ? 

—হ্যাঁ। এর মধ্যে এতটুকু অতিরঞ্জিত কিছু নেই । 

—কিন্তু কেন তিনি এভাবে খুন করতে যাবেন ? কি তাঁর স্বার্থ ? 

—সে কথার উত্তর তিনি দেননি। 

—আমি এটা বিশ্বাস করি না ৷ 

—বিশ্বাস না করবার কারণ ? ওঁর খাবারের সঙ্গে উনি ত অত্যন্ত সহজে বিষ প্রয়োগ করতে পারতেন । 

—কিন্তু ওঁরই বা কি স্বার্থ ? 

—অনেক কিছু হতে পারে। অতটা গভীর ভাবে চিন্তা করবার অবকাশ আমি পাইনি । কিছুদিন পূর্বে কি একটা বিষয় নিয়ে মনোরমা দেবীর সঙ্গে মায়া দেবীর মনোমালিন্য হয়েছিল না ? হয়ত সেটাই শেষ পর্যন্ত রেষারেষিতে পরিণত হয় এবং ক্রুদ্ধ হয়েই তিনি এভাবে মনোরমা দেবীকে হত্যা করেন। 

—কিন্তু এত সহজে হত্যা করা কি সম্ভব ? 

—অন্য কারণও থাকতে পারে । 

- যথা ? 

—পোস্ট মর্টেমের ফলে জানা গেছে যে মৃত্যুর সময়ে মনোরমা দেবী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন । 

—আশ্চর্য !—কথাটা অমল এমনভাবে বলল যে আকাশ থেকে বজ্ৰপাত হলেও সে বোধহয় এতটা চমকে উঠত না। 

— আপনি ত কিছুদিন পূর্বে মনোরমা দেবীকে বিয়ে করবেন বলে স্থির করেছিলেন। তাই নয় কি ? 

— হ্যাঁ। কিন্তু... 

—তারপরে হঠাৎ বিয়ে করলেন না কেন ? 

-সে অনেক কথা দীপকবাবু । সে সব কথা আমাদের আলোচনার বাইরে থাকা উচিত।  

—কিন্তু আমাদের প্রয়োজনের গণ্ডির মধ্যে সেটা এখন এসে পড়েছে অমলবাবু ৷ 

—সংক্ষেপে বলতে গেলে কাকার ঘোরতর আপত্তিই প্রধান কারণ। বিধবা-বিবাহে সমর্থন জানালে পরিবারের ঐতিহ্য বিনষ্ট হবে এই ধারণাই ছিল তাঁর মনে। তাই তিনি আপত্তি জানিয়ে বলেন যে, আমি যদি তাঁর না মানি এবং জোর করে বিয়ে করতে চাই, তা হলে আমি তাঁর কাছ থেকে আর কোন সাহায্যই জীবনে পাব না । 

—সেটা কতদিন আগে ? 

—প্রায় এক বছর। 

– তারপর কি মনোরমা দেবীর প্রতি আকর্ষণ আপনার কমে এসেছিল অমলবাবু ? 

-না। 

—তা হলে কাকার কথাটাই শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন কেন ? 

—সত্যি কথা বলতে গেলে, নিজের পায়ে দাড়াবার মত অর্থ উপার্জন করবার চেষ্টায় ছিলাম আমি। মনোরমা আমাকে পূর্বে কয়েকবার বলেছিল যে আমি যেন তাকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাই ৷ কিন্তু আমি তার সে কথা মেনে নিতে পারিনি। আমি বলেছিলাম যে, সাময়িক উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে এভাবে পালিয়ে না গিয়ে, কিছুদিন পরে উপযুক্ত অর্থ উপার্জন করবার ব্যবস্থা করে তারপরে আমরা অন্যত্র চলে যাব ৷ 

—কিন্তু এখন যদি প্রমাণিত হয় যে মনোরমা দেবী যে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন এবং অবশেষে যেভাবে প্রাণ হারিয়েছেন, তার জন্যে দায়ী হচ্ছেন আপনি ? 

অমল কোন উত্তর দিল না । 

দীপক বলে চলল—এ কথা ত আপনি স্বীকার করতে বাধ্য যে আপনি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। সাক্ষ্যপ্রমাণেও সেই কথাই স্বীকৃত হবে । আপনি ছাড়া অন্য কেউ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না । তারপর দেখুন, তিনি যে অবস্থায় পড়ে যেভাবে মৃত্যুবরণ করলেন, এতে আপনার উপরেই সন্দেহটা এসে পড়ে না কি ? 

—এর উত্তরে আমার কিছু বলবার নেই দীপকবাবু।

—কিছু না ? 

-না। 

—তা হলে আপনি স্বীকার করছেন যে আপনিই মনোরমা দেবীর হত্যার মূলে আছেন—অর্থাৎ আপনিই তাঁকে হত্যা করেছেন ? মনোরমা দেবীকে বিয়ে করবার ইচ্ছা আপনার আদৌ ছিল না । তিনি হঠাৎ যখন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লেন, তখন আপনি নিজের বিপদ বুঝতে পারেন । আপনি দেখলেন যে তাঁকে হত্যা করা ছাড়া আর কোনও উপায় আপনার নেই। কি বলেন অমলবাবু ? 

–হ্যাঁ, আমিই মনোরমাকে হত্যা করেছি : দীপকবাবু—আমিই তাকে হত্যা করেছি । 

কথাটা শেষ করে উত্তেজিতভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে অমল । তার সারা ভঙ্গির মধ্যে যেন বিশ্বের ব্যর্থতা পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে। চোখদুটো তার অশ্রুভারে টলমল করতে থাকে । 

অমলের দিকে চেয়ে দীপকের ঠোঁটে ফুটে ওঠে অদ্ভুত একটা রহস্তের হাসি । 

বিনয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ভজহরিবাবুর। 

ভজহরিবাবু কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে কি যেন সব চিন্তা করছিলেন। হঠাৎ বিনয়ই তাঁকে প্রথমে প্রশ্ন করে বসল – আপনি এই খুনের তদন্ত ব্যাপারে কতদূর অগ্রসর হলেন ভজহরিবাবু ? 

ভজহরিবাবু মৃদু হেসে বললেন— বেশী দূর নয় । 

- সেকি ? 

—হ্যাঁ, খুনী কে তা এখনও আমরা স্থির করতে পারিনি। 

—তবে তদন্তের ফল হলো কি ? 

--খানিকটা এগিয়েছি মাত্র । 

-কিসের উপর নির্ভর করে ? 

—সন্দেহ এবং প্রমাণের উপর নির্ভর করে। দুটোই আমাদের তদন্ত- ব্যাপারে কিছু কিছু সাহায্য করেছে । 

–ধন্যবাদ । কিন্তু সন্দেহটা ঠিক কার ওপর... 

—মাপ করবেন। সেটা বলতে আমার বাধা আছে । 

—বেশ । 

-তবে এটা নিশ্চয়ই জানেন যে, পুলিস মর্গের রিপোর্টে যে যে তথ্য প্ৰকাশ পেয়েছে তাতে কেসটা বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। 

—তাই নাকি ! কি কি তথ্য আবার প্রকাশ পেলো ? 

—ও, সেগুলো জানেন না বুঝি ? 

—না, জানবার সৌভাগ্য হয়নি এখনও। 

–বেশ, তা হলে শুনুন। প্রথম তথ্য এই যে, আমরা জানতে পেয়েছি পিঠের ওই ছোট ক্ষতস্থানে বিষপ্রয়োগে মনোরমা দেবীর মৃত্যু হয়নি । 

—তবে ? 

—ওটা একটা ভাঁওতা মাত্র ! 

– সেকি ? 

—হ্যাঁ, তাঁর পেটে যে বিষ পাওয়া গিয়েছে তাতে বোঝা যায় যে খাবারের মাধ্যমেই বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। 

—আশ্চর্য ! 

—হ্যাঁ। আরও একটা সংবাদ শোনবার জন্যে প্রস্তুত থাকুন বিনয়বাবু । মনোরমা দেবী মৃত্যু সময়ে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন । 

সো স্টে ঞ্জ ! 

—হ্যাঁ, এমনি আরো কতো আশ্চর্যজনক ব্যাপারই না পৃথিবীতে ঘটে থাকে ! আমরা তার কতটুকু খবর রাখি বলুন ! 

—তা ত বটেই। 

—তবে যতদূর আমরা জানতে' পারি তাতেই আমরা সেটাকে আশ্চর্যজনক বলে ভূষিত করি । যাক্, এবার খুনী কে সে সম্বন্ধে আপনি নিশ্চয়ই একটু সাহায্য আমাকে করতে পারবেন । 

—কিন্তু, এ দুটো তথ্য জানা সত্ত্বেও যদি বলি খুনী যে কে তা এখনও আমাদের ধারণার বাইরে রয়েছে ৷ 

—তা হয় না বিনয়বাবু, তা হলে আমি বলব, ওর দ্বারা আপনি সত্যের অপলাপ করছেন । 

—হয়ত তাই । কিন্তু এর বেশী আপাততঃ আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। —বেশ, বলতে আপনাকে হবে না। আপনি এটা বলবেন কি কে মনোরমা দেবীর সঙ্গে বিগত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশী ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করেছিল ? 

—সেটা ঠিক... 

—না না, এভাবে আসল সত্যকে চাপা দেবার চেষ্টা অত্যন্ত অন্যায় বিনয়বাবু । 

– কেন ? 

-আপনি জানেন কিছুদিন আগে পর্যন্ত অমলবাবুর সঙ্গে মনোরমা দেবীর যে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল সেটা আমাদের অজানা নেই । 

—সে রকম ঘনিষ্ঠতা এক পরিবারের যে কোনও একজনের সঙ্গে অপরজনের থাকতে পারে । 

—তা অবশ্য সত্যি। কিন্তু এক্ষেত্রে মনোরমা দেবীর সঙ্গে অমলবাবুর বিয়ের কথা পর্যন্ত হয়েছিল সে খবর আমরা রাখি । 

—ও, দীপকবাবুর মুখে শুনেছেন বুঝি ? 

-যেখান থেকেই শুনি, ব্যাপারটা গিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই একই জায়গায় দাঁড়ায় ৷ 

—ছোট্ট একটা কথার উপরে নির্ভর করে আপনারা এমন তুচ্ছ জিনিসের ভিত্তিতে একটা বিরাট সিদ্ধান্ত গঠন করতে চান যে তা শুনলে যে কোন সুস্থ লোকের হাসি পাওয়া সম্ভব । 

—কিন্তু ছোট ছোট সিদ্ধান্ত ধরে অগ্রসর না হলে ত অন্ধের মত ঘুরে বেড়াতে হয়! 

—ভুল ভজহরিবাবু, একদম ভুল। সত্য কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, আপনাদের এই লাইন অব প্রোগ্রেস অর্থাৎ অগ্রগতির পথটাই হচ্ছে ইতস্ততঃ টুকরো ঘটনার পেছনে অন্ধের মত ছুটে চলা, এই আর কি ! 

-এ কথা বলছেন কেন ? 

-বলছি এই জন্যে যে, কে খুনী তা আমরা জানি । 

— অর্থাৎ ? 

—আমি জানি যে খুনী কে। খুনী স্বয়ং ঠিক আপনার সামনে বসে ৷ আমিই মনোরমা দেবীকে খুন করেছি। সুতরাং আপনার এই সমস্ত লাইন অব প্রোগ্রেস্টাই মিথ্যা পথ ধরে হচ্ছে নাকি ? 

—কিন্তু এভাবে আপনি নিজেকে খুনী বলে স্বীকার করলেও বা লাভটা এমন বেশী কি হলো ! আমরা ত যে তিমিরে, সেই তিমিরেই রয়ে গেলাম । উপযুক্ত প্রমাণ না পেলে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য নই যে আপনি খুনী । এমন কি আপনি নিজমুখে তা স্বীকার করলেও নয় । 

–সে আপনি যে পদ্ধতি অনুযায়ী তদন্ত করুন না কেন শেষ পর্যন্ত আমি প্রমাণ করবই যে আমি প্রকৃত খুনী। সুতরাং অনর্থক আর মিথ্যার পেছনে 'অন্ধের মত ঘুরে বেড়িয়ে লাভ কি হবে আপনার ... 

কথা শেষ না করেই হঠাৎ কথার মধ্যে অহেতুক ছেদ টেনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় বিনয় ৷ 

ভজহরিবাবু অবাক হয়ে শুধু ভাবতে থাকেন এই অদ্ভুত তদন্তের শেষ হবে কোথায় ! 


–আট -

ঈশানবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ভজহরিবাবু লক্ষ্য করলেন যে দীপকের মুখ অহেতুক গম্ভীর । 

তার থমথমে মুখের দিকে চেয়ে ভজহরিবাবু কোনও প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করলেন না। 

যে যেন চিন্তিত মনে কি এক গভীর ভাবনার অতলে ডুব মেরেছে । একসময় ভজহরিবাবু হঠাৎ বলে ফেললেন—বিনয়বাবু নিজেকে খুনী বলে স্বীকারোক্তি করেছেন দীপকবাবু । 

দীপক তাঁর কথা শুনে বলল – এতে লাভটা আর কি হলো বলুন ত ? এদিকে অমল আমার কাছে একটু আগেই বলল যে সেই হচ্ছে আসল খুনী। 

ভজহরিবাবু হেসে বললেন—এ রকম ঝামেলায় ত মশাই এর আগে জীবনে কখনও পড়তে হয়নি । 

দীপক হেসে বলল—যাক, এবার নতুন একটা অভিজ্ঞতা লাভ হলো ত! হাজার হোক, তারও একটা মূল্য অবশ্যই আছে ৷ 

ভজহরিবাবু বললেন—কিন্তু এদিকে তদন্তের কি যে ছাই মাথামুণ্ডু হচ্ছে কিছুই বুঝছি না!! 

দীপক রসিকতার সুরে বলল—দাঁড়ান, আগে বাড়ির বাকি ক'জন লোকও এই সঙ্গে নিজেদের খুনী বলে স্বীকার করুক, তারপর যা হয় চেষ্টা করা যাবে। 

ভজহরিবাবু বললেন—হ্যাঁ, মায়া দেবী, বিনয়বাবু আর অমলবাবু ত হলো, এবার বাকি সকলেও অমনি করবে না কি ? 

দীপক বলল—আশ্চৰ্য নয় ! 

— কিন্তু কি ওদের স্বার্থ ? 

—স্বার্থ কিছু নয়, শুধু পরার্থ । 

– সেকি ? 

—হ্যাঁ, একজন অপরকে বাঁচাবার জন্যে নিজের ঘাড়ে দোষটা গ্রহণ করছে, আর একজন আবার তাকে বাঁচাবার জন্যে চেষ্টা করছে। এমনি সব কাণ্ডকারখানা চলছে আর কি ! 

—সে ত মশাই বড় গোলমেলে ব্যাপার ! এক্ষেত্রেও তেমনি গোলমেলে বলেই আপনার মনে হচ্ছে নাকি? 

—কতকটা ত বটেই। 

-তা হলে শেষ পর্যন্ত কি দেখা যাবে অপরাধী কেউই নয় ? 

– না, অতটা আশা আমি অবশ্য করি না। খুনী যে কেউ একজন নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আমরা তার কাছে গিয়ে ঠিকমত পৌঁছুতে পারিনি। তবে শীঘ্রই যে পারব সে আশা রাখি । 

—এদের তিনজনের মধ্যেই কি কেউ খুনী ? 

—সেটাও অসম্ভব নয় ভজহরিবাবু । 

—-তা হলে শেষ নির্ভর করছে আমাদের নিজেদের তদন্তের উপরেই। 

ওদের স্বীকারোক্তিগুলো কোনও কাজেই আসছে না । 

—সে ত বুঝতেই পারছেন । 

--তা হলে ত এখন ও কিছুদিন দেরি হওয়া সম্ভব । 

-খুব বেশী নয়। কেননা কাছাকাছি আমরা এসে গেছি । 

– সেকি ? 

—আপনি এখনও কিছুই আন্দাজ করতে পারেননি নাকি ? 

—আমি ভাবছিলাম বোধ হয় মায়া দেবীর ভাই ওই অবনীবাবুই এই ব্যাপারে লিপ্ত । 

—না মশাই, আপনি এতগুলো লোক ফেলে রেখে শেষ পর্যন্ত কিনা ওই অবনীবাবুর পেছনেই ধাওয়া করলেন ! 

—কিন্তু ওই তিনজন, যারা স্বীকারোক্তি করেছেন, তাঁদের কাউকে কিন্তু অপরাধী বলে মনে হয় না আমার। কি করি, অগত্যা অবনীবাবুর নাম করেছিলাম, এই আর কি ! 

– ও, আপনি তা হলে পারমিউটেশন কম্বিনেশন করছেন বোধ হয় ? না, আপনার দ্বারা এভাবে রহস্যের কিনারা কোনও দিনই হবে বলে মনে হচ্ছে না আমার । আচ্ছা চলি ভজহরিবাবু ।

থানার কাছে এসে দীপক গাড়ি থেকে নেমে পড়ে । ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে দিলে দীপক পেছনের দিকে ফিরে তাকিয়ে মৃদু হেসে আপন মনে বলে,—ও, এখনও আপনি বহুদূরে পড়ে আছেন ! 

ধীরে ধীরে সে আপন মনে পথ দিয়ে এগিয়ে চলে । 


-নয়-

-আপনি তা হলে আমাকে এ কথাই বিশ্বাস করতে বলেন যে মনোরমা দেবীর হত্যাসংক্রান্ত ব্যাপারের কোনও কিছুই আপনার জানা নেই ?—দীপক প্রশ্ন করে রায়সাহেব ঈশান মিত্রের দিকে চেয়ে । 

—ঠিক ওই কথাই বলতে চাই আমি ৷ 

ঈশান মিত্রের কথাগুলো কেমন যেন অপ্রতিভ বলে মনে হয় । 

ঘরের মধ্যে মুখোমুখি এরা দুজন। ঈশান মিত্রের নিজের শয়নকক্ষ সেটা।  

হালকা হাওয়ায় দরজার পরদাটা কাপছিল। বাইরের কোলাহল থেকে দূরে এ ধরনের একান্ত সান্নিধ্যে বসে দীপক যে তাঁকে এভাবে প্রশ্ন করতে পারে এ ধারণা বোধ হয় ঈশান মিত্রের ছিল না। তাই তিনি এভাবে অপ্রতিভ হয়ে পড়েছিলেন । 

একটু হেসে দীপক আবার বলে চলে—এ কথাটা আমি জানি ঈশানবাবু, যে কেউ যা কিছুই বলুক না কেন, আপনি শেষ বয়সে আবার বিয়ে করেছেন অন্য কোনও কারণেই নয়, একরকম বলতে গেলে বাধ্য হয়েই । 

– সেকি ? 

ঈশান মিত্র যেন চমকে উঠলেন । 

—হ্যাঁ ঈশানবাবু। ভয় নেই, আমি কথাটা অন্য কারও কাছে প্রচার করব না যে বিয়ের আগেই আপনার সঙ্গে মায়া দেবীর পরিচয় ছিল। 

—কিন্তু তুমি কি করে তা জানলে দীপক ? 

—ডিটেকটিভদের অনেক কিছুরই খোজ রাখতে হয় ঈশানবাবু । থাক সে কথা, আপনি মায়া দেবীকে কেন বিয়ে করেছিলেন তা জেনে এ খুনের ব্যাপারে আমার কোনও সুবিধে হবে না, কিন্তু আপনার স্ত্রীভাগ্য যে ভাল সেটা আমিও স্বীকার করছি। 

—তোমার এ কথার কোনও মানেই হয় না ৷ 

ঈশান মিত্র এবার যেন মরিয়া হয়ে ওঠেন। 

—অনর্থক উত্তেজিত হবেন না, ঈশানবাবু । আমার প্রশ্ন এই যে, অমলবাবুর সঙ্গে মনোরমা দেবীর ঘনিষ্ঠতা কতদূর ছিল ? 

-এ প্রশ্নের কোনও প্রয়োজন আছে বলে ত মনে হচ্ছে না আমার। 

— আছে ঈশানবাবু, নিশ্চয়ই আছে। পুলিসের রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে যে মনোরমা দেবী মৃত্যুর পূর্বে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।  

— সেকি ?—ঈশানবাবুর মুখ যেন পাংশুবর্ণ ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত অমল তা হলে এভাবে... 

—যাক, সে সম্বন্ধে পরে ভেবে দেখব আমরা। আপনি কি দয়া করে মনোরমা দেবীর একখানা ভাল ফটো দিতে পারেন আমাকে, একটু প্রয়োজন আছে। 

–ও হ্যাঁ, এখুনি এনে দিচ্ছে। 

ঈশানবাবু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান ৷ 

দীপক এতক্ষণ যেন এই সুযোগই খুঁজছিল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে একটা সবথোল চাবি বের করে ড্রয়ারগুলো খুলে কি যেন খুঁজতে লাগল । কিছুক্ষণ খোজাখুঁজি করে একটা ড্রয়ারে সে দেখতে পেল ঈশান মিত্র বিশ্রী কতকগুলি অশ্লীল ছবি জমিয়ে রেখেছেন। এ ধরনের একজন প্রৌঢ়ের এই বিকৃত রুচির পরিচয় পেয়ে দীপকের মনটা ঘৃণায় রি-রি করে উঠল । 

ড্রয়ারগুলো বন্ধ করে দীপক কি যেন ভাবছিল, এমন সময় প্রবেশ করলেন ঈশান মিত্ৰ । 

-এই নাও মনোরমার ফটো । 

দীপক ফটোটা হাতে নিয়ে বলল— আচ্ছা চলি ঈশানবাবু, অনর্থক আপনাকে কিছুটা বিরক্ত করে গেলাম।

– না না, সে কি ! তুমি বাবা যেদিন ইচ্ছে হবে এখানে আসবে। মনোরমার হত্যাকারীকে খুঁজে শীঘ্র বের কর এই আমি চাই । 

—হ্যাঁ, সে ত প্রায় একরকম হয়েই গেছে ঈশানবাবু। আমি দারোগা ভজহরিবাবুকে নিয়ে আসব কাল সন্ধ্যার সময় । আপনাদের বাড়ির সকলকেই সেদিন হলঘরে গিয়ে উপস্থিত হতে হবে। সকলের সামনে সেদিন হত্যাকারীকে ধরিয়ে দেব । 

—তোমার কার্যপদ্ধতি দেখে সত্যিই আমি আনন্দিত হলাম দীপক, আশা করি তুমি অবশ্যই সফল হবে। 

দীপক মৃদু হেসে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় । 

ঈশানবাবু তার গমনপথের দিকে চেয়ে থাকেন এক দৃষ্টে । 

বাড়িতে ফিরে এসে দীপক সবে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল সশব্দে । 

—হ্যালো, কে ? দীপক রিসিভারটা তুলে ধরে প্রশ্ন করল । 

—চিনতে পারবেন না । কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন বিকৃত বলে মনে হলো । 

—এক্ষুনি ঈশান মিত্রের বাড়ির তদন্ত থেকে সরে দাঁড়াবেন কিনা জানতে চাই । 

– আপনি কে সেটা শুনে না হয়.. 

—আমি আপনার শুভেচ্ছার্থী বন্ধু । এখনও সময় আছে, এবং সময় থাকতে সরে দাঁড়ালে উপযুক্ত পারিশ্রমিক.. 

—সেই অঙ্কটা কত ? 

—দু'হাজার । 

-ধন্যবাদ । 

– তা হলে কি ব্যবস্থা করলেন ? 

—চিন্তা করে দেখছি। 

-এই আমার শেষ সাবধানবাণী দীপক চ্যাটার্জী । মনে থাকে যেন। দীপক কোনও উত্তর না দিয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখে । 


-দশ- 

ভজহরিবাবু দীপকের কথা শুনে এমন চমকে উঠবেন এটা দীপক আগে বুঝতে পারে নি মোটেই । 

—আপনি তা হলে বলছেন যে খুনী কে তা আপনি ঠিক বুঝতে পেরেছেন দীপকবাবু ? ভজহরিবাবু প্রশ্ন করেন । 

মৃদু হেসে দীপক বলে—অবশ্যই। আর আজ সন্ধ্যায় আপনি যদি দয়া করে আমার সঙ্গে চলেন আপনাকে হাতে হাতে ধরিয়ে দেব । 

—অসম্ভব । 

—পৃথিবীর অনেক কিছুকেই বাইরে থেকে অসম্ভব বলে মনে হয় ভজহরিবাবু। 

—তা হলে কি আপনি বলতে চান যে আপনি ভোজবিদ্যা জানেন ? 

—অর্থাৎ ? 

—আমি মশাই এতদিনেও খুনী ত দূরের কথা কারও টিকির সন্ধান পেলাম না, আর আপনি বলেন কিনা একেবারে খুনীর সন্ধান বের করে বসে আছেন। —আমি সত্যি কথাই বলছি কিনা আমার সঙ্গে গেলেই টের পাবেন। যাক, এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। চলুন আমরা রওনা দিই। হ্যা, আপনি আপনার রিভলভারটা সঙ্গে নিতে ভুলবেন না ভজহরিবাবু। আজ কিন্তু যে কোন বিপর্যয় ঘটতে পারে । 

– সেকি ? 

—বুঝতেই পারছেন । এখন পর্যন্ত খুনী বেশ নিশ্চিন্ত আছে। শেষ মুহূর্তে যদি বুঝতে পারে যে আমরা তাকে ঠিক চিনতে পেরেছি তা হলে সেই চরম মুহূর্তে সে সব কিছুই করে বসতে পারে । 

—তা ত বটেই । 

-তা হলে ভেবে দেখুন অস্ত্র নিয়ে তৈরী থাকার প্রয়োজনীয়তা কত বেশী । যাক, মিনিট পনর সময় দিলাম আপনাকে। এর মধ্যে আপনার অস্ত্রটা নিয়ে তৈরী হয়ে এখানে আসুন । আর দুজন আর্মড পুলিসেরও ব্যবস্থা করুন । ছদ্মবেশে তাদের বাড়ির সামনে রাখতে হবে। 

—এটারও প্রয়োজনীয়তা আমি অনুভব করছি দীপকবাবু । 

—হ্যাঁ, সবদিক থেকে তৈরী হয়ে নিন। ঠিক সাড়ে ছটায় আমাদের সেখানে পৌছুতে হবে। আমি ততক্ষণ ঈশানবাবুকে বাড়িতে একটা  ফোন করে দিই । 

কথা শেষ করেই দীপক টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিল। 

ভজহরিবাবু বেরিয়ে গেলেন চরম মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত হবার উদ্দেশ্যে । 

এক ঘণ্টা পর । 

রায়সাহেব ঈশান মিত্রের বাড়িতে পৌঁছে দীপক দেখতে পেল যে বাড়ির সকলে হলঘরে এসে একত্র বসে আছে । স্বয়ং রায়সাহেব ঈশান মিত্র থেকে শুরু করে ছোট ছেলে শংকর পর্যন্ত কেউ বাদ যায়নি। 

চাকর, দারোয়ান, মালী ইত্যাদি সকলে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। তাদের আহ্বান করলেই যে কোন মুহূর্তে তারা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে প্রস্তুত । 

দীপক ভজহরিবাবুর দিকে চেয়ে বলল – আপনি একটু বসুন ভজহরিবাবু। আমি জরুরী কাজে একটু বাইরে যাচ্ছি। দু'মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসব । 

দীপক বেরিয়ে গেলে ভজহরিবাবু উঠে দাঁড়িয়ে সকলের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বললেন –দেখুন, এটা আপনারা বুঝতেই পারছেন যে আপনাদের মধ্যে মাত্র একজন খুনী। কিন্তু পর পর তিনজন পৃথক পৃথক ভাবে স্বীকারোক্তি করেছেন যে তিনি খুন করেছেন । এর ফলে ব্যাপারটার মধ্যে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল তা কাটিয়ে ওঠা সহজ ছিল না। কিন্তু গোয়েন্দা দীপকবাবুর আপ্রাণ চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত আমরা কৃতকার্য হতে সক্ষম হয়েছি। 

ঘরের মধ্যে নিঃসীম চুপচাপ। প্রত্যেকেই পরস্পরের মুখের দিকে চাইছে। তাদের সেই অবর্ণনীয় উৎকণ্ঠা ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই কষ্টকর। 

ভজহরিবাবু একটু থেমে আবার বলে চললেন – হ্যাঁ, মাত্র একটি অদৃশ্য সঙ্কেতের উপর নির্ভর করে দীপকবাবু শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন ৷ মাত্র একটি সঙ্কেত । আপনারা কেউ এবং আমি পর্যন্ত সেটা অনুমান করতে পারিনি । 

-কিন্তু কি সেই অদৃশ্য সঙ্কেত ? – সজোরে বলে উঠল ঈশানবাবুর বড় ভাইপো অমল ৷ 

—সেই সঙ্কেতটি হচ্ছে মনোরমা দেবীর নামে কোনও একটি ব্যাঙ্কে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা পড়েছিল। তারপর মনোরমা দেবীর আকস্মিক মৃত্যুর পর যে টাকাটা জমা দেয় সেই সেটা উইথ ড্র করে । 

– সেকি ? 

–কে সেই লোক ? 

-একি ব্যাপার ? 

—টাকা জমা কেন ? 

একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন পর পর বেরিয়ে এলো সকলের মুখ থেকে প্রত্যেকের ভঙ্গির মধ্যেই ফুটে উঠেছে অদ্ভুত উৎকণ্ঠা আর প্রবল উত্তেজনার ছাপ । 

ভজহরিবাবু বললেন—টাকা জমা দেওয়ার এই অদৃশ্য সঙ্কেতের উপরে নির্ভর করে দীপকবাবু এগোতে সক্ষম হলেও আমরা এক পাও এগোতে পারিনি। তাই তিনি এসেই সব কিছু ব্যাখ্যা করবেন। 

কথা শেষ করে ভজহরিবাবু বসে পড়লেন তাঁর চেয়ারে। এভাবে মাঝপথে কথা শেষ করায় সকলের উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়ে যে অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াল তা বর্ণনাতীত। 

সকলের দৃষ্টি দ্বারের দিকে । 

দীপক চ্যাটার্জী কোথায় ? 


-এগারো-

সহস্র রজনীর মোহনিদ্রা হতে জেগে-ওঠা রূপকথার রাজকন্যার চোখে-মুখে যে অদ্ভুত বিহ্বলতা ফুটে উঠেছিল, ঠিক তেমনি ভাব ফুটে উঠল সকলের চোখে-মুখে দীপক চ্যাটার্জীর নাটকীয় - আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই । 

ঘরে পা দিয়েই দীপক শুরু করল—আপনারা প্রত্যেকেই যে কি পরিমাণ উত্তেজিত ও উৎকণ্ঠিত তা আমি জানি ৷ ধৈর্যের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেচেন আপনারা। কিন্তু আপনাদের ধৈর্যের উপরে আরও কিছু আঘাত আমি করব । কারণ প্রথম থেকেই সব কিছু বলতে হবে আমাকে । 

হ্যাঁ, শুনুন আপনারা। আপনারা তিনজনে পর পর স্বীকারোক্তি করেছেন নিজেদের খুনী বলে। কিন্তু আমি প্রত্যেককেই পরীক্ষা করে দেখেছি । কিভাবে তা একে একে খুলে বলছি । 

প্রথমে ধরা যাক মায়া দেবীর কথা। তিনি স্বীকার করেছেন আসল খুনীকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যেই । তিনি দোষটা নিজের কাঁধে নিয়েছেন বটে, কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এই খুন, সেদিক থেকে বিচার করলে তিনি যে নির্দোষ তা সহজে বলা চলে। 

দ্বিতীয় জন হচ্ছেন বিনয়বাবু। প্রথমটা তাঁর উপরে সন্দেহ হতে পারে বটে, কিন্তু একটু ভাবলেই বোঝা যায় মনোরমা দেবীর সঙ্গে তাঁর এমন কিছু নিবিড়তা ছিল না। তাই ওদিক থেকে তিনি নির্দোষ। তিনি অমলবাবুকে বাঁচাবার জন্যেই এভাবে খুনের বোঝা কাঁধে নিয়েছেন। কিন্তু বিনয়বাবু, দুঃখের সঙ্গে আপনাকে জানাচ্ছি যে আপনার এই অনুমান ভুল । অমলবাবুও আসল খুনী নন, সবদিক থেকে যদিও সন্দেহটা তাঁর উপরে গিয়েই পড়ে। এ কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে প্রথমে আমিও অমলবাবুকেই দোষী সাব্যস্ত করেছিলাম । কারণ আমি ভেবেছিলাম যে মনোরমা দেবীর অবৈধ সন্তানের পিতা হচ্ছেন আপনি। কিন্তু সেই সন্দেহ থেকে আপনি মুক্তি পেলেন, যখন ঐ ব্যাঙ্কে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দেবার সঙ্কেতকে অনুসরণ করলাম আমি। মায়া দেবীর ভাই অবনীবাবুও নির্দোষ, কারণ তাঁর এতে কোনও স্বার্থ নেই । 

এবার আসা যাক আসল খুনীর ব্যাপারে। আসল খুনী সবদিক থেকেই সবার ধারণার বাইরে ছিল। সেই ছিল মনোরমা দেবীর অবৈধ সন্তানের পিতা। মনোরমা দেবী তাকে ভয় দেখান যে পঞ্চাশ হাজার টাকা তাঁর নামে জমা না দিলে তিনি তাঁর মুখোশ খুলে ধরবেন। মনোরমা দেবীর ইচ্ছা ছিল এই টাকাটা নিয়ে তিনি কাশীর পথে পা বাড়াবেন । আত্মীয়দের সংস্রব থেকে দূরে তাঁর শেষ জীবন কাটাবার ইচ্ছা ছিল । কিন্তু খুনী দেখল কাশীতে গিয়েও যদি মনোরমা দেবী তাকে নিস্তার না দেন। তা ছাড়া এভাবে ব্ল্যাকমেল করার সুবিধা অনেক। দূর দেশে গেলে, অর্থাৎ খুনীর হাতের বাইরে গেলে প্রায়ই এভাবে ভয় দেখিয়ে টাকা নেওয়া যাবে । খুনী তাই দেখল যে আসলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েও সে একেবারে নিস্তার পাচ্ছে না। বরং হাতের বাইরে গেলে আরও অসুবিধা বাড়বে। তাই সে প্রথমে মনোরমা দেবীর নামে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দিল বটে, কিন্তু সুযোগমত তার কাশী যাত্রার আগে নিপুণ কৌশলে খাদ্যের সাথে বিষ মিশিয়ে তাকে হত্যা করল। যাতে সন্দেহটা অন্যের উপরে পড়ে এই উদ্দেশ্যে সে তার পিঠে ক্ষত সৃষ্টি করল আর ভাঙ্গা অ্যাম্পুল ফেলে রাখল । 

—স্টপ, ইট্‌ ! স্টপ, ইট্‌ ! বন্ধ কর! চীৎকার করে কথাগুলো বলে উঠে উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন রায়সাহেব ঈশান মিত্র। হাতে তাঁর একখানি দামী অটোমেটিক রিভলভার চকচক করছে দেখা গেল! দীপকের দিকে লাফ দিয়ে পড়লেন তিনি। 

দীপক এর জন্যে প্রস্তুত ছিল। 

গুড়ম ! 

তীব্র শব্দ আর প্রচুর ধোঁয়া । 

সে মেঝের ওপর শুয়ে পড়ল। 

গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গিয়ে দালানে বিদ্ধ হলো। সুযোগ খুঁজছিলেন। তিনি রায়সাহেব ঈশান মিত্রের রিভলভারটা কেড়ে নিলেন । 

তারপরেই তীব্র একটা ঘুসি এসে আচমকা পড়ল ভজহরিবাবুর নাকে। 

তিনি ছিটকে পড়তেই ঈশানবাবু একলাফে ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটলেন দোতলার দিকে। 

দীপক আর ভজহরিবাবু ছুটলেন পেছনে পেছনে। কিন্তু তাঁকে ধরবার আগেই তিনি দোতলা পেরিয়ে গিয়ে উঠলেন তিনতলার ছাদে। সেখান থেকে প্রশস্ত রাজপথের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি ৷ 

দীপক আর ভজহরিবাবু উপর থেকে নেমে রাস্তায় এসে দেখতে পেলেন রায়সাহেব ঈশান মিত্রের মাথার খুলির একটা অংশ ভেঙে গেছে। বাঁ পা, ডান হাতের অবস্থাও প্রায় তাই। তক্ষুনি তাঁকে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হলো । 

ঘণ্টা চার পাঁচ পরেই রায়সাহেব ঈশান মিত্রের মৃত্যু হলো । তাঁর পরিবারের সকলে দীপক আর ভজহরিবাবুকে অনুরোধ করলেন পারিবারিক এই ব্যাপারগুলো সাধারণের কাছে প্রকাশ না করতে। 

দীপক আর ভজহরিবাবু অনুরোধ রক্ষা করলেন । 

পরদিন প্রত্যেকটি সংবাদপত্রে শোক-সংবাদের স্থানে ছাপা হলো : 

রায়সাহেব ঈশান মিত্রের শোচনীয় অপমৃত্যু ! 

তিনতলার ছাদ হইতে অকস্মাৎ পা পিছলাইয়া রাস্তায় পড়িয়া রায়সাহেব ঈশান মিত্র মারাত্মকভাবে আহত হন । পরে হাসপাতালে চার পাঁচ ঘণ্টা পরেই তাঁহার মৃত্যু হয় । আমরা তাঁহার শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গকে সান্ত্বনা জানাইতেছি ৷ 

এই ঘটনার পর দীপক ঈশানবাবুদের বাড়ি যে দু'একবার না গেছে তা নয়, কিন্তু এই ব্যাপারগুলি নিয়ে কোনও আলোচনাই করেনি সে। 

শুধু ইনস্পেক্টর ভজহরিবাবু মাঝে মাঝে দীপককে বলেন—সত্যি, আপনার তদন্তের ধারাগুলো আমার আজও অদ্ভুত লাগে মিঃ চ্যাটার্জী । 

দীপক তার উত্তরে শুধু রহস্যময় হাসি হাসে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ