১ ম পর্ব
ডাক্তারি জীবনে বহু রোগীর সংস্পর্শে আসতে হয়েছে আমায়; বিচিত্র মন, বিচিত্র স্বভাবের মানুষ দেখেছি, তাই এখন আর নতুন কোনও রোগী আমার মনে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কিন্তু রাঘব সামন্তকে দেখেই কেন জানি আমি বেশ একটা ধাক্কা খেলাম। আমার মনের ঠিক অনুভূতিটা বুঝিয়ে বলা মুশকিল - কেমন যেন গা ঘিনঘিন আর গা শিরশির করা অনুভূতি। যেন একটা জীবন্ত মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি।
গোড়া থেকেই শুরু করি। আমার চেম্বারের কিছুদূরেই একটা মেসবাড়ি। ওখানকার কিছু বাসিন্দা আমার রোগী, মাঝে মাঝে তাই ওখানে আমায় ভিজিটে যেতে হয়। হঠাৎ একদিন বর্ষার রাতে ফাঁকা চেম্বারে বসে উঠব উঠব করছি, এমন সময় মেসের মালিক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। দিন কয়েক হল এক নতুন বোর্ডার এসেছেন তাঁর মেসে, সেই বোর্ডার ভদ্রলোক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, গুরুতর কিছু বলেই মনে হচ্ছে, আমায় এখুনি যেতে হবে। যেতে হল।
ছোট্ট একটা চিলেকোঠা ঘরে রোগী ভদ্রলোক শুয়ে আছেন। পরে মেসের মালিকের মুখে শুনেছিলাম, ভদ্রলোক কারোর সঙ্গে ঘর ভাগাভাগি করে থাকতে চাননি, যত ছোট বা খারাপই হোক না কেন, ঘরটা সম্পূর্ণ তাঁর একা'র চাই, তার জন্য যত বেশি টাকা দিতে হোক না কেন, তিনি রাজি। তেমন কোনও ঘর ছিল না, শেষ পর্যন্ত চিলেকোঠার ঘরটার জঞ্জাল পরিষ্কার করে ভদ্রলোককে দেয়া হয়। তিনি খুশিই হয়েছিলেন।
নতুন এই ভদ্রলোক মেসে আসার পর থেকে এ'কদিন কোথাও বেরোননি। কারোর সঙ্গে বিশেষ একটা কথাও বলেননি। ওই ছোট্ট ঘরে নিজেকে যেন বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চেয়েছেন। মেসের চাকর ঘরে খাবার দিয়ে আসে, খাবার জন্য নীচেও নামেন না তিনি।
আজ একটু আগে রাতের খাবার দিতে গিয়ে মেসের ছোকরা চাকরটি দেখে, ভদ্রলোক মাটিতে পড়ে আছেন - মুখটা হাঁ করা, দু'চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। তার চিৎকারে মেসের লোকজন ছুটে আসে। নাড়ীর গতি এত মৃদু যে, মনে হয় জীবন মরণের একটা লড়াই চলছে। ভয় পেয়ে মেসের মালিক ভদ্রলোক ছুটে এসেছেন আমার কাছে। মেসে কেউ মারা গেলে সেটা মেসের পক্ষে বদনাম, তাই তাঁর দুর্ভাবনাটাই বেশি।
মালিকের সঙ্গে তাঁর মেসবাড়িতে যেতে হল। যদিও আগে অনেকবারই এখানে এসেছি, কিন্তু চিলেকোঠায় কখনো আসিনি। সত্যিই একচিলতে ঘর। তক্তাপোশের ধারে মাটিতে যিনি পড়ে আছেন, তাঁকে দেখে আমি চমকেই উঠলাম, সারা শরীরে কেমন একটা শিহরণ বয়ে গেল।
রোগী ভদ্রলোকের মাথার চুলের ডান দিকটা ধবধবে সাদা, কিন্তু বাঁ দিকটা কালো। মুখে অসংখ্য বলিরেখা। অথচ আমার মনে হল, ভদ্রলোককে যত বুড়ো দেখাচ্ছে, তত বুড়ো নন তিনি, অকালে বুড়িয়ে গেছেন। গায়ের রঙ ফ্যাকাসে, কেউ যেন তার রক্ত শুষে নিয়েছে। কেমন যেন একটা মৃত্যুর গন্ধ, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
ভদ্রলোকের শরীর বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। তাঁকে পরীক্ষা করে আমি রোগটা ঠিক কি, তা বুঝতে পারলাম না। প্রথমে ভাবলাম হার্ট অ্যাটাক, কিন্তু ব্লাডপ্রেসার মেপে দেখলাম, একেবারে স্বাভাবিক। নিজের ডাক্তারি বিদ্যে-বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতায় মনে হল, ওসব ব্যাপার নয়। যা হোক, তখনকার মতো চাঙ্গা করে তোলার মতো ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করলাম। ভদ্রলোক পরদিনই সুস্থ হয়ে খাড়া হয়ে উঠলেন। আমি একটু অবাকই হলাম। গত রাতে অমন একটা অবস্থার পর এত তাড়াতাড়ি তিনি সামলে উঠবেন, এ আশাই করতে পারিনি আমি। যা হোক, পরদিন তাঁকে দেখতে যেতেই, তিনি আমায় বসতে বললেন। আমি লক্ষ্য করলাম, ভদ্রলোকের চোখের সাদা অংশটা একটু বেশী প্রকট, চাউনিতে কেমন একটা অস্থিরতা। আমাকে তিনি একদৃষ্টে লক্ষ্য করছেন দেখে, আমার অস্বস্তি হতে লাগল। সেটা কাটাবার জন্য আমি তাঁকে পরীক্ষা শুরু করলাম। সব কিছুই স্বাভাবিক।
আমার পরীক্ষা শেষ হতেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন, " আপনি ডাক্তার? "
প্রশ্নটা শুনে আমি থতমত খেলাম। আমার গলায় স্টেথোস্কোপ, হাতে ব্লাডপ্রেসার মাপার যন্ত্র, এতক্ষণ যত্ন করে পরীক্ষা করলাম, তারপরেও এমন প্রশ্নের কারণ কি হতে পারে।
ভদ্রলোক নিজেও বোধহয় প্রশ্নটার অসারতা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই বললেন, " মানে...আমিও একসময় ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখতাম, বছর তিনেক ডাক্তারি পড়েও ছিলাও"।
" তাই নাকি!" আমি এবার কৌতূহল নিয়ে তাকালাম, " পড়া ছেড়ে দিলেন কেন?"
" ছাড়তে হল....সে অনেক কথা", এই পর্যন্ত বলে ভদ্রলোক হঠাৎই যেন সেই কথায় ছেদ টানতে চাইলেন। আমিও তাঁর ইঙ্গিতটা বুঝে আর ও প্রসঙ্গে গেলাম না।
এ ঘটনার দিন তিনেক পর, ভদ্রলোক হঠাৎ আমার চেম্বারে এসে হাজির হলেন। সময়টা ছিল বর্ষার রাত, সেদিনও চেম্বার বন্ধ করে উঠব উঠব করছি। ভদ্রলোককে এইসময় দেখে মোটেও খুশি হলাম না আমি, কেন, তা অবশ্য জানি না।
ভদ্রলোক এটা ওটা কথার পর আমার সন্মন্ধে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন। কোন মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেছি, কোন কোন প্রফেসরের কাছে পড়েছি, আমার পরিচিতদের মধ্যে কারা ডাক্তার হিসেবে নাম করেছেন, এসব ব্যক্তিগত প্রশ্ন। বলা বাহুল্য, আমি বেশ বিরক্তিই বোধ করছিলাম।
হঠাৎ ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, " আচ্ছা, ডাঃ অনাথ চৌধুরী নামে কাউকে চেনেন?"
" ডাঃ অনাথ চৌধুরী! " আমি বেশ অবাক হয়েই বললাম, " তিনি তো প্রথম সারির একজন সার্জেন। চিনতেন নাকি আপনি তাঁকে?"
" হ্যাঁ, একসময় আমার সঙ্গে তাঁর খুবই জানাশোনা ছিল"।
" কিন্তু ওঁর বয়স তো আপনার মতো হয়নি...." আমি বললাম।
ভদ্রলোক এ'কথায় হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, " ওখানেই আপনার ভুল! " হাসি থামিয়ে তিনি বললেন, " আমার চাইতে উনি বয়সে কিছু বড়'ই হবেন। আমার শরীর ভেঙে পড়েছে, তাই বেশী বয়স দেখায়....নয়তো আমারও একসময় জোয়ান চেহারা ছিল। হ্যাঁ, বেশ ভাল রকমই জোয়ান চেহারা ছিল আমার"।
আমার দৃষ্টিতে বোধহয় অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠেছিল, তা লক্ষ্য করে ভদ্রলোক বললেন, " না, আমি আপনাকে ধোঁকা দিচ্ছি না। " তারপরই একটু মুচকি হেসে বললেন, " যদি অনাথ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়, তবে জিজ্ঞেস করবেন, রাঘব সামন্ত'র স্বাস্থ্য কেমন ছিল".... বলেই আবার হা হা করে হেসে উঠলেন।
বিশ্রী হাসি। আমার কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। রাত হয়ে যাচ্ছে বলে উঠে পড়লাম।
এরপর থেকে রাঘব সামন্ত মাঝেমাঝেই আমার চেম্বারে আসতেন। ভিড় থাকলে এক কোণে চুপ করে বসে থাকতেন। সবাই চলে যাওয়ার পর আমার মুখোমুখি বসে শুরু করতেন নানান কথা। একদিন হঠাৎ আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, " আচ্ছা, আপনারা তো হাল আমলের ডাক্তার, আপনাদের সময় কাটা-ছেঁড়ার জন্য ডেডবডির বোধহয় তেমন অভাব ছিল না"? তারপর নিজেই সে প্রশ্নের জবাব দিলেন, " হবেই বা কি করে, আজকাল কথায় কথায় লোকে ছুরি চালায়, বোমা মারে। মানুষ মারা এখন ডালভাত হয়ে গেছে। ডেডবডির অভাব নেই, অনেক ক্ষেত্রেই সেসব বডির কোনও দাবিদার থাকে না , ফলে মেডিকেল স্টুডেন্টদের সুবিধেই হয়েছে। আমাদের সময় এত খুনজখম ছিল না, ডেডবডিও ছড়িয়ে পড়ে থাকত না। রীতিমতো সমস্যা ছিল ডেডবডি পাওয়া, মাঝেমাঝে ডিসেকশন বন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হত"।
♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦
শরতের মাঝামাঝি রাঘব সামন্ত মারা গেলেন। সেবারেও মেসের ছোকরা চাকর সকালবেলার চা নিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে কোনও সাড়া না পেয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দ্যাখে, ভদ্রলোক মাটিতে চিত হয়ে পড়ে আছেন। মুখটা একটু হাঁ করা, কয়েকটা মাছি ভনভন করছে মুখের সামনে।
আমি চেম্বারে আসতেই আমার ডাক পড়ল মেসে। এবার কিন্তু আর ভুল ছিল না, ভদ্রলোক মারাই গেছেন এবং করোনারি অ্যাটাকেই মৃত্যু হয়েছে। সার্টিফিকেট লিখে দিতে কোনও দ্বিধা করলাম না।
পরেরদিন মেসের মালিক আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাঁর হাতে একটা বড় পুরু লেফাফা। সেটা তিনি আমার হাতে দিলেন। আমি লেফাফার ওপর লেখাটায় চোখ বুলিয়ে অবাক হলাম। লেখা আছে -
'একান্ত ব্যক্তিগত, আমার মৃত্যুর পর এটা যেন ডাক্তার বিমল ব্যানার্জীকে দেওয়া হয়'।
বিমল ব্যানার্জী আমার'ই নাম। রাতে বাড়ি ফিরে আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে রাঘব সামন্ত'র লেফাফাটা খুললাম। আমার স্ত্রী সুষমা, দিন কয়েকের জন্য বাপের বাড়ি গেছে।
প্রথমেই একটা চিঠি।
প্রিয় ডাঃ ব্যানার্জী,
আপনি হয়তো ভেবে অবাক হচ্ছেন, এত লোক থাকতে আপনাকেই কেন আমি আমার জবানবন্দি শোনাবার জন্য বেছে নিলাম। আসলে, সত্যিই একদিন আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। যদি আমার জীবনে ওলোটপালট না হতো কিংবা যদি ডাঃ অনাথ চৌধুরী আমার জীবনে শনি হয়ে দেখা না দিত, তবে হয়ত আজ আমি একজন সফল ডাক্তার হিসেবে মানুষের জীবন বাঁচাবার মহৎ প্রচেষ্টায় ব্যস্ত থাকতাম। কিন্তু শনি আর রাহু এই দুয়ের মিলন ঘটেছিল আমার ভাগ্যের ঘরে, তাই....যাক সে কথা। আপনাকে দেখে আমার জীবনের স্বপ্নের কথা মনে পড়েছে, আপনাকে কেন জানি ভাল লেগেছে। তাই আমার জীবনের বিচিত্র কাহিনী আপনার হাতে দিয়ে গেলাম। যদি অবিশ্বাস হয়, তবে ডাঃ অনাথ চৌধুরীকে প্রশ্ন করতে পারেন, সেইসঙ্গে তার মানসিক প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করবেন। তবে সাবধান, তার পথ মাড়াবেন না। সে শুধু লোভী নয়, নিষ্ঠুর। কত বড় নিষ্ঠুর, তা এই কাহিনী থেকেই জানতে পারবেন।
আমার শুভেচ্ছা রইল,
ইতি
রাঘব সামন্ত
আমার কৌতূহলের লাগামটাকে যেন সামলাতে পারছি না। পাতা উলটে রাঘব সামন্ত'র জীবনের আসল কাহিনী পড়তে শুরু করলাম।
তাঁর নিজের জবানীতেই লেখা :
... সে আজ অনেক বছর আগের কথা, যদ্দূর মনে পড়ে, সালটা ছিল ১৯৪৪। দেশ তখনো স্বাধীন হয়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমি ডাক্তারি পড়ি। ছোটবেলা থেকে চট করে কিছু বুঝে নেবার ক্ষমতা ঈশ্বর আমায় দিয়েছিলেন। তার ওপর ছিলাম পরিশ্রমী, মাস্টারমশাইদের মান্য করে চলতাম, তাই সহজেই তাঁরা আমার প্রতি সদয় হতেন, সহজেই বিশ্বাস করতেন আমায়। ছাত্র হিসেবেও খারাপ ছিলাম না। আমি যে একদিন ডাক্তারি পাশ করে বেরোব, ডাক্তার হব, এ বিষয়ে মাস্টারমশাইদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না - আমার তো নয়ই।
ডাঃ পাল ছিলেন তখন অ্যানাটমি বিভাগের প্রধান। নামটা ইচ্ছে করেই আমি গোপন করলাম, কারণ তাঁর সেইসময় দারুণ খ্যাতি, এ কাহিনীর সঙ্গে তাঁকে আর জড়াতে চাই না। মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ ছিল পাশাপাশি। এই দুয়ের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে একটা সরু রাস্তা....অনেকদূর পর্যন্ত। সেই রাস্তার ওপরেই ছিল ডাঃ পালের দোতলা বাড়ি। তখন সেই রাস্তায় আর অন্য কোনও বাড়ি ছিল না। ডাঃ পালের বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বেরোলে হাসপাতালের পাঁচিল এবং খিড়কির দরজা দিয়ে বেরোলে মেডিকেল কলেজের পাঁচিল পড়ে। খিড়কির দরজার কয়েক হাত দূরে মেডিকেল কলেজের পাঁচিলের গায়ে একটা ছোট দরজা ছিল, ওই দরজা দিয়েই ডাঃ পাল নিয়মিত মেডিকেল কলেজে যাতায়াত করতেন। তাতে অনেকটা ঘুরপথ বেঁচে যেত। রাতে মেডিকেল কলেজের পাঁচিলের দরজার গায়ে তালা ঝুলত এবং তার চাবি থাকত ডাঃ পালের কাছে। ওই দরজা দিয়ে ঢুকে খানিকটা গেলে, বাঁ দিকে টিনের ছাউনির টানা লম্বা একটা ঘর। ওটাই অ্যানাটমির ক্লাসরুম। ওখানেই ক্লাস নিতেন ডাঃ পাল। মড়া কাটাছেঁড়া করে সার্জারিতে হাত পাকাত তরুণ সব ছাত্ররা - ভাবী কালের শল্যচিকিৎসক।
ডাঃ পালের বাড়িটা ছিল আসলে হাসপাতালেরই সম্পত্তি। মেডিকেল কলেজে পড়ানো ছাড়াও তিনি হাসপাতালের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত ছিলেন। অ্যানাটমির যাবতীয় দায়িত্ব, এমনকি কাটাছেঁড়া করে হাত পাকানোর জন্য মড়া যোগাড় করা-ও ছিল তাঁর দায়িত্ব। ডাঃ পাল অবশ্য নিজে মড়া যোগাড় করতেন না, এই কাজের জন্য তাঁর হাতে বেশ কিছু লোক নিযুক্ত থাকত, একটা খরচও বরাদ্দ ছিল, কিন্তু তাঁকে সবকিছুর হিসেব রাখতে হত।
আমি এইসময় ডাঃ পালের সুনজরে পড়ে গেলাম, তখন আমার সবে তৃতীয় বছর চলছে। অ্যানাটমি ক্লাসের সব দায়িত্ব আস্তে আস্তে তিনি আমার ওপর ছেড়ে দিতে লাগলেন। ক্লাসরুমের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, ছাত্রদের মধ্যে ঠিকমতো 'লাশ' ভাগ করে দেওয়া, ঠিকমতো হিসেব রাখা, যারা লাশের চালান নিয়ে আসে, তাদের পাই - পয়সা চুকিয়ে দেওয়া - এসবই তিনি আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন।
একটা কথা সর্বাগ্রে বলে রাখি। বৈধ পথে কাটা-ছেঁড়ার জন্য যে লাশ আমরা পেতাম, তা পর্যাপ্ত ছিল না, ফলে আমাদের প্রায়ই ' চোরা' পথে লাশ সংগ্রহ করতে হত এবং সে কাজও যথেষ্ট কঠিন ছিল। এসব চালান আসত গভীর রাতে। ডাঃ পালের খিড়কির দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে বুঝতে পারতাম, চালান এসেছে। যারা নিয়ে আসত, তাদের দিয়েই ডিসেকশান রুমে বডিটা নিয়ে গিয়ে, তাদের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে আবার পাঁচিলের দরজা বন্ধ করে দেবার কাজটা আমার ছিল। আরও একটা কথা বলে নেওয়া ভাল, যারা লাশ নিয়ে রাতের আঁধারে চুপিচুপি আসত, তাদের চেহারা একনজরে দেখেই বুঝতে অসুবিধে হত না যে, তারা মোটেও সুবিধের লোক নয়; অন্ধকার জগতের মানুষ। খুন, রাহাজানি - এসবই তাদের পেশা। প্রথম প্রথম আমার ভয় করলেও পরে ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া, দরদস্তুরের পর নিজেদের পাওনা টাকা পেয়ে যখন তারা আমায় সেলাম করত, তখন নিজেকে খুব শক্তিমান পুরুষ বলেই মনে হত।
ডাঃ পাল তাঁর বাড়ির একতলাটায় আমায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাঁর পরিবারে লোকজন কম থাকায় একতলাটা খালিই পড়ে থাকত, বিশেষ করে খিড়কির দরজার দিকের অংশটায় আমি ছাড়া আর কেউ থাকত না।
ব্যবস্থাটা যে আমার পক্ষে খুব সুখকর হয়েছিল, তা নয় মোটেও। শীতকালে গভীর রাতে কিংবা ভোর রাতে কড়া নাড়ার শব্দে আমায় বিছানা ছেড়ে উঠতে হত। ঘুম জড়ানো চোখে হাতড়ে হাতড়ে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলে বেরোতে হত। আমার সামনে কদর্য চেহারার গুন্ডাশ্রেণীর লোক, তাদের সঙ্গে রয়েছে ' মাল', যা দিয়ে সাজানো হবে শবব্যবচ্ছেদের লম্বা লম্বা টেবিল, শিক্ষানবিসী ছাত্ররা ওই ' মাল' কাটাছেঁড়া করে হাত পাকাবে, ভবিষ্যতে জীবিত মানুষের ওপর প্রয়োগ করবে আজকের অর্জিত বিদ্যা। যারা ' মাল' নিয়ে আসত, তাদের পয়সাকড়ি মিটিয়ে তাদের দিয়েই আমি ডিসেকশান রুমে ওগুলো তুলতাম। তারপর ওরা চলে গেলে আমাকে একা কিছুক্ষণ থাকতে হত ওই ঘরে, যেখানে পাশাপাশি সাজানো রয়েছে মৃতদেহ, আর বিরাজ করছে একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা, হয়তো বা কবরের নিস্তব্ধতা। মেডিকেল কলেজের প্রধান দালান থেকে ওটা ছিল বেশ খানিকটা দূরে, তাই নির্জনতাও ছিল যথেষ্ট। একা একা লাশগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার যে একটু গা ছমছম করত না, তা নয়, মনে হত, ওরা যেন সবাই আমায় লক্ষ্য করছে। তারপর একসময় ওই ঘরের তালা বাইরে থেকে লাগিয়ে আমি ফিরে আসতাম আমার ঘরে, নষ্ট ঘুম পুষিয়ে নিতে আশ্রয় নিতাম বিছানায়।
এইভাবে কাটছিল আমার দিন আর রাত। সাধারণ চোখে আমার তখনকার জীবন মোটেও ঈর্ষনীয় না হলেও দিনে - দিনে আমি অন্যান্য মেডিকেল স্টুডেন্টদের কাছে হিংসের পাত্র হয়ে উঠতে লাগলাম। ডাঃ পালের আমার প্রতি সদয় ভাবকে তারা পক্ষপাতিত্ব বলেই মনে করত। ছাত্রদের মধ্যে লাশ ভাগাভাগি করার সময় আমি যে একটু মাতব্বরি দেখাতাম না বা যারা আমার অনুগ্রহপ্রার্থী তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতাম না, এ'কথা বললে মিথ্যে বলা হবে।
দিনে-দিনে আমি ডাঃ পালের ডানহাত হয়ে উঠলাম। সেসময় আমি কেমন যেন বিবেকহীন, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক যুবক হয়ে উঠলাম। সবসময় নিজের আখের গোছানোটাকেই করনীয় মনে করতাম। এ ধরনের জীবনে প্রত্যেক মানুষই বেপরোয়া হয়ে ওঠে, আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। এদিকে,ডাঃ পালের কাছাকাছি থাকতে থাকতে আমি ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারলাম,তাঁর মতো ঘোর স্বার্থপর আর বিবেকবর্জিত মানুষ পৃথিবীতে আর দুটি নেই। সারা দিনের খাটুনির পর তিনি এমন সব বিশেষ বিশেষ জায়গায় যেতেন, যেখানে বিলিতি মদ এবং সুন্দরী রমণীর অভাব হত না। কতদিন যে তাঁকে মাতাল অবস্থায় আমি দরজার গোড়া থেকে উঠিয়ে তাঁর ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছি, তার হিসেব নেই। যাক সে অবান্তর কথা।
♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦
এদিকে ব্যবচ্ছেদের জন্য লাশ সংগ্রহ করা একটা ঘোর সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। অ্যানাটমির ক্লাসে স্টুডেন্ট সংখ্যা কখনো কম থাকত না। তাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে এক একেকটা দলকে একটি করে লাশ ভাগ করে দেওয়া হত। তারা পালা করে নিজেদের মধ্যে মৃতদেহের ওপর ছুরি চালাত কিন্তু তাতেও অনেক সময় চাহিদা মেটানো যেত না। ফলে মাঝেমাঝেই একটা বিচ্ছিরি, অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হত ক্লাসরুমে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের আরও বেশী করে বাইরের গোপন চালানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হচ্ছিল আর তার ফলও বিপজ্জনক হয়ে ওঠার মুখে দাঁড়িয়েছিল। মৃতদেহ চালানি সেইসব গুন্ডা লোকগুলো লাশ সংগ্রহের জন্য আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল যা সমাজের পক্ষে মোটেও শুভ নয়। ডাঃ পালের এ ব্যাপারে একটা নীতি ছিল, যারা মাল সরবরাহ করে আনে, তাদের কোনও প্রশ্ন করবে না। তারা কোথা থেকে লাশটা সংগ্রহ করেছে, কিভাবে করেছে, এ ব্যাপারে তাদের কিছু জিজ্ঞেস করা চলবে না। ওরা লাশ নিয়ে আসে, আমরা টাকা দিয়ে কিনি - ব্যস,শুধু এটুকু জানলেই হবে। দু'পক্ষই এতে লাভবান, তাই কোনও প্রশ্ন করা চলবে না।
' খুন করে লাশ নিয়ে আসা হয়েছে', এমন সম্ভাবনার কথা তাঁর সামনে পাড়লেই আতঙ্কিত হয়ে উঠতেন ডাঃ পাল। কিন্তু তাঁর কথাবার্তার হালকা ধরনই বুঝিয়ে দিত, তিনি এসব আলোচনায় মোটেও ইচ্ছুক নন। অনেক সময় আমি লাশ দেখে চমকে উঠতাম - একেবারে টাটকা মৃতদেহ, যেন সদ্য খুন করে আনা হয়েছে। যারা রাতের অন্ধকারে ওইসব মৃতদেহের চালান নিয়ে আসত, তাদের ভয়াবহ চেহারা দেখেও কতসময় শিউরে উঠতাম আমি। কিন্তু ডাঃ পালের এ ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত নীরবতা দেখে আমিও চুপ করে থাকাকেই শ্রেয় মনে করেছিলাম। আমার কাজ হল, যে বস্তুটা আনা হয়েছে,সেটা গ্রহণ করা, দাম চুকিয়ে দেওয়া আর মৃতদেহের গায়ে অপরাধের কোনও চিহ্ন দেখতে পেলে মুখ ফিরিয়ে থাকা। এ ব্যাপারে আস্তে আস্তে আমি পোক্ত হয়ে উঠতে লাগলাম।
কিন্তু পৌষ মাসের এক ভোররাতে আমার এই চুপ করে থাকা বা চোখ ফিরিয়ে রাখার চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়ে গেল। সে রাতের কথা আমি জীবনেও ভুলব না ...
২য় পর্ব
(রাঘব সামন্তের লেফাফার ২ য় অংশ)
... সেই রাতে দাঁতের যন্ত্রণায় ঘুম আসছিল না, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছটফট করছিলাম। রাত দুটোর পর একটু তন্দ্রা এল। ঘন্টাখানেক বোধ হয় ঘুমিয়েছিলাম, বেশ কয়েকবার জোর কড়া নাড়ার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। যে বা যারা কড়া নাড়ছে, তারা যে বেশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, বোঝাই যাচ্ছে। আকাশে চাঁদের পাতলা আলো, শীতের রাতে হিমেল হাওয়া বইছে, সারা শহর ঘুমিয়ে। যারা এসেছিল, তারা একটু দেরী করেই এসেছিল কিন্তু এখন চলে যাবার জন্য যেন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ঘুমে আমার চোখ ভেঙে আসছিল, তবু কোনরকমে উঠে গিয়ে দরজা খুলে তাদের সামনে দাঁড়ালাম। আমার চোখ থেকে ঘুমের রেশ তখনো মিলিয়ে যায়নি কিন্তু তার মধ্যেও বুঝতে পারলাম, লোকগুলো নিজেদের মধ্যে গজগজ করছে। লাশকাটা ঘরে বস্তা সমেত মালটা ওরা বয়ে নিয়ে গেল। একটা টেবিলে সেটাকে ফেলে বস্তাটা সরিয়ে নিতেই, ঘরের আলো এসে পড়ল ওটা'র মুখের ওপর, আর সঙ্গে সঙ্গে আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। দু'পা এগিয়ে একটু ঝুঁকে ভাল করে দেখে বললাম, " এ কি কান্ড! এ যে মালতী! "
যে লোকদুটো বস্তায় পুরে মৃতদেহটা এনেছিল তারা কোনও জবাব দিল না, কিন্তু যেন একটু সচকিতভাবে দরজার দিকে সরে গেল।
" আমি একে চিনি", আমি এবার বেশ জোর দিয়ে বলে উঠলাম, " বাংলাবাজারে এদের বাড়ি। সন্ধ্যাবেলাতেও আমি এর সাথে কথা বলেছি।" মেয়েটি যে আধা গেরস্ত, এবং ওর ওখানে আমার যাতায়াত ছিল, সেকথা আর লোকগুলোর সামনে খুলে বললাম না। শুধু বললাম, " সন্ধেবেলাতেও তো মালতী বেঁচে ছিল, কি করে ও এইটুকু সময়ের মধ্যে মারা গেল! তোমরা অন্যায়ভাবে এর লাশ এনেছ, কোনও অসুখবিসুখে ও মারা যায় নি"।
" আপনি ভুল করতাছেন কত্তা", লোকগুলোর একজন বলল, " আপনার দিষ্টিবেভ্যম হইছে"।
দ্বিতীয়জন বিচ্ছিরিভাবে আমার দিকে তাকিয়ে তাদের পাওনা টাকাটা দাবি করল।
লোকগুলোর কন্ঠস্বরে একটা অমঙ্গলজনক স্বর আমার কান এড়াল না, আমি ভয় পেলাম। এই নির্জন ঘরে আমাকে মেরে ফেলে রেখে গেলেও আমার কিছু করার থাকবে না, হয়তো পরদিন শবব্যবচ্ছেদের টেবিল শোভা করে আমিই অন্যান্য ছাত্রদের হাত পাকাবার বস্তু হয়ে দাঁড়াব। আমি আমতা আমতা করে কিছু একটা বললাম, তারপর তাদের নিয়ে চলে এলাম ডাঃ পালের বাড়িতে। ওদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ঘরের ভেতর থেকে গুণে গুণে টাকা এনে ওদের হাতে দিলাম। ওরা চলে যেতেই আমি তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম লাশকাটা ঘরে। মালতীর শরীরে কতগুলো মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন আমার চোখে পড়ল, আর আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম। আমার সন্দেহ তাহলে মিথ্যে নয়? কোনমতে পালিয়ে এসে আমি আমার ঘরে আশ্রয় নিলাম। পরে একটু ধাতস্থ হবার পর আমি পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। ডাঃ পালের উপদেশটা আমার মনে পড়ে গেল। আরো একটা কথা চিন্তা করলাম, যারা এই ব্যবসার সাথে জড়িয়ে আছে, আমি যদি তাদের বাধা হয়ে দাঁড়াই, তবে আমার পক্ষে সেটা খুব নিরাপদ হবে না। ওই শয়তানগুলো খুনে, নৃশংস। যাই হোক, পরের দিন এ ব্যাপারে ডাঃ পালের সহকারীর সঙ্গে কথা বলব, ঠিক করলাম।
ডাঃ পালের সহকারীটি একজন তরুণ ডাক্তার। নাম অনাথ চৌধুরী। চটপটে, চৌকস এই তরুণটি তখন ছাত্রমহলে খুব প্রিয়। চতুর, ফিটফাট আর উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির, কিন্তু কথার চটকে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করার অসাধারণ তার ক্ষমতা। দেশ-বিদেশেও ঘুরেছে, বিলেত থেকে ডাক্তারি পাশ করে এসেছে, তাই অল্প বয়সেই ছড়িয়ে পড়েছে নাম। তাছাড়া, নাটক, অভিনয়, খেলাধুলো - সব কিছুতেই চৌকস। ছাত্রদের সঙ্গে সমানে মিশে যাবার প্রবণতাই তাকে অত জনপ্রিয় করে তোলে।
আমার সঙ্গে তার যথেষ্ট দহরমমহরম ছিল। আগেই বলেছি, আমি ডাঃ পালের ডানহাত হয়ে উঠেছিলাম আর অনাথ চৌধুরী ছিল তাঁর সহকারী, সুতরাং কাজকর্মের ব্যাপারে আমাদের খুব কাছাকাছিই থাকতে হত। যখন শবব্যবচ্ছেদের জন্য লাশের জোগানে টান পড়ত, তখন আমাদের দুজনকেই শলা পরামর্শ করে একটা উপায় বের করতে হত। ডাঃ পালকে এ ব্যাপার নিয়ে আমরা বিব্রত করতে চাইতাম না, তিনিও আকারে ইঙ্গিতে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এইসব সামান্য ব্যাপার নিয়ে আমরা যেন মোটেও তাঁকে বিরক্ত না করি।
সেদিন ডাঃ অনাথ চৌধুরী একটু আগেই হাসপাতালে এসেছিল। আমি তাঁকে রাতের ঘটনা বললাম, আমার সন্দেহের কথা জানাতেও ভুল করলাম না। মালতীর মৃতদেহের ক্ষতচিহ্নগুলি পরীক্ষা করে অনাথ চৌধুরী ঘাড় দোলাল, বলল, " হুঁ, ব্যাপারটা সন্দেহজনক "।
" আমি এখন কি করব? - আমি প্রশ্ন করলাম।
" করবে?" ডাঃ চৌধুরী যেন আমার কথাটাকেই আওড়াল, " কিছু করতে চাও নাকি তুমি? কোন ব্যাপার নিয়ে যত কম ভাবা যায়, তত তাড়াতাড়ি সেটা মন থেকে মুছে যায়, এমন একটা প্রবাদবাক্য শুনেছিলাম যেন।
" কিন্তু মেয়েটিকে কেউ চিনে ফেলতে পারে", আমি প্রতিবাদ না করে পারলাম না, " আমার মতো অনেকেই ওর চারপাশে ঘুরঘুর করত"।
" আমরা আশা করব, যে কেউ ওকে সনাক্ত করবে না", জবাব দিল ডাঃ অনাথ চৌধুরী, " তবে কেউ যদি মেয়েটিকে চিনেই ফেলে....তুমি তাকে চিনতে পারোনি....ব্যস, ল্যাঠা চুকে গেল। আসল ঘটনা হল, এ ধরনের ঘটনা অনেকদিন ধরে চলে আসছে। তুমি এ নিয়ে যদি নাড়াচাড়া কর, তবে ডাঃ পাল'কে ভয়ানক ঝঞ্ঝাটে ফেলা হবে। তুমি নিজেও জড়িয়ে পড়বে....মানে, লাশ যোগান দেবার ব্যাপারে একটা চক্র আর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তুমি, আমি - সবাই জড়িয়ে পড়ব। যদি আদালতে সাক্ষীর কাঠগোড়ায় আমাদের দাঁড়াতে হয়, তবে জেরার মুখে কি অবস্থা হবে আমাদের? তাছাড়া কাগজে কাগজে ফলাও করে সবকিছু ছাপা হলে, কি চোখে লোকে আমাদের দেখবে, সেটাও ভেবে দেখতে হবে তোমায়। খাপ্পা হয়ে উঠবে না আমাদের ওপর? তবে সত্যি কথাই যদি জানতে চাও,আমাদের বেশীরভাগ লাশই খুন - জখমের লাশ"।
" ডাঃ চৌধুরী! " আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।
" আ-হা!" অনাথ চৌধুরী আমায় প্রায় খিঁচিয়ে উঠল, " যেন তুমি নিজে ব্যাপারটা সন্দেহ করনি! এমন ভান করছ যেন নতুন জানছ। যত্তোসব, হুঁ!"
" সন্দেহ করা এক জিনিস....."
" আর প্রমাণ করা অন্য জিনিস", বলল ডাঃ চৌধুরী, " হ্যাঁ, তা জানি আমি। এই মেয়েটার বডি'টা এখানে এসে তোমায় বড় ভাবিয়ে তুলেছে বুঝতে পারছি...." বলতে বলতে ছড়ি দিয়ে মালতীর নিশ্চল মৃতদেহটাকে মৃদু আঘাত করতে থাকে অনাথ চৌধুরী। তারপর আবার বলতে লাগল, " সবচেয়ে ভাল হল, এটা'কে না চেনার ভান করা, তাই করা উচিত তোমার। অবশ্য তোমার যদি মন চায় তাহলে স্বীকার করতে পারো, একে তুমি চিনতে। আমি তোমায় উপদেশ দিতে চাই না, কিন্তু আমার মনে হয়, যে কোনও বুদ্ধিমান মানুষই আমার পথে চলবে। তবে এ'কথাও বলে রাখি, ডাঃ পাল নিজেও হয়তো চাইবেন যে, আমরা এই পন্থা গ্রহণ করি। তিনি কেন আমাদের দুজনকেই সহকারী হিসেবে বেছে নিয়েছেন, সে কথাও ভেবে দ্যাখো। নিশ্চয়ই মুখ দেখে তা করেননি, আমাদের কাজকর্মে তাঁর আস্থা জন্মেছিল, এ ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা আমরা করতে পারব বলেই তিনি আশা করেন"।
এরপর এই বিষয়টা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, তা বুঝতে আমার দেরী হল না। তাছাড়া নিজের ভবিষ্যৎ আমায় ভাবতে হবে না!
মালতীর দেহটা কাটাছেঁড়া হয়ে গেল, কেউ তাকে নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুলল না, আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
৩য় পর্ব
( রাঘব সামন্ত'র লেফাফা'র ৩ য় অংশ)
এরপর থেকে ডাঃ অনাথ চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। একদিন সন্ধের পর আমি নবাবপুরে একটা রেস্তোরাঁয় গিয়েছি। একটা টেবিলে দেখলাম, ডাঃ চৌধুরী একজন লোকের সঙ্গে বসে আছে। ছোটখাটো চেহারার একজন লোক, গায়ের রং ফ্যাকাসে, চোখদুটো কয়লার মতো কালো। লোকটির বেশভূষা এবং চালচলন দেখে তাকে অতি সাধারণ এবং গেঁয়ো মানুষ ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। লোকটির চেহারায় রুক্ষতাই ফুটে উঠেছে, কিন্তু ডাঃ চৌধুরীর মতো একজন প্রতাপশালী এবং চৌকস মানুষের ওপর তার হম্বিতম্বি দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। ডাঃ চৌধুরীকে'ও মনে হল, লোকটির হুকুম তামিল করার জন্য সদা তৎপর। কথায় কথায় লোকটি ডাঃ চৌধুরীকে ধমকাচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে চৌধুরী হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকল, আমি কাছে যাবার পর সেই লোকটির সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিল। জানতে পারলাম, লোকটির নাম গোবিন্দ বসাক। তার সন্মন্ধে আর কিছু অবশ্য চৌধুরী খুলে বলল না, আমার কৌতূহল সত্ত্বেও আমাকে চুপ করে থাকতে হল। গোবিন্দ বসাক কিন্তু কেন জানি না , হঠাৎ আমার প্রতি খুব সদয় হয়ে উঠল। রেস্তোরাঁর একজন ছোকরাকে ডেকে আমার জন্য মুর্গির মাংস আর পরোটার হুকুম দিল। তারপর এই অল্প পরিচয়েই আপনা থেকে নিজের বিগত জীবন সম্পর্কে বলে গেল অনেক কথা। তার বক্তব্যের দশ ভাগের এক ভাগ'ও যদি সত্যি হয়, তবে সে যে একটি পাষণ্ড এবং আস্ত বদমাশ - সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। নিজের দুষ্কর্মের কাহিনী শোনাতে শোনাতে তার চোখেমুখে ফুটে উঠছিল গর্বের ছাপ।
" আমি খুব খারাপ লোক", গোবিন্দ বসাক বলতে লাগল, " কিন্তু চৌধুরীর কাছে শিশু। ও হল সাক্ষাৎ শয়তান.....আমি ওর নাম দিয়েছি শয়তান চৌধুরী। ওহে শয়তান, তোমার বন্ধুর জন্য আরও এক প্লেট মাংসের অর্ডার দাও না.....শয়তান কিন্তু মনে মনে আমায় ঘেন্না করে....." তারপরই চৌধুরীর দিকে ফিরে বলল, " হ্যাঁ গো শয়তান বাবু, আমি জানি তুমি আমায় মনে মনে ঘেন্না কর"।
" একদম আমাকে ওই বিচ্ছিরি নামে ডেকো না!" চাপা গর্জন করে উঠল ডাঃ চৌধুরী।
" শোনো ওর কথা.....", গোবিন্দ বসাক হো হো করে হেসে উঠল। তারপর হাসি থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, " ছুরি মারামারি দেখেছেন কখনো? আমার সমস্ত শরীরে ছুরির কোপ বসাতে পারলে ও খুশিই হবে"।
" আমরা যারা ডাক্তারি পড়ি, তাদের অন্য উপায় আছে", আমি এবার মন্তব্য না করে পারলাম না, " আমরা যাকে পছন্দ করি না, তাকে ফালা ফালা করে কাটাছেঁড়া করি"।
চৌধুরী মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল, ওর দু'চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি!
বেশ অনেকক্ষণ আমরা ওই রেস্তোরাঁয় কাটালাম। গোবিন্দ বসাক নিজেও কয়েকবার এটা ওটা খাবারের অর্ডার দিল, চৌধুরীকেও সমানে হুকুম করল মুখরোচক খাবার অর্ডার দেবার। মাঝখান থেকে আমার ভুরিভোজটা ভালই হল। আমরা যখন উঠব উঠব করছি, রেস্তোরাঁর ছোকরাটি মোটা একটা বিল এনে আমাদের টেবিলে রাখল। ওটাতে চোখ না বুলিয়েই বসাক আঙুলে টোকা মেরে ওটা ডাঃ চৌধুরীর দিকে ঠেলে দিল। আমি দেখলাম, চৌধুরীর মুখটা যেন অন্ধকার হয়ে গেল। প্রচণ্ড রাগ আর বাধ্যতা এই দুই পরস্পরবিরোধী অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তার মুখে। অতগুলো টাকা ওকে একা দিতে হবে, এটা যেন সে বরদাস্ত করতে পারছে না; কিন্তু বসাকে'র মুখের ওপর প্রতিবাদ করারও সাহস নেই।
সেদিন ফিরতে একটু রাতই হল। ডাঃ অনাথ চৌধুরী আর গোবিন্দ বসাক ধরল এক রাস্তা আর আমি ধরলাম অন্য রাস্তা। পরদিন চৌধুরী ক্লাসে কিংবা হাসপাতালে এল না। আমি মনে মনে হাসলাম, গতকাল রাতের টাকার শোক এখনো ভুলতে পারেনি ও। কিংবা হয়তো গোবিন্দ বসাকের সঙ্গে কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। গোবিন্দ যেভাবে ওকে হুকুম তামিল করছিল, হুকুম তামিল করতে একটু দেরী হলে যেভাবে তিরিক্ষি মেজাজ করে উঠছিল, তা থেকেই আমি ধরেই নিয়েছি, ভেতরে কোনও ব্যাপার আছে। হয়তো ডাঃ চৌধুরীর অনেক কু-কীর্তির কথা গোবিন্দ বসাক জানে, তাই ডাঃ চৌধুরীকে সবসময় ওর কাছে তটস্থ হয়ে থাকতে হয়।
সেদিন সন্ধের পর আমি আবার ওদের দুজনের খোঁজে গতকাল রাতের রেস্তোরাঁয় হানা দিলাম কিন্তু আজ আর ওদের দেখা পেলাম না। আরো কয়েকটা সৌখিন রেস্তোরাঁয় উঁকি মেরে দেখলাম, ওরা নেই। আমি আর রাত করলাম না, ফিরে এলাম। ভোররাতের দিকে, সুপরিচিত সেই কড়া নাড়ার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলেই আমি ' থ'। ডাঃ চৌধুরী তার পুরনো মডেলের ঝরঝরে অস্টিন গাড়িটা এনে দাঁড় করিয়েছে ওই গলির মধ্যে, একেবারে খিড়কি দরজার সামনে। আমি দরজা খুলতেই সে গাড়ির ভেতর থেকে একটা বস্তা টেনে বের করল - আমার পরিচিত বস্তা।
" কি ব্যাপার!" আমি একটু চেঁচিয়েই উঠলাম, " আপনি একাই মালে'র খোঁজে বেরিয়েছিলেন? একা সামলালেন কি করে?"
ডাঃ চৌধুরী যেন ধমক দিয়ে আমায় থামিয়ে দিল, তারপর মেডিকেল কলেজের পাঁচিলের গায়ের দরজাটা খুলতে বলল। দরজার তালা খোলবার পর ভারী বস্তাটা দুজনে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেলাম। বস্তাটা টেবিলের ওপর রাখার পর চৌধুরী চলে যাবার জন্য ফিরল, তারপর একটু ইতস্তত করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, " তুমি বরং মুখটা একবার দেখে নাও। হ্যাঁ, মুখটা তুমি একবার দেখেই নাও...." শেষের কথাটা যেন নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করেই বলল সে।
" কিন্তু কোথায় এটা পেলেন? কেমন করে? কখন? "... আমি না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।
" ওটা'র মুখটা দেখ!" কঠিন, শান্ত গলায় জবাব এল।
আমার কেমন ভয় করতে লাগল। ডাঃ চৌধুরী অমন করছে কেন! আমি একবার তার মুখের দিকে, আরেকবার বস্তাটার দিকে তাকাতে লাগলাম। তারপর একসময় বস্তাটা কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলতেই টেবিলের ওপর যে নগ্ন দেহটা আমার চোখের সামনে জেগে উঠল, সেটা দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। এক রাত আগে যার সঙ্গে রেস্তোরাঁয় বসে খানাপিনা আর গল্প করেছি, সেই গোবিন্দ বসাকের লাশ আমার সামনে। চোখদুটো আধবোজা, মুখে কেমন একটা বিকৃত হাসি, বীভৎস সে দৃশ্য। আমি চৌধুরীর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না, আতঙ্কে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল।
চৌধুরীই পেছন থেকে এসে আমার কাঁধে একটা হাত শক্তভাবে রেখে বলল, " কমল নাথ'কে মাথাটা দিও"।
কমল নাথ আমারই মতো একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট, ব্যবচ্ছেদের জন্য অনেকদিন ধরেই একটা মাথা দাবি করে আসছিল।
আমি কোনও জবাব দিতে পারলাম না। খুনি ডাক্তার আবার বলল, " এবার লেনদেনের ব্যাপারটায় আসা যাক। মালের জন্য তোমাকে টাকা দিতে হবে, তোমার হিসেবপত্তর ঠিক রাখতে হবে তো?"
আমি এবার কোনওমতে আমার ভাষা খুঁজে পেলাম। বললাম, " টাকা দিতে হবে! এরজন্য আপনাকে টাকা দিতে হবে?!"
" নিশ্চয়ই!" জবাব দিল ডাঃ চৌধুরী, " আমি এমনিতে একটা 'মাল' তোমায় গছাতে পারি না, আর তুমিও বিনামূল্যে ওটা নিতে পারো না; আমাদের দুজনের পক্ষেই সেটা সন্দেহজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। ভাল কথা, টাকাপয়সা কোথায় থাকে?"
আমি অনেকটা পুতুলের মতো তাকে নিয়ে আমার ঘরে ফিরে এলাম। টিনের ক্যাশবাক্সটা আঙুল দিয়ে দেখালাম। চৌধুরী ডান হাতটা বাড়িয়ে বলল, " চাবিটা দাও..."
আমি এক মূহুর্ত দ্বিধা করলাম, তারপর ক্যাশবাক্সের চাবিটা তুলে দিলাম তার হাতে। মনে হলো এতক্ষণে চৌধুরী যেন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। হিসেবের খাতাটা একটা ছোট টেবিলের ওপর ছিল। সেটা খুলে সে আমার সামনে ধরল, তারপর চাবি দিয়ে ক্যাশবাক্সটা খুলে মালে'র দাম বাবদ যা হওয়া উচিত, তা বের করে নিয়ে বলল, " পাওনা টাকা তুমি মিটিয়ে দিলে - এটা হলো তোমার ওপর যে বিশ্বাস করা যায়, তার মর্যাদা তুমি রেখেছ। তোমার নিরাপত্তার প্রথম সিঁড়ি হল এটা। এবার দ্বিতীয় ধাপ পার হতে হবে তোমায়। খরচের হিসেবটা খাতায় লিখে নাও। শয়তানও তোমার মাথার চুল ছুঁতে পারবে না"।
পরের কয়েক মূহুর্ত আমার মনের মধ্যে যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। স্বার্থপর এবং উচ্চাভিলাষী হলেও তখনো পর্যন্ত বিবেক একেবারে বিসর্জন দিইনি, কিন্তু সেই মূহুর্তে চৌধুরীর প্রস্তাবের বিরোধিতা করার মতো মনের জোর আমার ছিল না। তাছাড়া তার কথামতো না চললে আমারও যে বিপদ হতে পারে, এমন একটা সূক্ষ্ম অনুভূতি আমায় সাবধান করে দিল। খাতায় চটপট লেনদেনের হিসেবটা লিখে রাখলাম।
" চমৎকার! " আমায় যেন উৎসাহ দিয়ে চৌধুরী বলল, " পুরস্কারের টাকাটা তোমারই পাওয়া উচিত। আমার পাওনা আমি পেয়ে গেছি"। এই বলে অর্থপূর্ণ ভাবে সে হাসল। তারপর টাকাটা তুলে দিল আমার হাতে। ক্যাশবাক্সের চাবিটা আমায় ফিরিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগল, " সংসারে কোন মানুষের হাতে হঠাৎ যদি কিছু টাকা এসে পড়ে....তোমায় একথা বলছি বলে অবশ্য কিছু মনে কোরো না....মানে, এসব ক্ষেত্রে একটা আচরণবিধি মেনে চলার নিয়ম আছে। খানাপিনা, নতুন নতুন জিনিসপত্র কেনা, পুরনো দেনা শোধ করা....এসবের ধারকাছ দিয়েও যেতে নেই। কারণ তা করলেই পাড়া পড়শি, চেনাজানা মানুষ, সন্দেহ করতে শুরু করবে। কোথা থেকে টাকা আসছে, কিভাবে আসছে - নানারকম প্রশ্ন করতে শুরু করে দেবে। তাই যত ইচ্ছে ধার কর কিন্তু কখনো ধার দিও না"।
" ডাঃ চৌধুরী! " আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, " আপনাকে অনুগ্রহ করতে গিয়ে শেষটায় আমি ফাঁসির দড়ি গলায় পড়লাম! "
" আমাকে অনুগ্রহ করার জন্য?" অনাথ চৌধুরীর গলায় যেন এবার ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল, " বেশ মজার কথা বলেছ তো! আমি তো দেখতে পাচ্ছি, তুমি নিজেকে বাঁচাবার জন্যই আমার কথামতো কাজ করেছ। ধর, আমি যদি ঝামেলায় পড়ি, তুমিও কি রেহাই পাবে ভেবেছ? আজকের এই ছোট দ্বিতীয় ঘটনাটি প্রথম ঘটনাস্রোতেরই একটি গতি। গোবিন্দ বসাক হল মালতী'র অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা। একবার শুরু করে তুমি থামতে পারবে না। শুরু করেছ কি তোমায় চালিয়ে যেতে হবে, এর মাঝামাঝি কোনও পথ নেই"।
আমার চোখের সামনে সবকিছু যেন অন্ধকার হয়ে এল। একটা ভয়ানক ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েছি আমি, এর থেকে উদ্ধারের আর দ্বিতীয় পথ নেই।
" হা ভগবান! " আমি সখেদে বলে উঠলাম, " আমি কি এমন অন্যায় করেছি যার জন্য আমায় এমন মূল্য গুণতে হচ্ছে? শুরুই বা করলাম কখন? "
" কি ছেলেমানুষি করছ, সামন্ত?" - চৌধুরী মৃদু ধমকের সুরে বলল আমায়, " কি ক্ষতি হয়েছে বলো তো তোমার? তুমি যদি বাইরে কারোর সামনে এ ব্যাপারে মুখ না খোলো, তবে কি ক্ষতি হবে তোমার? জীবন সন্মন্ধে কোনও ধারণাই দেখছি তোমার। পৃথিবীতে দু'ধরনের মানুষ আছে - সিংহ আর মেষশাবক। যদি তুমি মেষশাবক হও, তবে আর পাঁচটা মড়ার মতো তোমারও স্থান হবে ওই লাশকাটা ঘরের টেবিলে; আর যদি তুমি সিংহ হও, তবে আমার, ডাঃ পালের কিংবা পৃথিবীর সব সাহসী পুরুষদের মতো তুমিও গাড়ি চাপবে, জীবনটা উপভোগ করবে, বুঝেছ হাঁদারাম? প্রথম ধাক্কাতেই তুমি টাল সামলাতে পারছ না। তুমি ভাগ্যবান তাই তো ডাঃ পালের সুনজরে পড়েছ, তা ভেবে দেখেছ কি? সূত্রগুলো তুমি ঠিক ঠিক ঠাণ্ডা মাথায় অনুসরণ করবে, এটাই তিনি আশা করেন তোমার কাছ থেকে। আর একথাও তোমায় আজ বলছি, আজ থেকে তিনদিন পর আজকের কথা ভেবে তুমি নিজেই লজ্জা পাবে, আমি বাজি রেখে বলতে পারি"।
অনাথ চৌধুরী আর অপেক্ষা করল না। অন্ধকার থাকতে থাকতেই তার সেই ঝরঝরে গাড়িটা নিয়ে চলে গেল। একা একা আমি নিজের অবস্থাটা ভেবে দেখার চেষ্টা করলাম। নিজের দূর্বলতার জন্য নিজেকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না আমার। চৌধুরীকে সুবিধে দিতে দিতে এত বাড়িয়েছি যে তার ভাগ্য আমার হাতের মুঠোয় না এসে আমিই তার কেনা গোলাম হয়ে গেছি। আমার অবস্থা এখন দাঁড়িয়েছে যেন : অন্যায় যতই ঘটুক না কেন, আমায় এমনভাবে চলতে হবে, যেন সেটাই ন্যায়। হিসেবের খাতায় সেই সর্বশেষ লেখাটাই বন্ধ করে দিল আমার মুখ।
... একসময় দিনের আলো ফুটল, ঘন্টা গড়িয়ে গেল, শুরু হল ক্লাস। গোবিন্দ বসাকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছাত্রদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হল, তারাও কোনও প্রশ্ন তুলল না। মাথা'টা পেয়ে খুশী হল কমল নাথ। দু'দিন ধরে লাশ কাটাছেঁড়ার ওপর আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলাম। যতই কাটাছেঁড়া হচ্ছে, ততই ওটাকে চেনার সম্ভাবনা কমে আসছে, আর আমারও মনে সাহস ফিরে আসছে।
তৃতীয় দিন অনাথ চৌধুরী এল ক্লাসরুমে। এই দু'দিন নাকি ওর অসুখ করেছিল। প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে দু'দিনে যে সময় নষ্ট হয়েছে, তা উশুল করে দেবার জন্য যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টেবিলে টেবিলে ঘুরে সে নির্দেশ দিতে লাগল ছাত্রদের - অক্লান্ত কর্মীর মতো। বিশেষ করে কমল নাথকে সাহায্য করার জন্য যেন বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। তার কাছ থেকে অযাচিত উৎসাহ পেয়ে কমল নাথেরও উদ্দীপনার শেষ নেই। নানান কোণ থেকে সে মাথাটায় ছুরি চালিয়ে পাকাতে লাগল হাত।
সপ্তাহটা শেষ হবার আগেই চৌধুরীর ভবিষ্যৎবাণী ফলে গেল। আমি ভয় কাটিয়ে উঠলাম। মনে মনে একটা গর্ব অনুভব করলাম। চৌধুরীর কথামতো সিংহের দলেই ভিড়েছি আমি। চৌধুরীর সঙ্গে ক্লাসে দেখা হল কিন্তু সে রাতের ঘটনা নিয়ে আমরা কেউ উচ্চবাচ্যও করলাম না।
ঠিক এইসময়েই ঘটল ঘটনাটা.......
মাল সরবরাহে হঠাৎ টান পড়ল, অ্যানাটমির ক্লাস প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হল, ছাত্রদের মধ্যে দেখা দিল মৃদু অসন্তোষ। ডাঃ পাল উদ্বিগ্ন হলেন। তিনি আমাকে আর চৌধুরীকে ডেকে এ ব্যাপারে তাঁর দুশ্চিন্তার কথা জানালেন। ঠিকমতো ' মাল' না পাওয়া গেলে ছাত্রদের প্রাকটিস চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না, তাঁর কাছে কলেজ কর্তৃপক্ষ কৈফিয়ত চেয়ে বসবেন। ডাঃ পাল এ ব্যাপারে আমাদের তৎপর হতে বললেন।
আমরাও চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আসলে পুলিশ সেইসময় একটা ঘটনায় বেশ কিছু গুন্ডাকে আটক করেছিল। যারা গভীর রাতে ' মাল' নিয়ে আসত, তাদের হঠাৎ পুলিশ কোনও একটা ঘটনায় গ্রেপ্তার করে, তার ফলেই ' মাল' সরবরাহে এই অচলাবস্থা। আমি আর চৌধুরী শলাপরামর্শ করতে লাগলাম, একটা উপায় আমাদের বের করতেই হবে। ঠিক এমন সময় শহর ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা দূরে একটা খুব পুরনো কবরখানার সন্ধান এল আমাদের কাছে। ওটার চারপাশে নাকি জঙ্গল, অনেকটা পরিত্যক্ত। খুব কাছের গাঁয়ের কিছু পুরনো মানুষ ছাড়া ওটা কেউ এখন আর ব্যবহার করে না, একটা নতুন কবরখানা অন্যদিকে হয়েছে, সেখানেই যায়। আরও যে খবরটা আমাদের কাছে এল, তা হল, খালেদ মিঞা নামে এক বুড়ো চাষীর বউ বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেছে। মাত্র গতকালই তাকে ওই পুরনো কবরখানায় গোর দেওয়া হয়েছে।
খবরটা শুনে আমি আর চৌধুরী পরামর্শ করলাম, এ সুযোগ হাতছাড়া করা চলবে না।
সেদিনই সন্ধের পর চৌধুরীর ঝরঝরে গাড়িতে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
শহর ছাড়িয়ে বেশ অনেকটা দূরে সেই কবরখানা। ওখানে পৌঁছে কাজ শেষ করে আবার ফিরে আসতে অনেক রাত হয়ে যাবে। শহরের শেষ সীমানায় চৌধুরী গাড়ি থামিয়ে একটু অন্ধকার দেখে রাস্তার পাশে গাড়ি রাখল। গাড়ির পেছনের সিটের পায়ের কাছে ছিল শাবল আর কোদাল, আর ছিল চটের বস্তা। যাতে কারোর চোখে না পড়ে, তাই অন্ধকারে গাড়িটা রাখল চৌধুরী। আমরা রাস্তার ওপাশে একটা হোটেলে ঢুকলাম। রাতের খাওয়াটা সেরে নেওয়াই ভাল, নাহলে রাতে পেটে কিছুই পড়বে না।
মাংস আর পরোটার অর্ডার দিয়ে চৌধুরী পকেটে হাত ঢোকাল, তারপর একমুঠো টাকা বের করে আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, " সেদিন আমার সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য এই সামান্য উপহারটুকু গ্রহণ করো"।
আমি টাকাটা পকেটে পুরে বললাম, " আপনি একজন দার্শনিক। আপনি ঠিক কথাই বলেছিলেন, তিনদিন পর আমি আর ওই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না হওয়া পর্যন্ত আমি একটা বুদ্ধু ছিলাম। আপনি আর ডাঃ পাল - আপনারাই আমাকে সত্যিকার মানুষ বানিয়ে ছাড়বেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আপনাদের নজরে পড়েছিলাম "।
" তা আর বলতে!" চৌধুরী জবাব দিল, " মানুষ তোমাকে আমরা না বানিয়েই ছাড়ব না। আর তাই যদি বলো, সেদিন আমার পাশে দাঁড়াবার জন্য একজন সাহসী মানুষই আমার দরকার ছিল। প্রকাণ্ড চেহারার অনেক মানুষই ওই দৃশ্য দেখে মুর্ছা যেত, কিন্তু তোমার বেলায় তা হয়নি- তুমি মাথা ঠিক রেখেছিলে। আমি লক্ষ্য করছিলাম তোমায়"।
" মাথা কেন ঠিক রাখব না?" আমি বেশ গর্বের সঙ্গেই জবাব দিলাম, " ওসব আমার কাছে কোন ব্যাপার নয়, তাছাড়া আপনাকে সাহায্য করার জন্য আপনি চিরকাল আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন, সেটাও কম কথা নয়"।
কথাটা বলে আমার মনে হল, আমার কথায় ডাঃ চৌধুরীর কপাল যেন কুঁচকে উঠল, চোখদুটো ছোট ছোট করে তাকাল আমার দিকে। আমি ততক্ষণে বাচাল হয়ে উঠেছি। গলায় অহঙ্কার ফুটিয়ে বললাম, " আসল কথা হল ভয় না পাওয়া। ফাঁসিকাঠে আমি ঝুলতে চাই না, এ'কথা সত্যি কিন্তু সবসময় ন্যায় পথে চলব, ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখব - এসব আদর্শের বুলি আমার কাছে উপহাস বলেই মনে হয়। আপনার - আমার মতো সাহসী মানুষদের জন্যই এই জগৎ"।
হোটেলের টাকা মিটিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
আবার শুরু হলো আমাদের যাত্রা। রাস্তা ক্রমে নির্জন হয়ে এল, আকাশে আধখানা চাঁদ, তার স্বল্প আলোয় তেমন অসুবিধে হচ্ছিল না। অবশেষে কবরখানার সামনে এসে আমরা পৌঁছলাম। কবরখানার চারদিকে জঙ্গল, একটা পুরনো জীর্ণ মসজিদ আর তার লাগোয়া কবরখানা। মসজিদে এখন কেউ থাকে না, কবরখানার মতো ওটাও এখন পরিত্যক্ত।
কবরখানার সামনে একটা সুবিধেমতো জায়গা দেখে আমরা গাড়িটাকে দাঁড় করালাম। তারপর গাড়ি থেকে দরকারী জিনিসপত্রগুলো বের করে আনলাম - একটা টর্চ, একটা লন্ঠন, শাবল, কোদাল আর বস্তা।
আধখানা চাঁদের আলো যেন এক ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। টুঁ শব্দটি নেই কোথাও, চারদিকে কবরের নিস্তব্ধতা। একটা কাঠের ভাঙা গেট পেরিয়ে কবরখানায় ঢুকলাম আমরা। বড় বড় ঘাস হয়েছে চারিদিকে, সাপ থাকাও বিচিত্র নয়। সন্তর্পণে পা ফেলে, লণ্ঠন আর টর্চের আলোয় আমরা পথ করে এগোচ্ছিলাম। বড় বড় গাছের ছায়া চাঁদের আলো'কে ঢেকে ফেলে এক এক জায়গায় সৃষ্টি করেছে নিরন্ধ্র অন্ধকার। আমার গা ছমছম করে উঠল। মনে হল, সারি সারি কবরের তলা থেকে চিরনিদ্রিত মানুষগুলো আমাদের এই গোপন অভিসার লক্ষ্য করছে। আমরা তাদের শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছি, অবৈধভাবে প্রবেশ করেছি তাদের সংরক্ষিত এলাকায়, সেটা তারা পছন্দ করছে না।
চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে নির্বিকার। আমার সাহস ফিরে এল। নতুন কবরটা বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। বেশীরভাগ কবরই বড় বড় ঘাসে ঢাকা পড়েছে, কিন্তু এটা যেন সদ্য তৈরি, তাই ঘাস পরিষ্কার করা হয়েছে, সহজেই চোখে পড়ে।
লণ্ঠনটা নামিয়ে রেখে আমরা দুজনে মাটি কোপাতে শুরু করলাম। নরম মাটি, সবে খোঁড়া হয়েছিল, তাই তাড়াতাড়ি গর্তটা বড় হতে লাগল। পরিশ্রমে আমাদের শরীরে নামল ঘামের বন্যা। তারপর একসময় কফিনটা আমাদের চোখে পড়ল। খুব সাবধানে চারপাশে গর্ত করে কফিনের দু'দিক শক্ত মুঠোয় ধরে ওটাকে মাটির ওপর উঠিয়ে নিয়ে এসে রাখলাম। শাবলে চাপ দিয়ে কফিনের ঢাকনাটা খুলতেই ভেতরের মৃতদেহটা চোখে পড়ল। দুজনে লাশটার মাথা আর পায়ের দিকটা ধরাধরি করে বাইরে বের করে এনে শুইয়ে দিলাম বড় বড় ঘাসের ওপর। অল্পবয়সী বউয়ের মৃতদেহ, তেমন ভারী নয়। এবার কফিনের ঢাকনাটা আবার বন্ধ করে, গর্তে যেমনটি ছিল, তেমনটি রেখে ওপর থেকে ভরাট করে দিলাম মাটি। আমাদের কুকীর্তির প্রমাণ আমরা রাখতে চাই না।
বস্তার মধ্যে লাশটাকে ভরে আমরা ধরাধরি করে নিয়ে চললাম চৌধুরীর ছ্যাকরা গাড়িতে। গাড়ির পেছনের দিকের সিটের তলায় রাখা হল বস্তাবন্দি লাশটা। যন্ত্রপাতি, লন্ঠন সব নিয়ে এসে আমরা ফিরে চললাম। এত সহজেই একটা লাশ পাওয়া গেছে বা যোগাড় করতে পেরেছি, ভেবে মন উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। ওটা'র বাবদ যে টাকা হওয়া উচিত, সেটা আমরা দুজন ভাগাভাগি করে নেব। সহজ ভাবে টাকা রোজগারের ভাল একটা পথ পাওয়া গেছে। এই গভীর রাতে কবর থেকে একটা মেয়েমানুষের লাশ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছি আমরা - কি জানি কেন আমার মনটা এতে কু-ডাক ডাকছিল। আমার ভয় কাটাতে চৌধুরী গাড়ি চালাতে চালাতে একটা অশ্লীল রসিকতা করে উঠল, এবার দুজনেই হেসে উঠলাম।
হঠাৎ শুরু হল ঝিরঝিরে বৃষ্টি, মেঘে ঢাকা পড়ল চাঁদ। আমার পায়ের কাছে বস্তাবন্দি লাশটা রাখা ছিল। চৌধুরীর ঝরঝরে গাড়িতে খুব ঝাঁকুনি হচ্ছিল, আর বস্তাটা বারবার আমার পায়ের ওপর এসে পড়ছিল। আমি যতই পা দিয়ে ওটা ঠেলে পেছনের সিটের তলায় সরিয়ে দিচ্ছিলাম, ততই যেন ওটা নতুন উদ্যমে এসে পড়ছিল আমার পায়ের ওপর। এই সংস্পর্শে আমার গা ঘিনঘিন করে উঠছিল। একবার যেন মনে হল, বস্তার ভেতর থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে আমার পায়ে সুড়সুড়ি দিল। ভীষণ চমকে উঠলাম আমি এবার। গলা দিয়ে বোধহয় একটা চিৎকার বেরিয়ে পড়েছিল, চৌধুরী গাড়ি থামিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, " কি হল? চেঁচিয়ে উঠলে কেন?"
" আ....আ...আমার কেন জানি ভাল ঠেকছে না", আমি কোনওমতে থতমত খেয়ে বললাম, " আমার পায়ে কে যেন সুড়সুড়ি দিল"।
" তোমার দেখছি ভয় ধরেছে!..." ব্যঙ্গ কন্ঠে বলে উঠল চৌধুরী, " এই তুমি সাহসী পুরুষ, অ্যাঁ?"
গাড়ি থামিয়ে ও নেমে এল। বৃষ্টির বেগটা বেড়েছে। হঠাৎ কোথা থেকে কতগুলো কুকুর এসে আমাদের চারপাশে ঘিরে ধরে ডাকতে লাগল। তাদের সেই ডাকের মধ্যে হিংস্রতা নেই, আছে একটা ভীষণ অমঙ্গলজনক কান্নার সুর। এই নিশুতি রাতে চারদিকের জমাট অন্ধকার, বৃষ্টি, কুকুরের একটানা কান্না, আমাদের সঙ্গে কবর থেকে সদ্য চুরি করে আনা যুবতীর মৃতদেহ - সবমিলিয়ে একটা অশরীরী পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে আমাদের চারপাশে।
চৌধুরী আমার বাঁ দিকের দরজাটা খুলে ভেতরদিকে ঝুঁকে বলল, " কই দেখি,টর্চটা জ্বালাও তো! মেয়েমানুষের সুড়সুড়িতে তোমার ভয়ের চাইতে বেশী আরামই লাগা উচিত "।
আমি পাশ থেকে টর্চটা তুলে আলো ফেললাম বস্তটার ওপর। কয়েক মূহুর্ত আমরা দুজনেই স্তম্ভিতের মতো হয়ে গেলাম, মুখে কথা রইল না কারোর। দেখি, সত্যি সত্যিই বস্তার ভেতর থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সেটা রমণীর কোমল হাত নয়, কোনও পুরুষের বলিষ্ঠ লোমশ হাত!
একটা ভয়ানক আতঙ্ক আমার বুকে যেন পাষাণের মতো চেপে বসছে।
" এটা কার হাত!" ফিসফিস করে বলল চৌধুরী, " মেয়েমানুষের হাত তো নয়!"
" ক্ক...কি....কিন্তু.... আমরা তো মেয়েমানুষের লাশই কবর থেকে তুলে এনেছি... " কোনওমতে বললাম আমি।
" আলোটা আরেকটু উঁচু করে ধরো তো", চৌধুরী হঠাৎ যেন মরিয়া হয়ে বলে উঠল, " লাশের মুখটা আমি দেখতে চাই....."
আমি টর্চের আলোটা বস্তার মুখের কাছে ধরলাম। চৌধুরী একটানে ওটা সরিয়ে দিতেই একটা মুখ বেরিয়ে পড়ল। দাড়ি কামানো একটা মুখ, চোখদুটো খোলা, গভীর কালো দু'চোখের তারা, মুখে সেই ব্যঙ্গের হাসি। যেন আমাদের উপহাস করছে।
রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে দিল আমাদের দুজনের আতঙ্কিত চিৎকার। চৌধুরী একলাফে সরে গেল, আমি কেমন করে ডান দিকের দরজা খুলে লাফ মেরেছিলাম জানি না। অন্ধকারে শক্ত মাটিতে আছড়ে পড়ে হাত-পা ছড়ে গেল কিন্তু আমার তখন ভ্রুক্ষেপ নেই, দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে আমি ছুটছি তো ছুটছিই..........
যে মুখটা আমাদের দিকে তাকিয়ে বীভৎস ভাবে হাসছিল, সেটা গোবিন্দ বসাকের মুখ - যাকে কিছুদিন আগে লাশকাটা ঘরে ফালাফালা করে কাটাছেঁড়া করা হয়েছিল আমাদের দুজনের চোখের সামনে........!!!
♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦
রাঘব সামন্ত'র লেফাফা এখানেই শেষ। এরপরের ঘটনা - কিছুই আর লিখে যান'নি রাঘব সামন্ত। নিঃসন্দেহে এটি আদ্যন্ত একটি ভয়াবহ ঘটনা কিন্তু আশ্চর্য এই যে অমন একটি ভয়ঙ্কর ঘটনার প্রভাব শুধু রাঘব সামন্ত'র ওপরই কেন পড়ল যার কারণে তাঁকে ডাক্তারি পড়ায় ইতি টানতে হল? এমনকি এই আতঙ্ক নিয়েই আজ তাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হল..... অথচ একই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও ডাঃ অনাথ চৌধুরীর ওপর এর সামান্য আঁচও পড়ল না? সে তো এখন দিব্যি বহাল তবিয়তে দেশের প্রথম সারির সার্জন হয়ে চলাফেরা করছে....এরকমটা কি করে সম্ভব?
বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ডাক্তার হিসেবে যা সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি, তা হল - রাঘব সামন্ত'র এই জবানবন্দি থেকে স্পষ্ট, ডাঃ অনাথ চৌধুরী সম্পূর্ণ বিবেকবর্জিত এবং মানবিক আবেগ অনুভূতি শূন্য এক মানুষ। যে কোনও ধরনের নির্মম, নৃশংস কাজ সে খুব নির্বিকারভাবে করতে পারত। সাইকোলজি অনুযায়ী, এই ধরনের 'অতিমাত্রায় নিষ্ঠুর ' স্বভাবের মানুষের ভেতর 'ভয়' নামক জিনিসটার লেশমাত্র অস্তিত্ব থাকে না। এককথায় এরা পৈশাচিক স্বভাবের মানুষ। সমাজে এদের বলা হয় ' মানুষ পিশাচ'। এরা কোনওকিছুতেই ভয় পায় না, আতঙ্কিত হয় না, এদের দ্বারাই বরঞ্চ অন্য কেউ আতঙ্কিত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে রাতের গোরস্থানের ঘটনায় সে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ভয় তাকে বিন্দুমাত্র কাবু করতে পারেনি। তাই সে এখন আর দশজনের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে । কিন্তু রাঘব সামন্ত? সে তো আর দশজনের মতোই আবেগ - অনুভূতিপ্রবণ একজন সাধারণ মানুষ..... তাই তার ওপর সে রাতের ঘটনা বিশ্রীভাবে প্রভাব ফেলেছিল।
0 মন্তব্যসমূহ