Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ডাকিনী ভিলা ।। উপেন মান্না (সম্পূর্ণ ভয়াল-ভয়ঙ্কর ভৌতিক উপন্যাস)

 (পর্ব ১)

ডাকিনী-ভিলায় যাবেন ? তাহলে আসুন ! খবরদার! না !

ডাকিনী-ভিলায় যাবেন না! যিনি একবার গিয়েছিলেন, অতি কষ্টে ফিরে এসে তিনি তার যে অভিজ্ঞতার কাহিনী বলেছেন, তা যেমনি শিউরে ওঠার মতন তেমনি অবিশ্বাস্য ও ভয়ংকর।

------------------------

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাগও বাড়তে থাকলাে। আশ্চর্য লােক বটে এই হরি নারায়ণ ! নেমন্তন্ন করে যে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে এ আবার কেমন ধারা নিয়ম ! কি দরকার ছিল বাপু আমাকে এই পাণ্ডব বর্জিত দেশে ডেকে আনবার ?

হাত ঘড়িতে দেখি দুটো বেজে গেছে। অথচ এখনও হরিবাবুর .পাত্তা নেই। বসে বসে কেবল মাছি তাড়ানাে ছাড়া করার কিছু ছিল না। একটা মাছি ক্রমাগত জ্বালাতন করে চলছিল। কখনও নাকে কখনও কানে ঘুরে ফিরে এসে বসছিল। আমি যতবারই তাড়াই ততবারই সে ফিরে আসে।

অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলাম। কিন্তু কোন উপায় ছিল না। আর উপায় ছিল না বলেই বসে বসে হরিনারায়ণের আর তার সঙ্গে সঙ্গে ঐ হতভাগা মাছিটার বাপান্ত করছিলাম। মনের অবস্থা তখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছিল যে সেই মুহুর্তে হরিনারায়ণকে হাতের কাছে পেলে খুন করতেও দ্বিধা করতাম না।

বেলা গড়িয়ে তখন বিকেল হয়ে গেছে। মেজাজটাও তখন অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে। হঠাৎ মনে হল, আমি ভুল করিনি

তাে?  সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগটা খুলে চিঠিটা বার করলাম ।

না, ভুল হয় নি মােটেই। স্বয়ং হরিনারায়ণের লেখা। বেশ স্পষ্টাক্ষরে লেখা রয়েছে আমাকে রিসিভ করার জন্যে সে স্টেশনে হাজির থাকবে।

এ যে কি দুর্ভোগ, একমাত্র ভুক্তভােগী ছাড়া অনুমান করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। ষ্টেশনটির নাম ভুঁতুরিয়া। এখনও পুরােপুরি ষ্টেশনের মর্যাদা পায়নি। সারাদিনে দু’খানি মাত্র গাড়ী' যাতায়াত করে।

একখানা সকালবেলাই চলে গেছে। আর একখানি মানে শেষ ট্রেনটি সন্ধ্যার সময় আসবে। সুতরাং সারাটা দিন ইচ্ছা না থাকলেও অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না। 

ষ্টেশনটিতে ট্রেন থামলেও দুটি কি একটির বেশী যাত্রী ওঠানামা করে না। ষ্টেশন মাষ্টার সারাদিনটা কোনক্রমে কাটিয়ে শেষ ট্রেনে চেপে চলে যান। আবার পরের দিন সকালের ট্রেনে এসে হাজির হন ভুঁতুরিয়াতে।

ষ্টেশনের গায়ে একটা প্রকাণ্ড বট গাছের তলায় ছিলাম বসে।

এমন সময় ষ্টেশন মাষ্টারকে আমার দিকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালাম।

—কোথায় যাবেন ?—ষ্টেশন মাষ্টার বললেন, সেই সকাল থেকেই তাে রয়েছেন দেখছি।

আমি বললাম, আমি একটু দুশ্চিন্তায় পড়েছি মাষ্টার মশাই, আমারই এক বন্ধুর আসবার কথা আছে কিন্তু কেন যে এলে না

বুঝতে পারছি না।

—আপনি কি আপনার বন্ধুর বাড়ী চেনেন ?

—না মশাই! জীবনে এই প্রথম এখানে আসছি।

—তাহলে তাে বেশ দুশ্চিন্তার কথা মশাই,ষ্টেশন মাষ্টার বেশ গম্ভীর ভাবে বললেন, দেখুন, এ সব নতুন জায়গা, এখানে রাত্রে এমন কি এই স্টেশনের চার-পাঁচ মাইলের মধ্যেও কোন গ্রাম বা লােক বসতি নেই। কেউ থাকে না।

সুতরাং শেষ ট্রেনটা এলেই চেপে বসবেন। বুঝলেন ?

—সে কথা আর বলতে,-আমি একটু কাষ্ঠ হাসি হেসে বললাম,

বন্ধুত্ব করে আচ্ছ। বিপদে পড়েছি বাবা, আর নয়!

-আপনার বন্ধুর নামটা কি জানতে পারি ?

—নিশ্চয়ই! হরিনারায়ণ মুখুজ্যে। স্টেশন থেকে মাইল দুয়েক হবে। বাড়ীখানা নাকি বিরাট এক প্রাসাদের মতো।

কথাটা শুনেই ষ্টেশন মাষ্টার কেমন যেন থমকে গেলেন। ভদ্রলোক অবাক দৃষ্টি মেলে আমার দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন, সে কি! ও বাড়ীতে কেউ থাকে বলে ত শুনিনি!

বিশ্বাস হচ্ছে না!

 -বলেই আমি ব্যাগ থেকে হরিনারায়ণের চিঠিখানা বার করে ষ্টেশন মাষ্টারের হাতে দিলাম। তিনি চিঠিখানা ভাল করে দেখে শুনে আমার হাতে ফেরৎ দিয়ে বললেন, কি জানি মশাই! আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। যাই হােক, আপনি যদি আমার কথা শােনেন, তবে দয়া করে শেষ ট্রেনটা ছাড়বেন না।

আমার মন ভাল বলছে না।

ষ্টেশন মাষ্টার আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ত্রস্তপদে ষ্টেশনের দিকে রওনা দিলেন। আমি তার ভাব চাঞ্চল্য দেখে একটু ঘাবড়ে গেলাম। মনে হল, এর মধ্যে যেন এক গভীর রহস্য লুকিয়ে রয়েছে।

কিন্তু, সে রহস্যটুকু যেন ইচ্ছা করেই তিনি গােপন করে গেলেন। ট্রেনটি যথাসময়ে ভুঁতুরিয়া ষ্টেশনে এসে থামল। একজন যাত্রীকেও নামতে দেখা গেল না। অন্ধকারও তখন বেশ আসর জাঁকিয়ে চারিদিকে পরিব্যপ্ত হয়ে পড়েছে। একটানা ঝিঝি পােকার ডাক কানে এসে বাজছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, এখানে আর এক সেকেণ্ড সময়ও থাকতে রাজি নই। এগিয়ে চললাম ট্রেনের দিকে।

ষ্টেশন মাষ্টার ইতি মধ্যেই তার অফিস ঘরে তালা লাগিয়ে গাড়ীতে গিয়ে উঠে পড়েছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন।

গাড়ীতে উঠতে যবে ঠিক সেই মুহূর্তে কোথা থেকে হরিনারায়ণ এসে হাজির হল, আরে এ কি! তুমি চলে যাচ্ছ ?

যাবাে না তাে কি, তােমার মত একজন কর্তব্যহীন লােকের জন্যে অপেক্ষা করবাে ? - কথাগুলাে খুব জোরের সঙ্গেই বললাম।

আমাকে আর লজ্জা দিও না ভাই। তােমাকে ঠিক সময়ে রিসিভ করতে পারিনি বলে আমি খুবই লজ্জিত। কিন্তু কি করবাে বলাে - গরুর গাড়ী করে আসছিলাম। হঠাৎ খানায় পড়ে গাড়ীটা উলটে গেল। এইসব ঝামেলা মেটাতে গিয়ে সন্ধ্যে হয়ে এলাে।

বরাত ভালাে যে ঠিক সময়েই উপস্থিত হতে পেরেছি। না হলে তাে আর তােমার দেখা পেতাম না।

হরিনারায়ণের কথায় যেন যাদু ছিল, সব ভুলে গেলাম, সত্যিই তত বেচারী বিপদে না পড়লে ঠিক সময়েই আসতাে।

ট্রেনের হুইল” এর শব্দে চমকে উঠলাম। গাড়ীখানা তখন চলতে সুরু করেছে। ষ্টেশন মাষ্টার তখনও তাকিয়ে রয়েছেন আমার দিকে,যতক্ষণ দেখা যায় ট্রেনটির দিকে চোখ মেলে দেখতে লাগলাম।

যেই মুহূর্তে ট্রেনটি দৃষ্টি-সীমানার বাইরে চলে গেল, আমি যেন কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করলাম মনে মনে। নির্জন ভুঁতুরিয়া ষ্টেশনটিতে তখন আমি আর হরিনারায়ণ ছাড়া অন্য কোন মানুষ ছিল না।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই অন্ধকার এসে গ্রাস করলে সমগ্র অঞ্চলটিকে! এক বিন্দু আলাের চিহ্ন কোনখান থেকে দেখা যাচ্ছিল না। কেবলমাত্র কয়েকটি জোনাকি পােকা সামনের সেই বটগাছটার উপর মাঝে মাঝে তাদের আলাে বিকিরণ করে আলাের অস্তিত্বটুকু জানিয়ে দিচ্ছিল।

নিজেকে বড় অসহায় বােধ হল। হরিনারায়ণের বাড়ী যে এমন এক অদ্ভুত পরিবেশের মধ্যে এরূপ ধারণা আগে করতে পারিনি।

নিশ্চল অবস্থায় ষ্টেশনের উপর দাড়িয়ে ভাবছিলাম বর্তমান পরিস্থিতির কথা। হরিনারায়ণও কথা না বলে চুপচাপ ছিল দাঁড়িয়ে।

অকস্মাৎ একযােগে কয়েকটি ক্ষুধার্ত শৃগালের ডাক ভেসে এল ।

আর তারই সঙ্গে মনে হল একটি সদ্যজাত মানব শিশু যেন কেঁদে উঠল তারস্বরে।

একটু চমকে উঠেছিলাম কিন্তু পরক্ষণেই ফিরিয়ে আনলাম নিজের সাহস। দেশ-গ্রামে এমন ঘটনা নতুন নয়। এর ব্যাখ্যা সকলেরই জানা আছে। কিন্তু তবুও মনের কোনে যেন কিসের একটা ইঙ্গিত ভেসে বেড়াচ্ছিল - হয়তাে সব কিছুই ঠিক, হয়তাে বা কিছুই ঠিক নয় !

মােদ্দাকথা, এ অবস্থায় মােটেই ভাল লাগছিল না আমার। এই নির্জন জনমানবশূন্য একটা জায়গায় অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ শক্ত ব্যাপার! অথচ এখন এমনি অবস্থা যে ইচ্ছা থাকলেও ফেরবার কোন রাস্তা ছিল না। শেষ ট্রেনটি চোখের সামনে দিয়েই ছেড়ে চলে গেছে। আমি হরিনারায়ণকে শুধালাম, কি হে হরি !

আমরা কি এখানে দাড়িয়েই থাকবাে?

হরি একটু হাসল । অবশ্য হাসলাে না কালাে অন্ধকারে ঠিক বােঝা গেল না। হরির হাসির শব্দ বাতাসে ভর করে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই অনেকগুলাে শেয়ালের চিৎকার আমাকে উন্মনা করে তুলল। একটু ভয় যে পেলাম না, তা নয়।

গা-টা শির শির করে উঠল। পা দুটো মনে হল বেশী ভারী হয়ে উঠেছে। আমি হরিকে বললাম, আমরা কি এখানে দাড়িয়ে থাকবাে সকাল থেকে পেটে বিশেষ কিছু পড়েনি। খিদেয় পেট চুই চুই করছে যে।

আরে না না-হরি বললে, এখুনি গাড়ীটা এসে যাবে, অন্ধকার পথ বলে হয়তাে দেরি হচ্ছে !

হরির কথা শেষ হতে না হতেই একটা গরুর গাড়ী আসার শব্দ কানে ভেসে এলাে। গাড়ীটা এসে একেবারে আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। ঐ ঘন অন্ধকারের মধ্যেও আমার বুঝতে অসুবিধা হল যে গরু দুটো বেশ তাগড়াই চেহারার । ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছিল গরু দুটির নাক দিয়ে। মনে হল কামারশালায় যেন হাপর টানছে।

এমন কি আমি যেন ওদের নিঃশ্বাসটুকু দেখতে পাচ্ছিলাম, যেন এক এক ঝলক আগুন বেরিয়ে আসছিল ওদের নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে। ড্রাগনের নিঃশ্বাসে আগুন ঝরে জানতাম কিন্তু আমাদের এই বাংলা মুলুকের গরুর নিঃশ্বাসে আগুন বেরােয় এটা আমার জানা ছিল না।

সবই যেন কেমন একটা অদ্ভুত বলে মনে হতে লাগল। অথচ হরি নির্বিকার। তার কোনদিকেই খেয়াল নেই। সে যেন এইসব পরিবেশের সঙ্গে বিশেষ ভাবেই পরিচিত।

হরি এগিয়ে গিয়ে গাড়ীতে উঠে বসল। আমিও হরিকে অনুসরণ করে উঠ বসলাম গাড়ীর মধ্যেখানে ছাউনিঘেরা আবরণীর মধ্যে।

শরীরটা বড়ই ক্লান্ত। খড় বিছানাে গদির উপর নিজেকে এলিয়ে দিলাম। হঠাৎ একটা কথা মনে আসতেই তড়াক্‌ করে উঠে

বসলাম হরি নিজেই চালকের আসনে বসে গাড়ী চালাচ্ছিল।

কথাটা মনে হতেই বেশ খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম -ষ্টেশনে যখন গাড়ীটা পোঁছাল তখন কোন চালককে দেখতে পাইনি বলে ।

আর হরিও নিশ্চিন্ত মনে চালকের আসনে বসে গরুগুলােকে চালিয়ে নিয়ে চলল। তাহলে, বিনা চালকে গাড়ীখানা ষ্টেশনে গেল কি ভাবে ।

গরুর গাড়ী হলেও প্রচণ্ড দ্রুত গতিতে চলছিল আমাদের গাড়ীটা।

গরু দুটো যে কোনও ঘােড়াকে যে হারিয়ে দিতে পারে তা আমি হলপ করে বলতে পারি। তাছাড়া এই ঘনান্ধকার রাতে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের রাস্তায় এত জোরে কি করেই বা চলছে পথ চিনে ?

ষ্টেশনের নামটি যেমন ভুঁতুরিয়া, ঠিক সেই নামের সঙ্গে তাল রেখে যেন সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এখানে। আশ্চর্য !

হরিকে আমার মনের কথা বলব বলে ভাবছি, কিন্তু তার আগেই আমার দিকে পেছন ফিরে না তাকিয়েই হরি, বলতে শুরু করল, তােমায় বলতে ভুলে গেছি মান্নাদা, তােমাকে অনেক কিছুই বলবার আছে। তারপর গলার স্বর কমিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বললে, আপাততঃ যা দেখছে সে সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন করাে না। যথাসময়ে তােমাকে সব কিছুই বলব।

হরির কথায় যেন সম্মােহনের মন্ত্র ছিল, আমি আর কোন প্রশ্ন করা দূরে থাক্‌ কথা বলতেও যেন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। কেবল চুপচাপ অন্ধকারের বুকে মেলে রাখলাম আমার দৃষ্টি।

বুঝতে পারছিলাম না এ যাত্রার শেষ হবে কোথায় ?

গাড়ীর চাকায় আওয়াজ উঠছে ক্যাচ ক্যাচ, করে। মাঝে মাঝে গাড়ীখানি দুলে উঠছে স-শব্দে, গােরুদুটির নিঃশ্বাসে বেরুচ্ছে আগুনের হালকা। নিঃশ্বাসের শব্দে জেগে উঠছে গাছের ঘুমন্ত পাখীরা। মাঝে মাঝে শােনা যাচ্ছে হরির মুখ থেকে গরু চালাবার হাট হুট শব্দ।

সব মিলিয়ে ছাপিয়ে উঠছে একটা অবরুদ্ধ কান্না। অতি ক্ষীণ অথচ খুবই তীক্ষ্ণ সে কান্না। মানুষ কিংবা অশরীরী বােঝবার মত মনের অবস্থা তখন আমার ছিল না। কিন্তু সেই কান্না বেশ আমার মনটাকে নিয়ে চলছিল কোন এক সুদূরললাকে। একটা ভয়াবহ কোন কিছু যেন আমাকে বাঁধতে চাইছে আষ্টেপৃষ্ঠে; অক্টোপাশের মতো।

একটা অদ্ভুত কিছু প্রত্যক্ষ করছি এবং তার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করছি এক অকল্পনীয় পরিবেশ। যে পরিবেশের সঙ্গে জীব জগতে কোন সম্পর্ক নাই। একটা হিমশীতল রক্তজল করা পরিস্থিতি।

যা কিছু দেখছি সবই যেন কেমন খাপছাড়া। জীবন্ত জগতের সঙ্গে যেন তার কোন মিল নাই। আমি যেন ছুটে চলেছি এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের সাগরের বুকে, একফালি একটা পানসিতে চেপে।

আকাশের তারাগুলাে যেন সেই স্বর্গরাজ্যে এক একটা অভিশাপ।

ধূসর আবরণের মধ্যে যেন তাদের দ্যুতি হারিয়ে গেছে। তারা ম্লান মুখে চেয়ে রয়েছে অন্ধকার ধরিত্রির দিকে। মনে হচ্ছে ওরা আমাদের দিকেই তাকিয়ে কিছু বলতে চাইছে। আমি যেন বুঝতে পারছি

ওদের কথা। ওরা বলছে, যেওনা যেও না, কোথায় যাচ্ছ সে কথা কি তুমি জাননা? তুমি পিশাচের সহচর হয়ে ছুটে চলেছে জাহান্নামের পথে। যেখানে কোন রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষ যায় না।

অশরীরীদের রক্ত পিপাসু জিহ্বা যেখানে লক লক করে। সেই মৃতের পুরীতে তােমার নিমন্ত্রণ। আশাকরি এই নিমন্ত্রণের অর্থ বুঝতে তুমি পারছো।

চোখ ফিরিয়ে আনলাম নক্ষত্র লােকের দিক থেকে। বেশী সময় আকাশের দিকে চেয়ে থাকলে, হয়ত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে হবে। অবাস্তব কল্পলােকের মোহ কাটিয়ে বাস্তবের দিকে দৃকপাত করতে গিয়েই নজর পড়ল গরু দুটোর দিকে।

আমি অভিভূতের মত লক্ষ্য করলাম, ঐ দুরন্ত গতিবেগের মধ্যেও গরুগুলাে তার প্রভুর দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছিল। অন্ধকারের মধ্যেও ওদের চক্ষুগুলি জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল। সেই ভয়াবহ বড় বড় রক্তবর্ণ চোখগুলি যেন বারে বারে আমার দিকেই কটাক্ষ করছিল। সেই দৃষ্টি .যে কত ভয়াবহ স্বচক্ষে না দেখলে বুঝিয়ে বলা যায় না। আমার মুখের ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিল। একটা অজানিত আশংকা যেন গ্রাস করে বসছিল প্রতি মুহূর্তে।

আমি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে দেখতে পেলাম, হরি সপাসপ কয়েক ঘা চাবুক বসিয়ে দিল গরু দুটির পিঠে। সঙ্গে সঙ্গে লক্ লক্ করে উঠল গরুগুলাের জিভ। দেখলাম হরি যেন কিছু ছুঁড়ে দিল ওদের মুখের দিকে। গরুগুলো ছুটন্ত অবস্থায় জিভ দিয়ে সড়াৎ করে টেনে নিল নিজেদের মুখে।

অসহ্য মানসিক যন্ত্রনায় আমি ছটফট করে উঠলাম। এসব কি ?

এ সবের মানে কি ? ভাবলাম, হরিকে জিজ্ঞেস করবাে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই হরি বলে উঠল, খুব ভুল হয়ে গেছে দাদা, সত্যিই আমি খুব লজ্জা পাচ্ছি কথাটা ভেবে। তােমার সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। তােমার সামনেই খাবার ঢাকা দেওয়া আছে, খেয়ে নাও।

আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। কথাটা কানে আসতেই বুঝতে পারলাম, সত্যিই তাে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে আমার। আমার সামনেই পড়ে রয়েছে আমার খাবার।

সব কথা ভুলে গিয়ে তখন সামনের খাবার নিয়ে বসে গেলাম। আশ্চর্য সুস্বাদু খাবার । অমৃত হার মেনে যাবে এর কাছে। অভুক্ত ছিলাম বলে হয়তাে অমন সুস্বাদু লেগেছে এ কথাটাও অবশ্য উড়িয়ে দেওয়া যায় না।


(পর্ব ২)

প্রথমদিকে খেয়াল হয় নি। গোগ্রাসে খাবার গেলবার পর খেয়াল হল। এই গাঢ় অন্ধকারের মধ্যেও আমার খেতে কোনই অসুবিধা হল না দেখে। একটা নীলাভ আলােয় ভরে ছিল চারিদিক। একটু লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারলাম বহু দূরে একটা গাঢ় নীল আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে আর তারই আলো এসে পড়েছে আমাদের গাড়ীর ভিতরে।

আশ্চর্য হলাম, এত তীব্র দ্যুতিময় আলাে এই অজ পাড়াগাঁয়ে এল কোথা থেকে। এবং এটাও লক্ষ্য করলাম আমাদের গাড়ীটা ছুটে চলেছে সেই আলােটির দিকেই। ঐ নীল আলাের মধ্যে কি ছিল জানি না। কিন্তু আমার, মন একটা অজানা আশংকায় ভরে উঠল।

এখানকার সব কিছুই কেমন যেন অস্বাভাবিক বলে মনে হতে লাগল ।

খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই আলােটা নিভে গেল। আবার সেই তিমিরাচ্ছন্ন পথ! গরু দুটোর নাসিকা গর্জন, চাকার ক্যাচ, কাচ, শব্দ। সর্বোপরি হরিনারায়ণের নিশ্চিন্ত নীরব অবস্থান। আমি হরিকে আমার মনের কথা বলতে উদ্যত হবার আগেই সে আগের মতই বলে উঠল, যা কিছু দেখছে বা শুনছো, দয়া করে কৌতূহল প্রকাশ করে না।

এ জায়গাটা খুব সুবিধার নয়। তােমার ভালাের জন্যেই তােমাকে অনুরােধ করছি, আপাততঃ তােমার প্রশ্নগুলােকে চেপে রাখাে। বাড়ীতে পৌছে তােমাকে সব কিছুই খুলে বলবাে।

হরির কথার মধ্যে যেন একটা কঠোর আদেশের সুর ধ্বনিত হল।

যে আদেশকে অগ্রাহ্য করার মত ক্ষমতা বা মানসিক ধৈর্য আমার ছিল না। নির্বাক দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করা ছাড়া তখন আমার আর কোন উপায় ছিল না।

হঠাৎ একটা শব্দ কানে আসতেই সচকিত হয়ে উঠলাম। কতকগুলি বিরাটাকার পাখী একসঙ্গে উড়তে থাকলে তাদের ডানায় যে রকম শব্দ হয়, ঠিক সেই রকমের । আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করতই যে দৃশ্য নজরে পড়ল তাতে সারা শরীরের রক্ত যেন জমাট বেঁধে গেল।

অতিকায় কয়েকটি জীব প্রকাণ্ড ডানা মেলে আমাদের গাড়ীর ঠিক উপরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বাদুড় শ্রেণীর হলেও অতবড় বাদুড়ের যে অস্তিত্ব সম্ভব, না দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস হবে না। তাদের চোখগুলাে আগুনের গােলার মত জ্বল জ্বল করে জ্বলছিল। মনে হচ্ছিল যেন ওদের ঐ দৃষ্টি দিয়েই ওরা শুষে নেবে শরীরের রক্ত।

ঝপ করে একটা আওয়াজ হতেই ভীষণভাবে চমকে উঠলাম।

গরুর গাড়ীর চালের উপর একটা জীব বা ঐ রক্তচোষা বাদুড় লাফিয়ে পড়েছে। গাড়ীটা ভীষণভাবে দুলে উঠল। গরু দুটোও যেন ভয় পেয়ে আরও দ্রুত বেগে ছুটতে সুরু করল।

আমি একটা চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হরি সেই মুহূর্তেই তার হাতের চাবুক দিয়ে সপাং করে ঐ প্রাণীটির গায়ে আঘাত করতেই একটা তীক্ষ্ণ-শীষের মত আওয়াজ তুলে জীবটি সবেগে উধাও হয়ে গেল উর্ধ্বাকাশের দিকে। গরুর গাড়ীটা দুলে উঠল প্রচণ্ড বেগে। আমি ছিটকে পড়লাম একধারে। হরি কতকগুলি অদ্ভুত ধরণের কথা উচ্চারণ করল যার অর্থ আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।

হয়ত সে কিছু সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করে থাকবে। কিন্তু আশ্চর্য ফল পাওয়া গেল তাতে। ডানা ঝাপটানাে শব্দ মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেল।

আবার ফিরে এল সেই পূর্বাবস্থা। একঘেয়ে গরুর গাড়ীর চাকার আওয়াজ আর গরুগুলির নিঃশ্বাসের গুরুগম্ভীর ফাঁনি।

সবকিছু পরিস্থিতির সঙ্গে যেন আমি খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম এরই মধ্যে। সুতরাং যতই কেন না ভয়ঙ্কর অথবা ভীতিজনক হােক, আমার মনােবল বিন্দুমাত্র নষ্ট হবে না। হঠাৎ জানিনা কেন আমার জে চেপে গেল। আমি এর শেষ দেখতে চাই। এমনকি জীবনের মূল্যেও যদি দেখতে হয় তবে তাতেও রাজী। কথাটা মনে আসা মাত্রই যেন শরীর ও মনে অনুভব কয়লাম প্রচণ্ড শক্তি। এতক্ষণ কথা বলার স্বাধীনতাটুকু পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল আমার মন থেকে। একটা অদ্ভুত ভীতিকর শিহরণ অনুভব করছিলাম সারাক্ষণ ধরে। কিন্তু এই মুহূর্তে আর সেই দুর্বলতা আমার মন থেকে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল।

আমি হরিকে প্রশ্ন করলাম, হরি! আমাদের আর কতদূর যেতে হবে?

এই যে এসে গেছি দাদা, অত্যন্ত সহজ সরল কণ্ঠ ধ্বনিত হল হরির গলা থেকে-ঐ যে বাড়ীটা দেখতে পাচ্ছ, ওটাই আমার

বাড়ী।

তাইতাে! এতক্ষণে যেন খেয়াল হােল। অদূরেই দেখা যাচ্ছিল বাড়ীটাকে। গেটের মুখে জ্বলছে একটা নীলাভ দ্যুতিময় আলাে।

অন্ধকারকে যেন আরও অন্ধকার করে তুলছিল ঐ আলাের নীলাভ রশ্মি। বাড়ীটাকে একটা দুঃখস্বপ্নের সৌধ বলে মনে হচ্ছিল।

কেন হচ্ছিল তা বলতে পারব না। তবে একটা অশুভ ইংগিত যেন আমার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় দিয়ে আমাকে বলতে চাইছে বাড়ীটা একটা শয়তানের পীঠস্থান।

মনে পড়ল ষ্টেশন মাষ্টারের মুখের ছবি।

যখন আমি তাকে আমার গন্তব্যস্থলের কথা বলেছিলাম, তখন তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। তিনি যেন একটু ভীত হয়ে পড়েছিলেন। তাই বারবার অনুরােধ করেছিলেন শেষ ট্রেনটিতেই যেন আমি ফিরে যাই।

কিন্তু হরিনারায়ণ যদি সেই মুহূর্তে এসে হাজির না হত বা একটু দেরি করতাে তাহলে আমি কলকাতায় ফিরে যেতাম।

হরিনারায়ণের যে সাহস আছে এবং সে বর্তমান ঘটনাবলীর সঙ্গে যে অভ্যস্ত, তার আচার আচরণে বুঝতে পারা যায়। নিরুদ্বেগ চিত্তে সে গাড়ী হাঁকিয়ে চলেছে। যে গাড়ীর বাহন দুটি গরু হয়েও যেন গরু T যেন ড্রাগনগরু। সাধারণ গরুর চেয়ে শতগুণ শক্তিশালী। চোখগুলাে লাল এবং অস্বাভাবিক রকমের বড় বড়।

নিঃশ্বাসে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আগুনের ফুলঝুরি ।

গেটের সামনে গাড়ীটা পৌঁছবামাত্রই কড় কড় ক্যাঁচ, ক্যাঁচ, ঘড় ঘড় শব্দ তুলে গেটটা খুলে গেল। মনে হল, গেটটা বহুদিন যাবৎ খােলা হয়নি অথবা জরা-জীর্ণ গেটটি শেষ অবস্থায় এসে হাজির।

হয়েছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় গেটটিকে কে যে খুলে দিল তা দেখতে পেলাম না। নীলাভ আলােটি তখনও জ্বলছিল কিন্তু সেই আলােয় কোন মানুষকে দেখতে পেলাম না, গেটটি যেন আপনা হতেই খুলে গিয়ে গাড়ীটিকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিল।

গাড়ীটি ফটক পেরিয়ে বাড়ীর সামনে দাঁড়াতেই আবার কানে এল সেই অবরুদ্ধ কান্নার স্বর, এত তীব্র আর এত তীক্ষ্ণ যে কোন মানুষ অমনভাবে কাঁদতে পারে তবু বিশ্বাস হয় না। আমি কেমন যেন উন্মনা হয়ে পড়লাম। হরি সম্ভবতঃ আমার মনের কথা বুঝতে পেরে একলাফে গাড়ী থেকে নেমে বাড়ীর ভিতর ঢুকে গেল।

সেই তীক্ষ্ণ তীব্র কান্নার রেশ আমার কানে বাজছে আর কান্নার সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমার হৃৎপিণ্ডটা ধ্বক্ ধ্বক্ করে লাফিয়ে উঠছে বেশ বুঝতে পারছি। মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার বুক থেকে কপিণ্ডটাকে টেনে ছিড়ে নিয়ে যেতে চাইছে। আমি দু'হাত দিয়ে কান দুটোকে চেপে ধরলাম । কিন্তু তা সত্বেও কান্নার শব্দকে প্রতিহত করতে পারলাম না।

গাড়ীর গরু দুটি ছাড়া আর কোন প্রাণীকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। অথচ আমার মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার চোখ আমার দিকে লােলুপ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়েছে। যাদের আমি দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু তারা আমাকে লক্ষ্য রাখছে। আমার প্রতিটি আচার আচরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে শিউরে উঠলাম। হরি বাড়ীর ভিতর চলে যাওয়ার পরই গরু দুটি মাথা ঘুরিয়ে আমাকে একদৃষ্টে নজর করছে। তাদের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে জিংঘাসার লালসা। লকে লকে জিভ বেরিয়ে এসেছে ওদের মুখ থেকে। আগুনের ভাটার মতো চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে হিংস্রতা। ওরা যেন আমাকে গিলে ফেলতে চাইছে ওদের দৃষ্টি দিয়ে। বুঝতে পারছি হয়তো যে কোনও মুহূর্তে গরু দুটো লাফ দিয়ে আমার ঘাড়ে পড়তে পারে। কিন্তু ওদের প্রভুকে হয়ত ওরা ভীষণ ভয় করে সেই জন্যেই ওরা সে সাহস পাচ্ছে না।

এমন সময় সেই কান্না থেমে গেল। হাত দুটো কান থেকে নামিয়ে এনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। উঃ কি দুঃসহ এই অমানুষিক কান্নার শব্দ! ভাবলেও শরীরের রক্ত শুকিয়ে যায়। কান্নার শব্দ থেমে যাওয়া মাত্রই গরু দুটি মুখ ঘুরিয়ে নিল আমার দিক থেকে।

আমি আরও কিছুটা স্বস্তি বােধ করলাম।

হরি বেরিয়ে এল বাড়ীর ভিতর থেকে। হাসতে হাসতে বললে, এস দাদা, ঘরটা ঠিকঠাক করে এলাম। জানােই তো নিজের দেশেই পরবাসী হয়ে রয়েছি। সব কিছু নিজের হাতেই করতে হয়। তােমাকে উপরে নিয়ে যাওয়ার আগেই একবার ঘরটা দেখে এলাম, ঠিক আছে কি না! নেমে এসো -

আস্বস্ত হলাম হরিকে দেখে। হেসে বললাম, আরে না, না ঠিক আছে।

তােমাকে ব্যস্ত হতে হবে না।

কথাটা বলতে বলতে আমি গাড়ী থেকে নেমে হরিকে অনুসরণ করলাম।

নিস্তেজ একফালি চাঁদ আকাশের এক কোনকে আলােকিত করার চেষ্টা করছিল বাড়ীটার ঠিক পিছন দিকটার আকাশে। এক লহমার জন্যে মনে হল নরকপুরীর যবনিকা উঠবার পূর্বমুহূর্তে যেন নেহাৎ করুণাবশতঃ ঐ একফালি চাঁদের এক টুকরো আলাে ঠিকরে এসে পড়ছিল বাড়ীটার মাথায়। বাড়ীটাকে অতি প্রাচীন পােড়া বাড়ী বলে আখ্যায়িত করলেই বােধ হয় ঠিক মানানসই হবে। যেন প্রকাণ্ড একটা হাঁ করে সব কিছুকে সে গিলে খেতে চাইছে।

চাদের ঐ অস্পষ্ট আলােয় বাড়ীটাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল। কেননা আমি গাড়ী থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই গেটের সেই নীলাভ আলােটি নিভে গিয়েছিল বলে।

কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলাম। এই অন্ধকারে বাড়ীর ঐ অন্ধ-কূপের মধ্যে ঢুকতে যেন মনে সায় পেলাম না।

একটু আগেই যে কান্নার শব্দ আমাকে ব্যাকুল ও ভীত করে তুলেছিল, সে কথা মনে হতেই হৃদস্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠল।

 মনে হল বাড়ীটার ভিতরে এমন কিছু আছে যা অমঙ্গলজনক।

 মানুষের পক্ষে শুভ নয়। কিন্তু অমঙ্গলের দোর গোড়ায় এসে দাড়িয়ে এখন ও সব কথা ভেবে কি লাভ। এখন হাজার ইচ্ছা থাকলেও ফিরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে আমার কাছে। সুতরাং আমাকে এগিয়ে যেতে অথচ, অবাক হচ্ছি ভেবে হরি কত সহজ স্বচ্ছন্দ গতিতে এগিয়ে চলেছে বাড়ীটার দিকে । ভেবে আরও আশ্চর্য হচ্ছি যে, হরি এই বাড়ীতেই থাকে। এবং নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করে নির্ভয়ে।

যাই হােক, মনটাকে শক্ত করে ফেললাম। হরি যদি থাকতে পারে তবে আমিই বা থাকতে পারবাে না কেন । কিসের ভয় ! জীবন্ত মানুষ আমি। মৃত-মানুষকে মানে অশরীরীকে ভয় করতে যাবাে কোন দুঃখে !

আরও কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। সতর্ক দৃষ্টি মেলে চারিপাশে চোখ বুলিয়ে ভাল করে বাড়ীটার পরিস্থিতি সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হতে চাইলাম। না তেমন কিছু নজরে পড়ছে না। পাড়া গাঁয়ের রূপ যেমন হয় ঠিক তেমনিই পরিবেশ। কয়েকটা নারকেল আর তাল গাছ মাথা উচু করে বাড়ীটার এধারে ওধারে দাঁড়িয়ে। আর, এদিকে সেদিকে ভরা রয়েছে ঝােপঝাড়। অন্ধকারের মধ্যে যতদূর চোখের দৃষ্টি চলে তার মধ্যে আর কোন বাড়ী চোখে পড়ল না। বাড়ীর পূর্ব দিকটায় কয়েকটি বড় বড় গাছ। অন্ধকারে দৈত্যের মত রয়েছে দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ একটা কিছু দেখতে পেয়ে চমকে উঠলাম। যে দিকটায় ঝােপ-ঝাড়ে ভরা, সেই ঝােপের মধ্যে থেকে যেন একজোড়া চোখ আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। জন্তু-জানােয়ারের চোখ রাত্রে জ্বলে আমরা জানি। তবে কি কোন হিংস্র জন্তু ওঁৎ পেতে বসে রয়েছে ওখানে ?

আমি নিঃসন্দেহ হওয়ার আশায় আর একবার তাকালাম কিন্তু সেই জ্বলজ্বলে চোখ দুটি ধীরে ধীরে উপর দিকে উঠতে লাগল।

আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম একটা প্রকাণ্ড ছায়া-মূর্তি মিলিয়ে গেল সামনের তাল গাছটাকে আশ্রয় করে ।

চলার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম, সম্বিৎ ফিরে এলাে হরির কথায় কি দেখছাে দাদা! ওসব কিছু নয়। চলে এসাে।

হয়তাে কিছুই নয়। আমার চোখের ভুলও হতে পারে। কোন কথা না বলে পা বাড়ালাম হরিকে অনুসরণ করে ।

মনকে সান্ত্বনা দিতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল শত শত অশরীরী দেহধারীরা যেন আমার আশে পাশে চলতে শুরু করেছে। তাদের চলার শব্দ এমনকি তাদের হিম শীতল নিঃশ্বাসের হাওয়া আমার গায়ে এসে লাগছে। বেশ বুঝতে পাচ্ছি গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। শীত শীত অনুভব করছি।

প্রায় মুহ্যমান হয়ে হরির সঙ্গে ঢুকলাম সেই প্রকাণ্ড বাড়ীটার মধ্যে। বাড়ীর মধ্যে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জ্বলে উঠলো আলাে।

একেবারে অন্ধকারের মধ্যে এই আলাে যেন মৃত সঞ্জীবনীর কাজ করল। মনে সাহস এল ফিরে আমরা দোতলার একটি সুসজ্জিত কক্ষে এসে উপস্থিত হলাম।

হরিনারায়ণ বললে, এই ঘরটাই তােমার জন্যে ঠিক করে রেখেছিলাম দাদা। নিশ্চয়ই তােমার পছন্দ হয়েছে।

খুব পছন্দ হয়েছে হরি, সত্যিই তােমার তারিফ না করে পারছি না ,আমি বেশ খুশী মনেই বললাম, - বাড়ীর বাইরে থেকে দেখে এ ধরনের আধুনিক সাজ-সরঞ্জামে ভরা ঘর কল্পনা করাই কষ্ট সাধ্য।

বিনয়ের হাসি হাসল হরি। বললে, শুনে আনন্দ হল দাদা, আপাততঃ আমি যাচ্ছি, তােমার দরকার হলেই টেবিলে যে “কলিংবেল”টা আছে বাজিও, আমি হাজির হ’ব। এখন তুমি খুবই ক্লান্ত।

অনেকটা পথ এসেছে। তােমার এখন ঘুমের প্রয়ােজন খুব। আমি চলি তা হলে-বলেই হরি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।

নিজেকে বড়ই ক্লান্ত বােধ হচ্ছিল। সুতরাং হরির কথায় কোন প্রতিবাদ করলাম না। সকালবেলাই না হয় কথাবার্তা হবে। ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম বিছানায়।

কিন্তু পরিশ্রান্ত হলেও আমার চোখে ঘুম এলাে না। চোখ বুজে ঘুমােবার চেষ্টা করতে গেলেই হাজার রকমের দুঃস্বপ্ন এসে

জড় হতে থাকে মনের মধ্যে।


(পর্ব ৩)

প্রথম থেকে ঘটনার রােমন্থন সুরু করলাম। আর প্রতি মুহূর্তেই শিউরে উঠতে লাগলাম। যে পরিবেশের মধ্যে দিয়ে হরি আমাকে এই অট্টালিকায় নিয়ে এল, সে পরিবেশ তাে সাধারণ পরিবেশ নয়, সব কিছুকেই একটা অবাস্তব এবং মানুষের বুদ্ধি-যুক্তির বাইরে বলে মনে হল। যা কিছু ঘটতে দেখলাম তা এক পৈশাচিক কাণ্ড ছাড়া আর কি হতে পারে ।

পরমুহূর্তেই ভাবলাম, তবে কি হরিনারায়ণ পিশাচ-সিদ্ধ ? ডাগন অতিকায় রক্তচোষা বাদুড়, ভূতুড়ে কান্না, এসব তবে কি ? আর এই পরিবেশ সৃষ্টি হলাে কেমন করে। এ সবই তাহলে হরির কাজ।

কারণ, ঘটনাগুলি আমার মনে গভীরভাবে দাগ কাটলেও হরির মধ্যে তার এক বিন্দুও আভাস পাওয়া যায় নি !

বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। মনের অস্থিরতা বেড়ে চলল।

আমি ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু হঠাৎ খেয়াল হল, জানালাগুলাে সব বন্ধ। আমি এগিয়ে গিয়ে একটা জানালা খুলে দিতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এসে মুখে আছড়ে পড়ল। বুঝলাম, আকাশে মেঘ করেছে, এখুনি বৃষ্টি নামবে তারই আভাস ভেসে আসছে হাওয়ার সঙ্গে।

জানালা দিয়ে বাইরে উকি মেরে দেখবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই দৃষ্টিগােচর হ’লনা। গাঢ় অন্ধকারে ভরে আছে চারিদিক।

জানালাটা বন্ধ করে ফিরে এসে বিছানায় বসতে যাবে। হঠাৎ একটা তীব্র হৃদয় বিদারক করুণ আর্তনাদ আমাকে সচকিত করে তুললাে।

একটা অমানুষিক করুণ আর্তনাদ। জীবনে আমি কোনদিনই এমন ধারা করুণ আর্তনাদের শব্দ শুনিনি। করুণ সুরের আর্তনাদ হলেও সেই আর্তনাদের মধ্যে একটা বীভৎসতার লক্ষণ সুপরিস্ফুট যে বাড়ীতে একমাত্র হরি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি বাস করে না, সেই বাড়ীতে এমন ভাবে কাঁদে কে ! বিশেষ করে মেয়েলি সুরের কান্না! তবে কি হরি কোন কিছু গােপন করছে আমার, কাছে ?

আমি কেমন যেন মরীয়া হয়ে উঠলাম। দরজা খুলে ছুটলাম সেই আর্তনাদ মিশ্রিত কান্নাকে অনুসরণ করে। বারান্দা দিয়ে কিছুটা এগুতেই মনে হল পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে সেই শব্দ।

আমি' দরজার সামনে দাড়ানো মাত্রই সব কিছু থেমে গেল। নিমেষে বিরাজ করতে লাগল এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। চারিদিক ঘিরে যেন একটা থমথমে ভাব অনুভূত হতে লাগল।

বৃহস্য জালে যেন আরও গভীরতর ভাবে জড়িয়ে পড়লাম। এখন আমার কি করা উচিত। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম। নিজের ঘরে ফিরে যাবাে অথবা কান্নার উৎসকে খুঁজে দেখবে?

ভাবতে গিয়ে মনে হল, সকাল থেকে এই গভীর রাত অবধি যখন কোনরূপ বিপদে পড়তে হয়নি; তখন হয়তাে কোনরূপ বিপদ আমাকে স্পর্শ করবে না। মনে হওয়া মাত্রই সামনের দরজাটা ঠেলে খুলে ফেললাম।

দরজা খােলা মাত্রই যে দৃশ্য ফুটে উঠলে চোখের সামনে, তা যেমনি বিস্ময়কর তেমনি ভয়াবহ। শিরায় শিরায় বয়ে গেল রক্ত ঠাণ্ডা হিমেল প্রবাহ। স্থানুবৎ স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলাম দরজার সামনে।

ঘরের ঠিক মধ্যিখানে একটি কাচের আধারে শুয়ে আছে একটি সুন্দরী রমণী। কফিনের আকারে তৈরী হলেও আধারটি ঠিক কফিন নয়।' স্থির দৃষ্টি মেলে সে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে !

নিষ্পলক প্রাণহীন চোখ দুটি সতেজ এবং জীবন্ত বলে মনে হতে লাগল। সে দৃষ্টিতে যেন সম্মােহনের মন্ত্র ছিল। আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম সেই দিকে। চোখ ফেরানাে দুষ্কর হয়ে উঠল আমার কাছে।

মেয়েটির সর্বাঙ্গ ব্যাণ্ডেজ দিয়ে বাঁধা। কেবল মাত্র মুখমণ্ডলটুকু ছাড়া। প্রচীন মিশরে “মমি” করে যেমন দেহগুলিকে সংরক্ষিত করা

হতে, প্রায় ঠিক সেই ভাবেই মেয়েটির দেহটিকে ব্যাণ্ডেজ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।

চোখের মণি থেকে যেন একটা ক্ষুধার্ত শাণিত রশ্মি নির্গত হয়ে আমাকে অলক্ষ্যে লেহন করে চলছিল। দেহটুকু বাদ দিয়ে কেবলমাত্র মুখমণ্ডলটিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলে মনে হবে, একজন সুন্দরী যুবতী তার শয্যা থেকে নিরক্ষণ করছে আগন্তক মানুষটিকে, বেশীক্ষণ সেই দৃষ্টির সামনে থাকা যায় না। শির শির করে ওঠে শীর। অদম্য মনের জোরে চোখ ফিরিয়ে নিলাম অন্য দিকে। মুহূর্তে মনে হল আমি যেন এক দুরন্ত অদৃশ্য এক শক্তির বাঁধন ছিড়ে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছি। যদি না পারতাম, জানি না তাহলে আমার পরিণতি কি হতাে?

সে যাই হােক মেয়েটির মধ্যে বিশেষ করে তার ঐ অন্তর্ভেদী দৃষ্টির মধ্যে ভয়ানক এক সম্মােহনী শক্তি ছিল সে কথা অস্বীকার করতে পারলাম না। কিন্তু, এই হরিনারায়ণ তা হলে মেয়েটিকে এখানে রেখেছে কেন? মিশর দেশের মমি হলে না হয় বুঝতে পারতাম যে হরির একটা “হবি” আছে। এ তাে দেখছি আমাদের বাঙালী ঘরের মেয়েদের মতই চেহারা। আর যদি মমি করে মেয়েটিকে রাখা হয়ে থাকে তবে তার মুখমণ্ডল এমনকি তার মাথার চুলগুলি পর্যন্ত খুলে রাখার অর্থ কি হতে পারে ?

ভীষণ শব্দে একটা বাজ পড়ল। বৃষ্টি পড়তেও শুরু করেছে। ঠাণ্ডা জোলাে হাওয়া এসে লাগছে আমার গায়ে। বজ্রপাতের শব্দে জরাজীর্ণ বাড়ীটা কেঁপে কেঁপে উঠল। আমি নিজের কামরায় ফিরে যাওয়ার পূর্ব মুহুর্তে আর একবার দৃষ্টিপাত করলাম ঘরের ভেতটায় আর সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড ভাবে চমকে উঠলাম। জীবনে এতটা চক বােধ করি কোন দিনই আসেনি। আর সেই চমকের সাথে সাথে একটা ভয়াল- কালো ছায়া যেন আমার মানসিক চিন্তাধারাকে ওলােট-পালােট করে দিতে চাইল।

দু’হাত দিয়ে আমার দুটি চোখকে ভাল করে রগড়ে নিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। আমি কি স্বপ্ন দেখছি অথবা আমার মনের ভ্রম! ?

কোনটা !? কিন্তু না, যা দেখছি তা সত্য। একটু আগে মেয়েটির যে চক্ষু দুটির বর্ণনা দিয়েছিলাম, সেই চোখ দুটো আর খােলা নেই। তার পরিবর্তে সেই কাচের আধারের মধ্যে শায়িত রয়েছে সেই মেয়েটি।

চোখ দুটি তার বোজা এবং মেয়েটির মুখে ফুটে আছে মৃদু হাসির ঝলক। যে ঠোট দুটি বন্ধ ছিল, তাও যেন ঈষৎ ফাক হয়ে পড়েছে। টকটকে লাল দুটি ঠোটের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে মেয়েটির সারিবদ্ধ সুন্দর দাঁতের বাহার।

সাহসেরও একটা সীমা আছে। সে সীমা আমায় বােধ হয় ছাড়িয়ে গেছে। মনে হল এক ছুটে ফিরে যাই নিজের ঘরে। কিন্তু পা দুটো অচল অনড় হয়ে তাদের অবস্থা জানিয়ে দিল। সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আসতে লাগল । আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কাচের  কফিনটার দিকে ।

বাইরে তখন অঝাের ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। বিদ্যুতের ঝলক এসে ঘরের সব কিছুকে মাঝে মাঝে ঝলসে দিয়ে যাচ্ছে। আমি দেখছি, আমাকে যেন দেখতেই হবে। দেখে আমার উপায় ছিল না।

কঁচের সেই কফিটা মনে হল যেন একটু নড়ে উঠল। পরক্ষণেই উপরের ডালাটা দু’ফাক হয়ে খুলে গেল।

তারপর......

তারপরই সেই শায়িত সুন্দরীর চোখের পাতা দুটো খুলতে লাগল ধীরে ধীরে।

সেই ভয়ঙ্কর রক্ত-শীতল করা চাউনী দিয়ে আবার যেন সে আমাকে লেহন করে চলল । সর্বাঙ্গ ব্যাণ্ডেজ দিয়ে বাঁধা থাকা সত্ত্বেও মেয়েটি উঠে বসল কফিনের মধ্যে। রক্তবর্ণ জিভ বার করে কয়েকবার ঠোট দুটোকে ভিজিয়ে নিয়ে কফিনের ডালার উপর হাত দুটো প্রসারিত করে নিজেকে কফিনের বাইরে নিয়ে এল সে।

বিস্ময়ে বিমূঢ় অবস্থায় আতংকগ্রস্ত হয়ে আমি তাকিয়ে রয়েছি মেয়েটির দিকে। শত চেষ্টা করেও আমি আমার চোখ দুটোকে অন্য দিকে ঘােরাতে পারলাম না। একটা অদৃশ্য শক্তি যেন আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল।

মেয়েটি এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার চোখ দুটো কিসের আনন্দে চক চক করে উঠছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলাে যখন তার চোখের উপর এসে আছড়ে পড়ছে তখন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার বীভৎস চাউনী। যেন আগুনের ফুলকি ঠিকরে বেরুচ্ছে চোখ দুটো থেকে, আর সেই আগুনের হলকায় আমি যেন দগ্ধ হতে চলেছি।

অনেক, অনেকটা কাছে সে এগিয়ে এসেছে। এতক্ষণ তার ঠোট দুটো ছিল বন্ধ। এবার হঠাৎই খুলে গেল তার ঠোট। লকলকে লাল জিভ বেরিয়ে এল তার মুখগহ্বর থেকে। সেই ভয়ঙ্কর মূর্তির দিকে তখনও আমি চেয়ে আছি নিষ্পলক দৃষ্টি মেলে। নির্বাক, বােধশক্তিহীন হয়ে। আমার নিজের বলতে করণীয় যেন কিছুই নেই।

মেয়েটি আরও এক পা এগিয়ে এসেই চীৎকার করে উঠল। মনে হল কেউ যেন করুণ সুরে বিলাপ করে চলেছে। কিন্তু বড়ই তীব্র সে স্বর। কানের মধ্যে প্রবেশ করে মানুষকে দিশেহারা করে তােলে।

মনে পড়ল, এই রকম অমানুষিক বিলাপের সুর শুনতে পেয়েছিলাম এখানে আসার পথে এবং আরও একবার বাড়ীতে প্রবেশ করার প্রাক্কালে।

মেয়েটির ঠোট দুটি ধীরে ধীরে কাপছে আর সেই ঠোটের ফাঁক দিয়ে বেরুচ্ছে এই অপ্রাকৃত শব্দধ্বনি। যে ধ্বনিকে একজন মহিলার ক্রন্দন ধ্বনি বলে মনে হয়।

আমি যেন এতক্ষণ তন্ময় হয়ে ছিলাম। হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজের সত্ত্বাকে। হঠাৎ এই বুক কাঁপানো ধ্বনি আমার সম্বিৎ ফিরিয়ে আনল। আমার মনে হল, আমি যেন এক অদ্ভুত জগৎ থেকে হঠাৎ নিজের জগতে ফিরে এসেছি।

মেয়েটি এগিয়ে আসছে আমার দিকে। নিস্পলক চোখে ঝরছে তার আগুনের হলকা। যেন এক মূর্তিমতী অভিশাপ। ডাকিনী হয়ে আসছে তাজা তাজা রক্ত চুষে খাওয়ার উল্লাসে, আনন্দে।

আরও, আরও কাছে এগিয়ে এলৌ ঐ ভয়ঙ্করী ডাকিনী। লােভাতুর হিংস্র চোখ দুটি তার আরও বড় হয়ে উঠল। জিভ বার করে একটা টকাশ করে শব্দ করল সে। ব্যাণ্ডেজ দিয়ে বাঁধা হাত দুটো প্রসারিত করল-আমার দিকে ।

আমি সভয়ে পিছিয়ে এলাম দুপা। জড়তা আমার আগেই দূরীভুত হয়েছিল, ফিরে এসেছিল মানসিক স্থিরতা। ছুটে যে পালাব সে সময়টুকুও ছিল না। রক্তপিপাসু ডাকিনী তখন প্রায় একেবারে সামনা সামনি এসে গেছে। আমি আরও কয়েক পা পেছিয়ে গেলাম। কিন্তু আমার দৃষ্টি মুহুর্তের জন্যও অন্য দিকে না ফিরিয়ে পেছন দিকে সরে যেতে থাকলাম। বুঝতে পারছি যে কোনও মুহূর্তে সে লাফ দিয়ে পড়বে আমার ঘাড়ে। সুতরাং মনকে দৃঢ় করে প্রস্তুত হলাম! প্রয়ােজন হলে সর্ব শক্তি নিয়ােগ করেও ওব আক্রমণকে প্রতিহত করতে হবে। আর কথাটাও জানি আমার সাহস হারালে চলবে না।' মনকে কঠিন করে রাখতে হবে। সাহস হারালে মৃত্যু অবধারিত, বুঝতে পারলাম।

পিছন হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ লােহার রড, দেখতে পেলাম। পাশেই রয়েছে পড়ে। চোখের পলক পড়ার থেকেও দ্রুতবেগে কুড়িয়ে নিলাম সেই রড টি । মনটা দ্বিগুণ উৎসাহে ভরে উঠল। রড, হাতে নিয়ে স্থির দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মেয়েটি আর এক পা অগ্রসর হলেই ওর মাথাটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবাে। তা সে অশরীরী ডাকিনী অথবা রক্ত-মাংসের মানুষ যেই হােক না কেন!

ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম বারান্দায়। প্রচণ্ড বৃষ্টির সঙ্গে চলছিল ঝড়ের তাণ্ডব। কিন্তু কোনদিকেই তখন আমার হুস ছিল না।

মেয়েটির একজোড়া অস্বাভাবিক চোখের তারায় তখন আমার মনপ্রাণ নিবদ্ধ।

জলের ঝাপটা এসে আছড়ে পড়ছে আমাদের গায়ে। সর্বাঙ্গ ভিজে উঠেছে এরই মধ্যে।

এক ঝলক বিদ্যুতের আলাে এসে পড়ল মেয়েটির মুখে। সে একটা অস্বাভাবিক চিৎকার করে লাফিয়ে পড়ল আমার দিকে  ক্ষিপ্রবেগে পিছিয়ে এলাম কয়েক পা।

মেয়েটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল।

একটুর জন্যে ওই দানবীর কবল থেকে নিজেকে বাঁচাতে সমর্থ হলাম বটে, কিন্তু সে যেন আরও ক্ষিপ্র হয়ে উঠল।

তার মুখের চেহারা হ’ল আরও ভয়ংকর। লকলকে জিভ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে ।

রক্তের নেশায় যেন সে উন্মাদ হয়ে গেছে।

আমি আর মুহূর্ত মাত্র সময় নষ্ট না করে দৃঢ় মুষ্টিতে লােহার রডটি মেয়েটির মাথা লক্ষ্য করে উচিয়ে ধরলাম। আর একটি পা অগ্রসর হলেই আমি ওর মাথাটা গুড়িয়ে থেতাে করে দেবাে।

উত্তেজনায় তখন আমার সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। হরির বাড়ীতে এসে শেষ অবধি যে এমনি এক মারাত্মক পরিস্থিতির সঙ্গে মােকাবিলা করতে হবে, ভাবতেই পারিনি।

মেয়েটি আর এক পা এগিয়ে আসতেই আমি সজোরে লােহার রডটা ওর মাথা লক্ষ্য করে চালিয়ে দিলাম।

কিন্তু পরমুহূর্তেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম ঘটনার আকস্মিকতায়। যেই মুহুর্তে আমি রডটা চালিয়ে দিলাম মেয়েটির মাথার দিকে, ঠিক সেই মুহূর্তেই ঝড়ের বেগে হরিনারায়ণ এসে রডটা ধরে ফেলল। আর এক সেকেণ্ড দেরী হলে হয়তাে মেয়েটির মাথা দু ফাঁক হয়ে যেত রডের আঘাতে।

হরিকে দেখে মেয়েটি যেন কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেল। হরি কোন কথা না বলে মেয়েটির দিকে ভৎসনার চোখে তাকিয়ে আদেশের সুরে, বললে, তােমাকে অনেকবার সাবধান করে দিয়েছি ইলা যে তুমি কখনই আমার বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি অসদাচারণ করবে না। কিন্তু আমি খুবই দুঃখিত তােমার ব্যবহারে । ছিঃ ছিঃ !

যাও নিজের ঘরে ফিরে যাও।

ইলা সুড় সুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। হরি আমার দিকে ফিরে বলল, তুমি দাদা বাইরে বেরিয়েছে। কেন? এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। তােমার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করাে

আমি এখুনি আসছি। বলেই হরিনারায়ণ ঢুকে গেল ইলার ঘরের মধ্যে।

আমি নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড কৌতূহল মনটাকে উতলা করে তুললাে। হরি কি করছে ইলার

ঘরে । আমাকে তা দেখতেই হবে। আমি নিজের ঘরের দিকে না গিয়ে ফিরে চললাম ইলার ঘরের দিকে।


(পর্ব ৪)

চুপিসাড়ে ঘরের বাইরে থেকে ভিতরের দিকে তাকাতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের সামনে। হরির চোখ দিয়ে যেন অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। হাতে একটা প্রকাণ্ড চাবুক। আর সেই চাবুক দিয়ে ইলাকে সপাসপ মেরে চলেছে। ইলার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে করুণ আর্তনাদ। যে শব্দ আমি এর আগেও কয়েক বার শুনেছি। হরিকে বলতে শুনলাম, শােন ইলা, আমি চাই না তুমি আমার আদেশকে অমান্য কর । তােমার যা প্রয়ােজন আমি সব সময়েই তা যুগিয়ে চলেছি, কিন্তু তা সত্বেও যদি তুমি লােভের মাত্রা বাড়াতে চাও তার ফল ভাল হবে না। যাও তােমার জায়গায় ফিরে যাও।

ইলা কোন কথা না বলে সেই কাঁচের বাক্সের মধ্যে গিয়ে শুয়ে পড়ল। হরি কয়েকটি জীবন্ত মুরগী সেই বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে ডালাটা বন্ধ করে দিল।

আমি লঘু পদক্ষেপে দ্রুত ফিরে এলাম নিজের ঘরে। বিছানায় শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম, একটু আগে যা দেখলাম তা কি সত্য?

বাস্তবের সঙ্গে এই ঘটনার মিল কতটুকু?

অথবা আমি একটা ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে চলেছি।

মেয়েটি কে ? আর ঐ মেয়েটিকে ঐ অবস্থায় রাখার মানেই বা কি? ইলা কি জীবিত অথবা সে মৃত ? কোনটা ঠিক ! সাধারণ মানুষের সঙ্গে ওর মিল কোথায় ? হাজার প্রশ্ন মনের মধ্যে ভীড় করে আসছে। কিন্তু সমাধান করার মত কোন সূত্রই আমি পাচ্ছিলাম না। একমাত্র হরিকে পেলে তার কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করা ছাড়া আর কোন রাস্তাই দেখতে পেলাম না। জীবন্ত মুরগী গুলােকে কেন ইলার সঙ্গে রাখা হল ? এই কথাটা ভেবে খুবই অবাক হয়েছি। কিন্তু কোন সমাধানে পৌঁছতে পারছি না।

মাঝে মাঝে এক আশংকা গুরুগুর করে উঠছিল মনের মধ্যে।

অনুভব করছি আমার চারিদিকে যেন এক অশুভ ইংগীত একযােগে তাদের ঐক্যতান শুরু করেছে। কিন্তু আমার, ঠিক এই মুহূর্তে, করনীয় বলতে কিছু নাই। হরির আতিথ্য গ্রহণ করেছি। হরিই এখন আমার ভরসা।

অথচ হরি কেমন সহজ-সচ্ছল ভাবে এখানে বাস করছে এ কথা চিন্তা করে বিস্মৃত হলাম । এ সবের মধ্যে হরি নিজেকে কিভাবে যে জড়িয়ে ফেলল ; অনুমান করা আমার পক্ষে কষ্টসাধ্য ব্যাপার!

খট করে একটা শব্দ হতেই ফিরে তাকালাম পাশের জানলাটার দিকে। একটা দমকা হাওয়া যেন ছুটে এলাে। আমি কিছু একটা দেখবার আগেই দপ করে নিভে গেল ঘরের আলাে।

কিন্তু ওটা কি!? ঐ যে!! খােলা জানলার ঠিক বাইরে !!

এক জোড়া চোখ জলন্ত অঙ্গারের মত জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। হিংস্র রক্তলােভী পৈশাচিক উল্লাস যেন ঝড়ে পড়ছে ঐ দৃষ্টি থেকে।

অন্ধকারের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসছে দেখতে পাচ্ছি। শুধু একজোড়া অগ্নি-বিন্দু। আর একটু বাদেই যেন সে আমাকে গিলে খেয়ে ফেলবে। যদিও অন্ধকারের মধ্যে শরীরের কোন অংশই দেখতে পাচ্ছিলাম না; তবু যেন মনে হচ্ছিল ওর বিরাট হা আমাকে গ্রাস করবে।

হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন, দ্রুততর হয়ে উঠছে আমার। কি করবাে অথবা আমার করণীয় কি হতে পারে কিছুই মগজে আসছিল না।

আমাকে কেউ যেন পাথরের সঙ্গে বেঁধে রেখে আমার নড়বার-চড়বার ক্ষমতা লুপ্ত করে দিয়েছে।

সেই ভয়ঙ্কর চোখ জোড়া আমার আরও কাছে চলে এসেছে।

এক অসহনীয় অবস্থায় অন্ধকারের মধ্যে আমি এক অজানা শত্রুর সামনে দাড়িয়ে। এইবার--এইবার হয়তাে সে ছিড়ে খাবে আমাকে তার হিংস্র ধারালো নখর দিয়ে।

সপাং করে একটা শব্দ হল । শব্দের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, জলন্ত চোখ জোড়া যেন সেই আগেকার দ্যুতি হারিয়ে ফেলেছে।

ফুটে উঠেছে একটা ভয়ার্ত ছায়া। ধীরে ধীরে সে সরে যেতে লাগল জানলার দিকে।

সেই মুহূর্তে এক ঝলক বিদ্যুতের আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে।

এক লহমায় দেখতে পেলাম একটা বিরাটকায় কালো ছায়া সড়াৎ করে জানলার ফাক দিয়ে গলে গেল। ঘরের মধ্যে দাড়িয়ে আছে হরিনারায়ণ । হাতে রয়েছে সেই লম্বা চাবুক।

ভেসে এল হরির কণ্ঠস্বর-অন্ধকারের মধ্যে বসে রয়েছ কেন দাদা?

টেবিলের তলায় একটা হারিকেন আছে, জেলে দাও! বৃষ্টির জলে বাড়ীর লাইট ফিউজ হয়ে গেছে।

সম্বিৎ ফিরল হরি কথায়। এতক্ষণ যেন আমি আমার নিজের মধ্যে ছিলাম না। হরির কথার কোন জবাব না দিয়ে দেশলাই বার করে ফস্ করে একটা কাঠি জেলে হারিকেনটা জালিয়ে দিলাম।

হরিকে বেশ চঞ্চল আর গম্ভীর মনে হল। সে এগিয়ে এসে আমার সামনের চেয়ারটায় বসে পড়ল।

আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই হরি তার কণ্ঠস্বরকে যথা সম্ভব গম্ভীর করে বললেন, দেখ দাদা! বার বার এক কথা বলা আমার সভাব নয়! তােমাকে ইতিপূর্বেই বলেছি, কোনরকম কৌতূহল দেখাবে না! অথবা ঘর ছেড়ে বাইরে যাবে না। কিন্তু তুমি আমার কথা শুনছ না। এটা ঠিক নয়।

একটু থেমে একটা বুক সেলফের দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে হরি পুনরায় বলতে শুরু করল—আপাততঃ তুমি এই বইগুলাে পড়। আমার মনে হয় তুমি যা জানতে চাও তার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। আর একটা কথা তােমাকে বলে রাখি, তুমি অনেক কিছুই হয়তাে দেখবে যা তােমার কল্পনা বা চিন্তার বাইরে। তাই বলে হুট করে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যেও না যেন।

হঠাৎ হরির চোখের দৃষ্টি কোমল আর আদ্র হয়ে উঠল, কণ্ঠ হয়ে উঠল বাষ্পরুদ্ধ। সে বললে, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি দাদা।

আমি জানি তুমি নিহরষ্কারী এবং পরােপকারী। আর এটুকুও জানি তুমি নিশ্চয়ই আমার জন্যে এটুকু উপকার করতে কার্পণ্য করবে না।

– কি যা তা বলছে !?—আমি হরির কথায় বাধা দিয়ে বলে উঠলাম,-উপকার করার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে হরি ? তুমি নেমন্তন্ন করেছ, আমি এসেছি। এখন বলাে তােমার জন্যে আমি কি করতে পারি ?

স্থির দৃষ্টি মেলে হরি তাকাল আমার দিকে। বললে, তুমি বইগুলাে হাতে নিলেই বুঝতে পারবে আমি কি চাই, আর কি উপকার প্রত্যাশা করি তােমার কাছ থেকে। হয়তাে তােমার সঙ্গে আমার আর দেখা সাক্ষাৎ নাও হতে পারে। তুমি শুধু বন্ধুকৃত্যটুকু করলেই আমরা তােমার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবাে দাদা। তুমি জান না আমরা অসহ্য যন্ত্রণা ভােগ করছি। নরক যন্ত্রনা যে কি দারুণ যন্ত্রনা তা তােমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবাে না। তুমি আমাকে মুক্তি দাও।

হ্যাঁ দাদা, একমাত্র তুমিই পারাে আমাকে এই নরককুণ্ড থেকে উদ্ধার করতে।

আমি অভিভূত হয়ে শুনছিলাম হরিনারায়ণের কথা। বললাম হরি ব্যাপারটা একটু খুলেই বলনা কেন ?

কিন্তু আমার কথা শােনবার অপেক্ষায় হরি ছিল না। চেয়ার শূন্য ।

আমি হয়ত অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম একটু, সেই সুযােগে হরি কখন যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে টের পাইনি।

বিছানা ছেড়ে এগিয়ে চললাম বুক-সেলফের দিকে। দেখতে হবে, এই সব বইগুলােতে কি এমন লেখা রয়েছে যাতে করে আমার সকল প্রশ্নের জবাব মিলবে।

সপ, সপ, সপাং। একটা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এল এক অমানুষিক আর্তনাদ! কোন মানুষ অমন বীভৎস ভাবে আর্তনাদ

করতে পারে বলে মনে হয় না। আমি ছুটে গেলাম জানলার ধরে।

জানলার মধ্য দিয়ে দেখলাম এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। বাড়ীর সামনের চাতালটায় হরি পঁড়িয়ে আছে। হাতে তার চাবুক। সেই চাবুক দিয়ে সে নির্দয় ভাবে প্রহার করে চলেছে চার পাঁচটি বিরাটকায় বাদুড় শ্রেণীর জীবকে। জীবগুলির আর্তনাদ সারা অঞ্চলকে কাঁপিয়ে তুলেছে।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে জানালা দিয়ে কাণ্ড লক্ষ্য করে চলেছি।

কয়েক ঘ| চাবুক খাবার পর বাহড়গুলির দেহের হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে গেল। বাদুড়ের পরিবর্তে দেখা গেল কয়েক জন মানুষকে।

আমার বিস্ময়ের মাত্রা উত্তরােত্তর বেড়ে চলছিল হরির কাণ্ড দেখে। হরি ভৎর্সনার সুরে ঐ বাদুড়-মানুষগুলােকে তিরস্কার করে বলছে, হতভাগার দল, তােদর মুক্তির জন্যেই আমাকে এত কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে, অথচ প্রত্যেক বারই আমার চেষ্টাকে তােরা বানচাল করে দিচ্ছি! ফের যদি অবাধ্য হােস তবে এখান থেকে দূর করে দেবাে।

এখানে তােদের আশ্রয় হবে না। আশা করি কথাগুলো মনে থাকবে।

মানুষের রক্তের পরিবর্তে আজকের মত হাঁসের রক্ত খেয়ে থাকগে যা।

হরি গুটিকয় হাঁস ওদের হাতে দিতেই ওরা মুহূর্ত মাত্র দেরী না করে হাঁসের গলার কাছটায় দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষতে থাকলো, মুখে ফুটে উঠল এক বীভৎস রূপ। ঠোটের কষ বেয়ে গড়াতে লাগল তাজা রক্ত। পিশাচের পৈশাচিক কাণ্ড দেখে ভয়ে শিউরে উঠল আমার বুক। বুঝলাম, একটু আগেই অন্ধকারের মধ্যে এদেরই একজন এসেছিল আমার রক্ত পান করতে। কিন্তু হরির উপস্থিতিতে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়ে গেছি।

কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম খেয়াল ছিল না। চুড়ি র শব্দে চমক ভাঙলো। ফিরে দেখি, দরজার নামনে দাঁড়িয়ে ইলা।

এক রাশ চুড়ি পরেছে দু’হাতে। কিন্তু আশ্চর্য হলাম দেখে যে একটু আগে যাকে দেখছিলাম ব্যাণ্ডেজ বাঁধা অবস্থায় এখন তার শরীরের কোন অংশেই কোন ব্যান্ডেজ করা ছিল না। সুন্দর সিল্কের শাড়ী পরে অপরূপ সাজে সে দাড়িয়ে।

ইলাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সুন্দরী বললেও বােধ করি ঠিক বলা হয় না। স্বর্গের অপ্সরার যেন আবির্ভাব ঘটেছে মর্তে। চোখ ফেরানাে যায় না। চোখ ঝলসে যাচ্ছে তার রূপের জৌলুষে।' মুখে তার মনমােহিনী হাসি।

বিস্ময়ের ঘাের কাটিয়ে উঠতে একটু সময় লাগল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার ব্যাণ্ডেজ কোথায় গেল ।

কল কল খল খল করে হেসে উঠল ইলা। সেই হাসির আমেজ আমার মগজকে যেন অবশ করে দিল। ইচ্ছা হল ছুটে যাই ইলার কাছে। হরি যদি কিছু ভাবে তো ভাবুক, আমার, তাতে কিছুই আসে যায় না।

ইলা আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে অনুযােগ ভরা কণ্ঠে বললে, আমাকে জোর করে ব্যাণ্ডেজ দিয়ে মুড়ে রেখেছে ঐ হতভাগা হরিনারাণটা আর জোর জবরদস্তি করে ঐ কাঁচের বাক্সটায় আমাকে থাকতে বাধ্য করাচ্ছে। বলুন তো এটা কি ওর ঠিক হচ্ছে ?

নিশ্চয়ই না! আমি প্রতিবাদ করে বললাম, খুবই অন্যায় কথা, হরিকে আমি নিশ্চয়ই বলবে। তবে, তার আগে আমাকে জানতে হবে হরির সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কতদূর?

-কোন সম্পর্ক নাই, ঝাঁঝালাে গলায় ইলা৷ বললে, ও আমাকে জোর করে এখানে কয়েদ করে রেখেছে। আমি এখান থেকে পালাতে চাই। কিন্তু ....

-কিন্তু ! কিন্তুটা কি?-প্রচণ্ড আগ্রহ প্রকাশ পায় আমার মুখে। আমি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বলো, তুমি নির্ভয়েই বলো ইলা।

আবদারের সুরে ইলা বললে, বলবাে বই কি, নিশ্চয়ই বলব।

সেই জন্যেই তো এলাম। আপনি হারিকেনের আলােটা নিভিয়ে দিন।

হরি যদি এসে পড়ে মুস্কিল হবে।

না, না, সেটা ঠিক হবে না ইলা-আমি চিন্তিত ভাবে বললাম, হঠাৎ যদি হরি এসে পড়ে তবে বড়ই লজ্জার ব্যাপার হবে। হরি আমাকে অন্য কিছু ভাবুক, তা আমি চাই না।

-বেশ! তবে বাইয়ে আসুন বারান্দাটা অন্ধকার আছে ওখানে দাঁড়িয়ে শুনবেন -ইলা! হাতছানি দিয়ে আমাকে অনুসরণ করতে বলল।

নেহাৎ মন্দ কথা বলেনি ইলা, আমি ইলাকে অনুসরণ করে বারান্দায় এলাম। 

বারান্দাটা তখন গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। বৃষ্টির জোর অনেকটা কমে গেছে। ইলাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না।

কেবল একটা সাদা মূতিকে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।

ফিস্ ফিস্ শব্দ ভেসে এল ঐ সাদা মূর্তিটার কাছ থেকে, এদিকে  এগিয়ে আসুন! আমি নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম 'মূর্তিটির কাছে।

বললাম, বলো ইলা, কি বলতে চাও?

আমাকে জোর করে এখানে আটকে রেখেছে, আপনি আমাকে উদ্ধার করুন, -ইলা আরও সান্নিধ্যে এগিয়ে এসে বললে, দিনের পর দিন ওর অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছি। দেখছেন না সব সময়েই আমাকে ব্যাণ্ডেজ দিয়ে আড়াল করে রাখে। হাতের কাছে খাবার থাকলেও খেতে দেয় না।

—এটা তো খুবই অন্যায় কথা,—আমি সায় দিয়ে বললাম, হরি যে এতটা নীচে নেমে যাবে সেকথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি ইলা।

আমি নিশ্চয়ই তােমাকে উদ্ধার করবাে, এবং ..."।

কথাটা মাঝপথে আটকে গেল আচম্বিতে ইলা আমাকে জড়িয়ে ধরাতে। ইলার নিঃশ্বাস এসে পড়ছে আমার গালে। উঃ কি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সে নিঃশ্বাস ! মনে হচ্ছে হিমালয়ের বরফ-ঘেরা গিরিশিখর থেকে কেউ যেন হিম-শীতল হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে।

আমি অভিভূতের মত নিঃসাড়ে ইলার কবলে অত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলাম। হঠাৎ ইলা মুখটাকে আমার ঘাড়ের কাছে নামিয়ে আনল। আমি অনুভব করলাম ইলা তীক্ষ দাত বসিয়ে দিয়েছে আমার ঘাড়ে ।

বুঝতে অসুবিধা হল না যে হরির কথা না শুনে খুবই অন্যায় করে ফেলেছি। মেয়েটি নিশ্চই পিশাচী। কিন্তু এখন আর সেকথা ভেবে কোন লাভ নাই। নিজের বুদ্ধিকেই তিরস্কার করলাম।


(পর্ব ৫)

সপাং! একটা চাবুকের শব্দ কানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম, আমি মুক্ত। ইলা অমিকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।

হরির বিরক্তিসূচক কণ্ঠস্বর চমকে উঠলাম, ছিঃ ছিঃ দাদা! কতবার বারণ করেছি যে ঘরের বাইরে না যেতে কিন্তু কথা না শুনে কতখানি বিপদে পড়েছিলেন বলুন তো? যা শিগগীর নিজের ঘরে ফিরে যান!

অপরাধীর মত সুড়সুড় করে ফিরে গেলাম নিজের ঘরে।

দরজাটা আপনা হতেই বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে। হরি আর আমার সঙ্গে আমার ঘরে এলো না। যাই হােক, ঘরের মধ্যে ঢুকতেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল। মনে হল একটা দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছি যেন।

বুক সেলফের কাছে এগিয়ে গেলাম।

হা হতােস্মি, একটিও বই দেখলাম না সেলফে, পরিবর্তে পড়ে আছে একটা কালাে, খাতা।

মলাটের উপর জমা ধূলাে ময়লা দেখে মনেই হবে না যে কেউ ওটা নিয়ে নাড়া চাড়া করেছিল। বহুদিন ধরে অব্যবহৃত ঐ খাতাখানি ছাড়া দ্বিতীয় কোন বই দেখা গেল না। যদিও কিছুক্ষণ আগে হরি যখন সেলফটার কথা উল্লেখ করেছিল তখন প্রচুর বই নজরে পড়েছিল। থাকে থাকে সাজানাে ছিল বুক-সেলফের মধ্যে।

আশ্চর্য হয়ে ভাবছি ব্যাপারটা আসলে কি ? 

আমার চোখের ভুল অথবা, অথবা না, না, অসম্ভব ।  যে সেলফে ধুলো ময়লা ভর্তি কালাে খাতা থাকতে পারে, সে সেলফে কখনই সেলফ ঠাসা বই থাকা সম্ভব নয়।

ব্যাপারটা পরে ভেবে দেখবাে চিন্তা করে কালাে খাতাটা তুলে নিলাম সেলফ থেকে।

হারিকেনের আলােটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে কালাে খাতাটা যেই খুলেছি অমনি এক প্রচণ্ড গর্জনে সারা বাড়িটা গুম গুম করে উঠল।

সভয়ে খাতাটা বন্ধ করে টেবিলের উপর রেখে দিলাম।

গর্জনের চোটে কানে তালা লাগার উপক্রম। মনে হল শত শত ক্ষুধার্ত সিংহ একযােগে গর্জন শুরু করেছে। আর সেই দাপটে ঘুর বাড়ী থর থর করে কাঁপছে।

তাড়াতাড়ি জানালার কাছে গিয়ে মুখ বাড়াতেই এক অবর্ণনীয় কল্পনাতীত দৃশ্য চোখে পড়ল। যে গরু দুটো আমাদের গাড়ী টানছিল, অবশ্য আমার তাই মনে হল, তাদের নাক আর মুখ দিয়েই নিঃসৃত হচ্ছিল ওইরূপ বিকট আওয়াজ।

চোখ দুটো ফুটবলের মত বড় বড় হয়ে উঠেছে।

নিঃশ্বাসে বেরুচ্ছে ললকে আগুনের হল্কা। গরু হয়েও সরীসৃপের মতো হামাগুড়ি দিচ্ছে। আবার বাঁদরের মত সামনের দু’পা’কে হাত হিসাবে ব্যবহার করছে।

ভুঁতুরিয়া ষ্টেশন থেকে শুরু করে এই মুহুর্ত অবধি যে অবস্থার মধ্য দিয়ে আমি চলেছি, তার প্রকৃত ব্যাখ্যা কি হতে পারে তা বােধগম্য হওয়া দূরে থাক, আমি যেন ক্রমান্বয়ে এক অভূতপূর্ব কুহেলিকার মাঝখানে গিয়ে পড়ছি। মনের নিভৃতে একবার একটা কথা উঁকি মেরে গেল। এ কি তবে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের খেলা চলেছে ! যে যুগে বিরাটাকায় প্রাণীসমূহ পৃথিবীতে বিচরণ করতো ? আমি কি তবে সেই যুগে ফিরে এসেছি ? কোনো এক মহাশক্তির যাদু-দণ্ডের পরশে !

এইসব বৃহৎ নভােচরেরা কি তবে টেরাডাকটাইল গােষ্ঠির বংশধর।

আর এই গরুগুলাে, যাদের দেখলে মনে হয় গরু। কিন্তু তাদের অবয়ব না গরু, না বাঁদর, না কিছুর সমন্বয়ে সৃষ্ট। এ যেন ভগবানের এক অপূর্ব সৃষ্টি নৈপুণ্য। একটা অদ্ভুত ধরনের খেলা। যে খেলা ডাইনােসর আর টাইরােনােসরস যুগে তিনি খেলেছিলেন ?

আমার জানলার ঠিক নিচেই ওরা গজরাচ্ছিল। একটা গরু ছাদ থেকে নেমে আসা জলের পাইপ বেয়ে উপরের দিকে ওঠবার চেষ্টা করছিল আর সঙ্গে সঙ্গে অপর গরুটি প্রচণ্ড হুংকার দিয়ে প্রথম গরুর ল্যাজ ধরে একটানে মাটিতে ফেলে দিচ্ছিল। এই নিয়ে উভয়ের মধ্যে চলছিল এক প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ। ওদের ঘরােয়া যুদ্ধের ফলে মাটি কঁপছিল এমন কি বাড়ীটাও দুলে উঠছিল।

হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই শরীর হিম হয়ে এল। ওরা আমাকে আক্রমণ করতে আসছে না তাে? পাইপ বেয়ে যদি সত্যি সত্যিই উঠে আসে তা হলে ওদের নিঃশ্বাসেই তো আগুন ধরে যাবে জানালা কপাট, সব কিছুতে। তাড়াতাড়ি মুখটা জানলা থেকে সরিয়ে জানলা বন্ধ করতে যাবাে এমন সময় দেখলাম, কোথা থেকে ছুটে এলো হরিনারাণ! 

হাতে সেই প্রকাণ্ড চাবুক ।

মুহুর্ত অপেক্ষা না করে হরি সপাসপ চাবুক চালাতে লাগল গরু দুটির দিকে। হরির চাবুকে যেন আশ্চৰ্য্য যাদু ছিল ।

দৃষ্টি হয়ে এল সচল ও সাধারণ। নিঃশ্বাসে আর দেখা গেল না কোন আগুন ! গরু দুটি মাথা নীচু করে চলে গেল । চলে যাবার পূর্ব মুহূর্তে একবার মাত্র মাথাটা ঘুরিয়ে দেখে নিল আমার দিকে।

সেই চাহনীর দিকে অতিবড় সাহসীও চেয়ে থাকতে পারবে না।

আমি ঘরের মধ্যে সরে এলাম। তবে, এটুকু বিশ্বাস আমার জন্মেছিল।

যে, এই ঘরের মধ্যে কেউ আমার ক্ষতি করতে পারবে না।

সুতরাং বাইরে যা কিছু ঘটে ঘটুক, আমি ঘর ছেড়ে বাইরে যাবে না।

বিছানার উপর বসে কালাে খাতাটার পাতা ওলটাতেই যা যা নজরে পড়ল তাতে বেশ অবাক হয়ে গেলাম। বড় বড় হরফে

আমাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা হয়েছে।

দাদা,

আমি জানি একমাত্র আপনি ছাড়া এটুকু উপকার কেউ করবে না। তাই আপনাকে নিমন্ত্রণ করে এখানে আনতে হয়েছে। সকাল হলেই আপনি মুহূর্ত মাত্র সময় নষ্ট না করে গয়ায় গিয়ে এই খাতায় যে সব নাম ধাম গােত্র লেখা আছে তাদের নামে পিণ্ডদান করে এইসব হতভাগ্যদের নরকযন্ত্রনা থেকে মুক্ত করুন। ঘটনাটি ঘটে এমনি এক ঝড়ের রাতে। এইসব হতভাগ্যরা বজ্রাঘাতে মৃত্যু বরণ করে ।

যে দু'একজন বেঁচে ছিল তার মৃতদেহগুলিকে কবর দিয়ে এ স্থান তাগ। করে চলে যায়। সেই থেকে এই সব হতভাগ্যের দল, রাত্রি হলেই কবর ছেড়ে উঠে পড়ে রক্তের নেশায় পাগল হয়ে। জীবন্ত যা কিছু দেখতে পায় তাদেরই রক্ত শোষণ করতে থাকে। আমিও করেছি।

ইলা আমার বাগদত্তা, অন্যান্যেরা আমার চাকরবাকরের দল।

ইতি হরিনারায়ণ।

পাতার পর পাতায় যথাক্রমে হরিনারায়ণ, ইলা, ইত্যাদি বহুজনের নাম ধাম গােত্র লেখা রয়েছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কি করে সম্ভব কিছুতেই বুঝতে পারছি না। জলজ্যান্ত মানুষ গুলো, যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, এমন কি ইলার সানিধ্যে তার নিঃশ্বাসের হিমেল অনুভূতি টুকু পর্যন্ত পেয়েছি, এদের পিণ্ডদান করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে এই খাতা মারফৎ। কারণ কি! এরা কি সবাই মৃত?' আমি এতক্ষণ যাদের দেখলাম বা দেখছি সবই কি তবে ওদের প্রেত-রূপ ?

এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে আছড়ে পড়লো। জানালা দিয়ে আলাের বন্যা ছড়িয়ে পড়ছে ঘরের মধ্যে। ভাের হয়ে গেছে।

আকাশের জমাট মেঘ কখন যে সরে গিয়ে নীল আকাশ ফুটে উঠছে দেখতে পাইনি।

আমি কালাে খাতাটা হাতে নিয়ে ছুটলাম ইলার ঘরের দিকে ।

আমার বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হচ্ছিল না যে ইলা সত্য সত্যই রাতে প্রেতমূর্তি নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হয়েছিল।

ঘরের দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম সেই কাচের কফিনটা। সারা অঙ্গে ব্যাণ্ডেজবাধা অবস্থায় শায়িত রয়েছে একটি মৃতদেহই।

কফিনটার কাছে এগিয়ে যেতেই বিস্ময়ে ফেটে পড়লাম। '

 যেমনটি প্রথমবার দেখেছিলাম ঠিক তেমনি অবস্থায় শুয়ে আছে ইলা। চোখের মণিদুটো স্থির হয়ে আছে। ইলা মৃত। কিন্তু ঠোঁটের কষ বেয়ে লাল রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়েছে। একটু ভালকরে লক্ষ্য করতেই বুকটা কেঁপে উঠল। তাজা রক্ত এখনও শুকিয়ে জমাট বাঁধেনি।

কফিনের ভিতর কয়েকটি মুরগীর পালক রয়েছে পড়ে।

গতরাতে হরি যে মুরগীগুলাে : ওর কফিনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, এই রক্ত সেই মুরগীগুলােরই!

আমি একছুটে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। দরজাটা দু’ফাঁক করে খুলে ধরতেই প্রভাতী সূর্যের আলাে এসে ঘর ভরিয়ে দিল।

শেষবারের মত আর একবার ঘরের মধ্যে তাকাতেই আরও অবাক হয়ে গেলাম। সূর্যের আলাে ঢােকার সঙ্গে সঙ্গেই ইলা সমেত কফিনটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। ঘরটি একদম ফাঁকা।

কেবল মুরগীর কয়েকটি পালক ইতস্ততঃ ছড়িয়ে আছে।

এক লাফে দোতলা থেকে নেমে এসে দাঁড়ালাম উঠোনটার মাঝখানে। দিনের আলােয় তখন পরিষ্কার দেখাচ্ছিল আমার কাছে।

দেখলাম পর পর কয়েকটি সমাধি ক্ষেত্র।

কালো খাতার ক্রমিক নম্বর অনুসারে কবর গুলি সাজানাে।

কবরের ফলকে উৎকীর্ণ নাম ধাম, ইত্যাদির হুবহু নকল আমার হাতের এই কালাে খাতায় রয়েছে লেখা।

ইলার সেই অন্তর্ভেদী চাহনি, জানিনা সে দৃষ্টিতে কি ছিল আমাকে যেন আকর্ষণ করছিল। চৌম্বক যেমন লােহাকে সবলে আকর্ষণ করে নিজের কবজাগত করতে চায় ঠিক তেমনি ধারা এক অনুভূতি শিয়ায় শিরায় অনুভব করলাম।

হাতে সেই কালাে খাতা নিয়ে কবরের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে মনে হল, তাই তো! হিন্দুধর্মের নিয়মানুযায়ী এইসব দেহগুলিকে দাহ করাই ছিল বিধেয়। তবে কেন এইসব মানুষগুলােকে কবরস্থ করা হলাে। এর যে কি কারণ হতে পারে বুঝতে পারলাম না। অথচ হরিনারাণকে যে জিজ্ঞাসা করবে। তারও উপায় নাই। সে এখন শায়িত রয়েছে আমারই সামনে ঐ কবরের তলায়।

একে একে সমস্ত কবরগুলির ইতিবৃত্ত জানবার পর ইলার কবরের কাছে দাড়ালাম, যদিও এখন সকাল হয়ে গেছে। সূর্যের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে চারদিক। তবুও গা’টা ছম ছম করে উঠল।

আমি মানসচক্ষে ইলার সেই হিমশীতল চাহনি দেখতে পেলাম।

ইলা মৃত এবং তার দেহ কবরস্থ করা আছে একথা আমি বুঝতে পারছি, তবু মন বলছে হয়তাে সে কবর খুঁড়ে উঠে আসবে, আমার সামনে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে বসিয়ে দেবে তার ছুঁচলো দুটি দাঁত। আর তারপর নিঃশব্দে শােষণ করে চলবে আমার দেহের রক্ত।

ভাবতেই শিউরে উঠলাম আমি। হরিনারায়ণ না থাকলে হয়তাে আমার জীবনে, গতরাতের অভিজ্ঞতাই শেষ অভিজ্ঞতা হতো। এখানকার মত সােনালী প্রভাত এ জীবনে আর আসতো না। কিন্তু তবু কেন জানি না, ইলার প্রতি কেমন যেন একটা দুর্বলতা অনুভব করলাম।

জানি, ইলার সেই অশরীরী দেহ। জানি, ইলা বেঁচে নেই, আছে ঐ মাটির গহ্বরে। কফিনের মধ্যে তিলে তিলে পচনের মধ্য দিয়ে গলে গলে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে তার দেহ। হয়ত কয়েকটা হাড় পড়ে থাকবে কবরের তলায়। তবু যেন গত রাতের সম্মােহনী দৃষ্টিকে মনে হচ্ছে জীবন্ত। বড়ই ভয়ানক জীবন্ত সেই দৃষ্টি। একবার দেখলে যেন চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। মানসিক চেতনা হয়ে পড়ে পঙ্গু।

নিজের অজ্ঞাতে আত্মসমর্পন করতে হয়।

অদূরেই একটা কোদাল পড়ে রয়েছে দেখতে পেলাম। হাতের কালাে খাতাটা মাটিতে রেখে কোদাল দিয়ে কবর খুঁড়তে শুরু করলাম।

কেন যে খুঁড়ছি তা জানি না। কিন্তু মনের এক কোনা থেকে নিয়ত কে যেন উৎসাহিত করে চলেছে কবর খোঁড়ার জন্যে।

খানিক মাটি তােলবার পরই কফিনটা বেরিয়ে পড়ল। এক হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে একটু বিশ্রাম করে নিলাম। তারপর কফিনের ঢাকনা খুলতেই চমকে উঠলাম। হ্যা, ঠিক সেই মুখ।

ঠোটের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে রক্তের ধারা। প্রভাতের আগে ওই ঘরের মধ্যে যেমনটি দেখেছিলাম ঠিক তেমনি ভাবেই লেগে রয়েছে রক্তের দাগ !

যুক্তি দিয়ে কোন ব্যাখ্যাই মনকে নিরস্ত করতে পারল না। কিভাবে এই কফিনের মধ্য থেকে ইলা উঠে এসেছিল গতরাত্রে। আর কেমন করেই বা সে কথা বলেছিল আমার সঙ্গে। মৃত্যুর পরও কি মানুষ কথা বলতে পারে ?

এত সুন্দর যার মুখের চেহারা, দেখলে মনে হবে সদ্যফোটা একটি গােলাপ যেন। কেমন করে এই নিস্পাপ রমনীয় মুখ রক্তপান করে তৃপ্তি লাভ করতে পারে ? হয়তাে সবই সম্ভব এই দুনিয়াতে। মানুষের বুদ্ধির বাইরেও অনেক কিছু আছে যা মানুষের জানা নাই।

হরিনারাণ বলেছিল এদের মুক্তি দিতে ! একমাত্র গয়ায় পিণ্ডদান করলেই এইসব অভিশপ্তরা মুক্তি পাবে। শান্তি পাবে এইসব হতভাগাদের আত্মা। একদৃষ্টে চেয়েছিলাম ইলার মরদেহের দিকে।

মেয়েটি ছিল হরিনারাণের বাগদত্তা। বেচারী শান্তি পেলাে না।

 ইহজীবনে পারল না সুখ ভােগ করতে। বিধাতার নিষ্করুণ অভিশাপ।

অতৃপ্ত আত্মা মেতে উঠেছে তৃপ্তির নেশায়। সে তৃপ্তি ওদের জৈবিক কোন কামনা বা বাসনা নয় । তাজা তাজা রক্তে ওদের তৃপ্তি। ওরা রক্তের পিপাসায় উন্মত্ত। ভাবতেও কেমন যেন বিশ্রী লাগে ঘুলিয়ে ওঠে সারা গা। শিরশির করে ওঠে শরীরের শিরা উপশিরা,--

আতঙ্কে হাত পা বরফ হয়ে আসতে থাকে।


(পর্ব ৬)

রাতের অন্ধকারে যতই ভয় থাক না কেন, দিনের আলােয় সে ভয়টুকু কেটে গিয়েছিল। আমি কবরখানা ছাড়িয়ে বাড়ীটার আশে পাশে একটু দেখে নেবার জন্যে পা বাড়ালাম। বাড়ীটি অতি জরাজীর্ণ।

চারিদিকের দেওয়ালে চূণবালি খসে পড়েছে। বাড়ীর কার্নিশে, এদিকে ওদিকে অশ্বত্থ গাছ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বাড়ীর মধ্যেকার চাতাল ছাড়িয়ে গেটের দিকে যেতেই নজরে পড়ল একরাশ কঙ্কাল বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বুঝতে পারলাম, এইসব হতভাগ্যের দল ভুল করে এই পথে পা বাড়িয়ে এইসব প্রেতাত্মাদের খােরাক হয়েছে। শুধু যে মানুষের কঙ্কাল পড়েছিল তা নয়, অন্যান্য পশুপক্ষীর কঙ্কালও দেখা গেল ওদের মধ্যে। মনে মনে হরিনারায়ণকে ধন্যবাদ জানালাম। নতুবা এতক্ষণে হয়ত এইসব কঙ্কালের মাঝেই একটি নতুন  বাসস্থান হয়ে যেতো। কথাটা ভাবতেই মনটা ভয়ে কুঁকড়ে উঠল।

আর বীরত্ব দেখিয়ে কাজ নেই ! যত শীঘ্র সম্ভব এই প্রেতপুরী ছেড়ে দূরে চলে যাওয়াই উচিত। তা নাহলে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওরা জেগে উঠবে। ইলা হয়তাে ছুটে আসবে তার সেই রক্ত জল করা চাহনি নিয়ে। চুকচুক করে শুষে নেবে আমার দেহের রক্ত। তারপর ছুড়ে ফেলে দেবে ওই কঙ্কালের স্তুপের মধ্যে।

প্রেতপুরীর জীর্ণ গেটখানা আমার হাতের চাপে ক্যাচ ক্যাচ করে খুলে গেল। আমি বাড়ীর বাইরে বেরিয়ে এলাম। হঠাৎ মনে হল আমি যেন মুক্ত, রাড়ীর চৌহদ্দির মধ্যে যতক্ষণ ছিলাম নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছিল, আমি ইলা বা অন্য সব মৃত মানুষগুলির প্রভাব ছিল আমার উপর। কিন্তু বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম, আমার উপর কারুর বা কোন অদৃশ্য শক্তির প্রভাব নেই।

আমি ছুটলাম ভুঁতুরিয়া’ ষ্টেশনটার দিকে। আজ সন্ধ্যের সেই শেষ ট্রেনটি আমাকে ধরতেই হবে। তা নাহলে আবার নেমে আসবে রাত্রির অন্ধকার ।

এই রাজ্যের ওই প্রেতপুরীর প্রেতেরা জেগে উঠবে। ভাবতেই মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠল। আমি ছুটলাম মাঠের মধ্য দিয়ে। কিছুক্ষণ ছুটবার পর খেয়াল হলাে, আমি ঠিক ঠিক পথে চলছি তাে? ষ্টেশনটা কোন দিকে তাতে আমার জানা নাই।

গত রাত্রে হরিনারাণের গরুর গাড়ী করে এসেছিলাম। সে পথ চিনে, রাখা তাে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া যে অকল্পনীয় পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমি এই পােড়া বাড়ীটায় এসেছি সেই সময়ে কোন সুস্থ মানুষের পক্ষেই অন্য কোন দিকে নজর দেওয়ার সুযােগ ছিল না। ড্রাগন গরু গুলাের বড় বড় রক্তাভ চক্ষু আর নিঃশ্বাসের সঙ্গে আগুনের ঝলক মনে পড়লে হস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম ঘটে।

মাঠের উপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে চলেছি আর রোমন্থন করছি গতরাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা! নিজের অজ্ঞাতসারে একবার পিছন ফিরে তাকালাম ফেলে আসা সেই প্রেতপুরীর দিকে। আর তারপরই মনে পড়ে গেল, এই যাহ,-কালো খাতাটা ফেলে এসেছি ইলার কবরের পাশে। দুর্ভাবনায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।

দূরে দেখা যাচ্ছে সেই পোড়া বাড়ীটা। আশেপাশে অসংখ্য ঝােপঝাড় তার মধ্যে কয়েকটি নারকেল গাছ মাথা উঁচু করে , দাঁড়িয়ে। দিনের আলােতেও দূর থেকে বাড়ীটাকে দেখলে গা ছম ছম করে ওঠে।

কালাে খাতাটা ফেলে রেখে যাওয়াটা কি ঠিক হবে ?

অনবরত সেই কথাটাই মনের চাপ সৃষ্টি করছিল আমার ! অথচ অভিশপ্ত ওই বাড়ীটায় পুনরায় ফিরে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না। ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই একটা হিমেল হাওয়া যেন গায়ের উপর আছড়ে পড়ে শরীর মনকে অসন্ন করে তুলল।

আমি আর ওপথে পা বাড়াতে রাজী নই। ওরা চিরদিন ওদের রাজ্যে বিচরণ করুক। কারও আত্মা মুক্তি পাবে কি না সে

নিয়ে আমার উতলা হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাওয়াই ভাল। বন্ধুকৃত্য করতে এসে শেষটায় জীবন নিয়ে টানাটানি ভাল নয়। আমি পা বাড়ালাম ষ্টেশনের দিকে।

চলতে চলতে মনে হলাে হরিনারাণের কথা। সে আমাকে আমন্ত্রণ করে এনেছিল আর সে সব কিছু ভয়াবহ পরিণতির হাত থেকেও  আমাকে রক্ষা করেছে। কেন ? আমাকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য তার কি ছিল ? সে চেয়েছে মুক্তি। সঙ্গে সঙ্গে সে তার সঙ্গীদেরও মুক্তি কামনা করেছে । এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে আমাকে হরিনারাণ নিয়ে এসেছে এবং প্রতিমুহূর্তে আগলে রেখেছে তার রক্তপায়ী সঙ্গীদের কাছ থেকে।

কথাটা ভাবতেই মনে অনেকটা সাহস ফিরে এল। হরিনারাণের আন্তরিক ইচ্ছাকে কার্যে পরিণত করাই আমার উচিত। যদি বিপদের ঝুকি কিছুটা নিতেই হয়, ক্ষতি নেই। আমি ফিরলাম সেই ফেলে আসা বাড়ীটার দিকে।

সূর্যের আলােয় চারিদিক ঝলমলিয়ে উঠছে। ঝিরঝিরে হাওয়ায় শরীরের ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে অনেকটা। আমি এসে পৌছলাম বাড়ীটার সামনে। লােহার গেটটা হাত দিয়ে ঠেলে বাড়ীর চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকতেই মনটা ছ্যাৎ করে উঠল। মনে হল আবার যেন হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে। সেই চোখ, সেই মুখ, ছায়াছবির মতো ভেসে উঠতে লাগল মানসনেত্রে। আমি এগিয়ে গেলাম কবরখানার দিকে।

অপরূপ বললে হয়তাে রূপের ঠিক বর্ণনা করা হবে না।

ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ রং-এর ভাণ্ডার উজাড় করে, এক, কমনীয় রমনীয় রঙের সমন্বয়ে রাঙিয়ে তােলা হয়েছে ইলাকে। তার সঙ্গে বিশ্বকর্মার নিপুণহাতে তৈরী হয়েছে দেহসৌষ্ঠব। যেখানে যতটুকু প্রয়ােজন সেটুকুই স্থান পেয়েছে ইলার শরীরে। মেঘদূত কাব্যে কালিদাসের তন্বী শ্যামা যেন হার মেনে যায়। ইলাকে দেখলে কালিদাস হয়তাে তার' কাব্যে এক নতুন সংযােজন ঘটাতে, একথা হলফ করেও বলা চলে।

আমার সাহস উত্তরােত্তর বেড়ে যাচ্ছে। হয়তাে দিনের বেলা বলেই কিন্তু যখনই রাত্রি ঘনিয়ে আসবে তখন হয়তাে আমার আর এই সাহস থাকবে না। মনের ভেতর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব।

আমি এক পা এক পা করে এগুচ্ছি। কালাে খাতাটা যে চাই-ই চাই।

কালো খাতাটা পড়ে আছে ইলার কবরের পাশেই। খাতাটা হাত দিয়ে তুলে নেবার সময় চোখ দুটো নিবদ্ধ হল কফিনটার

দিকে। যে কফিনটায় শুয়ে আছে ইলা। বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। কফিনের দিকে তাকাতেই গতরাতের সেই ভয়াবহ ঘটনাগুলি মানসপটে ভেসে উঠল। কি জানি হয়তো দিনের আলােকেই ইলা কবর থেকে উঠে এসে জড়িয়ে ধরবে। তারপরই তার দু’কষ বেয়ে ঝরবে রক্তের ধারা। যে রক্ত আমারই রক্ত। গা শিরশির করে উঠল। না, আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা ঠিক নয়। আমি খাতাটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম গেটের বাইরে। তারপর হাঁটতে লাগলাম ষ্টেশনের দিকে।

মৃতদেহগুলি সম্ভবত বেশীদিন আগে কবরস্থ করা হয়নি। এত সতেজ মৃতদেহ, না দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, কি উপায়ে এই দেহগুলি এমন সুন্দর ভাবে পচন থেকে রক্ষা পাচ্ছে ভেবে কুল পাচ্ছি না। তবে কি এরা মৃত নয় ? তাই বা কেমন ভাবে সম্ভব ? জীবন্ত মানুষ কবরের তলায় বেঁচে থাকবেই বা কি করে ? একটা মস্তবড় হেঁয়ালী মনকে ঘিরে ধরলাে। কিন্তু জট ছাড়াতে সমর্থ হলাম না। হরিনারানের কথা অনুযায়ী এরা মৃত। কিন্তু বাহিক ক্ষেত্রে চোখের সামনে যা প্রত্যক্ষ করলাম, তাতে প্রতীয়মান হয়, এরা মৃত হলেও যেন মৃত নয় !

সে যাই হােক আমার কর্তব্যকর্মটুকু আমি করব। জীবন্ত অথবা মৃত, এ নিয়ে মাথা ঘামানো উচিত নয়। যে জিনিষের ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য, সে জিনিষ সম্বন্ধে অযথা চিন্তা করায় কোন লাভ নেই।

মাঝে মাঝে পিছন ফিরে চেয়ে দেখি, আবার হনহন করে হেঁটে চলি। ক্রমেই দূরত্ব বাড়তে থাকে। এখন আর সেই পােড়া বাড়ীটা দেখলে মনে ভয়ের উদ্রেক হয় না। দূর দিকসীমায় ছায়া ছায়া অস্তিত্ব নজরে আসে। বুক ভরে শ্বাস নিলাম। শরীর ও মন এখন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে আমার।

সামনেই একটা শাল গাছের বন। রাস্তাটা চলে গেছে তারই মধ্যে দিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চললাম। বাড়ীটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে। শাল বনের অপর প্রান্তে যখন পৌছলাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। একটা ছােট নদী বয়ে চলেছে।

বনের প্রান্ত ঘেঁষে। আমি জলে নেমে হাতমুখ ধুয়ে কিছুটা জল খেয়ে নিলাম। তারপর আবার নতুন উদ্যমে শুরু করলাম হাঁটতে।

কিন্তু ষ্টেশন কোথায় বা কোনদিক তার হদিস খুঁজে পেলাম না।

এমন কি এতদূর পথ হেঁটে আসার সময় একটি মানুষকেও পথের মাঝে দেখতে পাইনি।

অথচ সন্ধ্যার আগেই আমাকে হয় ষ্টেশন অথবা রাতের মত একটা আশ্রয়স্থল খুঁজে বার করতে হবে।

আরও খানিকটা চলার পর একটা গ্রাম নজরে পড়ল। আমি সেই গ্রাম লক্ষ্য করে এগিয়ে চললাম। গ্রামের কাছাকাছি একজন চাষীর সঙ্গে দেখা হতেই তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভুঁতুরিয়া ষ্টেশনটা কোনদিকে আর কতদূর ?

লােকটি অবাক দৃষ্টি মেলে আমাকে নিরীক্ষণ করার পর বললে, সে তাে অনেকদূর পথ বাবু ? তা আপনি আসছেন কোথা থেকে ?

আমি বললাম, পথটা বলে দাও ভাই, আমাকে সন্ধ্যার আগেই পৌছাতে হবে। আমি এদিকে বেড়াতে এসে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।

মুখ দেখে মনে হলো লোকটি যেন বিশ্বাস করতে পারেনি।

এই নির্জন পাণ্ডব বর্জিত অঞ্চলে আমার বেড়াতে আসা কথা

কেমন যেন বেমানান। যাইহােক, লােকটি বলল, আপনি যদি শাল বনের ভিতরের রাস্তা দিয়ে যান তবে পাঁচ ক্রোশ পথ হাঁটতে হবে। যে পথটা শালবনের মাঝামাঝি গিয়ে বাঁ হাতে ঘুরে গেছে।

তবে, সাবধানে যাবেন, 'সােজা যে পথটা চলে গেছে ও পথে যাবেন না। ওদিকে গেলে কেউ ফিরে আসে না। আমাদের গ্রামের দুজন মানুষ একবার ওই পথে ভুল করে চলে গিয়েছিল, আজও তারা ফিরে আসেনি। এছাড়া আর একটা রাস্তা আছে, ওই বনের ধারে যে নদীটা আছে। ওই নদীর ধার দিয়ে। ও পথটা একটু ঘুরপথে ষ্টেশনে গেছে। 

কিন্তু রাস্তাটা অনেকখানি, প্রায় আট ক্রোশটাক হবে। কথাটা শুনে ষ্টেশনের পথ যেমন আবিস্কৃত হলে সঙ্গে সঙ্গে দুশ্চিন্তায় ছেয়ে গেল মন। সন্ধ্যের আগে এতদূর পথ যেতে পারবাে কিনা! তার উপর শরীর ক্লান্ত, অবসন্ন। এমন কি পুনরায় রাস্তা ভুল হওয়াটাও কিছু অস্বাভাবিক না।

লােকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি গ্রামের দিকে এগুলাম। যদি কোন চায়ের দোকান পাওয়া যায় তো কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে।

একটি ছােট চায়ের দোকান। নবীন প্রবীণদের একটা ছােট, ভিড়। মুড়ি তেলেভাজা, বিস্কুটও বিক্রী হচ্ছে। আমি দোকানের কাছে আসতেই সকলের কৌতূহলী দৃষ্টি পড়লাে আমার দিকে।

একজন মধ্যবয়স্ক শুধালেন, বাবু মশায়, যাবেন কোথায় ? কার বাড়ী ?

ওরা আমাকে একটু জায়গা করে দিল বসবার জন্য। আমি বেঞ্চটার উপর বসে বললাম, পথ ভুল করে এ গাঁয়ে চলে এসেছি, যাবো কলকাতায়।

আপনাকে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে বাবু, ওদের একজন বললে, নদীর ধার দিয়ে যাবেন। শালবনের ভিতর দিয়ে যাবেন না।

শালবনের রাস্তাটাই তাে কম পথ,আমি বললাম।

ও বনে ঢুকলে কেউ ফিরে আসে না বাবু,-লােকটি ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বললে, নদীর ওপারে ওই শাল বন আর তারও ওপাশে ফাঁকা মাঠের উপরে আছে প্রকাণ্ড এক বাড়ী। পিশাচ আর ডাকিনীদের আখড়া। জ্যান্তমানুষ পেলে ঘাড় মটকিয়ে রক্ত খায়  তবে, নদীর এপারে ওরা আসতে পারে না। আমরা সন্ধ্যের সময় নদীর এপারে থেকে,ওদের কান্না শুনতে পাই। গায়ের রক্ত জলকরা সেই কান্না শুনে ছােট ছােট ছেলেমেয়েরা ভয়ে আঁতকে ওঠে।

ব্যাপারটা সবই বুঝতে পারছি কিন্তু ওদের কাছে প্রকাশ করলাম না।

সেই অমানুষিক কান্নার উৎস আমি জানি। সারারাত আমি ওদের মাঝেই কাটিয়েছিলাম। বললে ওরা ভয় পাবে, হয়তো অন্য কিছুও ভাবতে পারে। আমি কিছু জলযােগ করেই বেরিয়ে পড়লাম ষ্টেশনের দিকে। ঘুর পথে না গিয়ে শালবনের মধ্য দিয়েই সর্টকাট করার মনস্থ করলাম।

ছােট্ট নদীর ঘােট সঁকোটা পার হবার সময়ে মনটা একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু সব কিছু দুর্বলতা ঝেড়েমুছে ফেলে শালবনের রাস্তা দিয়েই এগিয়ে চললাম গন্তব্যস্থলের দিকে। সন্ধ্যার আগেই পৌছতে হবে ষ্টেশনে।

ষ্টেশনে একা একা কাটাতে হবে চিন্তা করতেই গা’টা শিরশির করে উঠল। জনমানবহীন অন্ধকার ষ্টেশনের পরিবেশ স্মরণ করে ভাবনায় পড়লাম। আমার পক্ষে খুব সুখকর হবে না সন্দেহ নেই। আরও জোরে পা চালালাম। সূর্য তখন মাথার উপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। শালবনের পথ যেন ফুরােতে চায় না। হাঁটছি তাে হাঁটছিই। একফালি সরু পথ । মনে হয় এপথ মানুষ সচরাচর ব্যবহার করে না। পরিত্যক্ত পথ হিসাবেই পড়ে আছে।

সামনে, পিছনে যেদিকে তাকাই কোন মানুষ নেই। বহুদিন পর আমিই যেন একমাত্র ব্যক্তি যে এইপথ দিয়ে চলেছি পায়ে হেঁটে। বাতাসে শালগাছগুলির পাতা নড়ছে। মনে হচ্ছে ওরা যেন ফিস ফিস করে "নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আমি যেন ওদের ভাষা বুঝতে পারছি।

ওরা বলতে চাইছে, হে পথিক, একটু তাড়াতাড়ি করাে। তুমি কি - বুঝতে পারছে না যে এক মহা অশুভ শক্তির এলাকা দিয়ে তুমি চলেছে। তুমি কি জানাে না, সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠবে এখানকার রক্তপায়ী পিশাচরা। তারা তােমার রক্ত পান করে নিজেদের মৃত-আত্মাকে জইয়ে রাখবে আরও কিছুদিন।

তুমি কি ওদের সেই অমানুষিক কর্ণবিদারক কান্না শােনননি! যে কান্নার শব্দে তােমার দেহের স্নায়ুগুলি অবশ হয়ে পড়বে। মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্মে ঘটবে বিপর্যয়। চিন্তাশক্তি লােপ পায় সেই নিনিনিদারুণ শব্দ তরঙ্গের শিকার হয়ে!


(পর্ব ৭)

অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সূর্য পশ্চিম আকাশের অনেক নীচে নেমে গেছে। লম্বা লম্বা ছায়া বিস্তার করেছে শালগাছগুলি অস্তগামী সূর্যের আলােয়। যেন লক্ষ লক্ষ অশরীরী ধেয়ে আসছে আমার দিকে।

আমাকে গ্রাস করার উল্লাসে ওরা কেঁপে কেঁপে নেচে উঠছে।

ছায়া ছায়া হাত বাড়িয়ে আহ্বান জানাচ্ছে সন্ধ্যাতারাকে।

গাছেরা হাসছে। দুলে দুলে নেচে নেচে এক একটা গাছ যেন আরেকটা গাছের ওপর গড়িয়ে পড়ছে। আর উভয়ের মিলিত আনন্দ হাসি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে বাতাসে।' শাল অরণ্যের চারিদিকে ধোয়াসার সৃষ্টি হয়ে অন্ধকারকে স্বাগত জানাচ্ছে। আমি যেন ওদের হাসি শুনতে পাচ্ছি। 'ওরা আমাকে হাসির মাধ্যমে বিদ্রুপ করছে।

বলতে চাইছে, কেমন মজা! এ্যাডভেঞ্চারের মজাটা কেমন লাগছে?

তারপরই যেন গাছেরা সুর পাল্টালাে, গাছের পাতার লাফালাফি দাপাদাপি করে বেহাগের করুণ সুরের রেশ ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

মনে হল, ওরা বলছে, তােমার পরিণতির জন্য আমরা দুঃখিত পথিক!

পারতো পালাও, যত তাড়াতাড়ি পারাে ততই মঙ্গল।

আমি কখন যে দৌড়াতে আরম্ভ করেছি নিজেই তা জানিনা।

থামলাম শালবনের শেষপ্রান্তে যেখানে শালবন শেষ হয়েছে। সামনেই উন্মুক্ত প্রান্তরের উপর দিয়ে চলে গেছে রাস্তাটা। আর ছয়  মাইল পথ হাঁটতে হবে। কিন্তু ওদিকে সূর্য যে অস্তগামী!

 ট্রেনটা ধরতে পারবাে কিনা বুঝতে পারছি না। অথচ এই মুহূর্তে পিছনে ফেলে আসা গ্রামটাতে ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়। ফিরতে গেলে রাতের অন্ধকারে পার হতে হবে ঐ ঘন শালবন। না, একেবারেই অসম্ভব।

ট্রেনটা আমাকে ধরতেই হবে। এই অভিশপ্ত পরিবেশ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে হবে !

আরও যে কতটা দৌড়েছি খেয়াল ছিল না। দৃষ্টি ছিল পশ্চিমের দূরদিগন্তে অস্তগামী প্রকাণ্ড থালার মত লাল টুকটুকে বিদায়ী সূর্যের দিকে। দিকচক্রবালে তখন তার অর্ধেক দেহ প্রােথিত। বাকী অর্ধেক মুহর্তের মধ্যেই ডুবে যাবে।

সূর্যের শেষ রশ্মিটুকুও মিলিয়ে গেল আকাশ থেকে। আমি এসে পৌছলাম ভুঁতুরিয়া ষ্টেশনে। রেল লাইনের উপর দাড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম অপসৃয়মান একটি লাল আলাের দিকে। ট্রেনটি মিনিট, দুই তিন আগে ষ্টেশন ছেড়ে চলে গেছে। তারই লাল আলােটুকু দেখতে পাচ্ছি। আশা-ভরসার প্রতীক সেই আলাে আমাকে গভীর নৈরাশ্যের মধ্যে ডুবিয়ে রেখে মিলিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে দূরান্তরের দিকে।

চারদিক ডুবে গেছে অন্ধকারের মধ্যে। আমি প্লাটফরমের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছি কোনদিকে যাব। হঠাৎ মনে পড়ল, ষ্টেশনের যেদিক থেকে আমি আসছি সেদিকটা মনুষ্যবর্জিত তেপান্তর হলেও ষ্টেশনের অপর দিকটায় গ্রাম আছে। অবশ্য মাইল দুই তিন পথ হাঁটতে হবে। আমি স্থির করলাম এই দু’মাইল পথ হেঁটে নিকটবর্তী গ্রামে গিয়ে রাতটা কাটাতে হবে । তারপর ভােরের ট্রেনেই কলকাতা রওনা হবাে।

কয়েক পা অগ্রসর হয়েছি মাত্র, এমন সময়ে ভেসে এলো সেই তীক্ষ্ণ সুতীব্র একটানা ক্রন্দনধ্বনি। বিহ্বল করে তুললাে আমাকে। দু'হাত দিয়ে চপে ধরলাম কান দুটোকে। তা সত্ত্বেও সেই অমানুষিক কান্নার রেশ কানের পর্দায় নিয়ে উঠতে লাগলো। ভাবলাম, ছুটে পালাই যে দিকে খুশী সেইদিকে। কিন্তু পা দুটি তার সমস্ত তার অক্ষমতা প্রকাশ করলাে।

প্রায় এক মিনিট ধরে সেই ধ্বনি আকাশ বাতাস মথিত করে স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলাম।

 তারপর রেললাইন পার হয়ে ওপাশের গ্রামের খোজে যাবার মনস্থ করলাম।

রেললাইন পার হতে গিয়ে নজরে পড়ল, একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। আমি থমকে দঁাড়ালাম। মানুষ অথবা হরিনাৱাণের কোন সহচর বোঝার আগেই সেই ছায়ামূর্তি আমার খুব কাছাকাছি এসে, গেল। অন্ধকারের মধ্যে লােকটির চেহারা ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি অভিভূতের মত দাড়িয়ে একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম লােকটার গতিবিধি।

মাষ্টারমশাই, গাড়ী কি চলে গেছে লােকটা কথা বলে উঠল।

মন থেকে একটা গুরুভার নেমে গেল। শরীরে শক্তি ফিরে এলাে।

বুঝলাম, একজন গ্রাম্য লােক। আমারই মতন ট্রেন ধরতে এসেছে।

খুশী হলাম, নিঃসঙ্গতাকে কাটিয়ে উঠতে পেরে। লােকটাকে কিছুতেই ছাড়া চলবে না। ওকে সঙ্গী করেই সারারাত কাটাতে হবে, তা এই ষ্টেশন চত্বরেই হােক অথবা নিকটবর্তী কোন গ্রামেই হােক, ক্ষতি নেই।

বললাম, হ্যা, গাড়ী চলে গেছে, আমিও ধরতে পারিনি।

কথাটা শুনেই লােকটা চঞ্চল হয়ে উঠল, বলল, আমি চললাম বাবু, এদিকটা মােটেই ভাল জায়গা নয়। তেনাদের বড্ড উৎপাত। আমি চললাম।

আরে দাড়ান, দাড়ান ! - আমি ব্যস্ত ভাবে বললাম আমি তাে রয়েছি, আপনার ভয় কিসের ? আমারও তাে একটা আস্তানার দরকার। যদি মনে কিছু না করেন তাে আপনার সঙ্গে আমিও যাবাে।

রাতটা তাে কাটাতে হবে ।

চলে আসুন চলে আসুন । লােকটি ততােধিক ব্যস্ততার সঙ্গে বললে, একমুহূর্তও দেরী করবেন না। দেরী করে ষ্টেশনে এসে কি ভুলটাই যে করেছি, রাম রাম, রাম রাম !

আমি লােকটাকে অনুসরণ করলাম।

সে সভয়ে রাম-নাম উচ্চারণ করে চলেছে। অন্ধকারে রেল লাইনের উপর একটা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। লােকটা তাড়াতাড়ি আমাকে তুলে ধরে বললে, পা চালান বাবু, আমার মনটা ভালো বলছে না। বলতে বলতে, লােকটা হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ছুটতে শুরু করলাে গ্রামের দিকে। দিগদিগন্ত কঁপিয়ে তখন শুরু হয়ে গেছে সেই তীক্ষ ভয়াল আর্তনাদ কান্নার আকারে।

একটা নীলাভদ্যুতিময় অথচ আবছা আলােকে ভরে উঠল চারিদিক। আলােকের উৎস দেখতে না পেয়েও যে দৃশ্য চোখের সামনে -ভেসে উঠল তা যেমনই মর্মান্তিক তেমনি ভয়াবহ।

অদূরে প্রাণভয়ে পলায়মান লােকটার সামনেই দাড়িয়ে আছে ইলা।

সেই লাস্যময়ী ভূবন মােহিনী রূপের ছটা। তার চোখ দুটি এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতায় চকচক করছে। এতদূরে থেকেও তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। বিস্ময়াভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ইলা আমার কাছে না এসে ঐ গেঁয়ো লােকটার সামনে দাঁড়াল কেন ?

লােকটা হতভম্ব হয়ে গেছিল প্রথমটা। তারপর সেও যেন কৌতুক অনুভব করল। ভুলে গেল পার্থিব অপার্থিব সব কিছু। ধীরপদে এগিয়ে চললাে ইলার দিকে। ' ইলাও এগিয়ে আসছিল লােকটার দিকে।

পরক্ষণেই ইলা ঝাঁপিয়ে পড়ল লােকটার উপর। দু’হাতে তাকে জরিয়ে ধরলো। মুখটা নেমে এলো লােকটার ঘাড়ের কাছে। আমি অসহায়ের মত দাঁড়িয়েছিলাম, হঠাৎ যেন প্রচণ্ড সাহস এসে মন প্রাণকে তাজা করে দিল। আমি ছুটলাম ইলার দিকে, চীৎকার করে বলতে লাগলাম, ছেড়ে দে শয়তানী, ছেড়ে দে !

কাছাকাছি আসতেই ইলা ছেড়ে দিল লােকটাকে। লােকটা ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি লােকটাকে তুলে ধরতে গিয়েই বুঝতে পারলাম লােকটা মারা গেছে। সারাদেহ তার বরফের মতন ঠাণ্ডা। লােকটার শরীরের শেষ রক্তবিন্দুটুকুও শুষে নিয়েছে পিশাচী।

ইলার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলাম। সে তখন তার জিভ দিয়ে ঠোঁট দুটিকে লেহন করে চলেছে। মুখে-চোখে ফুটে উঠেছে এক অবর্ণনীয় হিংতার ছাপ। চোখ দুটো যেন আগের থেকেও বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি সভয়ে দু’পা পিছিয়ে এলাম। অবচেতন মনের তাগিদে ছুটে চললাম প্লাটফরমের উপর দিয়ে ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরের দিকে। ইলাও, ছুটে এলাে আমার পিছু পিছু। অনুভব করছি আর হয়তাে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ইলা ধরে ফেলবে আমাকে।

ধরে যখন ফেলবেই এবং এই নির্জন অন্ধকারে আমাকে যখন ওর, শিকার হতেই হবে তখন আর পালিয়ে লাভ নেই। তাছাড়া পালিয়ে যাবােই বা কোথায় ? কথাটা মনে হতেই আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।

ইলা তখন আমার খুবই কাছে এসে গেছে। কয়েক হাতের ব্যবধান মাত্র। আমি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হাতের কালাে খাতাটা নিয়ে।

সজোরে আঘাত করলাম ইলার মুখে।

হায়! কোথায় ইলা? হাওয়া কেটে কালাে খাতাটা শূন্যের বুকেই দাগ কেটে গেল। ইলা অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি চোখ দুটো ভালো করে রগড়ে নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম। এতক্ষণ যা দেখছিলাম, তা কি সত্য অথবা আমার মনের বিভ্রম ? নীল আলােটাও অদৃশ্য হয়ে গেছে, ফিরে এসেছে পূর্বেকার সেই অন্ধকার ঘেরা পরিবেশ।

যদি মনের বিভ্রমই হয়ে থাকে তবে নিশ্চয়ই সেই গ্রাম্য লােকটির দেখা পাবো না। একটু আগে যার রক্ত শােষণ করেছে শয়তানী।

আমি এগিয়ে গেলাম সেইদিকে, যেখানে পড়ে রয়েছে গ্রাম্য লােকটার প্রাণহীন দেহ।

দাদা, কোথায় চলেছে ?—কথাটা শুনেই প্রচণ্ড ভাবে চমকে উঠলাম। হরিনারাণের কণ্ঠস্বর । অথচ হরিনারাণকে দেখতে পেলাম, না। মনে হলাে শব্দটা আসছে ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরের দিক থেকে ।

আবার শুনতে পেলাম, হরিনারাণ বলছে, এভাবে একা একা ঘােরা বিপজ্জনক। তুমি ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরে আজ রাতের মত বিশ্রাম করাে। কাল ভােরের গাড়ীতেই চলে যেও।

তুমি কোথায় হরিনারাণ ?—আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, অন্ধকারে তােমাকে দেখতে পাচ্ছি না। দয়া করে সামনে এসো।

 তুমি তাে আমাদের কথা সবই জেনে গেছে। দাদা এখন যদি তােমার সামনে দাড়াই, তুমি কি তা সহ্য করতে পারবে ?-হরিনারাণ বলল।

নিশ্চয়ই পারবে। হরি !- আমি বেশ জোর গলায় বললাম, যদি গতকাল রাত্রেও তােমার সঙ্গে কাটাতে পেরে থাকি, তবে এখনও পারবাে। সৎ আত্মার সনে সঙ্গদান করতে কোন ভয় নেই। তুমি আমার সামনে এসো।

বেশ, আসছি। তুমি মাষ্টারমশাই-এর ঘরে গিয়ে বসে।

ওখানেই তােমার সঙ্গে দেখা হবে। অলক্ষ্যে থেকেই কথাগুলি বললে হরিনারায়ণ।

ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরের কাছে এসেই অবাক হয়ে গেলাম। একটু আগে যে ঘর তালাবন্ধ ছিল, এখন তা উন্মুক্ত। পকেট থেকে দেশলাই ' বার করে জ্বলতেই টেবিলের উপর একটা হারিকেন দেখতে পেলাম।

ভালােই হলো, অন্ততঃ অন্ধকারের মধ্যে রাত্রিযাপন করতে হবে না। আলােটা জ্বালিয়ে চেয়ারটায় বসতে গিয়েই নজর পড়ল হরিনারাণের দিকে। সে জানালাটার ধারে একটা টুলের উপর বসে রয়েছে।

আমি খুবই দুঃখিত হরিনারাণ, আমি আন্তরিকতার সঙ্গে বললাম, ট্রেনটা ধরবার আপ্রাণ চেষ্টা সত্বেও দেরী হয়ে গেল।

সবই জানি দাদা, মুখ না ঘুরিয়ে হরিনারাণ বললে আমারই ভুল হয়ে গেছে। কালাে খাতাটার পাশে একটা রাস্তার নক্সা রাখলে তােমার পক্ষে সুবিধে হতাে। তাড়াতাড়িতে সেকথা ভুলে গিয়েছিলাম।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, তার জন্যে কি !—আমি বললাম হরিনারাণকে।

হরিনারাণ আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে চেয়ে রইল বাইরের দিকে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, আশ্চর্য! আমার একটুও ভয় করছে না হরিনারাণকে দেখে। যদিও এখন আমার অজানা নয় যে আমার সামনে যে হরিনারাণ বসে আছে সে কোন জীবিত মানুষ না।

পরন্তু, একটি মৃত মানুষ। যে দিনের আলােকে কবরের মধ্যে থাকে, রাতের অন্ধকারে উঠে আসে কবর থেকে। আরও আশ্চর্য হচ্ছি ভেবে যে এইসব মৃতেরা সশরীরে কেমন করে কবর থেকে বেরিয়ে আসে।

একটু আগেই যে ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখলাম সে তো কোন বায়বীয় বা বিদেহী আত্মার কাজ নয়। লােকটার রক্ত শোষণ করা কোন বিদেহী আত্মার পক্ষে সম্ভব নয়। মৃত ইলা তার দেহ নিয়েই গ্রাম্য লােকটার রক্তপান করেছিল। এ কেমন করে সম্ভব ?!!

হরিনারাণ সম্ভবতঃ আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই বলে উঠল, ওইসব ব্যাপার ভেবে কোন লাভ নেই দাদা'। অযথা তােমার মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করাে না। তবে, তােমার কৌতূহল মেটাবার জন্যে বলতে পারি যে কবর থেকে সত্যি সত্যিই ইলা বা আর সবাই উঠে আসে কবর ভেদ করে। ঠিক এই মুহর্তে যদি কেউ কবরের কাছে যায় তবে সে কোন দেহকেই শায়িত দেখতে পাবে না। রক্তপান করেই দেহগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। রক্তপান না করলে দেহগুলি গলে পচে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যাবে । যতদিন পর্যন্ত না ওরা মুক্তি পাচ্ছে ততদিন ওদেরকে বেঁচে থাকতে হবে কোন জীবিত প্রাণীর রক্ত শােষণ করেই। যাই হােক আমি এখন যাচ্ছি, দরকার মনে করলেই এসে হাজির হব! একটা শুধু অনুরােধ করবাে, ঘরের বাইরে বেরিও না।  গতরাত্রে আমার কথা না শুনে বিপদে পড়েছিলে, সুতরাং অহেতুক নিজেকে বিপদের মধ্যে জড়িও না।


(পর্ব ৮)

আমার চিন্তা ভাবনা যেন কোন অতল গভীরে তলিয়ে গেছে ।

হরিনারায়ণের কথাগুলাে মনে হচ্ছিল যেন বহুদূর হতে আসছে। কথা শেষ হতেই অমার চমক ভাঙলো। তাকয়ে দেখি হরিনারাণ, নেই।

সে চলে গেছে।

দরজা বন্ধ করে দিয়ে কেবলমাত্র জানালাটা খুলে রাখলাম।

 প্রচণ্ড মানসিক উত্তেজনা আর ক্লান্তিতে শরীর মন কাহিল হয়ে পড়েছিল।

পা দুটোকে টেবিলের উপর তুলে দিয়ে একটু জিরিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। দৃষ্টি চলে গেল জানলার মধ্য দিয়ে দূরের অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝােপঝাড়ের দিকে দৃষ্টি আটকে গেল । ক্ষনেকের জন্যে ভুলে গেলাম সবকিছু। চোখের সামনে যা দৃশ্য ভেসে উঠল, আমার জীবনে তা কোনােদিন দেখিনি, চুমকি আলাের ঝাড়।

থরে থরে আলােকিত করে রেখেছে সামনের গাছ-গাছালিতে ভরা প্রান্তরকে।

 অপরূপ দৃশ্য।

মােহিত না হয়ে পারা যায় না। মনে হয় কোটি কোটি শুভ্র বেল ফুল ফুটে আছে সারা পৃথিবী জুড়ে। সত্যি বলতে কি আমি কলকাতার লােক। একসঙ্গে অত জোনাকী পােকার সমারােহ কোনদিন দেখিনি।

এ দৃশ্য লিখে প্রকাশ করা যায় না। এ দৃশ্য অনুভব করতে হয় মাত্র।

যেন ফুলের চাদর দিয়ে সারা অঞ্চলকে মুড়ে রেখেছে।

তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে মনে হল, নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের বুক দিয়ে মহাশূন্যের গভীরতম প্রদেশে বিচরণ করছি আর অসংখ্য নক্ষত্র ঝিকমিক্ করে জ্বলছে মহাকাশের বুকে। আর সেই মহাকাশের মাঝখানে প্রাণের প্রতীক হয়ে আমি অনুভব করছি সৃষ্টি রহস্য। অনুভূতি অথবা আনন্দ অথবা আরও অন্য কিছু যার স্পর্শে আমার অন্তর ভরে উঠল এক অনির্বচনীয় প্রশান্তিতে। আমি পলকহীন নেত্রে সেই অপার্থিব সুধা সঞ্চয় করতে লাগলাম মন প্রাণ ভরে।

দেখতে দেখতে বােধহয় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আচমকা ঘুম ভেঙে গেল একটা শব্দে। একটা শৃগাল জানলা দিয়ে লাফিয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরের মধ্যে আমি কিছু করার আগেই একটা লােমশ হাত জানলা দিয়ে ঢুকে শেয়ালটাকে টেনে নিয়ে গেল বাইরে। একটা কাতর অন্তিম-ধ্বনি শােনা গেল শৃগাল-কণ্ঠের।

আমি দ্রুত জানলার ধারে গিয়ে ব্যাপারটা অনুধাবন করবার চেষ্টা করতেই দেখতে পেলাম কয়েকহাত দূরে একটা না-মানুষ না-পশু শ্রেণীর জীব শৃগালটাকে তার মুখের কাছে চেপে ধরছে। কয়েক সেকেণ্ড পরেই জীবটি ছুড়ে ফেলে দিল শৃগালটাকে। বুঝতে পারা গেল, শৃগালটি আর বেঁচে নেই। পিশাচটা ওর শরীরের সবটুকু রক্তই শুষে নিয়েছে।

ফিরে এসে চেয়ারটায় বসতে না বসতেই আবার ভেসে এল, সেই অমানুষিক ধ্বনি। তীক্ষ, তীব্র কান্নার রেশ। তার কয়েক মিনিট পরেই জানলার ধারে দেখা গেল ইলাকে ! লােভাতুর চোখে সে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।

ঘৃণায় সারা অঙ্গ জ্বলে উঠল আমার। চীৎকার করে বলে দূর হও এখান থেকে। তুমি একজন গ্রাম্য লােককে হত্যা করেছে শয়তানী! দূর হয়ে যাও সামনে থেকে ।

হরিনারাণ আমার বন্ধু। মৃত হলেও তার আত্মা অমর।  প্রকৃতপক্ষে অমন সৎ আত্মা জগতে খুব কমই আছে। তােমরা শয়তানীরা তার ধারে কাছে পৌঁছতে পারবে না। তাছাড়া, হরিনারাণের কাছ থেকে তােমাদের ইতিবৃত্ত যা জানবার সব জেনেছি। তোমার মত জঘন্য আর কারুকে দেখেছি রলে মনে হয় না। হাঁস, ছাগল, মুরগী ইত্যাদি প্রাণী থাকতে তােমার লােভ মানুষের রক্তের ওপর দেখে ঘৃণায় মন ভরে উঠছে। আর এক মুহূর্তও তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। আবার বলছি, আমার সামনে থেকে তুমি সরে যাও। তােমাকে আমি সহ্য করতে পারছি না।

চোখ দুটো জ্বলে উঠল ইলার । সে বলল, আপনি ভুল করেছেন।

হরিনারাণ আপনাকে ভুল সংবাদে বিভ্রান্ত করেছে মাত্র।

 আসলে হরিনারাণ চায়না যে আমি এখানে আসি। আপনি বিশ্বাস করুন ।

আমি নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে পারি না ইলা। -আমি বেশ জোর গলাতেই বললাম, প্লাটফরমের উপর সেই গ্রাম্য লােকটাকে জড়িয়ে ধরে তুমি তার রক্ত শােষণ করেছে। তার ফলে লােকটিকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে ! এটাও কি ভুল ?

হাে হাে শব্দে হাসির ঝঙ্কার তুলে ইলা বলল, আপনি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছেন, প্লাটফরমে কোন লােকই পড়ে নেই। আমি তাে এইমাত্র ওদিক থেকেই আসছি।

মিথ্যা কথা ! আমি ক্ষিপ্তের মত চেঁচিয়ে উঠলাম ।

মিথ্যে নয়।-গলায় কাকুতি মিশিয়ে ইলা। বলল, এসব হরিনারাণের চালাকি। ও লােকটা আমাকে মুক্তি দিতে চায়না। তাই এসব বানিয়ে বলেছে। আপনি নিজের চোখে দেখে যান। আমার কথা মিথ্যে না সত্য!

আশ্চর্য! এত কথা বলার পর কি জানি কি হলাে আমি সব কিছু ভুলে গেলাম ইলার কথায়। সাময়িক ভাবে আমার অস্তিত্বকে বিস্মৃত হলাম।

ইলা যা বলছে হয়তাে ঠিক। দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম।

দেখতে হবে সত্যি সত্যিই কোন গ্রাম্য লােকের মৃতদেহ প্লাটফরমের উপর পড়ে আছে কিনা! যদি না থাকে তবে ইলার' কথাকেই মেনে নেবাে।

বুঝবাে হরিনারাণ আমাকে বােকা বানাচ্ছে।

প্লাটফরমের ওপর পা দিতেই ইলা চলে এলো আমার সান্নিধ্যে।

একটা হিমশীতল স্পর্শ অনুভব করলাম আমার বাহুতে। মুখ ফেরাতেই ইলা আমার হাতটাকে স্পর্শ করেছে। ইলার চোখে চোখ পড়তেই কেমন যেন হয়ে গেলাম। ইলার চোখ দুটোর গভীরে দেখতে পেলাম নিজের ছায়াকে। বুঝলাম, এ দৃষ্টির হাত থেকে কোন মানুষের মুক্তি নেই। ইলা যেন আমাকে সম্মােহিত করছে তার দৃষ্টি দিয়ে ।

দু’হাত দিয়ে ইলা আমাকে বেষ্টন করে চেপে ধরেছে তার দেহের সঙ্গে। আমার সংজ্ঞা লােপ পাবার আগে শুধু এইটুকুই মনে আছে, হরিনারাণের হাতের চাবুক সপাং সপাং করে ইলার গায়ে আঘাত করছে।

আর হরিনারাণ চীৎকার করে বলছে, তােমাকে কতবার বলতে হবে ইলা, আমাদের মুক্তির একমাত্র হাতিয়ারকে রক্ষা করতে হবে। তােমার লােভ ক্রমাগতই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শীগগির ছেড়ে দাও।

ইলা মুহুর্তের মধ্যেই আমাকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। আর আমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম প্লাটফরমের উপরে।

যখন জ্ঞান হলো তখন ভাের হয়ে এসেছে। পাখীদের স্বতঃস্ফুর্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে কানে। পূবের আকাশ ভরে গেছে সােনালী ছটায়। বিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া নতুন জীবন বয়ে আনছে ঝলকে ঝলকে। আমি প্রাণ ভরে সেই তাজা হাওয়া ভরে নিলাম বুকে।

প্রথমেই আমি ছুটলাম প্লাটফরমের সেইদিকে যেখানে গ্রাম্য লােকটি ইলার শিকার হয়েছিল। কিন্তু কোন মৃতদেহ নজরে পড়লো না। আমি একটু অবাক হলাম। তাহলে সত্যিই কি আমি ভুল দেখেছি ?

হঠাৎ দেখতে পেলাম একটা ময়লা গামছা পড়ে রয়েছে একপাশে। হাতে করে তুলে নিলাম গামছাটা। একদিকে গামছার কোণায় গিট দিয়ে বাঁধা রয়েছে একটি একশ’ টাকার নােট আর কিছু খুচরাে পয়সা।

একটুকরো কাগজও ছিল তার মধ্যে। একজন উকিলের নাম ও ঠিকানা তাতে লেখা। বুঝতে পারলাম এই গামছার মালিক চলছিল শহর অভিমুখে তার উকিলের কাছে।

গতরাত্রে যে গ্রাম্য লােকটিকে দেখেছিলাম, এই গামছাটি যে তারই এমন প্রমাণ কোথায় ? অন্য কোন ব্যক্তিরও হতে পারে। সুতরাং এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হতে গেলে নিকটবর্তী গ্রামে গিয়ে খোঁজ করা ছাড়া পথ নেই।

মনের মধ্যে পাহাড় প্রমাণ কৌতূহল জমে উঠল এই মুহর্তে আমাকে এর শেষ দেখতেই হবে। আমাকে জানতেই হবে এর আসল রহস্যটুকু। ইলা আর হরিনারাণের উদ্দেশ্যটুকুও পরিস্ফুট হয়ে উঠবে আমার কাছে।

আমি ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরের দিকে এগিয়ে চললাম। ঘরের দিকে তাকিয়ে রীতিমত চমকে উঠলাম। আশ্চর্য! ঘরে তালা দেওয়া।

জানালাগুলি সব ভেতর থেকে বন্ধ। অথচ ....

ভাবতে গিয়ে চিন্তাধারায় হোঁচট খেলাম, গতরাতে আমি এই ঘরের মধ্যেই বসেছিলাম হরিনারাণের মুখােমুখি।

মাথাটা দু'হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে পড়লাম। নিজের উপর যেন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। যা কিছু দেখেছি যা অনুভব করেছি সবই ভুয়াে? সবই কি আমার মনের ভুল ? কেমন করে সম্ভব?

মানুষ কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে ? অথবা এই ষ্টেশনে যেদিন এসে নেমেছিলাম সেই সময় থেকেই আমি একটানা ঘুমিয়ে রয়েছি আর এই সব বিদঘুটে স্বপ্ন দেখছি? কোনটা যে ঠিক আর কোনটা যে ঠিক নয় সে বিচারশক্তি যেন আমার লােপ পেয়ে গেছে এই মুহূর্তে।

সবকিছু চিন্তাজাল ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়ে ট্রেনের হুইসল-এর শব্দ ভেসে এলাে দূর থেকে। সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মনটা আনন্দে নেচে উঠল। ট্রেন আসছে এবং আমি তা দেখতে পাচ্ছি। আরও দেখতে পাচ্ছি। আরও দেখতে পেলাম কয়েকজন যাত্রী প্লাটফরমে অপেক্ষা করছে। ওরা যে কখন এসেছে টের পাইনি।

আমি দ্রুতগতিতে একজনের দিকে এগিয়ে গেলাম। ভদ্রলােক জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকাল। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলাম, আমাকে একটা খবর দিতে পারেন?

লােকটি অবাক হয়ে আমার দিকে একবার তাকাল। তার চোখে সন্দেহের ছায়া ঘনীভূত হয়ে উঠেছে দেখতে পেলাম। আমি সেই গামছাটা নিয়ে লােকটির কাছে মেলে ধরে বললাম, আপনাদের কারুর হয়তাে খােয়া গিয়ে থাকতে পারে। হয়তাে আপনাদের গ্রামেরই কেউ হবে। যদি তাকে ফেরৎ দেন তাে খুবই উপকার হবে।

টুকরাে কাগজের উকিলের নাম দেখেই বলে উঠল, হ্যাঁ আমাদের গ্রামের গদাই মােড়লের বলেই মনে হচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যার গাড়ীতে তিনি উকিলের বাড়ী গেছেন। তাড়াতাড়িতে হয়তাে গামছা পড়ে গিয়ে থাকবে।

লােকটির কথার কোন উত্তর না দিয়ে গামছাটাকে একরকম জোর করেই তার হাতে গুজে দিয়ে সরে এলাম। আবার আমি মানসিক চিন্তার জালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। তাহলে সেই গ্রাম্য লােকটিই কি গদাই মােড়ল? সম্ভবতঃ সেই লােকটিই হবে। দেরী করে ষ্টেশনে আসার ফলেই ইলার খােরাক হয়ে মারা পড়েছে।

ট্রেনটি ষ্টেশনে এসে থামতেই ষ্টেশনমাষ্টার নেমে এলেন।

আমাকে দেখতে পেয়েই চীকার করে বললেন, আরে মশাই, চললেন নাকি ? আমি বললাম, হ্যা, এই ট্রেনেই যাবাে।

না, তা হয় না, ষ্টেশনমাষ্টার আত্মীয়সুলভ কণ্ঠে বললেন, দুপুরের ট্রেনে যাবেন। এখানে কথা বলার লোক বলতে কারুকেই পাই না। তবু কিছুটা সময় আপনার সঙ্গে কাটানাে যাবে।

কথাটা শেষ হতে না হতেই হন্তদন্ত হয়ে তিনি ছুটলেন টিকিট কাউন্টার খুলতে। যে কজন যাত্রী ষ্টেশনে অপেক্ষা করছিল, টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়ল। পয়েন্টসম্যান একটি সবুজ পতাকা নিয়ে নাড়তে লাগল। ট্রেনটি চলতে শুরু করলাে।

আমি একাগ্রচিত্তে পয়েন্টসম্যানকে লক্ষ্য করছিলাম। একটু আগেই আমি যার হাতে টাকা সমেত গামছাটা দিয়ে এসেছিলাম সেই ভদ্রলােকই সবুজ পতাকা নিয়ে লাইন ক্লিয়ার দিচ্ছিল।

যাত্রীদের মধ্যে থাকায় উনি যে একজন রেলকর্মী তা বুঝতে পারিনি।

তখন ট্রেনটি প্লাটফরম ছাড়িয়ে যায়নি। খেয়াল হতেই ছুটলাম ট্রেন ধরতে, আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল ‘কালাে খাতাটার কথা।

তাইতাে! খাতাটা গেলো কোথায় ? খাতাটা না পেলে তা কোন কাজই হবে না! ফিরে এলাম নিজের জায়গায় যেখানে সারারাত শুয়েছিলাম। তন্ন তন্ন করে চারদিকে খুঁজতে লাগলাম কিন্তু কোথাও সেই খাতার হদিস পেলাম না।

মনের কোনে সন্দেহ দেখা দিল, যা কিছু দেখেছি সব কিছুই হয়তাে আমার মনের অলীক কল্পনা মাত্র। অথবা একটা নিদারুণ দুঃস্বপ্ন।

নতুবা ইলাকে মৃত জেনেও তার সঙ্গে আমি স্বাভাবিক আচার-আচরণ বজায় রাখলাম কি করে ?

হরিনারাণ আমাকে ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরের ভিতরে বসতে বলবার পর আমি ও হরিনারাণ দুজনেই ঐ ঘরের মধ্যে বসেছিলাম। অথচ, সকালবেলায় তালা ঝুলছে দেখতে পেয়েছি। মাথাটা কেমন যেন ঘুলিয়ে যায় কথাগুলি চিন্তা করতে গিয়ে। অথচ তার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

এদিকে ষ্টেশনমাষ্টার কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে জানি না।

চমক ভাঙলো তার কথায়। তিনি বলছেন, কি খুঁজছেন মশাই? কিছু হারিয়েছে নাকি ?

বললাম, হ্যা। তবে, তেমন কিছু নয়। চলুন, ঘরে গিয়ে বসি।

যাক, পরের ট্রেনেই ফিরবাে।

ব্যাপারটা ইচ্ছা করেই গােপন করে গেলাম। মিছিমিছি হাস্যস্পদ, হয়ে কোন লাভ নেই ভেবে। ষ্টেশনমাষ্টারের সঙ্গে ঘরে ঢুকেই কিন্তু আমার আক্কেল গুড়ুম। রােমাঞ্চ আর বিস্ময়ে মুখটা হা হয়ে গেল।

মুখ দিয়ে শুধু উচ্চারিত হল, আশ্চর্য !

কিসের আশ্চর্য !—ষ্টেশনমাষ্টার ফ্যাল ফ্যাল করে আমার মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

আমার দৃষ্টি তখন টেবিলের উপর। হারিকেনের পাশে পড়ে রয়েছে সেই কালাে খাতাটা । একে একে ভেসে উঠল গতরাত্রির অভিজ্ঞতার কথা। এতক্ষণ যে সন্দেহ মনের মধ্যে দানা পাকিয়ে উঠেছিল সেই সন্দেহের নিরসন হলো। আমি স্বপ্ন দেখিনি অথবা মানসিক বিভ্রান্তিও নয়। গতরাত্রে আমি যে ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরে বসেছিলাম কালো খাতাই তার জলন্ত সাক্ষ্য । অথচ কে যে কখন তালা খুলল আর কখন যে তালা দিল বুঝতে পারলাম না।


(পর্ব ৯)

আমি ষ্টেশনমাষ্টারকে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা, আর গদাই মােড়লের কথাটাও বললাম ! শুনেই ষ্টেশনমাষ্টার রীতিমত চমকে উঠলেন, বললেন, আপনি খুব জোর বেঁচে গেছেন মশাই! এ জায়গাটার বড়ই দুর্নাম রয়েছে ! সেই জন্যেই এখানে কেউ রাত্রে থাকে না। আমার পয়েন্টসম্যান থাকে ওর গ্রামে। রােজ সকালে আসে আর সন্ধ্যায় শেষ ট্রেন যাওয়ামাত্রই সে ফিরে যায় গ্রামে। একটা অভিশপ্ত জায়গা এটা।

আমি আগের ষ্টেশনের কোয়ার্টারে থাকি। সকালের এই গাড়ীটায় আসি আর বিকালের শেষ ডাউনটায় ফিরে যাই। নেহাৎ চাকরি, তাই  দায়ে পড়েই এমন জায়গায় চাকরি করি মশাই।

অন্য ব্যবস্থা থাকলে কবেই চলে যেতাম। কিন্তু আপনি যা শােনালেন তাতে তো পেটের পিলে চমকে যাচ্ছে মশাই! আমি আজই কতৃপক্ষের কাছে ব্যাপারটা

জানাবাে। হয় এই ষ্টেশনটাকে পরিত্যক্ত বলে ঘােষণা করুক নয়তো আমাকে অন্য কোথাও বদলি করুক ! উঃ কি মারাত্মক ব্যাপার মশাই !

তবে এর মধ্যে একটা কথা আছে। আপনি ইচ্ছে মতো বানিয়ে বানিয়ে গাল গল্প করে না থাকেন ।

আমি বললাম, ছিঃ ছিঃ অমন কথা বলবেন না মুখার্জিবাবু! বানিয়ে বলে আমার লাভ কি ? তাছাড়া, আপনি তো জানেন। আমি কবে এসেছি এই ষ্টেশনে !

হুম্ ! কথাটা মন্দ বলেননি, মুখার্জিবাবু, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন, যদি আপনার কথাই সত্য বলে ধরে নেওয়া যায় তবে বিপদের ঝুকি না নেওয়াই ভালো। আমি বরং পরের ষ্টেশনে ব্যাপারটা জানিয়ে দিই।

কথাটা শেষ করেই মুখার্জিবাবু ছুটলেন পরবর্তী ষ্টেশনের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সংযােগ স্থাপন করতে পারলেন না।

শেষটায় বিষন্ন চিত্তে গজ গজ করতে করতে আমার দিকে এগিয়ে এলেন, যত্ত সব ইয়ে ! এই সময়েই বাবা লাইন খারাপ! দেখলেন তো স্যার ! দরকারের সময় সব কিছুই কেমন যেন বিকল হয়ে যায়।

—কেন ! লাইনে আবার কি হলো? আমি জিজ্ঞেস করলাম ।

—মাথা আর মুণ্ডু !—যত সব ইয়ে,—রাগে রি রি করতে করতে মুখার্জিবাবু বললেন, বলুনতাে এখন কি করি? আপনার কথা শুনে আমার তাে বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে ।

আপনার অত দুশ্চিন্তার কারণ নেই,আমি সাহস দিয়ে বললাম আপনাকে সব কথাই তাে বলেছি। হরিনারাণ চায় মুক্তি। সে এই অবস্থায় মােটেই থাকতে রাজী নয়। আমাকে ডেকে আনার উদ্দেশ্যটুকুও ওর সৎ প্রচেষ্টার সাক্ষ্য বহন করেছে। কালাে খাতায় এইসব অভিশপ্ত আত্মার অধিকারীদের নাম-ধাম লেখা রয়েছে। এদের পিণ্ডদান করার সঙ্গে সঙ্গেই এরা পাবে মুক্তি। তারপর আর কোন ভয়ই থাকবে না।

ওদের উপদ্রব থেকেও এ অঞ্চল মুক্ত হবে।

এই সময় পয়েন্টসম্যান এসে উপস্থিত হলাে। ষ্টেশনমাষ্টার বললেন, জগদীশ, একটু চা-খাবারের ব্যবস্থা করাে। সকাল থেকে এখনও পর্যন্ত একটুও চা পেটে পড়েনি।

জগদীশ বলল, আজ কিন্তু পরােটা আর হালুয়া এনেছি মুখার্জিবাবু।

বিস্কুট আনিনি।

বলাে কী? মুখার্জীবাবু খুশীভরা মুখে বললেন, বেশ কাজের কাজ করেছে।

জগদীশ চা তৈরি করল স্টোভ জ্বেলে, আমরা হালুয়া পরােটা সহযােগে চা খেতে লাগলাম। জগদীশ আমাকে লক্ষ্য করে বলল, এই সাত-সকালে আপনি কোথা থেকে এলেন বাবু ? আগে তাে আপনাকে দেখিনি ?

আমি ইচ্ছে করেই জগদীশের কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, মুখার্জিবাবু, আমার কিন্তু বড় ঘুম পাচ্ছে। আমি একটু ঘুমােতে চাই। কিন্তু পরের ট্রেনেই আমি যাবে, দয়া করে সেদিকটায় একটু খেয়াল রাখবেন ।

আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকুন, - মুখার্জিবাবু সহাস্যে বললেন, আজ আপনাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তবে ছাড়বো।

এত গভীর ঘুমে যে মানুষ আচ্ছন্ন হতে পারে, এর আগে কোনদিন অনুভূত হয়নি। হয়তাে গত দু'রাত্রির জাগরণের জন্যেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কোথা দিয়ে কখন যে সারাটা দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে, ঘুণাক্ষরে টের পাইনি।

প্রথমটা আমি বুঝতেই পারিনি যে আমি একটা অখ্যাত রেল ষ্টেশনে ঘুমুচ্ছিলাম। চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম মিঃ মুখার্জিকে বিরস বদনে বসে থাকতে ! কিছু সময় হা করে চেয়ে রইলাম ভদ্রলােকের কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। এমন একটা অখাদ্য ষ্টেশনে এসে পড়লামই বা কি করে, তাও স্মরণে আসছিল না।

আমাকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিঃ মুখার্জি বললেন, ঘুম ভাঙলাে? আচ্ছা ঘুমই ঘুমিয়েছেন মশাই! সেই সকাল থেকে এই সন্ধ্যে পর্যন্ত। এদিকে যে সর্বনাশের মাথায় পা হয়ে গেছে।

এ্যা! কি বললেন ? আমি চমকে উঠে প্রশ্ন করলাম, ধীরে ধীরে সব কথাই আমার মনের পটে ভেসে উঠেছিল। কেমন ভাবে এই ভয়ানক রেল ষ্টেশনে হাজির হলাম । ড্রাগন গরুর গাড়ীতে চেপে ডাকিনী ভিলায় যাওয়ার পথে সেই রোমহর্ষক ঘটনাসমূহ। তারপর সেই ডাকিনী ইলার খপ্পর থেকে কোনরকমে পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে ফিরে আসা। সবকিছুই জলের মত ভেসে বেড়াতে লাগল মনের মধ্যে ।

আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসলাম । এই মুহূর্তেই আমাকে এই অভিশপ্ত স্থান ত্যাগ করতে হবে। আমি উৎকণ্ঠিত চিত্তে শুধালাম, শেষ ট্রেনটা আসতে কত দেরী মুখার্জিবাবু ?

বিষন্ন মুখে মুখার্জি বললেন, সেই কথাটাই বলছি মশাই, বিপদ যখন আসে তখন এমনি করেই আসে। আজ আর কোন ট্রেনই এ-পথে আসবে না।

কেন ! কেন !—আমি চীৎকার করে উঠলাম।

এখান থেকে তিরিশ কিলােমিটার দূরে গাড়ীটা লাইনচ্যুত হয়েছে ।

“মিঃ মুখার্জি বললেন, এইমাত্র আগের ষ্টেশন থেকে খবর এসেছে।

তাহলে কি হবে ? এদিকে যে সন্ধ্যে হয়ে এলো মুখার্জিবাবু ? আমি মুষড়ে পড়লাম।

এখন আর কিছু করার নেই। আজ রাতের মত জগদীশের সঙ্গে ওর গ্রামেই গিয়ে আশ্রয় নিই। কাল সকালে এসে না হয় একটা কিছু করা যাবে। মিঃ মুখার্জি দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে বললেন।

ছটফট করছিল জগদীশ। সে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, তাড়াতাড়ি করুন মুখার্জিসাহেব! সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। একটু পরেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে। আমার মনটা খুব ভালাে বলছে না।

এই যে আমার হয়ে গেছে। তালা লাগিয়ে মিঃ মুখার্জি বললেন, চলাে আমারও মনটা খুব ভালো বলছে না জগদীশ।

আমরা তিনজনেই প্লাটফর্মের উপর দিয়ে দ্রুতগতিতে পা চালালাম।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই যেন ঝড় উঠল। ধূলাের ঝড়। সে সঙ্গে বাতাসের গােঙনির সঙ্গে চারিদিক ঘিরে ধূলাের অন্ধকারে ঢেকে গেল।

আমরা এক পাও অগ্রসর হতে পারলাম না। প্রচণ্ড হাওয়ার বেগ আমাদের পিছন দিকে ঠেলে ফেলছিল। তারসঙ্গে ধূলাে ঢুকে চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না' জগদীশ বা মিঃ মুখার্জি যে সেই ধূলিঝড়ের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেল দেখতেই পেলাম না। বুকের ভেতরটা দুরু দুরু কাঁপতে শুরু করে দিল আমার।

এমনতর একটা পরিস্থিতির মধ্যে যে পড়তে হবে, আগে তার বিন্দুমাত্র হদিশ করতে পারিনি।

আমি দুহাত দিয়ে চোখ দুটো চাপা দিয়ে বসে পড়লাম প্লাটফরমের উপরে। অনুভব করলাম, যেন ক্রোধােন্মত্ত দৈত্য হুঙ্কার ছেড়ে মেদিনী দ্বিখণ্ডিত করে ফেলতে চাইছে। তার পায়ের চাপে পাহাড়-অরণ্য জনপদ সবকিছু গুড়িয়ে রেণু রেণু হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ধূলাের ঝড়ের মধ্যে দিয়ে।

চোখে হাতচাপা দিয়ে বসলেও ঠিকমত টাল সামলাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল হয়তাে এখুনি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে । চ্যাং দোলা করে আছড়ে মারবে মাটির বুকে। জীবনে বহুবার বহু ঝড়ের মধ্যে পড়েছি কিন্তু আজকের মতাে এমনতর প্রলয়ঙ্করী ঝড়, কল্পনাতেও স্থান পায়নি। মড়, মড়, শব্দে গাছ উপড়ে পড়ছে বুঝতে পারছি অথচ চোখ খুলে দেখবার উপায় নেই।

হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে আমাকে তিন-পাক ঘুরিয়ে দিল।

একরকম গড়াতে গড়াতে ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরের দেওয়ালে এসে ঠেক খেলাম। তারপরই মনে হল, প্রকৃতি যেন শান্ত হয়ে আসছে। ঝড়ের গতিবেগ যাচ্ছে কমে।

ঝড় থামবার সঙ্গে সঙ্গেই মুষলধারে বৃষ্টি নেমে এলাে। আমি তখনও একই ভাবে বসে রয়েছি প্লাটফরমের উপর। কোথা দিয়ে যে কি হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। সকালের ট্রেনটা ছেড়ে দিয়ে খুবই যে অবিমৃষ্যকারীতা হয়েছে একথা মনে হতেই মিঃ মুখার্জির উপর ভীষণ রাগ হলাে।

সে যদি না আমাকে আশ্বাস দিত তাহলে নিশ্চয়ই এই অভিশপ্ত জায়গা থেকে আমি অনেক অনেক দূরে চলে যেতে পারতাম।

সারা শরীর ভিজে সপ, সপ করছে। আমি গলা ছেড়ে মিঃ মুখার্জিকে ডাকতে লাগলাম। ডেকে তখন আমার কোন উপায়ও ছিল না। রাতের আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। বৃষ্টির জন্যে জোনাকী পােকার আলােও তখন কোনদিক থেকে দেখা যাচ্ছিল না।

অদূরেই একটা গাছের তলায় মিঃ মুখার্জি ও জগদীশ আশ্রয় নিয়েছিল। আমার চিৎকারে মুহূর্তের মধ্যে এসে হাজির হল।

 জগদীশ ভীতকণ্ঠে বলে উঠল, আর দেরী করবেন না স্যার ! শীগগির চলুন।

অন্ধকার হয়ে গেছে। সন্ধ্যের পর এখানটায় থাকা ঠিক নয় ! গা ছমছম করছে!

জগদীশের কথা মিঃ মুখার্জির কানে গেছে বলে মনে হলো না।

তিনি উৎকর্ণ হয়ে কি যেন শােনবার চেষ্টা করছিলেন। আমার কছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, আপনি কি কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছেন ?

আমি বললাম, কই, তেমন কিছু তো শুনতে পাচ্ছি না। বৃষ্টি পড়ার শব্দ আর গাছের পাতায় পাতায় ঝােড়াে হাওয়ার দাপটের শব্দ ছাড়া আর কিছু তাে কানে আসছে না।

আমার কথা শেষ হতে না হতেই তীক্ষ্ণ শীষের মত সেই ভয়াবহ কান্নার ধ্বনি আকাশ বাতাসে রণরণিয়ে উঠল। মিঃ মুখার্জি সভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে শুরু করলেন। জগদীশ তার গলায় দোদুল্যমান যজ্ঞােপবীত ডান হাতের মুঠোয় ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় নাম জপ করতে লাগল, রাম রাম হরে রাম।

মিঃ মুখার্জিও হয়তো রাম নাম জপ করবার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন শব্দই বের হচ্ছিল না, শুধু একটা গো গো শব্দ ছাড়া। আমিও বেশ ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু জগদীশ আর মিঃ মুখার্জির অবস্থা দেখে যেন আমার সাহস ফিরে এল । মনে পড়ল, এ কান্না আমি বহুবার শুনেছি। এ কান্না সেই রক্তলােপ পিশাচী ডাকিনীর কান্না। মনে পড়ল, হরিনারাণ আমার সহায়! সে সব সময়েই ছায়ার মত আমার পেছনে থেকে সব রকম বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে চলেছে।

সজোরে মুখার্জিকে নাড়া দিয়ে বললাম, ভয় কি মিঃ মুখার্জি, আপনি কি কখনো শকুনের কান্না শােনেন নি। গভীর রাতে শকুনের ডাক ঠিক যেন দুগ্ধপােষ্য শিশুর কান্নার মত শোনায়। চলুন, আমরা জগদীশের গ্রামের দিকে রওনা হই।

আমার কথায় কাজ হল ! মুখার্জি কাঁপা গলায় বললেন, ওঃ, তাই বুঝি ? চলাে, চলাে জগদীশ, আর একমুহুর্তও এখানে নয়। কি কুক্ষণেই এমন ধরণের চাকরী নিয়েছিলাম যে এখন পৈত্রিক প্রাণটাই - খাবি খেয়ে মরছে ।

জগদীশ মেঠো পথ ধরে হন্ হন্ করে এগিয়ে চললাে, আমরা চললাম জগদীশকে অনুসরণ করে। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে আমি চিন্তিত হয়ে উঠলাম। কিন্তু জগদীশ বা মিঃ মুখার্জি যে বিষয়টা লক্ষ্য করেছে তা মনে হল না।

সারা আকাশ মেঘে ঢাকা। জোনাকিরাও যেখানে আলাে জ্বালাতে সাহস পাচ্ছে না। এমনতর ঘন্ধকারের মধ্যেও আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম আমাদের চলার পথটুকুকে। একটা অতি ক্ষীণ নীলাভ আবছা আলােয় পথটি আলােকিত হয়ে আছে। আর সেই আলােয় পথ চিনে আমরা এগিয়ে চলেছি জগদীশের গ্রামের দিকে ।

ব্যাপারটার কোনরকম ব্যাখ্যাই করতে পারলাম না। এই আবছা নীলাভ দ্যুতির কেন্দ্রস্থল কোথায় ? অথচ ভারী অদ্ভুত লাগল পিছন দিকে দৃষ্টিপাত করে ! পেছন দিকটা ছিল কালােয় ভরা। নিকষ কালো সেই অন্ধকার। যেন পেছন থেকে সেই অন্ধকার আমাদের তিনজনকে গ্রাস করতে আসছে তার কালো কালাে বিরাটকায় ভয়ংকর মুখ নিয়ে ।

চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম।

কয়েক সেকেণ্ডের বেশী সেদিক পানে তাকানাে যায় না। সামনের দিকের ঐ নীলাভ আলােক দৃশ্যটাই যেন আমাদের প্রাণ। সেই আলো যেন আমাদের বড় আপন অন্ততঃপক্ষে পেছনে ফেলে আসা অন্ধকারের চেয়ে।

আমার মনের ভাবনা বা মনের কথা মুখার্জিকে বললাম না। যতক্ষণ না জগদীশের গ্রামে পৌছাই ততক্ষণ না বলাই ভালাে, অযথা বেচারা ভয় পেয়ে যাবে আমার কথায়। সুতরাং যেমন নীরবে পথ হাঁটছিলাম তেমনি নীরবে এগিয়ে চললাম জগদীশকে অনুসরণ করে ।


(১০মপর্ব)

বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু হাওয়ার দাপট রয়েছে তখনও। কর্দমাক্ত কাঁচামাটির রাস্তা দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। এ পথের যেন শেষ নেই।

ষ্টেশন থেকে জগদীশের গ্রাম যে কতদূর আমি জানি না।

শুনেছিলাম, খুব বেশী দূরে নয়, কিন্তু এখনও আমরা জগদীশের গ্রামের সীমানায় আসতে পারিনি। দু’ঘণ্টার বেশী সময় ধরে আমরা হাঁটছি আথচ গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম না। মনটা বিচলিত হয়ে উঠল। আমি জগদীশকে শুধালাম, আর কতদূর জগদীশ ?

কথাটা জগদীশের কানে যেতেই সে থমকে দাঁড়াল। বিস্ময়সূচক শব্দ করে বললে, তাইতাে স্যার ! আমরা কি তবে পথ ভুল করলাম।

এত বেশী সময় লাগবার কথাতাে নয়। তাছাড়া এ পথটা কেমন যেন অচেনা অচেনা ঠেকছে।

সে কি ? মিঃ মুখার্জিকে আমি বললাম, হা হুতাশ করে কোন লাভ নেই, অন্ধকারের মধ্যে জগদীশ ভুল পথে এসে পড়েছে। আমার মনে হয় পুনরায় এগিয়ে না গিয়ে ষ্টেশনে ফিরে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। অন্ততঃপক্ষে মাথা গুজে থাকবার একটা ঠাই মিলবে।

তাই বরং চলুন! আমরা ষ্টেশনেই ফিরে যাই। মিঃ মুখার্জি হতাশস্বরে বললেন ।

আমরা তিনজনেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। পিছনের দিকে তাকিয়ে আমরা থমকে দাঁড়ালাম। যাবাে কোথায় ? গাঢ় আন্ধকারে ছেয়ে আছে চারিদিক, পথের কোন নিশানাই নজরে পড়ছে না। পরিবর্তে দেখা গেল ঘন ঝােপঝাড়ের জঙ্গল। যা ভেদ করে এগুবার কোন প্রশ্নই আসে না। তবে একটা প্রশ্ন সেখানে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলাে আমাদের মনে, আমরা তাহলে এলাম কি করে ? আর এলামই বা কোন পথ দিয়ে।

নীলাভ আলােকে যে পথ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম, সেই পথটাই বা গেল কোথায় ?

হঠাৎ জগদীশের ভয়ার্ত চিৎকার আমাকে সচকিত করে তুলল।

সেই ঘনান্ধকার ঝােপঝাড়ের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে কয়েক জোড়া জলন্ত চোখ। আগুনের গােলার মত সেই চোখগুলাে স্থির দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। শির শির করে উঠল সারা শরীর।

একটা ভয়াবহ অনুভূতি শিরায় শিরায় প্রবাহিত হতে লাগল।

জগদীশ প্রাণপণে রামনাম জপ করছে। মিঃ মুখার্জি আতংকে নির্বাক হয়ে গেছে। অপলক দৃষ্টি মেলে ঐ রক্তলাল চোখগুলাের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। মনে হল, চোখগুলাে যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। চোখগুলাে যেন অপেক্ষাকৃত হারে ক্রমান্বয়ে বড় আকার ধারণ করে এগিয়ে আসছিল। চোখের মালিকদের দেহগুলি কিন্তু এখনও আমাদের আগােচরে ছিল ।

হঠাৎ মনে পড়ল হরিনারাণের কথা। আমার প্রথম রজনীর অভিজ্ঞতার কথা। যে গরুর গাড়ীতে করে হরিনারাণ আমাকে ডাকিনী ভিলাতে নিয়ে গিয়েছিল। সেই শকটের গরুগুলো ছিল ড্রাগন-গরু, যাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে তাগ্নি উদ্গীরণ হতে দেখেছি। যাদের চোখগুলাে ছিল ঠিক এই রকমই বড় বড় আকারের এবং রক্তের মত লাল।

তাহলে এরা কি সেই ড্রাগন-গরু ? ডাকিনী ভিলার পাইপ বেয়ে আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিল ? হরিনারাণের হস্তক্ষেপের ফলে আমি রক্ষা পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন, এই অরণ্যের অন্ধকারে।

এদের আক্রমণ থেকে কে রক্ষা করবে আমাদের।

ভেবে কোন লাভ হবে বলে মনে হল না, বরং বিপদকে মােকাবিলা করাটাই যেন সংগত বলে মনে হল। আর মনে হওয়া মাত্রই আমার সাহস ফিরে এলাে। ঠিক সেই মুহূর্তেই আকাশ-বাতাস-অরণ্য কাঁপিয়ে ভেসে এলো তীক্ষ্ণ শীসের মত কান্নার শব্দ। যে শব্দ মানুষকে মুহূর্তে দিশেহারা করে দেয়।

আমি মনকে শক্ত করে ফেলেছিলাম। ওই কান্নার শব্দ কানের মধ্যে দিয়ে মগজে ঢুকে অঘটন ঘটবার প্রয়াস চালালেও আমি নিজেকে নিজের আয়ত্বে রাখতে সমর্থ হলাম। পরিবেশ এখানে যতই ভয়ংকর হােক না কেন, ডাকিনী-ভিলায় রাত্রিবাসের চেয়ে নিশ্চয়ই নয়। তা ছাড়া, হরিনারাণ যখন আমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে তখন এটুকু আশা করা যায় যে এইসব অশুভ শক্তি আমার তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। এই কথাটা মনে উদয় হতেই আমার মানসিক শক্তি যেন দ্বিগুণিত হয়ে উঠল।

হঠাৎ একটা তীব্র চীৎকার করে মিঃ মুখার্জি ছুটতে লাগল।

দিগবিদিক জ্ঞানহারা হয়ে। সঙ্গে সঙ্গে এক জোড়া জ্বলন্ত চোখ ছুটে চলল মুখার্জিকে তাড়া করে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, একটা বিরাট গরু ছুটে চলেছে মুখার্জিকে ধরবার জন্যে। নাক দিয়ে বেরুচ্ছে আগুনের ঝলক। বুঝলাম এই সেই ড্রাগন-গরু। আমি চিৎকার করে মুখার্জিকে ফিরে আসতে অনুরােধ জানালাম কিন্তু আমার চিৎকার মুখার্জির কানে পৌছেছে বলে মনে হল না।

চমকে উঠলাম একটা তপ্ত অনুভূতিতে। আমার অদূরেই আর একটি ড্রাগন-গরু এসে হাজির হয়েছে। তার নিঃশ্বাসে নির্গত হচ্ছে ঝলকে ঝলকে আগুনের শিখা৷ সেই শিখায় যে তাপ সৃষ্টি হচ্ছে, তারই কিছুটা আমার গায়ে এসে পড়ছে !

নিঃসহায় অবস্থায় আত্মসমর্পণ ছাড়া কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। জগদীশ ঠিক আমার পিছনটায় দাড়িয়ে ঠক ঠক করে কাপছে আর অনর্গল রামনাম উচ্চারণ করছে। আমি নিশ্চল হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম চরম পরিণতির অপেক্ষায়।

সপং ! সপাং ! শব্দে পুনরায় চমকে উঠলাম। বুক থেকে যেন একটা দশমণী বােঝা নেমে গেল। ড্রাগনগরু আর আমাদের মাঝখানে দাড়িয়ে স্বয়ং হরিনারাণ। তার হাতে উদ্যত চাবুক। মুহূর্তের মধ্যে ড্রাগনগরু অদৃশ্য হয়ে গেল ঝােপ অভ্যন্তরে। আর কোন চোখই দেখা গেল না কোনদিকে।'

আমি চিৎকার করে বললাম, হরিনারাণ প্লিজ। মুখার্জিকে বাঁচাও !

তােমাকে অযথা দায়িত্ব গ্রহণ করতে নিষেধ করেছি দাদা, হরিনারাণ বললে, কিন্তু তুমি আমার কথা শুনছে না। কখন যে বিপদ ঘটে যায় তার ঠিক নেই। তােমার উচিত ছিল, সকালের ট্রেনেই এ স্থান ত্যাগ করে যাওয়া। তুমি তা না করে সারাটা দিন ঘুমিয়ে রইলে। তােমার প্রতি আমি যে দায়িত্বটুকু দিয়েছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা করে ফেল ।

তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারাে হরিনারাণ, আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম, কিন্তু মিঃ মুখার্জিকে তুমি বাঁচাও !

এখন আর তা সম্ভব নয় দাদা,বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে হরিনারাণ বললে, আবার বলছি, নিজের ছাড়া অপরের কথা চিন্তা না করাটাই মঙ্গলজনক। মানুষ একদিন না একদিন মরবেই। সুতরাং মুখার্জির কথা ভুলে গেলেই তােমার পক্ষে সুখকর হবে। তাছাড়া আমাদেরও ত খাদ্যের প্রয়ােজন রয়েছে। সুযােগ পেলে আমরা তার সদ্ব্যবহার করবােই। মুখার্জির মত শত শত লােককে যদি বাঁচাতে চাও তবে দেরী করে যা বলছি তাই করাে।

মাথাটা ঘুরে উঠল হরিনারাণের কথায় ! মুখার্জি আর বেঁচে নেই ভাবতেই মনটা  মুষড়ে পড়ল। আমি ছুটলাম মুখার্জির খোঁজে।

আমাকে অনুসরণ করল জগদীশ।

জগদীশ সঙ্গে থাকায় মনে যথেষ্ট জোর পেলাম। একজন জীবন্ত মানুষের সাহচর্য আমার একান্তই প্রয়ােজন ছিল তখন। জগদীশও আমার উপর ভরসা রেখে নিজেকে সাহসী করে তুলেছিল। আর সেই কারণেই সে বেঁচে গেল এ যাত্রায়।'

একটা ঝােপের ধারে মুখার্জি পড়েছিল। গা বরফের মত শীতল।

বেচারা ! ড্রাগন গরুর খােরাক হয়ে প্রাণটা হারাল। মনটা শক্ত করে ফেললাম, সকাল হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ছুটতে হবে গয়ার পথে।

বিষ্ণু পাদ-পদ্মে পিণ্ডদান করে এই সব হতভাগাদের পাপমুক্ত করতে না পারলে এমনতর বহু প্রাণ এদের হাতে বলি হবে।

তুমি রাস্তা চিনে ষ্টেশনে যেতে পারবে জগদীশ ? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

কোন দিকে যে ষ্টেশন তাই বুঝতে পারছি না স্যার। জগদীশ নিরাশ কণ্ঠে বললে, 'ব্যাপার-স্যাপার দেখে তাে আমার পেটের মধ্যে পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে স্যার!

তাহলে এক কাজ করা যাক,-আমি বললাম, আজ রাতের মতো আমরা এই বনের মধ্যেই অপেক্ষা করি, সকাল হলে দিনের আলােয় পথ চিনতে কষ্ট হবে না। আরও একটা কাজ আমাদের করতে হবে।

মিঃ মুখার্জির সৎকারের ব্যবস্থা। তুমি বরং কিছু শুকনাে ডাল-পালা।

জোগাড় করে আন। মুখার্জির দেহটা দাহ করতে হবে তাে?

সেই ভালাে, জগদীশ আমার কথায় সায় দিয়ে বললে, মুখার্জি সাহেবের সৎকার করার ব্যবস্থা করতে করতেই ভাের হয়ে যাবে ।

আশেপাশের ঝােপ ঝাড় থেকে জগদীশ কাঠ সংগ্রহ করতে লাগলাে, আমিও তাকে সাহায্য করতে লাগলাম । বরাত ভালাে বলতে হবে ।

এদিকটায় মােটেই বৃষ্টি হয়নি। গাছপালাগুলাে সব খটখটে শুকনােই ছিল। অসুবিধায় পড়তে হল না। রাশিকৃত গাছের ডাল-পালার মধ্যে মুখার্জির দেহটাকে চাপিয়ে দিয়ে অগ্নিসংযােগ করতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল ডাল-পালার স্তুপ ।

আগুনের আলােয় চারদিক ঝলমল করে উঠল।

যেটুকু ভয় অন্ধকারের মধ্যে দানা পাকিয়ে তখনও ভয় দেখাবার প্রয়াস পাচ্ছিল, তা দূর হল। মনটা বেশ হাল্কা হয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই জগদীশ আমার আরও কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বললে, বডড ভয় করছে বাবু!

ভয় করছে ! কি যে বল জগদীশ তার ঠিক নেই! আমি সাহস দিয়ে বললাম ।

না বাবু, আমি ঠিকই বলছি, আপনি একবার চারিদিকটা লক্ষ্য করে দেখুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন। জগদীশের গলার স্বর ভয়ের চোটে জড়িয়ে যাচ্ছিল।

সংক্রামক ব্যাধির মত আমার মনের মধ্যেও সংক্রামিত হল ভয় ভয় ভাব। চারদিক দৃষ্টিপাত করতেই মনে হল জগদীশ সত্যি কথাই বলছে। মুখার্জির চিতার আগুনে চারিদিক আলােকিত হলেও গাছগাছালির ফাকে ফাকে কারা যেন সতর্ক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। কয়েকটা বড় বড় গাছের মাথায় যেন কারা সব বসে আছে লােলুপ চোখে। শত সহস্র তাদৃশ্য চক্ষু যেন আমাদের লেহন করে চলেছে। আমরা যেন এক সুপরিকল্পিত ফঁাদের মধ্যে পড়ে আটকে গিয়েছি। যেখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোন পথই খােলা নেই।

একটা দমকা হাওয়া এসে চিতার লেলিহান শিখাকে নাড়া দিয়ে গেল। আর সেই সঙ্গে চারিদিকের গাছপালারাও যেন হিঃ হিঃ করে হেসে উঠে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ল। জগদীশ প্রচণ্ড ভাবে ভয় পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বিড় বিড় করে কি যে বলল বুঝতে পারলাম না।

কিন্তু তার হাতটা একদিকে প্রসারিত করে কিছু যেন ইঙ্গিত দিচ্ছিল। সেদিকে তাকাতেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে এলো। বড় বড় গাছগুলির মাথা থেকে বিরাট বিরাট ডানাওলা কতকগুলি জীব নেমে আসছিল আমাদের দিকে। অনেকটা শকুনের মত দেখতে কিন্তু আকারে শকুনের থেকেও অন্ততঃপক্ষে তিনগুণ বড়। মুখটা দেখলে সারা শরীর ঘুলিয়ে ওঠে। এত বিশ্রী চেহারার মুখ' বােধকরি কোন জন্তু বা জানােয়ারের নেই। একটা অদ্ভুত ধরণের কর্কশ ধ্বনি নির্গত হচ্ছিল ওদের মুখ থেকে। সেই শব্দে শরীরের স্নায়ুগুলো আমাদের অবশ হয়ে আসছিল।

জগদীশকে সজোরে একটা ধাক্কা মেরে বললাম, সাহস হারালে মরতে হবে জগদীশ। কাপুরুষের মত মরবে কেন, বরং এসো চিতাগ্নি থেকে দুটো জলন্ত কাঠের টুকরো নিয়ে প্রতিরােধ করার চেষ্টা করি।

দাড়িয়ে দাড়িয়ে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করে কোন লাভ হবে না।

একলাফে একটা জলন্ত কাঠ তুলে নিয়ে রুখে দাড়ালাম।

 জগদীশও একটা জলন্ত কাঠ হাতে তুলে নিল। কাঠদুটো ঠিক মশালের মত কাজ করল । হাতের দিকটায় তখনও আগুন ধরেনি। উঁচু করে ধরে আমরা প্রস্তুত হয়ে রইলাম, শকুনরূপী শয়তানের সঙ্গে মােকাবিলা করার জন্যে ।

ভারী আশ্চর্য ব্যাপার ! জানােয়ারগুলাে আর এগুলাে না।

 ঝটপট ডানার শব্দ করে উড়ে গেল বড় বড় গাছগুলাের মাথায়। অতিকায় অদ্ভুত জীবগুলােকে এখন আরও পরিষ্কার দেখতে পেলাম। যা মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপরই আর ওদের দেখা গেলনা। ওরা যেন হাওয়ার মধ্যে মিলিয়ে গেল। পূবাকাশে তখন ভােরের আলােয় রং ধরছে। গাছ গাছালি ঘিরে যে অন্ধকার বিরাজ করছিল তা যেন মূহূর্তে অপসৃত হয়ে গেল।

রাতের ভয় দিনের আগমনে সাহস হয়ে ফিরে এলাে আমাদের মনে।

আমি জগদীশকে নিয়ে বনের পথ ধরে এগিয়ে চললাম। কিছুটা পথ অতিক্রম করার পরই চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি জরাজীর্ণ বাড়ী। চিনতে অসুবিধা হল না। এই সেই ডাকিনী ভিলা।

আমরা নিজেদের অজ্ঞাতসারে ডাকিনী ভিলার দিকেই চলে এসে ছিলাম। জগদীশ তাই নিজের গ্রামের পথ চিনতে পারেনি। হঠাৎ একটা কথা বিদ্যুৎ ঝলকের মত মনের মধ্যে খেলে গেল।

আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। হরিনারাণ মুক্তি পাবার জন্যে ব্যর্থ হয়ে উঠেছে, কিন্তু গয়ায় পিণ্ডদান করলেই কি তারা মুক্ত হবে ! যতদিন ওদের দেহ কববের মধ্যে থাকবে ততদিন ওরা রাতের অন্ধকারকে ভর করে উঠে আসবে কবরের বাইরে। আর ক্ৰয়ান্বয়ে একের পর এক শত শত মানুষ ওদের হাতের শিকার হবে। সুতরাং ওদের সত্যিকারের মুক্তি দিতে হলে মুখার্জি বাবুর মত ওদের দেহগুলােকে দাহ করা, দরকার ।

কথাটা মনের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল। শয়তানের বাসস্থান ডাকিনী ভিলাকে আজ যেন আমার ভালই লাগল। বিন্দুমাত্র ভয়ের উদ্রেক হল না। লােহার মরচে ধরা গেটটা খুলে এগিয়ে চললাম কবরখানার দিকে।

প্রথমেই ইলার কবরটা খুঁড়ে ফেললাম। আশ্চর্য ! সেই মুখ, সেই চাউনি, যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে ইলা। শরীরের কোথাও কিছুমাত্র পচনের চিহ্ন নেই। তারপর খুললাম হরিনারাণের কবর।

শান্ত সমাহিত সৌম্যমূর্তি হরিনারাণের। তেজদীপ্ত মুখমণ্ডল থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে স্বর্গীয় সুষমা। পর পর যতগুলি কবর ছিল সবগুলি থেকে তুলে আনলাম মৃতদেহগুলি।

হরিনারাণের দিকে তাকিয়ে কেবলই মনে হচ্ছিল, একটি মাত্র সৎ আত্মা কতগুলি অসৎ আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। এইসব সৎ আত্মার জন্যেই পৃথিবী আজ এত সুন্দর হয়েছে মানুষের কাছে। শত সহস্র অসৎ আত্মা থাকা সত্বেও। কিন্তু যদি সব আত্মাই অসৎ-এর যুপকাষ্টে নিজেদের বলি দেয় তবে ? তাহলে পৃথিবী আর সুন্দর থাকবে না।

নরকের কীটে ভরে উঠবে সুন্দরের থালা। প্রাণ থেকেও প্রাণহীন জীবন যাপন করবে ধরিত্রীর মানুষ।

কি ভাবছেন বাবু ? জগদীশের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম।

তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ভাই জগদীশ প্রচুর কাঠ আর ডালপালা দরকার।

এইসব দেহগুলিকে দাহ করতে হবে। তা হলেই তােমাদের এ অঞ্চল ভয় মুক্ত হবে। আর সঙ্গে সঙ্গে এই হতভাগ্যের দল মুক্তি পাবে। জগদীশ কি বুঝলাে বুঝতে পারলাম না। কিন্তু সে কাল বিলম্ব না করে কাঠ সংগ্রহে মনােনিবেশ করল।

স্তুপীকৃত কাঠ আর গাছের ভালপালা দিয়ে তৈরী চিতায় শবদেহগুলি সাজিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলাম। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন।

একটি সৎ আত্মার জন্যে অনেকগুলাে আত্মা শান্তি লাভ করলে।

কালাে খাতাটা সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যের আগেই হাজির হয়েছি ষ্টেশনে।

হরিনারাণের একান্ত অনুরােধ আমাকে রাখতে হবে।

যথা সময়েই শেষ গাড়ীটা এসে পৌছাল ষ্টেশনে। জগদীশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে আমার হৃদয়। আমি এক মহান দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছি।

গয়ায় গিয়ে এই কালাে খাতার কালাে মানুষগুলােকে বিষ্ণু পাদপদ্মে সমর্পন করতে।


সমাপ্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ