Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

আজব দেশ ও ছড়ার কাহিনি ।। সপ্তদ্বীপা অধিকারী

 

 

এক ছিল আজব দেশ। সে দেশে ছড়া হারিয়ে যাচ্ছিল। কিছুতেই কেউ ছড়া লিখতে পারছিল না। ছড়ার অভাবে শিশুদের হাসি হারিয়ে যাচ্ছিল। খেলতে ভুলে যাচ্ছিল। নানারকম আজব আজব সব রোগ দানা বাঁধছিল শিশুদের শরীরে। দেশের সমস্ত মানুষ হাহাকার করছিল। শিক্ষা-দীক্ষা হাসি আনন্দ ছাড়া একটা দেশ ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে ধ্বংসের করাল গ্রাসে পড়তে যাচ্ছিল। 

এই আজব দেশের একটি ছেলের নাম ছিল সায়ন। সে তার দাদাইকে বড্ড ভালোবাসে। দাদাইও তাকে।

 একদিন হয়েছে কী... তখনো সায়নের ঘুম ভাঙেনি...

 আধো ঘুমে আধো জাগরণে সে শোনে- 

"সেদিন ভোরে দাদাই জোরে

 ঘুম ভাঙিয়ে বলে- 

ছড়ার গাছে ছড়া আছে 

পাড়ছে সব কৌশলে!" 

দাদাই-এর চিৎকারে ঘুম তো ভেঙে গেল। সায়ন ভাবছেসে ঠিক শুনেছে তো ঘুমের ঘোরে? নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখল সে। স্বপ্ন দেখছে নাতো! কিন্তু স্বপ্ন তো নয়। ও ব্যথা পেল তো!

সায়নকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে ওর দাদাই আবার একই কথা উচ্চারণ করলেন।

সায়ন ভাবলোদেশে ছড়ার আকাল বলে দাদাই বোধহয় মজা করছেন!সায়ন বলল- 

"ছড়ার গাছে ছড়া আছে

 বলছো দাদাই কী যে!"

 বললো দাদাই  "রইলি হাঁদাই 

দেখলাম চোখে নিজে!"

আর বেশি বলতে হল না! চটজলদি উঠে পড়ল সায়ন। হাত-মুখ ধুয়ে, জামা-প্যান্ট পরে সে তৈরি। দাদাই-এর হাত ধরে টান দেয়- "চলোদাদাই!"

দাদাই বলে- "আরে ব্রেকফাস্ট তো করবি!" 

আর ব্রেকফাস্ট! সায়ন ডানা থাকলে উড়ে যেত। সেখানে গিয়ে সায়নের কী অবস্থা জানো তো? ছড়ার ভাষাতেই না হয় বলি! কেমন- 

"তারপরেতে যেতে যেতে

 ভাবি মনের গড়া!

 গিয়ে একি! সত্যি দেখি 

গাছে ঝোলে ছড়া!" 

সায়ন হাঁ করে চেয়ে রইল। সামনেই একটা বিরাট ছড়ার গাছ। গাছে নানারকম ছড়া ঝুলছে।এই গাছটা অনেক বছর ধরেই তো এখানেই ছিল। এটা যে ছড়ার গাছতাতো আগে বোঝেনি কেউই!

 "লম্বা ছড়াবেঁটে ছড়া

 রোগা কিম্বা মোটা

 যার যেটা চাইহাত দিলে পাই

 ছেঁড়া নহেগোটা!"

সায়নের চোখ দুটো চকচক করে উঠল লোভে। সে বলল- "দাদাইআমি গাছে উঠছি!"

দাদাই বললেন- "বাড়ি থেকেই আকাশ মুখো হয়ে রয়েছিস! এবার একটু মাটির দিকে চা!"

সায়ন বুঝতে না পেরে দাদাই-এর দিকে চাইতে দাদাই গাছের গোড়ার দিকে ইশারা করলেন।সেদিকে চেয়েই সায়নের চক্ষু চড়কগাছ! গাছের গোড়ায় কবিতে কবিতে ছয়লাপ!

সায়ন বলল- "দাদাই গোআমাদের দেশে এত কবি?"

দাদাই বললেন- "তাই তো দেখছি!"

সায়ন ছটফট করে উঠে বলল- "আমি যাই দাদাই। গাছে উঠি গে! নইলে সব ছড়া পেড়ে নেবে সব্বাই!"

দাদাই বললেন- "মনে হয় ওভাবে ছড়া পাড়া যাবে না!"

সায়ন বলল- "কেন দাদাই?  লাইন আছে নাকীআমি ওসব লাইন ফাইন মানি না!"

দাদাই তারপরও নানারকম যুক্তিপূর্ণ কথা বলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সায়ন কিছুই শুনলো না। দাদাই বলছিলেনভোর রাত থেকে এত যে কবি এসেছেনতো তাঁরা কেন ছড়া গাছে ওঠেননি! একবার ভাবো।

কিন্তু কে শোনে কার কথা! সায়ন একে ধাক্কা মেরেতাকে গুঁতো মেরে গাছের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালো। একবার যেন তার মনে হলতার দাদাই তাকে কিছু যেন বলছেন। কানে ছিদ্র আছে বলে কথাগুলো তার কানে প্রবেশ করেছে। কিন্তু মনেও প্রবেশ করেনি প্রাণেও প্রবেশ করেনি! সে গড়গড় করে গাছে চড়তে লাগলো। কিছুটা উঠেই দেখে সামনেই একটা বড়োসড়ো ছড়া।ছড়া ঠিক নয়যেন ছড়াফল। মেটেমেটে রঙের ছয় আঙুল পরিমাণ চওড়া এবং প্রায় দেড় হাত লম্বা একটা ছড়া। সায়নের খুব পড়তে ইচ্ছে করছিল কিন্তু ও ভাবলোআগে বাড়িতেই নিয়ে যেতে হবে। ভেবে যেই না হাত বাড়িয়েছে, অমনি ঠিক যেন চাবুকেরই মতো সেই ছড়া ফলটা সায়নকে সজোরে আঘাত করল। শুধু তাই নয়, সে ভেংচিও কাটলো!

"ওরে বোকা ন্যাকা খোকা

মুলে দেব কানটি?

গাছে এসে অবশেষে

দিবি কি তোর প্রাণটি?"

সায়ন ছড়ার মুখে ছড়া শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কোনোরকমে বলে- "কেন? কান মুলে দেবে কেনকী করেছি আমি?" লম্বা ছড়াটা আবার মুখ ভ্যাঙায়।

"কী করেছিস যদি জানতিস

মিটেই যেত ভাবনা!

ছড়াকে চাস কী সর্বনাশ

গাছ থেকে তুই নাম না!"

সায়ন এদিক চায়ওদিক চায়। অনেকটাই উপরে উঠেছে সে। তার মাথার ঠিক উপরেই দুটো মাঝারি সাইজের ছড়া ল্যাতপ্যাত করে দোল খাচ্ছে। তাদের পেলেও চলতো। সায়ন এসব দেখার পর আবার লম্বা ছড়াটার দিকে চাইল। এবার সায়নের ভিরমি খাবার মতো অবস্থা। লম্বা ছড়াটার মুখ আছে। এতক্ষণ সে খেয়াল করে দেখেনি। আর মুখে দুটো চোখও আছে। মোটামোটা এক জোড়া চোখ। চোখদুটো ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়েছে সায়নের দিকে। সে অত্যন্ত ভয় পেয়ে গিয়ে গলায় মধু ঢেলে বলল- "ছড়াদাদাও ছড়াদাদা অল্প কিছু ছড়া দাও!" বলে সে নীচের দিকে ইশারা করলো- "ওই যে সরু সরু ডালে যে ছোটো ছোটো ছড়াগুলো রয়েছে, ওখান থেকে কিছু ছড়া নিয়ে যাই! প্লিজ ছড়াদাদা!"

ছড়াদাদা জোরে চিৎকার করে উঠল- "আরে  ওগুলো তো সবে কুঁড়িওদিকেও নজর দিচ্ছিস? তোরা মানুষগুলো এত বদ কেন বলতো!"

সায়ন বলল- "কেন?  মানুষগুলো আবার কী করল?"

ছড়াদাদা বলল- 

"মানুষগুলো যেই না ছুঁলো

কবি হবে বলে

সকল ফুলই পটল তুলি

শুকোয় যে কোন্ কলে!"

সায়ন অবাক হয়ে বলল- "মানে? মানুষ ছড়া গাছে হাত দিলেই ছড়াফুল শুকিয়ে যায়? মরে যায়? "

লম্বা ছড়াদাদা বলল- "তবে আর বলছি কী? যাও যাওকেটে পড়ো! কেটে পড়ো তো! বেটা হুলো!"

এবার সায়নেরও রাগ হয়ে গেল- "কী?  আমি হুলো?"

ছড়াদাদা বলল- "নয়তো কী মুলো? নাকী কুলো?"

সায়ন বলল- "ভালো হচ্ছে না কিন্তু ছড়াদাদা! আমি কুলোও নইমুলোও নই! আমি সায়ন!"

ছড়াদাদা বলল- "ওহআবার নাম বলা হচ্ছে! যে নামই হোক না কেন! সব্বাই সমান!কেটে পড়ো তো যত্তসব অপগন্ডোগুলো!"

ততক্ষণে সায়ন সেই নীচের ছোট্ট ছড়াটা ছিঁড়তে গেছে। সে ভেবেছিল যেসে কথা বলতে বলতে ছড়াদাদাকে অন্যমনস্ক করে দিয়েছে। আর ঝট করে এই ছোট্ট ছড়াফুলটা সে তুলে নেবে এই সুযোগে! কিন্তু ছড়াদাদা সব বুঝতে পেরেছিল। সে জন্যই সে "হুলো" বলে গাল পেড়েছিল সায়নকে। আর সায়ন যেই না ছোট্ট ছড়াটাকে তুলে নেবে বলে হাত ঠেকিয়েছেওরে বাপরে বাপ! এই এত্তটুকুনি ছোট্ট ছড়াটার আবার দাঁত আছে! ইঁদুরে দাঁত বোধহয়! কী ধারালো রে বাবা! কুটুস করে কামড়ে দিয়েছে! আর সায়নও এমন আঘাতের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে নীচে আছড়ে পড়েছে! সারা গা রক্তাক্ত হয়েও একটাও ছড়া পেল না সে! এবার সে নীচে তাকালো। এই কারণেই তার দাদাই তাকে বলেছিলেন যেসারাক্ষণ উপরমুখী হয়েই সে ছড়াগাছতলায় এসেছে! এবার সে  কবিদের অবস্থা পুরো দেখতে পেল। সমস্ত কবিরাই রক্তাক্ত!কেউ কেউ কাঁদছে! তবু ঠায় দাঁড়িয়ে! ছড়ার গাছ হঠাৎ অট্টহাস্য করে উঠল। আর সমস্ত ছড়ারা খিল খিল করে হেসে উঠল। ছোটোবড়োমাঝারিমোটারোগালম্বাবেঁটে ইত্যাদি নানান আকার ও আয়তনের ছড়াগুলো দুলে দুলে হাসতে লাগলো। হঠাৎ একটা পরিপক্ক ছড়া বোঁটা ছিঁড়ে টপাস করে নীচে পড়ে গেল। সায়ন এক লাফে ছড়াটা কুড়িয়ে নিল! মনের আনন্দে সে তার দাদাইকে খুঁজতে লাগলো। একমাত্র সেই একটা ছড়া কুড়িয়ে পেয়েছে! সায়নের সামনেই বিখ্যাত কবি বিশ্বেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় দাঁড়িয়েছিলেন। প্রবীন কবি। তিনি ধমকের সুরে সায়নকে বললেন- "এই ওটা আমায় দে!" সায়নও অন্যান্য অনেকের মতো এই কবিকে খুবই ভক্তি করেশ্রদ্ধা করেভালোবাসে! তবু তার খুব রাগ হল। সে বলল- "আপনাকে দেব কেন? এ ছড়া তো আমি পেয়েছি। এটা আমার!" বিশ্বশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন- "জীবনে একটাও ছড়া লিখেছযেএটা তোমার বললেই সম্পাদকরা বিশ্বাস করবেন? নাকী পাঠকরাই বিশ্বাস করবে?" সায়ন বলল- "কিন্তু আপনিও তো একটাও ছড়া আজ পর্যন্ত লেখেননি! খালি চেষ্টা করেছেন আর পূর্বপুরুষদের ছড়া টুকলি করেছেন!"

বিশ্বেশ্বরবাবু এতখানি বয়সে এইরকম ঠোঁটকাটা দেখেননি। যদিও অভিযোগ সত্যতবু তাঁর মুখের উপর এমনভাবে কেউ বলতে পারে বলে তিনি কল্পনাও করেননি!

তিনি ধৈর্যচ্যুত হলেন। বললেন- "দেব এক চড়! দে ওটা আমাকে! গাছে উঠতে পেরেছিস বলেই এই ছড়া তোর হয়ে গেল না! একেই বলে গাছে উঠতেই এক কাঁদি!"

সায়ন বলতে যাচ্ছিল- "আমি তো তবু গাছে উঠেছি। আপনারা তো সেই মাঝরাত থেকে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুমীরের কান্না কাঁদছেন! এক পাও বাড়াতে পারলেন না!"

কিন্তু তার আগেই বিশ্বেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক বাজ পাখির মতো ছোঁ মেরে ছড়াটা নিতে গেলেন! আর ছোঁয়া লাগতে না লাগতেই ওরে বাবারে-মারে বলে চিৎকার করে উঠলেন! এবং ছড়াটাও তাঁর হাত ফস্কে নীচে পড়ে গেল। সায়ন তাকিয়ে দেখেপ্রবীন কবির হাত থেকে ঝরঝর করে রক্ত ঝরে পড়ছে! আসলে ওই পরিপক্ক ছড়াটার গায়ে খুব বড়ো বড়ো আর শক্ত শক্ত কাঁটা ছিল। সায়নের হাতেও লেগেছে। কিন্তু সে অল্পবয়স্ক। সহ্য শক্তি তার বেশি। আর তাছাড়া সায়ন ভাবছেবাঘের পায়ের থাবার মতো কে জানে এই ছড়াগুলোও কাঁটা বেশি কম বার করতেও পারে। সকাল থেকে সে যা দেখছে তাতে অসম্ভব বলে আর কিছুই নেই। বয়স্ক মানুষের হাতে লেগেছেসায়নের কষ্ট পাওয়া উচিতকিন্তু যেভাবে তার ছড়াটা ওই মানুষটা নিয়ে নিচ্ছিলেনতাতে তার এখন খুব আনন্দই হল। সে এবার নীচু হয়ে ছড়াটা কুড়োতে গেল!আর অমনি অবাক কাণ্ড! ছড়াটা বলে উঠল-

" বলি তোমরা হোমড়াচোমড়া

কবিরা সব মরো

একটা ছড়া নিজের গড়া

করতে পারলে করো!"

বলেই ছড়াটা মানে ছড়ার ফলটা ফটাস করে ফেটে গেল! আর তার ভিতরের সারি সারি সমস্ত বীজ বেরিয়ে পড়ল! সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা কবিরা আর সেই বীজ নেবার প্রয়োজন বোধ করলেন না! তাঁরা ভাবলেনবীজ তো বীজ! বীজ দিয়ে কী আর হবে! সে তো আর পরিপূর্ণ ছড়া নয়! হঠাৎ কোত্থেকে এক ঝাঁক পাখি উড়ে এসে বসলো। আর টপাটপ বীজগুলো খেয়ে নিল। তারপর আবার উড়ে গেল! এবার ছড়ার গাছ বলল-

" অপদার্থ বোঝে স্বার্থ

কাজের কাজি নয়!

বীজের পাশে ফলটি আসে

নইলে পরাজয়!"

সায়ন বলল- "ভুল হয়ে গেছেছড়া মা। আর কক্ষনো এমন ভুল করব না।আর একটা পরিপক্ক ছড়া দাও!"

কেউ কোনো জবাব দিল না! সায়ন আকুলি-বিকুলি করে লম্বা ছড়াদাদাকে ডাকল। সে তখন কতো কথা বলেছিল! সায়নের হাজার কথাতেও আর কোনো জবাব দিল না! কোনো ছড়াও নীচে পড়ল না!

হঠাৎ আকাশ পথে সেই পাখির ঝাঁক ফিরে এল। উড়তে উড়তে ঝাঁকের মধ্যে থেকে একটা পাখি বলল- 

"তোদের মতো আছে যত

ছড়ার জন্য লড়াই!

শিশুর ছড়া হচ্ছে মড়া

করছ তবু বড়াই!

ছড়ার জন্য কর না গণ্য

গাছের গোড়ায় পানি

সমস্ত সুর ধাইছে যে দূর

পাখির ঠোঁটেই জানি!"

সেই থেকে সেই আজব গাঁয়ের মানুষেরা এখনও কোনো ছড়া লিখতে পারে না। পাখিদের ঠোঁটে ঠোঁটে ছড়া শোনা যায়। আর সায়ন এখন নিয়ম করে সব গাছের গোড়ায় জল দেয়! বলা তো যায় নাকখন কোন গাছে হঠাৎ ছড়া ফলতে শুরু করবে!

গল্পটি শেয়ার করে আরো-সব বন্ধুদের পড়ার সুযোগ করে দাও।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ