দেখুন কী আছে আমার হাতে। ডান হাতের থাবাটা আমাদের সামনে মেলে ধরে বললেন মাদুলিবাবা।
আমরা পরিষ্কার দেখলাম মাদুলিবাবার ডান হাতে কিছুই নেই।
এবার তিনি বাঁ হাতটা দেখিয়ে বললেন, এ-হাতে? দেখুন, দুটো হাতই ভালো করে দেখুন। দেখেছেন? এবার বলুন, কিছু আছে আমার হাতে।
উপস্থিত ভক্তবৃন্দ সবাই একবাক্যে বলে উঠল, না, কিছুই নেই।
মাদুলিবাবা সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত মুঠো করে আমাদের সামনে আবার মেলে ধরলেন। তারপর বললেন, এবার?
আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, তার দু-হাতে দু-গাছি মুক্তোর মালা বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল ঝলমল করছে। আর মাদুলিবাবা আমাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বিশ্ববিজয়ীর মতন মৃদু মৃদু হাসছেন।
এক সময় মাদুলিবাবা এক সাহেব-ভক্তের চোখের ওপর চোখ রাখলেন। বললেন, কী সাহেব, পরখ করে দেখতে চাও আসল মুক্তো কি না। এই নাও ধরো। বলেই তিনি হার দু-গাছি সাহেবের দিকে ছুঁড়ে দিলেন, আর সাহেব সঙ্গে সঙ্গে দু-হাতে লুফে নিল।
কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সাহেব হার দু-গাছি মাদুলিবাবাকে ফিরিয়ে দিল। কিন্তু আমি বেশ ভালভাবেই লক্ষ্য করলাম তার চোখ থেকে এখনও অবিশ্বাসের ছায়া মুছে যায়নি। হয়তো আমারই চোখের ভুল হতে পারে, সাহেবদের নীল চোখের রহস্য হয়তো ধরতে পারিনি।
মাদুলিবাবা সাহেবকে বললেন, আরও দেখবে? এই দেখ, আমার দুটো হাতই খালি। এই মুঠো করলাম। এই খুললাম। কী দেখছ এবার?
না, এবার আর মুক্তোর হার নয়, তার চেয়েও দামী জিনিস। মাদুলিবাবার দু-হাতে দুটো আংটি। দুটো আংটির মাথাতেই দু-খণ্ড প্রকাণ্ড হীরে শোভা পাচ্ছে। আমি নিজে যদিও জহুরী নই, তবুও কেন জানি না, আমার কেবলই মনে হচ্ছে এত বড় বড় হীরে শুধু ভারতবর্ষেই নয়, পৃথিবীতেই বিরল দেখা যায়।
সাহেব হাত বাড়িয়ে দুটো আংটিই মাদুলিবাবার কাছ থেকে নিয়ে নিল। তারপর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলো।
মাদুলিবাবা আর সাহেবের দিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। একটু পরে অনেকটা আপনমনেই বলে উঠলেন, আমাকে পরীক্ষা করবে মানুষ। তাহলেই হয়েছে। আমি আপনাদের সামনে ঘোষণা করতে চাই, এক মাত্তর ভগবান ছাড়া আমাকে পরীক্ষা করার অধিকার আর কারও নেই। বলেই তিনি একটু থামলেন। তারপর আবার বলতে লাগলেন, আপনারা আমাকে ভালবাসেন, ভক্তি করেন, এটাই তো আমার পাসের খবর। স্বয়ং ভগবানই তো আমার এই পরীক্ষা নিয়েছেন। এ কি যা তা পরীক্ষা! মানুষের হৃদয় জয় করা কি যার তার কর্ম! প্রেম বললেই কি প্রেম হয়।
মাদুলিবাবা থামতেই সাহেব আংটি দুটো তার হাতে ফিরিয়ে দিল। আর নিঃসংকোচে বলল, প্রেমের কথা রাখুন। আপনার অলৌকিক ক্ষমতার কথা বলুন।
নিজের চোখেই তো তা দেখলে।
যা দেখলাম, সে তো ম্যাজিক। ম্যাজিক তো লৌকিক ক্ষমতা।
ম্যাজিক মানে? দু-ছড়া মুক্তোর মালা আর দুটো হীরের আংটি কি ভুয়ো? তাহলে তুমি দেখলে কী?
ভুয়ো, সে-কথা বলিনি। বরং আমি বলতে চাই, ও-রকম বহু মূল্যবান অলংকার আপনার কাছে আরও আছে। আপনি কেবল একটু জাদুবিদ্যার আশ্রয় নিয়ে আমাদের এতগুলো লোককে ভেলকি দেখিয়ে দিলেন। ভেবেছেন, এ-রকম করেই গণেশ হালদারের চোখে ধুলো দিতে পারবেন।
কে। গণেশ হালদার! প্রাইভেট ইনভেসটিগেটর গণেশ হালদার! তাহলে লোকটা সাহেব নয়, সাহেবেব ছদ্মবেশ পরেছে কেবল।
শুধু মাত্তর ‘গণেশ হালদার’ নামটা উচ্চারণ হতেই ঘরের আবহাওয়া যেন পাল্টে গেল। সবাই সাহেববেশী গণেশ হালদারের দিকে অবাক হয়ে তাকাতে লাগলাম।
কিন্তু মাদুলিবাবা দমলেন না। তিনি সরোষে বলে উঠলেন, আমি কারোর চোখে ধুলো দিতে চাই না। বরং সবার চোখের সামনে প্রমাণ করতে চাই যে, আমি ম্যাজিসিয়ান নই, মাদুলিবাবা। আবার বলছি, আমার ক্ষমতা পরীক্ষা করার অধিকার ভগবান ছাড়া কারও নেই।
গণেশ হালদার বলল, আপনি অনর্থক রেগে যাচ্ছেন। কথা হচ্ছে আপনার আর আমার মধ্যে। এখানে আবার মিস্টার ভগবানকে টেনে আনছেন কেন? আপনি বরং আপনার মাদুলির গল্প আরম্ভ করুন, আমরা শুনি।
মাদুলিবাবার গলায় কয়েকগাছি মাদুলির মালা। বেশ বড় বড় মাদুলি। সংখ্যায় কম করেও শ’ পাঁচেক।
তুমি আমার সঙ্গে রসিকতা করতে এসেছ? জানো, টালিগঞ্জ থানার ওসি আমার পরম ভক্ত? আমার এই মাদুলি শরীরে ধারণ করে কত লোক রোগ থেকে মুক্ত হয়েছে, সে খবর রাখো?
সব খবরই আমি পেয়েছি। আপনার মাদুলি-রহস্যও আমার জানা হয়ে গেছে। এখন সেই জানা রহস্যটাই আমি উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলীর সামনে উদঘাটন করে দেব। তবে একটু অপেক্ষা করতে হবে। একটু আগে আপনি যে পুলিস অফিসারের নাম করলেন, তিনি আর মিনিট দশেকের মধ্যেই এসে যাবেন। তাঁর সঙ্গে সন্তোষ বিশ্বাসেরও আসার কথা। সন্তোষ বিশ্বাসকে চেনেন তো? বলেই গণেশ হালদার মাদুলিবাবার চোখের দিকে বাঁকা চোখে তাকালো।
স্পষ্ট দেখলাম, গণেশ হালদারের কথায় মাদুলিবাবা বেশ চঞ্চল হয়ে উঠলেন। বললেন, তোমার মতন নাস্তিক লোকের সঙ্গে তর্ক করার সময় আমার নেই। তুমি এখন যেতে পারো। আমার খুব কাজ আছে।
কাজ আমারও আছে।
‘বটে।' বলেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন মাদুলিবাবা। তিনি পকেট থেকে আচমকা আগ্নেয়াস্ত্র বার করে ফেললেন।
গণেশ হালদার ব্যঙ্গ করে বলে উঠল, আমি এটাই চাইছিলাম। আপনারা সবাই মাদুলিবাবার স্বরূপখানা দেখছেন তো!
চোপ রও! যদি ভাল চাও, এখনি আমার আখড়া থেকে বেরিয়ে যাও। না হলে তোমার মাথার খুলি এই মুহুর্তে উড়িয়ে দেব। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে লাগলেন মাদুলিবাবা।
‘যাব।' বলেই গণেশ হালদার চোখের পলকে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাদুলিবাবার উপর।
গায়ের জোরে গণেশ হালদার শীগগিরই মাদুলিবাবাকে কাবু করে ফেলল। তার হাত থেকে রিভলভারটা ছিনিয়ে নিল। ঠিক তখনই আমাদের সামনে উপস্থিত হলেন দু-জন বিশিষ্ট পুলিস অফিসার। একজন হচ্ছেন টালিগঞ্জ থানার ও. সি, বিনয় মজুমদার, অন্যজন হচ্ছেন গণেশ হালদারের ডিটেকটিভ জীবনের বে-সরকারী গুরু, ডি, সি, ডি, ডি, সন্তোষ বিশ্বাস।
গণেশ হালদার মাদুলিবাবাকে বলল, ওই যে আপনি যার কথা বলছিলেন, তিনি এসে গেছেন। এই বলে সে বিনয় মজুমদারকে দেখালো। তারপর বলল, কি বিনয়বাবু, মাদুলিবাবাকে চেনেন নাকি? ভাল করে দেখুন তো এর বদনখানি। বলেই সে মাদুলিবাবার নকল দাড়ি হাত দিয়ে টেনে উপড়ে ফেলল।
আরে, এ কে! জয়নগরের গোপাল চক্রবর্তী না। বললেন বিনয়বাবু।
এখনও আপনার সন্দেহ আছে? এই মহাত্মাটির নাম এক সময় সি, বি, আই-এর খাতায় উঠেছিল। স্মাগলার হিসেবে এর যথেষ্ট কুখ্যাতি আছে। কিন্তু সি. বি. আই. বা পুলিস কোথাও এর পাত্তা পাচ্ছিল না। নিজেরই অলৌকিক ক্ষমতা বলে আজ ইনি আমাদের কাছে ধরা দিলেন। না হলে আমাদের সাধ্য কী ছিল এর কেশাগ্রটুকুও স্পর্শ করি। একটু থেমে সে আবার বলল, এই যে মাদুলির মালাগুলো দেখছেন, এগুলোতে ভর্তি আছে সোনা। সে মালাগুলো খুলে ও. সি-র হাতে দিল।
এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। মাদুলিবাবা ওরফে গোপাল চক্রবর্তী গ্রেফতার হলেন। আমরা (অর্থাৎ মাদুলিবাবার ভক্তবৃন্দ) যে যার বাড়িতে ফিরে এলাম। আর প্রতীক্ষায় রইলাম, কবে মাদুলিবাবার বিচার আরম্ভ হবে।
0 মন্তব্যসমূহ