Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

কবরের চারপাশে ।। ড. গৌরী দে

 

এক অদ্ভুত নেশা পেয়ে বসেছে হরি ডােমকে। কাজিমগঞ্জের শ্মশানে মড়া পােড়ানাে তার কাজ। তাতে আর কত হয়! দিন চলে না। এই সময় ওর বন্ধু মনসুর একটা প্রস্তাব নিয়ে এলাে। বলল, শােন হরি তােকে গােপনে একটা কথা বলি। একথা যেন কেউ না জানতে পারে। তাের ছেলে-বৌ-ও নয়। আমার কথামতাে কাজ করলে তুই টাকার গদির ওপর বসে থাকবি।।

চমকে উঠল হরি ডােম, মনসুর আলি বলে কি! নুন আনতে পান্তা ফুরােয় যার সে বসবে টাকার গদিতে! লােভে চকচক করে উঠল হরি ডােমের চোখ দুটো। বলল, করব, তুমি যা বলবে আমি তাই করব। বলাে কী করতে হবে।

মনসুর বলল, শােন, মড়া নিয়ে এখন বিরাট ব্যবসা চলছে। মড়ার হাড়, কঙ্কাল সব মােটা দামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তার চেয়েও বেশি দাম সদ্য মরা টাটকা বেওয়ারিশ লাশ, তার চোখ, কিডনি বের করে নেওয়া হয়, তারপর সেগুলাে মােটা দামে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এইরকম কয়েকটা যদি জোগাড় করে দিতে পারিস, তাের আর কোনাে অভাব তাে থাকবেই না। সুখে দিন কাটাতে পারবি।

হরি বলল, আমি তাে মড়া পােড়াই। যারা সঙ্গে আসে তারা দাঁড়িয়ে থাকে। এরকম সুযােগ কোথায় পাব?

ধমক দিয়ে ওঠে মনসুর। বােকার মতাে কথা বলিসনি হরি। পােড়ানাে ছাড়া বেওয়ারিশ মড়া পাস না? সেগুলাে কি করিস?

পুড়িয়ে দিই, হরি বলল, তবে সে আর কটা। মাঝে-মধ্যে একটা-আধটা! তাতে কী হবে?

আবার ধমক দেয় মনসুর, অত হিসেব আমি জানি না হরি। তােকে একটা ভালাে প্রস্তাব দিলুম, করবি তাে কর। চোরাগােপ্তার মাঠের উত্তর কোণে যে ছােট। টালির ঘর রয়েছে, আমরা ঐ ঘরে প্রত্যেক রাতে থাকি। যারা আমাদের সঙ্গে কাজ করে গভীর রাতে তারা মড়া এনে দেয়, টাকা নেয়, চলে যায়। আমরা সেই মড়া ভােররাতে ভ্যানে করে নিয়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিই। যদি পারিস জোগাড় করতে তাহলে রাত বারােটার পর চোরাগােপ্তা মাঠের উত্তরের ঘরে লাশ নিয়ে যাবি, সঙ্গে সঙ্গে নগদ টাকা পাবি। রাতারাতি বড়লােক। তবে একটা কথা শুনে। রাখ, পারিস বা না পারিস কথাটা পাঁচকান করবি না। জানতে পারলে আমার দলের লােকেরা তােকেই লাশ বানিয়ে রেখে দেবে। আমার কিছু করার থাকবে না।

ভাগ্যক্রমে সাতদিনের মধ্যে দুটো বেওয়ারিশ লাশ পেয়ে গেল হরি। নগদ টাকা হাতে পেয়ে সে পাগল হয়ে গেল। তার মনে জেগে উঠল লােভ। তাই সে সারারাত এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায় যদি কোনাে লাশ পায়। হরির এখন একটাই চিন্তা, কেমন করে লাশ জোগাড় করবে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। কবর খুড়লে তাে অনেক লাশ পাওয়া যাবে। যেগুলাে কঙ্কাল হয়ে গেছে বা পচে ধসে গেছে সেগুলাের জন্যে দাম কম পেলেও টাকা তাে পাবে। বলা যায়। না খুঁড়তে খুঁড়তে টাটকাও তাে পাওয়া যেতে পারে।

ওদিকে অনেকেরই চোখে পড়েছে গভীর রাতে কবরের আশেপাশে একটা ছায়ামূর্তি ঘােরাঘুরি করে। ভূতের ভয়ে আজকাল আর কেউ ওদিক দিয়ে রাতের বেলায় যায় না। তাতে হরির আরও সুবিধে হল। না, হরির আজ কোনাে অভাব নেই। দিব্যি রমরমিয়ে চলছে তার ব্যবসা।

হরির বাড়ির কাছাকাছি একটা পুকুর ছিল, পুকুরের এপারে হরির ঘর। ওপারে কয়েক ঘর মুসলমান নিয়ে একটা বস্তি। সেদিন সকালে প্রচণ্ড চেঁচামেচি-কান্নার শব্দ, মারপিট। ব্যাপার কি? না জামালউদ্দিন তার বাবা নাসিরউদ্দিনের সঙ্গে ঝগড়া করে বঁটি দিয়ে নিজের গলা কাটতে যাচ্ছিল। সবাই মিলে ধরে ফেলে, ব্যাপারটা মিটিয়ে নেয়। হরি ভাবে আহা মরলে তাে একটা লাশ পাওয়া যেত।

এই ঘটনার দিনই রাতে ভূতের মতাে অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে কবরে লাশ খুঁজছিল হরি। হঠাৎ দেখল একটা লােক টলমল করতে করতে চলেছে। যে কোনাে মুহূর্তে পড়ে যাবে। ওদিকে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে প্রচুর নেশা করেছে জামাল। কাছে আসতেই বুঝতে পারল, এ তাে জামালউদ্দিন। জামাল টলমল করতে করতে পুকুরের ধারে এগিয়ে চলেছে। হরি জামালের পিছু নিল, যদি পুকুরে পড়ে যায় সাতরে ওঠার ক্ষমতা জামালের হবে না। আর তাহলে সে এখুনি লাশটা নিয়ে জমা দিয়ে দেবে। কিন্তু জামাল তাে পড়ছে না। এক এক সময় মনে হচ্ছে এই বুঝি পড়ে গেল কিন্তু পড়ল না। উত্তেজনায় ঘামছে হরি। বিড়বিড় করে বলছে পড় না পড় না রে। না, জামাল পড়ছে না। টলমল করতে করতে ও ঠিক পেরিয়ে যাচ্ছে। আর আট-দশ পা গেলেই পেরিয়ে যাবে পুকুরটা। হরির আশায় ছাই পড়ল, টাটকা লাশ আর তার পাওয়া হল না। আর মােটা টাকাও ফসকে যাবে। মাথায় খুন চেপে গেল হরির। বিবেক-বুদ্ধি লােপ পেল, দিকবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ও ছুটে গিয়ে জামালকে পেছন থেকে একটা জোরে ঠেলা মারল। সঙ্গে সঙ্গে জামাল ছিটকে জলের মধ্যে পড়ে গেল। হরিও মুহুর্ত দেরি না করে ঝাপিয়ে পড়ল জলে। ডুবে যাওয়া জামালের শরীরটা টেনে তুলে নিয়ে এল ঘাটের কাছে। জামাল তখনও বেঁচে, হরি জামালের মাথাটা বেশ খানিকক্ষণ চুবিয়ে রাখল জলের মধ্যে। একটু ছটফট করে জামাল স্তব্ধ হয়ে গেল।

আনন্দে নেচে উঠল হরি। আজ সে যা টাকা পাবে তাতে তিন-চারদিন আর মড়া না পেলেও ক্ষতি নেই। জামালের নিথর শরীরটাকে তুলতে গিয়ে হঠাৎ কি মনে করে থমকে গেল হরি। তার মনে হল জামালকে সে যদি আজই পাচার করে দেয় তাহলে ঝামেলায় পড়তে পারে। জামালের খোঁজ চলবে, পুলিশ আসবে— তাতে হরির ওপর সন্দেহ পড়তে পারে। হরি জানে কবরখানায় মাঝরাতে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে তাকে রসুল। সে কবরখানার কেয়ারটেকার। সে রটিয়েছে হরি ডােম মড়া খায়। তার চেয়ে অন্য বুদ্ধি করা যায়। নানারকম ভেবে সে জামালের। শরীরটা পুকুরে ঘাটের সিড়ির ওপর এমন করে রাখল যেন জামাল নেশা করে পা হড়কে পুকুরে পড়ে গেছল, কিন্তু সম্পূর্ণ উঠতে পারেনি। কোনােকরমে শুধু মুখটা বার করতে পেরেছে। তাও নাকটা প্রায় ডােবাই। রাত তখন বেশ গভীর। গ্রামের রাত কেউ কোথাও নেই। হরি ধীর পায়ে উঠল কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নয়। তার পায়ের। ছাপ পড়লে যদি কেউ সন্দেহ করে! তাই সে সাঁতার কেটে অন্য পাড়ে চলে গেল, ওদিকটায় ওর ঘর। ঘরে যাবার আগে আর একবার শ্মশানে গেল যদি কোনাে মড়া এসে থাকে।

পরদিন সকালে পুকুরপাড়ে কাপড় কাচতে এসে ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ করল নাপিত বউ। তার চিৎকার, চেঁচামেচিতে লােক জড় হল। ছুটে এল নাসিরউদ্দিন। ছেলের এমন অপঘাত মৃত্যুতে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ঝগড়া হােক আর যাই হােক ছেলে তাে। হরি ভালােমানুষের মতাে এসে দাঁড়াল। জিগ্যেস করল, কি ব্যাপার গাে? কেউ সন্দেহ করল না তাকে। সারাদিন কেটে গেল, সন্ধেবেলা জামালের মৃতদেহ কবর। দেওয়া হল। হরিও গেল, আহা প্রতিবেশি বলে কথা। নাসিরউদ্দিনের কাছে বেশ খানিকটা হা-হুতাশ করল। কবর দেওয়া হয়ে গেলে যে যার ঘরে চলে গেল, হরিও শ্মশানে চলে গেল। অপেক্ষা করে রইল কখন রাত হবে। রাত বারােটা নাগাদ কোদাল আর একটা কাপড় নিয়ে হরি চলল কবরখানার দিকে। গ্রামের রাস্তা, চারপাশে গাছপালা, হরি গাছ-গাছলার ভেতর দিয়ে নিজেকে আড়াল করে চলল জামালের মৃতদেহ বার করে আনার জন্যে।

নাসিরউদ্দিনের চোখে আজ ঘুম নেই। অতবড় একটা তাগড়া জোয়ান ছেলে, বিয়ে-থা করেছে, কী হবে তার বৌয়ের ভবিষ্যৎ। তারও তাে বয়স হল। ঘুম আসছে না নাসিরউদ্দিনের। বিছানা ছেড়ে উঠে এল নাসির, বাইরের উঠোনে পায়চারি করতে লাগল। বুকটা তার কান্নায় ঠেলে ঠেলে উঠছে। হঠাৎ চোখে পড়ল দাওয়ায় রাখা জামালের গ্লাসটার দিকে। কাচের গ্লাস। রােজ রাতে ঘুমােবার আগে জামাল এক গ্লাসভর্তি জল খেয়ে তবে ঘুমােতে যেত। কতদিন রাগ করেছে নাসিরউদ্দিন, বলতাে, হ্যারে এই তাে দু' গেলাস জল খেলি, আবার জল খাচ্ছিস কেন। বেশিজল খেলে শরীরের রক্তটা যে জল হয়ে যাবে। জামাল হাসত। বলতাে, বাপজান, তুমি। আবার ডাক্তার হলে কবে থেকে! জানই তাে জল না খেলে আমার ঘুম আসে না। জল বেশি খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালাে।

কথাটা মনে পড়তেই নাসিরউদ্দিন তাড়াতাড়ি ওই গ্লাসে জল ভরল, তারপর নিজের মনেই বলে উঠল, জামাল, বাপ আমার। তােকে তাে জল দিতে ভুলে গেছি। জল না দিলে তুই যে ঘুমােতে পারবি না। আমি যাচ্ছি, তাের জন্যে জল নিয়ে যাচ্ছি, একটু অপেক্ষা কর।

নাসিরউদ্দিন কবরখানায় যখন ঢুকছে, হরি তখন জামালের দেহটা বার করে কাপড়ে মুড়ে একপাশে সরিয়ে কবরে মাটি চাপা দেওয়া শেষ করেছে। নাসিরউদ্দিন যখন কবরের কাছে গেল হরি তখন পিছনের পথ দিয়ে কবরখানার পাঁচিল পেরােচ্ছে। আসা-যাওয়ার সুবিধের জন্যে পাঁচিলের গায়ে একটা বড় ফুটো করে রেখেছিল হরি।

কবরের কাছে গিয়ে, জলটা কবরের পাশে রাখতে গিয়ে, চমকে উঠল নাসিরউদ্দিন। কবরের মাটি আলগা কেন? জামাল কি জেগে উঠল? জলের গ্লাসটা পাশে রেখে নাসিরউদ্দিন দু’হাতে মাটি সরাতে লাগল। একি, জামালের দেহটা কোথায় গেল। উঠে দাঁড়াল নাসিরউদ্দিন, দুটো চোখ বাঘের মতাে জ্বলছে। প্রায় ছ'ফুটের মতাে লম্বা লােকটা উঠে দাঁড়াতেই লক্ষ্য করল, পাঁচিল পেরিয়ে কে যেন যাচ্ছে তার কাঁধে একটা কাপড়ের পুটলি। নাসিরউদ্দিনের চিনতে অসুবিধে হল না হরিকে। আর এটাও বুঝতে পারল হরিই জামালের দেহটা নিয়ে পালাচ্ছে। হ্যা। ছেলেটাকে একটু শান্তিতে ঘুমােতেও দিল না হরি। প্রচণ্ড রাগে দুঃখে যন্ত্রণায় থরথর করে কেঁপে উঠল নাসিরউদ্দিন, চিৎকার করে ডাকল হরি...। গলা দিয়ে একফোটা স্বর বেরােল না। বুকে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করল, তারপর লুটিয়ে পড়ল ছেলের কবরের খোড়া মাটির ওপর।

হরি ডোম জানতেও পারল না তার মৃত্যুর পরােয়ানা জারি হয়ে গেল সেই মুহর্তে। হরি কাজ শেষ করে একগাদা টাকা নিয়ে আনন্দে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরল।

নাসিরউদ্দিনের দেহটা রসুলই আবিষ্কার করল। সমস্ত গ্রামময় ঢি-ঢি পড়ে গেল। গ্রামের লােক ঝেঁটিয়ে এলাে। এক তাজ্জব ব্যাপার। জামালের কবর খালি, সে জায়গায় পড়ে তার বাপজান নাসিরউদ্দিন। লােকে বলতে লাগল, জামাল কবর থেকে প্রেত হয়ে উঠে বাপকে টেনে এনেছে কবর দেবে বলে। হাজার হােক বাপ-ছেলে তাে!

ঝগড়া হলে কী হবে ভাবও ছিল দুজনের। সবাই মিলে পরামর্শ করে ছেলের কবরেই বাপকে শােয়াবার ব্যবস্থা করল।

হরির আনন্দ ধরে না, পরপর দুটো তাজা শরীর। এখন শুধু রাতের অপেক্ষা। হরি শ্মশানেই বসে রইল, আজ আর বাড়ি গেল না।

রাত তখন গভীর। হরি চলল নাসিরউদ্দিনের কবরের দিকে। ওঃ আজ আবার কড়কড়ে এতগুলাে টাকা তার বরাতে নাচছে। হরির হাতে আজ একটা শাবল। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাটি খুঁড়তে বেশি মেহনত করতে হবে।

সবচেয়ে হাসি পাচ্ছে হরির গ্রামের লােকের ধারণার কথা শুনে। জামালের দেহটা নাকি প্রেত হয়ে বাপকে মেরেছে। যাক হরির ভালাে। ওর দিকে আর কারাে নজর পড়েনি।

হরি জানে না, নজর পড়েছে একজনের। সে হল নাসিরউদ্দিন, সে মরার ঠিক আগে দেখেছে, হরি তার ছেলেকে তুলে নিয়ে গেছে। পাকা লােক বুঝতে তার অসুবিধে হয়নি, হরি এ দেহটা নিয়ে কী করবে। কানাঘুষােয় সে শুনেছিল হরি নাকি রাতের অন্ধকারে কবরের চারদিকে ঘােরে। তােক বলতাে, হরি মড়া ছাড়া থাকতে পারে না, তাই কবরে গিয়ে ঘুমােয়। আবার কেউ বলতাে, না, না, তাহলে তাে শ্মশানই ছিল। ও বােধহয় কবরখানার প্রেতাত্মাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে।

এসব কিছু নয়। নাসিরউদ্দিন সন্দেহ করেছিল অন্য কিছু। আর সেটাই ঘটল। তার ছেলের বেলা। ও হরিকে ছেড়ে দিত না। কিন্তু আল্লা বাধ সাধলেন ঠিক সেই মুহূর্তে তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেল। ছেলের শােক আর হরির দেওয়া শক সে সহ্য করতে পারল না। জ্ঞান হারাবার মুহূর্তে সে বলে উঠেছিল, এর প্রতিফল হরিকে পেতেই হবে। সে কথা কেউ শােনেনি, শুনতে পায়নি। হরি তাে নয়ই। | হরি গিয়ে দাঁড়াল নাসিরউদ্দিনের কবরের কাছে। সামান্য পরিশ্রমেই মাটি। সরানাের কাজ শেষ হয়ে গেল। ঐ তাে নাসিরউদ্দিনের দেহটা, নিশ্চল, নিথর। হরি দু’হাত বাড়িয়ে নিচু হয়ে ঝুঁকে দেহটা তুলতে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে কিসের আঘাতে ছিটকে পড়ল দু'হাত দূরে। হরির কী দমবন্ধ হয়ে আসছে? ও এ কী দেখছে। নাসিরউদ্দিন উঠে বসেছে। জুলন্ত রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল হরির দিকে। হরি। চিৎকার করে উঠল, এ কী তুমি তাে মরনি!

নাসিরউদ্দিন হেসে উঠল বিকট স্বরে। বলল, মরেছি— আবার ফিরেও এসেছি। তােকে মারব বলে। হাঁ করল নাসিরউদ্দিন, মুখের মধ্যে টলটল করছে রক্ত। বলল, আমার ক্ষিদে পেয়েছে, আমার রক্ত চাই।

হরি তাড়াতাড়ি মাটি চাপা দিতে গেল, পারল না। পেছিয়ে এলাে। হাহা করে অট্টহাসি হেসে উঠল নাসিরউদ্দিনের অতৃপ্ত আত্মা। সােজা দাঁড়িয়ে উঠল নাসিরউদ্দিনের শবটা। দুটো হাত বাড়িয়ে কবর থেকে উঠে এলাে। হরির দিকে একপা একপা করে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠল, আমার ক্ষিধে পেয়েছে, খেতে দে হরি।

হরি ছুটে পালাতে গেল, পারল না, পড়ে গেল। আবার একটা অট্টহাস্য, একটা আর্তনাদ শােনা গেল। তারপর সব চুপ।

চালাঘরে বসে অপেক্ষা করছে পুরাে দলটা! হরি বলেছে, শব নিয়ে আসবে অথচ রাত তাে অনেক হল, কই হরি তাে আসছে না। ভাের রাতে ওদের ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। মনসুর পায়চারি করছে অস্থির হয়ে আর ঘড়ি দেখছে। এমন সময় খুট করে একটা শব্দ, মনসুর না দেখেই চেঁচিয়ে ওঠে, হরি এলি, তাড়াতাড়ি আয়, তাের এত দেরি হল কেন রে? | পেছন থেকে ভাঙা গলায় উত্তর এলাে, হরি নয়, হরির যম।।

ধপ করে হরির মৃতদেহটা মাটিতে এসে পড়ল মনসুরের পায়ের কাছে। সামনে দাঁড়িয়ে বীভৎস চেহারায় নাসিরউদ্দিনের প্রেতাত্মা, গাময় মাটি মাখা। মুখের দু'কষ বেয়ে রক্ত পড়ছে, চোখগুলাে ভাটার মতাে জ্বলছে আর ঘুরছে। বােঝা গেল হরির শরীরের সব রক্ত শুষে নিয়েছে। প্রেতাত্মা হেসে উঠল। সে হাসিতে কেপে উঠল। টালির ঘর, দু’হাত বাড়িয়ে প্রেতাত্মা এগিয়ে এলাে মনসুরদের দিকে। মুখে সেই এক কথা—আমার ক্ষিধে পেয়েছে, রক্ত চাই। মনসুর পালাতে গেল। পারল না। কে যেন তার পা দুটো মাটির সঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে দিয়েছে। এই ফাকে অন্য দুজন ভ্যান নিয়ে পালিয়ে গেল।

পরদিন সকালে সকলে অবাক হয়ে দেখল, হরি, মনসুর-এর প্রাণহীন দেহ নাসিরউদ্দিনের কবরের উপর পড়ে আছে।

এখনপর্যন্ত কাজিমগঞ্জের গ্রামবাসীদের কাছে ব্যাপারটা রহস্যজনক হয়ে আছে। নাসিরউদ্দিনের কবরের ওপর হরি, মনসুরকে মেরে শােয়াল কে?

# গল্পটি শেয়ার করে আরো অনেকের পড়ার সুযোগ করে দাও।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ