এক ছিল রাজা আর তাঁর ছিল এক মস্ত বড়ো দেশ। তার নাম হল কানকাটার দেশ। সেই দেশের সকলেরই কান কাটা। হাতি, ঘোড়া, ছাগল, গরু, মেয়ে, পুরুষ, গরিব, বড়োমানুষ সকলেরই কান কাটা। বড়োলোকদের এক কান, মেয়েদের এক কানের আধখানা, আর যত জীবজন্তু গরিব দুঃখীদের দুটি কানই কাটা থাকত। সে দেশে এমন কেউ ছিল না যার মাথায় দুটি আস্ত কান, কেবল সেই কানকাটা দেশের রাজার মাথায় একজোড়া আস্ত কান ছিল। আর সকলেই কেউ লম্বা চুল দিযে, কেউ চাপ দাড়ি দিয়ে, কেউ বা বিশ গজ মলমলের পাগড়ি দিয়ে কাটা কানা ঢেকে রাখত, কিন্তু সেই রাজা মাথা একেবারে ন্যাড়া করে সেই ন্যাড়া মাথায় জরির তাজ চাপিযে গজমোতির বীরবৌলিতে দুখানা কান সাজিয়ে সোনার রাজসিংহাসনে বসে থাকতেন।
একদিন সেই রাজা এককান মন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কানকাটা ঘোড়ায় চেপে শিকারে বার হলেন। শিকার আর কিছুই নয়, কেবল জন্তু জানোয়ারের কান কাটা৷ রাজ্যের বাইরে এক বন ছিল, সেই বনে কানকাটা দেশের রাজা আর এককান মন্ত্রী কান শিকার করে বেড়াতে লাগলেন। এমনি শিকার করতে করতে বেলা যখন অনেক হল, সূর্যদেব মাথার উপর উঠলেন, তখন রাজা আর মন্ত্রী একটা প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় ঘোড়া বেঁধে শুকনো কাঠে আগুন করে যত জীবজন্তুর শিকার করা কান রাঁধতে লাগলেন। মন্ত্রী রাঁধতে লাগলেন আর রাজা খেতে লাগলেন, মন্ত্রীকেও দু-একটা দিতে থাকলেন। এমনি করে দুজনে খাওয়া শেষ করে সেই গাছের তলায় শুয়ে আরাম করছেন, রাজার চোখ বুজে এসেছে, মন্ত্রীর বেশ নাক ডাকছে এমন সময় একটা বীর হনুমান সেই গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে রাজাকে বললে, – 'রাজা তুই বড়ো দুষ্ট, সকলের কান কেটে বেড়াস, আজ সকালে আমার কান কেটেছিস; তার শাস্তি ভোগ কর।' এই বলে রাজার দুই গালে চড় মেরে একটা কান ছিঁড়ে দিয়ে চলে গেল। রাজা যাতনায় অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। অনেকক্ষণ পরে যখন জ্ঞান হল, তথন রাজা চারিদিকে চেয়ে দেখলেন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, হনুমানটা কোথাও নেই, মন্ত্রীবর পড়ে পড়ে নাক ডাকাচ্ছেন। রাজার এমনি রাগ হল যে তখনি মন্ত্রীর বাকি কানটা এক টানে ছিঁড়ে দেন; কিন্তু অমনি নিজের কানের কথা মনে পড়ল, রাজা দেখলেন ছেঁড়া কানটি ধূলায় পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি সেটিকে তুলে নিয়ে সযত্নে পাতায় মুডে পকেটে রেখে তা টুপির সোনার জরির ঝালর কাটা কানের উপর হেলিয়ে দিলেন যাতে কেউ কান দেখতে না পায়, তারপর মন্ত্রীর পেটে গুঁতো মেরে বললেন,- ঘোড়া আন। এক গুঁতোয় মন্ত্রীর নাক ডাকা হঠাৎ বন্ধ হল, আর এক গুঁতোয় মন্ত্রী লাফিয়ে উঠে রাজার সামনে ঘোড়া হাজির করলেন। রাজা কোনো কথা না বলে একটি লাফে ঘোড়ার পিঠে চড়ে একদম ঘোড়া ছুটিযে রাজবাড়িতে হাজির। সেখানে ভাড়াতাড়ি সহিসের হাতে ঘোড়া দিযেই একেবারে শয়ন-ঘরে খিল দিয়ে পালঙ্কে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।
সকাল হয়ে গেল, রাজবাড়ির সকলের ঘুম ভাঙল, রাজা তখনও ঘুমিয়ে আছেন। রাজার নিয়ম ছিল রাজা ঘুমিয়ে থাকতেন, আর নাপিত এসে দাঁড়ি কামিয়ে দিত, সেই নিয়ম মতো সকাল বেলা নাপিত এসে দাড়ি কামাতে আরম্ভ করলে। এক গাল কামিয়ে যেই আর এক গাল কামাতে যাবে এমন সময় রাজা দুর্গা দুর্গা বলে জেগে উঠলেন। নজর পড়ল নাপিতের দিকে, দেখলেন নাপিত ক্ষুর হাতে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ কানে হাত দিয়ে দেখলেন কান নেই। রাজা আপশোসে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে নাপিতের হাতে ধরে বললেন, 'নাপিত ভায়া এ কথা প্রকাশ কোরো না। তোমাকে অনেক ধনরত্ন দেব। নাপিত বললে, কার মাথায় কটা কান যে এ কথা প্রকাশ করব!' শুনে রাজা খুশি হলেন। নাপিতের কাছে আর-আধখানা দাড়ি কামিয়ে তাকে দু-হাতে দু-মুঠো মোহর দিয়ে বিদায় করলেন। নাপিত মোহর নিয়ে বিদায় হল বটে কিন্তু তার মন সেই কাটা কানের দিকে পড়ে রইল। কাজে কর্মে ঘুমিয়ে জেগে কী লোকের দাড়ি কামাবার সময়, কী সকাল, কী সন্ধ্যা মনে হতে লাগল – রাজার কান কাটা, রাজার কান কাটা, কিন্তু কারুর কাছে এ কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না, মাথা কাটা যাবে। নাপিত জাত সহজে একটু বেশি কথা কয়, কিন্তু পাছে অন্য কথার সঙ্গে কানের কথা বেরিয়ে পড়ে সেই ভয়ে তার মুখ একেবারে বন্ধ হল। কথা কইতে না পেরে পেরে পেট ফুলে তার প্রাণ যায় আর কি।
এমন সময় একদিন রাজা নাপিতের কাছে দাড়ি কামিয়ে সোনার কৌটো খুলে কাটা কানটি নেড়ে চেড়ে দেখছেন, আর অমনি কোত্থেকে একটা কাক ফস্ করে এসে ছোঁ মেরে রাজার হাত থেকে কানটি নিয়ে উড়ে পালাল। রাজা বললেন– ‘হাঁ হাঁ হাঁ ধরো! কাক কান নিয়ে গেল!' রাজা মাথা ঘুরে সেইখানে বসে পড়লেন। ভাবতে লাগলেন, প্রজাদের কাছে কী করে মুখ দেখাব।
এদিকে নাপিত ক্ষুর ভাড় ফেলে দৌড়। পড়ে-তা-মরে এমন দৌড়। শহরের লোক বলতে লাগল– নাপিত ভায়া, নাপিত ভায়া হল কী? পাগলের মতো ছুটছ কেন?
নাপিত না রাম না গঙ্গা কাকের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে একেবারে অজগর বনে গিয়ে হাজির। কাকটা একটা অশ্বথ গাছে বসে আবার উড়ে চলল, কিন্তু নাপিত আর এক পা চলতে পারল না, সেই অশ্বথ গাছের তলায় বসে পড়ে হাঁপাতে লাগল, আর ভাবতে লাগল– এখন কী করি? রাজার কান কাটা ছিল, অনেক কষ্টে সেকথা চেপে রেখেছিলুম; এখন সেই কান কাকে নিলে এ কথাও যদি আবার চাপতে হয় তাহলে আমার দফা একদম রফা! ফোলা পেট এবারে ফেঁসে যাবে, এখন করি কী?' নাপিত এই কথা ভাবছে এমন সময় গাছ বললে– 'নাপিত ভায়া ভাবছ কী?
নাপিত বলল, - ‘রাজার কথা।'
গাছ বলল– 'সে কমন?'
তখন নাপিত চারিদিকে চেয়ে চুপিচুপি বললে–
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা।'
এই কথা বলতেই নাপিতের ফোলা পেট একেবারে কমে আগেকার মতো হয়ে গেল, বেচারা বড়োই আরাম পেল, এক আরামের নিঃশ্বাস ফেলে মনের ফুর্তিতে রাজবাড়িতে ফিরে চলল।
নাপিত চলে গেলে বিদেশি এক ঢুলি সেই গাছের তলায় এল। এসে দেখলে গাছটা যেন আস্তে দুলছে, তার সমস্ত পাতা থরথর করে কাঁপছে, সমস্ত ডাল মড়মড় করছে, আর মাঝে মাঝে বলছে-
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা।'
ঢুলি ভাবলে এ তো বড়ো মজার গাছ! এরই কাঠ দিয়ে একটা ঢোল তৈরি করি। এই বলে একখানা কড়ল নিয়ে সেই গাছ কাটতে আরম্ভ করলে।
গাছ বললে–
‘ঢুলি, ঢুলি আমায় কাটিসনে!
-আর কাটিসনে! এক-দুই-তিন কোপে একটা ডাল কেটে নিয়ে ঢোল তৈরি করে-
রাজার কান কাটা,
তাই নিলে কাক ব্যাটা।
বাজাতে বাজাতে ঢুলি কানকাটা শহরের দিকে চলে গেল।
এদিকে কানকাটা শহরে রাজা কান হারিয়ে মলিন মুখে বসে আছেন আর নাপিতকে বলছেন- 'নাপিত ভায়া এ কথা যেন প্রকাশ না হয়!'
নাপিত বলছে– 'মহারাজ কার মাথায় দুটো কান যে এ কথা প্রকাশ করবে!' এমন সময় রাস্তায় ঢোল বেজে উঠল–
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা৷'
রাজা রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে নাপিতের চুলের মুঠি এক হাতে আর অন্য হাতে খাপ-খোলা তরোয়াল ধরে বললেন- “তবে রে পাজি! তুই নাকি এ কথা প্রকাশ করিসনি? শোন্ দেখি ঢোলে কী বাজছে।'
নাপিত শুনলে ঢোলে বাজছে-
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা৷'
নাপিত কাঁদতে কাঁদতে বললে- ‘দোহাই মহারাজ, এ কথা আমি কাউকে বলিনি, কেবল বনের ভিতর গাছকে বলেছি। নইলে হুজুর পেটটা ফেটে মরে যেতুম! আর আমি মরে গেলে আপনার দাড়ি কে কামিয়ে দিত বলুন?'
রাজা বললেন- 'চল্ ব্যাটা গাছের কাছে।' বলে নাপিতকে নিয়ে রাজা মুড়িসুড়ি দিয়ে গাছের কাছে গেলেন।
নাপিত বললে- ‘গাছ আমি তোমায় কী বলেছি? সত্য কথা বলবে।'
গাছ বললে–
‘রাজার কান কাটা।
তাই নিলে কাক ব্যাটা৷'
রাজা বললেন- 'আর কারো কাছে নাপিত বলেছে কি?'
গাছ বললে– 'না।'
রাজা বললেন– 'তবে ঢুলি জানলে কেমন করে?'
গাছ বললে– আমার ডাল কেটে ঢুলি ঢোল করেছে। তাই ঢোল বাজছে– 'রাজার কান কাটা।' 'আমি তাকে অনেকবার ডাল কাটতে বারণ করেছিলাম কিন্তু সে শোনেনি।'
রাজা বললেন- ‘গাছ, এ দোষ তোমার; আমি তোমায় কেটে উনুনে পোড়াব।'
গাছ বললে– ‘মহারাজ, এমন কাজ কোরো না। সেই টুলি আমার ডাল কেটেছে, আমি তাকে শাস্তি দেব। তুমি কাল সকালে তাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে এসো।
রাজা বললেন- 'আমার কাটা কানের কথা প্রকাশ হল তার উপায়? প্রজারা যে আমার রাজত্ব কেড়ে নেবে।'
গাছ বলে– 'সে ভয় নেই, আমি কাল তোমার কাটা কান জোড়া দেব। শুনে রাজা খুশি হযে রাজ্যে ফিরলেন।'
রাজা ফিরে আসতেই রাজার রানী, রাজার মন্ত্রী, রাজার যত প্রজা রাজাকে ঘিরে বললে– 'রাজামশাই তোমার কান দেখি। দেখালেন- এক কান কাটা। তখন কেউ বললে,– “ছি ছি। কেউ বললে– ‘হায় হায়'। কেউ বললে,- এমন রাজার প্রজা হবো না।'
তখন রাজা বললেন, ‘বাছারা কাল আমার কাটা-কান জোড়া যাবে, তোমরা এখন সেই ঢুলিকে বন্দী করো। কাল সকালে তাকে নিয়ে বনে অশ্বত্থ গাছের তলায় যেও।' রাজার কথা শুনে প্রজারা সেই ঢুলিকে বন্দী করবার জন্যে ছুটল।
তার পরদিন সকালে রাজা মন্ত্রী নাপিত, রাজ্যের প্রজা আর সেই ঢুলিকে নিয়ে ধুমধাম করে সেই অশ্বত্থ তলায় হাজির হলেন। রাজা বললেন, ‘অশ্বত্থ ঠাকুর ঢুলির বিচার করো।'
অশ্বত্থ ঠাকুর নাপিতকে বললেন- 'নাপিত, ঢুলির একটি কান কেটে রাজার কানে জুড়ে দাও।'
নাপিত ঢুলির একটি কান কেটে রাজার কানে জুড়ে দিল। চারদিকে ঢাক-ঢোল বেজে উঠল, রাজার কান জোড়া লেগে গেল। এমন সময় যে হনুমান রাজার কান ছিঁড়ে ছিল সে এসে বললে- ‘অশ্বত্থ ঠাকুর, বিচার করো- রাজামশায় আমার কান কেটেছে, আমার কান চাই।
অশ্বত্থ বললে, - ‘রাজা ঢুলির অন্য কান কেটে হনুকে দাও। এক কান কাটা থাকলে বেচারির বড়ো অসুবিধা হতো- দেশের বাইরে দিয়ে যেতে হত।
এইবার ঢুলির দু-কান কাটা হল- সে এখন দেশের ভিতর দিয়ে যেতে পারবে।'
রাজা এক কোপে ঢুলির আর-এক কান কেটে হনুর কানে জুড়ে দিলেন আবার ঢাক-ঢোল বেজে উঠল। তখন অশ্বত্থ ঠাকুর বললে, - ‘ঢুলি এইবার ঢোল বাজা।' ঢুলি লজ্জায় ঘাড় হেঁট করে ঢোল বাজাতে লাগল- ঢোল বাজছে
''ঢুলির কান কাটা।
ঢুলির কান কাটা।''
রাজা ফুল-চন্দনে অশ্বত্থ ঠাকুরের পুজো দিয়ে ঘরে ফিরলেন। রানী রাজার কান দেখে বললেন-'একটি কান কিন্তু কালো হল।
রাজা বললেন- 'তা হোক, কাটা কানের থেকে কালো কান ভালো। নেই মামার চেয়ে কানা-মামা ভালো।'
0 মন্তব্যসমূহ