স্কুল থেকে বেরিয়েই দেখি চঞ্চলদা দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, কী ব্যাপার চঞ্চলদা, তুমি এখানে কী জন্য?
- তোর জন্যই।
- আমার জন্য? কেন? তুমি কলকাতা থেকে ফিরলে কবে?
- আজই। একটু আগে। ফিরেই তোর কথা মনে হল। বাড়ি গিয়ে দেখি তুই স্কুল থেকে ফিরিসনি। তাই স্কুলেই চলে এলাম।
- ভালোই হল। আজ আমি সাইকেল আনিনি। তোমার সাইকেলেই বাড়ি যাব।
- না, আমিও সাইকেল আনিনি। তাছাড়া এখন তো আমরা বাড়ি যাব না। দ্বীপচন্দ্রপুর যাব।
- কেন?
- তুই ভুলে গেছিস দেখছি। আজ ভাদ্র মাসের অমাবস্যা না?
- ভাদ্র মাসের অমাবস্যাতে কী?
- দেখো কাণ্ড। আমি মনে রেখে কলকাতা থেকে ছুটে এলাম, আর তুই সব ভুলে বসে আছিস। আজ ভূত দেখতে যাওয়ার কথা না? দিব্যমাসি কথা দিয়েছে। আজ আমাদের ভূত দেখাবে।
- সত্যি?
- সত্যি না হলে আমি এতদূর ঠেঙিয়ে এলাম কী করতে?
- তাহলে চলো। তবে আগে বাড়ি যাই। মাকে বলে আসি। না হলে বাড়িতে চিন্তা করবে।
- তোর বাড়িতে বলেই এসেছি। তবে ভূত দেখতে যাব সেকথা বলিনি। বললে পারমিশন পেতাম না। বলেছি কালীপুজোর নেমন্তন্ন আছে। সেখানে যাচ্ছি। ফিরতে রাত হবে।
– ঠিক বলেছো। তবু দাঁড়াও একটা ফোন করে দিই অন্তত।
– ফোন করবি কী করে? দুপুর থেকে তো টাওয়ারই নেই। এক্সচেঞ্জ বসে গেছে। কালকের আগে ঠিক হবে না।
মোবাইল বের করে দেখলাম সত্যিই টাওয়ার নেই। স্কুল থেকে সোজা না বলে-কয়ে যাব বলে একটু চিন্তা হচ্ছে। স্কুল থেকে বাড়ি না গেলে নিশ্চয়ই চিন্তা করবে। আবার ভূত দেখার লোভও সামলাতে পারছি না। ভাবছি কী করি? আমার মুখ দেখে চঞ্চলদা বুঝে ফেলেছে। আমাকে আস্বস্থ করে আবার বলল, তোর ভয় নেই, বাড়িতে বলেই এসেছি, তাছাড়া এখন বাড়িতে গেলে সন্ধে হয়ে যাবে। তখন কি আর বাড়ি থেকে ছাড়বে ভেবেছিস? তার চাইতে বেলায়-বেলায় হেঁটে চল। শোন, পাকা রাস্তা ধরে যাব না, জমির আল ধরে শর্টকাটে যাব। তাড়াতাড়ি হবে। দিব্যমাসি বলেছে পুজো শেষ হলেই পাটে বসবে।
- ভূত দেখা যাবে তখন?
- শুধু দেখা যাবে না! কথাও বলা যাবে। যেমন তুই আমি কথা বলছি তেমন।
দ্বীপচন্দ্রপুরের মাতা দিব্যময়ী জাগ্রত তান্ত্রিক কালী সাধিকা। তান্ত্রিক সাধারণত পুরুষ মানুষই হয়। কিন্তু দিব্যময়ী ব্যতিক্রম। তিনি নাকি তাঁর গুরুদেবের কাছে একরকম জোর করেই তন্ত্র সাধনা শিখেছেন। তাঁর স্মৃতি, তাঁর ধৈর্য, কঠিন ব্রতপালন ক্ষমতা দেখে তাঁর তন্ত্র ধারক গুরুদেব তাঁকে শব-সাধনার অনুমতি দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন মুণ্ড আসনে বসে তন্ত্র সাধনা করেছেন তিনি। সাধন শেষে তারপীঠ, কামরূপ-কামাক্ষা, বিন্ধ্যাচল সহ ভারতবর্ষের নানান স্থান ঘুরে দ্বীপচন্দ্রপুরে এসে আশ্রম গড়েছেন। মন্দির গড়েছেন। সেই মন্দিরে প্রতি ভাদ্র মাসের অমাবস্যায় শ্মশান কালীপুজো হয়। পুজো শেষে তিনি তাঁর তন্ত্রশক্তির সাহায্যে ভূত-প্রেতদের ডাকেন। তাদের দিয়ে তিনি ভৃত্যের মতো কাজ করান। এইসব ভূতেরা নাকি বিভিন্ন রূপে আশ্রমে থাকে। কেউ মানুষ রূপে। কেউ-কেউ পশু-পাখি রূপে। আরব্য রজনী রূপকথার জাদুকরীদের মতন তিনি ভূতেদের বহুরূপে বন্দি করে রাখেন। সাধারণ মানুষের চোখে এঁরা অন্যান্য জাগতিক প্রাণীর মতোই সাধারণ প্রাণী। মাতার মতো অন্য কোনো তন্ত্র সাধক হয়তো এঁদের স্বরূপ চাক্ষুস করতে পারেন। গভীর রাতে মাতা দিব্যময়ী যখন টকটকে লাল চেলি পরে, কপালে রক্ত তিলক এঁকে, গলায় একশ আটটা অষ্টমুখী রুদ্রাক্ষের মালা ঝুলিয়ে, ইয়া বড়ো বাদামি-জটা নাড়িয়ে রক্ত চোখে হুঙ্কার ছেড়ে ভূতেদের ডাকেন, তখন উপস্থিত গুটিকতক বিশেষ সাধারণ মানুষও হয়তো এইসব ভূতেদের স্বচক্ষে দেখে থাকতে পারেন। কিন্তু মাতা দিব্যময়ী ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট' হোক তা চান না।
ভূতের সাথে দেখা করতে নাকি বুকে সাহস লাগে। দুর্বল হৃদয়ের মানুষেরা নাকি কখনই ভূত দর্শন করতে পারে না। মাতার আশ্রমে যারা ভূত বৈঠকিতে উপস্থিত থাকার সুযোগ পায় তাদের রীতিমতো সাহসের পরীক্ষা দিতে হয়।
চঞ্চলদাকে এসব পরীক্ষা-টরীক্ষা দিতে হয়নি। চঞ্চলদা মাতার খুব কাছের লোক। ওকে খুব ভালোবাসেন মাতা। চঞ্চলদা আমাদের সম্পর্কিত আত্মীয় না হলেও একটা আলাদা সম্পর্ক আছে। চঞ্চলদার মা আর আমার মা টগর-বেলি সই। তারা লোকবাংলার অতীত বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে নতুন করে ফিরিয়ে আনতে চায়। বলে, ফেসবুক-টুক বাদ দাও, আমরা সই সম্পর্ক নিয়েই থাকব। সে কারণেই চঞ্চলদা আমার প্রতি একটু বেশি কেয়ারিং।
চঞ্চলদা বিজ্ঞানের ছাত্র। ভূতকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিত। ভূত দেখার জন্য তেঁতুলতলা শ্মশানে একরাত কাটিয়েও এসেছে। কোনো ভূত-টুত দেখতে পায়নি। যারা ভূত দেখেছে বলে দাবী করে তাদের সঙ্গে তুমুল ঝগড়াও করেছে। শেষে একদিন মাতা দিব্যময়ীর ওখানে যায়।
তখন সবে মাতার ভূত নিয়ে জাগলিং-এর কথা চাউর হয়েছে। চঞ্চলদা তাকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিল- আপনি ভূত দেখেছেন?
মাতা দিব্যময়ী ওইটুকু ছেলের অমন কনফিডেন্ট প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলছিলেন। বলেছিলেন, ওরে ভূত আমার ছেলেমেয়ের মতো। আশ্রমে ওরা আমার ফাইফরমাস খাটে। আমার কথায় ওঠে বসে। আর তুই আমাকে প্রশ্ন করিস আমি ভূত দেখেছি কিনা!
- আমি ভূত দেখব। আমাকে ভূত দেখাতে পারবেন?
- কেন পারব না? তুই ভূত দেখতে চাস?
সেই শুনে তো চঞ্চলদা মাতা দিব্যময়ীর কাছে বলেই বসল, আমি তন্ত্র সাধনা শিখব। আপনি আমাকে শেখাবেন? তাহলে আজই আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করব।
মাতা এবারও হেসে বলেছিলেন, ওরে পাগল, তন্ত্রসাধনা তোর জন্য নয়। তোর জন্য অন্য কাজ নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। সে কাজ আগে শেষ কর, তারপর ভেবে দেখব।
চঞ্চলদার তখন উচ্চ মাধ্যমিক। তারপর জয়েন্ট দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কলকাতা চলে যায়। কলকাতা গেলেও মাতার সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিলই। মাতার সঙ্গে ওর এমন ভাব হয় যে চঞ্চলদা মাতাকে মাসি বলে ডাকতে শুরু করে।
মাসি নাকি বলেছিল, বারো নম্বরের তেমাথার মোড়ে নেপালদের বাড়ির পাশে যে বড়ো বটগাছটা আছে সেই গাছে নাকি একটা ব্রহ্মদৈত্য আছে। আমাদের বাড়ি যাওয়ার পথেই গাছটা পড়ে। ওই গাছের নীচ দিয়েই যেতে হয়। কথাটা শোনার পর থেকে সন্ধের পর ওই গাছের নীচ দিয়ে গেলেই গা ছমছম করে উঠত। দু-একদিন ভয়ে-ভয়ে মাথা তুলে ওপরের দিকে চেয়েও দেখেছি কোনো ব্রহ্মদৈত্য ডালে লম্বা-লম্বা পা মেলে দাঁড়িয়ে আছে-কিনা। বিস্তীর্ণ বটগাছের কোল জুড়ে হরেকরকমের অন্ধকার দেখেছি। কিন্তু তাঁদের দেখা পাইনি।
একদিন চঞ্চলদাকে বলেছিলাম। তোমার দিব্যমাসির বাড়ি ভূত দেখাতে নিয়ে যাবে? তখনই চঞ্চলদা বলেছিল, ভাদ্র মাসের অমাবস্যার রাত হল ভূত দেখার আদর্শ সময়। এবার তোকে নিয়ে যাব ওইদিন।
আজ যে ভাদ্র মাসের অমাবস্যা তা আমার মনেই ছিল না। সূর্য পশ্চিম আকাশে লাল টিপের মতো সেঁটে আছে। আমরা ধানজমির আল ধরে যাচ্ছি। দুধারে কচি ধান গাছে সবুজের ঢেউ। পাখিরা বাসায় ফিরছে। দূরে গাছে পাখিদের আনন্দ-কাকলি শুনতে পাচ্ছি। সোনা কাকার কাছে কতরকমের ভূতের গল্প শুনেছি স্কন্ধকাটা, মামদো, শাকচুন্নি, এলে..।
মাসির কাছে এদেরই কাউকে চাক্ষুষ করব আজ। ভাবতে-ভাবতে যাচ্ছি। আলের উপর একটা আল কেউটে যে আমার পায়ের সামনে ফণা তুলে আছে খেয়াল করিনি। ছোবল মারতে যাবে এমন সময় চঞ্চলদা ডান হাতে আমাকে হ্যাঁচকা-টানে সরিয়ে বাঁ পায়ে মেসির মতো জোরালো একটা শট মারল। সাপটা দেখলাম বলের মতো উড়ে গিয়ে দূরে ধানের জমিতে পড়ল। চঞ্চলদা ভালো ফুটবল খেলে। অনেক দর্শনীয় গোল দেখেছি। কিন্তু এমন একটা ফণা তোলা বিষধর সাপকে যে এভাবে উড়িয়ে দিতে পারে তা কল্পনাও করতে পারিনি। চঞ্চলদা হাসতে-হাসতে বলল, তুই তো ভূত দেখার আগেই ভূত হয়ে যেতিস রে।
আশ্রমে পৌঁছতে আমাদের সন্ধে হয়ে গেল। মাতা আমাদের দেখেই বললেন, হ্যাঁরে চানু, এ তুই কাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিস?
- মাসি, ও আমার মাসতুতো ভাই। ভূত দেখবে বলে তোমার কাছে নিয়ে এসেছি।
- এইটুকু একটা ছেলেকে এনে ভুল করেছিস। ঠিক আছে, তুই যা। ও আমার কাছেই থাক।
চঞ্চলদা চলে গেল। আমি মাতাকে প্রণাম করলাম। মাতা আমার নাম-ধাম জিজ্ঞেস করার পর বললেন, আগে হাত-মুখ ধুয়ে একটু ভোগের প্রসাদ খেয়ে নে। অনেক দূরের থেকে হেঁটে এসেছিস। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তারপর দেখছি কী করা যায়! বলে মাতা একটা লোককে বললেন, পবা ওকে একটু প্রসাদ দে তো।
এটা দুপুরের ভোগের প্রসাদ। খাওয়া শেষ হতে মাতা বললেন, শোন বিজু, আজ মায়ের পুজো হবে নিশুত রাতে। এতরাত অবধি তোর থাকা ঠিক নয়। বাড়িতে বাবা-মা চিন্তা করবে। তুই বাড়ি চলে যা। পবা, ওকে একটু বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়।
আমি বললাম, চঞ্চলদা কোথায় গেল? বাড়ি যাবে না?
- ও থাকবে। ওকে আমি একটা কাজে পাঠিয়েছি। ফিরতে দেরি হবে। তুই পবন কাকুর সঙ্গে যা।
চঞ্চলদা যেহেতু এখানে হামেশাই আসে তাই আমি আর প্রশ্ন করলাম না।
মাতা আমার কানে একটা জবাফুল গুঁজে দিয়ে বললেন, যা তোর কোনো চিন্তা নেই। মা তোকে রক্ষা করবে।
ভূত দেখব বলে খুব আগ্রহ নিয়ে এসেছিলাম। শেষ পর্যন্ত হতাশ মনেই ফিরতে হল।
বাড়ি ফিরে দেখি বাবা-মা কেমন চুপচাপ। আমার খুব ভয় হল। অন্যদিন টিউশন থেকে ফিরতে রাত হলে হাজার কৈফিয়ত দিতে হয়। অথচ আজ কেউ কিছু বলছে না। বাড়িতে একটা গুমোট ভাব। আমাকে নিয়ে কেউ কিছু ভাবছে না। সবাই যেন অন্যকিছু নিয়ে ভাবছে।
কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও সাহস পাচ্ছি না। ঘরে ঢুকে দেখি ঠাম্মাও চুপচাপ বসে আছে। ঠাম্মাকে বললাম, কী হয়েছে? তোমরা সবাই এমন চুপচাপ কেন?
- তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি ভাই? ঠাম্মা গম্ভীরভাবে বলল।
- আমি তো চঞ্চলদার সঙ্গে দ্বীপচন্দ্রপুর মাতার আশ্রমে কালীপুজোর প্রসাদ খেতে গেছিলাম। কেন চঞ্চলদা বলে যায়নি?
- কী বললি তুই? কার সঙ্গে গেছিলি! ঠাম্মার গলায় বিস্ময় ঝরে পড়ল।
- চঞ্চলদার সঙ্গে।
- চঞ্চলের সঙ্গে?
- হ্যাঁ।
- তুই কিছু শুনিসনি?
- কী শুনব?
- ওরে চঞ্চল আজ দুপুরে কলকাতার রাস্তায় এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছে। বলে ঠাম্মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছল।
- বলো কী তুমি!
- ঠিকই বলছি ভাই। দেখছিস না সবাই কেমন মন মরা!
হঠাৎ একটা ভয় আমাকে জাপটে ধরল। বুকের ভিতর একটা দমবন্ধ কান্না গুমরে উঠল। শেষ পর্যন্ত চঞ্চলদা দেহ ধারণ করে আমার ইচ্ছেপূরণ করে গেল এইভাবে।
ছবি : রাহুল মজুমদার
গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল- "চিরকালের ছেলেবেলা" মে ২০১৩ সংখ্যায়।
0 মন্তব্যসমূহ