ভূতেরা বড় মিথ্যুক ।
কথাটা আমার নয়। এ শহরের সবচেয়ে লম্বা পাড়ির বাসে দমদম এয়ারপাের্টের দিকে যাবার মুখে বেশ খালি হয়ে আসা বাস-এর একটি বেঞ্চিতে পড়ে থাকা বেওয়ারিশ একটি পুটলিতে যারা ছেড়া-খোঁড়া একটা খেরাে খাতা পেয়ে মালিকের নাম-ঠিকানা তাতে খুজে পেলে ফিরিয়ে দেবার আশ্বাস দিয়ে সেটা নিয়ে এসেছিলাম, সেই একমেবাদ্বিতীয়ম ভূত-শিকারী দুয়েপরিচয় সেই মেজকর্তাও একথা বলেননি। এ মন্তব্যটি হল মুনশি মুলুকটাদের, নেজকর্তার খেরােখাতা ঘটতে ঘাঁটিতে যার
খোঁজ পেয়েছি।
মুনশি মুলুকদ মেজকর্তাকে বেশ একটু টিটকিরি দিয়েই বলেছিলেন “যাদের পেছনে ছুটে-ছুটে মাথার অর্ধেক চুল ঝরিয়ে ফেললেন, এতদিনেও তাদের একটু চিনলেন না! বড়া অফিসোস কি বাত কর্তা মশাই, আপনার জন্যে বড়ো দুঃখ হয়, অপনিও এখন জানেন না যে, একদম ষোল আনা সাচ্চা অনিরও ওপরে গেল জবান ঝুটা হয়ে। যায়। সব ভুল ভাল যা মন চায় কিসসা শুনিয়ে দেয় আপনাদের। আর দেবে নাই বা কেন? তাদের যে-রকম জ্বালাতন অপারা করেন, তাতে আপনাদের নিয়ে একটু বেয়াড়া রসিকতা করে শোধ নিতে চাওয়া তাদের। খুব অন্যায় কি?
“এই ধরুন, আপনাদের কী এক নয়া যন্তর এসেছে, কি এই পেলেনচিট না প্যালানটি কী যেন নাম। কাঠের একটা পানপাতার তলায় তিনটে চাকা বসানাে। যেখাসে-সেখানে যখন-তখন একটু সুবিধে আর সময় পেলেই ক'জনে মিলে টেবিলের ওপর এই প্যালানটি নিয়ে আপনারা বসে যান। আপনারা ক’জনে ওই কাঠের পানপাতার ওপর হাত রেখে চোখ বুজে বসে যারা ওপারে গিয়েছে তাদের কথা ভাবেন। আর তাতে মনে করেন ওপারের ওরা চুম্বকের টানে লোহার মত ওই প্যালাচিতে এসে ভর না করে পারবে না। তা ওরা তাই অলে আর প্যলাচিতে ভর করে তা যে চালায় তাও ঠিক। কিন্তু কেন আসে জানেন ? আসে কখনাে-কখনাে আপনাদের বুদ্ধিশুদ্ধির দৌড় দেখে আপনাদের নিয়ে একটু মজা করতে। যেমন দু চারটে অজানা খবর আপনাদের মনের লুকোনাে পাতা থেকেই পড়ে নিয়ে আচমকা জানিয়ে দিয়ে তাক লাগানাে। তাক লাগাবার পর এই পানপাতা প্যালানটি নাড়িয়ে যা লেখে তাতেই আপনারা ভয় ভক্তি বিশ্বাসে গদগদ।
“সে যারা যা হয় হোক, আপনার মতাে পাকা জরি কিনা ওদের কথা শুনে এমন ভূলটা করলেন ?
“যার তার তো নয়,” বলেছিলেন মেজকর্তা, “কথা শুনেছি তো খােদ লালা রাজারামের !”
“লাল রাজারামের!” হেসেছিলেন মুনশি মুলুকটাদ। হেসে তিনি কী বলেছিলেন, আর তার জবাবে কী বলেছিলেন মেজকর্তা, কথাটা উঠেছিল কী থেকে, আর কোথায় কেনই বা এমন সব কথা হয়েছিল তা স্বয়ং নেকর্তার কাছ থেকে তাঁর নিজের জবানিতে শােনা নিশ্চয়ই ভাল।
“আশা তাে দূরের কথা,” তার খেরো খাতায় লিখেছেন মেজকর্তা, -“যা ভাবতে পর্যন্ত পারিনি তাই এবার সত্যি ঘটেছে একেবারে অবাক করে দিয়ে।
“কিন্তু অবাক বা হই কেন ? একটু ভেবে দেখলেই তো বুঝতে পারি, যা সোজা আর হিসেবমাফিক তার চেয়ে উল্টোটা দুনিয়ায় বড় কম ঘটে না।
“এই যেমন মাছ ধরার বেলায় হামেশা দেখি। বেশ করে আগে থাকতে চায় ফেলে নিখুত সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে একেবারে সেরা ছিপ-টিপ নিয়ে আর সবচেয়ে সরেস টোপ ফেলে যেখানে বসি, সেখানে এবেলা ওবেলা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফাতনার ধ্যানই কতবার না সার হয়। আর তাইতেই বদমেজাজ নিয়ে ফিরে যেতে-যেতে বেয়াড়া কোনো অঘাটায় নেহাত হেলায়-ফেলায় টোপ-গাথা বঁড়শিটা একবার ছুড়ে দিয়েছি কি, চোখের পাতা না পড়তে পড়তে চো-চঁ কিসের টানে জলের তলায় ফাতনা উধাও হওয়ার সঙ্গে স্বততা ছাড়ার বেগে হুইলের গোঙানি যেন আর থামতে চায় না।
“ভাগ্য আর-একটু ভাল হলে সেই দফাতেই শেষ পর্যন্ত হয়ত আধ| মনি একটি মাছের রাজাকে কাটা কলাগাছের ভেলায় চড়ে জল থেকে শেষ পর্যন্ত তুলে আনতে হতে পারে।
“এ যাত্রায় আনার যা হয়েছে তা ঠিক ওই। আমার সেই চিরকেলে নেশার তাগিদে নয়, শ্রেফ একটু বিদেশ ঘোরাফেরা আর সেই সঙ্গে যেটুকু তীর্থধর্ম হয় তা সারবার জন্যে কিছু দিনের মতো বেরিয়ে পড়ে ছিলাম।
“সময়টা মােটেই ভাল নয় বলে অনেকে একটু বাধা দিতে চেয়েছিল।
কিন্তু আমি তো ডাঙার পথ মাড়াচ্ছি না বললেই হয়। আমার নিজের ফরমাশ দিয়ে বানানো বজরা, মাঝিমাল্লাও সব আমার পুরনাে পাকা লোক। যেখানে যাবার, জলে-জলেই যাব তাদের নিয়ে। ছােটখাটো তো নয়, প্রায় অকূল নদী। এপারে কিছু লোক দেখলে ওপারে গিয়ে ভিড়লেই হল। সুতরাং আমার ভাবনট। কিসের?
“তা সেরকম ভয়-ভাবনার কিছু হয়নি এ-পর্যন্ত। হেসেখেলে ভেসে ভেসে অনন দু-হোটে। মুলক তো পার হয়ে এলান, তার মধ্যে কখনোসখনো রাতবিরেতে ওড়না-গাড়ামের মতো যা অওয়াজ শুনেছি তা মেঘের ডাক যে নয়, তা কে বলতে পারে !
“সব কিছুর বদলে যা হল তা এই “কৃষ্ণপক্ষের নবনী-দশমী। রাত তখন প্রথম প্রহর পার হয়েছে। মেঘে ঢাকা আকাশ যেমন অন্ধকার তেমনি অন্ধকার নদীর জল। স্রোত আর হাওয়ার সুবিধে নিতে যে-পার ঘেযে বজরা যাচ্ছে, সেখানকার সব কিছুও যেন গাঢ় কালির পোঁচ লাগানো।
“এরই মধ্যে হঠাৎ চমকে উঠে বড় মাঝিকে ব্যস্ত হয়ে ডাকলাম, ‘দে ওলাল! দেওলাল! দেখতে পেয়েছে ? শুনতে পাচ্ছ কিছু?
“দেওলাল তখন আমার পাশেই এসে দাড়িয়েছে। একটু যেন দ্বিধা করে বলল, ‘ই। সরকার।
“তাহলে চুপ করে দাড়িয়ে আছ কেন? একটু ধমকের সুরে বললাম, ‘বজরা রােখো, লাগাও ওই ঘাটে।
“কিন্তু সরকার, দে ওলাল আমার ধমক খেয়েও সামান্য একটু আপত্তি করে, ‘দিনকাল বড় খারাপ ! একেবারে অজানা ঘাটে এমন করে বজরা ভিড়নাে কি—
“তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আবার ধমকে উঠলাম, “দিনকাল খারাপ তাে কী ? অজানা ঘাটে ওই একটা মানুষ আমাদের বজরা সমেত এতগুলাে মানুষকে খেয়ে ফেলবে? মানুষটা আমার নাম ধরে ডাকছে শুনতে পেয়েছে ?
এমন অসম্ভব জায়গায় ওই নাম ধরে ডাকাটা যত তাজ্জবই করুক।
তা শোনার পর বজরা না থামিয়ে চলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
“যেখানে মানুষটাকে দেখেছি, বজরা এতক্ষণে স্রোতের টানে তা ছাড়িয়ে অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছে। সেখান থেকে বজরা ঘুরিয়ে যথাস্থানে লাগাতার হুকুম দিয়ে দেওলাল আমার কাছে ফিরে আসার পর বললাম, যাও, আমার কামরা থেকে বন্দুকটা বরং নিয়ে এসাে।
“দেওলাল বনদক আনতে গেল না! জানলে বজরা ঘাটে লাগবার পর রীতিমতো লড্রোতেই পড়তাম। কারণ এমন একটা অসম্ভব জায়গা থেকে এমন অবিশ্বাস্যভাবে যে আমায় ডেকেছে, সে আর কেউ নয় লাল রাজারাম। তার সঙ্গে এই পথে দেখা হওয়ার ব্যাবস্থা খত লিখে আগে থাকতেই আমাদের ঠিক হয়ে আছে।
“তা থাকলেও লাল রাজারামের এমন জায়গায় এ-সময়ে এসে দাড়িয়ে আমার বজরা থানাবার জন্য ডাক দেওয়াটা অবশ্য একেবারে অদ্ভুত কল্পনাতীত ব্যাপার! সেটা কেমন করে সম্ভব হল ?
“বজরা পড়ে লাগবার পর তা থেকে বেশ কষ্ট করেই সেই আঘাটায় নেমে সেই কথাই রাজারামকে জিজ্ঞাসা করলাম। বললাম, “এই এখানে এমন করে দাড়িয়ে কেন লালাজি ? তোমার তাে আমার সঙ্গে কাল সকালে দিলদারনগর ছাড়িয়ে সেই জামানিয়ার ঘাটে দেখা করার কথা !
“সেখানে কাল সকালে থাকতে পারব না বলেই তোমায় যাবার পথে ধরবার জন্যে এখন দাড়িয়ে আছি। জানাল লালাজি।
“তার এ অপাবে বিস্ময়টা বাড়ল বই কমল না। বেশ একটু হতভম্ব হয়েই তাই বললাম, কী বলছ লালাজি ? অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। কিন্তু জায়গাটা চৌসা বলেই মনে হচ্ছে। এখান থেকে নদী দিয়ে জামানিয়া যেতে পঞ্চাশ মাইলের কম নয়। এই এতখানি রাস্তার মধ্যে ঠিক কোথায় দাঁড়ালে আমার বজরা ডেকে থামতে পারতে ত! তুমি ঠিক করলে কী করে?
“বুদ্ধ নয় বলেই ঠিক করতে পারলাম। জবাব দিয়ে লালাজি, বেশ সােজাভাবেই রহস্যটা পরিষ্কার করে দিল। লালাজি এই অঞ্চলের পয়লা নম্বর কারবারি। এখানকার নীর হাড়হ তার জ না। তাই এ-পথে পুব থেকে পশ্চিমে যেতে ছোট বড় সব নোকক স্রোতের প্যাচে এই জায়গাটিতে নদীর দক্ষিণ পাড় ঘেঁষে যেতে হব জেনেই লালাজি এইখানে দাড়িয়ে ছিল আনার অপেক্ষায়।
লালাজির এই ব্যাখ্যার পরও একটা-দুটো প্রশ্ন মনে জেগেছিল । কিন্তু তা আর না তুলে বললাম, “যাক, দেখা যখন হয়ে গেছে, তখন বজরায় ওঠো এসে। যেখানে যেতে চাও যেতে যেতে তোমার সব ব্যাপার শুনি।
“কিন্তু বজরায় উঠতে রাজী হল না লালাজি। বললে, 'না, আমি বজরায় উঠব না। তুমি বজরা এখানে মাঝিদের জিন্নায় বেঁধে রেখে আমার সঙ্গে এসাে।
“তোমার সঙ্গে যাব!“ এবার সত্যিই একটু অস্বস্তির সঙ্গে বললাম এখানে এই আঘাটায় নেমে কোথায় যাব তোমার সঙ্গে আর যাই বা কেন?
যেতে যেতে সব বলছি। এসাে। বলে লালাজি অন্ধকারেই আঘটায় পাড় বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল।
‘লালাজির আবদারটা অত্যন্ত বেয়াড়া হলেও অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। লাল। রাজারাম এদিকের এই সমস্ত তল্ল। .উর মস্ত বড় নামী লোক। শুধু অগাধ ধনী শেঠই নয়, মস্ত বড় দাতা। সারা দেশময় সব বড়-বড় শহর আর তীর্থস্থানে কত ধরমশালা যে সে বসিয়েছে তার ঠিক নেই। বাংদেশে ভাগীরথির ধারের সব তীর্থস্থানে এমনি কিছু ধরমশালা বসার ব্যবস্থা করবার সময় তার সঙ্গে আমার আলাপটা দোস্তিতে দাঁড়িয়ে যায়। এরকম একটা সাচ্চা মানুষ আমি খুব কম দেখেছি লাল মাং দেখাশোনা না হলেও চিঠিপত্রে সে দোস্তিটা খানি ফিকে হয়ে যেত দিইনি। যত বেয়াড়া আজগুবি মনে হোক, এ-রাত্রে তার ফরমাশ শুনে তার সঙ্গে তাই না-গিয়ে পারলাম না।
“সঙ্গে যে যেতে তার কাছে যা শুনলাম তা খুৰ হঃখের হলেও একেবারে মন বি ও কিছু নয়। এ অঞ্চলে এখন দারুণ গণ্ডগোল। কুনওয়ারা সিং মারার কাছে জগদীশপুর, কোম্পানির গোরা পল্টনের কাছে হেরে গে স্ত। তার সঙ্গে যোগ ছিল বলে কোম্পনির ফৌজ রাজারামের জানিয়ার কুঠির ওপর চড়াও হয়ে সব লুটপাট করে নিয়ে গেছে। সেখানে আর তার থাকার উপায় নেই বলেই লাল| রাজারাম আমার জন্য এনে এসে দাড়িয়ে আছে। ‘কিন্তু কাঁদকার ছিল অত বড় বিপদের পর তোমার এত কষ্ট করে আমার জন্য এখানে এসে দাড়াবার? আমি সত্যি অঞ্চ হয়ে বললাম, আমার তো কোনাে সত্যিকার দরকার নেই। এই পথে যাচ্ছিলাম বলে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম।'
“বাঃ! লালাজি আমার কথায় যেন দুঃখ পেয়ে বললে, ‘আমি কথা দিয়েছিলাম না যে, তোমার সঙ্গে দেখা করব? আমার কথার কোনাে দাম দেই ?
“লালাজির নরম জায়গাটায় ঘা লাগাবার ভয়ে কথাটা ওইখানেই চাপা দিয়ে এত রুণের সত্যিকার যা নিয়ে উৎকণ্ঠা সেই প্রশ্নটাই করলাম । ‘কিন্তু আমরা যদি কোথায়?
“শুধু মা বা দিয়ে উঠে নয়, অন্ধকারে অভূ-পদাড় বন-জঙ্গল আর ছড়ানাে ইট-পাথরের পোড়া জমির ভেতর দিয়ে হেঁচট খেতে খেতে যেভাবে এ কণ এসেছি, তাতে এই প্রশ্নটাই আগে করার কথা। রাজারামের কথায় বাধা দিতে চাইনি বলেই এতক্ষণ চুপ করে ছিলাম।
প্রশ্নটা শুনে লালাজি মনে হল যেন একটু ঠাট্টার সুরে আমার কথাটাই আবার আউড়ে বললে, ‘কোথায় যাচ্ছি ? এখুনি দেখতে পাবে।
“তা সত্যিই পেলাম। অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ যেন সামনে একটা কালাে পাহাড় খাড়া হয়ে উঠেছে মনে হল!
“পাহাড় নয়, বিরাট একটা সাবেকি মঞ্জিল। এখন অবশ্য প্রায় ধ্বংসস্তুপ হতে চলেছে।
“তারই ভেতর এ-ঘর ও-ঘর, এ-গলি ও-গলি দিয়ে এ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে লালাজি।
“লালাজি অবশ্য যেতে যেতেই সে কথা আমায় জানিয়েছে। কোম্পানির সে এখন বিষনজরে পড়েছে। কুনওয়ার সিংয়ের হারের পর কোম্পানির ফৌজ আর চরেরা সিংজির সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংস্রব যাদের ছিল, নির্মম হয়ে তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। লাল রাজারাম তাদের কাছে। পয়লা নম্বর দুশমন। লালজিকে তাই এখন পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কোম্পানির হাতে ধরা পড়লেও সোনাদানা হীরা-জহরত নিয়ে তার বিপুল সম্পত্তি যাতে তাদের হাতে না পড়ে তাই লালাজি অনেক খুজে খুজে এই পুরনাে মঞ্জিলের ধ্বংসস্তুপটা বার করে তার একটা গােপন কামরায় সেগুলাে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে। নিজের ভাগ্যদোষে ধরা পড়লে বা মারা গেলেও এই বিপুল ঐশ্বর্য যাতে বেপাত্তা না হয়ে গিয়ে তার বিশ্বাসী ভাল একজনের কাজ লাগে তাই সে আমাকে সে গুপ্ত কামরাটা দেখিয়ে রাখবার জন্যে এনেছে।
“তা এনেছে, ভালই করেছে। কিন্তু সে কামরা আমায় দেখাবে কখন ? ঘরের পর ঘর, গলির পর গলি, সিড়ি দিয়ে ওঠা আর নামা, এই করতে করতে সব জায়গাটা আমার কাছে গোলকধাঁধার চেয়েও জটিল মনে হচ্ছে যে! রাজারাম নিজে সে কামরা আবার চিনতে পারবে তো?
“সে-প্রশ্নের জবাব যা পেলাম তা কল্পনাতীত। একটা বেশ লম্বা আবছা অন্ধকার ঘুলঘুলি দিয়ে আমায় নিয়ে যেতে লালাজি হঠাৎ অামার দিকে ফিরে দাড়িয়ে কীরকম বিশ্রী অদ্ভুতভাবে হেসে বললে, “এইখানটায়! এইখানটায় আমি নিজেই তারপর হারিয়ে গেছি!'
“এই কথা কটা উচ্চারণের পরই সামনে থেকে সে এক নিমেষে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
* লালাজি! লালাজি ! আমি চিৎকার করে উঠলাম।
“তার জবাবে প্রথমে একটা বিকট হাসি সমস্ত বাড়িটার ভেতর দিয়ে যেন বেড়াে হওয়ার মতো বয়ে গেল। তারপরই লালাজির বিদ্রুপে বাঁকা গলা, ‘খোজো খোজা বাবুজি। সোনা চাঁদি, হীরা। জহরতের বহুত লালচ তোমার দিলের মধ্যে কেমন ? খোঁজা, খোঁজে। তাহলে জান দিয়ে। আর কিছু না পারে, সেই লুকনো কামরায় হীরা। জহরতের ওপর তােমার হাডিড গুলাে হয়ত সাজানো থাকতে পারবে।'
লালাজি! লালাজি। আমি প্রায় ককিয়ে চিৎকার করে বললাম, “এসব তুমি কী বলছ ? তুমি এপারের বদলে ওপারেই যদি গিয়ে থাকে তাহলেও আমার সঙ্গে বেইমানি কি তােমার সাজে ? তােমার লুকনাে দৌলতখানা আমি দেখতে চাই না, তুমি শুধু আমায় এ-গােলকধাঁধা থেকে বার হবার হদিশ বাতলে দাও। বাতলে দাও লালজি।
“উত্তরে আবার সেই নিষ্ঠুর হাসি।
“পাগলের মত এ-ঘর থেকে ও-ঘর, এগলি থেকে অন্য গলি তারপর ছুটে বেড়াতে লাগলাম। দোলে চৌকাঠে ঠোকা লেগে, হাতপা-মাথা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল তবু বার হবার রাস্তা পেলাম না।
“সত্যিই শেষ পর্যন্ত তা পাব না নাকি ? এই অজানা ধ্বংসস্তুপের মধ্যে আমার কঙ্কাল চিরকালের মতো লুপ্ত হয়ে থাকবে নাকি?
“অস্থির উৎকণ্ঠায় আর-একবার ঢুটে বার হবার চেষ্টা করতেই অলােটা দেখতে পেলাম।
“অলো! তার মানে তো নিশ্চয় মুক্তির উপায় !
“সেই আলোর রেখার দিকে পড়ি কি মরি করে ছুটলাম। অলো পাছে আলেয়া হয়ে যায়, এই ভয়।
“তা হল না। একটা বাঁক ঘুরতেই আলোটা দেখতে পেলাম। বেশ লম্বা-চওড়া একটা ঘর। ঘরের মধ্যে এক কোণের দিকে দড়িতে বোনা দুটি ছোট চৌকি ! তার একটিতে বসে এক প্রৌঢ় সরু লম্বা একটা খাতার পাতা ওল্টাচ্ছেন। তার দড়িতে বোনা চৌকির পাশেই বেশ উচু মাটির পিলসুজের ওপর একটা প্রায় গোলাকার প্রদীপের মোটা কটা সলতে রেড়ির তেলের জোরেই বোধহয় জ্বলছে।
“ঘরটার ভেতর ঢুকে সেখানকার সরঞ্জান আর অচেনা প্রৌঢ়টিকে দেখে একটু থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম।
“প্ৰৌঢ় কিন্তু বিন্দুমাত্র না চমকে, চশমাটা নাকের ওপর থেকে নামাবার সঙ্গে হাতের লম্বা খাতাটা মুড়ে আমাকেই রীতিমতাে অবাক করে দিয়ে বললেন, “আসুন, আসুন, বাবুজি। আপনার জন্যেই অপেক্ষা করে। আছি। আমার নাম হল মুনশি মুলুকচাদ।”
“আপনার নাম মুনশি মুলুকটাদ! আর আপনি এই গোলকধাঁধামঞ্জিলে অামার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন !
“কথাগুলো আমার গলা দিয়ে বার হয়নি। আমার চোখমুখের চেহারাতেই প্রকাশ পেল।
“মুনশি মুলুকদ তা ঠিকমতো বুঝে পাশের অন্য দড়ির চৌকিটা। আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘বসুন বাবুজি, ঠাণ্ডা হয়ে বসুন। আজ আপনার বহুত পরেশানি হয়েছে বুটমুট।”
“বুটমুট ! এবার রাগের জ্বালায় আমার গলায় আবার কথা ফুটল, “ধু বুটমূট বললে কিছুই বলা হয় না মুনশি মুলুকাদজি। কাউকে নিয়ে এরকন তামাশা শয়তানি ছাড়া আর কিছু নয়, আর সে শয়তানি যে করেছে তার ঠিকানা এখন এপারের না ওপারের ?
“আমার এই কথা শুনে মুনশিজি বলেছিলেন, যাদের পেছনে ছুটে দুটে অর্ধেক চুল ঝরিয়ে ফেললেন, এতদিনেও তাদের চিনলেন না ? ”
মুনশিজি অর মেজকর্তার মধ্যে তারপর যা কথা হয়েছিল, এই বিবরণের শুরুতেই তা কিছুদূর পর্যন্ত দেওয়া আছে। মেজকর্তার নিজের জবানি গোড়া থেকে ধরবার জন্যে যেখানে তা কাটা হয়েছিল, সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত ঐকর্তার নিজের কথাতেই আবার বে'না যেতে পারে। মেজকর্তা কথায় কথায় লাল রাজারামের নামটা করায় ‘লাল রাজারামের’ বলে হেসেছিলেন মুলুকচাঁদ!
মেজকর্তা তঁার খেরো খাতায় তারপর লিখেছেন, “মুনশিজির হাসির ধরনের একটু গরম হয়েই বললাম, হাসছেন কী? লালা রাজারাম কে তা আপনি জানেন ?
“ত। একটু জানি বইকি!' একটু যেন চাপা বিদ্রুপের সঙ্গে বললেন মুনশিজি ।
“তাতেই আরও জ্বলে উঠে বললাম, “জানেন, লালা রাজারামের কথার কী দাম! লােকে স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের চেয়ে তার কথায় বেশি বিশ্বাস করে।
করে নয়, করত।' বললেন মুনশি মুলুকদ একটু মুচকি হেসে, ‘কিন্তু আগেই তো আপনাকে বলেছি যে, এপারের সঙ্গে ওপারের কোনো মিল নেই। এপারে যে যেল আনা সাচ্চা ওপারে হামেশা সে আঠারো আনা ঝুটা হয়ে স্রেফ মজা করবার জন্যও।
“তা বলে লালা রাজারানও তাই হবে ! অবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, এই দুদিন আগে দেশের জন্যে যিনি জান দিয়েছেন তার এমন প্রবৃত্তি।
“যদি বলি এই জান দেওয়াটাও ঝুট। বাহাদুরি! আগের মতােই মুখ টিপে হেসে বললেন মুনশি মুলুকদ। লালাজি ধুনওয়ার সিংকে ছেড়ে কোম্পানিরই শরণ নিয়েছিলেন। তার জান নিয়েছে কোম্পানির ফৌজ নয়, তার আগেই দলেরই লোক, বিশ্বাসঘাতকতার জন্য।
“কখখনো না। হতে পারে না। আমি প্রায় মারমুখো হয়ে বললাম, ‘কী জানেন আপনি লাল রাজারামের বিষয়ে, কে আপনি?
‘আনি লালা রাজারামেরই মুনশি। তাই সব জানি। গম্ভীর হয়ে বললেন মুনশিজি।
“মাথাটা প্রথমে গুলিয়ে গেলেও এতক্ষণে নিজেকে অনেকখানি সামলে নিয়েছি। তবু মুনশিজির মুখের দিকে না চেয়ে নিচের নেঝেতে প্রদীপের আলোর ছায়াগুলোর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললাম ‘আপনি লাল রাজারামের মুনশি ছিলেন, তাই সব জানেন। কেমন মুনশিজি? আপনি লালাজিকে নিজের দলের সঙ্গে বেইমানি করবার জন্যে তাদের হাতে মরতে দেখেছেন, তারপর ওপারে গেলে সাচ্চারাও সব ঝুটা হয়ে যায় জেনে এখানে আমার মতাে নিরীহ মানুষ যাতে লালজির হাতে নাকাল না হয় তাই দেখবার জন্যে এখানে পাহারাদার হয়ে বসে আছেন, এই তাে আসল ব্যাপার ! না মুনশিজি ?
“মুনশিজি এবার খুশি হয়ে কী বলতে যাচ্ছিলেন। তাকে বাধা দিয়ে বলে গেলাম, আপনাকে কিছু আর বলতে হবে না মুনশিজি। আপনি যা করছেন তা অতি মহৎ কাজ। কিন্তু এপারের কারুর পক্ষে ওপারের কারুর ওপর পাহারাদারি করায় বেশ একটা ঝামেলা নেই কি?”
* ‘তা আছে।'- মুনশিজি স্বীকার না করে পারলেন না, তবে, নানে•••
“মুনশিজিকে আবার থামিয়ে দিয়ে বলল, “তবে আপনার নিঃস্বার্থ গরজটা বড় বেশি। লালা রাজারামের লুকনাে দৌলতখানা যাতে যারতার হাতে না পড়ে, তার জন্য সব কিছু সহ্য করতে আপনি প্রস্তুত।
* ঠিক ধরেছেন! উৎফুল্ল হয়ে বললেন মুনশিজি।
“কিন্তু তার সঙ্গে আরও যা-যা ধরেছি, সেটাও তাহলে শুনুন।”
এবারে সােজা মুনশিজির মুখের ওপর চোখ রেখে বললাম, আপনি নিজে আর এপারের কেউ নন। আমি ঠিকই বুঝতে পারছি, আপনি শুধু লাল রাজারামের মুনশি ছিলেন না, কোম্পানির চরও ছিলেন সেই সঙ্গে! আপনার কাছে গােপন খবর পেয়ে কোম্পানি রাজারামজিকে কুনওয়ার সিংয়ের দলের বলে জেনে তার আস্তানায় চড়াও হয়ে তাকে হত্যা করে। কিন্তু তার আগে নিজের ধনদৌলত লুকোবার ব্যবস্থা করে আপনার বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দিতে লালাজি ভােলেননি। ওপারে যাবার পর আপনার সবচেয়ে বড় দুঃখ এই যে, ওপারে গেলেই সবজান্তা। হওয়া যায় না। তাই রাজারামজির লুকনো দৌলতখানার হদিশ আপনি পাচ্ছেন না। তা পাবার জন্যেই এখানে এসে এমন পাহারা দিয়ে বসে আছেন। কিন্তু আপনি ডালে-ডালে বলেই রাজারামজিকে পাতায়পাতায় যেতে হয়েছে। এতক্ষণে বুঝেছি, আপনাকে হদিশ না দেবার জন্যে আমার মতাে দোস্তের সঙ্গেও বাধ্য হয়ে তাঁকে এমন বি শ্ৰী চালাকি করতে হয়েছে। তবে যা তিনি করেছেন, তা একেবারে ঝুটমুট নয়। এই বেয়াড়া রসিকতার ভেতর দিয়েই আমায় আসল ব্যাপারটা বুঝিয়ে তিনি আমাকে দিয়ে তার লুকনাে দৌলত উপযুক্ত হাতে পৌছে দেবার ব্যবস্থা করতে চেয়েছেন। আমি সেই চেষ্টাই এবার করব। দেশের জন্যে যিনি প্রাণ দিয়েছেন, তাঁর দৌলত দেশের কাজেই যাবে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ওপারের মিথ্যে ছায়াবাজি দিয়ে লালা রাজারামের লুকনো দৌলতখানা আপনার বংশের কারুর হাতে তুলে দেওয়ার আশা আপনার আর নেই।
‘মুনশি মুলুকচাদের ফ্যাকাশে মুখটা তখন প্রায় ঝাপসা হয়ে এসেছে! সেদিকে চেয়ে বললাম, আপনি যে এপারের নন, সেটা প্রথম কী করে। বুঝলাম, তাই ভাবছেন নিশ্চয়। একটা কথা তাহলে আপনাকে বলে যাই। ওপারের হয়ে এপারের সাজতে হলে কায়ার চেয়ে ছায়াটার দিকেই বেশি নজর রাখতে হয়। আপনি এমনিতে 'আজকের আসরট। ভালই সাজিয়েছিলেন। কিন্তু ধরিয়ে দিয়েছে আপনার ছায়াটা। প্রদীপের আলোয় আপনার ছায়াটা ঠিকমতো পড়তে না দেখেই আসল
কিটা ধরে ফেলে আর সব ব্যাপার আমি বুঝে নিয়েছি। ঠিক যে বুঝেছি, তা তাে আপনার ফ্যাকাশে হয়ে মিলিয়ে যাওয়া থেকেই বুঝতে পারছি। আচ্ছা নমস্কারটা তাহলে নিয়ে যান।
মেজকর্তার লেখা এখানেই শেষ। যা তিনি লিখে গেছেন, তা সত্য মিথ্যা যাই হােক, তার নিজের হদিশ’ এবারে একটু দিয়ে ফেলেননি কি ?
কনওয়ার সিংয়ের তিনি নাম করেছেন। কুনওয়ার সিং তাে সিপাহী বিদ্রোহের সময় বিহারের অরা জেলার কাছে তাঁর জগদীশপুরের রাজ্য থেকে কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন।
মেজকর্তা কি তাহলে সেই সিপাহী বিদ্রোহের সময়কার মানুষ? তার খেলােতা.আর-একটু ভাল করে ঘেটে দেখতে হবে।
গল্পটি শেয়ার করে অন্যদের পড়ার সুযোগ করে দাও।
0 মন্তব্যসমূহ