Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

অভিশপ্ত ।। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার জীবনে সেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার সেবার ঘটেছিল। বছর তিনেক আগেকার কথা। আমাকে বরিশালের ওধারে যেতে হয়েছিল একটা কাজে। ওই এলাকার একটা গঞ্জ থেকে বেলা প্রায় বারোটার সময় নৌকোয় উঠলাম। আমার সঙ্গে এক নৌকোয় বরিশালের এক ভদ্রলোক ছিলেন। গল্পে গুজবে সময় কাটতে লাগল। সময়টা পূজোর পরে, দিনটা মেঘলা মেঘলা। মাছে মাঝে টিপটিপ করে বৃষ্টিও পড়তে শুরু করল। সন্ধ্যের কিছু আগে কিন্তু আকাশটা অল্প পরিষ্কার হয়ে গেল। ভাঙা ভাঙা মেঘের মধ্য দিয়ে চতুর্দশীর চাঁদের আলো অল্প অল্প প্রকাশ পেল। সন্ধে হবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বড় নদী ছেড়ে একটা খালে পড়লাম। শোনা গেল খালটা এখান থেকে আরম্ভ হয়ে নোয়াখালীর উত্তর দিক দিয়ে একেবারে মেঘনায় গিয়ে মিশেছে। পূর্ববঙ্গে সেই আমার নতুন যাওয়া, চোখে সব কেমন আমার নতুন ঠেকতে লাগল। অপরিসর খালের ধারে বৃষ্টিস্নাত কেয়ার জঙ্গলে মেঘে আধা ঢাকা চতুর্দশীর জ্যোৎস্না চিকচিক করছিল। মাঝেমাঝে নদীর ধারে বড় বড় মাঠ। শুঁটি, বেত, ফার্ন গাছের বন জায়গায় জায়গায় খালের জলের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। বাইরে একটু ঠাণ্ডা থাকলেও আমি ছইয়ের বাইরে বসে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। বরিশালের সেই অংশটা সুন্দরবনের কাছাকাছি। ছোট ছোট খাল, নদী চারদিকে। সমুদ্র খুব দূরে নয়, দশ পনেরো মাইল দক্ষিণ পশ্চিমেই হাতিয়া ও স্বন্দীপ।

আরও একটু রাত হল। খালের দুপাড়ে নির্জন জঙ্গল অস্ফুট জ্যোৎস্নায় কেমন যেন অদ্ভুত দেখাতে লাগল। এই অঞ্চলে লোকের বসতি একেবারেই নেই। শুধু ঘন বন আর জঙ্গলের ধারে বড় বড় হোগলা গাছ। আমার সঙ্গী বললেন, " এত রাতে আর বাইরে থাকবেন না, আসুন ছইয়ের মধ্যে। এইসব জঙ্গলে..." কি একটা বলতে গিয়েও থেমে গিয়ে শুধু বললেন, "বুঝলেন না?"

তারপর তিনি সুন্দরবনের নানা গল্প করতে লাগলেন। তাঁর এক কাকা নাকি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন। তাঁরই লঞ্চে করে তিনি একবার সুন্দরবনের নানা অংশে বেড়িয়েছিলেন, সেইসব গল্প করতে লাগলেন।

দেখতে দেখতে রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি হল। মাঝি আমাদের নৌকোয় ছিল মোটে একটি। সে বলে উঠল, " বাবু! একটু এগিয়ে বড় নদী পড়বে, এত রাতে আর একা সে নদীতে পাড়ি জমাতে পারব না। এই... এইখানেই নৌকা রাখি?"

আমরা ওর কথায় সায় দিলাম।

নৌকো সেখানেই বাঁধা হল। এদিকে বড় বড় গাছের আড়ালে চাঁদ অস্ত গেল। দেখলাম অপ্রশস্ত খালের দু'ধারে অন্ধকারে ঢাকা ঘন জঙ্গল। চারিদিকে কোনও শব্দ নেই। পতঙ্গগুলো পর্যন্ত চুপ করেছে। সঙ্গী ভদ্রলোকটিকে বললাম, " মশাই, এই তো সরু খাল! আরে... পাড় থেকে বাঘ লাফিয়ে পড়বে না তো নৌকোর ওপর? "

সঙ্গী একটু হেসে বললেন, " না পড়লেই আশ্চর্য হব।"

শুনে অত্যন্ত ' আনন্দে' ছইয়ের মধ্যে ঘেঁষে বসলাম। খানিকক্ষণ বসে থাকবার পর সঙ্গী বললেন, " আসুন, একটু শোয়া যাক। ঘুম তো হবে না। আর ঘুমোন ঠিক'ও না", বলতে বলতে হাই তুলতে লাগলেন, " আসুন, চোখটা অন্তত বুজে থাকি।"

খানিকক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকবার পর সঙ্গীকে ডাকতে গিয়ে দেখি, তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। মাঝিও ওদিকে জেগে আছে বলে মনে হল না। ভাবলাম তবে আমি-ই বা কেন মিথ্যে মিথ্যে চোখ চেয়ে চেয়ে থাকি?

একটা লম্বা হাই উঠল আমার।

তারপর যা ঘটল... সেটি আমার জীবনের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।

ভাল করে শুতে যাচ্ছি, হঠাৎ আমার কানে এল, অন্ধকার ঘন ঝোপের ওপাশে অনেক দূরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে কে যেন কোথায় গ্রামোফোন বাজাচ্ছে। তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। গ্রামোফোন! এই বনে এত রাতে গ্রামোফোন বাজাবে কে!

কান পেতে শুনলাম। না গ্রামোফোন নয়, অন্ধকার হিঁজল হিমতাল গাছগুলো যেখানে খুব ঘন হয়ে আছে, সেখান থেকে কারা যেন উচ্চস্বরে আর্ত করুণ স্বরে কি যেন বলছে। শুনে মনে হল, সেটা একাধিক লোকের সমবেত কণ্ঠস্বর। প্রতিবেশীর তেতলার ছাদে গ্রামোফোন বাজলে যেমন নীচ থেকে খানিকটা স্পষ্ট, খানিকটা অস্পষ্ট, অথচ একটানা সুরের ঢেউ এসে কানে বাজে, এ'ও অনেকটা সেইরকম। মনে হল কতগুলো অস্পষ্ট বাংলা ভাষার শব্দ'ও কানে এল। কিন্তু ধরতে পারা গেল না, কথাগুলো কি। শব্দটা মাত্র মিনিটখানেক স্থায়ী হল। তারপর অন্ধকার বনভূমি যেমন নিস্তব্ধ ছিল, তেমনিই আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

তাড়াতাড়ি ছইয়ের বাইরে এলাম। চারিপাশের অন্ধকার আলকাতরার মতো কালো। বনভূমি নীরব, শুধু নৌকোর তলায় খালের জল ভাটার টানে কলকল করে বাজছে। আর শেষ রাতের বাতাসে খালের জলে কেয়াঝোপে এক ধরনের অস্পষ্ট শব্দ হচ্ছে। পাড় থেকে দূরে হিঁজল গাছের কালো গুঁড়িগুলো অন্ধকারে অদ্ভুত চেহারা নিয়েছে। ভাবলাম, সঙ্গীদের ডেকে তুলি। আবার ভাবলাম, বেচারীরা ঘুমোচ্ছে, ডেকে কি হবে। তারচেয়ে বরং নিজে জেগে বসে থাকি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। তারপর আবার ছইয়ের ভেতর ঢুকতে যাব, এমন সময় অন্ধকারে ঢাকা সেই বিশাল বনভূমির কোন অংশ থেকে সুস্পষ্ট আর্ত করুণ কন্ঠের মতো তীক্ষ্ণ স্বর তীরের মতো জমাট অন্ধকারের বুক চিরে আকাশে উঠল:

" ওগো নৌকোযাত্রীরা, তোমরা কারা যাচ্ছ? আমরা শ্বাস বন্ধ হয়ে মরলাম... আমাদের ওঠাও... আ...আ... আমাদের বাঁচাও...ও...ও...ও...

ও...ও!"

নৌকোর মাঝি ধড়মড় করে জেগে উঠল। আমি সঙ্গী ভদ্রলোকটিকে জাগাতে লাগলাম, " ও...ও...ম...মশাই! শুনছেন? উঠুন... উঠুন। "

মাঝি আমার কাছে ঘেঁষে এল। ভয়ে তার গলার স্বর কাঁপছিল, " ইয়া আল্লাহ!..... আল্লাহ! শু...শু...শুনতে পেয়েছেন বাবু? শু...শুনতে পেয়েছেন আপনি?"

সঙ্গী ভদ্রলোক জেগে উঠে বললেন "কি মশাই? ডাকলেন কেন? কোনও জানোয়ার টানোয়ার নাকি?"

আমি ব্যাপারটা বললাম। তিনজন তাড়াতাড়ি ছইয়ের বাইরে এলাম। তিনজন অন্ধকার বনভূমির দিকে চেয়ে কান খাড়া করে রইলাম। তখন সব আগের মত চুপ। ভাটার জল নৌকোর তলায় বেধে আগের চেয়েও জোরে শব্দ হচ্ছিল।

সঙ্গী ভদ্রলোক মাঝিকে জিজ্ঞেস করলেন, " এটা কি তবে..."

মাঝি বলল, " হ্যাঁ বাবু। বাঁ-য়ে কীর্তিপাশার গড়।"

সঙ্গী ভদ্রলোক রেগে উঠে বললেন, " তবে তুই এত রাত্রে এখানে নৌকো বাঁধলি কেন? বেকুব কোথাকার! "

মাঝি বলল, " নৌকোয় তিনজন আছি বলেই রেখেছিলাম বাবু। ভাটার টানে নৌকো পিছিয়ে দেবার তো জো ছিল না।"

কথাবার্তার ধরন শুনে মাঝিকে বললাম, " কি... কি ব্যাপার মশাই? কিছু জানেন নাকি আপনারা এ ব্যাপারে?"

ভয়ে যত না হোক, বিস্ময়ে আমরা কিরকম হয়ে গিয়েছিলাম।

সঙ্গী ভদ্রলোক মাঝিকে বললেন, " ওরে তোর সেই কেরোসিনের ডিবেটা জ্বাল। আরে আলো জ্বেলে বসে থাকতে হবে এখন। রাত তো এখনো ঢের।"

মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, " তুই শব্দটা শুনতে পেয়েছিলি? "

সে বলল, " হ্যাঁ বাবু। ওই আওয়াজ কানে গিয়েই তো আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি এর আগে আরও দুই বার নৌকো বেয়ে যেতে যেতে ও ডাক শুনেছি।"

সঙ্গী ভদ্রলোক বললেন, " এটা এ অঞ্চলের একটা অদ্ভুত ঘটনা। তবে এই জায়গাটা সুন্দরবনের সীমানায় বলে আর এ অঞ্চলে কোনও লোকালয় নেই বলে শুধু নৌকোর মাঝিদের কাছেই এটা সুপরিচিত। এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে। সেটা অবশ্য নৌকোর মাঝিদের কাছে অজানা। সেটাই আপনাকে বলি শুনুন।"

তারপর কেরোসিনের ডিবার আলোয় অন্ধকার বনের বুকের মধ্যে বসে সঙ্গীর মুখে কীর্তিপাশার গড়ের ইতিহাসটা শুনতে লাগলাম...

" আজ থেকে তিনশো বছর আগের কথা। মুনিম খাঁ তখন গৌড়ের সুবেদার। এ অঞ্চলে তখন বারো ভুঁইয়ার দুই প্রতাপশালী ভুঁইয়া রাজা রামচন্দ্র রায় ও ঈশা খাঁ আলীর তখন খুব প্রতাপ। মেঘনার মোহনার বাহির সমুদ্র, যাকে এখন স্বন্দীপ চ্যানেল বলে, সেখানে তখন মগ আর পর্তুগীজ জলদস্যুরা শিকারের খোঁজে ওঁত পেতে বসে থাকত। সেসময় এখানে এরকম জঙ্গল ছিল না। এ সমস্ত জায়গা কীর্তি রায়ের অধিকারে ছিল। এই জায়গাটায় তাঁর সুদৃঢ় দূর্গ ছিল। মগ জলদস্যুদের সঙ্গে তিনি অনেকবার লড়েও ছিলেন। তাঁর অধীনে কামান, সৈন্য সামন্ত, যুদ্ধের কোষা-সবই ছিল। স্বন্দীপ তখন ছিল পর্তুগীজ জলদস্যুদের প্রধান আড্ডা। এদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এই অঞ্চলের সকল জমিদারকেই সবসময় সৈন্যদল তৈরি রাখতে হত।এই বনভূমির পশ্চিম ধার দিয়ে তখন আরেকটা খাল বড় নদীতে গিয়ে পড়ত। বনের মধ্যে তার চিহ্ন এখনো আছে। কীর্তি রায় অত্যন্ত অত্যাচারী এবং দূর্ধর্ষ জমিদার ছিলেন। তাঁর রাজ্যে এমন সুন্দর মেয়ে খুব কমই ছিল, যে তাঁর জমিদারবাড়ির অন্তপুরে একবার না ঢুকেছে। তাছাড়া তিনি নিজেও একপ্রকার জলদস্যুই ছিলেন। তাঁর নিজের অনেকগুলো বড় ' ছিপ' বা ছোট নৌকো ছিল। কীর্তি রায়ের পাশের জমিদারী ছিল কীর্তি রায়ের বন্ধুর। এঁরা ছিলেন চন্দ্রদীপের রাজা রামচন্দ্র রায়ের পত্তনীদার। অবশ্য সেসময় অনেক পত্তনীদারের ক্ষমতা এখনকার স্বাধীন রাজাদের তুলনায় অনেক বেশীই ছিল। কীর্তি রায়ের বন্ধু মারা গেলে তার তরুণ বয়স্ক পুত্র নরনারায়ণ রায় পিতার জমিদারীর ভাগ পান। নরনারায়ণ তখন সবে যৌবনে পদার্পণ করেছেন। অত্যন্ত সুপুরুষ, বীর এবং শক্তিমান। নরনারায়ণ রায় ছিলেন, কীর্তি রায়ের পুত্র চঞ্চল রায়ের সমবয়সী ও বন্ধু। সেবার কীর্তি রায়ের আমন্ত্রণে নরনারায়ণ রায় তাঁর রাজ্যে দিনকতকের জন্য বেড়াতে এলেন। চঞ্চল রায়ের তরুণী পত্নী লক্ষ্মীদেবী স্বামীর বন্ধু নরনারায়ণ রায়কে দেওরের মতো স্নেহের চোখে দেখতে লাগলেন। দু একদিনের মধ্যেই কিন্তু সেই স্নেহের চোটে নরনারায়ণ রায়কে বিব্রত হয়ে উঠতে হল। নরনারায়ণ রায় তরুণ বয়স্ক হলেও একটু গম্ভীর প্রকৃতির। বিদ্যুৎ -চঞ্চলা তরুণী বন্ধু পত্নীর ঠাট্টাতামাসায় গম্ভীর প্রকৃতির নরনারায়ণ রায়ের নিজের মান বাঁচিয়ে চলাই দুষ্কর হয়ে পড়ল। স্নান করে উঠেছেন, মাথার পাগড়ী খুঁজে পান না...নানা জায়গা খুঁজে যখন হতাশ হয়ে পড়েছেন, তখন নিজের বিছানায় বালিশ তুলতে গিয়ে দেখতে পান, বালিশের তলাতেই পাগড়ী চাপা আছে। যদিও এর আগে তিনি বালিশের নীচেই খুঁজেছেন। তাঁর প্রিয় তলোয়ারটা দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে পাঁচবার হারিয়ে গেল, আবার পাঁচবারই তিনি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে খুঁজে পেলেন। পানে এমন সব জিনিসের সমাবেশ হতে লাগল যা কোনওকালেই পানের উপকরণ নয়। বন্ধুপত্নীর সঙ্গে কিছুতেই এঁটে উঠতে না পেরে নরনারায়ণ স্থির করলেন, তাঁর বন্ধুর স্ত্রী 'টি কিঞ্চিৎ ছিটগ্রস্ত।

বন্ধুর দূর্দশায় চঞ্চল রায় মনে মনে খুশী হলেও প্রকাশ্যে স্ত্রী 'কে বললেন, দু'দিনের জন্য এসেছে বেচারা, ওকে তুমি যেমন বিব্রত করে তুলেছ, ও আর কখনো এখানে আসবে না।

দিনকয়েক এরকম কাটবার পর একদিন কীর্তি রায়ের আদেশে হঠাৎ চঞ্চল রায়কে কি একটা কাজে গৌড়ে যাত্রা করতে হল। নরনারায়ণ রায়'ও বন্ধুর স্ত্রী কখন কি করে বসেন-সেই ভয়ে নিজের বজরায় উঠে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। যাবার সময় লক্ষ্মীদেবী ঠাট্টার হাসি হেসে বললেন, এবার যখন আবার আসবে ভাই, তখন এরকম একটা লোককে সঙ্গে এনো, যে রাতদিন তোমার জিনিসপত্র ঘরে বসে পাহারা দেবে, বুঝলে?

নরনারায়ণের বজরা রায়মঙ্গলের মোহনা ছাড়িয়ে যাবার একটু পরেই জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হল। তখন দুপুরবেলা, সমুদ্রের সেই অংশে এমন কোনও নৌকো ছিল না, যারা সাহায্য করতে আসতে পারে। সেটা রায়মঙ্গল আর কালাবদর নদীর মুখ--সামনেই সমুদ্র, স্বন্দীপ চ্যানেল জলদস্যুদের প্রধান ঘাঁটি। নরনারায়ণের বজরার রক্ষীরা কেউ হত হল, কেউ বা মারাত্মক জখম হল। নরনারায়ণ নিজে জলদস্যুদের প্রতিহত করতে গিয়ে হাঁটুতে কিসের চোট খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

জ্ঞান হবার পর দেখতে পেলেন, তিনি এক অন্ধকার জায়গায় শুয়ে রয়েছেন। তাঁর সামনে কি যেন একটা বড় নক্ষত্রের মতো জ্বলছে। কিছুক্ষণ জোর করে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর বুঝলেন, যেটাকে তিনি ' বড় নক্ষত্র ' ভাবছিলেন, সেটা আসলে একটা ছোট জানলা দিয়ে আসা বাইরের আলো। নরনারায়ণ দেখলেন, তিনি একটি অন্ধকার ঘরের ভেজা মেঝের ওপর শুয়ে রয়েছেন। ঘরের দেওয়ালের জায়গায় জায়গায় সবুজ শ্যাওলার দল গজিয়েছে।

আরও ক'দিন, আরও কটা রাত কেটে গেল। কেউ তাঁর জন্য কোনও খাবার আনল না। তিনি বুঝলেন যাঁরা তাঁকে এখানে এনেছে, তাঁকে না খেতে দিয়ে মেরে ফেলাই তাদের উদ্দেশ্য। মৃত্যু... সামনে নির্মম মৃত্যু।

সেদিনটাও কেটে গেল। আঘাতজনিত ব্যথায় এবং ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর নরনারায়ণের চোখের সামনে থেকে জানলা দিয়ে আসা দিনের শেষ আলোটাও মিলিয়ে গেল। তিনি অন্ধকার ঘরের পাথরের মেঝেতে শুয়ে অধীরভাবে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পর, কতক্ষণ পরে তা তিনি বুঝতে পারলেন না, হঠাৎ চোখে আলো এসে পড়ায় তাঁর তন্দ্রাঘোর কেটে গেল। চোখ মেলে বিস্মিত নরনারায়ণ দেখলেন, তাঁর সামনে অন্ধকারে জ্বলন্ত প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে তাঁর বন্ধুর স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী। কথা বলতে গিয়ে বিস্মিত নরনারায়ণ লক্ষ্মীদেবীর ইঙ্গিতে থেমে গেলেন। লক্ষ্মীদেবী তাঁর হাতের প্রদীপটি আঁচল দিয়ে ঢেকে নরনারায়ণকে তাঁর অনুসরণ করতে ইঙ্গিত করলেন। একবার নরনারায়ণের সন্দেহ হল, এসব স্বপ্ন নয় তো!

কিন্তু ঐ যে দীপশিখার উজ্জ্বল আলোয় ভিজে দেওয়ালে সবুজ শ্যাওলার দল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!

নরনারায়ণ শক্তিমান যুবক। ক্ষুধায় কাতর থাকা স্বত্তেও তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর গ্রাস থেকে বাঁচবার উৎসাহে বন্ধু পত্নীর পেছন পেছন চলতে লাগলেন। একটা বাঁকা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে একটা দীর্ঘ সুড়ঙ্গ পার হবার পর তিনি দেখলেন যে তাঁরা কীর্তি রায়ের প্রাসাদের বাইরে খালধারে এসে পৌঁছেছেন। লক্ষ্মীদেবী একটা ছোট বেতে বোনা ঝুড়ি নরনারায়ণের হাতে দিয়ে বললেন, " এতে খাবার আছে। এখানে খেও না। তুমি সাঁতার জানো, খাল পার হয়ে ঐপাড়ে গিয়ে খেয়ে নিও। তারপর যত শীগগির সম্ভব পালিয়ে যেও।"

ব্যাপারটা কি, নরনারায়ণ রায় একটু একটু করে বুঝতে পারলেন। তাঁর জমিদারী কীর্তি রায়ের জমিদারীর পাশেই এবং তাঁর অবর্তমানে কীর্তি রায়ই ভবিষ্যৎ জমিদার। অত বড় বিশাল ভূসম্পত্তি, সৈন্যসামন্ত হাতে আসার সম্ভাবনা থাকলে কীর্তি রায় আর কি কিছু গ্রাহ্য করবেন! নরনারায়ণ -কে নিজের রাজ্যে আমন্ত্রন তাহলে কীর্তি রায়ের একটা বাহানা ছিল! আসল উদ্দেশ্য ছিল, তাঁকে ঐ অন্ধ কূপে আটকে রেখে হত্যা করা! তারমানে এই সমস্ত কিছুর মূলে আছে লক্ষ্মীদেবীর শ্বশুর কীর্তি রায়ের জঘন্য চক্রান্ত! কি সাঙ্ঘাতিক! নরনারায়ণ শিউরে উঠলেন।

প্রদীপের আলোয় তিনি দেখলেন, তাঁর বন্ধুপত্নীর মুখে সেই চটুল হাসির চিহ্নটুকুও নেই। তাঁর মুখখানি সহানুভূতিতে ভরা মাতৃমুখের মতো স্নেহকোমল হয়ে এসেছে।

তাঁদের চারপাশে গাঢ় অন্ধকার, মাথার ওপর আকাশের বুক চিরে দিগন্তবিস্তৃত উজ্জ্বল ছায়াপথ, কাছেই খালের জল ভাটার টানে তীব্র স্রোতে, তীরের হোগলা জঙ্গলগুলোকে দুলিয়ে কলকল শব্দে বড় নদীর দিকে ছুটেছে।

নরনারায়ণ আবেগপূর্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, " বউ-ঠাকরুন, চঞ্চলও কি এই চক্রান্তের মধ্যে আছে?"

লক্ষ্মীদেবী বললেন, " না ভাই, ও এসব ব্যাপারে কিছু জানে না। এসব সব শ্বশুরঠাকুরের কীর্তি। এইজন্যেই ওকে অন্য জায়গায় পাঠিয়েছেন। এখন আমি বুঝতে পারছি। গৌড়-টৌড় সব মিথ্যে।"

নরনারায়ণ দেখলেন, লজ্জায় দু:খে তাঁর বন্ধুপত্নীর মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠেছে।

লক্ষ্মীদেবী আবার বলতে লাগলেন, আমি আজ জানতে পারি। খেঁনকিগড়ের পাইক সর্দার আমায় ' মা' বলে ডাকে। তাকে দিয়ে দুপুর রাতে সব পাহারা সরিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। তাই...

নরনারায়ণ বলে উঠলেন, বৌ-ঠাকরুন, আমার এক বোন ছেলেবেলায় মারা গিয়েছিল। তুমিই আমার সেই বোন। আজ আবার ফিরে এলে...

লক্ষ্মীদেবীর পদ্মের মতো মুখখানি চোখের জলে ভেসে গেল। একটু ইতস্তত করে বললেন, ভাই, বলতে সাহস পাই না, তবু বলছি। বোন বলে যদি রাখো।

নরনারায়ণ জিজ্ঞাসা করলেন, কি কথা, বৌ ঠাকরুন?

লক্ষ্মীদেবী বললেন, তুমি আমার কাছে বলে যাও ভাই, শ্বশুরঠাকুরের কোনও অনিষ্ট চিন্তা তুমি করবে না?

নরনারায়ণ রায় একটুখানি কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, তুমি আমার প্রাণ দিলে বৌ ঠাকরুন। তোমার কাছে বলে যাচ্ছি, তুমি বেঁচে থাকতে আমি কখনো তোমার শ্বশুরের কোনও অনিষ্ট চিন্তা করব না।

বিদায় নিতে গিয়ে নরনারায়ণ একবার জিজ্ঞাসা করলেন, বৌ ঠাকরুন, তুমি ফিরে যেতে পারবে তো?

লক্ষ্মীদেবী বললেন, আমি ঠিক চলে যাব। তুমি কিন্তু যতদূর সম্ভব সাঁতরে গিয়ে ডাঙায় উঠে তারপর চলে যেও।

নরনারায়ণ রায় সেই ঘন কৃষ্ণ অন্ধকারে নিঃশব্দে খালের জলে লাফিয়ে পড়ে মিলিয়ে গেলেন।

লক্ষ্মীদেবীর হাতের প্রদীপটা অনেকক্ষণ বাতাসে নিভে গিয়েছিল। তিনি অন্ধকারের মধ্য দিয়েই শ্বশুরের গড়ের দিকে চললেন। একটু দূরে গিয়েই তিনি দেখলেন, পাশের ছোট খালটায় দু'খানা বড় 'ছিপ' মশালের আলোয় সজ্জিত হচ্ছে। ভয়ে তাঁর বুকের রক্ত জমে গেল। সর্বনাশ! এরা কি তবে জানতে পেরেছে!

দ্রুত পায়ে অগ্রসর হয়ে এসে তিনি সুড়ঙ্গের মুখে এসে দেখলেন, সুড়ঙ্গের মুখ খোলাই আছে। তিনি তাড়াতাড়ি সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকে গেলেন।

কীর্তি রায় বুঝতেন, নিজের হাতের আঙুলও যদি বিষাক্ত হয়ে ওঠে, তাহলে সেটা কেটে ফেলাই সমস্ত শরীরের পক্ষে ভাল।

পরদিন আবারও দিনের আলো ফুটে উঠল, কিন্তু লক্ষ্মীদেবীকে আর কোনওদিন কেউ দেখেনি। রাতের হিংস্র অন্ধকার তাঁকে গ্রাস করে ফেলেছিল।

নরনারায়ণ রায় নিজের রাজধানীতে বসে সব শুনলেন। গুপ্ত সুড়ঙ্গের দুই পাশের মুখ বন্ধ করে কীর্তি রায় তাঁর পুত্রবধূ লক্ষ্মীদেবীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন। শুনে নরনারায়ণ চুপ করে রইলেন।

এর কিছুদিন পর তাঁর কানে এল, বাসুন্তার লক্ষণ রায়ের মেয়ের সাথে খুব শীগগিরই চঞ্চলের বিয়ে।

সেদিন রাতে চাঁদ ওঠার পর নরনারায়ণ রায় তাঁর প্রাসাদের ছাদ থেকে চারদিকে আলোর সাগরের ওপর দৃষ্টিপাত করে দৃঢ়চিত্ত নরনারায়ণেরও চোখের পাতা ভিজে উঠল। তাঁর মনে হল, তাঁর অভাগিনী বৌ ঠাকুরানীর চোখের দুষ্টু হাসিটি তারায় তারায় নবমল্লিকার মতো ফুটে উঠেছে।

নরনারায়ণ রায়ের পূর্বপুরুষরা ছিলেন দুর্ধর্ষ দস্যু। হঠাৎ পূর্বপুরুষের সেই বর্বর রক্ত নরনারায়ণের ধমনীতে নেচে উঠল। তিনি বলে উঠলেন, আমার অপমান আমি একরকম ভুলে ছিলাম বৌ ঠাকরুন; কিন্তু তোমার অপমান আমি সহ্য করব না কখনওই।

কিছুদিন কেটে গেল। তারপর এক শীতের ভোর রাতের কুয়াশা কেটে যাবার সাথে সাথে দেখা গেল, কীর্তি রায়ের গড়ের খালের মুখ ' ছিপে', সুলুপে, জাহাজে ভরে গিয়েছে। তোপের আওয়াজে কীর্তি রায়ের প্রাসাদের ভিত ঘন ঘন কেঁপে উঠতে লাগল। কীর্তি রায় শুনলেন, আক্রমণকারী নরনারায়ণ রায় এবং সাথে দুরন্ত পর্তুগীজ জলদস্যু সিবাস্টিয়ান গঞ্জালেস। উভয়ের সম্মিলিত বহরের চল্লিশখানা কোষা খালের মুখে চড়াও হয়েছে। পুরো বহরের বাকি অংশ বাইরের নদীতে দাঁড়িয়ে। এই আক্রমণের জন্য কীর্তি রায় আগে থেকে প্রস্তুত ছিলেন। শুধু প্রস্তুত ছিলেন না, নরনারায়ণের সঙ্গে গঞ্জালেসের যোগদানের ব্যাপারটা নিয়ে। কীর্তি রায়ের কাছে এটা ছিল সত্যিই একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। তা হলেও কীর্তি রায়ও প্রাসাদ থেকে তোপ ছুঁড়তে লাগলেন। গঞ্জালেস সুদক্ষ নৌবীর। তাঁর পরিচালনে দশখানা সুলুপ চড়া ঘুরে গড়ের পাশের ছোটখালে ঢুকতে গিয়ে কীর্তি রায়ের নৌবাহিনী দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হল। গড়ের কামান সেদিকে এত প্রখর যে খালের মুখে দাঁড়িয়ে থাকলে বহর মারা পড়ে। গঞ্জালেস দুখানা কামানবাহী সুলুপ ছোট খালের মুখে রেখে বাকিগুলো সেখান থেকে ঘুরিয়ে এনে চড়ার পেছনে দাঁড় করালেন। গঞ্জালেসের অধীনস্থ অন্যতম জলদস্যু মাইকেল রোজারিও ডিফেগা ছোট বহরগুলো খালের মধ্যে ঢুকিয়ে গড়ের পশ্চিমদিক আক্রমণের জন্য তৈরি হল। অতর্কিত এই আক্রমণে কীর্তি রায়ের নৌবাহিনী, শত্রুবহর দ্বারা ছিপি আঁটা বোতলের মতো আটকে গেল খালের মধ্যে। বাইরের বড় নদীতে গিয়ে যুদ্ধ দেবার ক্ষমতা তাদের আর আদৌ রইল না। তবুও তাদের বিক্রমে রোজারিও অনেকক্ষণ পর্যন্ত কিছু করে উঠতে পারল না। কীর্তি রায়ের নৌবহর দূর্বল ছিল না।

বিকেলের দিকে রোজারিও'র কামানের আঘাতে কীর্তি রায়ের গড়ের পশ্চিম দিকটা ভেঙে পড়ে গেল। নরনারায়ণ রায় দেখলেন, প্রায় তিরিশখানা কোষা জখম অবস্থায় খালের মুখে পড়ে আছে। কীর্তি রায়ের গড়ের কামানগুলো সব চুপ। নদীর দু'পাড় ঘিরে সন্ধ্যে নেমে আসছে। ওপরে নীল আকাশে কেবলমাত্র একঝাঁক শকুনি কীর্তি রায়ের গড়ের মাথায় চক্রাকারে ঘুরছে। হঠাৎ নরনারায়ণ রায়ের চোখের সামনে তাঁর বন্ধুপত্নীর কাতর মিনতিপূর্ণ চোখদুটো মনে পড়ল। তীব্র অনুশোচনায় তাঁর মন তখনিই ভরে উঠল। তিনি করেছেন কি! এইভাবেই কি তিনি স্নেহময়ী প্রাণদাত্রীর শেষ অনুরোধ রাখতে এসেছেন? নরনারায়ণ রায় হুকুম জারি করলেন, কীর্তি রায়ের পরিবারের এক প্রাণীরও যেন প্রাণহানি না হয়। একটু পরেই সংবাদ এল, গড়ের মধ্যে কেউ নেই। নরনারায়ণ রায় বিস্মিত হলেন। তিনি তক্ষুনি নিজে গড়ের মধ্যে ঢুকলেন। তিনি এবং গঞ্জালেস গড়ের সমস্ত ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। দেখলেন সত্যিই কেউ নেই। পর্তুগীজ বহরের লোকেরা গড়ের ভেতর লুঠপাট করতে গিয়ে দেখলেন, মূল্যবান জিনিসপত্র বড় কিছু একটা নেই। পরদিন দ্বিপ্রহর পর্যন্ত লুঠপাট চলল। কীর্তি রায়ের পরিবারের একটি প্রাণীরও সন্ধান পাওয়া গেল না। দুপুরের দিকে দুখানা মাত্র সুলুপ খালের মুখে পাহারায় রেখে নরনারায়ণ রায় ফিরে গেলেন।

এই ঘটনার দিনকয়েক পর।

পর্তুগীজ জলদস্যুর দল লুঠপাট করে চলে গেলে কীর্তি রায়ের এক কর্মচারী গড়ের মধ্যে প্রবেশ করে। আক্রমণের দিন সকালে এই লোকটি অন্য অনেকের সঙ্গে পালিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে একটা বড় থামের আড়ালে সে দেখতে পেল, একটা আহত মুমুর্ষু লোক তাকে ঈশারায় ডেকে কি যেন বলবার চেষ্টা করছে। কাছে গিয়ে সে লোকটাকে চিনতে পারল। লোকটি কীর্তি রায়ের পরিবারের এক পুরনো বিশ্বস্ত কর্মচারী। তার মৃত্যুকালীন অস্পষ্ট কথাবার্তায় আগন্তুক কর্মচারীটি যা বুঝল, তাতেই তার কপাল ঘেমে উঠল। সে বুঝল, কীর্তি রায় তাঁর পরিবারবর্গ এবং ধনরত্ন সমেত মাটির তলায় এক গুপ্ত স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন এবং এই লোকটি, একমাত্র এই লোকটি সেই গুপ্ত ঘরের সন্ধান জানে।

তখনকার দিনে কিন্তু কেউ এই গুপ্তপথগুলি খুলে না দিলে সেখান থেকে বের হওয়া অসম্ভব ছিল। কোথায় সেই মাটির নীচে গুপ্ত ঘর, তা স্পষ্ট করে বলবার আগেই আহত লোকটিই মারা গেল। অনেক অনুসন্ধান করেও গড়ের কোন অংশে সেই গুপ্তগৃহ ছিল, তা খুঁজে পাওয়া গেল না। কীর্তি রায় তাঁর পরিজন সমেত চিরকালের মতো ঐ মাটির তলার ঘরেই আটকা পড়ে গিয়েছিলেন।

ঐ ছোট খালটা প্রকৃতপক্ষে স্বন্দীপ চ্যানেলেরই একটি খাঁড়ি। খালের ধার থেকে একটু এগোলে গভীর অরন্যের বুকে কীর্তি রায়ের গড়ের বিশাল ধ্বংসাবশেষ এখনও বর্তমান আছে দেখতে পাওয়া যায়।

বহুদিন থেকেই এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে থাকে। দুপুর রাতে গভীর বনভূমি যখন নীরব হয়ে যায়, হিমতাল আর হিঁজল গাছের কালো গুঁড়িগুলো অন্ধকার বনের মধ্যে প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, স্বন্দীপ চ্যানেলের জোয়ারের ঢেউয়ে লোনা জল খাঁড়ির মুখে যখন জোনাকির মতো জ্বলতে থাকে, তখন খাল দিয়ে নৌকো বেয়ে যেতে যেতে মোম-মধু সংগ্রাহকেরা কতবার যে শুনেছে, অন্ধকার বনের এক গভীর অংশ থেকে কারা যেন আর্ত করুণ স্বরে চিৎকার করে বলছে,

ওগো পথযাত্রীরা! ওগো পথযাত্রীরা! আমরা যে এখানে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা পড়লাম! দয়া করে আমাদের তোল...আমাদের তোল...আমাদের তোল...

ভয়ে কেউ বেশী রাত্রে এখান দিয়ে নৌকো বাইতে যায় না।"

আমার সঙ্গী ভদ্রলোক তাঁর কাহিনী শেষ করলেন।

# গল্পটি শেয়ার করে আরো অনেকের পড়ার সুযোগ করে দাও।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ