Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

সোনার পাখি ।। সুখলতা রাও

 

রাজবাড়ির চারিপাশে প্রকাণ্ড বাগান। সেই বাগানে এক আশ্চর্য আতাগাছ হয়েছে, তাতে সোনার আতা ফলেছে। রাজা নিজে এসে রোজ আতাগুলি গুণে দেখেন কম পড়ল কিনা। এমনি দিন যাচ্ছে, ক্রমে আতাগুলি পেকে এল, তখন একদিন রাজা দেখলেন, একটি আতা চুরি গিয়েছে। অমনি তিনি তাঁর তিন ছেলের বড়োটিকে ডেকে হুকুম দিলেন, “আজ রাত্রে আতা গাছের নিচে পাহারা দেবে, যেন একটি আতাও চুরি না যায়।

সন্ধ্যা হতেই বড়ো রাজকুমার আতাগাছের নিচে পাহারা দিতে এল, আর রাতদুপুর অবধি খুবই সাবধান হয়ে জেগে রইল। কিন্তু তারপর তার এমনি ঘুম পেল যে, বেচারা একটু না শুয়ে থাকতে পারল না। পরদিন সকালে দেখা গেল, আর একটি আতা চুরি গিয়েছে।

এবার রাজা তাঁর মেজছেলেকে পাঠালেন রাত্রে আতাগাছ পাহারা দেবার জন্য। মেজ রাজকুমার সন্ধ্যা হতে না হতেই তো গিয়ে আতাগাছের নিচে বসল আর ভাবল, “আমি কিছুতেই ঘুমাব না।তারপর শেষরাত্রে কখন যে তার চোখ দুটি আপনা হতেই বুজে এসেছে তা সে টেরই পায়নি।

পরদিন আবার একটি আতা কম। তখন ছোটো ছেলেটি রাজাকে বলল, “বাবা আজ রাত্রে আমি পাহারা দেব।রাজা বললেন, “তুমি কি পারবে? তোমার দাদারাই পারল না।" কিন্তু ছেলেটি কিছুতেই ছাড়ল না, সে রাজাকে অনেক মিনতি করল, “তোমার পায়ে পড়ি বাবা, একটিবার আমাকে দিয়ে দেখ।' কাজেই রাজামশাই রাজি হলেন।

রাত্রে ছোটো রাজপুত্র আতাগাছের তলায় পাহারা দিচ্ছে। রাত বারোটা বেজে গিয়েছে, তবু তার একটুও ঘুম পায়নি। কোথায় কি নড়ল, কোন্ দিকে কিসের একটু শব্দ হল, সব খবর সে নিয়েছে। শেষরাত্রে তার মনে হল, যেন আকাশের উপর দিয়ে কি একটা শোঁ-শোঁ করে উড়ে আসছে, কিন্তু কিছু দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গে-সঙ্গে একটা সোনার পাখি এসে গাছে বসল, আর গাছ থেকে একটি আতা ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেল। রাজার ছেলে তাকে একটা ভীষণ তীর ছুঁড়ে মেরেছিল, কিন্তু অন্ধকারে আর তাড়াতাড়িতে সে তীর তার গায়ে ভালো করে লাগেনি, পাখির একটি চকচকে সোনালী পালক শুধু খসে পড়ল, আর কিছু হল না।

সকাল হতে ছোটো রাজকুমার সেই পালকখানিই নিয়ে রাজার হাতে দিয়ে, সব কথা তাঁকে বলল। সে আশ্চর্য পালক দেখে সকলে একেবারে অবাক। এমন একটা পালকের দাম লাখ টাকার কম কিছুতেই হতে পারে না। রাজা বললেন, “একটা পালকের দাম যদি লাখ টাকা হয়, তবে সমস্ত পাখিটার দাম না জানি কত। এই পাখি আমি চাই। যেমন করে হোক, আমাকে এনে দিতে হবে।

বড়ো রাজকুমার তখনি তীর-ধনুক নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাবার জন্য তৈরি হল। তার খুবই বিশ্বাস, সে গেলেই পাখিটাকে ধরে আনতে পারবে। খানিক দূর গিয়ে, সে এক বনের ধারে একটা শেয়াল বসে আছে দেখতে পেল। তীর উঠিয়ে যেই শেয়ালটাকে মারতে যাবে, অমনি সেটা মিনতি করে বলল, ‘আমাকে মেরো না আমি তোমাকে সেই সোনার পাখির খোঁজ বলে দিতে পারি।কাজেই রাজপুত্র আর তীর ছুড়ল না।

শেয়াল বলল, “এই পথে যাও। পথের ধারে দুটো সরাই আছে, একটা বেশ বড়ো আর জমকালো, আরেকটা ভাঙাচোরা। সেই ভাঙাচোরা সরাইতে রাত কাটিও। সাবধান, জমকালোটায় যেন ঢুকো না।' রাজপুত্র আবার তাকে তীর মারতে যাচ্ছে দেখে, শেয়াল সেখান থেকে ছুটে পালাল।

যাহোক, শেয়াল যে পথের কথা বলেছিল, সেই পথ ধরেই রাজার ছেলে যেতে লাগল, আর ঠিক সন্ধ্যায় গিয়ে দুই সরাই-এর কাছে উপস্থিত হল। তার একটা খুবই বড়ো আর জমকালো, তাতে আলো ঝলমল করছে আর গান-বাজনা, খাওয়া-দাওয়ার ভারি ধুম পড়ে গেছে। দেখেই রাজার ছেলে টকাটক ঘোড়া হাঁকিয়ে গিয়ে তার ভিতর ঢুকল। অন্য সরাইটা ছোট্ট, ভাঙা আর অন্ধকার, সে ওদিকে চেয়েই দেখল না। তাকে দেখেই বড়ো সরাই-এর লোকেরা আদর করে ডেকে নিয়ে গেল, আর সেখানকার আমোদে এমনি ভুলিয়ে ফেলল যে, কোথায় বা রইল তার সোনার পাখি, কোথায় বা রইল বাড়িঘর!

এদিকে রাজা আর দেশের লোক তার জন্য পথ চেয়ে সারা। তারপর যখন সে আর দেশে ফিরলই না, তখন রাজা মেজ কুমারকে সোনার পাখির খোঁজে, আর তার দাদার খোঁজে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু মেজ রাজকুমারও বড়ো ছেলের চেয়ে আর বেশি কিছু করতে পারল না। শেয়ালের সঙ্গে তারও দেখা হয়েছিল, শেয়ালের কথা তার পছন্দ হয়নি। তাতে আবার সেই জমকালো সরাই-এর কাছে যেতেই যখন তার দাদা এসে তাকে ভিতরে ডেকে নিয়ে গেল, তখন তারও দাদার দশা না হয়ে যায় কোথায়? সে সোনার পাখি-টাখি সব ভুলে, সরাইতেই আমোদেই মেতে রইল।

বড়ো দুই রাজকুমার যখন ফিরে এল না, তখন ছোটোটি বলল, “আমি যাব।" কিন্তু রাজা কিছুতে তাকে ছাড়েন না। তিনি বললেন, “হ্যাঁ! তোর দাদারাই পারল না, আর তুই পারবি? শেষটায় তুইও রয়ে যাবি।কিন্তু ছেলেটি এমনি কাকুতি-মিনতি করতে লাগল যে, রাজামশাইকে শেষে রাজি হতেই হল।

ছোটো রাজকুমারের বনের ধারে সেই শেয়ালের সঙ্গে দেখা হল। শেয়াল তাকে জিজ্ঞাসা করল, “সোনার পাখি আনতে যাচ্ছ? আমার কথা শুনলে তোমার উপকার হবে।" ছোটো রাজকুমার তাকে বলল, “কেন শুনব না ভাই? তোমার কথা যদি ভালো হয়, অবশ্যই শুনব। আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু। এ কথায় শেয়াল ভারি খুশি হল। তুমি ঠিক পথেই যাচ্ছ। কিন্তু সাবধান! রাস্তায় দুটো সরাই পাবে। যেটা বড়ো আর খুব জমকালো, সেটাতে কখনো যেও না। ছোটোটাতে যেও।বলল সে।

ছোটো রাজকুমার শেয়ালের কথা ভুলল না। সে সেই দুই সরাই দেখতে পেয়েই সটান গিয়ে ছোটোটাতে ঢুকে পড়ল আর সেখানে বেশ আরামেই রাত কাটাল। ভোরবেলা উঠে দেখে, দরজায় শেয়াল দাঁড়িয়ে! শেয়াল তখন তাকে ডেকে এক মাঠের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি যখন আমার বন্ধু তখন আমি প্রাণ দিয়ে তোমায় সাহায্য করব। আমার পিঠে ওঠো, আমি তোমাকে নিয়ে এক রাজবাড়ির সামনে নামিয়ে দেব। সে-বাড়ির দরজায় দেখবে অনেক সিপাই সান্ত্রী, তারা সকলেই ঘুমাচ্ছে। তুমি কোনো ভয় না পেয়ে, সোজা তাদের ভিতর দিয়ে একেবারে বাড়ির মধ্যে চলে যাবে। যেতে-যেতে সকলের শেষের ঘরে গিয়ে দেখবে, একটা কাঠের খাঁচায় সোনার পাখিটি, আর তার পাশে একটা খালি সোনার খাঁচা ঝোলানো আছে। খবরদার! পাখিটাকে যেন কাঠের খাঁচা থেকে বার করে সোনার খাঁচায় পুরতে যেও না, তাহলে বড়োই বিপদ হবে।

ছোটো রাজকুমার শেয়ালের পিঠে উঠে বসতে শেয়াল তাকে নিয়ে ল্যাজ তুলে পাঁই-পাঁই করে দিল ছুট। ছুটতে-ছুটতে সে একেবারে রাজার বাড়ির সামনে এসে হাজির হল। সে-বাড়ির দরজায় সত্যি-সত্যি সিপাইগুলো যুদ্ধের পোশাক পরে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল। ছোটো রাজকুমার তাদের মাঝখান দিয়ে সোজা চলে গেল একেবারে বাড়ির ভিতর। তারপর সব ঘর পার হয়ে শেষের ঘরে গিয়ে দেখল, একটা কাঠের খাঁচায় সেই সোনার পাখি, আর তার পাশেই একটা খালি সোনার খাঁচা ঝোলানো আছে। তখন ছোটো রাজকুমার মনে-মনে ভাবল, “ছ্যাঃ!কাঠের খাঁচাটা কি নোংরা আর লটখটে। এমন সুন্দর পাখিটাকে অমন খাঁচায় নিয়ে যাব?” এই ভেবে সে যেই পাখিটাকে ধরে সোনার খাঁচায় ভরতে যাবে, অমনি পাখিটা ক্যাঁ-ক্যাঁকরে চেঁচিয়ে উঠল, আর দেখতে-দেখতে সব লোকজন ছুটে এসে, বেচারাকে ধরে তাদের রাজার কাছে নিয়ে গেল।

সে দেশের রাজা বললেন, “তোমাকে কেটে ফেলাই উচিত ছিল। কিন্তু আমি তোমাকে ছেড়ে দেব আর এই পাখিটাও তোমাকে দিয়ে দেব, যদি তুমি একটা কাজ করতে পার। কাজটি আর কিছুই নয়, সেই যে সোনার ঘোড়া বাতাসের আগে চলে সেই ঘোড়াটি আমায় এনে দিতে হবে।

ছোটো রাজকুমারকে তারা ছেড়ে তো দিল, কিন্তু সে কোথায় যাবে, কিছু ঠিক করতে পারে না। সোনার ঘোড়া কোথায় থাকে, কি করে তা জানবে? কখনও তার নামও সে শোনেনি! ভাবতে-ভাবতে পথ দিয়ে চলেছে, হঠাৎ তার শেয়াল বন্ধু সেখানে এল। শেয়াল বলল, “দেখ, আমার কথা, না শুনে কি কাণ্ডটাই করলে!

যাই হোক, এখন তো ঘোড়া আনতেই হচ্ছে। তোমাকে এবারে আর এক রাজার বাড়ি নিয়ে যাব। তাদের আস্তাবলে সোনার ঘোড়া আছে। আস্তাবলের সামনে সহিসেরা সব নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। তুমি চুপি-চুপি গিয়ে ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে আসবে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো আস্তাবলের দেয়ালে যে ছেঁড়া সাজ টাঙানো রয়েছে, ঘোড়াটাকে সেই পরিয়ে আনবে। তার কাছে যে সোনার সাজ আছে, সেটা পরিও না, তাহলে কিন্তু মুস্কিল হবে।

এই বলে শেয়াল আবার তাকে পিঠে নিয়ে ছুটতে-ছুটতে, একেবারে সোনার আস্তাবলের কাছে এনে নামিয়ে দিল। তখন আস্তে-আস্তে ঘোড়াটাকে সেই ছেঁড়া সাজখানি পরিয়ে নিয়ে চলে এলে আর কোন গোল ছিল না। কিন্তু রাজার ছেলের কিনা বড়ো মানুষী নজর, ছেঁড়া সাজটা দেখে তার বড়োই ঘেন্না হল। সে সোনার সাজটি নিয়ে গিয়েছে ঘোড়াকে পরাতে, আর ঘোড়াটাও অমনি উঠেছে চ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁকরে ভয়ানক চেঁচিয়ে, আর সহিসগুলো তাতে লাফিয়ে উঠে রাজকুমারকে ধরে নিয়ে গিয়েছে তাদের রাজার কাছে। রাজা সব কথা শুনে চটে লাল হয়ে, রাগে বললেন, “তোমাকে এখনি কেটে ফেলব।" তারপর একটু ভেবে বললেন, “আচ্ছা, তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি, যদি সোনার দেশের রাজার সোনার মতো সুন্দর মেয়েটি আমায় এনে দিতে পারো। তাহলে এ ঘোড়টাও তুমি বকশিশ পাবে।

তখনকার মতন সেখান থেকে ছুটি পেয়ে ছোটো রাজকুমার মাথা হেঁট করে পথ দিয়ে যাচ্ছে আর ভাবছে এবারেই প্রাণটি যাবে।" পথের ধারেই তার শেয়াল বন্ধু বসে ছিল, সে ছোটো কুমারকে বলল, “তুমি আমার বন্ধু, তোমাকে ছেড়ে আমি কি করে যাই? কিন্তু তুমি দেখছি কিছুতেই আমাকে তোমার প্রাণ বাঁচিয়ে রাখতে দেবে না। আর যেন এমন না হয়, আমার কথা না শুনলে তোমার ভারি বিপদ হবে মনে রেখো। এখন চলো, এই সোজা পথে আমাদের যেতে হবে। সন্ধ্যার আগে সোনার দেশে পৌঁছাব। রাজার বাড়ির বাগানে লুকিয়ে থাকবে তুমি। রাতদুপুরে রাজার মেয়ে স্নান করতে আসেন, ঠিক সে সময়ে তিনি নমস্কার করবার আগেই তুমি তাকে নমস্কার করে ফেলবে। তাহলে তুমি যেখানে নিয়ে যাবে তিনি সেইখানেই যাবেন। কিন্তু, খবরদার! তাঁকে কিছুতেই তার বাবার সঙ্গে দেখা করবার জন্য ছেড়ে দিও না, হাজার হাতে-পায়ে ধরলেও না।"

আবার ছোটো রাজকুমারকে পিঠে নিয়ে শেয়াল ছুটে চলল। হাজার-হাজার মাইল পার হয়ে সোনার দেশে যেতে হয়। কিন্তু শেয়াল এমনি ভয়ানক ছুটে চলেছে যে, দেখতে-দেখতে রাজকুমারকে সেই দেশের রাজার খিড়কীর বাগানে এনে নামিয়ে দিয়েছে। তখন রাজকুমার সেখানকার পুকুরের ঘাটের পাশের একটা গাছের আড়ালে গিয়ে বসে রইল।

দুপুর রাত্রে রাজার মেয়ে সেখানে স্নান করতে এসেছে। ঠিক যেন সোনার পুতুলটি। সে জানে না সেখানে কেউ আছে, এর মধ্যে রাজপুত্র তাড়াতাড়ি গিয়ে তাকে নমস্কার করে ফেলল। তখন রাজার মেয়ে প্রথমটা থতমত খেয়ে তারপর হেসে বলল, “তাহলে আমাকে আপনার সঙ্গে যেতে হচ্ছে। আচ্ছা একটু দাঁড়ান, আমি বাবার সঙ্গে একটু দেখা করে আসি, তারপর যাব।" রাজপুত্র বলল, “আর দেখা করবার সময় নেই, এখনি আমার সঙ্গে চলুন।

রাজার মেয়ে হাত জোড় করে কত বলল, কিছুতেই ছোটো রাজপুত্র তাকে ছেড়ে দিল না। কিন্তু তারপর তখন রাজার মেয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল, তখন রাজপুত্র আর মাথা ঠিক রাখতে না পেরে বলল, “আচ্ছা যান।

যেই ছুটি পাওয়া অমনি সেই মেয়ে গিয়ে সব বলে দিয়েছে রাজাকে। তখন দেখতে-দেখতে রাজার পেয়াদা সব ছুটে এসে ছোটো রাজকুমারকে নিয়ে গেল ধরে। সে রাত্রের মতন তাকে একটা ঘরে বন্ধ করে রাখা হল, পরদিন বিচার হবে।

পরদিন তাকে বিচারসভায় আনতেই রাজা বললেন, “তোমাকে শূলে চড়ানো হবে। তবে, একটা কাজ যদি করতে পারো তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেব, তার উপর আমার মেয়েটিও দেব। আমার বাড়ির দক্ষিণে এই যে প্রকাণ্ড পাহাড় দেখছ, এতে আমার বাড়ির সব হাওয়া আটকে রাখছে। তোমাকে আট দিনের মধ্যে এই পাহাড়টি ভেঙে সমান করে দিতে হবে।

এত বড়ো পাহাড় কি একজন লোক আট দিনে ভাঙতে পারে? ছোটো রাজকুমার তবু একটা শাবল হাতে নিয়ে, পাহাড়ে খোঁচা দিতে লাগল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাটি খোঁড়ে, একটু বিশ্রাম করে, তারপর আবার সারারাত খোঁড়ে। খুঁড়ে-খুড়ে যখন সাত দিনেও সেই পাহাড়ের লক্ষ ভাগের এক ভাগও ভাঙা গেল না তখন রাজকুমার শাবল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চুপ করে রইল বসে। একটু পরেই কোথা থেকে হঠাৎ এসে উপস্থিত হল তার শেয়াল বন্ধু! শেয়াল বলল, “আমি চলে গিয়েছিলাম, শুধু একবার মনে করলাম, যাই দেখে আসি বন্ধু কি করছে' তাই এলাম। যা হোক এসে ভালোই হয়েছে। তুমি এখন ঘুমাও গিয়ে, আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।

শেয়ালের কথায় রাজকুমার নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল! সকালে উঠে দেখে রাজার বাড়ির দক্ষিণে প্রকাণ্ড মাঠ ধু-ধু করছে, পাহাড়ের চিহ্ন নেই। তখন সে রাজার কাছে যারপরনাই আদর পেল। তিনি নিজের মেয়েকে দিলেন রাজপুত্রের হাতে। রাজপুত্রও তাকে নিয়ে ফিরে চলল।

পথে আবার শেয়াল বন্ধুর সঙ্গে দেখা। শেয়াল তাকে ডেকে বলল, “বন্ধু, তোমরা আমার পিঠে চড়ো, তাহলে শীগ্‌গির যেতে পারবে। রাজকন্যা তো তোমারই। আর একটা কথা সোনার ঘোড়াটি কিন্তু এই রাজকন্যার, সেটাকে নিয়ে যেতে হবে।

রাজপুত্র বলল, “কি করে নেব?' শেয়াল বলল, “আমি তোমাদের সোনার ঘোড়ার দেশে পৌঁছে দিচ্ছি। তুমি রাজার মেয়েকে সেখানকার রাজার কাছে নিয়ে গেলে, তিনি এতই খুশি হবেন যে, তখনি তোমাকে ঘোড়াটা দিয়ে দেবেন। তুমি আগে সেই ঘোড়ায় উঠে বসে, তারপর সকলের কাছে বিদায় নেবে। এই রাজকন্যার কাছে বিদায় নেবার সময়ে, একে হাত ধরে টেনে তোমার ঘোড়ায় উঠিয়ে নিয়ে একেবারে ঘোড়া ছুটিয়ে দেবে। তখন আর কে তোমাদের আটকায়।

এইরকম যুক্তি এঁটে তারা সোনার ঘোড়ার দেশে গেল। সেখানকার রাজা, রাজকন্যাকে পেয়েই ছোটো রাজকুমার চাইবার আগেই, সোনার ঘোড়াটা এনে তাকে দিয়ে দিলেন। রাজকুমারও তার উপর লাফিয়ে উঠতে আর তিলমাত্রও দেরি করল না। ঘোড়ায় চড়ে সে সকলের কাছে বিদায় নিতে লাগল। যেই সে রাজকন্যার কাছে এসেছে, অমকি তাকে হাত ধরে টেনে ঘোড়ায় তুলে, সেখান থেকে চম্পট। পথে শেয়ালও তাদের সঙ্গে জুটল।

এখন তাদের যেতে হবে। সোনার পাখির দেশে। সেখানে এসে ছোটো রাজকুমার, মেয়েটিকে শেয়ালের কাছে রেখে, ঘোড়া নিয়ে রাজবাড়ির ভিতর ঢুকল। তাকে ঘোড়া নিয়ে আসতে দেখে সে দেশের লোকের যা আনন্দ! রাজা নিজে ছুটে এসে সোনার পাখিটি তার হাতে দিলেন। রাজকুমার তখনও ঘোড়ার উপর বসে আছে। পাখি হাতে পেয়েই সে দিয়েহে ঘোড়া ছুটিয়ে। রাজামশাই পাত্রমিত্রসুদ্ধ ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন, ততক্ষণে রাজকুমার এসে শেয়ালকে আর রাজকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে।

খানিক দূরে গিয়ে শেয়াল বলল, “বন্ধু আমি তোমার এত কাজ করলাম, তুমি আমার একটা কাজ করবে?"

রাজকুমার জিজ্ঞাসা করল, “কি কাজ?" শেয়াল উত্তর করল, “আমার মাথাটা কেটে ফেলো।' রাজকুমার জিব কেটে বলল, “কি বলো বন্ধু! তাও কি হয়? তুমি আমার এত উপকার করেছ, আর আমি তোমাকে মেরে ফেলব? সে কিছুতেই পারব না।তখন শেয়াল ভারি দুঃখিত হল, আর বলল, “তবে চল্লাম। যাবার সময় বলে যাই পথে কোনও মানুষ কিনো না, আর ঝরণার ধারে বসো ন।" এই কথা বলে, দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল।

ছোটো রাজকুমার খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবল, “বন্ধু বোধহয় রাগ করেছে। কিন্তু কি করি, এমন কাজ কি করে করি? আর শেষে কি ভেবে সে এমন অদ্ভুত কথা বলে গেল? মানুষ কেন কিনব, ঝরনার ধারেই বা বসতে যাব কেন? এখনি তো ঘোড়া ছুটিয়ে বাড়ি যাব।

তারপর সোনার পাখি আর রাজকন্যাকে নিয়ে, সোনার ঘোড়ায় চড়ে, রাজপুত্র অনেক দূর চলেছে। যেতে-যেতে সেই সরাই দুটোর কাছে গিয়ে দেখে, সেখানে ভারি গোলমাল। রাজার পেয়াদা দুজন লোককে ধরে কয়েদখানায় নিয়ে যাচ্ছে, আর বলছে যে, তারা নাকি ভারি দুষ্ট লোক, নিজেদের সব টাকা উড়িয়ে দিয়ে এখন অন্য লোকের টাকা কেড়ে নেয়। ছোটো রাজপুত্র কাছে গিয়ে দেখে, সে দুজন আর কেউ নয়, তারই দুই দাদা। তখন ছোটো রাজকুমার পেয়াদাদের অনেক টাকা দিয়ে দু-ভাইকে কিনে নিল।

তারপর সবাই তারা বাড়ি চলেছে। ছোটো রাজপুত্রের মনে ভারি সুখ। তার দাদারা কিন্তু সুখী নয় মোটেই। তারা কেবলি মনে-মনে ভাবছে, ছোটো ভাই দেশে গিয়ে যদি তাদের কীর্তির কথা সকলকে বলে দেয়, তবে তারা কি করে মুখ দেখাবে? আর ছোটো ভাই একলা গিয়ে সোনার পাখি, সোনার ঘোড়া, সোনার রাজকন্যা সব নিয়ে এসে, না জানি কতই বাহাদুরি পাবে। সেটাই বা তারা কি করে সয়ে থাকবে? যত ভাবছে, ততই তারা হিংসায় জ্বলে মরছে আর নানারকমের মন্দ-ফন্দি আঁটছে।

শেয়াল মানুষ কিনতে মানা করেছিল, ছোটো রাজকুমার তো আগেই কিনেছে মানুষ, ঝরণার ধারে বসতে নিষেধ করেছিল, সে কথাও তার মনে নেই। একটা বনের ভিতরে একটা ঝরনা দেখতে পেয়েই তাড়াতাড়ি ছোটো রাজকুমার তার ধারে বিশ্রাম করতে বসল, আর তার দাদারাও অমনি তাকে বেঁধে সেই ঝরনার জলে ফেলে দিয়ে, সোনার পাখি-টাখি সব নিয়ে দেশে চলে গেল।

দেশে গিয়ে তাদের বড়াইয়ের সীমা নেই, যেন কতই কাণ্ডকারখানা করে তারা এসব জিনিস নিয়ে এসেছে। রাজা বেজায় খুশি হলেন, অন্য সকলে খুব বাহবা দিতে লাগল। এদিকে কিন্তু সোনার পাখি আর সোনার ঘোড়া খাওয়া-দাওয়া একেবারে ছেড়েছে, আর রাজকন্যা কেবলই কাঁদছে।

আর, ছোটো ভাই-এর কি হল? হাত-পা বাঁধা, বেচারা ঝরণা থেকে উঠতে পারছে না। ভাগ্যিস সেখানে জল বেশি ছিল না, থাকলে ডুবেই মারা যেত। সে খালি ডাকছে, “কে আছ? আমাকে টেনে তোল।সে ডাক শুনে কোথা থেকে তার শেয়াল বন্ধু ছুটে এসে হাজির। শেয়াল তার অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি ল্যাজ বাড়িয়ে দিল, আর রাজকুমার সেই ল্যাজ ধরতেই তাকে ডাঙায় তুলে ফেলল। তারপর শেয়াল এই বলে চলে গেল, “শীগ্‌গির দেশে যাও, কিন্তু যতক্ষণ না রাজার মেয়ে তোমাকে চিনতে পারে, ততক্ষণ নিজের পরিচয় দিও না।"

এবার আর ছোটো ভাই শেয়ালের কথা ভুলল না। সে এমনি এক ভিখারী সেজে বাড়িতে উপস্থিত হল যে, তাকে আর চিনবার যো-ই নাই। কিন্তু কি আশ্চর্য! সে যেতে-না-যেতেই সোনার পাখি গান গেয়ে উঠেছে, ঘোড় নাচছে, আর রাজার মেয়ে হেসে-হেসে সকলের সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করেছে। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, “রাজকন্যা আজ যে তুমি এত খুশি?" রাজার মেয়ে উত্তর দিল, “আমাকে যারা এখানে এনেছে, তারা তো চোর, আমি সত্যি-সত্যি যার, তিনি আজ এসেছেন।রাজা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কই, কোনখানে?" মেয়ে বলল, “আপনার বাড়ির সকলকে ডাকুন, আমি দেখিয়ে দেব।

তখন রাজা তার বাড়ির ছেলে-মেয়ে, আমলা-কামলা, ঝি-চাকর সকলকে ডাকলেন। তাদের সঙ্গে এক ভিখারীও এল। রাজার মেয়ে ভিখারীর কাছে গিয়ে প্রণাম করে, সকলকে বলল, “আমার বাবা এঁর হাতেই আমাকে দিয়েছেন।" ভিখারীও অমনি রাজামশাইকে প্রণাম করে বলল, “বাবা, আমাকে চিনতে পারলে না?”

তখন আর কোনো কথা জানতে বাকি রইল না। শুনে সেই দুষ্ট দুই ভাইয়ের উপর রাজার এমনি ভয়ানক রাগ হল যে, ছোটো রাজকুমার অনেক বুঝিয়ে তাঁকে ঠাণ্ডা না করলে তিনি সেদিন তাদের যে কি করতেন ঠিক নেই। ছোটো ছেলের অনুরোধে তিনি তাদের তাড়ালেন না বটে, কিন্তু রাজ্য ছোটো ছেলেকেই দিয়ে দিলেন।

এর অনেক দিন পরে একদিন ছোটো রাজকুমার, যে এখন রাজা, বনে শিকার করতে গিয়ে দেখল, তার শেয়াল বন্ধু গাছতলায় পড়ে কাঁদছে। সে তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “বন্ধু, তুমি কাঁদছ কেন? তোমার কি হয়েছে?” “বন্ধু তুমিই যখন আমার কাজটা করলে না, তখন কে করবে বল? কিন্তু যতদিন না আমার মাথা কাটা যাবে, ততদিন আমি ভয়ানক মনের কষ্টে থাকব।" বলে আরও কাঁদতে লাগল শেয়াল। তা শুনে ছোটো রাজকুমার বলল, “বন্ধু তুমি যদি তাতে সত্যিই সুখী হও তবে এসো, আমি রাজি আছি।এই বলে যেই সে তরোয়াল দিয়ে শেয়ালের মাথা কেটেছে, অমনি শেয়াল-টেয়াল সব কোথায় মিলিয়ে গিয়ে, পরম সুন্দর এক রাজপুত্র তার জায়গায় উঠে দাঁড়াল।

তখন দুই বন্ধুর কত আনন্দ। শেয়াল আসলে সোনার দেশের রাজারই ছেলে, সোনার রাজকন্যার, ভাই। এক দুষ্টু ডাইনির শাঁপে সে শেয়াল হয়েছিল। অনেক কথাবার্তার পর সে ছোটো রাজকুমারকে বলল, “এখন তবে চললাম বন্ধু, বাবার সঙ্গে দেখা করে আবার তোমাদের দেখতে আসব আমার বোনকে এই খবর দিও।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ