মনের দিক দিয়া বিচার করিলে দেখা যায় যে, দুইজনেই গোঁড়া। একজন গোঁড়া বৈজ্ঞানিক এবং আর- একজন গোঁড়া বৈষ্ণব। অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে নরেশ জ্ঞানমার্গ এবং পরেশ ভক্তিমার্গ অবলম্বন করিয়াছেন।
যখন নরেশের 'কমবাইন্ড হ্যান্ড' চাকর, নরেশের জন্য ফাউল কাটলেট বানাইতে ব্যস্ত এবং নরেশ ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি' লইয়া উন্মত্ত, তখন সেই একই বাড়িতে পরেশ স্বপাক নিরামিষ আহার করিয়া যোগবাশিষ্ট রামায়ণে মগ্ন। ইহা প্রায়ই দেখা যাইত।
তাই বলিয়া ভাবিবেন না যে, উভয়ে সর্বদা লাঠালাঠি করিতেন! মোটেই তা নয়। ইহাদের কলহ মোটেই নাই। তাহার সুস্পষ্ট কারণ বোধহ্য। এই যে, অর্থের দিক দিয়া কেহ কাহারও মুখাপেক্ষী নন।
উভয়েই এম. এ. পাস - নরেশ কেমিস্ট্রিতে এবং পরেশ সংস্কৃতে। উভয়েই কলেজের প্রফেসারি করিয়া মোটা বেতন পান। মরিবার পূর্বে পিতা দুইজনকেই সমানভাবে নগদ টাকাও দিয়া গিয়াছিলেন। যে বাড়িতে ইহারা বাস করিতেছেন – ইহাও পৈতৃক সম্পত্তি। বাড়িটি বেশ বড়ো। এত বড়ো যে ইহাতে দুই-তিনটি পরিবার পুত্র-পৌত্রাদি লইয়া বেশ স্বচ্ছন্দে বাস করিতে পারে। কিন্তু নরেশ এবং পরেশের মনে পৃথিবীর অনিত্যতা সম্বন্ধে এমন একটা উপলব্ধি আসিল যে, কেহই আর বিবাহ করিলেন না। পরেশ ভাবিলেন- ‘কা তব কান্তা'- ইহাই সত্য। রিলেটিভিটি'র শিক্ষার্থী নরেশ ভাবিতে লাগিলেন – নির্মলা সত্যিই কি মরিয়াছে? আমি দেখিতে পাইতেছি না - এই মাত্র!
সুতরাং নরেশ এবং পরেশ সহোদর হওয়া সত্ত্বেও ভিন প্রকৃতির এবং ভিন প্রকৃতির হওয়া সত্ত্বেও একই বাড়িতে শান্তিতে বাস করেন।
এক বিষয়ে কিন্তু উভয়ের মিলও ছিল।
পল্টুকে উভয়ে ভালোবাসিতেন। পল্টু তপেশের পুত্র। নরেশ এবং পরেশের ছোটোভাই তপেশ। এলাহাবাদে চাকুরি করিত। হঠাৎ একদিন কলেরা হইয়া তপেশ এবং তপেশের স্ত্রী মনোরমা মারা গেল। টেলিগ্রামে আহূত নরেশ এবং পরেশ গিয়া তাহাদের শেষ কথাগুলি মাত্র শুনিবার অবসর পাইলেন। তাহার মর্ম এই : ‘আমরা চললাম। পন্টুকে তোমরা দেখো৷' পন্টুকে লইয়া নরেশ এবং পরেশ কলিকাতা ফিরিয়া আসিলেন। | তপেশের অংশে পৈতৃক কিছু টাকা ছিল। নরেশ তাহার অর্ধাংশ পরেশের সন্তোষার্থে রামকৃষ্ণ মিশনে দিবার প্রস্তাব করিবামাত্রই পরেশ বলিলেন- 'বাকি অর্ধেকটা তাহলে বিজ্ঞানের উন্নতিকল্পে খরচ হোক! তাহাই হইল। পন্টুর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তাঁহারা ভাবিলেন যে, তাঁহারা নিজেরা যখন কেহই সংসারী নহেন তখন পন্টুর আর ভাবনা কী! পন্টু নরেশ এবং পরেশ উভয়েরই নয়নের মণিরূপে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। নরেশ কিম্বা পরেশ কেহই নিজের মতবাদ পন্টুর উপর ফলাইতে যাইতেন না। পল্টুর যখন যাহা অভিরুচি সে তাহাই করিত। নরেশের সঙ্গে আহার করিতে-করিতে যখন তাহার মুরগি সম্বন্ধে মোহ কাটিয়া আসিত তখন সে পরেশের হবিষ্যান্নের দিকে কিছুদিন ঝুঁকিত। কয়েকদিন হবিষ্যান্ন ভোজনের পর আবার আমিষ- লোলুপতা জাগিলে নরেশের ভোজনশালায় ফিরিয়া যাইতেও তাহার বাধিত না।
নরেশ এবং পরেশ উভয়েই তাহাকে কোনো নির্দিষ্ট বাঁধনে বাঁধিতে চাহিতেন না- যদিও দুইজনেই মনে-মনে আশা করিতেন যে বড়ো হইয়া পন্টু তাঁহার আদর্শই বরণ করিবে।
পন্টুর বয়স ষোলো বৎসর। এইবার ম্যাট্রিক দিবে। সুন্দর স্বাস্থ্য, ধবধবে ফরসা গায়ের রঙ, আহত চক্ষু। নরেশ এবং পরেশ দুইজনেই সর্বান্তঃকরণে পল্টুকে ভালোবাসিতেন। এ-বিষয়ে উভয়ের কিছুমাত্র অমিল ছিল না।
এই পন্টু একদিন অসুখে পড়িল।
নরেশ এবং পরেশ চিন্তিত হইলেন। নরেশ বৈজ্ঞানিক মানুষ, তিনি স্বভাবতই একজন অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার লইয়া আসিলেন। পরেশ প্রথমটায় কিছু আপত্তি করেন নাই, কিন্তু যখন উপর্যুপরি সাতদিন কাটিয়া গেল জ্বর ছাড়িল না, তখন তিনি আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। নরেশকে বলিলেন- একজন ভালো কবিরাজ ডেকে দেখালে কেমন হত?
বেশ দেখাও-
কবিরাজ আসিলেন, সাতদিন চিকিৎসা করিলেন। জ্বর কমিল না, বরং বাড়িল; পন্টু প্রলাপ বকিতে লাগিল। অস্থির পরেশ তখন নরেশকে বলিলেন, 'আচ্ছা একজন জ্যোতিষীকে ডেকে ওর কুষ্ঠিটা দেখালে কেমন হয়? কী বলো?'
বেশ তো! তবে, যাই করো এ জ্বর একুশ দিনের আগে কমবে না। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন- টাইফযেড!
‘তাই নাকি?‘
পল্টুর কোষ্ঠী লইয়া ব্যাকুল পরেশ জ্যোতিষীর বাড়ি ছুটিলেন। জ্যোতিষী কহিলেন- 'মঙ্গল মারকেন। তিনি রুষ্ট হইয়াছেন।' কী করিলে তিনি শান্ত হইবেন, তাহার একটা ফর্দ দিলেন। পরেশ প্রবাল কিনিয়া পল্টুর হাতে বাঁধিযা মঙ্গলশান্তির জন্য শাস্ত্রীয় ব্যবস্থাদি করিতে লাগিলেন।
অসুখ কিন্তু উত্তরোত্তর বাড়ি চলিয়াছে। নরেশ একদিন বলিলেন- ‘কবিরাজি ওষুধ তো বিশেষ উপকার হচ্ছে না, ডাক্তারকেই আবার ডাকব নাকি?‘
‘তাই ডাকো না-হয়-‘
নরেশ ডাক্তার ডাকিতে গেলেন। পরেশ পন্টুর মাথার শিয়রে বসিয়া মাথায় জলপট্টি দিতে লাগিলেন। পন্টু প্রলাপ বকিতেছে- 'মা আমাকে নিয়ে যাও। বাবা কোথায়!‘
আতঙ্কে পরেশের বুকটা কাঁপিয়া উঠিল। হঠাৎ মনে হইল, শুনিয়াছিল তারকেশ্বরে গিয়া ধরনা দিলে দৈব ঔষধ পাওয়া যায়। ঠিক!
নরেশ ফিরিয়া আসিতেই পরেশ বলিলেন- ‘আমি একবার তারকেশ্বর চললাম, ফিরতে দু-একদিন দেরি হবে।‘
‘হঠাৎ তারকেশ্বর কেন?‘
‘বাবার কাছে ধরনা দেব।'
নরেশ কিছু বলিলেন না, ব্যস্তসমস্ত পরেশ বাহির হইয়া গেলেন।
ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিলেন- বড়ো খারাপ টার্ন নিয়েছে।'
ডাক্তারি চিকিৎসা চলিতে লাগিল।
দিন-দুই পরে পরেশ ফিরিলেন। হস্তে একটি ভাঁড়। উল্লসিত হইয়া তিনি বলিলেন : 'বাবার স্বপ্নাদেশ পেলাম। তিনি বললেন যে, রোগীকে যেন ইনজেকশন দেওয়া না হয়। আর বললেন, এই চরণামৃত রোজ একবার করে খাইয়ে দিতে, তাহলে সেরে যাবে।‘
ডাক্তারবাবু আপত্তি করিলেন। নরেশও আপত্তি করিলেন। ‘টাইফযেড রোগীকে ফুলবেলপাতা পচা জল কিছুতেই খাওয়ানো চলিতে পারে না।‘
হতবুদ্ধি পরেশ ভান্ডহস্তে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।
আসলে কিন্তু বিষয় দাঁড়াইল অন্যরূপ। পরেশের অগোচরে পন্টুকে ডাক্তারবাবু যথাবিধি ইনজেকশন দিতে লাগিলেন এবং ইহাদের অগোচরে পরেশ লুকাইয়া পল্টুকে প্রত্যহ একটু চরণামৃত পান করাইতে লাগিলেন।
কয়েকদিন চলিল। রোগের কিন্তু উপশম নাই।
গভীর রাত্রি। হঠাৎ নরেশ পাশের ঘরে গিয়া পরেশকে জাগাইলেন! 'ডাক্তারবাবুকে একবার খবর দেওয়া দরকার, পন্টু কেমন যেন করছে।'
‘অ্যাঁ, বলো কী!
পন্টুর তখন শ্বাস উঠিয়াছে।
উন্মাদের মতো পরেশ ছুটিয়া নিচে নামিয়া গেলেন ডাক্তারকে ফোন করিতে। তাহার গলার স্বর শোনা যাইতে লাগিল-
‘হ্যালো- শুনছেন ডাক্তারবাবু, হ্যালো-হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমার আর ইনজেকশন দিতে আপত্তি নেই- বুঝলেন–হ্যালো- বুঝলেন- আপত্তি নেই- আপনি ইনজেকশন নিয়ে শিগগির আসুন- আমার আপত্তি নেই, বুঝলেন-'
এদিকে নরেশ পাগলের মতো চরণামৃতের ভাঁড়টা পাড়িয়া চামুচে করিয়া খানিকটা চরণামৃত লইয়া পল্টুকে সাধ্যসাধনা করিতেছেন- ‘পল্টু খাও- খাও তো বাবা- একবার খেয়ে নাও একটু-‘
তাঁহার হাত থরথর করিয়া কাঁপিতেছে, চরণামৃত কশ বাহিয়া পড়িয়া গেল।
0 মন্তব্যসমূহ