Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

তোতাকাহিনী ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

 

এক যে ছিল পাখি। সে ছিল মূর্খ। সে গান গাহিত, শাস্ত্র পড়িত না। লাফাইত, উড়িত, জানিত না কায়দাকানুন কাকে বলে। রাজা বলিলেন, এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়।

মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, পাখিটাকে শিক্ষা দাও।

 

রাজার ভাগিনাদের উপর ভার পড়িল পাখিটাকে শিক্ষা দিবার। পণ্ডিতেরা বসিয়া অনেক বিচার করিলেন। প্রশ্নটা এই, উক্ত জীবের অবিদ্যার কারণ কী।

সিদ্ধান্ত হইল, সামান্য খড়কুটা দিয়া পাখি যে বাসা বাঁধে সে বাসায় বিদ্যা বেশি ধরে না। তাই সকলের আগে দরকার, ভালো করিয়া খাঁচা বানাইয়া দেওয়া।

রাজপণ্ডিতেরা দক্ষিণা পাইয়া খুশি হইয়া বাসায় ফিরিলেন।

 

স্যাকরা বসিল সোনার খাঁচা বানাইতে। খাঁচাটা হইল এমন আশ্চর্য যে, দেখিবার জন্য দেশবিদেশের লোক ঝুঁকিয়া পড়িল। কেহ বলে, শিক্ষার এক্কেবারে হদ্দমুদ্দ। কেহ বলে, শিক্ষা যদি নাও হয়, খাঁচা তো হইল। পাখির কী কপাল।

স্যাকরা থলি বোঝাই করিয়া বকশিশ পাইল। খুশি হইয়া সে তখনি পাড়ি দিল বাড়ির দিকে। পণ্ডিত বসিলেন পাখিকে বিদ্যা শিখাইতে। নস্য লইয়া বলিলেন, অল্প পুঁথির কর্ম নয়।

ভাগিনা তখন পুঁথিলিখকদের তলব করিলেন। তারা পুঁথির নকল করিয়া এবং নকলের নকল করিয়া পর্বতপ্রমাণ করিয়া তুলিল। যে দেখিল সেই বলিল, সাবাস। বিদ্যা আর ধরে না। লিপিকরের দল পারিতোষিক লইল বলদ বোঝাই করি। তখনি ঘরের দিকে দৌড় দিল। তাদের সংসারে আর টানাটানি রহিল না।

অনেক দামের খাঁচাটার জন্য ভাগিনাদের খবরদারির সীমা নাই। মেরামত তো লাগিয়াই আছে। তার পরে ঝাড়া মোছা পালিশ-করা ঘটা দেখি সকলেই বলিল, উন্নতি হইতেছে।

লোক লাগিল বিস্তুর এবং তাদের উপর নজর রাখিবার জন্য লোক লাগিল আরও বিস্তর। তারা মাস-মাস মুঠা-মুঠা তনখা পাইয়া সিন্ধুক বোঝাই করিল।

তারা এবং তাদের মামাতো খুড়তুতো মাসতুতো ভাইরা খুশি হইয়া কোঠাবালাখানায় গদি পাতিয়া বসিল।

 

সংসারে অন্য অভাব অনেক আছে, কেবল নিন্দুক আছে যথেষ্ট। তারা বলিল, খাঁচাটার উন্নতি হইতেছে, কিন্তু পাখিটার খবর কেহ রাখে না।

কথাটা রাজার কানে গেল। তিনি ভাগিনাকে ডাকিয়া বলিলেন, ভাগিনা, এ কী কথা শুনি।

ভাগিনা বলিল, মহারাজ, সত্য কথা যদি শুনিবেন তবে ডাকুন স্যাকরাদের, পণ্ডিতদের, লিপিকরদের, ডাকুন যারা মেরামত করে এবং মেরামত তদারক করিয়া বেড়ায়। নিন্দুকগুলো খাইতে পায় না বলিয়াই মন্দ কথা বলে।

জবাব শুনিয়া রাজা অবস্থাটা পরিষ্কার বুঝিলেন, আর তখনি ভাগিনার গলায় সোনার হার চড়িল।

 

শিক্ষা যে কী ভয়ংকর তেজে চলিতেছে, রাজার ইচ্ছা হইল স্বয়ং দেখিবেন। একদিন তাই পাত্র মিত্র অমাত্য লইয়া শিক্ষাশালায় তিনি স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত।

দেউড়ির কাছে অমনি বাজিল শাঁখ ঘণ্টা ঢাক ঢোল কাড়া নাকাড়া তুরী ভেরি দামামা কাঁসি বাঁশি কাঁসর খোল করতাল মৃদঙ্গ জগঝম্প। পণ্ডিতেরা গলা ছাডিয়া, টিকি নাডিয়া, মন্ত্রপাঠে লাগিলেন। মিস্ত্রি মজুর স্যাকরা লিপিকর তদারকনবিশ আর মামাতো পিসতুতো খুড়তুতো এবং মাসতুতো ভাই জয়ধ্বনি তুলিল।

ভাগিনা বলিল, মহারাজ, কাণ্ডটা দেখিতেছেন!

মহারাজ বলিলেন, আশ্চর্য শব্দ কম নয়।

ভাগিনা বলিল, শুধু শব্দ নয়, পিছনে অর্থও কম নাই।

রাজা খুশি হইয়া দেউড়ি পার হইয়া যেই হাতিতে উঠিবেন এমন সময়, নিন্দুক ছিল ঝোপের মধ্যে গা ঢাকা দিয়া, সে বলিয়া উঠিল, মহারাজ, পাখিটাকে দেখিছেন কি।

রাজার চমক লাগিল, বলিলেন, ঐ যা! মনে তো ছিল না। পাখিটাকে দেখা হয় নাই।

ফিরিয়া আসিয়া পণ্ডিতকে বলিলেন, পাখিকে তোমরা কেমন শেখাও তার কায়দাটা দেখা চাই।

দেখা হইল। দেখি বড়ো খুশি। কায়দাটা পাখিটার চেয়ে এত বেশি বড়ো যে, পাখিটাকে দেখাই যায় না, মনে হয়, তাকে না দেখিলেও চলে।

রাজা বুঝিলেন, আয়োজনের ক্রটি নাই। খাঁচায় দানা নাই, পানি নাই, কেবল রাশি রাশি পুঁখি হইতে রাশি রাশি পাতা ছিঁড়িয়া কলমের ডগা দিয়া পাখির মুখের মধ্যে ঠাসা হইতেছে। গান তো বন্ধই, চীৎকার করিবার ফাঁকটুকু পর্যন্ত বোজা। দেখিলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়।

এবারে রাজা হাতিতে চড়িবার সময় কানমলা-সর্দারকে বলি দিলেন, নিন্দুকের যেন আচ্ছা করিয়া কান মলিয়া দেওয়া হয়।

 

পাখিটা দিনে দিনে ভদ্র-দস্তুরমতো আধমরা হইয়া আসিল। অভিভাবকেরা বুঝিল, বেশ আশাজনক। তবু স্বভাবদোষে সকালবেলার আলোর দিকে পাখি চায় আর অন্যায়রকমে পাখা ঝটপট করে। এমন কি, এক-একদিন দেখা যায়, সে তার রোগা ঠোঁট দিয়া খাঁচার শলা কাটিবার চেষ্টায় আছে।

কোতোয়াল বলিল, এ কী বেয়াদবি।

তখন শিক্ষামহালে হাপর হাতুড়ি আগুন লইয়া কামার আসি হাজির। কী দমাদম পিটানি। লোহার শিকল তৈরি হইল, পাখির ডানাও গেল কাটা।

রাজার সম্বন্ধীরা মুখ হাঁড়ি করিয়া মাখা নাড়িয়া বলিল, এ রাজ্যে পাখিদের কেবল যে আক্কেল নাই তা নয, কৃতজ্ঞতাও নাই।

তখন পণ্ডিতেরা এক হাতে কলম, এক হাতে সড়কি লইয়া এমনি কাণ্ড করিল যাকে বলে শিক্ষা।

কামারের পসার বাড়িয়া কামারগিন্নির গায়ে সোনাদানা চড়িল এবং কোতোয়ালের হুশয়ারি দেখিয়া রাজা তাকে শিরোপা দিলেন।

 

পাখিটা মরিল। কোনকালে যে কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই। নিন্দুক লক্ষীছাড়া রটাইল, পাখি মরিয়াছে।

ভাগিনাকে ডাকিয়া রাজা বলিলেন, ভাগিনা, এ কী কথা শুনি।

ভাগিনা বলিল, মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।

রাজা শুধাইলেন, ও কি আর লাফায়।

ভাগিনা বলিল, আরে রাম!

আর কি ওড়ে।

না।

আর কি গান গায়।

না।

দানা না পাইলে আর কি চেঁচায়।

না।

রাজা বলিলেন, একবার পাখিটাকে আনো তো, দেখি।

পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, পাইক আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হু করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁখির শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল।

বাহিরে নববসন্তের দক্ষিণহাওয়ায় কিশলয়গুলি দীর্ঘনিশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ আকুল করিয়া দিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ