Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

পণ্ডিত মশাই ।। বনফুল

 

হরিপুরের লোয়ার প্রাইমারি স্কুলের যোগেন পণ্ডিত বড়োই মর্মাহত হলেন বৃদ্ধ বয়সে। নতুন যুগের নতুন চাল-চলনের সঙ্গে কিছুতেই তিনি মেনে চলতে পারলেন না। এখনও তিনি ছেলেদের পড়া মুখস্থ করতে বলেন, না পারলে শাস্তি দেন। কানমলা, চড়, চাপড়, বেঞ্চির ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া, কান ধরে হাঁটুগেড়ে বসানো এসব তো আছেই, বেতও মারেন। ত্যাঁদড় ছেলেদের মারের চোটে আধমরা করে ফেলেন।

এসব ছাড়া আর একটা কাজও করেন তিনি। বরাবরই করে এসেছেন। পাঠশালায় এসে ঘণ্টা দুই ঘুমোন।

প্রায় ক্রোশখানেক দূরে থাকেন তিনি এক সোনার বাড়িতে। সেখানে অনেক রাত্রি পর্যন্ত জাগরণ করে তাঁকে হিসাবপত্র লিখতে হয়। এর বিনিময়ে সেখানে তিনি থাকতে পান এবং সিধা পান। নিজের রান্না নিজেই করে নেন। অত্যন্ত রাশভারী লোক। সকলেই ভয় করে তাঁকে। ছাত্ররা আড়ালে বলে মহিষ পণ্ডিত। যেমন কালো রং তেমনি বলিষ্ঠ। চোখ দুটিও লাল। কেউ ঘাঁটাতে সাহস করে না সহসা।

এক ক্রোশ পথ হেঁটে প্রত্যহ বেলা বারোটা আন্দাজ যখন তিনি পাঠশালায় হাজির হন তখন তাঁর দুই পা হাঁটু পর্যন্ত ধুলি-ধূসরিত। জুতো বা ছাতার বালাই নেই। হাতে একটি ছোটো পুঁটলি থাকে। পুঁটলির ভেতর একখানি গামছা, কয়েকটি বই, চশমাটি এবং মশলার একটি ছোটো কৌটো ছাড়া আর বড়ো কিছুই থাকে না। স্কুলে এসেই তিনি আদেশ করেন- ওরে, জল আন। পাশের পুকুর থেকে ছাত্ররা জল বয়ে এনে দেয়। যোগেন পণ্ডিত পদপ্রক্ষালন করেন। পুঁটলি থেকে গামছা বের করে পা দুটি ভালো করে মোছেন। তারপর ছাত্রদের সাহায্যে ধরাধরি করে বেঞ্চিগুলো জোড়া দিয়ে নেন। তারপর মশলার কৌটা থেকে একটা লবঙ্গ এবং এলাচের দানা মুখে ফেলে দিয়ে পুঁটলিটি সযত্নে বেঁধে ফেলেন আবার। তারপর ছাত্রদের সম্বোধন করে বলেন, যাও, এইবার পড়া মুখস্থ করো গিয়ে। ঘুম থেকে উঠে পড়া নেব। একটি ভুল যেন না হয় কারো। হলে আর আস্ত রাখব না।

ছাত্ররা বেরিয়ে যায়। পুঁটলিটি মাথায় দিয়ে যোগেন পণ্ডিত জোড়া দেওয়া বেঞ্চির উপর শুয়ে পড়েন।

পাঠশালার সামনে প্রকাণ্ড বটগাছ আছে একটি। তারই তলায় বসে ছাত্ররা পড়াশোনা করে। ঘণ্টা দুই পরে পণ্ডিত মশায়ের নিদ্রাভঙ্গ হয়। ছাত্রদের দিয়ে আবার বালতি করে জল আনিয়ে তিনি চোখ-মুখ-নাক-কান ধুয়ে ফেলেন বিশেষ করে নাক আর কান। তাঁর নাক আর কান দুই-ই বেশ বড়ো। শুধু বড়ো নয়, লাজও আছে বেশ।

হাত-মুখ মুছে, বটগাছের একটি ডাল ভেঙে নিয়ে যোগেন পণ্ডিত পড়াতে বসেন। তারপর পড়ানো শেষ করে যখন ওঠেন তখন প্রায়ই দেখা যায় যে, ডালটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।

এমনি প্রত্যহ-

কিন্তু একটি ছেলে ফেল হয়নি আজ পর্যন্ত। যোগেন পণ্ডিতের স্কুল থেকেই প্রতি বছরই বৃত্তি পায়। বাচালও হয়নি একটি ছেলে। কারণ, শুধু স্কুলে নয় স্কুলের বাইরেও তাঁর প্রতাপ কম ছিল না। কারণ, কোনও ছেলে শাসন সত্ত্বেও উপযুপরি পড়া না পারলে কিংবা স্বভাব না বদলালে, যোগেন পণ্ডিত তার বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেন, তার মা বাপকে পর্যন্ত বকেন। ছেলে খারাপ হবে কি ? তার স্কুলের প্রত্যেকটি ছেলেকে শায়েস্তা না করা পর্যন্ত তার শান্তি নেই।

তিনি ছেলেদের মারতেন বটে, কিন্তু ভালোও বাসতেন। কতই বা মাইনে পান, কিন্তু তার থেকেই তিনি ভালো ছেলেদের পুরস্কার দিতেন, গরিব ছেলেদের বই কিনে দিতেন, কারও অসুখ হলে বারবার গিয়ে খোঁজ নিতেন তার বাড়িতে। দরকার হলে সেবা করতেন।

সংসারে তাঁর নিজের বলতে কেউ নেই। প্রথম জীবনে বিয়ে করেছিলেন বাঁকুড়ায়। সেইখানেই একটা স্কুলে পণ্ডিতিও করতেন। কিন্তু পত্নী বিয়োগ হলে আর সেখানে থাকতে পারলেন না। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে এখানে চলে এলেন। এখানেই পঁচিশ বছর কেটে গেছে। এখানকার স্কুলের ছেলেরাই তার সব। তাদের ওপর নিজের অধিকারও তিনি অপ্রতিহত রাখতে না।

কিন্তু যুগ বদলে গেছে। তার সাবেক-চাল আর সহ্য করতে পারছে না লোকে। এতদিন মুখ ফুটে সাহস করে কেউ কিছু বলতে পারছিল না, কিন্তু নতুন দারোগাবাবুর ছেলেটিকে যেদিন শাসন করলেন, সেইদিন থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত চলতে লাগল। ছ'ফুট লম্বা বলিষ্ঠ যোগেন পণ্ডিতের এমন একটা ব্যক্তিত্ব ছিল যে, দারোগাবাবুও সামনাসামনি তাকে কিছু বলতে করলেন না। কিন্তু তিনি ছাড়লেন না। পণ্ডিতের সমস্ত দুস্কৃতির বর্ণনা দিয়ে গ্রামের সমস্ত লোককে দিয়ে সই করিয়ে এক লম্বা দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন তিনি শিক্ষাবিভাগের কর্তৃপক্ষের কাছে। যোগেন পণ্ডিত ঘুনাক্ষরেও কিছু জানতে পারলেন না।

কিছুদিন পর দরখাস্তকারীদের মুখপাত্র দারোগাবাবুকে কর্তৃপক্ষ জানালেন যে, তদন্ত করার জন্য জেলার ইন্সপেক্টর শীঘ্রই যাবেন। হৃষ্ট হলেন দারোগাবাবু।

নির্দিষ্ট দিনে ইন্সপেক্টর ভূতনাথ ভৌমিক এসে হাজির হলেন এবং দারোগাবাবুকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন স্কুলে। যোগেন পণ্ডিত তখন প্রাত্যহিক দিবানিদ্রা শেষ করে আরক্ত নয়নে পড়াচ্ছেন ছেলেদের। স্কুলে গিয়েই কিন্তু ভূতনাথ ভৌমিক এমন অপ্রত্যাশিত একটা কাণ্ড করে বসলেন, যে দারোগাবাবুর চক্ষুস্থির হয়ে গেল। অত বড়ো জাঁদরেল একটা লোক, যোগেন পণ্ডিতকে দেখবামাত্র কেঁচোটি হয়ে গেল যেন। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করে এক পাশে দাঁড়িয়ে হাত কচলাতে লাগল কাঁচুমাচু হয়ে।

দারোগাবাবু জানতেন না যে ভূতনাথ ভৌমিক যোগেন পণ্ডিতের প্রাক্তন ছাত্র একজন। তিনি যখন বাঁকুড়ায় ছিলেন বালক ভুতনাথকে পড়িয়েছিলেন। যোগেন পণ্ডিতও কম আশ্চর্য হননি। একবার দেখেই তিনি ভূতনাথকে চিনতে পেরেছিলেন।

- আরে ভূতো নাকি! তুই এখানে হঠাৎ কি করে এলি ?

- আমি আজকাল স্কুল-ইন্সপেক্টর হয়েছি পণ্ডিতমশায়।

তাই নাকি! বেশ বেশ! তা এখানে কেন ? ও স্কুল ভিজিট করতে এসেছিস বুঝি ?

যোগেন পণ্ডিতের হাসি আকর্ষণ বিস্তৃত হয়ে গেল। চোখ থেকে উপচে পড়তে লাগল, গর্ব আর স্নেহ।

লজ্জিত ভূতনাথ ভৌমিক বললেন, না, এমনি একটু দরকারে এসেছি। কয়েকটি কথা আছে আপনার সঙ্গে।

- কি কথা?

- স্কুল ছুটি হয়ে যাক, তারপরে বলব।

স্কুলের ছুটি দিয়ে দিলেই তো হল। ওরে, তোরা সব বাড়ি যা আজ। ইন্সপেক্টরের অনারে ছুটি দিয়ে দিলাম তোদের। এ আমার ছাত্র জানিস ? প্রণাম কর সব।

- তারপর, তোর খবর কি, সব বল। বিবাহ করেছিস ? ছেলে-পিলে কটি ?

- দুটি ছেলে।

- বেশ বেশ।

নানা কথার পর অনেক ইতস্তত করে অবশেষে আসল কথাটি ভূতনাথ ভাঙলেন। দরখাস্তটিও দেখালেন। দেখিয়ে বললেন, আমি যখন এসেছি তখন কোন খারাপ রিপোর্ট দেব না। কিন্তু-

যোগেন পণ্ডিতের দিকে চেয়ে থেমে গেলেন ভূতনাথ।

যোগেন পণ্ডিত স্তব্ধ হয়ে দরখাস্তখানা দেখছিলেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি যেন। যাদের ছেলেদের জন্য এতকাল ধরে প্রাণপাত করেছেন তিনি, তারা তাঁর বিরুদ্ধে দরখাস্ত করেছে। প্রত্যেকটি সই তার পরিচিত। এদের মধ্যে অনেকে তার ছাত্রও।

খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে যোগেন পণ্ডিত বললেন, আমি আর এখানে থাকব না ভূতনাথ! কালই এখান থেকে চলে যাব।

- কোথায় ?

- যেদিকে দুচোখ যায়।

ভূতনাথ যোগেন পণ্ডিতকে চিনতেন। বুঝলেন তার কথার নড়চড় হবে না। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে তিনি বললেন, একটা কথা বলতে সাহস হচ্ছে না পণ্ডিত মশায়, যদি অভয় দেন, বলি।

- কি বল।

আপনি এখান থেকে চলে যাওয়াই যদি ঠিক করে থাকেন, তা হলে আমার বাড়িতে চলুন না, আমি আপনাকে মাথায় করে রাখব। আমার ছেলে দুটির ভার আপনি নিন, তাহলে আমি নিশ্চিত হই। টুরে টুরে ঘুরে বেড়াতে হয় আমাকে। একটু চুপ করে থেকে যোগেন পণ্ডিত বললেন, বেশ তাই হবে।

তার পরদিন খুব ভোরে হরিপুর ছেড়ে চলে যাবার আগে যোগেন পণ্ডিত গ্রামের সীমান্তে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে রইলেন গ্রামটার দিকে। তারপর চলে গেলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ