অনেকদিন আগের কথা, দু’দেশের মাঝে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না তখন। আমাদের গ্রামের
ইস্টিশনের উপর দিয়ে বরিশাল এক্সপ্রেস, ইস্ট বেঙ্গল এক্সপ্রেস যেত ঢাকায়। তবে সেসব
এক্সপ্রেস দাঁড়াত না এখানে। লোকাল আসত, যদিও শিয়ালদা থেকে সে গাড়ি আসতে পাঁচ-ছ’ঘন্টা সময় লাগত। কখনো-কখনো সাত ঘন্টাও লেগে যেত। তখন ডিজেল বা ইলেকট্রিক ছিল না, ছিল কয়লার ইঞ্জিন। গাড়ির গার্ড, ড্রাইভারদের সঙ্গে পাবলিকের চুক্তি থাকত কয়লা
ফেলার। কামরার জানলা
দিয়ে তাকালেই দেখা যেত বেতের ঝুড়ি, চটের বস্তা নিয়ে
লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে আছে লোকজন। গাড়ি স্লো হলেই আঁকশিতে টাকা বেঁধে ড্রাইভারকে
দিত, ড্রাইভার কয়লা
ফেলতে-ফেলতে এগোত। কখনো বা ইঞ্জিনের গরম কয়লা কুড়োতে গিয়ে হাত-পাও পুড়ে যেত। তারপর সেই কয়লার দখল নিয়ে চলত মারপিট, ঝগড়াঝাঁটি। এটা ছিল নিত্যিদিনের ঘটনা।
এই গল্পটা সেই সময়কার। রেলগাড়ি চললেও গাঁয়ের লোক খুব বিপদে না পড়লে,
খুব দরকার না হলে গাড়িতে
চড়ত না। রোগ জ্বালা হলে
ডাক্তার দেখাতেও কলকাতা যাবার কথা ভাবত না| তার কিছু কারণও ছিল।
রোগ বালাই হলে রেলগাড়িতে চড়ে শহরে ডাক্তার দেখাতে যেতে-আসতে রুগির অবস্থা আরো
খারাপ হয়ে যেত| সে যে শুধু সময়ের
জন্য হত তা নয়, কয়লার ইঞ্জিন
ভুস-ভুস করে কালো ধোঁয়া ছাড়ত, সেই ধোঁয়ার সঙ্গে
উড়ত কয়লার গুঁড়ো। রেলগাড়িতে যাচ্ছে আর চোখে কয়লার গুঁড়ো পড়েনি
এমন প্যাসেঞ্জার খুঁজে পাওয়া যেত না। বাড়ি ফিরত চোখ জ্বালা-ফোলা নিয়ে। তারপর ফর্সা জামা-কাপড় কালো করে ঘরে ফেরা সেসব
তো ছিলই। আর ছিল ভয়, শহরে সব সাহেব ডাক্তার, তাদের মুখে খটোমটো ইংরেজি শুনে আরোই ভয় পেয়ে
যেত রুগি। ভাবত, সাহেব ডাক্তার ছুরি-কাঁচি চালিয়ে পেট কেটে দেবে। তাই সবেধন নীলমনি গজেন ডাক্তারই ছিল আশপাশের
পাঁচটা গাঁয়ের মুশকিল আসন। তখনকার দিনে প্রেসক্রিপশন দেবার বালাই ছিল না,
গজেন ডাক্তারের ডিগ্রী
নিয়ে কারো আগ্রহও ছিল না। তবে লোকে বলত হেলাপ্যাথি ডাক্তার। সম্ভবত হেকিমি, হোমিওপ্যাথি আর অ্যালোপ্যাথের মধ্যে সন্ধি
হওয়াতেই এই নাম।
গজেন ডাক্তার শুধু ডাক্তারিই করতেন না, পুজোপাঠও করতেন। আশপাশের গ্রামে গজেন ডাক্তারের যজমান ছিল অনেক। তাদের বাড়ি ‘কলে’ যাবার আগে শালগ্রাম শিলার পুজো করে চরণামৃত শিশিতে ভরে তবে ঘোড়ায় চড়তেন। ঘোড়াটা এককালে তেজীই ছিল, বয়সের ভারে সেও গজেন ডাক্তারের মতো খানিক কুঁজো হয়ে গিয়েছে। তবুও ঘোড়ার পিঠে চড়ে গজেন ডাক্তারের যাবার দৃশ্য দেখতে দু-চারজন পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকত। ডাক্তার আসার খবর পেয়ে রুগির বাড়িতেও ভীড় করত গ্রামের লোক। গজেন ডাক্তার প্রথমেই রুগিকে হাঁ করিয়ে গলায় ঢেলে দিতেন চরণামৃত। তারপর দড়ি দিয়ে বাঁধা দু’খানা আতস কাচ নাকের ডগায় ঝুলিয়ে নাকে মুখে ধুতির খুঁট চাপা দিয়ে উবু হয়ে বসে একটা প্যাকাটি হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতেন রুগির মল। আগেই বলেছি হেলাপ্যাথি ডাক্তার গজেন লাহিড়ি হেকিমি চিকিৎসা করতেন। হেকিমি চিকিৎসায় রুগির মলমূত্রের চাক্ষুষ পরীক্ষা বিধি আছে। রুগির মলে বড়ো-বড়ো কৃমি থাকলে ডাক্তারের উল্লাস দেখে কে!
হুঙ্কার ছাড়তেন, জানতাম! আমি আগেই জানতাম পেটের মধ্যে বাসা হয়েছে। তবে আমিও গজেন লাহিড়ি! কত কাক-বকের বাসা ভেঙেছি ছোটোবেলায়, এ তো আমার বাঁ হাতের খেল।
সত্যি-সত্যি বাঁ হাত দিয়ে ধুতির খুঁট খুলে বের করতেন (ডান হাতে মল খোঁচানো কাঠি) গাঢ় সবুজ রঙের একটা শিশি। ওই শিশি দেখেই রুগি চেঁচাতে থাকত, গজেন ডাক্তার ওসবে ভ্রূক্ষেপ না করে জোর করে রুগির মুখে ঢেলে দিতেন শিশির তরল। গুচ্ছের কালমেঘ, শিউলিপাতা, বেলপাতা, নিমপাতার রসের সঙ্গে আরো কিছু গাছ-গাছড়া মেশানো হাক্কুস তেতো, বিকট গন্ধের সে পাঁচন খেয়ে রুগির নাড়ি ছিঁড়ে যাবার উপক্রম। ওয়াক থুঃ, ওয়াক থুঃ করে চেঁচালেও গজেন ডাক্তারের হাত থেকে রোগ বা রুগির নিস্তার ছিল না।
সব রোগে হেকিমি চিকিৎসা চলত না, যাদের পেট ব্যথা, খাবারে অরুচি, বমি ভাব তাদের জন্য ছিল এই দাওয়াই। অল্পবিস্তর জ্বর জ্বালা হলে ময়দার মতো সাদা গুঁড়োর মধ্যে ছোট্ট শিশি থেকে দু-এক ফোঁটা কি যেন ঢেলে পুরিয়া করে দিতেন। লোকজন তাই ভক্তিভরে মাথায় ঠেকিয়ে প্রসাদের মতো করে খেত| ওষুধ খেলে সাতদিন, না খেলে একসপ্তাহ এই নিয়মে সেরেও যেত কিছু-কিছু রোগ। রোগ নিরাময় হলে খুশি হয়ে বাড়ির আম, কাঁটাল আনত ধামা ভরে। মোট কথা গ্রামের অন্য লোকজনের অভাব থাকলেও গজেন ডাক্তারের ঘরে মা লক্ষ্মী বাঁধা ছিল। তবে ডাক্তার হেকিমি, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করলেও কোনোদিন এলোপ্যাথ চিকিৎসা করেননি| মাঝে-মাঝে সুঁই ফুটিয়ে দেব বলে হুঙ্কার ছাড়তেন। কেউ কখনও সে সুঁই চোখে দেখেনি।
কিন্তু দিন তো সবসময় সমান যায় না। বয়সের ভারে গজেন ডাক্তার আর দূর গ্রামে যজমানি করতে যেতে পারে না। যজমানরা রোগের চিকিৎসা করতেও আসে না বিশেষ। কিছুদিন যাবৎ গজেন ডাক্তারের শরীর ভালো যাচ্ছে না। হাঁপানি, কাশিতে একেবারে জেরবার হয়ে আছেন। গাছ-গাছড়ার শেকড়-বাকড় খল নোড়ায় বেটে রস করে খেয়েও সুবিধা করতে পারছেন না। রোজগারপাতি না থাকায় পথ্যও জোগাড় করতে পারছেন না।
এর মধ্যে একদিন খবর পেলেন গঞ্জের বাজারে সপ্তাহে দু’দিন করে এলোপ্যাথি ডাক্তার বসছে। হেলাপ্যাথি নয় এলোপ্যাথি। অসুখের বাড়াবাড়ি হলে সে ডাক্তার সুঁই ফোটাচ্ছে| সে সুঁই নাকি এমনভাবে পুশ করছে যেন মাখন লাগাচ্ছে চামড়ায়, রুগি পিঁপড়ের কামড়ও টের পাচ্ছে না। গঞ্জের ডাক্তারের নাম যাই হোক না কেন, লোকজন তাকে মাখন ডাক্তার বলে ডাকছে। সবার মুখেই এক কথা, ডাক্তার তো নয় সাক্ষাৎ ভগবান।
যজমানি ব্যবসা, ডাক্তারি ব্যবসা সবই তলানিতে এসে ঠেকেছে। গজেন ডাক্তারের সংসার চালানোই দায়। পাঁচটা পার করলেও ঘরে এখনও দুটি বিয়ের যুগ্যি মেয়ে। গজেন ডাক্তার ভেবে দেখলেন উনি যদি ভেক ধরে চাদর মুড়ি দিয়ে মাখন ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাতে যান তবে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। নিজের শরীরটাও সারবে, সেই সঙ্গে সুঁই ফোটানোর ব্যাপারটা দেখেও আসতে পারবেন। চাই-কি দু’একটা রোগের ওষুধের এলোপ্যাথি নাম-ধামও জেনে আসতে পারবেন। দরকার হলে প্রতুল দত্তর ছেলেটাকে দিয়ে কলকেতা থেকে আনাবেন। শুনেছেন সে নাকি কোন সাহেবের কাছে কাজ করে। আর সুঁই তো তার ঘরে মজুত আছে বিশ বছর আগে থেকেই। জং ধরে গেলে নারকেল তেল ঘষে নিলেই হবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ| গজেন ডাক্তার নিজের চিকিৎসার জন্যে বৌয়ের গলার ধান তাবিজ বন্দক দিয়ে টাকা জোগাড় করে নাম ভাড়ালেন, হয়ে গেলেন ভজন ভাদুড়ি। অতি উৎসাহে ভুলেই গেলেন ও নামে তার নিজেরই আত্মীয় আছেন একজন। মাখন ডাক্তার সত্যিই মাখন, যেমন অমায়িক ব্যবহার, তেমন চিকিৎসা। দু’সপ্তাহ যেতে না যেতেই গজেন ডাক্তার বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। কথাবার্তার ফাঁকে কিছু ওষুধপত্তরের নামও জেনে নিয়েছেন। ভেবেছিলেন আর কয়েকদিনের মধ্যেই এলোপ্যাথি বিষয়টা ভালোমতো বুঝে ফেলবেন। কিন্তু বিধি বাম, সবে মাখন ডাক্তারের ওখানে সুঁই ফোটানোর ব্যাপারটা ভালো করে জানছেন তখনই ঢুকল আসল ভজন ভাদুড়ি। ধরা পড়তে-পড়তে জোর বেঁচে গেছেন গজেন ডাক্তার। সেই সময় যদি জরুরি কলে মাখন ডাক্তার না বেরিয়ে যেতেন কেলেঙ্কারির একশেষ হত!
সে যা হত, হত। হয়নি যখন তখন আর কি! শরীর ভালো হতে চণ্ডীমন্ডপের মজলিশে জমিয়ে বসে হুঁকোয় টান দিয়ে বলতে শুরু করলেন, ছোঃ! সেদিনের ছেলে ও আবার ডাক্তার হবে কি? যা শুনছি, সবই লোক ঠকানো। সুঁই ফোটাবে রুগি টের পাবে না, তাই কখনও হয়? তোমরাই ভালো করে ভেবে দেখো বাড়িতে বৌ-ঝিরা যখন কাঁথা ফোড়ায় তখন কি করে?
কী করে? কী করে?
সুঁইয়ের খোঁচা লাগে বলেই তো আঙুলে টুপি পরে।
ঠিকই তো! ঠিকই তো!
এবার ঘটনাটা তোমরাই বুঝে দেখো। এইটুকু বলেই উঠে পড়লেন আসর থেকে।
বিশেষ পিড়াপিড়ি করলে বললেন, অমন এলোপ্যাথি চিকিচ্ছে আমিও করতে পারি। ও বিদ্যে ঢের জানা আছে আমার। তোমরা জানোই তো টাকা-পয়সার খাঁই আমার কোনোকালেই ছিল না। তোমরা যে যেমন পেরেছ দিয়েছ, কোনোদিন কতাটি পর্যন্ত কইনি। এমনকি সুঁই ফুটিয়েও টাকা নিইনি কখনও।
তবে যা শুনলাম তোমাদের মাখন ডাক্তার নাকি ডাকাত! কলা-মুলোতে রুগি দেখে না, টাকা না বাজলে রুগি দেখে না। এই শেষের কথাটা এক্কেবারে মোক্ষম বলেছেন গজেন ডাক্তার। পকেটে টাকা না বাজালে মাখন ডাক্তার রুগি ছুঁয়ে দেখে না।
এইপর্যন্ত বলে পিছনে না তাকিয়ে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে চলে গেলেন গজেন ডাক্তার।
সবাই নানারকম আলোচনা করতে নিবারণ খুড়ো গলা খ্যাঁকাড়ি দিয়ে বলল, তোমরা সব থামো দিকিনি বাপু। ভালো করে ভাবতে দাও। কী বলে গেল গজেন? সুঁই ফুটিয়েও টাকা নেয়নি, বলি সুঁই ফোটালো কবে যে টাকা নেবে?”
তারপর সে একটা কাণ্ড হল! কেউ বলে, ওই তো সেবার রমেনের ছেলের ভেদবমি হল তখন দেখেছিলাম এই এত্তো বড়ো সুঁই ঘচাৎ করে
ফুটিয়ে দিয়েছিল রমেনের ছেলের পেটে| সাক্ষী দিতে
রমেনের ছেলেকে ডাকা হল, রমেন বছর পাঁচেক
আগেই ভবের খেলা শেষ করেছে তাই তাকে পাওয়া গেল না। রমেনের ছেলে সুষেন বলবে কি! সে তো এমনিই ভুলো,
ওবেলা কি দিয়ে ভাত খেয়েছে
জিজ্ঞেস করলে তাই বলতে পারে না। ও কি করে ছোটোবেলার কথা বলবে! যাইহোক শেষ
পর্যন্ত এই ঠিক হল নিবারণ খুড়ো যখন সন্দেহ প্রকাশ করেছে তখন নিবারণ খুড়োই যাবে
গজেন ডাক্তারের বাড়ি। খুড়োর শরীর ইদানিং মোটেই ভালো যাচ্ছে না। বাত, পিত্ত, শ্লেষ্মা সব
একেবারে চেপে ধরেছে। মাঝেমধ্যে নাকি জ্বরও আসছে ঝেঁপে।
পরেরদিন সকালবেলাতেই গজেন ডাক্তারের বাড়ির বাইরে থেকে হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল। প্রথমটা একটু হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিলেন, বুঝলেন ওষুধ ধরেছে। রুগি আসতে শুরু করেছে। কিন্তু এদের কারো হাতেই তো আম-কাঁটালের ঝুড়ি নেই এমনকি মানকচু পর্যন্ত নেই। না, বিনি পয়সায় আর চিকিচ্ছে করবেন না গজেন ডাক্তার। চোখের সামনে মাখন ডাক্তার পকেট ভরে টাকা বাজাতে-বাজাতে বাড়ি যাচ্ছে আর গজেনের বেলায় ফক্কা! বেড়াল মারতে হয় প্রথম রাতে, সে-কথা স্মরণ করে হাঁক পাড়লেন, রুগি কে? নগদ টাকা এনেছ তো? দেখ বাপু ধারে-বাকিতে কাজ নেই আমার।
বলে কি গজেন ডাক্তার? এ যে খুব রোয়াব! তবে কি সত্যি-সত্যিই সুঁই ফোটাবে?
তারপর এক টাকায় রফা হল। টাকাটা আগামই দিল নিবারণ খুড়োর ভাইপো। অন্দরে গিয়ে গিন্নির হাতে টাকাটা দিয়ে সিরিঞ্জ, নারকেল তেলের শিশি বের করলেন গজেন ডাক্তার। ঘর থেকে আর বেরন না, সবাই ভাবল ওষুধ তৈরি করছেন। তারপর সিরিঞ্জ বেশ করে ধুতির খুঁটে মুছে গরম জল, তুলো, ওষুধের ভায়াল, সিরিঞ্জ নিয়ে বাইরে বের হলেন। সিরিঞ্জ তো নয় যেন বস্তা সেলাই করার গুণসুঁই! সরঞ্জাম দেখেই নিবারণ খুড়োর আত্মারাম খাঁচাছাড়া, এরপরে ধুতির কষি খুলে পশ্চাত দেশের কাপড় তুলে শুইয়ে দিতেই কাঁপতে লাগল খুড়ো| ওদিকে গজেন ডাক্তারও কাঁপছে। কাঁপা-কাঁপা হাতে পিস্টনকে সামনে-পিছনে টেনে ফুঁ-টু দিয়ে যেই না সিরিঞ্জ ভায়ালে ঢুকিয়ে ওষুধ টানতে গিয়েছেন, সিরিঞ্জ সামান্য একটু ঢুকেই নট নড়ন-চড়ন। এখন উপায়? চাঁদা তুলে ঠ্যাঙানি খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে হলে উপায় একটাই, অভিনয়! ছোকরা বয়সে গজেন ডাক্তার কৃষ্ণযাত্রার দলে প্লে ভালোই করতেন। তাই হাত কাঁপলেও মুখের জোর ছাড়লেন না।
তোরা সব নিবারণ খুড়োকে বেশ শক্ত করে চেপে ধর। যদি নড়ে যায়, তবে সুঁই গায়ে গেঁথে থাকবে আর তোলা যাবে না। সে সুঁই তোলা তোমাদের ওই মাখন ডাক্তারের কম্মো না। শেষে শহরে গিয়ে গোরা ডাক্তার দেখাতে হবে, কাটা-ছেঁড়া করতে হবে। সেলাই-ফোড়াই করতে হবে।
তখন কিন্তু আমায় দোষ দিলে চলবে না।
গজেন ডাক্তারের বাক্য যত শোনে খুড়ো, তত কাঁপে। একেবারে ম্যালেরিয়া জ্বরের কাঁপুনি। এদিকে গজেন ডাক্তার ভায়ালের মধ্যে সূঁচ ঢোকাতে না পেরে অনেক কসরত করে সূঁচ বের করে নিয়ে খাড়া করে বাগিয়ে ধরে যেই না নিবারণ খুড়োর কাছে গিয়েছে, খুড়ো যেন বুড়ো হাড়ে ভেলকি দেখাল। জোয়ান-জোয়ান ছেলেগুলোর হাত ছাড়িয়ে ধুতির মায়া ত্যাগ করে নাগা সন্ন্যাসী হয়ে দিল দৌড়! যদিও বেশি দূর যাওয়ার আগেই গরুর খুঁটোয় পা বেঁধে চিৎপটাং।
গজেন ডাক্তার বলতে লাগলেন দেকো দিকি, ই কি কাণ্ড! সুঁই দেখে ভয় পেলে রোগ সারবে কী করে? তোমরা সবাই সাক্ষী রইলে, কেউ কিন্তু আমাকে দোষ দিও না। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিছি।
তারপর সাদা ময়দার গুঁড়োর মতো দ্রব্যের উপরে তিন-চার ফোঁটা শিশির জলের মতো ওষুধ ঢেলে নিজে হাতে নিবারণ খুড়োকে খাইয়ে দিলেন। এরপরেও কি কেউ গজেন ডাক্তারকে দুষতে পারে?
ঘটনা পল্লবিত হয়ে পাঁচখানা গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ল। যে-ই শুনল সে-ই বলল, না-না সে কি কথা! রুগি ডাক্তারকে দেখে পালিয়ে গেলে ডাক্তারের দোষ কোথায়?
এরপরে গজেন ডাক্তারের এলোপ্যাথ চিকিৎসা নিয়ে কারো মনেই কোনো সন্দেহ রইল না| তবে এরপরে কেউ আর সুঁই ফোটাতে গজেন ডাক্তারের কাছে যায়নি। সে অবশ্যি সবদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। সিরিঞ্জ আবার ঢুকে গিয়েছে আলকাতরা মাখানো টিনের তোরঙ্গে।
আনন্দের কথা, এই ঘটনার পর, দিন ফিরেছে গজেন ডাক্তারের। আবার কলাটা-মুলোটা নিয়ে রুগি আসছে হেলাপ্যাথি ডাক্তার গজেন লাহিড়ির কাছে। কিন্তু গজেন ডাক্তার নিজেই বুঝতে পারছে, যত কায়দাই করুন আর রুগি ধরে রাখতে পারবেন না।
হেলাপ্যাথির জাদু আর কাজ দিচ্ছে না। শেষবেলার সূর্যের মতো হেলে পড়েছে মাথাভাঙা নদীর বুকে। এখন শুধু অপেক্ষা, টুপ করে ডুবে যাওয়ার। নিজের অজান্তেই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন হেলাপ্যাথি ডাক্তার গজেন লাহিড়ি।
0 মন্তব্যসমূহ