Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ডিগবাজি খাঁ ।। রবীন্দ্রনাথ সেন

 

 

ডিগবাজি খাঁ ছিল শেয়ালদের মধ্যে ভারি শেয়ানা। কোথাও কিছু হলেই ডিগবাজি খাঁ লাফিয়ে, এমন ডিগবাজি খেত যে সবাই বলত- সাবাস্-সাবাস! চারদিকে তার নাম এমন রটে গেল যে, কারো বাড়ির ছাগল-ভেড়া হারিয়ে গেলে সবাই বলত- এটা ডিগবাজি খাঁর কারসাজি। রাত্রিবেলা চুপি-চুপি লোকের বাড়িতে ঢুকে মোরগ থেকে শুরু করে মালপো অবধি সবই সে খেয়ে মেরে দিত। লোকেরা ডিগবাজি খাঁকে পাকড়াও করবার জন্য কতরকম কৌশল করত, কিন্তু কিছুতেই সে ধরা পড়ত না। সেজন্য তার মানও বেড়ে গেল অনেক।

সেই সময় বনে এসে জুটল এক ফেউ, সে এসেই ডিগবাজি খাঁর পিছু লাগল, ফেউ বলে বেড়াতে লাগলো, বাঘ-মামা নেই, কাজেই ডিগবাজি খাঁর এমন কেরামতি। কথায় বলে বনগায়ে শেয়াল রাজা। কিন্তু ডিগবাজি খাঁকে রোজ-রোজ এত ভালো খাবার খেতে দেখে ভিতরে-ভিতরে ফেউয়ের ভারি লোভ হল, তাই সর্বদাই সে ডিগবাজি খাঁর খোঁজ নিতে লাগল।

একদিন ডিগবাজি খাঁ কোথা থেকে ভেড়ার একটা আস্ত ঠ্যাং কুড়িয়ে এনেছে। ভাবল, কাঁচা মাংস খায় সব ছোটোলোকেরা। আমি মাংসটা কালিয়া করে খাবো। এই না ভেবে ডিগবাজি খাঁ খানিকটা গরম বালি এনে তার তলায় মাংসটা গুঁজে দিল। এরকম করেই বরাবর কালিয়া তৈরি করে। ভাবল, কালিয়া তৈরি হতে তো অনেক দেরি, এইবেলা একটু ঘুমিয়ে নি'। কতকগুলি পাতা কুড়িয়ে এনে নরম বিছানা করে ডিগবাজি খাঁ তার উপর শুয়ে পড়ল, ঝিরঝিরে হাওয়ায় একটু বাদেই সে ঘুমিয়ে নাক ডাকাতে শুরু করল।

ফেউ এদিকে ঘুরতে-ঘুরতে সেখানে এসে হাজির। এসে দেখে, ডিগবাজি খাঁর নাক ডাকছে কো-কো কোৎ। ফেউ শুঁকে বুঝল তোফা মাংস কেউ রেঁধেছে। নিশ্চয়ই কালিয়া! আশেপাশে তাকালো, কোথাও কিছু নেই! ভারি মজা!

শুঁকতে-শুঁকতে ফেউ বালির কাছে এল, বালি উলটে দেখলে এক টুকরো মাংস!

আর কথা কি, ফেউ মাংসের টুকরোখানা বের করে খেয়ে ফেলল। ভাবলো ডিগবাজি খাঁ আজ খুবই জব্দ হবে। তারপর মজা দেখবার জন্য মাংসের রস খানিকটা ডিগবাজি খাঁর গোঁফে মাখিয়ে আর হাড়খানা বালির নিচে গুঁজে সে চুপচাপ সরে পড়ল।

অনেক বেলায় ডিগবাজি খাঁ ঘুম থেকে উঠল। অনেকটা সময় ঘুমিয়েছে, কাজেই পেটে খিদেও চনচনে হয়ে উঠেছে। বার দুই হাই তুলে, বালি খুঁড়ে দেখে মাংসের বদলে শুধু একখানা শুকনো হাড়। ওমা! ভুরভুরে সুবাসও তো তার মুখ থেকে আসছে। জিভ দিয়ে চেটে দেখল, মাংসের রসই তো বটে। সে ভাবলাো, তবে আমিই বুঝি মাংসখানা খেয়ে হাড়খানা ফেলে রেখেছি। কিন্তু তবে পেটে এত খিদেই বা হল কেন ? কিছুই সে আর ঠিক বুঝতে পারল না। হঠাৎ বালির উপর চেয়ে দেখে, ফেউয়ের পায়ের দাগ। আঃ! এ তো সেই ফেউ ব্যাটার কাজ, মাংস খেয়ে হাড়খানা রেখে গেছে। আবার চালাকি করে মাংসের রস মুখে মাখিয়ে দিয়ে গেছে। রসো বাবাজি, চোরের উপর বাটপারি করবার মজা দেখাচ্ছি!

ডিগবাজি খাঁকে পলটনের ঘোড়ার মতো ছুটে আসতে দেখেই ফেউ ভাবলো এইবার একটা উপায় বের না করলে যে মহা ফ্যাসাদ। তাড়াতাড়ি সে ঢিপির ধারে গিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে লাগল। ঢিপির পিছনে রবি ডুবছে, টিপির উপরের গাছপালা সেই আভায় লাল হয়ে উঠেছে।

ফেউকে কাঁদতে দেখে ডিগবাজি খাঁ বলল, কি হয়েছে ?

ফেউ বললে, দেখছ না, কি বিপদ! বনে আগুন ধরেছে, বন পুড়ে গেলে আমাদের ঘরদোর কিছুই থাকবে না। দাঁড়াও, সবাইকে খবর দিয়ে আসি, জল এনে আগুন নিবুতে হবে।

ডিগবাজি দাঁড়িয়ে রইল। ফেউ জল আনতে ও অন্য সবাইকে খবর দিতে চলে গেল।

কিছুক্ষণ বাদে সন্ধ্যা হতেই ঢিপির গাছপালা কালো হয়ে উঠল। ডিগবাজি বুঝতে পারল, কোথাও আগুন লাগেনি, সবই ফেউ-এর চালাকি। সে আবার ছুটল, এবার ফেউকে জব্দ না করে সে কিছুতে ছাড়ছে না।

এদিকে ফেউ কয়েকটা কাঁকড়া ভোজ সেরে কুয়োর ধারে বসে আছে। তখন ডিগবাজি খাঁ এসে হাজির। এসে দেখল পেটে হাত বুলিয়ে ফেউ মোটারকম হাই তুলছে।

ডিগবাজি খাঁ বললে, বড়ো যে চাল চেলেছ বাবাজি!

ফেউ বললে, আরে খুড়ো, বড়ো থিদে পেয়েছিল, তাই আধখানা মালপো খেয়ে দম ফেলছি।

একেই ডিগবাজি খাঁ সারাদিন কিছু খায়নি, পেটে খিদে চনচন করছে, তারওপর মালপোর নাম শুনেই তার জিভে জল গড়িয়ে এল। সে বললে, আর আধখানা কি করলে খুড়ো ?

ফেউ বললে, ভারি সরেস মালপো খুড়ো, তোমার জন্যে আধখানা রেখে দিয়েছি।

ডিগবাজি খাঁ বললে, কোথায় রেখেছ বলো দেখি ?

ফেউ কুয়োর মুখের কাছে গিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বললে, খুব সাবধানে রেখেছি, কেউ দেখলে খেয়ে ফেলতো নিশ্চয়।

নবমীর আধখানা চাঁদের ছায়া কুয়োর জলে পড়েছে।

ডিগবাজি খাঁ ভাবলে, তাইতো, আধখানা মালপোই তো বটে। অমনি ডিগবাজি খেয়ে কুয়োর ভিতর সে লাফিয়ে পড়ল। ফেউ তখন হাসতে-হাসতে বাড়ি গেল।

কুয়োর জলে পড়ে ডিগবাজি খাঁ ক্রমাগত হাবুডুবু খেতে শুরু করেছে। এদিকে এক বলদ গোঁজকাঠি সহ গলায় লম্বা এক গাছি রশি ঝুলিয়ে সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। যেতে-যেতে হঠাৎ নজরে পড়ল, কুয়োর ভিতর ডিগবাজি খাঁ হাবুডুবু খেয়ে জলে ভুরভুরি ছাড়ছে।

বলদ বললে, কুয়োর ভিতর সেঁধিয়ে পড়লে কী করে খাঁ মশাই ?

ডিগবাজি খাঁ উত্তর দিল, ভারি বোকা তো! পড়ে যাব কেন রে ? আমার বাসা থেকে এখানে আসবার তো সোজা পথ।

বলদ আবার বললে, ওখানে করছ কী ভায়া ? ডিগবাজি খাঁ বললে, অতটা যদি বুঝবে, তবে আর লোকে তোমায় বলদ বলবে কেন। আরে ভাই, মিছরির কাঁচা সরবৎ বিনি পয়সায় পেয়েছি। খেয়ে তাই ঢেঁকুর উঠছে। ভারি সরেস সরবৎ, যত খাই ততই খাবার লোভ হয়।

সরবতের নাম শুনে বলদের তো ভারি লোভ হল।

সে বললে, ভাই, একটু সরবৎ পেলে নিতুম বিনি পয়সায় তাই লোভও হয়।

ডিগবাজি খাঁ বললে, আলবৎ, কেন খাবে না। তোমার গলার ওই মোটা রশিখানা কুয়োর মধ্যে ঝুলিয়ে দাও, এক হাঁড়ি সরবৎ তাতে গিট বেঁধে দি।

সেই কথা শুনে বলদ গলার মোটা দড়িখানা কুয়োর ভিতর ফেলে দিতেই ডিগবাজি খাঁ তা বেয়ে উপরে উঠে বললকে বললে, ভাই, অসময়ে তুমি আমার বড়োই উপকার করলে। এই বলে ডিগবাজি খাঁ বনের ভিতর ছুটে গেল।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ