''জলই জীবন''। কথাটা আমাদের হাড়ে-মজ্জায় জানান দিচ্ছে দিন
কয়েক ধরে। একটা যে ভয়ঙ্কর দিন ক্রমশ এগিয়ে আসছে তা আমরা বেশ বুঝতে পারছি।
মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায়
এসব নিয়ে আকছার চর্চা চলছে। পাড়ার চা দোকান থেকে শুরু করে ট্রেনে-বাসেও আলোচনার
বিষয় হয়ে উঠেছে- ''জল সংকট''। কিন্তু এই
অবস্থা থেকে কী আমাদের সভ্যতাকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই। সবকিছুই কী হাতের বাইরে
চলে গেছে ? তাহলে কী 'মায়া' আর 'হরপ্পা' সভ্যতার মতো
আমাদের এই সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য ?
তোমরা অনেকেই হয়ত মনে
করবে এত উন্নত একটা সভ্যতা ধ্বংস হবে বললেই হল ? পৃথিবী জুড়ে এত-এত সমাজবিজ্ঞানী, পরিবেশবীদ, নেতা-নেত্রী
ইত্যাদি-ইত্যাদিরা থাকতে!
বিশ্বাস করতে তো কারোরই
মন চায় না। আমরা প্রত্যেকেই চাই- এত সুন্দর পৃথিবী, এত সুন্দর গড়ে ওঠা সভ্যতা বেঁচে থাক অনন্তকাল
ধরে। শূণ্য-শূণ্য আর শূণ্য! অনন্তকাল ধরে ব্রহ্মাণ্ডে অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের মতো
আমাদের এই পৃথিবীটাও জনমানবহীন হয়ে আকাশের মাঝে ঘুরে চলছে- এমনটা মেনে নিতে মন
চায় না যে কিছুতেই। কিন্তু সত্য যে বড়োই কঠিন, সে সত্যই। আর তাই বোধহয় একদিন ধ্বংস হয়ে
গিয়েছিল পৃথিবীর বুক থেকে এক সময়ে গড়ে ওঠা 'মায়া' আর 'হরপ্পা' সভ্যতা। এখন ভয় মেশানো একটাই প্রশ্ন আমাদের
মনের মাঝে কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে- তবে কী আমরাও!
অনেকেই জানো, 'মায়া' বা 'হরপ্পা' সভ্যতাও কিন্তু
যথেষ্ট উন্নত ছিল। আর এই দুই সভ্যতার ধ্বংসের কারণ খুঁজতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা
নানাকারণ খুঁজে পেয়েছেন। তার মধ্যে অধিকাংশের মত কিন্তু এই ''জল সংকট''। কী ছিল-না 'মায়া' সভ্যতায়, কিংবা 'হরপ্পা'য়।
বলা হয় বিশ্বের
সর্বাপেক্ষা ঘন জনবসতি ও সংস্কৃতিভাবে গতিশীল একটি সমাজ গড়ে তুলেছিল 'মায়া' সভ্যতা।
মেক্সিকোর দক্ষিণে এবং উত্তর-মধ্য আমেরিকাতে বসবাস ছিল তাদের। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০
থেকে ২৫০ অব্দ পর্যন্ত মায়া সভ্যতার সময় প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এর মধ্যে
প্রাচীনকালে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত মায়ানগরীগুলি
উন্নতির উচ্চশিখরে পৌঁছে ছিল।
বিশাল-বিশাল স্থাপত্য
নির্মাণ করেছিল। উন্নত পদ্ধতিতে জল সেচের মাধ্যমে চাষাবাদ করত তারা। ছোটো শহর থেকে
বড়ো শহর গড়ে তুলেছিল 'মায়া'র মানুষেরা। সে
যুগে প্রথম লিখিত শিলালিপি 'মায়া হায়ারোগ্লিফর' চিহ্নিত করা হয়েছিল। তারা একটি শিলাস্তম্ভের
উপর প্রথম 'মায়া
জ্যোতিষপঞ্জিকা'ও তৈরি করে। সে
সময়ে 'মায়া পিরামিড'ও গঠন করা হয়।
মায়াদের শ্রেষ্ঠতম যুগে বড়োধরণের নির্মাণ এবং নগরবাদ, বিস্ময়কর
শিলালিপির লিপিবদ্ধ এবং উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক শিল্পকর্মে উন্নয়ন ও কৃষিতেও
অত্যধিক বিকশিত হয়েছিল 'মায়া সভ্যতা'।
অবাক হওয়ার মতো ছিল
তাদের জীবনযাত্রা। একজন মায়া সম্রাট এবং অভিজাতদের জীবনযাত্রা ছিল বিলাসবহুল।
সাধারণত জন্তু-জানোয়ারের চর্ম ও লোম থেকে তৈরি বস্ত্র তারা পরিধান করত।
মহামূল্যবান রত্ন ও সোনার গহনা তারা ব্যবহার করত। প্রতিদিন তারা স্নান করত। স্নান
করাটা ছিল তাদের কাছে যেন সংস্কৃতির অঙ্গ।
মায়াদের প্রধান খাদ্য
ছিল ভুট্টা। এই ভুট্টা দিয়েই নানারকমের খাবার তৈরি করে খেত তারা। মায়াদের কাছ
থেকেই আমরা বিভিন্ন প্রকার খাবার খেতে শিখেছি। যেমন চকোলেট। কাকাও গাছ থেকে তারা
চকোলেট তৈরি করত। আর এই চকোলেটকে তারা ঈশ্বরের দান মনে করত।
কাকাও মায়া সভ্যতার কাছে
খুবই গুরুত্বপূর্ণ গাছ ছিল। এর বীজকে তারা মুদ্রার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করত। ঠিক
একসময়ে যেমন আমরা সামুদ্রিক কড়িকে ব্যবহার করতাম।
বাগান ঘেরা নিখাদ
গ্রানাইট দিয়ে অভিজাতদের বাড়ি তৈরি হতো। যেখানে থাকত স্নানাগারও। তবে দরিদ্র
পরিবারগুলি মাটির তৈরি বাড়িতে বাস করত। কিন্তু তাদেরও ছিল শৌচাগার, রান্নাঘর, পৃথক শয়নকক্ষ
এবং প্রার্থনা ঘর।
অনেকেই মনে করেন মায়ারা
ভলিবলের জনক। বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে তারা নাচ-গান, খেলা অভিনয় প্রভৃতিতে অভ্যস্থ ছিল। ধর্মীয়
দিবস পালনেও তারা পিছিয়ে ছিল না।
মায়া সভ্যতার পতনের কারণ
হিসেবে পরিবেশ দূষণ ও খরাকেই বহুলাংশে দায়ী করা হয়। মায়া জনগোষ্ঠীরা এক সময় অতিরিক্ত
প্রাণী শিকারের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে ছিল বলে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া
যায়। সম্প্রতি পণ্ডিত সমাজ মনে করছে যে, ২০০ বছরের একটি তীব্র খরা মায়া সভ্যতা পতনের
কারণ। তারা বনভূমিকে কেটে চাষাবাদের যোগ্য জমিতে রূপান্তরিত করায় এবং নগরায়নের
প্রক্রিয়াজারি রাখায় বাষ্পীভবন হ্রাস পায় এবং পরে বৃষ্টিপাতের হ্রাস ও প্রাকৃতিক
খরা বিবর্ধক ঘটে। এত উন্নত সভ্যতা হওয়া সত্বেও তাদের কিন্তু জল সংরক্ষণের উপায়
জানা ছিল না। নদী শুকিয়ে যেতে থাকল। জলের অভাবে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হল। খরার ফলে
সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেল।
মায়া সভ্যতার মতোই আরো
এক উল্লেখযোগ্য সভ্যতা হল 'হরপ্পা' বা 'সিন্ধু সভ্যতা।
পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ এই সভ্যতার আয়তন ছিল প্রায় সাড়ে ১২
লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। পশ্চিমে ইরান থেকে পূর্বে দিল্লির নিকটবর্তী আলমগীরপুর এবং
উত্তরে জম্মুর নিকটবর্তী মান্ডা থেকে দক্ষিণে গোদাবরী নদীর তীরে দাইমাবাদ পর্যন্ত
বিস্তৃত ছিল। মোটামুটিভাবে ৩০০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দকেই এই সভ্যতার সময়কাল
বলে মেনে নেওয়া হয়েছে।
সুপ্রাচীন 'হরপ্পা সভ্যতা' ছিল
নগরকেন্দ্রিক। ঐতিহাসিকদের মতে এখানকার নগর পরিকল্পনা যথেষ্ট উন্নত ছিল। নাগরিকদের
জীবনযাত্রাও ছিল উন্নত মানের। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, অট্টালিকার-নকশা, পরিষ্কার-পরিছন্নতা, স্বাস্থ্য-সচেতনতা, ভূগর্ভস্থ
প্রয়ঃপ্রণালী ছিল উন্নত নগরসভ্যতার নিদর্শন। ৫০০০ হাজার বছর আগে হলেও এখানে
নগরগুলিতে রাতে গ্যাসের আলো জ্বলতো।
'হরপ্পা সভ্যতা'র সামাজিক জীবনযাত্রাও ছিল বেশ উন্নত মানের।
মূলত কৃষিনির্ভর ছিল তখনকার মানুষ। গম ও যব ছিল তাদের প্রধান খাদ্যশস্য। পশুপালনেও
অভ্যস্থ ছিল তারা। গরু, ভেড়া, ছাগল, মহিষ, উট, শূকর প্রভৃতি ছিল
তাদের গৃহপালিত পশু। মহীষ ও ষাঁড়কে তারা চাষের কাজে লাগাতো।
'হরপ্পা বা সিন্ধুর' অধিবাসীরা সুতির
ও পশমের পোশাক পরত। নারী-পুরুষ উভয়েই লম্বা চুল রাখত। সোনা-রুপা ও দামি পাথরের
বিভিন্ন অলংকার মেয়েরা ব্যবহার করত।
বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে
নাচ-গান, পাশা খেলা, শিকার, রথদৌড়, মাছ ধরা ইত্যাদি
ছিল উল্লেখযোগ্য।
ঐতিহাসিকরা মনে করে এই
সভ্যতায় ব্যবসা-বাণিজ্যে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। কারণ সিন্ধু উপত্যকায় তামা, ব্রঞ্চ ও পোড়া
মাটির তৈরি প্রায় ২০০০ সিলমোহর পাওয়া গেছে।
হরপ্পা সভ্যতায় বিভিন্ন
শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। যেমন বয়ন শিল্প, মৃৎশিল্প শিল্প, ধাতু শিল্প, প্রস্তর শিল্প প্রভৃতি।
মাটি খুঁড়ে যেসব মূর্তি
পাওয়া গেছে, তা থেকে বোঝা
যায় তাদের জীবনে ধর্মের প্রভাব ছিল যথেষ্টই।
হরপ্পা সভ্যতার পতনের
কারণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তন ও খরার প্রভাবকে
অস্বীকার করা যায় না। সভ্যতার প্রসার ঘটাতে পাকা ঘর-বাড়ি নির্মাণে ব্যাপকহারে
পোড়া ইঁটের প্রয়োজন হয়। আর অত্যাধিক পরিমাণে ইঁট পোড়াতে গিয়েই যথেষ্ট
বৃক্ষছেদন হয়েছিল। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়। শুষ্কতা বৃদ্ধি পায়।
ভূগর্ভস্থ লবণ মাটির উপরে উঠে আসায় মরুভূমির প্রসার ঘটে। ক্রমাগত বনভূমি ধ্বংসের
ফলে খরার কবলে পড়ে 'হরপ্পা সভ্যতা'।
এইভাবেই গাছ কাটা ও
সংকটের ফলে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যায় 'হরপ্পা সভ্যতা'।
'মায়া' ও 'হরপ্পা' সভ্যতা আর কোনদিনই ফিরে আসবে না। কিন্তু আমরা
যে বিলুপ্তির পথে হাঁটছি ওদেরই মতো। আকছার গাছ কাটা, জলের অপচয়, পুকুর জলাভূমি ভরাট, মাত্রারিক্ত দূষণ
আমাদেরও ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে দিচ্ছে।
সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা
পৃথিবী আজ দারুণ ''জল সংকট''-এর সম্মুখীন।
ইতিমধ্যে চেন্নাইতে শুরু হয়ে গেছে তীব্র জল সংকট। কেরল সহ বিভিন্ন প্রদেশে
অনাবৃষ্টির ফলে বন্ধ চাষাবাদ।
এখনই সচেতন না হলে যে, বড্ডো দেরি হয়ে
যাবে আমাদের!!!
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জুলাই ২০১৯
0 মন্তব্যসমূহ