Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বাঘে মানুষে এক গর্তে ।। যোগীন্দ্রনাথ সরকার

 

আমরা যথাসময়ে সুন্দরবনে বন্ধু সুরেশচন্দ্রের কাছারী বাড়িতে উপস্থিত হলাম। পথের কষ্টের কথা আর বলব না।

তখন সন্ধ্যা হয়-হয়। কাছারীতে বন্দুকের বাহুল্য আর প্রহরীদল দেখে বুঝলাম, সত্যিই আমরা বাঘের ঘরে এসেছি। শুনলাম, সারারাত্রি পাহারা চলবে, আর মধ্যে-মধ্যে বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করা হবে। বন্দুকের আওয়াজে বাঘ ভয় পাবে। আগে কয়েকবার বাঘ নাকি কাছারীর মধ্যে এসেছিল।

সুরেশচন্দ্রের এক জ্যেষ্ঠতুতো পুত্র, অমরবাবু, কাছারীর নায়েব। তিনি আমাদেরকে এত বেশি যত্ন করতে লাগলেন যে, আমরা বিব্ৰত হয়ে পড়লাম।

অন্ধকার একটু ঘন হয়ে এল, কাছারীর চারপাশে চারিটি জায়গায় আগুন জ্বালা হল। প্রহরীরা একবার বন্দুকে ফাঁকা আওয়াজ করল আর যে যার পাহারার জায়গায় গেল। আমরা কয়েকজন বারান্দার চেয়ারে বসলাম। বারান্দার দুই দিকে দুইটি আলো জ্বলছিল। প্রাঙ্গণ থেকে ফুলের গন্ধ আর গাছের পাতার মৃদু মৰ্ম্মর শব্দ আসছিল। চারিদিক নিস্তব্ধ।

চা খেতে খেতে সুরেশচন্দ্র বললেন, আপনারা বাঘের নামেই এত ভয় পান, কিন্তু দাদা একবার বাঘের সঙ্গে এক গর্তে রাত্রি কাটিয়েছিলেন।

প্রমথ, অতুল ও আমি, তিনজনে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপারখানা কী, অমরবাবু? তিনি বললেন, এখন আপনারা বিশ্রাম করুন, কিছু খেয়ে নিন। পরে সে কথা বলব।

খাওয়া-দাওয়ার পর অমরবাবু বলতে আরম্ভ করলেন, সে আজ প্রায় তিন বছরের কথা। গ্রীষ্মকাল, সকালে উঠে চা খেয়ে বারান্দায় বসে আছি, এমন সময় ঘোড়ায় চড়ে ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ কেনেডি এসে উপস্থিত। তিনি সেই দিন রাত্রে তাঁর তাঁবুতে খাওয়ার জন্য আমাকে নিমন্ত্রণ করতে এসেছিলেন। সদর রাস্তা দিয়ে গেলে, কাছারী থেকে তাঁবু প্রায় দু-ক্রোশ। বনের মধ্যে একটা সঙ্কীর্ণ হাঁটা পথ ছিল, সে পথে এক ক্রোশেরও কম।

ম্যাজিষ্ট্রেট ঘোড়া থেকে নামলেন না, বড়ো ব্যস্ত বলে চলে গেলেন।

যখন যে ম্যাজিষ্ট্রেট এখানে আসেন, তখন তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, কারণ এই বনে চুরুট তখনও ফুরায়নি। আমি পকেট থেকে আর তিনটে বের করে ধরিয়ে নিলাম। একসঙ্গে এতগুলো টুরুট টানাতে আস্তে-আস্তে আমার মাথা যেন কেমন করতে লাগল। চায়ে দেখলাম, বাঘ স্থির হয়ে বসে আছে। রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে আসলো, আমি আরও তিনটে চুরুট বের করলাম। পকেটে হাত দিয়ে দেখি, আর দুটি মাত্র আছে। স্থির করলাম, এবার আস্তে-আস্তে টানব।

অল্পক্ষণ পরেই গর্ত ধোঁয়ায় ভরে গেল। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট বোধ করতে লাগলাম। আমার চোখের সামনে সবই যেন কেমন অস্পষ্ট বোধ হতে লাগল। তারপর কী হল, আমার মনে নাই।

চোখ মেলে দেখলাম, চারিদিকে আলো, আমি ম্যাজিষ্ট্রেটের তাঁবুতে তাঁর ক্যাম্পখাটে শুয়ে আছি। মিঃ কেনেডি চামচে করে আমার মুখে স্যুপ দিচ্ছেন।

আমি অবাক হয়ে ব্যাপার কী, জিজ্ঞাসা করলে, তিনি যা বললেন, তার মানে এই, সকালে শিকারীরা গিয়ে দেখে যে, গর্তে বাঘ পড়েছে, গর্তের একদিকে বাঘ বসে আছে, আর অন্যদিকে আমি মরে পড়ে রয়েছি! তারা ছুটে তাঁবুতে আসে। তিনি তখনও ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁকে জাগিয়ে এই খবর দিলে, তিনি সঙ্গে-সঙ্গে বন্দুক নিয়ে গর্তের পাশে আসেন এবং আমাকে মৃত মনে করে বাঘটাকে গুলি করেন। বাঘ মরলে শিকারীরা আমাকে গর্ত থেকে তুলে আনে। তখন আমাকে ভালো করে দেখে ম্যাজিষ্ট্রেট বুঝেছিলেন যে, আমি মরিনি, অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছি মাত্র। তাই আমাকে তাঁবুতে এনে শুশ্রষা করেছিলেন।

ম্যাজিষ্ট্রেট বললেন, আমি আগে বুঝতে পারিনি যে, আপনি জীবিত, তাতে বড়ো ভালো হয়েছিল। কারণ আপনি জীবিত জানলে খুবই মুস্কিলে পড়তাম, বাঘটাকে গুলি করতে সাহস হতো না।

ম্যাজিস্ট্রেটের খাবার-দাবার আমাকেই ব্যবস্থা করতে হয়। মিঃ কেনেডির সঙ্গে আমার পরিচয়ের আরও একটা কারণ ছিল। আগেরবার যখন তিনি এখানে এসেছিলেন, তখন যে গরুর গাড়িতে তাঁর কাপড়ের বাক্স প্রভৃতি ছিল, সেই গাড়ির গাড়োয়ানকে পথে বাঘে ধরে মেরে ফেলে। গাড়ি পৌঁছয়নি। শেষে আমিই তাঁকে আমার কতকগুলি পোশাক দিয়েছিলাম। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ পরিচয়, বন্ধুত্ব বললেও চলে।

সন্ধ্যার সময় আমি ম্যাজিষ্ট্রেটের তাঁবুতে উপস্থিত হলাম। অল্পক্ষণ পরেই চন্দ্রোদয় হল। নিস্তব্ধ বনভূমি চন্দ্রালোকে প্লাবিত হয়ে গেল, চারিদিকে জোৎস্নার ঝলমলে আলোয় গাছেরপাতা অপূৰ্ব শোভা বিস্তার করতে লাগল। আমি হাঁটাপথে কাছারীতে ফিরব ঠিক করে, সহিসকে ঘোড়া নিয়ে ফিরে যেতে বললাম।

খাওয়ার পর ম্যাজিষ্ট্রেট আর আমি তাঁবুর সামনে জ্যোৎস্নার আলোয় বসে গল্প করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে ঘড়ি খুলে দেখি, রাত্রি প্রায় বারোটা। আমি বিদায় নিয়ে চুরুট টানতে-টানতে হাঁটাপথে রওনা হলাম। সঙ্কীর্ণ পথে, কোথাও কেউ নেই। একবার মনে হল, বন্দুকটা সঙ্গে আনলে ভালো করতাম। ইচ্ছা হল, তাঁবুতে গিয়ে একটা বন্দুক নিয়ে আসি। শেষে ভাবলাম, এইটুকু রাস্তা, এখনই চলে যাব, আর বন্দুক এনে কাজ নেই।

প্রায় অর্ধেক রাস্তা এসে দেখলাম, রাস্তার পাশে একটা ছাগলছানা চিৎকার করছে। হয় তো ঝোপে তার পা আটকিয়ে গেছে, এই ভেবে, তাকে মুক্ত করবার জন্য সেই দিকে এগিয়ে গেলাম। কয়েক পা গিয়েই ঝপ করে গর্তে পড়ে গেলাম। তখন বুঝতে বাকি রইল না যে, আমি বাঘধরা গর্তে পড়েছি।

বনে কোথাও বাঘের বিশেষ অত্যাচার আরম্ভ হলে, লোকে জায়গায়-জায়গায় গর্ত খুঁড়ে, তার মুখ ছোটো-ছোটো ডাল-পালা দিয়ে ঢেকে রাখে আর সেই সবের ওপর এক-একটা ছাগল বেঁধে রাখে। ছাগলের লোভে বাঘ সেখানে আসে। ছোটো ডাল-পালায় তার ভার থাকে না, বাঘ গর্তে পড়ে। তারপর লোকে গুলি করে তাকে মেরে ফেলে। আমি অন্যমনস্কভাবে চলতে-চলতে সে কথা ভুলে গিয়েছিলাম। তখন আমি আমার বুদ্ধিকে ধিক্কার দিতে লাগলাম।

আমি বুঝিলাম, সকাল না হলে সেখানে লোক আসবে না। কাজেই রাত্রিটা আমাকে সেই গর্তেই থাকতে হবে। আমি তার একপাশের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে চুরুট টানতে লাগলাম।

আমি কতক্ষণ ওভাবে ছিলাম, ঠিক বলতে পারি না, কারণ এরকম অবস্থায় পড়লে, সময় যেন আর কাটতেই চায় না! যাইহোক, কিছুক্ষণ পরে উপরে একটা শব্দ হল। মুহুর্তের মধ্যে গর্তে কী একটা ভারী জিনিস পড়ল। আমি চমকিয়ে উঠলাম। ভয়ে-ভয়ে দেখলাম, সেটা কোনো জিনিস না, মস্ত একটা জানোয়ার! সেই অন্ধকার গর্তে তার চোখ দুটো যেন জ্বলতে থাকল। আমি বুঝলাম, সৰ্বনাশ গর্তে বাঘ পড়েছে!

সেই গর্তের মধ্যে আমার আর বাঘের হাত কয়েকমাত্র ব্যবধান। আমি প্রতিমুহূর্তই আশঙ্কা করতে লাগলাম, বাঘ আমাকে ধরে মেরে ফেলবে। কিছুক্ষণ পরে দেখি, সে থেকে-থেকে যেন ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। একটু লক্ষ্য করে দেখে বুঝলাম, আমি যখনই চুরুট টানি, অমনি আগুন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আর তা দেখে বাঘ পিছ্য়ে যায়। আমার মনে পড়ল, বাঘ আগুনকে বড়ো ভয় করে। যে জলে ডুবছে, সে শেষ অবলম্বন ভেবে জলের ওপর ভাসমান একটুকরো ঘাসকেও ধরে। আমিও সেইরকম করলাম।

পকেট থেকে দুটো চুরুট বের করে ধরিয়ে নিলাম। তারপর তিনটে চুরুট একসঙ্গে টানতে লাগলাম। বাঘ পিছিয়ে গিয়ে গর্তের এক কোণে স্থির হয়ে বসল। গর্ত চুরুটের ধোঁয়ায় ভরে যেতে থাকল। বুঝলাম, চুরুটের তীব্র গন্ধ তার সহ্য হচ্ছে না।

 

(আজকের ভাষায়)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ