Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

পুজোর ভূত ।। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়


 প্রথম অধ্যায় ।। ভয়ঙ্কর বাড়ি

আমার নাম তারক। কলকাতায় আমি বোর্ডিংয়ে থাকি। পুজার সময় আমি বাড়ি এসেছি। আমার নিজের বাড়ি নয়, মামার বাড়ি। মামার বাড়িতেই আমরা মানুষ হয়েছি। আমি ও আমার বোন প্রভা। শামীমাসী আমাদেরকে মানুষ করেছে। আমার মাকেও সে মানুষ করেছিল। শামীমাসী সদপোপের মেয়ে।

সন্ধ্যার সময় আমরা শামীমাসীকে ঘিরে বসলাম। আমি, প্রভা, আর আমার মামাতো ভাই ও বোনেরা। আমি বললাম, শামীমাসী! আজ তোমাকে একটা গল্প বলতে হবে। কেমন মেঘ করেছে। দেখো! কেমন অন্ধকার হয়েছে। কেমন টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আর বাতাসের একবার জোর দেখো। গাছের পাতার ভিতর দিয়ে শোঁ-শোঁ করে চলেছে। যেন রাগ করে কী বলছে। এই অন্ধকারে এমন দুর্যোগের সময় ভূত-প্রেত সব বাইরে বের হয়। বাপ রে! গা যেন শিউরে ওঠে।

শামীমাসী বলল, এই পুজার সময়, এইরকম দুর্যোগের সময়, তোমার মাকে নিয়ে আমি বড়ো বিপদে পড়েছিলাম। এখনও সে কথা মনে করলে ভয়ে আমার বুক ধড়ফড় করে।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছিল শামীমাসী ?

শামীমাসী উত্তর বলল, না, সে কথা এখন তোমাদেরকে আমি বলব না। তোমরা ছেলে মানুষ! সে কথা শুনলে তোমাদের ভয় করবে।

আমরা সকলে বললাম, সে কথা শুনলে আমাদের ভয় করবে না।

যা হোক, অনেক জেদা-জেদের পর শামীমাসী সে গল্প বলতে রাজী হল। শামীমাসী বলল, তারক ও প্রভার মায়ের নাম সীতা। সীতার মা, অর্থাৎ তোমাদের মাতামহীর নাম তারামণি। মৃত্যুশয্যায় তিনি আমাকে বলে যান, শামী! আমার কাছে তুই সত্য কর যে, সীতাকে তুই কখনও ছেড়ে যাবি না। সীতা পাঁচ বৎসরের শিশু, পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই।

সীতাকে আমি দিদিমণি বলে ডাকতাম। আমি বললাম, মাঠাকুরণ! দাদাবাবু (অর্থাৎ তোমাদের মার ভাই) ও দিদিমণি কোথায় কার কাছে থাকবে, তা আমি জানি না। দিদিমণি যাদের কাছে থাকবে, তারা যদি আমাকে ছেড়ে দেয়, তা হলে আমি কী করতে পারি ? কিন্তু তারা যদি আমাকে রাখে, তা হলে তোমার গায়ে হাত দিয়ে আমি দিব্য করে বলছি যে, দিদিমণিকে আমি কখনও ছাড়ব না।

তোমাদের মাতামহীর মৃত্যু হল, তোমাদের মামা, যাঁর এই বাড়ি, তিনি তখন বালক। লেখাপড়া শেখাবার জন্য একজন আত্মীয় তাঁকে কলকাতায় নিয়ে গেলেন। সীতা তার মামার বাড়িতে গেল। সীতার মামা আমাকে ছাড়লেন না। আমি দিদিমণিকে মানুষ করতে লাগলাম। দিদিমণির মামারা এক সময়ে খুব বড়োমানুষ ছিলেন। শুনলাম যে, তার মাতামহ জগমোহন রায়চৌধুরী একজন দুর্দান্ত লোক ছিলেন। দিদিমণিকে নিয়ে আমি যখন তার বাড়িতে গেলাম তখন তিনি জীবিত ছিলেন না। দিদিমণির মামাও দেশে থাকতেন না, পশ্চিমে কোথায় কাজ করতেন। দিদিমণিকে বাড়িতে রেখে তিনি সে জায়গায় চলে গেলেন। সে বাড়ি কী ভয়ঙ্কর! তিন মহল বাড়ি, বাড়ির বাইরে, মাঝের বাড়িতে, ভিতর বাড়িতে, একতলায়, দোতালায় কত যে ঘর, তা গুণতে পারা যায় না। কিন্তু সব ভোঁ-ভোঁ, দেখলেই যেন ভূতের বাড়ি বলে মনে হয়. বাইরের বাড়িতে কী মাঝের বাড়িতে জন-প্রাণী বাস করে না। এত বড়ো বাড়িতে আমরা কেবল ছয় জন থাকলাম, (১) তোমার মায়ের পিসী। অলক ঠাকুরুণ, তার বয়স প্রায় আশি হয়েছিল, আর তিনি সম্পূর্ণ কালা ছিলেন। (২) আর একজন ব্রাহ্মণী, তাঁর সহচরী, তাঁরও বয়স বড়ো কম হয়নি। তিনি রান্না করতেন। (৩) একজন চাকর, তার নাম পিতেম। (৪) পিতেমের স্ত্রী, তার নাম বিলাসী। (৫) তার পর আমি ও (৬) তোমাদের মা, আমার দিদিমণি, সীতা। বাড়ির ভেতর দোতলায় তিনটি ঘরে আমরা ছয়জনে থাকতে লাগলাম। প্রথম অলক ঠাকুরুণ ও সহচরীর ঘর, তার পাশে আমার ও দিদিমণির ঘর, তার পাশে পিতেম ও বিলাসীর ঘর। পশ্চিম দিকে এই তিনটে ঘর ছিল! উত্তর ও পূর্বদিকে অনেক ঘর পড়েছিল। বিলাসীর ঘরের পাশে আর একটা ঘর নিয়ে আমি দিদিমণির খেলাঘর বানিয়ে দিয়েছিলাম।

বাড়ির চারিদিকে অনেক দূর পর্যন্ত আম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারী প্রভৃতি নানাগাছের বাগান ছিল। বাগানের ভেতর চার-পাঁচটা পুকুর ছিল। উত্তর দিক ছাড়া বাড়ির আর চারিদিকে গ্রাম ছিল। কিন্তু সে মিথ্যা গ্রাম, ম্যালেরিয়া জ্বরের উপদ্রবে অনেক লোক মরে গেছে, অনেক লোক ঘর-দোর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। বাড়ির উত্তর দিকে মাঠ, যতদূর দেখতে পাই, ততদূর মাঠ ধূ-ধূ করছে।

শ্মশানের মতো সেই বাড়িতে গিয়ে আমি মনে করলাম, ওমা! এ বাড়িতে আমি কী করে থাকব! ভয়েই মরে যাব। যাই হোক, যেখানে আমার দিদিমণি, সেখানে সব ভালো, সেখানেই আলো, সেখানেই সুখ। দিদিমণির দৌড়াদৌড়ি, দিদিমণির খেলা, দিদিমণির কথা, দিদিমণির হাসিতে সেই শ্মশানভূমি যেন স্বর্গতুল্য হয়ে উঠল। এমন যে অলক-ঠাকুরুণ, যার গোমড়া মুখ দেখলে ভয় হয়, দিদিমণিকে দেখলে তাঁরও মুখ যেন একটু উজ্জ্বল হতো, তাঁরও মুখে যেন একটু হাসি দেখা দিত। দিদিমিণির যেমন রূপ, তেমনি গুণ। তেমন ফুটফুটে, দুধে আলতার রং আমি আর কোনো মেয়ের দেখিনি। কেমন পুরন্ত গাল দুটি, কেমন ছোট্টো হাঁ টুকু। কেমন টুকটুকে ঠোট, কেমন পটল-চেরা ঢুলু ঢুলু উজ্জ্বল চোখ, কেমন কালো-কালো চোখের পাতা, কেমন সরু-সরু চকচকে রেশমের মতো নরম চুল! হা কপাল! সে দিদিমণিকে ছেড়ে এখনও আমি প্রাণ ধরে বেঁচে আছি। তারপর দিদিমণি যখন কথা বলতো, তখন প্রাণ যেন শীতল হয়ে যেত, প্রাণের ভেতর দিদিমণি আমার যেন সুধা ঢেলে দিত। একবার এই সময় ঘোরতর দুর্যোগ হয়েছিল। বাইরে বাতাস হু-হু করে বইছিল। দিদিমণিকে নিয়ে আমি শুয়ে আছি। এমন সময় বাড়ির বাইরে বেহালার শব্দ হল। রাত্রি তখন প্রায় দুই প্রহর হবে। আমি মনে করলাম যে, এত রাত্রিতে আমাদের বাড়ির বাইরে বেহালা বাজায় কে ? বাড়ির বাইরে তো কেউ বাস করে না।

পরদিন আমি বাড়ির বাইরে গিয়ে চারিদিক দেখলাম। জনপ্রাণীকেও সেখানে দেখতে পেলাম না। পোড়ো-ভাঙা বাড়ির যেমন অবস্থা হয়, বাড়ির বাইরেটা সেইরকম অবস্থা হয়েছিল।

সে দিন বিলাসীকে একবার একলা পেয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, বিলাসী! কাল রাত্রিতে বাড়ির বাইরেটায় বেহালা কে বাজাচ্ছিল ?

আমার কথা শুনে বিলাসীর মুখ শুকনো হয়ে গেল। আমতা-আমতা করে সে উত্তরে বলল, বেহালা! বেহালা আবার কে বাজাবে ? ও বাতাসের।

বিলাসীর কথায় আমার বিশ্বাস হল না। আমি বুঝলাম যে, সে আমার কাছে কোনো বিষয় গোপন করছে।

বিলাসী আবার বলল, যাহোক, দিদিমণিকে তুমি সদর-বাড়িতে যেতে দিও না। সাপখোপ কি আছে না আছে, কাজ কি এদিকে গিয়ে।

আরও কিছুদিন চলে গেল। একবার নয়, আরও অনেকবার আমি সেই বেহালার শব্দ শুনতে পেলাম। যখনই রাত্রিতে বাদলা ও দুর্যোগ হয়, তখনই বাড়ির বাইরেটায় কে যেন প্রাণপণে বেহালা বাজায়। কেবল বেহালা না, সে বছর পুজোর সময় মহাঅষ্টমীর রাত্রিতে বাড়ির বাইরেটায় আমি শাঁখ-ঘণ্টার শব্দও শুনেছিলাম। ধূপ-ধূনোর গন্ধও পেয়েছিলাম। বলিদানের সময় যেমন একএকজন ভক্ত বিকট স্বরে মা-মা বলে চিৎকার করে, সে শব্দ শুনেছিলাম। এ সমুদয় ব্যাপারের অর্থ কী, তা জানবার জন্য বৃদ্ধা সহচরীকে, পিতেমকে, বিলাসীকে আমি বার-বার জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু কেউই আমাকে বলেনি। ও কিছু নয়, এই কথা বলে সকলে আসল কথা আমার কাছে গোপন করতে চেষ্টা করেছিল।

এইভাবে সে জায়গায় আমাদের দিন কাটতে লাগল। কত-শতবার আমি সেই বেহালার শব্দ শুনতে পেলাম। আবার পুজোর সময় এল। মহাষ্টমীর দিন দুই প্রহরের সময় দিদিমণি, পিতেম ও বিলাসীর সঙ্গে গ্রামের ভেতর পুজো দেখতে গিয়েছিল। আমি বিদেশী লোক, আমাকে কেউ নিমন্ত্রণ করেনি, সে জন্য আমি তাদের সঙ্গে যাইনি। পুজো দেখে বেলা পাঁচটার সময় দিদিমণি ফিরে এল। বিলাসী আমাকে বলল, যদু ভড়ের বাড়ি পুজোয় এবার খুব ধূম। আহা! কী চমৎকার প্রতিমা করেছে। আর শামীদিদি, বোন তোমাকে অনেক করে যেতে বলেছে।

আমি বলিলাম, আচ্ছা, বিলাসী! তবে আমি একবার মাকে দেখে আসি। তুই ভাই দেখিস, যেন দিদিমণি কোথাও না যায়।

এই কথা বলে আমি ভড়েদের বাড়ি ঠাকুর দেখতে গেলাম। ভড়গিন্নী আমাকে অনেক আদর করলেন। অনেকগুলো খই মুড়কি, নারিকেল-সন্দেশ, রসকরা আরও কত কি আমার কাপড়ে বেঁধে দিলেন। ফিরে আসতে আমার সন্ধ্যা হয়ে গেল।

 

দ্বিতীয় অধ্যায় ।। আর না ভাই

বাড়ি এসে তাড়াতাড়ি আমি বিলাসীর ঘরে গেলাম। দিদিমণিকে সেখানে দেখতে পেলাম না।

বিলাসী বলল, বোধহয় অলক ঠাকুরুণের ঘরে আছে। রুদ্ধশ্বাসে সে ঘরে আমি দৌড়িয়ে গেলাম। অলক ঠাকুরুণ ও সহচরী দুইজনেই তখন সে ঘরে ছিল। দিদিমণিকে দেখতে না পেয়ে সহচরীকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম। সহচরী উত্তরে বলল, কৈ। সীতা তো এ ঘরে আসেনি।

এই কথা শুনে প্রাণ আমার উড়ে গেল। আবার আমি বিলাসীর ঘরে গেলাম। কাঁদতে-কাঁদতে আমি বিলাসীকে তিরস্কার করতে লাগলাম।

বিলাসী কাঁদতে লাগল। সে বলল, এইমাত্র আমার ঘরের বারান্দায় সে খেলা করছিল। ঘরের ভেতর আমি কাজ করছিলাম। বোধহয়, অন্য কোনো ঘরে সে খেলা করছে।

এমন সময় পিতেম এসে উপস্থিত হল। আমার কান্না ও বিলাসীকে ভর্ৎসনার শব্দ শুনে সহচরীও সেইখানে উপস্থিত হলেন। প্রদীপ হাতে নিয়ে সকলে মিলে আমরা বাড়ি আতিপাতি করে খুঁজতে লাগলাম। ভেতরবাড়ি খুঁজে মাঝের বাড়ি, তারপর সদরবাড়ির সব ঘর তন্ন-তন্ন করে খুঁজলাম, কিন্তু কোনোখানে দিদিমণিকে দেখতে পেলাম না। মাথা খুঁড়ে, বুক চাপড়ে আমি উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লাগলাম। আমি ভাবলাম যে, হয় গয়নার জন্য দিদিমণিকে কেউ মেরে ফেলেছে, কিংবা পুকুরেতে পড়ে সে ডুবে গিয়েছে। সমস্ত বাড়ি ওলট-পালট করয়া অবশেষে আমরা বাগান ও পুকুরের ধারগুলো মন দিয়ে দেখলাম । কিন্তু কোনোখানে দিদিমণির চিহ্নমাত্র দেখতে পেলাম না। শেষে পিতেম আমাকে বলল, তোমাকে দেখতে না পেয়া তার মন কেমন করছিল, তোমাকে খোঁজবার জন্য নিশ্চয়ই সে পুজোবাড়ির দিকে গেছে। আমি এখনই তাকে আনছি। এই কথা বলে পিতেম গ্রামের দিকে চলে গেল।

কিন্তু তা বলে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারলাম না। আগেই বলেছি যে, আমাদের বাড়ি ও বাগানের উত্তর দিকে দূর পর্যন্ত মাঠ ছিল। দিদিমণিকে খোঁজবার জন্য বিলাসী ও আমি সেই মাঠের দিকে গেলাম। মেঘ করেছিল, খুব অন্ধকার হয়েছিল! তার ওপর এখন আবার বৃষ্টি আরম্ভ হল। কিছুক্ষণ পরে সামনে আমরা একরকম সাদা কী দেখতে পেলাম। বিলাসীর বড়ো ভয় হল। সে বলল, দিদি, ওই দেখো, একটা শাকচূর্ণী আসছে। এখনি আমাদের খেয়ে ফেলবে। আর গিয়ে কাজ নেই। এসো, বাড়ি ফিরে যাই। এতক্ষণে দিদিমণি বাড়ি এসে থাকবে। কোনো উত্তর না দিয়ে আমি বিলাসীর হাত ধরলাম, আর সেই সাদা জিনিসের দিকে তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকলাম। সেও অন্যদিক থেকে আমাদের দিকে আসতে লাগল। অল্পক্ষণ পরে তার সঙ্গে আমাদের দেখা হল। বিলাসী তাকে চিনতে পারল । সে আমাদের প্রতিবেশী একজন কৃষক! কাপড় ঢাকা তার বুকের উপর কি ছিল। আমরা কোনো কথা তাকে জিজ্ঞাসা করতে না করতে সে বলল, তোমাদের মেয়েটা মাঠের মাঝখানে গাছতলায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। কী করে সে মাঠের মাঝখানে এসে ছিল, তা আমি বলতে পারি না। আমি দেখতে পেয়ে এখন তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।

তাড়াতাড়ি দিদিমণিকে আমি তার কোল থেকে নিজের কোলে নিলাম। কিন্তু দিদিমণির সারা শরীরই ঠাণ্ডা দেখে আমার প্রাণ উড়ে গেল। আমি ভাবলাম, সে মরে গেছে। কাঁদতে-কাঁদতে আমি তার নাকে ও বুকে হাত দিয়ে দেখলাম। দেখলাম যে, নাক দিয়ে অল্প-অল্প নিঃশ্বাস পড়ছে। আর বুক অল্প-অল্প ধুক-ধুক করছে। তা দেখে প্রাণে আমার কতকটা আশা হল। তাড়াতাড়ি মাঠ পার হয়ে আমরা বাড়িতে এসে উপস্থিত হলাম। অনেক তাপ-সেক করতে করতে দিদিমণির জ্ঞান ফিরল। সেই চন্দ্রমুখে মধুর হাসি দেখা দিল, সুধামাখা দু-একটা কথা দিদিমণির মুখ থেকে বের হল। অল্প গরম দুধ এনে সহচরী তাকে খেতে দিলেন। তার সেই পদ্ম চোখ দুটো ঘুমে বুজে গেল। সে রাত্রিতে দিদিমণিকে আমরা কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলাম না।

দূরে মাঠের মাঝখানে একলা সে কি করে গিয়েছিল, পরদিন সেই কথা দিদিমণিকে আমরা জিজ্ঞাসা করলাম। দিদিমণি বললেন, বারান্দায় আমি খেলা করছিলাম। তারপর যে ঘরে আমার খেলা-ঘর আছে, আমি তার ভেতর গেলাম। সেই ঘরের জানালার ধারে যেই দাঁড়িয়েছি, আর দেখি না ঠিক তার নীচেতে, বাগানে একটা মেয়ে। মেয়েটা আমার মতো বড়ো, কিন্তু খুব সুন্দর। উপর দিকে আমার দিকে চেয়ে সে বলল, সীতা! নেমে আয় না ভাই, আমরা দু-জনে খেলা করি। আমি বললাম, না ভাই! এখন আমি নীচে নেমে যেতে পারব না। সন্ধ্যা হয়েছে, এখন নীচে নামবার সময় নয়। বিলাসী আমাকে বকবে, তারপর শামী এসে আমাকে বকবে। কাল সকালবেলায় তুমি এসো, দু-জনে তখন অনেকক্ষণ খেলা করব। মেয়েটা বলল, এখনও তেমন সন্ধ্যা হয়নি, এখনও অনেক আলো আছে। এই দেখ আমার মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে, তবুও দেখ আমি খেলা করছি। আয় না ভাই। তবুও আমি নামলাম না। নীচে নামতে মেয়েটা আমাকে বারবার বলতে লাগল। শেষে সে মাটির ওপর বসে পড়ল, বসে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল। আমি আর থাকতে পারলাম না। নীচে নেমে বাড়ির বাইরে গিয়ে আমি তার কাছে গেলাম। কিছুক্ষণ বাগানের ভেতর আমরা দু-জনে খেলা করলাম। এক জায়গায় অনেকগুলো রজনীগন্ধা ফুল ফুটে ছিল, তা আমরা তুললাম। সাদা টগর ফুল ফুটে আর একটা গাছ আলো করে ছিল। নীচে থেকে যত পারলাম, সেই টগর ফুলও আমরা তুললাম। কেমন করে জানি না, তারপর বাগান পার হয়ে আমরা মাঠে গিয়ে উপস্থিত হলাম। কেমন করে জানি না, সেই মেয়েটার সঙ্গে অনেক পথ চলে ক্ৰমে মাঠের মাঝখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সে জায়গায় একটা গাছ ছিল। সেই গাছতলায় একটা মেয়ে-মানুষ বসে কাঁদছিল। আমার মাকে স্বপ্নের মতো আমার মনে পড়ে। সে মেয়ে-মানুষটা ঠিক আমার মায়ের মতো। সেইরকম রং, সেইরকম মুখ, সেইরকম চুল, সেইরকম কথা। আদর করে তিনি আমাকে কোলে নিলেন, আমার মুখে তিনি কত চুমা খেলেন। কোলে বসিয়ে আমার মাথায় তিনি হাত বুলাতে লাগলেন। তারপর কি হল, আর আমার মনে নেই।

 

তৃতীয় অধ্যায় ।। বালিকা ভূত

দিদিমণির এই কথা শুনে সহচরী পিতেমকে চোখ টিপলেন। তারপর তিনি বিলাসীর পা টিপলেন। এর মানে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সে মেয়েটা কে ? সে তো বড়ো দুষ্ট মেয়ে দেখছি। তাকে আর বাগানে আসতে দেওয়া যাবে না।

আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সহচরী বললেন, এ বিষয় অলক ঠাকুরুণকে জানাতে হবে। তিনি যেরকম বলবেন, সেইরকম করতে হবে। এই কথা বলে সহচরী সে ঘর থেকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি আমাকে, পিতেমকে ও বিলাসীকে অলক ঠাকুরুণের ঘরে ডেকে পাঠালেন। দিদিমণিকে কোলে নিয়ে আমি পিতেম ও বিলাসীর সঙ্গে সেই ঘরে গেলাম। অলক ঠাকুরুণ থুড়থুড়ে বুড়ি। তিনি বেশি কথা বলতে পারতেন না। তাঁর হয়ে সহচরী আমার দিকে চেয়ে বললেন, অলক ঠাকুরুণ তোমাকে বলতে বললেন যে, সে মেয়েটা মানুষ না। তার মা, যাকে সীতা গাছতলায় দেখেছিল, তিনি অলক ঠাকুরুণের ভাইঝি, সীতার মাসি। অনেক দিন হল, তিনি ও তাঁর কন্যা অপঘাত-মৃত্যুতে মরে গেছেন। তাদের গতি হয়নি, এখন তাঁরা এরকম হয়ে আছেন। তাঁরা সবসময়, বিশেষতঃ ঝড় বাতাস বাদলার দিনে, আর এই পুজোর সময়, বাড়ির চারিদিকে ঘুরে বেড়ান। পিতেম, বিলাসী আর তুমি শামী, তোমাদের সকলকে অলক ঠাকুরুণ বলছেন যে, সীতাকে তোমরা খুব সাবধানে রাখবে, নিমিষের জন্য তোমরা তাকে চোখের আড়াল করবে না। সে মেয়েটা এবার যদি সীতাকে ভুলিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে আর তোমরা সীতাকে পাবে না।

এই কথা শুনে আমার আত্মা উড়ে গেল। কী করে মেয়েকে ভূতের হাত থেকে বাঁচাব, সেই ভাবনায় আমি আকুল হয়ে পড়লাম। তোমার মামার তখনও কর্মসংস্থান হয়নি, একদিন গিয়ে দাঁড়াব, একবেলা এক মুঠো কে যে ভাত দেবে, এমন জায়গা ছিল না। কাদায় গুণ ফেলে দিদিমণিকে নিয়ে আমাকে সেই ভয়ানক বাড়িতে থাকতে হল। কিন্তু সেইদিন থেকে দিদিমণিকে আমরা নিমিষের জন্যও চোখের আড়াল করতাম না। হয় আমি, না হয় বিলাসী, না হয় পিতেম, কেউ না কেউ সবসময় তার কাছে থাকত। কিন্তু মাঝে-মাঝে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দিদিমণি আমাদেরকে বলত, ওই সেই মেয়েটা এসেছে, ওই আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। শামী, তুই আমাকে সুন্দর বলিস, কিন্তু ওর দিকে একবার চেয়ে দেখ। আহা! কী চমৎকার রূপ! কেবল ওর দিকে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, অন্যদিকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না! ওই দেখ, আবার আমাকে ডাকছে। আমি যাচ্ছি না বলে, আহা! মেয়েটা ওই দেখ, কতই না কাঁদছে। তার কাপড় সে আমাকে দেখাচ্ছে, তার কাপড় ভিজে গেছে, টস্ টস করে তার কাপড় থেকে জল পড়ছে। মাথায় হাত দিয়ে সে নিজের মাথা আমাকে দেখাচ্ছে। আহা! মেয়েটার মাথায় কে মেরেছে, মাথা থেকে গাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। শামী! একবার আমাকে ছেড়ে দে। আমি ওর কাছে যাই, ওকে বাড়ির ভেতর ডেকে আনি। তুই ওর মাথায় ওষুধ দিয়ে দিবি। আমার ওই কাপড়টা আমি ওকে পরতে দেবো। যাই ভাই যাই!

এইরকম বললে তাড়াতাড়ি আমি তোমার মাকে গিয়ে কোলে নিতাম। ওপর থেকে বাগানের দিকে আমি চেয়ে দেখতাম, কিন্তু আমি কিছু দেখতে পেতাম না। কী করব! ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে, মেয়েকে কোলে নিয়ে, ভয়ে জড়সড় হয়ে আমি বসে থাকতাম।

এইরকম অতি কষ্টে আমরা সেই বাড়িতে দিনযাপন করতে থাকলাম। আবার পুজোর সময় এল। এই সময় দিদিমণি সেই মেয়েটাকে ঘন-ঘন দেখতে লাগল। বাগানের দিকে জানালা এখন আমি সৰ্ব্বদাই বন্ধ করে রাখতাম। তবুও দিদিমণি বলত, শামী! জানালা খুলে দে। মেয়েটা নীচে এসেছে, সে আমাকে ডাকছে। শামী! তোর পায়ে পড়ি, একবার জানালা খুলে দে, একবার তাকে আমি দেখি।

মহাষ্টমীর দিন মেয়েকে নিয়ে আমি বড়োই বিব্ৰত হলাম। সে দিন ভয়ানক দুর্যোগ হয়েছিল। সীতাকে কোলে নিয়ে আমি ঘরে বসেছিলাম। এখন আর বাইরে নয়, সেদিন দিদিমণি সেই মেয়েটাকে বাড়ির ভেতরেই দেখতে লাগল! আমি দরজা বন্ধ করেছিলাম। তবুও দিদিমণি বলতে থাকল, ও শামী! মেয়েটা আজ বাড়ির ভেতর এসেছে, ঘরের বাইরে আমাদের ঘরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ছেড়ে দে শামী। আমি একবার তার কাছে যাই। একবার তাকে না দেখলে মরে যাব। এই বলে দিদিমণি হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল! কী যে করি, তা আমি বুঝতে পারলাম না। মেয়ে নিয়ে আমি অলক ঠাকুরুণের ঘরে গেলাম। সেখানে সহচরী উপস্থিত ছিলেন। আমি বললাম, আজ বাছা, আমাদের খাওয়া-দাওয়াতে কাজ নেই। সকলে মিলে এসো, আজ আমরা মেয়েকে ঘিরে বসে থাকি। তা না করলে, দিদিমণিকে আজ আমরা বাঁচাতে পারব না, সেই দুষ্ট মেয়েটা এসে দিদিমণিকে নিশ্চয় আজ নিয়ে যাবে। সহচরী অলক ঠাকুরুণকে সব কথা বললেন। অলক ঠাকুরণ আমার কথায় সম্মত হলেন। পিতেম ও বিলাসীকে ডেকে দরজা-জানালা বন্ধ করে দিদিমণিকে ঘিরে, সকলে আমরা অলক ঠাকুরণের ঘরে বসে থাকলাম।

বলা বাহুল্য যে, ইতিপূর্বে এই বিড়ম্বনা নিবারণের জন্য অনেক প্রতিকার করা হয়েছিল। গয়াতে পিণ্ড দেওয়া হয়েছিল, শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করা হয়েছিল, রোজা এনে ঝাড়ান ও ভূত নামানো হয়েছিল, দিদিমণির অষ্টাব্দে কবচ, মাদুলি ও নেকড়ার পুটুলি বাঁধা হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।

 

চতুর্থ অধ্যায় ।। বিষম মহাষ্টমী

সকলে ঘিরে থাকলাম বটে, কিন্তু সেই মহাষ্টমীর সমস্ত দিন দিদিমণি বড়োই ছটফট করেছিল। ওই সেই মেয়েটা আসছে, সে আমাকে ডাকছে, তার কাপড় ভিজে গেছে, তার মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে; দাও, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তার কাছে যাই, এই বলে দিদিমণি বার-বার কাঁদছিল, আর আমার কোল থেকে উঠে আমার হাত ছাড়িয়ে বার-বার বাইরে পালাতে চেষ্টা করছিল। অতি কষ্টে আমি তাকে ধরে রাখছিলাম।

সন্ধ্যার পর দিদিমণি ঘুমিয়ে পড়ল। আমি ভাবলাম যে, এইবার বুঝি আমাদের বিপদ কেটে গেল, আর বুঝি কোনো উপদ্রব হবে না। কিন্তু আমরা কেউ ঘুমোতে গেলাম না, ঘরে দুটো আলো জ্বেলে সকলে জেগে বসে থাকলাম।

রাত্রি প্রায় দুই প্রহর হয়েছে। এমন সময় বাড়ির বাইরেটায় সেই বেহালা বেজে উঠল। কেবল বেহালা না, তার সঙ্গে ঢাক-ঢোল, শাঁখ-ঘন্টা, কাঁসর-ঘড়িও বেজে উঠল। সেই সকল বাজনা ছাপিয়ে বলিদানের সেই ভয়ানক মা-মা চিৎকারে আমাদের যেন কানে তালা লেগে গেল, আতঙ্কে আমাদের প্রাণ শিউরে উঠল, ভয়ে আমাদের শরীর রোমাঞ্চ হয়ে উঠল। হতভম্ব হয়ে আমরা বসে আছি, এমন সময় ধড়মড় করে দিদিমণি উঠে বসল। আমরা কিছু বলতে না বলতে চোঁৎ করে সে দরজার কাছে গিয়ে খিল খুলে ফেলল। তারপর আমরা তাকে ধরতে না ধরতে রুদ্ধশ্বাসে বাড়ির বাইরে পুজোর দালানের দিকে সে দৌড়ল। ও মা, কি হইল, সৰ্ব্বনাশ হল। এই কথা বলতে-বলতে অলক ঠাকুরুণ ছাড়া আর সকলেই আমরা তার পশ্চাৎ-পশ্চাৎ দৌড়লাম। কিন্তু তাকে ধরতে পারলাম না। দিদিমণি আমাদের আগে গিয়ে বাড়ির বাইরে পুজোর দালানে গিয়ে উপস্থিত হল। সেখানের অদ্ভুত ব্যাপার দেখে আমরা জ্ঞান হারালাম। এখন আর সে ভাঙা-জনশূন্য বাড়ি নেই। খুব ধুম-ধামের দুর্গোৎসব হলে যেরকম হয়, সেখানে এখন সেইরকম হয়েছে। দালানের মাঝখানে প্রতিমা নানা সাজে সুসজ্জিত। প্রতিমার চারিদিকে নৈবেদ্য প্রভৃতি পুজোর আয়োজন রয়েছে। সামনে পুরোহিতরা বসে আছেন। একপাশে একজন চণ্ডীপাঠ করছেন। সামনের প্রাঙ্গণ লোকে-লোকারণ্য, ধূপ-ধুনোর গন্ধে চারিদিক আমোদিত হয়ে আছে। দালানে, উঠোনে, সবখানে ঝাড় লণ্ঠন জ্বলছে। সোজা কথা, এমন ধুমধামের পুজো আমি কখনও দেখিনি।

দিদিমণি কারো প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে দালান পার হয়ে দালানের পুবদিকে চলে গেল। ভয়ে কাঁপতে-কাঁপতে আমরাও তার পিছন-পিছন চললাম। দালানের পুবদিকে একটা ঘর ছিল। সেই ঘরের ভেতর তক্তপোষের ওপর একজন বৃদ্ধ বসেছিলেন। তাঁর বাঁ-হাতে বেহালা, আর ডান-হাতে যেটা দিয়ে বাজায় সেটা ছিল। একটা পরমা সুন্দরী মহিলা মাটিতে বসে বৃদ্ধের পা দুটো ধরে কি বলছিলেন। সেই মহিলার পাশে সাত-আট বছরের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

দিদিমণি সোজা গিয়ে সেই ঘরের দরজার এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।

খপ করে আমি গিয়ে দিদিমণির হাত ধরে ফেললাম। তারপর আমরা সকলেই সেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

যে মহিলা বৃদ্ধের পা ধরে ছিলেন, তিনি এখন কাঁদো-কাঁদো মৃদু মধুর-স্বরে বললেন, বাবা, অপরাধ করেছি সত্যি। কিন্তু আমি তোমার মেয়ে! শত অপরাধ করলে, মেয়েকে ক্ষমা করতে হয়! এই মেয়েটাকে নিয়ে আমি এখন কোথায় যাই। বৃদ্ধ অতি নিষ্ঠুর ভাষায় বললেন, আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে, তোর আমি মুখ দেখব না। কালামুখ নিয়ে এ-বাড়ি থেকে এখনই দূর হয়ে যা।

মহিলা বললেন, বাবা! আমি কোনোরকম দুষ্কর্ম করিনি, স্বামীর ঘরে গিয়েছি, এই যা। বৃদ্ধ বললেন, তুই দূর হ, আমার সামনে থেকে দূর হ। মহিলাটি অবশেষে বললেন, আচ্ছা, বাবা, আমি দূর হচ্ছি, কিন্তু আমার মেয়ে তো কোনো অপরাধ করেনি! ওকে আমি তোমার কাছে রাখে যাচ্ছি। পাতের ভাতের দুটো ভাত দিয়ে ওকে প্রতিপালন কোরো।

সেই কথা শুনে বৃদ্ধ আরও জ্বলে উঠলেন, তোর ঝাড় আমার এ বাড়িতে থাকতে পারবে না। দূর হ, এখনি দূর হ। মহিলা ও তাঁর কন্যা দূর হচ্ছে না দেখে বৃদ্ধ রাগে অন্ধ হয়ে পড়লেন। ধৈর্য ধরতে না পেরে তিনি সেই বেহালার বাড়ি মেয়ের মাথায় মেরে বসলেন। মেয়ের মাথা থেকে দর-দর করে রক্ত পড়তে লাগল। গাল বেয়ে সেই রক্ত মাটিতে পড়ল।

এই নিষ্ঠুর ব্যবহার দেখে সেই মহিলা তখন উঠে দাঁড়ালেন। চোখ দিয়ে তাঁর যেন আগুনের ফিনকি বের হতে লাগল। তিনি বললেন, বাবা! তুমি এ কাজ করলে! যাহোক, আমি তোমাকে কিছু বলব না। কিন্তু আজ থেকে তোমার লক্ষ্মী ছাড়ল।

এই কথা বলে মেয়েটার হাত ধরে মহিলাটি সেই ঘর থেকে বের হলেন। তারপর দালানের ভেতর দিয়ে উঠোনে গিয়ে নামলেন। তারপর উঠোন পার হয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেলেন।

যেই তিনি বাড়ির বাইর গেলেন, আর বৃদ্ধ ভয়ানক চিৎকার করে সেই তক্তপোষের ওপর শুয়ে পড়লেন। সেই সময় ঝাড় লণ্ঠন সব নিভে গেল। প্রতিমা, পুরোহিত, লোকজন সব অদৃশ্য হয়ে গেল। ঢাক-ঢোলের আওয়াজ সব থেমে গেল।

অন্ধকারে আমি পিতেমের কথা শুনতে পেলাম- সীতা তোমার কাছে আছে ?

আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি তাকে ধরে আছি। পিতেম আবার বলল, তবে চলো, ঘরে চলো।

পঞ্চম অধ্যায় ।। পূর্ব-বিবরণ

সকলে আবার অলক ঠাকুরুণের ঘরে গেলাম। সীতা তখন ঘুমিয়ে পড়ল। সে রাত্রিতে আর কোনো উপদ্রব হল না।

কিন্তু সে রাত্রিতে আমাদের ঘুম হল না। আমরা সকলে বসে থাকলাম। পিতেম তখন আমাকে সব কথা বলল। পিতেম বলল, ওই যে বৃদ্ধ দেখলে, উনি বাড়ির কর্তা ছিলেন। ওঁর নাম জগমোহন চৌধুরী। উনি বড়ো দুর্দান্ত লোক ছিলেন। একবার যা বলতেন, তাই করতেন, তা সে ভালোই হোক আর মন্দ হোক। পৃথিবীতে তার কেবল একটা সখ ছিল। বেহালা বাজাতে তিনি বড়ো ভালো বাসতেন। সময় নেই, অসময় নেই, সবসময় তিনি বেহালা বাজাতেন। বিশেষতঃ ঝড় বাতাস বাদলার রাত্রিতে তাঁর সখটা প্রবল হত। অলক ঠাকুরুণ তার বোন। জগমোহন রায়ের এক ছেলে ও দুই মেয়ে ছিল। ছেলে সীতার মামা, যিনি এখন পশ্চিমে কাজ করেন। বড়ো মেয়ে নাম ছিল রামমণি, যাঁর ভূতকে সীতা মাঠের মাঝখানে গাছতলায় দেখেছিল। ছোটো মেয়ের নাম ছিল তারামণি, তিনি সীতার মা। রায়চৌধুরী বড়োমানুষ লোক, কোনোকালে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতেন না। কিন্তু রামমণির এক তেজস্বী পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। তিনি বললেন যে, ঘর-জামাই হয়ে আমি কিছুতেই থাকব না। নিজের স্ত্রীকে তিনি নিজের বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু কর্তা কিছুতেই রাজি হলেন না। শ্বশুর-জামাইয়ে ঘোর বিতর্ক বেধে গেল। অবশেষে কর্তা একদিন রামমণিকে ডেকে জামাইয়ের সামনে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি একে চাও না আমাকে চাও। রামমণি বললেন, বাবা! তুমি বাবা বটে, কিন্তু স্ত্রীলোকের পতিই সব। এই উত্তর শুনে কর্তা ঘোরতর রেগে গেলেন। তিনি বললেন, বেশ! তবে এখনই আমার বাড়ি থেকে দূর হও। আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে, আজ থেকে আমি তোমার মুখ দেখব না। রামমণি শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেন। নয়-দশ বছর স্বামীর ঘর করলেন। তাঁর একটা মেয়ে হল। সে মেয়েটার ভূত সীতাকে মাঠে নিয়ে গিয়েছিল। নয়-দশ বছর পরে রামমণির স্বামী মারা গেলেন। পরিবার প্রতিপালনের জন্য তিনি একটা পয়সাও রেখে যাননি। রামমণি ভীষণ বিপদে পড়লেন।

বাবাকে বেশ কয়েকটা চিঠি লিখলেন। বাবা কোনো উত্তর দিলেন না। অবশেষে ভাবলেন, পুজোর সময় লোকের মন নরম হয়। এই পুজোর সময় বাবার পায়ে গিয়ে পড়ি, তা হলে তিনি বোধহয় ক্ষমা করবেন। পুজোর সময় মেয়েকে নিয়ে রামমণি বাবার বাড়িতে আসলেন। তারপর তোমরা এইমাত্র তা দেখলে, অষ্টমীর দিন সত্যি-সত্যিই এইরকম ঘটনা ঘটেছিল। মেয়ের হাত ধরে রামমণি চলে গেলেন। পক্ষাঘাত রাগ হয়ে কর্তা তখনই মূর্চ্ছা গেলেন। কিছু সময় পরে তুমুল ঝড় উঠল, সেই সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে লাগল। পরদিন সকলে দেখল যে, রামমণি ও তাঁর মেয়ে দু-জনেই মাঠের মাঝখানে গাছতলায় মরে পড়ে আছেন। কর্তা আরও কয়েক মাস জীবিত ছিলেন। কিন্তু সেই দিন থেকে আর তিনি কথা বলতে পারেননি, উঠে বসতেও পারেননি। তাঁর লক্ষ্মী ছেড়ে গেল। জমিদারী, টাকা-কড়ি কিরকম করে কোথায় যে উড়ে গেল, তা কেউ বলতে পারে না। ঘর-জামাই রাখার অহঙ্কারও সেই সঙ্গে দূর হল। সে জন্য সীতার মাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে আর কোনো আপত্তি থাকল না। কর্তা, রামমণি ও তাঁর মেয়ে তিনজনই এখন ভূত হয়ে আছেন। কতবার গয়াতে পিণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। পরদিন সকালে আমি ভাবলাম যে, ভিক্ষা করে খেতে হয়, সেও ভালো তবু সীতাকে নিয়ে সে বাড়িতে আর আমি থাকব না। সীতার ভাই, তোমার মামাকে আমি চিঠি লিখলাম। ভাগ্যক্রমে এই সময় তাঁর কাজ হয়েছিল। তিনি এসে আমাকে ও সীতাকে তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। কিছুদিন পরে সীতার বিয়ে হল। তারপর তুমি ও প্রভা হলে। কিছুদিন পরে তোমার বাবার মৃত্যু হল। অল্পদিন পরে দিদিমণিও তাঁর সঙ্গে স্বর্গে গেলেন। দিদিমণিকে হারিয়ে কি করে আমি যে প্রাণ ধরে রেখেছি, সেটাই আশ্চর্য। যাইহোক, তোমাদের দু-জনকে পেয়ে আমি শোক অনেকটা কাটাতে পেরেছি। মা দুর্গা তোমাদেরকে আর যত ছেলে-পিলেকে বাঁচিয়ে রাখুন।

*(আজকের ভাষায়)

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ