Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

পোড়া ছায়া ।। মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

তখনও নীলা চেয়ে থাকে। ঝিলমিল-ঝিলমিল করতে-করতে দেয়ালে ছায়াটা তখন স্পষ্ট হয়েছে। আকৃতি বোঝা যায়, মূর্তিতে যে বিকৃতি ঘটেছে তাও বোঝা যায়। ফোকাস মোটামুটি ঠিক হয়েছে ধরা চলে, সেটা চোখের না ছায়াটার তা অবশ্য বলা কঠিন এ অবস্থায়। রাতদুপুরে চোখের সামনে যখন একটা ভূত রূপ নিচ্ছে তখন ওসব হিসাব কেইবা করে।

এদিকে আধপোড়া জানলা ঘেঁষে ছায়াটা রূপ নিচ্ছিল, জানলা দিয়ে নিরাকার অবস্থায় ঘরে ঢুকে যেন আকার ধারণের চেষ্টা। ধীরে ধীরে দেয়াল বেয়ে ডাইনে সরতে থাকে। অথবা দেয়ালটাই যেন তার গা বেয়ে ওদিকে সরে যায়। ওদিকে আর একটা আধপোড়া জানলা। দুটি জানলার মাঝামাঝি জায়গায় মূর্তিটা স্থির হয়। দেয়ালে লেপ্টেই আছে ছায়ার মতো, অথচ দেয়াল ছেড়ে বেরিয়েও আছে সামনের দিকটা। জ্যান্ত মানুষ দেয়ালে পিঠ হয়ে দাঁড়ালে তার রক্তমাংসের শরীরটা যেমন থাকে। আধপোড়া জামা-কাপড়ের কালচে মারা টুকরো গা থেকে ঝুলছে। সারা গায়ে পোড়ার দাগ ঝলসানোর থাগ থাগ ফোসকা। মাথাটা হেঁট একটু ফাঁক হয়েছে। চাপ-চাপ জমাটবাঁধা কালো রক্ত।

নীলা চেয়ে থাকে। ভূত দেখলে চোখের সামনে তিন-চার হাত তফাতে সত্যি-সত্যি।  সত্যিকারের ভূত দেখলে মানুষ চেঁচায় গোঁ-গোঁ করে, মূর্ছা যায়, এসব স্রেফ মিছে কথা। ভয়-টয় যা হবার তা হয় পরে। নড়ে না, চড়ে না, শব্দ করে না, অবশ্য আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। তাই বলে অচেতন হয় না। কিন্তু চেতনা থাকলে আর ভূত দেখবে কি করে? শরীরে ইলেকট্রিক কারেন্ট চালিয়ে দিলে যেমন হয়, বেশ টের পাওয়া যায় কি ঘটছে, অথচ শরীরটা অবশ হয়ে থাকে, ভূত দেখলে ঠিক সেরকম হয়।

দুপাশে আধপোড়া জানলা, দেয়ালে নানারকম কালচে-কালচে দাগ, ছায়ামূর্তিটা যেন তার নকল করে মিশে গিয়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করছে। জন্তু-জানোয়ার যেমনই বনে-জঙ্গলে রং ছায়া ফোঁটা ফুটকি দিয়ে গা সাজিয়ে গা-ঢাকা দেবার চেষ্টা করে। ছায়াটা তাই ভূতের চেয়ে ভয়ঙ্কর।

হঠাৎ ছায়াটা মিলিয়ে যায়। অর্থাৎ নীলার তাই মনে হয়, সামনে ছিল, আচমকা দেখা গেল নেই। আসলে ভূত যারা দেখে ভূতের অন্তর্ধানটা তাদের কাছে এইরকম ঠেকে। ভূত আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলেও সেটা তারা টের পায় না। ভূত বা ভূতের আবির্ভাবের ভূতের শেষ চিহ্নটুকু মিলিয়ে গেলে আরেকটা শক লাগে, তা হল ভূত দেখার শেষ। দুটো শকের মাঝামাঝি সময়টা হল ভূত দেখা পিরিয়ড।

গলা ফাটিয়ে প্রাণপণে একটা চিৎকার করার জন্য নীলা মুখে করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, কানের কাছে পাশে আচমকা বিকট একটা আওয়াজ ওঠায় আঁতকে উঠে সে মূর্ছা গেল। এক পলকের ব্যাপার প্রফুল্লবাবুও আবিষ্ট হয়ে ছায়ামূর্তিটা দেখছিলেন, ছায়া মিলিয়ে যাবার পর তিনিও স্বভাবতই গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ করেছেন। নীলার চেঁচিয়ে ওঠার সিকি-সেকেন্ড আগে হওয়ায় তার উৎকণ্ঠ আওয়াজে চমকে নীলা মূর্ছা গেছে। নীলা আগে চেঁচালে প্রফুল্লবাবুও হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়তেন। ভূত দেখার পর এরকম হয়।

নীলার মা ঘুমোচ্ছিলেন। নীলার ছোটভাই বলাই স্বপ্ন দেখছিল বন্যায় ট্রেন আটকে আছে, গাড়ি প্রায় ডুবুডুবু, সে গাড়ির ছাদে বসে আছে। দুজনেই ঘুম ভেঙে চেঁচামেচি শুরু করে।

নিচের তলার ভাড়াটেদের ছেলে অনন্ত লন্ঠন হাতে খবর নিতে আসে। তারাও প্রফুল্ল বাবুদের সঙ্গেই আজ তিন দিন এবাড়িতে ভাড়াটে এসেছে। বাড়ির দরজা-জানালা যেমন সারানো হয়নি, ইলেকট্রিকের লাইনও ঠিক করা হয়নি। বাড়িওয়ালা কথা দিয়েছে, শিগগির হবে। পুরনো ভাঙাচোরা লন্ঠন আর মোমবাতি দিয়ে চালাতে হয়।

মাথায় জল দিতে না দিতে নীলার জ্ঞান হয়। ভূতের ভয়ে মূর্ছা যাওয়াটা ঠিক অজ্ঞান হওয়া নয়, তফাৎ আছে। মূর্ছা গেলেও একটু জ্ঞান থেকে যায়। রাতদুপুরে চুল ভেজানোর অনিচ্ছা থেকে পুরো জ্ঞান ফিরে আসে চট করে।

ভূত? দুজনেই দেখেছেন? দেয়ালে- অনন্ত চিন্তিতভাবে একটা ট্রাঙ্কে বসে। এবড়ো-খেবড়ো দাগ ধরা দেওয়ালটার দিকে চেয়ে বলে, ভূত অবশ্য চোখের ভুল। যে যেখানে ভূত দেখেছে সেই চোখে ভুল দেখেছে। ভূত মানেই ভুল দেখা।

নীলা চটে যায়। আপনি বলতে চান আমরা কিছু দেখিনি! মিছে বলছি? আমরা বলে নিজের  চোখে-

তাই বললাম আমি? অনন্ত তাড়াতাড়ি বলে, ভূত আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন। নইলে চ্যাঁচাবেন কেন? মূর্ছা যাবেন কেন? ভূত মানে কি আমি তাই বলছিলাম। মনে আছে বলা মানেই ভূত আছে বলা। যা নেই তার মানে থাকে?

নীলা ঢোক গেলে। প্রফুল্লবাবু একটু ভীত চোখে তাকান অনন্তর দিকে। ছেলেটার মাথায় ছোটো-ছোটো কদমছাঁট চুল আর এত রাত্রে চোখে রোদের ঝাঁঝ নিবারণী রঙিন কাঁচের চশমা আঁটা, এতক্ষণে যেন প্রথম নজরে পড়ে। গত তিন দিন অনেকবার অনন্তকে অবশ্য দেখেছেন, কয়েকবার ওপরে এসে ঘর গুছিয়ে বসতে এটা-ওটা সাহায্যও তাদের করেছে, আজ বিকেলে চাও খেয়েছে তাদের সঙ্গে। তবু- এখন রাতদুপুর কিনা ছায়ামূর্তি দেখা ঠিক পরে কিনা।

আমার একটা কথা বিশ্বাস করবেন?

নীলারা জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থাকে।

এসব জিনিস, মানে ভূত-টুত, অনন্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, এক রাত্রে দু'বার দেখা যায় না। কেউ কোনদিন একরাত্রে দু'বার ভূতের ছায়াটুকু কখনও দেখেনি। আপনারা আজ নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোন।

নীলা বলে, ভয় করবে।

ভয় করাটা আশ্চর্য নয়। দাঙ্গার সময় ও বাড়িতে হানা পড়েছিল, দু'জন খুন হয়েছিল, আধপোড়া বাড়িটা বহুদিন খালি পড়েছিল। দরজা-জানালা, দেয়ালে-মেঝেতে কত চিহ্ন, কত প্রমাণ আঁকা আছে। বাড়ি মেলে না, তাই তারা বাধ্য হয়ে মেরামত চুনকামের আগেই বাড়িটা দখল করেছে। অনন্ত একাই আছে একতলায়, দু'-চারদিনের মধ্যে অন্য সকলে এসে পড়বে।

অনন্ত বাকি রাতটা এ-ঘরে এসে শুতে পারে না? প্রস্তাব শোনামাত্র রাজি হয়ে অনন্ত নিচে থেকে বিছানাপত্র নিয়ে আসে। একবাক্যে এমন আগ্রহের সঙ্গে সে রাজি হয়, হুড়মুড় করে নিচে গিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে উপরে আসে, যে বেশ একটু খটকা লাগে সবার মনে। ভূত চোখের ভুল। ভূতের মানে আছে। অনন্ত তাই ভূত মানে। মানে বলেই বোধহয় নিচের তলায় একলা শুয়ে বাকি রাতটা কাটাতে তার ভয় করে। তা হোক। সেটা দোষের নয়। ভূত না থাক, ভূতের ভয় কি তাহলে থাকবে না। মানুষের?

সকালে দিনের আলোয় মনে হল বৈকি যে রাত্রে একটা বাড়াবাড়ি হয়েছিল। সম্ভবত ছাড়াই দেখেছিল, ছায়ামূর্তি নয়। ভূতের ভয়ে না হোক, দিনের বেলাও গা ছমছম করে এ বাড়িতে। যে বীভৎস কাণ্ড হয়ে গেছে বাড়িতে, এক মুহূর্ত ভুলবার উপায় নেই। কে জানে দু'জন কোন ঘরে খুন হয়েছিল, একতলায় না দোতলায়। বাড়িটা তাড়াতাড়ি মেরামত করা দরকার।

প্রফুল্লবাবু বাড়িওয়ালার কাছে দরবার করতে গেলেন। বাড়িওয়ালা গম্ভীর মুখে বললে, হবে মশায় হবে। বলেছি যখন, হবে। কি বাজার দেখেছেন তো? না মেলে সিমেন্ট-

আমরা সারিয়ে নি। ভাড়া থেকে কাটা যাবে।

হবে মশায়, হবে। আনাড়ি লোক, দশগুণ দামে মাল কিনে বাড়ি সারাবেন, ঘাড়ে তো চাপাবেন আমার। ওই তো ভাড়া দেবেন-

প্রফুল্লবাবুর চোখ কপালে উঠে যায়, ঠিক যেন ভূত দেখেছেন। সে কি মশাই! হাজার টাকা সেলামি নিলেন, আধপোড়া ভাঙা বাড়ি তার তিনশ টাকা ভাড়া, তাতে মন ওঠেনি?

বাড়িওয়ালা সবিনয় হাসল, কি বাজারটা দেখেছেন তো?

অনন্ত বলে, নালিশ ঠুকে দিলে হয় ব্যাটার নামে।

প্রফুল্লবাবু বলেন, কচু হবে। বড়োকর্তাদের খাতিরের লোক, ও ব্যাটা কি আইনের ধার ধারে?

অনন্ত ভেবেচিন্তে ক'সের চুন কিনে আনে, নিজেই নীলাদের ঘরের যে দেয়ালে রাত্রে ভূতের আবির্ভাব হয়েছিল সেটা চুনকাম করে দেয়। ফল যা হয় দেখে গা ছমছম করতে থাকে সকলের। জানলা পোড়া, তিন দিকের দেয়াল আর সিলিং-এ ধোঁয়ার দাগ, তার মধ্যে এক দিকের দেয়ালটা বিলকুল সাদাটে মেরে গেছে। চুনকামে সব দাগ ঢেকে গেলেও রক্ষা ছিল, ভেজাল, বাজে চুন তাতে নীল পড়েনি। দাগগুলি সব আবছা-আবছা হয়ে উঁকি মারছে।

অনন্ত জোর দিয়ে বলে, তাতে কি! ছায়াটা এলে চেনা যাবে।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে তারা ভূতের জন্য প্রতীক্ষা করতে বসে। কাল কেউ ঘড়ি ধরে টাইম ঠিক করে রাখেনি। তবে আন্দাজ সাড়ে বারোটার সময় ছায়ার আবির্ভাব ঘটেছিল, এগারোটার আগেই চারিদিক বেশ নিঃঝুম হয়ে আসে। সবে কিছুদিন হল দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেমেছে, পাড়াটা এখনও ধাতস্থ হয়নি। অনন্ত লন্ঠন নিভিয়ে দিতে গেলে গোল বেধে যায়। কেউ আলো নেভাতে রাজি নয়।

অনন্ত বলে, আলোতে কী ছায়া আসে?

নীলা বলে, কাজ নেই এসে।

মিছে তবে বসে থেকে লাভ কী?

না থাক লাভ, ঘর অন্ধকার করলে চলবে না। তর্ক চলতে-চলতেই আপনা থেকে তর্কের মীমাংসা দেখা দেয়। একটু-একটু করে কমতে থাকে আলো। আপনা থেকে লণ্ঠনটা নিভে আসতে থাকে।

বড়ো-বড়ো চোখ করে সকলে তাকিয়ে থাকে। সর্বাঙ্গে কয়েকবার শিহরণ বয়ে যায়। কমতে-কমতে প্রায় নিভে আসে কাচের ভেতরে পলতের শিখাটা, তারপর বার কয়েক দপ্-দপ্ করে একেবারে নিভে যায়। কাঠ হয়ে তারা বসে থাকে, এবার আর চুনকাম করা দেয়াল থেকে দৃষ্টি সরানো যায় না। বাইরের আলোছায়ার প্রতিফলনে অস্পষ্ট ছায়াছবির আঁচ পড়েছে দেয়ালে। সেগুলি স্থির পড়ে না।

নীলা বলে অস্ফুটস্বরে, আমার ভয় করছে বাবা।

প্রফুল্লবাবুর আরও সে গা ঘেঁষে বসে। নীলার মা আর ছোটো ভাইও ঘেঁষে এসে জড়াজড়ি করে বসেছে। একজন আরেকজনের হাত চেপে ধরে থাকে। চেপে-চেপে সবাই নিঃশ্বাস ফেলে। নইলে নিঃশ্বাসের শব্দ অনেক দূর ঝড়ের আওয়াজের মতো শোনায়। টাইম পিসটা টিকটিক করে চলেছে। সময় গুণে যেন এগিয়ে আনছে সেটাকে। তারপর ঘরের মধ্যে অদ্ভুত একটা চাপা অস্পষ্ট ঘরঘর ঘষড়ানো দাপড়ানোর মতো আওয়াজ শোনা যায়- অনেক দূরের মোটরগাড়ির থামা যেন এই ঘরের মধ্যে ঘটছে। আওয়াজ ঘরে- গাড়ি যেন দূরে। সেইসঙ্গে এসে গেছে দেয়ালে ছায়ার ঝিলমিল-ঝিলমিল আবির্ভাব। বেড়ে-কমে, নড়ে-চড়ে, নেচে-নেচে ছায়া রূপ নিচ্ছে। ঘরের মধ্যে আওয়াজ হয় অনেক দূরে গ্যারেজের দরজা খোলার, গাড়ি ব্যাক করিয়ে গ্যারেজে ঢোকানো। ছায়া আরও বেশি ঝিলমিল করে। ধীরে-ধীরে রূপ নিতে-নিতে সরে-সরে দেয়ালের মাঝামাঝি এনে স্থির হবার আগে একটু কেঁপে ওঠে।

না। আজ একটা নয়। শুধু দেয়ালে নয়। আরও চারটি ছায়ামূর্তির নিঃশব্দে আবির্ভাব ঘটেছে। সকলে মোহাবিষ্টের মতো চেয়ে থাকে। ছায়াগুলি এদিকে-ওদিকে ভেসে বেড়ায়। ট্রাঙ্কটা তুলে নিয়ে যায়। স্যুটকেশটা, হাতবাক্সটা, ঘড়িটা তুলে নিয়ে যায়।...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ