এক সময় পাখিরা মস্ত একটা মিটিং করে ঠিক করল তাদের মধ্যে একজনের রাজা হওয়া নিতান্ত দরকার, নয়তো আইন-কানুন কিছুই নেই, বড়োই বে-বন্দোবস্ত, যার মন যা চায়, তাই করে ঝগড়াঝাটি-বচসা-লড়াই লেগেই আছে। চড়াই, শালিখ, কাক, কোকিল, কাঠঠোকরা, হাঁড়িচাচা, মাছরাঙা, কার নাম করি ? সবাই সমান।
সভায় ঠিক হল সবাইকে আপন-আপন বুদ্ধি-বল ও দেহ-বল দুইয়েরই পরীক্ষা দিতে হবে, তারপর যিনি সবারই উপর জয়ী হবেন তাঁকেই রাজা করা হবে।
পেঁচা-রামের যেমন বা হাঁড়ি-মুখ, গোল-গোল চোখ, নাকটি চেপ্টা, গম্ভীর মূর্তি- তাঁকেই লড়াই-এর জজীয়তী করার অনুরোধ করা হল; তিনিও রাজী হয়ে ডানা ঝাপটে চলে গেলেন। ডানা ঝাপটানো হাত তালির সামিল, তাই দেখে সবাই ডানা নেড়ে সোরগোল করে সাধুবাদ দিয়ে সভা ভঙ্গ করল।
লড়াই-এর দিনটি হল চমৎকার, আকাশে মেঘ নেই, চারিদিক রোদে জমকাল, একেবারে ঝলমল করছে। পাখি-পাকালি যে যেখানে ছিল, মাঠে, ক্ষেতে, পুকুর পাড়ে, বনে জঙ্গলে, নদীর জলে, কিনারায় সবাই সত্বর এসে সভায় হাজির হয়ে গেল। সে কি একটা-আধটা ? হাজারে-হাজারে। তবে একটা কথা বলতেই হবে, সভায় তারা সবাই সভ্য-ভব্য হয়ে বসে ছিল, আঁচড়া-আঁচড়ি, ঝগড়া-ঝগড়ি করেনি।
সবারই আগে এল ভরত-পক্ষী, সে খুব ভোরে ভগবানের নাম গান গায়, কারো সাতে-পাঁচে থাকে না, তারপর এল কাক, বাকচতুর, অতঃপর একটু যেতে না যেতেই গম্ভীর-মূৰ্ত্তি লাল পোশাক-পরা মার্কিন দেশের ধাৰ্মিক পাখি, (যার ইংরেজি নাম Cardinal Bird), কিছু পরে সবুজ-পোশাক, রাঙা চেপ্টা নাক তোতা- এরাই ক’জন সকাল-সকাল ওঠে। তারপরে এল মুরগি-ছানা, বেচারি বেশি উঁচুতে উড়তে পারে না, তবুও পড়ি-মরি করে এসে উপস্থিত। সব্বাই এলো, দোয়েল, শ্যামা, কোয়েল, চোখ গেল, বউ কথা কও, খোকা হোক আর ঘুঘু। কেবল গরহাজির হাঁড়ি-মুখো পেঁচা। পাখিরা বসে-বসে হয়রান। বেলা বাড়ল, ভোরে কিছু খাওয়া হয়নি, পেট চোঁ-চোঁ করছে, কত আর মুখ বুজে বসে থাকা যায়। দেখতে-দেখতে মাঠ হল হাট, চেঁচানীতে কানে তালা ধরে গেল, কেউ কারো কথা শুনতে পায় না, তবুও বকবকানি থামে না, পেঁচাকে গাল-মন্দ করাই তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান কথা।
তখন বাধল ঝগড়া, প্রত্যেকেই রাজ-অধিকার চায়। শিকারী বাজপাখি বললে, আমার নামই যখন বাজ, দেবরাজের বজ্রের মতো আমি জবর, তখন আমিই হব রাজা। অন্যরা কিন্তু তাতে রাজি হল না, তখন সে চটে-মোটেই চলে গেল। সেই থেকে আর-পাখিদের পিছনে লেগে শত্রুতা করতে লাগল। অনেক বচসা, বহুতর বাক্য ব্যয়, আর ঝগড়ার পর সাব্যস্ত হল ভোট-রঙ্গের ব্যবস্থা। সবাই একটা জায়গায় নুড়ি পাথর জমা করতে লাগল, যার নামে বেশি নুড়ি জমবে সেই হবে রাজা। ভোট যখন গুণতি করা হল, জানতে পারা গেল হেঁড়েগলা হাঁড়ি-চাচার নামেই নুড়ি পড়েছে বেশি, তার সাজ পোশাকও ভালো, লেজটি লম্বা, চাল-চলনও রাজকীয় চালের, মাথার পাগড়িটা কালো হলেও সুশ্রী। তখন সবাই সমস্বরে তাকেই রাজা বলে ঘোষণা করল। বাস রে, সে কি বিশাল, “জয়” “জয়” ধ্বনি! এখনও কোনো জন-নেতার ভাগ্যে সেরকমটি হয় কিনা সন্দেহ। ধন্যবাদাদি দেবার পর পেঁচার অবহেলার জন্যে পক্ষী-সঙ্ঘ মত প্রচার করল, সে যদি সময় আর কথামতো এসে উপস্থিত হতো তবে কোন গোলই হতো না। এমন একটা জরুরি সভায় কথা দিয়ে না আসা শুধু যে জবরদস্তি তা না, একেবারে বড়োই অন্যায়। তাহলে তো বাজপাখির সঙ্গে ঝগড়াই হতো না, সেও পক্ষীসমাজের দুষমন শত্রু হয়ে দাঁড়াতো না, সে শিকারী, এখন সবারই তার ভয়ে-ভয়ে থাকতে হবে, সব নষ্টের মূলে ওই পেঁচাটা। ওকে শাস্তি দিতেই হবে। এ প্রস্তাব একবাক্যে সকলেই স্বীকার করে নিয়ে আপন-আপন বাসায় চলে গেল। সেই থেকে পেঁচা হলেন নিশাচর। সাধ্যি কি তিনি দিনে মুখ দেখান, তবেই তো ঠোকরাণীর চোটে আক্কেল গুড়ুম, কোথায় লুকোবেন পথই পান না।
0 মন্তব্যসমূহ