Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

চাঁদের জমি ।। নলিনী রঞ্জন মণ্ডল

 

 


পুরনো একটি ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে চলেছে ব্রজনাথ। সারাদিন পড়ার সময় কোথায়! এখন পড়ে না নিলে কাল সকালে কাগজটা বাসি হয়ে যাবে। তাই রাতে শুতে যাবার আগে যতটা শেষ করা যায়।

ওদিকে বিলাসী বিছানা ঝেড়ে, মশারি খাঁটিয়ে অপেক্ষা করছে কখন ব্রজনাথ শোবেন, তারপর বিলাসী আলো নেভাবেন, দরজা বন্ধ করবেন। কিন্তু কর্তার কাগজ পড়া শেষ আর হচ্ছে না! বসে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে বলে- মন দিয়ে কি অ্যাত পড়ছো বলতো? বুড়ো বয়সে পরীক্ষায় বসবে নাকি?

ব্রজনাথ কোনো সাড়া না দিয়ে এক মনে পড়েই চলেছে। এইবার বিলাসী উঠে এসে হঠাৎ কাগজটা কেড়ে নিয়ে বলে- ধ্যাত্তেরিকা! কাগজের পাতায় নাক গুঁজে পড়ে আছে। কত রাত হল সে খেয়াল আছে।

ব্রজনাথ সাত রাজার ধন মানিক হারিয়ে ফেলার মতো চঞ্চল হয়ে বলে- আরে আরে করো কি? জানো ওতে কি আছে?

তোমার মাথা আর আমার মুণ্ডু লেখা আছে।

আহা চটো কেন? জানো না তো ওতে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ খবর বেরিয়েছে।

কি এমন খবর যেটা তোমার রাতের যে তোমার ঘুম কেড়ে নিচ্ছে।

কাগজ দাও পড়ছি। শুনলে তুমিও খুশি হবে।

বিলাসী ঝপ করে কাগজটা ব্রজনাথের কোলে ফেলে দিয়ে বলে- গুরুত্বপূর্ণ। খবর! হুঁ! তোমাদের তো সব খবরই গুরুত্বপূর্ণ।

ব্রজনাথ কাগজটা নিয়ে বিলাসীকে শুনিয়ে পড়তে থাকে, 'চাঁদে জমি বিক্রি'। হেডলাইনটা শুনেই বিরক্তি এক নিমিষে উড়ে যায়। তাড়াতাড়ি একটা টুল টেনে ব্রজনাথের পাশে বসে বলে- তারপর পড়ে যাও।

ব্রজনাথ পড়তে থাকে- ''এতদ্বারা জানানো যাইতেছে যে, চাঁদে জমি বিক্রি হইতেছে। ইচ্ছুক ব্যক্তিগণকে সত্বর তাহাদের নিকটবর্তী কর্পোরেশন, মিউিনিসিপ্যালিটি অথবা পঞ্চায়েত অফিসে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।''

খবর শুনে বিলাসীর মুখে আর কোনো কথা নেই। কি যেন ভাবতে ভাবতে শুতে চলে যায়। ব্রজনাথ তাকে আর চটাতে চায় না। খবরের কাগজটা টেবিলে রেখে নিজেই দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ পরে বিলাসী হঠাৎ নরম স্বরে বলে ওঠে একটা কথা বলব তুমি রেগে যাবে না তো ?

কি বলবে বলে ফেলো। বেশি দেরি করলে ঘুমিয়ে পড়ব।

আমতা আমতা করে বিলাসী বলে- বলছিলাম কি চাঁদের জমি কোথায় বিক্রি হচ্ছে আমাদের একটু দেখলে হত না।

বিলাসীর কথা শুনে ব্রজনাথের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কেটে যায়। বলে- তোমার মাথার ঠিক আছে তো?

কেন?

এই গরিবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরনো সংসার ঠেলে চাঁদো জমি কেনার কথা ভাবছো, তোমার কত টাকা আছে?

তবুও একটু খোঁজ নিলে হত না।

খোঁজ নিয়ে এলে কি তোমার মরা বাবা টাকা দিয়ে যাবে? খুব ভেবেছো, এবার ঘুমাও। ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই। এই বলে ব্রজনাথ পাশ ফিরে শোয়।

বিলাসী আপন-মনে বলে চলেছে- এই পোড়ামুখো পৃথিবীতে আর ভালো লাগছে না। এখানে বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, পরিবেশ দূষণ, খাদ্য দূষণ, সব দূষণে ভরে গেছে। নতুন করে দূষিত হবার জন্য আর কিছু বাকি নেই। দুদিন পরে হয়তো জলের তলায় তলিয়ে যাব। আগেভাগে যদি কাঠা দুই জমি কিনে রাখা যেত...। এমন সাত পাঁচ ভাবনায় ডুবে যায়। ততক্ষণে ব্রজনাথ ঘুমের ঘোরে কোনো এক অজানা দেশে পাড়ি জমিয়েছে।

ডানা ঝাপটে নয়। রকেটের মতো শোঁ শোঁ করে উড়ে চলেছে ব্রজনাথ। শূন্যে থেকে মহাশূন্যে। উড়তে উড়তে ব্রজনাথ হঠাৎ চাঁদে গেঁওগাছের মতো একটা গাছে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। ধাক্কা লাগলে কি হবে- শরীরে কোনো ব্যথা লাগল না। ব্রজনাথ যেন তুলোর মতো হাল্কা। গায়ে শক্তি আছে, তবু যেন মনে হচ্ছে সারা শরীরে হাওয়া ভর্তি। ব্রজনাথ যদি মনে করে চাঁদের মাটিতে একটু দৌড়াদৌড়ি করবে, করতে পারবে না। পিংপং বলের মতো হালকা-হালকা লাফিয়ে চলতে হবে। এ পরিস্থিতিতে দুর্গতি না সুগতি গাছের গোড়ায় বসে সেটাই চিন্তা করছে।

এমন সময় সামনে এসে দাঁড়ায় যাত্রাদলের রাজপোশাক পরা একজন সুপুরুষ। কিন্তু এ কে ?

সে পুরুষটি ব্রজনাথের মনের কথা বুঝতে পেরে বলে- আমি চন্দ্রদেব।

চন্দ্রদেব! মানে চাঁদমামা! স্বয়ং চাঁদ এসেছে সামনে! ব্রজনাথ অবাক হয়ে তাড়াহুড়ো করে সষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলে- চাঁদমামা প্রণাম হই।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার বল তোমার আগমনের হেতু?

সে কি মামা, আমি পৃথিবীর মানুষ হয়ে কিভাবে চাঁদে এলাম জানতে না চেয়ে...

এসব বিষয় এখন ফাইলবন্দি। পৃথিবী থেকে এখন হামেশাই লোকজন আসছে। এ আর নতুন কি। তুমি বরং তোমার কারণটাই বল।

হঠাৎ ভাবে গদগদ হয়ে বলে- মামাগো আমার বউয়ের একটা আবদার নিয়ে এসেছি। যদি দয়া করে...

সে কি! চাঁদমামা অবাক হয়ে বলে এখানে যারা আসে পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য আসে। আর তুমি এসেছ বউয়ের আবদার পালন করতে? সামান্য একটা পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে এখানে চলে এসেছো?

খুব বিপদে পড়েছি মামা। অন্তত আমার মুখ চেয়ে...

চাঁদমামা একটু চিন্তা করে নেয়। তারপর বলে- আচ্ছা বল দেখি তার কি আবদার।

পৃথিবীতে ঢি-ঢি পড়ে গেছে- চাঁদে জমি বিক্রি হচ্ছে। আমাদের তো পয়সা নেই। আমাদের কেউ পাত্তাও দেবে না। তাই তোমাকে বলছিলাম যদি আমাদের দু-কাঠা জমির ব্যবস্থা করে দাও, তাহলে কোনোরকমে একটা টালির বেড়ার ঘর করে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে পারি।

চাঁদমামা মাথা নাড়ে।- উঁহু সে হবে না।

কেন মামা?

এখানে টালি বেড়ার কোনো অনুমোদন দেওয়া হবে না। রাজপ্রাসাদে আপত্তি নেই। বড়জোর জমিদার বাড়ি পর্যন্ত মেনে নিতে পারি। তা বলে টালির ঝুপড়ি! কিছুতেই মানা যাবে না। আমার একটা আভিজাত্য আছে তো নাকি?

চিন্তা করতে করতে ব্রজনাথ বলে- তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা... ঠিক আছে। তুমি আপাতত জমিটার ব্যবস্থা করে দাও। তারপরের ব্যবস্থা করা যাবে।

আচ্ছা শোনো... কি নাম যেন তোমার?

আমার নাম ব্রজনাথ।

চাঁদমামা চিন্তা করতে করতে বলে- হ্যাঁ ব্রজনাথ। এ নামটা চলতে পারে। কেমন বৃন্দাবন-বৃন্দাবন গন্ধ আছে। তবে একটা সমস্যা হল-

আবার কী সমস্যা মামা?

এখানে তো কাউকে কাঠা হিসেবে জমি দেওয়া হয় না।

কেন?

তাহলে তোমাদের কলকাতার মতো ঘিঞ্জি এলাকা হয়ে নোংরা পরিবেশ হবে। না-না তুমি হেক্টরের হিসাব বল। ক'হেক্টর নিতে চাও?

এবার ব্রজনাথের চোখ ধোঁয়া হয়ে যায়। গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না। ভাবে হেক্টর সে তো অনেক! কোনোরকমে ঢোক গিলে বলে- মামা, তুমি আমাকে হেক্টর হেক্টর জমি দেবে?

হ্যাঁ।

মাথা ঝাঁকিয়ে নিয়ে ব্রজনাথ বলে- মামা আমার মাথার মধ্যে কেমন ঘূর্ণিঝড় বইছে। যেন আয়লা এসে তোলপাড় করে দিয়ে যাচ্ছে। আমি ঠিক বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। যেটা ভালো হয় সেটা তুমি করে দিও।

চাঁদ মামা ব্রজনাথকে প্রকৃতিস্থ করার জন্য বলে- ঠিক আছে। আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি এখন এখানে একটু বিশ্রাম নাও। ফিরে এসে কথা বলব।

কোথায় যাবে মামা?

রাজ দরবারে। দেবরাজ খবর পাঠিয়েছেন।

দেবরাজ মানে! ইন্দ্রদেব?

হ্যাঁ।

ব্রজনাথ সোজা গিয়ে চাঁদমামার পা-দুটো জড়িয়ে ধরে। করুণা দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকিয়ে বলে- মামা!

চাঁদমামা জিজ্ঞাসা করে- কি হল, পা ধরলে কেন? ছাড়ো।

মামা আমার একটা আবদার রাখতে হবে।

আবার আবদার। তোমাদের পৃথিবীর মানুষগুলোর এই এক দোষ। একটা দিলে আরেকটা চাই, সেটা মিটলে আবার...

না-না মামা, আর বলব না। এই শেষ।

আচ্ছা বল দেখি তোমার কি আবদার?

স্বর্গ দেখতে কেমন তা আমি কোনোদিনও দেখিনি। যদি দয়া করে-

না। এ হতেই পারে না। চাঁদমামা গম্ভীর হয়।

কেন মামা?

স্বর্গে যাওয়ার অধিকার তো তোমাদের নেই।

অধিকার নেই! তবে যে আমাদের পুরোহিতরা বলে মরা মানুষের জন্য কি সব করলে তারা নাকি স্বর্গে চলে যায়?

দেখো ব্রজনাথ, তোমাদের পৃথিবীর কথা পৃথিবীতেই রাখো। আমি যা বলছি শোনো। দেব সমাজে মানুষের বিচরণ এটা কেউ মেনে নেবে না।

কিন্তু তোমাকে ঘিরে দেবতারা যখন কৈফিয়ৎ চাইবে?

ব্রজনাথ কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলে- ওসব আমি কিছু জানি না। আমাকে নিয়ে যেতেই হবে। এমনভাবে বায়না ধরল যেন মনে হয় বাচ্চা ছেলে তার মায়ের কাছে লজেন্স খাবে বায়না ধরেছে।

চাঁদমামা একটু বিরক্ত হয়ে বলে- মানুষের এই জেদ-ই মানুষকে রসাতলে পাঠাচ্ছে। কি আর বলব। নাও চলো।

আমাকে নিয়ে যাবে?

তোমরা যে জোঁকের চেয়ে এককাঠি ওপরে। না নিয়ে গেলে ছাড়বে?

হে-হে। খুশিতে ব্রজনাথ দু-পাটি দাঁতের প্রায় সবকটি বেরিয়ে পড়ে।

দাঁত দু-পাটি বন্ধ করতো? যত বায়নাসব আমার কাছে। তোমাদের তো আরো একটা মামা আছে। তার কাছে কোনো আবদার করতে পারো না?

ওরে বাবা। লাফিয়ে ওঠে ব্রজনাথ। বলে- ও মামার যা তেজ! কোনোদিন ধারে কাছে ঘেঁষতে পারি না।

খুব হয়েছে। এবার থামো। আর যা বলছি শোনো। আমি তোমাকে কিছু দেবলোকের পোষাক দেব। তুমি সেগুলো পরে নেবে। কেউ যেন কিছুতেই বুঝতে না পারে যে তুমি স্বর্গের বাসিন্দা নও। জানতে পারলে কিন্তু আমার আর মান-সম্মান থাকবে না।

সে কি কথা। মামার মান-সম্মানের কথা ভাববো না। তবে আমি কিসের ভাগ্নে?

বেশ। তবে এসো আমার সঙ্গে।

এই বলে ব্রজনাথের হাত ধরে উড়তে উড়তে কত আকাশ, মহাকাশ, মেঘ পিছনে ফেলে মুহূর্তের মধ্যে লক্ষ মাইল পেরিয়ে একটা দেশে এলো। এখানকার রাস্তা দেখলে মনে হয় থোকা থোকা পেঁজাতুলোর রাস্তা। নরম বরফের পাহাড়। হাঁটলে অনুভব হয় মাখনের সুড়সুড়ি। রাস্তার ধারে ধারে আঙ্গুর, আপেল, কাজু গাছ ভর্তি হয়ে শোভাবর্ধন করছে। পারিজাত ফুলের বাগান। বরফ আছে কিন্তু ঠাণ্ডা নেই। আবার গরমের লেশমাত্র নেই। ব্রজনাথের কি যে আনন্দ হচ্ছে।

স্বর্গে যেতে যেতে ব্রজনাথ দেখে রাস্তার ধারে একটা আঠারো-কুড়ি বছরের মেয়ে হরিণের মতো টুকটুক করে নাচছে আর আস্তে আস্তে গান গাইছে আর রং-বেরংয়ের ফুলে ফুল তুলে সাজি ভরছে। তাই দেখে ব্রজনাথ বলে- আচ্ছা মামা, ওই ছুঁড়িটা...!

চাঁদমামা ব্রজনাথের হাতে হ্যাঁচকা টান মেরে বলে- অর্বাচীন, এখানে ওই সব ভাষা চলে না। আর তাছাড়া ওটা ছুঁড়ি নয় তোমাদের ভাষায় বুড়ি।

বুড়ি! ব্রজনাথের চোখ ছানাবড়া। তাহলে উনার বয়স কত হবে?

সঠিক বলা মুশকিল।  তবে কয়েক শ'কোটি বছর।

ওরে বা-বা! ক-য়ে-ক-শো কোটি বছর, বল কি মামা?

আবার কিছুটা যাওয়ার পরে ব্রজনাথ প্রশ্ন করে- মামা এখানে হাসপাতাল কোথায়?

কেন? হাসপাতাল কি হবে?

না মানে, আপনাদের রোগ-ব্যাধি হাত পাও ভাঙতে পারে!

ওসব এখানে হয় না।

আশ্চর্য কথা! তাহলে এখানকার বাসিন্দারা বিনা কারণে একেবারেই মরে যায়। মানে স্ট্রোক?

ওরে পাগল এখানে জন্ম-মৃত্যু বলে কিছু নেই। চাঁদমামা একটু বিরক্ত হয়ে বলে- ব্রজনাথ তাড়াতাড়ি চলো, দরবারে যাওয়ার সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

ঠিক আছে মামা চলো। আর বাক্য ব্যয় না করে চাঁদনী চাঁদমামার পিছে পিছে চলতে থাকে ব্রজনাথ।

রাজ দরবার। বিশাল সুসজ্জিত হলঘর। হলের চারিদিকে সোনা ও রুপা, মণি, মুক্তা দিয়ে সাজানো। সুবাসিত আতরের গন্ধে সারাটা ঘর ম-ম করছে। রাজাসন এখনো শূন্য। দেবাসনগুলো পূর্ণ হয়েছে। সবার উপরে রাজাসন। তারপরে দেবায়ন এবং সবার নিচে স্বর্গবাসীদের আসন। এই স্বর্গবাসী আসনের মাঝখানে একটা আসনে ব্রজনাথকে বসতে বলে চাঁদমামা নিজস্ব আসনে গিয়ে বসে। সুন্দর হলঘর। ব্রজনাথের খুব ইচ্ছে করছে মাথাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরের চারদিকেটা দেখতে। কিন্তু উপায় নেই। সবাই যদি ভাবে নতুন লোক। আসনে বসে চারপাশের ব্যক্তিগুলোকে আড়চোখে দেখে নিচ্ছে। উদ্দেশ্য ওকে কেউ দেখছে কিনা! আশেপাশের সঙ্গে নিজের পোষাকের সামঞ্জস্য আছে কিনা। বেমানান হয়ে গেলে মুশকিল। কেলেংকারী কাণ্ড হবে। তাতে চাঁদমামার সম্মান নষ্ট হবে। এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখা গেল দেবরাজ ইন্দ্র আসছেন।

সিংহাসনে বসে ইন্দ্রদেব বললেন- সভাসদগণ, আজ একটা বিশেষ প্রয়োজনে এই সভার আহ্বান। চির বসন্তের দেশ আমাদের এই স্বর্গরাজ্য একটু একটু করে সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।

দেবাসন থেকে এক দেবতা বলে ওঠে- সে কি দেবরাজ! আমাদের স্বর্গেও সংকট! কি সেই সংকট?

স্বর্গে মানুষেরা থাবা বসাতে চাইছে।

ব্রজনাথের মনে চিন্তা ঢুকে যায়। ভাবে স্বর্গে মানুষের থাবা বলতে... তবে কি তার এখানে আসাটা সবাই জেনে ফেলেছে! তাই যদি হয় তাহলে তো চাঁদমামার মুশকিল হবে! ব্রজনাথের চিন্তার সাথে সাথে সভার প্রকাশ্য আলোচনাও এগিয়ে যায়।

দেবরাজ ইন্দ্র বললেন- খেয়ে পরে থাকার জন্য পৃথিবীতে মানুষের বরাদ্দে দেওয়া হয়েছে। তাতে তারা সন্তুষ্ট নয়। আবার চাঁদের দিকে হাত বাড়াচ্ছে।

উত্তেজিত হয়ে এক দেবতা বলে ওঠে- না-না দেবরাজ। এ সুযোগ কখনোই মানুষকে দেওয়া যাবে না। দেখছেন না কেমন পিল-পিল করে ওদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। একবার সুযোগ দিলে সারা ব্রহ্মাণ্ড দখল করে নেবে।

আর এক দেবতা জানতে চান- দেবরাজ, খবরটা এলো কোথা থেকে?

দেবরাজ বললেন- দেবর্ষি নারদ ঘুরতে ঘুরতে একদিন হিমালয় নেমেছিল। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশ ঘুরে একটা চাঞ্চল্য খবর নিয়ে আসে। তা হল- সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞাপন চলছে ''চাঁদে জমি বিক্রি''।

এক দেবতা বললেন- এত ঢাকঢোল পিটিয়ে চাঁদে জমি বিক্রি হচ্ছে, অথচ চন্দ্রদেব কি এইসব কিছুই জানেন না? সে নীরব কেন?

সব দেবতারা চিৎকার করে ওঠে- হ্যাঁ চাই কৈফিয়ৎ চাই।

এবার চন্দ্রদেব বললেন- হ্যাঁ, জানি। না জানার তো কিছুই নেই।

চাঁদমামার কথায় দেবরাজ বিস্মিত হয়ে যান। বলেন- তুমি জানো অথচ আমাকে কিছু বলোনি!

চন্দ্রমামা বলে- দেবরাজ, এর জন্য আপনি দায়ী।

আমি? ইন্দ্রদেব যেন পাতাল ফুঁড়ে উঠলেন।

চাঁদমামা জোর গলায় বললেন- হ্যাঁ আপনি। বছরের পর বছর ধরে তারা রকেট চালিয়ে সবার সামনে দিয়ে যাতায়াত করছে, চাঁদের মাটি নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে, কত কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছে এইসব করতে গিয়ে। তাদের আসাটাকে যদি সহ্য করতে না পারেন তাহলে আগেই বাধা দিতে পারতেন।

ব্রজনাথ চাঁদমামার কথাগুলো খুব আনন্দের সঙ্গে শুনতে শুনতে ভাবছে সেও চাঁদমামার সমর্থনে দু-চার কথা বলবে। কিন্তু তা করলে তো হবে না। জানাজানি হয়ে গেলে চাঁদমামার বদনাম হয়ে যাবে। তাই নিজের উত্তেজনাকে সংযত করে নেয়।

এদিকে দেবরাজ ইন্দ্র বিপাকে পড়েছেন। উত্তর দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু উত্তর না দিলে সবার কাছে নিজে দোষী হয়ে যাবেন। তাই বলেন- চন্দ্রদেব তুমি দেখছি মানুষের সমর্থনে কথা বলছো। তাদের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক?

মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক।

একথা শুনে দেবতারা মনে মনে খুব জোর হোঁচট খেলেন। দেবরাজ অবাক হয়ে বলেন- কি বলছো তুমি? তোমার মাথার ঠিক আছে তো?

নিশ্চয়ই। আপনি কি জানেন না- পৃথিবীর বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই আমাকে মামা বলে ডাকে।

মা-মা! সূর্যদেবকেও তো মামা বলে ডাকে।

তা ঠিক। তবে সূর্যদেবের মেজাজ ভীষণ কড়া সেজন্য তার কাছে কেউ যেতে চায় না। তাই সবাই আমাকে আপন করে নিয়েছে। আমিও পৃথিবীর মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি দেবরাজ।

ব্রজনাথ আর চুপ করে থাকতে পারল না। আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিতে দিতে বলে- চাঁদমামা জিন্দাবাদ। চাঁদমামা জিন্দাবাদ।

ব্যাস শুরু হল ঘটনার পালাবদল। চাঁদমামাকে ছেড়ে সবাই উক্তিকারী ব্রজনাথকে খুঁজতে থাকে।

দেবরাজ বলেন- কে কথা বলল? হঠাৎ ব্রজনাথের হুঁশ ফেরে। ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বসে পড়ে। কোনো দিক থেকে সাড়া না পেয়ে আবার বললেন- এখানে এসো। আবার একটু অপেক্ষা। তাতেও কোনো সাড়া না পেয়ে প্রহরীকে হুকুম দিলেন- যে কথা বলল, তাকে খুঁজে নিয়ে এসো।

ব্রজনাথ ভয় পেয়ে যায়। সামনের জনের আড়ালে মাথা নিচু করে বসে থাকে। যাতে কেউ দেখতে না পায়। ওদিক থেকে প্রহরীরা এগিয়ে আসে নির্দিষ্ট জনকে খুঁজতে থাকে। ব্রজনাথের আশেপাশে যারা বসেছিল তারাই ব্রজনাথকে দেখিয়ে দেয়। প্রহরী দু-জন দুই হাত ধরে ব্রজনাথকে ইন্দ্রদেবের কাছে নিয়ে যায়।

দেবরাজ আপাদমস্তক ভালো করে নিরীক্ষণ করে কেমন যেন সন্দেহের গন্ধ পায়। জিজ্ঞাসা করেন- কে তুমি?

আজ্ঞে আমি।

আমি মানে? আমি কে? দেবরাজ হুংকার দিয়ে বলেন।

ব্রজনাথ ভয়ে ভয়ে বলে- আজ্ঞে আমি ব্রজনাথ।

ব্রজনাথ! ব্রজনাথ আবার কে? কোথায় থাকো? আবার এক ধমক দেন।

এবার ব্রজনাথ হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলে বলে- আমি পশ্চিমবাংলায় থাকি।

য়্যাঁ! যেন দেবরাজের মাথায় বাজ পড়ে। বলেন- মানে পৃথিবীতে?

আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর। কাঁদতে কাঁদতে ব্রজনাথ জানায়।

ব্রজনাথের কথা শুনে সবার চোখে সরষে ফুল ফোটে। স্বর্গটা যেন টলমল করতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে সবার অলক্ষ্যে চুপিচুপি চাঁদমামা পিঠটান দেয়।

রাজসভাতে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। কেউ বলে- ''আতঙ্কবাদী''। কেউ বলে- নিশ্চয়ই স্বর্গ আক্রমণ করতে এসেছে। কেউ বলে- দেবরাজ আপনি ঠিকই বলেছেন, মানুষদের আর বিশ্বাস নেই। ওরা ধীরে ধীরে শক্তিধর হয়ে উঠেছে। স্বর্গ যদি বাঁচাতে চান তো এখনি আপনার বজ্র নিক্ষেপ করুন। নইলে আর রক্ষে নেই। ব্রজনাথ অসহায় হয়ে কেঁদে কেঁদে সবাইকে বোঝাতে থাকে, না-না আমি আতঙ্কবাদী নই। আমি একজন ছাপোষা মানুষ।

দেবরাজ ইন্দ্র ভেবে অস্থির। পৃথিবীর মানুষ এখানে এলো কিভাবে! আর কেনই বা এসেছে! ভাবতে ভাবতে ইন্দ্রদেবের গায়ের রক্ত জল হয়ে যাচ্ছে। মানুষেরা কখন কি করে বসে বোঝা মুশকিল। পুরাকালে অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে একটা শিক্ষা হয়েছিল। দুর্গা ছিল বলে সে যাত্রায় যুদ্ধ জয় করে কোনোরকমে রক্ষা পাওয়া গেছে। অতএব আর দেরি নয়। তখুনি ইন্দ্রদেব আদেশ দেন- একে রাজসভার বাইরে নিয়ে গিয়ে চ্যাংদোলা করে ছুঁড়ে ফেলে দাও পৃথিবীতে।

আদেশ শোনামাত্র ব্রজনাথ আঁতকে ওঠে। বলে- না-না হুজুর এভাবে আমাকে ছুঁড়ে ফেলবেন না। আমি মরে যাব। এই বলে দৌড়ে যায় দেবরাজের পা জড়িয়ে ধরতে।

এবার সত্যি সত্যি দেবরাজ ভয় পেয়ে যান। চিৎকার করে বলেন- এ যে আমার দিকে দৌড়ে আসছে। ধরো, ধরো তাড়াতাড়ি ধরো একে।

প্রহরী দুজন দৌড়ে এসে ব্রজনাথকে ধরে ফেলে। ব্রজনাথ আপ্রাণ চেষ্টা করে কাছে যাওয়ার। কিন্তু প্রহরীরা ধরে ফেলে। এবার প্রহরীদের পায়ে ধরতে যায়, বলে- ও ভাই এভাবে ছুঁড়ে ফেলো না। আমার হাত-পাগুলো গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যাবে। আমি মরে যাব।

প্রহরী হুকুম অমান্য করতে পারে না। নরম বরফের পাহাড়ের উপরে উঠে ব্রজনাথকে চ্যাংদোলা করে ধরে দোলাতে দোলাতে ঝুপ করে ফেলে দেয় পৃথিবীর উদ্দেশ্যে।

ব্রজনাথ প্রাণপণে চিৎকার করে- কে আছো আমাকে ধরো। আমি মরে গেলাম। আমাকে বাঁচাও-ও-ও-ও। ব্রজনাথ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে পৃথিবীতে নামতে থাকে।

নিশুতি রাত। জনমানুষের সাড়া শব্দ নেই। সারা পৃথিবীটা যেন অঘোরে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ করুণ আর্তনাদ। ঘুম ভেঙে যায় বিলাসীর। গভীর ঘুম ভাঙতে বিলাসী একটু বিরক্ত বোধ করে। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই বিরক্তবোধ তো দূরে থাক ঘুমের জড়তাও চটকে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে ব্রজনাথকে জোরে ধাক্কা মারে। এসব হচ্ছেটা কি! বলি আশপাশের মানুষদেরও ঘুমোতে দেবে না নাকি?

ব্রজনাথ ধড়ফড় করে উঠে বসে বিছানায়। আতঙ্কিত হয়ে বলে- অন্ধকার, অন্ধকার ঘোর অন্ধকার। আলো কই?

এ বুড়ো তো জ্বালিয়ে খেলো দেখছি। বিলাসী বেড স্যুইচটা অন করে দেয়।

আলো জ্বললে ব্রজনাথ অবাক হয়ে বলে- এ আমি কোথায় এলাম?

আঃ মরণ! নিজের ঘরবাড়ি চেনো না নাকি?

ব্রজনাথ নিজের দিকে তাকিয়ে বলে- আমার রাজ পোষাক কই?

বিলাসী এবার খেঁকিয়ে ওঠে- এই মাঝরাতে তোমায় কি ভূত ধরেছে! চলো পানা পুকুরে চুবিয়ে আনি।

ব্রজনাথ মনে মনে ভাবে বিলাসী তো গজ-গজ করবেই। কারণ ও তো আর জানে না ঘুমের মধ্যে কি তুমুল কাণ্ডটাই না ঘটে গেল।


 অলংকরণ- অমর লাহা 

 প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ