কদিন ধরেই বিষ্ণু টের পাচ্ছিল বাড়ির হাওয়াটা বদলে গিয়েছে। তাকে তো কেউ কিছু বলবে না কিন্তু অফিস ফেরত বাবার হাসিখুশি ভাবটাও বদলে গিয়েছে। পিসিকে দু-একবার চোখের জল মুছতে দেখেছে আড়ালে। মা-বাবা পিসি এক জায়গায় হলেই গম্ভীর মুখে কি সব আলোচনা করছেন, বিষ্ণু ঢুকলেই থেমে যাচ্ছেন।
বাবা বিষ্ণুর সঙ্গে স্ক্র্যাবল খেলছেন না। মা ম্যাগাজিন দেখে নানারকম নতুন রান্না করছেন না। বিষ্ণু দুপুরবেলা গল্পের বই পড়তে পড়তে একগাদা তেঁতুলের আচার খাওয়া সত্বেও পিসিমা বকছেন না- এমন সব অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে অথচ বিষ্ণু কারণটা জানতে পারছে না।
এর মধ্যে কখন বিষ্ণু সেভেন থেকে এইটে উঠে গেল কেউই টের পেল না। রেজাল্ট বেরোনোর দিন হাফ ছুটি হয়ে যাওয়ায় বিষ্ণু বাড়ির সামনের পার্কটার রেলিং-এর গায়ে ঠেস দিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখছিল হঠাৎ দেখল বাবার ফ্যাক্টরির ম্যানেজার মুকুন্দবাবু তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন। বিষ্ণু মুকুন্দবাবুকে দেখে চেঁচিয়ে ডাকল- জেঠু এদিকে এসো। আমি এখানে।
মুকুন্দবাবু রাস্তা পার হয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন- তুমি দুপুরবেলা এখানে দাঁড়িয়ে কি করছ ?
কিছু না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট খেলা দেখিছ। আজ রেজাল্ট বেরুনোর পর ছুটি হয়ে গেল। বাড়িতে ঢুকতেই ইচ্ছে করছে না। কি যে হয়েছে সবার- সারাক্ষণ সবাই মুখ গোমড়া করে আছে।
মুকুন্দবাবু বিমর্ষ মুখে বললেন, তুমি জানো না? অবশ্য তোমার জানার কথাও নয়। ব্যবসায়ে তো অনেক লোকসান হল এবার। দেনার দায়ে তোমার বাবার রাতের ঘুম গিয়েছে। চটজলদি সুরাহা না হলে এই ব্যবসাই বন্ধ করে দিতে হবে। তাতেও যে রেহাই পাওয়া যাবে তাও নয়।
বিষ্ণুর বাবার একটা পাখার মোটর তৈরির ছোটো কারখানা আছে কল্যাণীতে। সেটার রোজগার থেকে বিষ্ণুদের পরিবারসহ আরো গোটা দশেক কর্মচারীর সপরিবারে ভালোই চলে গিয়েছে এতদিন। বিষ্ণুর বাবা রজতমোহন বাগচী নদীয়ার এক সম্ভ্রান্ত বনেদি পরিবারের বংশধর। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া করিমগঞ্জে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো জগৎমহল নামে প্রাসাদটি ছাড়া ধন-দৌলত বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এদিক-ওদিক কিছুদিন চাকরি করে কল্যাণীর ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে জমি নিয়ে রজতমোহন পাখার মোটর তৈরির কারখানা খোলেন বিষ্ণুর জন্মের আগে।
ব্যবসা ভালোই চলেছে এতদিন। বাঁধা কিছু খদ্দের থাকায় জিনিস বিক্রি করা সমস্যা হয়নি। বিশ্বাসী পুরনো কর্মচারীরা রজতমোহনের সৎ পরিচালনায় এবং আন্তরিকতার গুণে সন্তুষ্ট মনেই কাজ করে এসেছে এতকাল।
রজতমোহন ব্যবসা বড়ো করে বেজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ার থেকে অনেক বেশি ভালোবাসেন বিষ্ণুর সঙ্গে স্ক্র্যাবল খেলতে। নানারকম মজার খেলায় অংশ নিতে আর স্ত্রী, বোন ও বিষ্ণু সুদ্ধ অখ্যাত অথচ সুন্দর সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে। আর সব থেকে বেশি ভালবাসেন দু-চার দিনের ছুটি পেলেই আর কেউ না হোক বিষ্ণুকে নিয়ে করিমগঞ্জে জগৎমহলে সময় কাটাতে। এই প্রাসাদটি বিষ্ণুদের অত্যন্ত গর্বের এবং আদরের।
সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হল গত দু'শ বছরে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রিয় পাত্র শ্রীযুক্ত জগতৎমোহনের বংশের কখনো একটির বেশি পুত্র সন্তান জন্মায়নি। বা জন্মালেও বেশিদিন বাঁচেনি। সেইজন্য জগৎমোহন শরিকি বিবাদে জড়িয়ে পড়েনি। সেইজন্য এক মালিকের আদর-যত্নের প্রাসাদটিতে অতীতের জাঁকজমক না থাকলেও মোটামুটি বাসযোগ্য আছে বলা যায়।
বিষ্ণু অর্থাৎ শুভ্রমোহন বাগচী শ্রী জগৎমোহনের বংশ ধারার আপাতত শেষ পুরুষ। সেই বিষ্ণু এখন মুকুন্দজেঠুর কাছে যা শুনল তাতে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড় হল।
রজতমোহন মাদ্রাজের কোনো বড়ো কোম্পানি থেকে মস্ত এক অর্ডার পেয়ে অনেক টাকা ব্যাংক লোন নিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। পুরোটা হয়ে যাবার পর তৈরি মোটরগুলিতে কি একটা দোষ ধরা পড়ে এবং সমস্ত অর্ডারটাই বাতিল হয়ে যায়।
এখন রজতমোহনের শাঁখের করাতের মতো অবস্থা। মুকুন্দবাবু বললেন, যদি আবার নতুন করে মাল তৈরি করে দেওয়া যায় তাতে সুনামও বাঁচে এবং খানিকটা টাকাও ঘরে আসে। কিন্তু এই অবস্থায় আর তো ব্যাংক লোন পাওয়া যাবে না। অথচ নতুন করে কাজে হাত দিতে অন্তত কয়েক লক্ষ টাকার প্রয়োজন। আর কিছু যদি আমরা নাও করি সে ক্ষেত্রে ব্যাংকের টাকা, কাঁচামাল কেনার টাকাও শোধ করতে হবে। তার পরিমাণও কম নয়।
বিষ্ণু ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল, তাহলে কী হবে মুকুন্দজেঠু? এর থেকে বেরোনোর কী কোনো রাস্তাই নেই?
একটাই উপায় আছে, তা হল জগৎমহল বিক্রি করে দেওয়া।
বিষ্ণুর বুকে যেন ছুরি বেঁধে যায়। সে বলে ওঠে, সেকি! বাবা পারবেন বিক্রি করতে?
মুকুন্দবাবু নিরুপায় হয়ে বলেন, এছাড়া তো আর উপায় দেখি না। যাক গে, তুমি ছেলেমানুষ, অতসব তোমার জানার দরকারই বা কি!
মা বিষ্ণুর রিপোর্টকার্ডটার উপর চোখ বুলিয়ে দেখে নিলেন কেমন করেছে। তারপর বললেন, তুমি শুনলে খুশি হবে এই গরমের ছুটি পুরোটাই আমরা জগৎমহলে কাটাব। এই রবিবারই রওনা দেব।
অন্য সময় হলে বিষ্ণু কত খুশি হত। এখন সে জানে জগৎমহল আর তাদের থাকবে না। সেইজন্যই এই শেষবারের মতো বেশি করে থাকা।
রবিবার যাওয়া হবে শুনে বিষ্ণু আগে থাকতেই তার নিজস্ব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ছিল। তার মধ্যে যাবতীয় ইনডোর গেমস, ছুরি, লম্বা নাইলনের দড়ি, এমনকি শুঁয়াপোকা রাখার জন্য ঢাকনায় ফুটো করা মুখ বন্ধ টিনের কৌটো পর্যন্ত আছে।
করিমগঞ্জ পৌঁছতে লাগল দু'ঘণ্টা। স্টেশনে গাড়ি রাখা ছিল। বিষ্ণুরা চারজন সেই গাড়ি করে জগৎমহলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
পিচ রাস্তা ছেড়ে গ্রামের রাস্তা ধরে মাইল খানেক যাওয়ার পরই বিশাল বাগান ঘেরা জগৎমহল চোখে পড়ে। এখন অবশ্য বাগানের কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে এখানে-ওখানে পাথরের বেদী, ফোয়ারা, ভাঙাচোরা মূর্তি দেখে বোঝা যায় এককালে এই বাগান কত চমৎকার ছিল।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর রাজধানী কৃষ্ণনগরের কাছেই জগৎমোহন করিমগঞ্জে শান্ত পরিবেশে প্রাসাদ তৈরি করে বসবাস করতে থাকেন।
একতলায় বিশাল বসার ঘরটাতে জগৎমোহনের একটা বিরাট তৈলচিত্র ঢুকতেই চোখে পড়ে। এছাড়া হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা যায় এমন সব সোফা, হরিণ ও বুনো মোষের শিং শুদ্ধ মাথায় আরো কতরকম ছবি, কাচের সৌখিন জিনিসপত্র দিয়ে বসার ঘরটা সাজানো তা বলে শেষ করা যায় না। এককোণে একটা বিরাট গ্র্যান্ড পিয়ানো আছে। অন্য সময়ে কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকে, শুধু বিষ্ণুরা এলে খুলে দেওয়া হয়।
একতলার সারি-সারি ঘরে তালা বন্ধই থাকে। দোতলার পাঁচ-ছয়টা ঘর বিষ্ণুরা ব্যবহার করে।
বিষ্ণুর সবথেকে প্রিয় ছাদের চিলেকোঠার ঘরটা। বাগান, বন-জঙ্গল ঘুরে তার যা কিছু ভালো লাগে মা ও পিসির চোখ এড়িয়ে চিলেকোঠার ঘরে সেইসব মজুত করে। এ কাজে তার প্রধান সঙ্গী ঠাকুরদার আমল থেকে থেকে যাওয়া জগৎমহলের বারো মাসের বাসিন্দা সর্বজনীন গোপালদা।
বিষ্ণুকে দেখেই গোপালদা দু'হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল। বিষ্ণু গোপালদার সঙ্গে ভেতরে যেতে-যেতে ভাবল, গোপালদা তো জানে না, জগৎমহল যে হাতবদল হয়ে যাচ্ছে।
দুশ্চিন্তা সত্বেও জগৎমহলে এসে সবাইকে আবার একটু স্বাভাবিক লাগছে বিষ্ণুর। বাবা বিরাট মোটা-মোটা ফাইল খুলে কাজকর্মের ফাঁকে-ফাঁকে বিষ্ণুর সঙ্গে ওয়ার্ড পাজল্, চেস্ খেলতে লাগলেন। পিসি জঙ্গলে বেশি ঘোরাঘুরি করলেই বকুনি দিচ্ছেন।
সেদিন বিষ্ণু একটা বিড়ালছানা নিয়ে বাড়িতে ঢুকেছিল। ইচ্ছে ছিল পুষবার, কিন্তু পিসির প্রচণ্ড বকুনিতে আবার বাইরে রেখে আসতে হল। বাবা ভয় পান পিসিকে। তাও মৃদু করে বলেছিলেন, করে নিতে দাও না, যা করতে চায়। আর তো মাত্র ক'টা দিন। তারপর তো কলকাতার সেই বদ্ধ জীবন।
বিষ্ণু শুনেছে কারা যেন এখানে হলিডে রিসোর্ট করবে। তাই বাগান শুদ্ধ বাড়ি কিনে নিতে চায়। ইস্ কোনো মন্ত্রবলে বিষ্ণু যদি এই টাকাটা পেত, সে বাবার ধার শোধ করে দিত। তাহলে আর জগৎমহল বিক্রি করতে হত না। কাউকে না জানিয়ে চুপি-চুপি সে লটারির টিকিটও কিনেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
দুপুরবেলা বিরাট গদি আঁটা সোফাটায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে-শুয়ে বিষ্ণু এইসব কথা ভাবছিল। বাইরে গরম হাওয়া বইছে। শুকনো পাতায় সরসর আওয়াজ উঠছে। ঘরের মধ্যে আবছা অন্ধকার। তার মধ্যে দেড়'শ দু'শ বছরের পুরনো সব জিনিস। সময় যেন থমকে দাড়িয়ে আছে এই ঘরের মধ্যে। বাবা-মা পিসি যে-যার ঘরে বিশ্রাম করছেন।
আরো ছোটবেলায় এই সোফাগুলোকে কাশি, কোশল, মগধ ইত্যাদি রাজ্য বানিয়ে বিষ্ণু যুদ্ধ যুদ্ধ খেলত। এইসব জিনিস আর তাদের থাকবে না ভেবে বিষ্ণুর চোখ জ্বালা করে ওঠে।
হঠাৎ ঝুপ করে একটা আওয়াজে তাকিয়ে দেখে জগৎমোহনের বিশাল ছবিটার সামনে কী একটা পড়ে আছে।
বিষ্ণু কাছে গিয়ে দেখে, একটা প্যাঁচার ছানা। উঁচু কড়িকাঠের কোনো ফোকর দিয়ে নিশ্চয়ই নিচে পড়ে গিয়েছে। ওপর দিকে তাকিয়ে বিষ্ণু ছানার মা-বাবাকে খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু সিলিং-এর কাছে এত নানারকম নকশা করা ফাঁক-ফোকর তার কোন ফাঁকে যে এদের বাসা বুঝতেই পারল না।
বাচ্চাটা পড়ে গিয়ে বোধহয় ডানায় চোট পেয়েছে। কাত হয়ে পড়ে আছে। আর একটু-একটু ডানা নাড়াচ্ছে। পিসি দেখলে আর রক্ষে নেই। বলবে, এখনই এটাকে বাইরে ফেলে দিয়ে আয়।
বিষ্ণু প্যাঁচাটাকে নিয়ে এক দৌড়ে চিলেকোঠার ঘরে চলে আসে। এক্ষুনি এর ডানার একটা চিকিৎসা হওয়া দরকার। মানুষের হাত-পা মচকালে তো চুন হলুদ দেওয়া হয়। পাখিরও সেই একই ব্যবস্থা কিনা গোপালদাকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে।
আশ্চর্যের ব্যাপার প্যাঁচাটা কিন্তু বিষ্ণুর হাতের মধ্যে শান্তভাবে বসে রইল। বিষ্ণু ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখে প্যাঁচাটা ধূসর সোনালী আর ছাই রঙের পালকে ঢাকা। ডানার ওপরে খুব ছোটো-ছোটো সাদা-কালো বুটি, পেটের কাছটা নরম সাদা এবং মাঝে-মাঝে ছাই রঙের পালকে ঢাকা। তার মধ্যে বড়ো-বড়ো গাঢ় খয়েরি রঙের বুটি। মাথাটা বড়ো গোল এবং শক্ত পালকে ঘেরা।
বিষ্ণু অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, পাখিটা তার দিকে বেশ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। তার বদলে বেশ শান্ত মজার একটা দৃষ্টি। যেন বিষ্ণু তার বহুকালের চেনা।
বিষ্ণুর এত চেনা-চেনা লাগছে মুখটা, কোথায় যেন দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারছে না।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তাই তো! মোটা গোঁফ লাগিয়ে, মাথার মাঝখানে সিঁথি করে, বাবরি চুল পরিয়ে দিলেই তো অবিকল জগৎমোহনের মতো দেখাবে।
বিষ্ণুর ভাবতেই হাসি পেল। আপনা থেকেই সে প্যাঁচাটার নাম দিয়ে ফেলল, জগবন্ধু।
গোপাল ও বিষ্ণুর সেবাযত্নে গোপনে চিলেকোঠার ঘরে জগবন্ধু মহানন্দে বাস করতে লাগল। গোপালদা কীসব পাতা বেটে জগবন্ধুর ডানার তলায় কয়েকদিন লাগাতেই ডানার জখম সেরে গিয়েছে।
বিষ্ণু চিলেকোঠার ঘরের জানলা বন্ধ করে ঘরটা অন্ধকার করে রাখে, জগবন্ধুর পছন্দ মতো। ঘরের দেওয়ালে একটা কুলুঙ্গিতে সারাদিন জগবন্ধু স্থির হয়ে বসে ঝিমুতে থাকে। বিষ্ণু জানালা ঘেঁসে বসে খড়খড়ি ফাঁক করে সরু হয়ে আসা আলোতে গল্পের বই পড়ে, কখনও ছবি আঁকে। কখনও খাতায় স্ট্যাম্প সাঁটে। সব কাজেই জগবন্ধুকে তার সালিশি মানা চাই।
সেদিন জগবন্ধুরই একটা পেন্সিল স্কেচ করে বিষ্ণু জগবন্ধুকে ডাকাডাকি করতে থাকে- দ্যাখো, তোমার ছবি। কেমন হয়েছে?
জগবন্ধু কষ্ট করে এক চোখ খুলে ছবিটার দিকে তাকায়। বিষ্ণু প্রতিবাদ করে, না-না, ওরকমভাবে দেখলে চলবে না। ভালো করে কাছে এসে দ্যাখো।
জগবন্ধু অগত্যা ডানার পালক ঝেড়ে, লেজটা দু'বার ঝাপটে উড়ে এসে বিষ্ণুর কাঁধে বসল। ছবিটা দেখে ঘাড় বাঁকিয়ে মুখ দিয়ে অস্পষ্ট একটা তারিফ করার আওয়াজ করে বিষ্ণুর কানে আদর করে দুটো ঠোকর দিয়ে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসে ঝিমুতে লাগল।
জগবন্ধুকে নিয়েই বিষ্ণুর বেশিরভাগ সময় কেটে যায়। জগবন্ধুর হাবভাব চোখ বুজে থাকা, খাবার খাওয়া, ঘরের এদিক থেকে ওদিক উড়ে যাওয়া সবকিছুই বিষ্ণুর চোখে অসাধারণ মনে হয়।
গোপালদাও বলে, যে যাই বলুক তোমার জগবন্ধু আসল লক্ষ্মী প্যাঁচা, মা লক্ষ্মীর বাহন। এরা যে কবে থেকে এখানে বাসা বেঁধে আছে, তা কেউ জানে না। আমি কর্তাবাবুর আমল থেকে দেখেছি বৈঠকখানা ঘরের কড়িকাঠের ফাঁকফোকরে এদের বাসা। কর্তাবাবু বলতেন, মা লক্ষ্মীর বাহন যেমনভাবে আছে থাকতে দাও।
বিষ্ণু ভালো দেখে মাছ-মাংসের টুকরো বেশি করে নিয়ে বেশ খানিকটা রেখে দেয় জগবন্ধুর জন্য। পিসি খুব খুশি। কোনোদিন বিষ্ণুকে এই পরিমাণ খাবার খেতে দেখেননি। খাবার টেবিলে বসে বাবা বললেন, আসলে স্বাস্থ্যকর খোলা জায়গায় রয়েছে, পড়াশোনার চিন্তা নেই, স্কুলের চাপ নেই, মনের আনন্দে খিদে বেড়ে যাচ্ছে।
এই আনন্দময় জায়গাটা আর বেশিদিন থাকবে না, এই ভেবে সকলের দীর্ঘশ্বাস পড়ল।
চিলেকোঠার ঘরে জগবন্ধু কখনো কুলুঙ্গি থেকে বিষ্ণুর টেবিলে উড়ে আসে। কখনও জানলার তাকে উড়ে যায়। সন্ধেবেলা চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলে চনমনে ভাবটা বেশি হয়। তখন দু-তিনবার শরীর ঝাঁকিয়ে জড়তা ঝেড়ে ফেলে। মুখের চারপাশের পালকগুলো শক্ত হয়ে খাড়া হয়ে ওঠে। সারাদিনের আধবোজা ঝিমানো চোখটা মেলে সোজাসুজি বিষ্ণুর দিকে যখন তাকায় বিষ্ণুর মনে হয় প্রবল পরাক্রান্ত শ্রীযুক্ত জগৎমোহন যেন অসীম স্নেহভরে বিষ্ণুর দিকে তাকিয়ে আছেন।
গোপালদা জগবন্ধুর উন্নতি দেখে বলল, তোমার জগবন্ধু কিন্তু এখন নিজে নিজেই শিকার করতে পারবে। দেখবে নাকি একবার ছেড়ে দিয়ে?
আগামী শনিবার বাবা-মা ও পিসির কৃষ্ণনগর যাবার কথা আছে। ঠিক হল, সেদিনই জগবন্ধুকে সন্ধেবেলা শিকার ধরবার জন্য ছাড়া হবে।
শনিবার জগৎমহলের ছাদের পশ্চিম দিকে সূর্যটা টুপ করে ডুবে যাবার সঙ্গে-সঙ্গে ফিকে অন্ধকারে চারিদিক ছেয়ে গেল। বিষ্ণুর অত্যন্ত দুশ্চিন্তা হতে লাগল, যদি জগবন্ধু ঠিকমতো রাস্তা চিনে ফিরতে না পারে। গোপালদাকে জিজ্ঞেস করে, ও গোপালদা, জগবন্ধু অন্ধকারে হারিয়ে যাবে না তো? অন্য রাতচরা পাখিদের সঙ্গে শিকার নিয়ে ঝগড়া বাঁধাবে না তো?
গোপালদা হাসে, যদি ঝগড়া লাগেই তুমি তার কী করবে? তোমার-আমার নিয়ম তো পক্ষীজগতে খাটবে না। আর জগবন্ধুকে কি তুমি চিরকাল এমন আগলে রাখবে? একদিন তো ছেড়ে দিতেই হবে।
জগবন্ধু গোপালদা আর বিষ্ণুর কথা শুনতে-শুনতে ডানায় ঠোঁট ঘষে। বিষ্ণু চিলেকোঠার জানলা খুলে দেয়। বাইরে কালো আকাশ অন্ধকারে ডুবে থাকা শস্যক্ষেত্র নিশাচর পাখিকে সাদর আহবান জানায়। জগবন্ধুর চোখটা জ্বলজ্বল করে ওঠে কিন্তু উড়ে যাবার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না।
বিষ্ণু আদর করে জগবন্ধুর গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। মনে-মনে খুশিই হয় জগবন্ধুর শিকার ধরার অনিচ্ছায়।
হঠাৎ বিষ্ণু জগবন্ধুর মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে। মুখের মজার ভালো মানুষ ভাবটা মুছে গিয়ে একটা সতর্কভাবে ফুটে উঠেছে। সমস্ত পালকগুলো শক্ত-সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। বিষ্ণু জগবন্ধুর দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে মা, বাবা ও পিসি।
এঁরা কোথা থেকে এল! ওঁদের তো কৃষ্ণনগরে যাবার কথা। গোপালদা একপাশে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু'পক্ষই হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। বেশিক্ষণ অবশ্য এই অবস্থাটা থাকল না। পিসি শুরু করলেন, তাই ভাবি থেকে-থেকে এত ছাদে কেন যাওয়া? শুঁয়োপোকা, কুকুর, বেড়াল ছেড়ে তুমি এবার বুনো প্যাঁচার পেছনে পড়েছ? গোপালদা তুমিও খুব অন্যায় করেছ। ও ছেলেমানুষ, যা খুশি তাই বলল আর তুমিও ওই তালে নাচলে?
গোপালদা মিনমিন করে বলে, এটা বুনো প্যাঁচা নয় দিদিমণি।
না বুনো নয়। প্যাঁচা কখনো পোষ মানে? দেখো, বিষ্ণু একেবারে ওর মুখের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি ঠুকরে দেয়!
পিসি একেবারে শিউরে ওঠে সেই সম্ভাবনায়। বাবা গোপালদাকে বলেন, যাও, তুমি গিয়ে প্যাঁচাটাকে বাড়ির বাইরে রেখে এসো বা উড়িয়ে দাও।
আর বিষ্ণু তুমি মা বা পিসিকে না জিজ্ঞেস করে আর ছাদে উঠবে না।
বিষ্ণু কোনোরকমে চোখের জল আটকে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। সে রাতে কিছু খেল না পর্যন্ত। মা বললেন, থাক একরাত্রি না খেলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না। ওই প্যাঁচাকে খাওয়াতে গিয়ে তো কতদিন আধপেটা খেয়েছে।
অভিমানে বিষ্ণুর বুকটা ব্যাথা করতে থাকে। জগবন্ধু কি সাধারণ প্যাঁচা! মা-বাবা তার একটা কথাও শুনলেন না! বাইরের অন্ধকারে জগবন্ধুকে খোঁজার ব্যার্থ চেষ্টা করে বিষ্ণু মনের দুঃখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে জানতেও পারেনি। রাত কত বিষ্ণু বলতে পারবে না। ঘুমটা ভেঙে গেল জানলায় ঠকঠক আওয়াজে। তাকিয়েই খুশিতে বুকটা ছলাৎ করে উঠল। জগবন্ধু ঠোঁট দিয়ে জানলার পাল্লায় আওয়াজ করছে। বিষ্ণু কাচের শার্শি খুলে দিতেই জগবন্ধু উড়ে এসে তার কাঁধে বসে বিষ্ণুর জামার কলার ধরে টানতে লাগল।
আর কেউ বুঝবে কিনা বিষ্ণু জানে না, কিন্তু জগবন্ধু যেভাবে তাকে ঘাড় নেড়ে সিঁড়ির দিকটা দেখাচ্ছে তার একটাই মানে হয়।
বিষ্ণু জগবন্ধুর নির্দেশমতো বৈঠকখানা ঘরের সামনে জগৎমোহনের ছবির সামনে এসে দাঁড়াল। ঠিক যেখানে ও প্রথমদিন জগবন্ধুকে পড়ে থাকতে দেখেছিল।
কোথা থেকে একফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে। আধো অন্ধকার ঘরে প্রাচীন সব আসবাবপত্রের মাঝে দাঁড়িয়ে বিষ্ণুর মনে হল, সে যেন জগৎমোহনের আমলে পৌঁছে গিয়েছে।
জগবন্ধুও কাঁধের ওপর থেকে উড়ে গিয়ে জগৎমোহনের বিশাল ছবিটার কারুকার্য করা কাঠের ফ্রেমের ওপরে বসেছে।
বিষ্ণু এক পা, এক পা করে এগিয়ে ছবিটার তলায় গিয়ে দাঁড়াল। জগবন্ধু কি তাকে কিছু বলতে চাইছে! আবছা আলোয় ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। জগবন্ধু উড়ে গিয়ে ছবির পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল। বোধহয় নতুন বাসার খোঁজ পেয়েছে।
বিষ্ণু জগবন্ধুর কাছে শেষ বিদায় নেবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। জগবন্ধুর আর পাত্তা নেই। কতক্ষণ বিষ্ণু অপেক্ষা করেছে খেয়াল নেই। চমক ভাঙল, হঠাৎ চাঁদের জোৎস্না যেন জমাট মোহর হয়ে ঠনঠন আওয়াজে ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে জগৎমোহনের বিশাল ছবিটার কাঠের ফ্রেম বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল বিষ্ণুর পায়ের কাছে।
পনেরোবার আওয়াজের পর চারিদিক শুনশান হয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেলে পর বিষ্ণু মাটির উপর বসে পড়ে এক-এক করে গুনে দেখল পনেরোটি কি সব ছাপ মারা পুরনো আমলের ভারি ভারি মোহর। মোহর তো নয়, চাঁদের সোনালী আলো যেন জমাট বেঁধে বন্দী হয়ে আছে বিষ্ণুর হাতের মধ্যে।
এটা জগবন্ধুরই কারসাজি কিনা বুঝবার জন্য বিষ্ণু এদিক-ওদিক প্রাণপণে তাকে খুঁজবার চেষ্টা করল। কিন্তু আর তাকে দেখতে পেল না।
চলে আসবার আগে বিষ্ণু জগৎমোহনের বিশাল তৈলচিত্রটার দিকে তাকিয়ে দেখল। তার মনে হল জগৎমহল রক্ষার ব্যবস্থা করে শ্রীযুক্ত জগৎমোহনের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে কিংবা হয়তো তারই মনের ভুল।
অলংকরণ- রাহুল মজুমদার
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪২০
0 মন্তব্যসমূহ