আমরা তখন সবে কলকাতায় এসেছি, ইস্কুলে পড়তে। কলকাতার ইস্কুল যে মফঃস্বলের চাইতে ভালো সে বিশ্বাসে নয়। কারণ, ইস্কুল সব জায়গাতেই সমান। সবই এক ছাঁচে ঢালা। আমরা এসেছিলুম ম্যালেরিয়ার হাত থেকে উদ্ধার পেতে।
আমরা আসবার মাস তিনেক পরে হঠাৎ সারদা দাদা এসে আমাদের অতিথি হলেন। সারদা দাদা কি হিসেবে আমাদের দাদা হতেন, তা আমি জানিনে। তিনি আমাদের জ্ঞাতি নন, কুটুম্বও নন, গ্রাম সম্বন্ধে ভাইও নন। তাঁর বাড়ি আমাদের গ্রামে নয়। দেশ তাঁর যেখানেই হোক, সেখানে তাঁর বাড়ি ছিল না। তিনি সংসারে ভেসে বেড়াতেন। আমাদের অঞ্চলে সেকালে উইয়ের ঢিবির মতো দেদার জমিদারবাবু ছিলেন, আর তাদের সঙ্গে তাঁর একটা-না-একটা সম্পর্ক ছিল। সে সম্পর্কে যে কি, ও কেউ জানত না, কিন্তু এর-ওর বাড়িতে অতিথি হয়েই তিনি জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন। আর সব জায়গাতেই তিনি আদরযত্ন পেতেন। তিনি একে ব্রাহ্মণ, তার উপর কথাবার্তায় ও ব্যবহারে ছিলেন ভদ্রলোক। তাই তিনি দাদা হোন, মামা হোন, দূর সম্পর্কের শালা হোন, ভগ্নীপতি হোন সকলেই তাঁকে অতিথি করতে প্রস্তুত ছিলেন। টাকা তিনি কারও কাছে চাইতেন না। তার নাকি কাশীতে একটি বিধবা আত্মীয়া ছিলেন, আবশ্যক হলে তাঁর কাছ থেকেই টাকা পেতেন। সে মহিলাটির নাম সুখদা। সুখদার নাকি ঢের টাকা ছিল, সন্তানাদি কিছু ছিল না। তাই সুখদার আপনার লোক বলে তাঁর মানও ছিল।
সারদা দাদার আগমনে আমরা ছেলেরা খুব খুশি হলুম, যদিও ইতিপূর্বে তাঁকে কখনও দেখিনি, তাঁর নামও শুনিনি। আমাদের মনে হল তার সঙ্গে কথাবার্তা করে বাঁচব। কলকাতায় আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজনও ছিল না, কোনো বন্ধুবান্ধবও ছিল না, যার সঙ্গে দুটো কথা কয়ে সময় কাটানো যায়। আর ইস্কুলে সহপাঠীদের সঙ্গে গল্প করেও চমৎকৃত হতুম না, কারণ সেকালে কলকাতাই ছেলেদের কথাবার্তার রস কলকাতার দুধের মতই ছিল নেহাৎ জলো।
সারদা দাদা রোজ সন্ধ্যাবেলায় আমাদের দেদার গল্প বলতেন, জীবনে যা তিনি দেখেছেন, তারই গল্প। মা অবশ্য আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, সারদা যা বলে তার ষোল আনাই মিথ্যা। কিন্তু আমরা তাতে ভড়কাইনি।
কেন না, মিথ্যা কথা আদালতে চলে না, কিন্তু গল্পে দিবারাত্র চলে। সে যাই হোক, সারদা দাদা বেশির ভাগ ভূতের গল্প বলতেন। তবে সে কথা মার কাছে ফাঁস করিনি। শুনিছি বাবার একজন প্রিয় তামাকওয়ালা দাদার কাছে নিত্য ভূতের গল্প বলত, ফলে দাদা নাকি রাত্তিরে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যেতে ভয় পেতেন। তারপর বাবা তার প্রিয় তামাকওয়ালার আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ করে দিলেন। পাছে মা সারদা দাদাকে বিদায় করে দেন, এই ভয়ে মার কাছে এ গল্পসাহিত্যের আর পুনরাবৃত্তি করতুম না। তাছাড়া, কলকাতা শহরে তো ভূতের ভয় নাই। রাস্তায় আলো, পথের ধারে শুধু বাড়ি, জঙ্গল নেই। ভূতেরা আলোকে ভয় করে ও মানুষের চেঁচামেচিকে। কলকাতায় আলো যতটা না থাকে, হল্লা দেদার আছে। আর হট্টগোলের মধ্যে ভূত আসে না। সারদা দাদা শুধু সেই সব ভূতের গল্প বলতেন, যাদের তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। আমি তাকে একদিন জিজ্ঞেস করলুম, আপনি তো শুধু পাড়াগেঁয়ে ভূতের গল্প করেন, আপনি কি কখনও সাহেব ভূত দেখেননি ?
সারদা দাদা উত্তর করলেন, দেখব কোত্থেকে ? সাহেবরা তো এদেশে আর মরে না। না মরলে তারা ভূত হবে কী করে ? দেখো, ট্রেনে এত বড়ো-বড়ো কলিসান হয়, যাতে হাজার হাজার দেশি লোক মরে, কিন্তু তাতে কোনো সাহেব মরেছে, এমন কথা কি কখনও শুনেছ ?
তবে এত গোরস্থানে কারা পোঁতা আছে ?
সব ফিরিঙ্গি। তবে দু-চারজন সাহেব যে মরে না এমন কথা বলছিনে। কিন্তু যারা মরে ভূত হয়, তাদের আমরা দেখা পাইনে।
কেন ?
এদেশে তারা গাছেও থাকে না, হেঁটেও বেড়ায় না। তারা ট্রেনের ফাষ্টক্লাশ গাড়িতে চড়ে বেড়ায় আর ফিরিঙ্গি ভূতরা সেকেন্ডক্লাশ গাড়িতে। তবে একবার একজনের দেখা পেয়েছিলুম। আর তার হাতে যে সাজা-শাস্তি পেয়েছিলুম, তা আর বলবার কথা নয়। আজও মনে হলে কান্না পায়।
আমরা সেই সাহেব ভূতের গল্প শুনতে চাই।
সারদা দাদা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলছেন, আচ্ছা, বলছি শোনো। কিন্তু এ গল্প যেন আর কাউকে বলো না।
কেন ?
কী জানি, আবার যদি মানহানির মামলায় পড়ে যাই। মরা লোকেরাও হানাহানি করলে জরিমানা হয়, জেলও হয়। আবার জেল খাটতে আমার ইচ্ছে নেই। এরপর সারদা দাদা বললেন, আমি একবার কলকাতা থেকে কাশী যাচ্ছিলুম। হাওড়া স্টেশনে যখন পৌঁছলুম তখন গাড়ি ছাড়ে-ছাড়ে। তাই একটা খালি ফার্স্টক্লাশ গাড়িতে উঠে পড়লুম এই মনে করে যে, পরের স্টেশনে নেমে থার্ডক্লাশে ঢুকব। গাড়ি তো ছাড়ল, অমনি বাথরুম থেকে একটি সাহেব বেরিয়ে এল। ঝাড়া সাড়ে ছ' ফুট লম্বা, মুখ রক্তবর্ণ, চোখ গুগলির মতো। আর তার সর্বাঙ্গে বেজায় মদের গন্ধ বেরুচ্ছে, আর সে বিলেতী মদের। সে ঘরে ঢুকেই বললে, কালা আদমী, নিচু যাও। আমার তখন ভয়ে নাড়ি ছেড়ে গিয়েছে, আমি কাঁপতে-কাঁপতে বললুম, হুজুর, আভি বিস্তরে নীচু যায়ে গা ? দুসরা স্টেশনমে উতার যায়েঙ্গে! তিনি বললেন, ও নেহি হাো শকতা! তোমরা কাপড় বহুত ময়লা, আর তোমরা দেহ সে বহুত বদ বু। গোসলখানাসে যাকে তোমরা কাপড়া উতার কে গোসল করো । আর হুঁই বৈঠ রহো । হামচলা যানেসে তুম গোসলখানাসে নিকলিয়ো। হাম যো বোলতা আভি করো, জানতা হাম রেলকো বড়াসাহেব হ্যায় ?
আমি প্রাণের দায়ে হুজুর যা বললেন তাই করলুম। অর্থাৎ স্নানের ঘরে গিয়ে বিবস্ত্র হয়ে সেই শীতের রাত্তিতে স্নান করলুম। অমনি একটা দমকা হাওয়া এসে আমার কাপড়-চোপড় উড়িয়ে কোথায় নিয়ে গেল! আমি বিবস্ত্র হয়ে ভিজে গায়ে গোসলখানাতেই বসে রইলুম। আর সাহেব তার কামরায় হুটোপাটি করতে লাগলেন ও মধ্যে-মধ্যে চিৎকার করে আমার প্রতি শূয়োর, গাধা, উলুক প্রভৃতি প্রিয় সম্ভাষণ করতে লাগলেন। আমি নীরবে সব গালিগালাজ হজম করলুম।
প্রায় ঘণ্টাখানেক এইভাবে কেটে গেল। আমি ভিজে গায়ে হি-হি করে কাঁপছি। সর্বাঙ্গে এক টুকরো কাপড় নেই, আর পাশের ঘরে বড়োসাহেব মদ খাচ্ছেন আর লাফাচ্ছেন।
মাঝখানে গাড়ি হঠাৎ মিনিট খানেকের জন্যে থামল। ক্লিক করে একটা আওয়াজ হল, ছিটকিনি খোলবার আওয়াজ। তারপর গাড়ি ফের চলতে লাগল। পাশের ঘরে টু শব্দ নেই, তাই আমি স্নানের ঘর থেকে বেরিয়ে সে ঘরে যাবার চেষ্টা করলুম। ও সর্বনাশ! বড়ো সাহেব স্নানের ঘরে দুয়োরে ছিটকিনি টেনে বন্ধ করে দিয়েছেন। আমি সেই অন্ধকূপের ভিতর আটকে থাকলুম। আধ ঘণ্টা পরে গাড়ি বর্ধমানে এসে পৌঁছল। আর আমি বাথরুমের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যা থাকে কপালে ভেবে, কুলি-কুলি করে চিৎকার করতে লাগলুম। তারপর একজন কুলি এসে ছিটকিনি খুলে আলো জ্বেলে আমাকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখে ভূত ভেবে ভয়ে পালিয়ে গেল। শেষটা স্টেশনমাস্টারবাবু এসে ভূত নেহি হ্যায়, চোর হ্যায়, বলাতে কুলিরা পাশের ঘরে ঢুকে আমাকে মারতে-মারতে আধমরা করে প্ল্যাটফরমের উপর টেনে নিয়ে গেল।
স্টেশনবাবু বললেন, শীগগির ওকে একটা কাপড় পড়িয়ে দে। একজন আমাকে একটা ছেঁড়া কাপড় দিলে। সেই কাপড় পরে আমি স্টেশনবাবুকে সব কথা বললুম। তিনি বললেন যে, রেলের বড়োসাহেব এখন সিমলায়, তাছাড়া এ ট্রেনে কোনো সাহেব আসেওনি, কোথাও নেমে যায়নি। এখন বুঝলুম যার, হাতে আমি নাস্তানাবুদ হয়েছি সে সাহেব নয়, সাহেবের ভূত। তারপর স্টেশনবাবু আমাকে থানায় পাঠিয়ে দিলেন। সেখানেও প্রথম এক পত্তন মার হল, তারপর দারোগাবাবুর জেরা।
তার পরদিনই দারোগাবাবু আমাকে আদালতে হাজির করলেন। হাকিমবাবু ছিলেন অতিশয় ভদ্রলোক, উপরন্তু উচ্চশিক্ষিত। তিনি গাডিতে ভূতের উপদ্রবের কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করলেন, কিন্তু ভগবানের দোহাই ও ভূতের দোহাই ইংরেজের আদালতে চলে না। অগত্যা তিনি আমাকে এক মাসের মেয়াদে জেল দিলেন। আমার অপরাধ বিনা টিকিটে বিনাবসনে ফার্স্টক্লাশ গাডিতে গাঁজা খেয়ে ভ্রমণ!
এখন তোমরা ফার্স্টক্লাশ ভূতের কথা তো শুনলে ? এদের তুলনায় পাড়াগেঁয়ে ভূতরা ঢের বেশি সভ্য।
0 মন্তব্যসমূহ