প্রতাপগড়ের জমিদার ঈশ্বর নরেন্দ্র প্রতাপ চৌধুরীর জমিদারি আর আগের মতো নেই
বললেই চলে। কিন্তু একটা বিশাল প্রাসাদ সমান বাড়ি আছে। দেড়শো বিঘে জমি আছে। গোটা
দশেক খাল-বিল আছে। আর আছে কিছু আমবাগান আর বাঁশের ঝাড়।
এসবের মালিক এখন জমিদারবাবুর একমাত্র ছেলে বিকাশ চৌধুরী। বিকাশবাবুকে প্রতাপগড়ের সবাই ছোটোবাবু বলে ডাকে। বিকাশবাবুরা কেউ বর্তমানে প্রতাপগড়ে থাকেন না। থাকেন কলকাতায়। মাঝে মধ্যে ছুটি কাটাতে বা বিশ্রাম নিতে আসেন এখানে। জমিদারি সম্পত্তি থেকে যা আয় হয়, নায়েবমশাই কলকাতায় গিয়ে দিয়ে আসেন ছোটোবাবুকে।
এই ছোটোবাবুর একমাত্র মেয়ের বিয়ে আজ। ছোটোবাবু হঠাৎ ঠিক করলেন মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান প্রতাপগড়ে হবে। সবাইকে দেখিয়ে দেবেন পুরনো জমিদারির নমুনা। আর তাছাড়া শুভ অনুষ্ঠান পূর্বপুরুষের ভিটেতে হওয়া মঙ্গলের।
শ'খানেক লোক কাজে লেগে গেল এক মাস আগে থেকে। পুরনো বাড়ি সারাই করে নতুন রঙ হল। ঘরের সমস্ত দামি আসবাবপত্র ঝাড়পোঁছ পালিশ। ভাঙাচোরা রাস্তায় নতুন মাটি-ইঁট-পিচ পড়ল।
এক সপ্তাহ আগে থেকে সারা বাড়িতে আলো ঝলমল করে উঠল। এক কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে আলো লাগানো হল। শোনা যাচ্ছে এত আলো নাকি ছোটোবাবু চন্দননগর থেকে এনেছেন। প্রতাপগড় জুড়ে এখন শুধু একটাই আলোচনা ছোটোবাবুর মেয়ের বিয়ে। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে, হাজার লোকের আয়োজন। মেনুতেও আছে নানান চমক।
বিয়ের আগের রাত থেকেই সানাই বেজেছে জমিদার বাড়িতে। প্রতাপগড়ে উৎসবের মেজাজ। অতিথিরা আসতে শুরু করেছে। বিয়ের দিন সকাল থেকেই ছোটোবাবু রান্নার তদারকিতে ব্যস্ত। নিজে খাদ্য রসিক মানুষ, খাওয়াতেও ভালোবাসেন। লখ্নৌ থেকে বাবুর্চি এনেছেন বিরিয়ানির জন্য। বাংলাদেশ থেকে আনিয়েছেন ইলিশ, আন্দামান থেকে গলদা চিংড়ি, কলকাতার কে. সি. দাশের রসগোল্লা, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, চন্দননগরের জলভরা সন্দেশ, কৃষ্ণনগরে সরভাজা, রেওয়াজি খাসি সব মজুত করেছেন ভাঁড়ার ঘরে।
অনেকদিন বাদে জমিদার বাড়িতে পেটপুরে খাওয়া-দাওয়া হবে ভেবেছিল প্রতাপগড়ের মানুষ। কিন্তু কোথায় কি! ছোটোবাবু হাজার-হাজার লোক নেমন্তন্ন করে আনছেন শহর থেকে। কিন্তু গ্রামের মানুষদের কথা ভাবেননি। ওরা ছোটোবাবুর জমিতে সারাবছর খাটে, পুকুরে জাল দেয়, বাগানের ফল পাড়ে। আজ এই আনন্দের দিনে ছোটোবাবু ওদেরই ভুলে গেলেন।
বিখ্যাত ক্যাটারার এসেছে জমিদার বাড়িতে। কেউ পেঁয়াজ-রসুন ছাড়াচ্ছে, কেউ তরকারি কুটছে। ছোটোবাবু মাঝেমধ্যে এসে দেখে যাচ্ছেন। রান্নার প্রধান ঠাকুর বলেছে, আপনি নিশ্চিন্তে মেয়ের বিয়ে দিন, এদিকে চিন্তা করবেন না। আমাদের উপর ছেড়ে দিন।
খাবারের গন্ধে ম-ম করছে চারপাশ। বিপত্তিটা ঘটল এই সময়ে। প্রতাপগড়ের পশ্চিম দিকে যে বিশাল জঙ্গলটা আছে তার পাশেই কবরখানা। ওই জঙ্গলেই ভূতেদের বাস। দিনেরবেলাতেও ভয়ে সেখানে কেউ যায় না। ভূতেরা নিশ্চিন্তে সংসার পেতেছে সেখানে। সব থেকে বৃদ্ধ ভূত নিবারণ হঠাৎ বলে উঠল, তোরা কেউ কিছু মেখেছিস? একটা সুন্দর গন্ধ পাচ্ছি যেন! সঙ্গে-সঙ্গে গোকুল ভূত বলে উঠল, ঠিক বলেছ দাদু, গন্ধটা আমিও অনেকক্ষণ ধরে পাচ্ছিলুম।
গন্ধ এবার সবার নাকেই আসছে। বৃদ্ধ নিবারণ বলল, এই বলাই, রহিম, বাচ্চু তোরা একটু এদিক-ওদিক দেখতো, গন্ধটা কিসের আর কোথা থেকে আসছে।
দাদুর নির্দেশে বাচ্চাভূতগুলো এ'ডাল-ও'ডাল করে খুঁজতে-খুঁজতে একেবারে প্রতাপগড়ের ধারে এসে সব দেখে-শুনে জঙ্গলে ফিরে এসে বলল, ও দাদু, এ যে বিরিয়ানির গন্ধ গো। প্রতাপগড়ের জমিদার বাড়িতে বিয়ে। কি সুন্দর-সুন্দর রান্না হচ্ছে, কত মানুষ, হাঁড়িহাঁড়ি বিরিয়ানি হচ্ছে দেখে এলুম।
এইসব শুনে নেপু আর ইসমাইল বলল, ও দাদু, আমরাও বিরিয়ানি খাব।
দাদু বলল, ওগুলো বিয়ে বাড়ির লোকের জন্য। আমরা খেয়ে নিলে হয়!
না দাদু, ওখানে অনেক বিরিয়ানি হচ্ছে। ওদের কম পড়বে না। আমরা মাত্র একটাই হাঁড়ি আনব। আর সবাই মিলে খাব। নিবারণের নাতনি তো একপ্রকার জেদ করেই বসল। বিরিয়ানি তার চাই-ই চাই।
বৃদ্ধ নিবারণ আর কি করে, বাধ্য হয়ে বলে, তোরা যা খুশি কর গে যা।
এই কথা বলা মাত্রই সব পিলপিল করে দৌড়ে এল বিরিয়ানির হাঁড়ি আনতে।
প্যান্ডেল থেকে একটু দূরে কাঠের উনুনে বসানো ছিল হাঁড়িগুলো। রাধুনিরা ব্যস্ত যে যার কাজে। ফাঁক তাল বুঝে বিরিয়ানির হাঁড়ি নিয়ে ভুতেরা তাদের ডেরায় হাজির। সব ভূতেরা মিলে একটু করে চাখতে গিয়েই হাঁড়ি ফাঁকা। এত সুন্দর বিরিয়ানি এইটুকুতে ওদের পেট আর মন কিছুই ভরল না। ওরা আবার যেতে চাইল আর একটা হাঁড়ি আনতে। বৃদ্ধ নিবারণ বলে, আর যাস না তোরা। জমিদারবাবু অসুবিধায় পড়বেন।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। ভূতেরা নিমিষে তুলে নিয়ে এল আর একটা হাঁড়ি। এরপর বিরিয়ানির নেশায় পড়ে গেল সব ভূত। একটার পর একটা হাঁড়ি এনেই চলেছে। পাঁচ-পাঁচটা হাঁড়ি শেষ। একটাও হাঁড়ি আর বাকি নেই।
জমিদার বাড়িতে সবাই আনন্দে মশগুল। ছোটোবাবুর জামাই হয়েছে খাসা। যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনই মোটা মাইনের চাকরি। থাকে বিদেশে। ধীরে-ধীরে রাত বাড়ছে। এবার এক-এক করে খাওয়ার ঘরে খেতে এল। ক্যাটারারের লোক সেজেগুজে তৈরি। তাদের সবার ড্রেস একইরকম। সবার মাথায় পাকড়ি। একজন খাবার ঘরে গোলাপ জল স্প্রে করে গেল। নুন-লেবু-মেনুকার্ড পড়ল পাতে। এক-এক করে রকমারি আইটেম আসছে।
এমন সময় ক্যাটারারের লোক বিরিয়ানি আনতে গিয়ে দেখে বিরিয়ানির হাঁড়িগুলোই নেই। গেল কোথায় বিরিয়ানির পাঁচ-পাঁচটা হাঁড়ি। তবে কি কেউ চুরি করে নিয়ে গেল! কিন্তু কে-ই বা চুরি করবে! কার এত বড়ো সাহস হবে যে, জমিদার বাড়ির হাঁড়ি চুরি করে নিয়ে যাবে!
লোকজনদের তো মাথায় হাত। কি করবে তারা এখন।
এক সময় খবরটা ছোটোবাবুর কানে পৌঁছে গেল। ছোটোবাবু তো রাগে-দুঃখে অপমানিত হওয়ার ভয়ে দিশাহারা হয়ে উঠলেন। এমন কি হবে! এখন পয়সা থাকলেও এত কাণ্ড করে এই সময়ের মধ্যে বিরিয়ানি তৈরি করাও যাবে না। বিয়ে বাড়িতে হুলুস্থূলু কাণ্ড।
ছোটোবাবু ঘরের দেওয়ালে বাবার ছবির সামনে ক্যাটারারের লোকগুলোকে ধরে এনেছে, গুলি করে মারবে বলে। অন্যরা ছোটোবাবুকে শান্ত করতে থাকে। কেউ ছোটোবাবুকে পাখার বাতাস করছে তো কেউ জল দিচ্ছে। কিন্তু ছোটোবাবু পাগলের মতো করছে।
বৃদ্ধ নিবারণ বিরিয়ানি খেয়ে সুখনিদ্রা দিচ্ছিল। হঠাৎ কিসের যেন চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙে গেল। একটু কান পেতে শুনতেই বুঝতে পারলেন, এ জমিদার বাড়িরই আওয়াজ। বৃদ্ধ নিবারণ ভাবল, নিজেই গিয়েই একটু দেখে আসি কি ব্যাপার।
জমিদার বাড়ির পরিস্থিতি দেখে বৃদ্ধ নিবারণ অবাক। বিরিয়ানির সবকটা হাঁড়ি নাকি চুরি হয়ে গিয়েছে। বৃদ্ধ নিবারণ জানতোই না যে তার দলের ভূতেরা সব হাঁড়িই নিয়ে গেছে। অতিথিদের পাতে বিরিয়ানির বদলে এটা-ওটা দিয়ে বসিয়ে রেখেছে ক্যাটারারের দল। কেউ-কেউ বলছে, কোথায় তোমাদের লখ্নৌয়ের বাবুর্চির বিরিয়ানি? কোথায় এবার নিয়ে এসো?ছোটোবাবুর পাগলের মতো অবস্থা।
এসব দেখে নিবারণ ভূতের খুব কষ্ট হল। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। একসময় প্রতাপগড়ের জমিদার প্রতাপ চৌধুরীর বাবার খাস কাজের লোক ছিল সে। তাই ছোটোবাবুর কষ্ট তার সহ্য হচ্ছে না। নিবারণ মনে-মনে বারবার নিজেকেই দায়ী করতে লাগল। এখনই কিছু একটা করা দরকার, না হলে ছোটোবাবু খুব অসম্মানিত হবেন। এটা নিবারণ হতে দেবে না।
জঙ্গলে ফিরে এসে সবাইকে জানালো ঘটনাটা। ছোটোবাবুর সম্মান বাঁচানো তাদের কর্তব্য। নিবারণের বন্ধু ইব্রাহিমের কথা মনে পড়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে তাকে ডেকে নিয়ে এল ভূতেরা।
নিবারণ বলল, ইব্রাহিম, তুমি তো বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলার খাস রান্নার লোক ছিলে। তোমার হাতের বিরিয়ানি আজও আমার মুখে লেগে আছে। তুমিই এখন পারো ছোটোবাবুর সম্মান বাঁচাতে।
ইব্রাহিম সামান্য হেসে বলল, জোগাড় দিলে চেষ্টা করতে পারি।
কয়েক মিনিটের মধ্যে জোগাড় রেডি। ইব্রাহিমও অনেকদিন বাদে মনের সুখে হাত পাকিয়ে রান্না করল এক হাঁড়ি বিরিয়ানি। বৃদ্ধ নিবারণ কিছুটা স্বস্তি পেল। নাতিদের বলল, যা এটাকে ঠিক জায়গায় রেখে আয় এক্ষুনি, যেন কোনো গোল না বাধে।
ছোটোবাবুকে একজন এসে বলে গেল, একটা বিরিয়ানির হাঁড়ি পাওয়া গেছে। এটা শুনে ছোটোবাবু আরো রেগে গেলেন। একটা হাঁড়িতে কি হবে এত লোক!
ছোটোবাবু, আপাতত এই ব্যাচটা সামাল দিই। তারপর না হয় আবার রান্না বসাতে হবে।
তোমাদের যা মনে হয় করো। আমার মাথা কাজ করছে না।
মজার ঘটনাটা ঘটলো এরপর। বিরিয়ানি এত ভালো হয়েছে যে, কেউ আর অল্প খাচ্ছে না। সবাই বলছে, এত সুন্দর বিরিয়ানি তারা আগে কোথাও খায়নি। আর সব বাদ দিয়ে বিরিয়ানিই খাচ্ছে সবাই। আর লখ্নৌয়ের বাবুর্চি নিজে খুব গর্ববোধ করছে।
সবথেকে অবাক কাণ্ড এই যে, যতই হাঁড়ি থেকে বিরিয়ানি তুলে নেওয়া হচ্ছে, ততই হাঁড়ি আবার ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। এ তো আজব হাঁড়ি রে বাবা! ক্যাটারারদের যে লোকটা বিরিয়ানি তুলছিল, তার এসব দেখে ভিরমি খাওয়ার অবস্থা।
নিমন্ত্রিতরা সব খুশি মনে পেট ভরে বিরিয়ানি খাচ্ছে দেখে ছোটোবাবু সব ভুলে অতিথিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এক থেকে, দুই থেকে দশ-বারো ব্যাচ বিরিয়ানি খাইয়েও একহাঁড়ি বিরিয়ানি এখনও আছে। অন্যান্য খাবারও অনেক বেঁচে গেছে। কে খাবে এত! ডাক পড়ল প্রতাপগড়ের গরিব খেটে খাওয়া মানুষগুলোর।
কিন্তু প্রতাপগড়ের মানুষরা একজোট হয়ে জানিয়ে দিল, তারা কেউ যাবে না ছোটোবাবুর মেয়ের বিয়েতে খেতে। কারণ, ছোটোবাবু তো আগে তাদের নিমন্ত্রণ করেননি। এখন খাবার বেঁচেছে বলে তাই খেতে ডাকছেন।
এই কথা শুনে ছোটোবাবু ছুটে এলেন। প্রজাদের ঘরে-ঘরে কাতর হয়ে বললেন, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। ভগবান আজ আমায় উচিত শিক্ষা দিয়েছেন। আমার বড়ো ভুল হয়ে গেছে। আমাকে তোমরা ক্ষমা করো। এখন আমি বুঝেছি তোমরাই আমার কাছের মানুষ। তোমাদের ছাড়া কোনো শুভ কাজ সম্পন্ন হতে পারে না। চলো তোমরা চলো।
স্বয়ং ছোটোবাবু এসে কাকুতি-মিনতি করছেন, তারা আর না গিয়ে পারে!
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জানুয়ারি ২০২০
0 মন্তব্যসমূহ