ইষ্টিশানের কাছে, রেললাইনের পাশে ঘর। দাদা থাকে আর বোন থাকে। দাদা চাকরি করতে শহরে যায়, বোন ঘর দেখে। একদিন বোনের কটা সৌখিন কেনাকাটা আছে। বললে, আমার একদিন শহরে যেতে হবে দাদা। ছুটির দিন তো দোকান বন্ধ, হপ্তার ভেতরেই একদিন যাবো।
দাদা বলে, বেশ যাস। তাড়াতাড়ি ফিরব একদিন, সন্ধের ঝোঁকে যাস। দোর গোড়ায় ট্রেন। ফিরতি ভীড়ও তেমন থাকে না। কিনেকেটে ফিরতেই বা কতক্ষণ লাগবে। আটটাতেই তো দোকান বন্ধ হয়ে যায়।
যেদিন যাবে স্থির, দাদা তাকে দিল দুখানা কড়কড়ে পাঁচশ টাকার নোট। দেখ হবে তো!
বাব্বা! হবে আবার না। বেন তার হাত ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল টাকাটা.
লোকাল ট্রেন। উঠে দেখে কামরায় আলো কম, যাত্রীও কম। ছাড়া ছাড়া বসে। ফাঁকা কামরা। জানলার পাশে ঘেঁষে সে বসল গিয়ে ফাঁকা বেঞ্চে। সামনের মুখোমুখি বেঞ্চটা জুড়ে এক ফিরিঙ্গি বুড়ি ঘুমোচ্ছে একভাবে। এধারের একানি সিটটাতে হকার সামান নীচে নামিয়ে চুপচাপ বসে, বেচবার লোক নেই কামরাতে। পরের স্টেশন আসতেই ঝাঁকা উঠিয়ে সে নেমে গেল।
ট্রেন চলছে। যাত্রী নেই, কথা কইবারও লোক নেই। সামনের বেঞ্চে বুড়ি ঘুমোচ্ছে। ট্রেনের একঘেঁয়ে আওজে তারও ঢুল লেগে গেল কখন। ঢুলতে ঢুলতে চলেছে ট্রেনের চলার তালে তালে।
হঠাৎ চটকা ভেঙে গেল। চোখ খুলতেই মনে হয় অতগুনো টাকা রয়েছে সঙ্গে, ইস! ঘুমিয়ে পড়ে ঠিক করেনি। সামনের বেঞ্চের বুড়ি অবশ্য অকাতরে ঘুমোচ্ছে। তবু, দরকার কি! চেখ রগড়ে টানটান হয়ে সে পেছনে ঠেস দিয়ে বসল। তারপর কি ভেবে টাকাটা ঠিক জায়গায় আছে কিনা দেখতে ব্যাগটা খুলল হাতে তুলে।
এ কী! টাকা কি হল! ব্যাগ খুলে ধরে পাট পাট করে খোঁজে বারবার। কী হল! বুড়ি ছাড়া তো লোক নেই এদিকে। তবে কি-
বুড়ির দিকে চেয়ে দেখে রীতিমতো আওয়াজ হচ্ছে ঘুমের। কিন্তু-
দোনোমোনো করে, তারপর নিঃসাড়ে ঝঁকে হাত বাড়িয়ে আলতো করে বুড়ির পাশে রাখা হাত ব্যাগটা খুলে ফেলল-
চমক লেগে যায়। এ কী! পাঁচশ টাকার কড়কড়ে নোট একটা, দু আঙুলে ঘষা দিতে তলায় আরো একটা। ও বাবা! কী সাংঘাতিক হাত সাফাই। কী করবে এখন!
দেখে মনে হয় অবস্থা ভালো নয়, বয়সও হয়েছে। রেল পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবে! তারপরই ভাবে কী দরকার বাবা। অকারণে ঝামেলা। তারচেয়ে-
সন্তর্পনে তুলে নিল সে টাকাটা।
ব্যাগে ঢুকিয়ে, বুড়ির ব্যাগ বন্ধ করে যেখানকারটা সেখানে রেখে উদাসীন মুখে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে।
পরের স্টশনেই হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসল বুড়ি। জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখেই ব্যাগটা তুলে নিয়েই নেমে গেল দ্রুত পায়ে।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। যাক, নিশ্চিন্ত। কেনাকাটা সেরে, রংচঙে দোকান-ব্যাগ ঝুলিয়ে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে ফের সেই ট্রেন। ফিরতে রাতই হয়ে গেল একটু। হোক গে। মনটা খুশি হয়ে আছে। নামতেই দেখে দাদা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে এগিয়ে এসেছে। তার হাতে রংচঙে দোকান-ব্যাগটা দেখে বলে, বাঃ! কিন্তু কীভাবে ম্যানেজ করলি ?
তার মানে ?
মানে, কিনেছিস তো বোধহয় সবই। কিন্তু কিনলি কীভাবে ?
কেন ? কিনতেই তো গেলুম। বাব্বা যা দাম! কিন্তু কুলিয়েও গেল।
সে তো দেখছি। কিন্তু কিনলি কীভাবে ? আমি তো তোর হাঁড়ি মুখ সামলাতে স্টেশন অবধি চলে এলুম।
হাঁড়ি মুখ কেন ?
তুই বেরিয়ে যাবার পরই হঠাৎ দেখি নোট দুটো টেবিলেই পড়ে আছে।
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা ।। এপ্রিল ২০১৩
অলংকরণ- অমর লাহা
0 মন্তব্যসমূহ